মাঝরাতে আমেরিকার আইওয়া স্টেটের ছোট্ট শহর সিডার রেডিস-এ বিমান থামল। প্রায় দশ বছর পর এই দেশে আসছি। চারদিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু দশ বছরে কি পরিবর্তন হলো তা দেখার তেমন আগ্রহ বোধ করছি না। আমেরিকা কতটুকু বদলালো তা দিয়ে আমার কি? আমার দেশে দশ বছরে কিছুই হয় নি এই আমার চিন্তা। চারদিকে তাকানোর উদ্দেশ্য–দেখা কেউ আমাকে নিতে এলো কি না। না এলে খুব চিন্তার কথা। অচেনা শহরে ট্যাক্সি ভাড়া করে হোটেলে উঠতে হবে। তাও দুপুর রাতে। পকেটে একশ’ ডলারের একটা নোট, তা দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া এবং হোটেল ভাড়া হবে কি-না কে জানে। কাউকে দেখতে পেলাম না। এটাই স্বাভাবিক। আজ উইক এন্ডের রাত। আমেরিকানরা হৈচৈ করে ছুটি কাটাচ্ছে। কার দায় পড়েছে মাঝরাতে এয়ারপোর্টে এসে বসে থাকার?
আমি পুরো পরিস্থিতি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার জন্যে ভেন্ডিং মেশিন থেকে গরম কফি কিনলাম। সিগারেট ধরাব কি না বুঝতে পারছি না। সিগারেট খাওয়া এখানে ড্রাগ খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। সব জায়গায় নো স্মোকিং। সিগারেট ধরালেও সমস্যা–চারদিক এত ঝকঝক-তকতকে ছাই ফেলব কোথায়? যেখানে সেখানে ছাই ফেলার এবং ওয়াক থু বলে থুথু ফেলার যে মজা তা এরা কোনোদিন জানবে না।
কিছু মনে করবে না। তুমি কি বাংলাদেশের লেখক ড. হুমায়ুন? আমি চমকে তাকালাম।
ইন্ডিয়ান-আমেরিকানদের মতো দেখতে বিশাল দেহী এক যুবক দাঁড়িয়ে। মাথায় টেক্সানদের হ্যাট। মুখ হাসি হাসি। আমি হাসি মুখে মাথা নাড়লাম।
আমার নাম লেম। আমি আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনের সঙ্গে জড়িত। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।
ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে আমি তোমার উইক এন্ড মাটি করেছি।
তা করেছ। আমি অনেকক্ষণ থেকেই তোমাকে লক্ষ করছি। তুমি যে লেখক বুঝতে পারি নি। তোমার চেহারা লেখকদের মতো নয়।
লেখকদের চেহারা কেমন থাকে বলো তো?
লেম হাসতে হাসতে বলল, তাও তো জানি না। তোমার লাগেজ কোথায়?
আমি আমার স্যুটকেস দেখিয়ে দিলাম। লেম বিস্ময় মাখা গলায় বলল, হলি কাউ! এটা স্যুটকেস?
হ্যাঁ।
আমি ছোট গাড়ি নিয়ে এসেছি। এই জিনিস গাড়িতে ঢুকবে না। এটা বরং এখানে থাক। ভোরে বড় গাড়ি করে নিয়ে যাব।
বেশ তো, তাই করো।
আমরা যাব আইওয়া সিটিতে। তোমাকে তোমার আস্তানায় নামিয়ে দিয়ে চলে যাব। ভোরবেলা আবর এসে অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেব।
ধন্যবাদ।
তুমি কি বাংলায় লেখালেখি করো?
হ্যাঁ।
বাংলায় লেখালেখি করেন এমন লেখক এই প্রোগ্রামে খুব বেশি আসেননি। একজন শুধু এসেছিলেন, দু’বার এসেছিলেন।
তাঁর নাম কি?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তুমি কি তাকে চেনো?
খানিকটা চিনি তবে তার লেখার সঙ্গে পরিচিত।
আমরা গাড়িতে উঠলাম। লেম বলল, দয়া করে সিট বেল্ট বেঁধে নাও। আইওয়া রাজ্যে সিট বেল্ট না বাঁধলে সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারের জরিমানা।
আমি সিট বেল্ট বাঁধলাম। গাড়ি ঝড়ের গতিতে উড়ে চলল। বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান হাইওয়ে। এই হাইওয়েতে গুলতেকিন এবং আমার বড় মেয়ে নোভাকে নিয়ে কত না ঘুরা ঘুরেছি। এক শীতের রাতে ক্রমাগত গাড়ি চালানোর রেকর্ড করব ভেবে সারারাত গাড়ি চালিয়েছিলাম। এক মুহূর্তের জন্যেও না থেমে ফার্গো থেকে গিয়েছিলাম মন্টানার বনভূমিতে।
আমি পুরানো আমেরিকা দেখার চেষ্টা করছি। কুয়াশা পড়েছে। তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। গাছপালা বা পাহাড়-পর্বত চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে প্রেইরির সমভূমি।
লেম!
ইয়েস প্লিজ।
তোমাদের এটা কি সমভূমি? ফ্ল্যাট ল্যান্ড?
না। এটাকে বলে রোলিং কান্ট্রি। ঢেউ-এর মতো উঁচু নিচু। আইওয়া হচ্ছে পৃথিবীর সেরা কর্ন প্রডিউসিং এলাকা।
লেম গাড়ির রেডিও চালু করে দিল। ভুলেই গিয়েছিলাম রাতের বেলা হাইওয়েতে গাড়ি নিয়ে নামলে এরা অবশ্যই রেডিও চালু রাখে। যাতে চলন্ত গাড়িতে ঘুমিয়ে না পড়ে। চোখ এবং কান থাকে সজাগ। রেডিওতে একটি মেয়ে অত্যন্তু মিষ্টি গলায় গাইছে–
I will love you on Tuesday.
মেয়েটি তার প্রেমিককে শুধু মঙ্গলবারে ভালোবাসতে চায় কেন? সপ্তাহের অন্যদিনগুলি কি দোষ করল? এই ভাবতে ভাবতে ঝিমুনী ধরে গেল।
হুমায়ুন। নামো আমরা এসে গেছি।
চোখ কচলাতে কচলাতে গাড়ি থেকে নামলাম। আধো অন্ধকার, আধো ছায়ায় মেপল এবং বার্চ গাছে ঢাকা বিশাল লাল ইটের দোতলা দালানের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হুহু করে বইছে শীতের হাওয়া। বিকট শব্দে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। আমেরিকান ঝি ঝি পোকা বড় বেশি শব্দ করে। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, এইখানে থাকব?
হুঁ।
আমি একা?
হ্যাঁ।
সে কি-আমাকে তো বলা হয়েছিল মে ফ্লাওয়ারের কথা।
তুমি দেরি করে এসেছ তাই মে ফ্লাওয়ার তোমাকে দেয়া যায় নি। আমরা তোমার জন্যে এই বাড়ি ভাড়া করেছি। বাড়ি তোমার পছন্দ হবে। দেড়শ’ বছরের পুরানো বাড়ি। এক সময় স্কুল হাউস ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা পড়ত। তুমি শুনে খুশি হবে এই বাড়ি হিস্টোরিকাল প্রিজার্ভেশন পুরস্কার পেয়েছে। আমরা অনেক খুঁজে পেতে এই বাড়ি বের করেছি।
আমি শুকনো গলায় বললাম, থ্যাংকস। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে আমার কাঁপুনি ধরে গেল। এই নির্জনপুরীতে একা থাকব কি করে? ভয়েই তো মারা যাব। ভূত প্রেত আছে কি-না কে জানে। পুরানো বাড়ি ভূতদের খুব প্রিয় হয় বলে জানি।
হুমায়ুন বাড়ি পছন্দ হয়েছে তো?
হয়েছে। কিন্তু কথা হলো–ভূত-প্রেত নেই তো?
লেম কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, থাকতেও পারে। পুরানো বাড়ি বুঝতেই পারছ। গুড নাইট, শ্লিপ টাইট।।
স্লিপ টাইট মানে? ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। ঘুমুতে গেলাম ঘরের সব ক’টা বাতি জ্বালিয়ে। বলাই বাহুল্য ঘুম এলো না। আমার তিন কন্যা এবং কন্যাদের মা’র জন্য বড় মন কেমন করতে লাগল। কেন বোকার মতো ওদের ছেড়ে এসেছি। কি আছে এখানে? একা একা এই ভুতুড়ে বাড়িতে নিশিযাপনের কোনো মানে হয়?
শেষ রাতের দিকে মনে হলো কাঠের মেঝেতে পা টেনে টেনে কে যেন হাঁটছে। কাঁচ কাঁচ শব্দ হচ্ছে–কেউ বোধ হয় বাথরুমের দরজা খুলে বের হচ্ছে সেখান থেকে। পরিস্কার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পেলাম। আমি ভয়ে আধমরা হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম–Who is there? ইংরেজিতে বললাম কারণ আমেরিকান ভূত বাংলা নাও বুঝতে পারে। প্রশ্ন করে আৱো ভয় পেয়ে গেলাম কারণ ভূত যদি সত্যি সত্যি প্রশ্নের উত্তর দেয় তাহলে হার্টফেল করে মরে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। মেঝেতে হেঁটে আসার শব্দ। আমার শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি নিশ্চিত এখন কেউ কোমল গলায় বলবে–হে বিদেশী আমি এখানে বড়ই নিঃসঙ্গ। আমি খানিকক্ষণ তোমার সঙ্গে এই জীবনের হতাশা ও বেদনা নিয়ে কথা বলতে চাই। তুমি কি দয়া করে বাতি নিভিয়ে দেবে?
তেমন কিছু হলো না। পদশব্দ দরজার কাছে থেমে গেল। ঘুমানোর চেষ্টা করা বৃথা। আমি হাত বাড়িয়ে কবিতার বই টেনে নিলাম। কবিতা পড়ে যদি ভূতের ভয় কাটানো যায়। হিথ্রো বিমানবন্দরে এক গাদা বই কিনেছি। তার মধ্যে পণ্ডিত নেহেরুর প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্ট আছেন। যার ‘Stopping by woods on a snowing evening’ কবিতার প্রতি ভারতবাসীর দৃষ্টি তিনিই প্রথম আকৃষ্ট করেন।
কবিতা আমার প্রিয় বিষয় নয় তবু এই ভয়ংকর রাতে কবিতাই
আমাকে উদ্ধার করল। পড়তে পড়তে ভূতের ভয় কেটে
গেল।
The woods are lovely dark and deep
But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.