মহাভারতের মহত্তম দ্বিধা
পূর্বের মতো একই ধরনেরই একটি প্রশ্ন মহাভারতে আছে, একলব্য উপাখ্যানে। আপাত দৃষ্টিতে এক চণ্ডাল লোকচক্ষুর অগোচরে মাটি দিয়ে দ্রোণাচার্যের মূর্তি গড়ে তাঁকে গুরুর আসনে বসিয়ে তাঁর সামনে ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করছিল। কাজটা ধর্ম-বিরুদ্ধ নয়, চণ্ডাল শিকার করে, ধনুর্বিদ্যায় জ্ঞান তার পক্ষে প্রয়োজনীয়। সে চণ্ডাল বলে ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য তাকে শিষ্য-রূপে স্বীকার করবেন না, কাজেই বেচারার গোপন উচ্চাকাঙ্ক্ষা (উচ্চমানের ধনুর্বিদ্যা আয়ত্ত করা) সফল করতে গেলে এ ছাড়া পথও ছিল না। বেশ চলছিল, যতক্ষণ না সে তার বিদ্যায় এমন উঁচুমানের শিক্ষার পরিচয় দিয়ে ফেলল যা অর্জুনেরও সাধ্যাতীত। অর্জুন দ্রোণাচার্যের কাছে নালিশ করতে দ্রোণাচার্য দেখলেন অর্জুনের মনস্কামনা পূর্ণ না হলে তাঁর নিজের প্রতিপক্ষ দ্রুপদের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়া দুঃসাধ্য হবে, অতৃপ্ত অর্জুন তাঁর তৃপ্তিবিধান নাও করতে পারেন। তা ছাড়া একলব্য চণ্ডাল বৈ ত নয়, অতএব দ্রোণাচার্য ফতোয়া দিলেন, ‘গুরুদক্ষিণা দাও ওই আঙুল ক’টি— যা দিয়ে ধনুকে জ্যা রোপণ করে, শরনিক্ষেপ করা যায়।’ হাসিমুখেই দিলেন একলব্য এবং মহাকাব্য এর পর তাঁকে ভুলে গেল। এই উপাখ্যানও সহজ নয়, বহুমুখী এর সমস্যা: চণ্ডাল নিম্নবর্গের মানুষ, তার প্রাণের আপেক্ষিক মূল্য সামান্য; অর্জুন ধনুর্বিদ্যায় উন্নতমান লাভ করবেন, তাঁর কাছে দ্রোণের এই মর্মে প্রতিশ্রুতি ছিল। কার্যকালে তাঁকে দিয়ে ইষ্টসিদ্ধি করতে হবে, অতএব তাঁকে বিমুখ করা চলবে না, এ পর্যন্ত বেশ সহজ। কিন্তু ঘটনা তো এইটুকুই নয়। একটি অন্ত্যজ বালক নিভৃতে অন্যথা-দুষ্প্রাপ্য দ্রোণাচার্যকে গুরুর আসনে বসিয়ে সুদীর্ঘকাল নিষ্ঠা সহকারে এমন একাগ্র সাধনা করেছে যে তার কৃতির সামনে অর্জুন পরাঙ্মুখ, তাকে আপন প্রতিদ্বন্দ্বী বলে শঙ্কিত হন। এই দীর্ঘ দুরূহ গোপন সাধনার এমন অসামান্য সিদ্ধি, যেখানে দ্রোণাচার্যের কল্পিত পদতলে বসে সে অর্জন করেছে, সেখানে এই নৈপুণ্য, সাধনা, নিষ্ঠা, একান্ত আত্মবিলোপের কী মর্যাদা দিলেন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণগুরু, ক্ষত্রিয় শিষ্য? গুরু দেখলেন শিষ্যের ক্ষোভ, শিষ্য দেখলেন দুর্জয় প্রতিদ্বন্দ্বী। অতএব, তার মর্মস্থানে আঘাত করে তার সাধনায় পূর্ণচ্ছেদ টানার জন্যে ওই ধনুঃসাধক আঙুল কটিই দক্ষিণা দিতে হল। আপাতস্তরে এ ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না। কিন্তু কী নিষ্ঠুর, কী অমানবিক এ গুরুদক্ষিণা! এমন দক্ষিণা গুরুই বা নেন কেমন করে এবং তাঁর প্রিয়শিষ্য তাঁকে নিবারণ না করে সমর্থনই বা করে কী করে? কেমন করে একটি চণ্ডাল বালকের স্বপ্ন-সাধ-সাধনা-দীর্ঘ তপস্যা পদদলিত করে অনায়াসে বিজয়ীর মতো সেখান থেকে নিষ্ক্রমণ করেন গুরু-শিষ্য, যেখানে রক্তাপ্লুত অঙ্গুলিহীন করতল মৃণ্ময় গুরুমূর্তির দিকে উদ্যত রেখে হতোদ্যম ব্যর্থ তরুণটি সমস্ত ব্যাপারটা উপলব্ধি করবার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে পাঠকও, এবং স্বস্তি পায় না, কারণ একটি মানুষের এমন সুন্দর এক স্বপ্নসাধনা, হোক না সে চণ্ডালের, সে তো দ্রোণকেই গুরু মেনেছিল! সেই দ্রোণের এক কৃতী শিষ্যের মনস্কামনা পূরণ করতে অজ্ঞাতপরিচয় একটি নিষাদের সুকঠোর সাধনার কঠিন সিদ্ধির মুহূর্তে তার ওপর নেমে এল আত্মবিলোপের নির্দেশ।
আবার দেখছি, কোনও ঘটনায় সাড়া দিতে গেলে প্রথমে তার বহুমুখী ব্যাপ্তি ও সম্ভাবনার মুখোমুখি আসতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে এর সম্ভাব্য বিকল্প কী। না পেলেও আত্যন্তিক অর্থে ঘটনাটি যে হীন, মর্মান্তিক এবং আচার্য শিষ্য উভয়েরই সম্বন্ধে ঘৃণা জন্মিয়ে দেয়, এ প্রতিক্রিয়া পাঠক এড়াতে পারেন না। ফলে তার প্রতিক্রিয়া দ্বিধাবিভক্ত, কখনও বা বহুধা বিভক্ত হয়, তাই একটা অসন্তোষ একটা নৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য থেকেই যায়।
মহাকাব্যের প্রথমাংশেই বেশ কিছু কাহিনি পাঠক শ্রোতাকে চিন্তায় ফেলে। শান্তনুর ছেলে দেবব্রত, গঙ্গার সঙ্গে তাঁর প্রথম বিবাহের সন্তান। জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে সিংহাসনে তাঁরই অগ্রাধিকার। শান্তনু প্রেমে পড়লেন সত্যবতীর সঙ্গে, কিন্তু সত্যবতীর শর্ত তাঁর আপন সন্তান সিংহাসনে অধিকার পাবে। শান্তনু এত বড় অন্যায্যতাটাতে রাজি হতে পারছিলেন না, কিন্তু অচরিতার্থ প্রেমের তাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন। বুঝতে পেরে দেবব্রত সত্যবতীকে আশ্বাস দিলেন সিংহাসনের অধিকার তিনি ত্যাগ করবেন। সত্যবতীর সংশয় ঘোচে না, যদি দেবব্রতর পুত্রের এ ঔদার্য না থাকে? তখন দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি ব্রহ্মচর্য আচরণ করবেন। এ কঠোর ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্যে তাঁর নাম হল ভীষ্ম। দেবব্রত চিরকুমার থাকার উদার অঙ্গীকার তাঁকে মর্যাদা দিয়েছে, মহনীয় করে তুলেছে তাঁর পিতৃভক্তিকে। কিন্তু সম্পর্কটি তো একতরফা নয়। এ অঙ্গীকার গ্রহণ করার অর্থ: শান্তনু যে সুখের জন্য এত বড় ত্যাগ গ্রহণ করলেন, সেই গ্রহণের দ্বারাই তিনি আপন আত্মজকে প্রেমের ও দাম্পত্যের সুখ থেকে বঞ্চিত করলেন; বঞ্চিত করলেন বংশধর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে বংশের ধারা সৃষ্টি করার সমাজে চিরস্বীকৃত অধিকার থেকে। শান্তনু সত্যবতীর বিবাহ হল;[১] কুরু পাণ্ডব, মহাভারতের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজবংশ এঁদেরই সন্ততি। চিত্রাঙ্গদ, বিচিত্রবীর্য দুই ছেলে। চিত্রাঙ্গদ দুরাচার, গন্ধর্বের সঙ্গে যুদ্ধ তিনি নিহত হন। বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দিতে ভীষ্ম নিয়ে এলেন কাশীরাজের কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে, কিন্তু সন্তান জন্মের পূর্বেই তাঁরও মৃত্যু হল।
পরাশরের ঔরসে সত্যবতীর এক পুত্র ছিল ব্যাস। ঘটনাচক্রে শান্তনুর দুই পুত্রেরই মৃত্যু হলে সিংহাসনে পুত্রের দাবি কায়েম করার জন্যে পূর্বে সত্যবতী একটি নিষ্ঠুর উপায় অবলম্বন করেছিলেন: দেবব্রতকে চিরকুমার ব্রত নিতে হয়েছিল। এত করেও কিন্তু তাঁর বা তাঁর স্বামীর কোনও পুত্র বা পুত্রদেরও কোনও সন্ততিরই সিংহাসনে অধিকার হল না। প্রথমে সত্যবতী যখন শান্তনু ও দেবব্রতর সঙ্গে সিংহাসনের অধিকার নিয়ে দরাদরি করেছিলেন, তখন সত্যবতীর প্রতি পাঠকের এক রকম সহানুভূতি উদ্যত হয়, ধীবর কন্যাকে রাজা ক্ষণভোগ্যার মতো গ্রহণ করে অল্প দিন পরেই ভুলে যেতে পারতেন, তাই এই শর্ত। কিন্তু পিতার প্রেমকে সার্থক করার জন্য ভাবী বিমাতার কাছে চিরকৌমার্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া, এটা এতই নিষ্ঠুর ও অমানবিক যে, এতে সাড়া দেওয়া পাঠকের পক্ষে কঠিন। নিরপরাধ দেবব্রতকে স্বাভাবিক জীবন থেকে চিরবঞ্চিত থাকতে হল। পিতার প্রেমোন্মাদকে চরিতার্থতা দিতে গিয়ে, প্রেমকে তিনি নিজের জীবনে জানতে পারলেন না। অর্থাৎ ঘটনাটির দুটি দিক আছে: সত্যবতীর স্বার্থের দিক, যার একাংশ শান্তনুরও স্বার্থের সঙ্গে অভিন্ন, আর অন্য একটা দিক হচ্ছে সত্যের প্রতি আনুগত্য; তাঁকে আমরণ কঠোর ব্রত মেনে নিতে হল এঁদের সুখবিধানের জন্য। পাঠক দ্বিধান্বিত বোধ করে প্রেমের সার্থকতা এবং নির্দোষ এক তরুণের আমরণ কৌমার্যের প্রতিজ্ঞার মধ্যে। যখন রাজমাতা হওয়ার জন্যে সত্যবতীর এই উদগ্র আকুতি পদে পদে ব্যর্থ হয়, এবং শান্তনুর সিংহাসনে বসে সত্যবতীর কানীন পুত্রের ঔরস জাত সন্তান, তখনও হয়তো পাঠক বিষণ্ণতার সঙ্গে একটা ন্যায়সঙ্গত বিধান দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়। যা বলতে চাইছি তা হল: মহাভারতের ছোট বড় প্রায় কোনও উপাখ্যানেই পাঠকের প্রতিক্রিয়া সরল, একমাত্রিক নয়। এই বহুমাত্রিক সংবেদনই মহাভারতের বৈশিষ্ট্য।
সিংহাসন নিয়ে এই ধরনের আরও একটি উপাখ্যান শকুন্তলা-দুষ্যন্তর কথা। গল্পটি বিখ্যাত, কিন্তু সেখানেও দুৰ্য্যন্তকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল, শকুন্তলার সন্তানই রাজা হবে। গান্ধর্ব মতে শকুন্তলাকে বিয়ে করবার পরই দুষ্যন্ত শকুন্তলার কথা সব ভুলে গেলেন। শকুন্তলা বালকপুত্র সর্বদমনকে নিয়ে রাজসভায় যেতে দুষ্যন্ত বালকের পিতৃত্ব, গান্ধর্ব বিবাহ সবই অস্বীকার করলেন। তখন শকুন্তলা কঠিন ভাষায় তীব্র অনুযোগ করলেন, বললেন, ‘আমার দায়িত্ব নিতে হবে না। কিন্তু তোমার সন্তানকে তুমি যৌবরাজ্যে অভিষেক কর বা না কর ভরণপোষণের দায়িত্ব তোমার।’ দুয্যন্ত স্বীকার না করলেও দৈববাণী শকুন্তলার কথার সত্যতা প্রমাণ করল, দুষ্যন্ত পুত্র ও শকুন্তলাকে গ্রহণ করলেন।[২] এই পুত্রই বংশকর পুত্র, পরে এর নাম হয় ভরত, কুরু পাণ্ডব যার বংশের শাখাপ্রশাখা। এ উপাখ্যানেও এমন বস্তু আছে যাতে সাড়া দেওয়া কঠিন। গান্ধর্ব বিবাহের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন নয়, কিন্তু যে সময়ে মহাকাব্য সম্পূর্ণতা লাভ করছে সে সময়ে গান্ধর্ব-বিবাহ ক্রমশ অচল হয়ে আসছিল। তার পরে প্রকাশ্যে রাজসভায় এক নারী এমন এক পুরুষকে তার দায়িত্ব সম্বন্ধে উপদেশ দিচ্ছে, ভর্ৎসনা করছে, যে-পুরুষ বিবাহ সম্বন্ধই অস্বীকার করছে। দৈববাণী অলৌকিক; সমাধান এল সে পথে; কিন্তু তার আগে পর্যন্ত এই স্বাধীনচেতা নারীর আচরণ শ্রোতা বা পাঠককে কতকটা বিভ্ৰান্ত করে। গোপন বিবাহে জাত এই সন্তান বংশকর পুত্র হয়ে উঠল, কিন্তু তার পূর্বে তাকে উপলক্ষ্য করে তার জননী রাজাকে কটুকথা বলে যাচ্ছে অনর্গল, এটা বরদাস্ত করা হয়তো সহজ হয়নি সামাজের পক্ষে, কারণ ব্যাপারটায় কিছু জটিলতা আছে এবং জটিল ব্যাপারে সাড়া দেওয়া কঠিন। তাই তার জনপ্রিয়তা বড় একটা ঘটে না।
যে-বেদব্যাস মহাকাব্যের রচয়িতা তাঁর জন্মের ইতিবৃত্তেও একই রকম এক ঘটনা। নৌকা বাইত মেছুনির মেয়ে; পারানির সময়ে তাকে দেখে আকৃষ্ট হয়ে তাকে গ্রহণ করতে চাইলেন ঋষি পরাশর। না, বিবাহ নয়, কোনও দায়িত্ব নয়, শুধু ক্ষণ-সম্ভোগের আহ্বান। কৌমার্য ফিরে পাবে সে-মেয়ে, গায়ের যে গন্ধের জন্যে তার দুর্নাম ‘মৎস্যগন্ধা’ বলে’, তা ঘুচে যাবে, সন্তান কৃতী হবে, ইত্যাদি বরে তাকে প্রলুব্ধ করলেন। জন্ম নিল কালো ছেলে কৃষ্ণ দৈপায়ন।[৩] লক্ষণীয়, ঋষি পরাশর সত্যবতীকে সম্ভোগ করার জন্য তাকে কিছু কিছু বর দিলেন বটে কিন্তু তার সম্বন্ধে বা তার গর্ভজাত সন্তানটির সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র দায়িত্ব স্বীকার করলেন না। ঋষিত্বের একটা দিক উন্মোচিত হল। দ্বৈপায়ন, কেননা এক দ্বীপে তমিস্রার আবরণ সৃষ্টি করে মৎস্যগন্ধাকে গ্রহণ করেছিলেন ঋষি। কাজটা প্রচলিত অর্থে দুর্নীতির, অথচ সেই ছেলেই হল বেদব্যাস। মানতে মুশকিল থেকে যায়, মহাভারতের রচনার শেষ পর্বের পাঠকেরও, পরবর্তীদের তো বটেই। কিন্তু অকুণ্ঠ নিরাবরণ এই বর্ণনায় কোথাও দুর্নীতিকে সুনীতিতে পরিণত করার চেষ্টাও নেই। জনপ্রিয়তার পথে এতে এক ধরনের প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হয়: সমাজে যা ভ্রষ্টাচার, তারই ঋষি-আচরিত সংস্করণকে মেনে নিতে হবে আর এক মহর্ষির জন্মকথা বলে।
কুন্তি এক ঋষিকে সেবায় তুষ্ট করলে তিনি একটি মন্ত্র শিখিয়ে বর দেন, সে মন্ত্র উচ্চারণ করে, যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করলে তিনি আসবেন। তরুণী কুন্তির কৌতূহলে এলেন সূর্য, তাঁর বরে কুন্তির পুত্র কর্ণের জন্ম। আক্ষরিক অর্থে এ কাহিনিকে বিশ্বাস করা যায় না। মূল কথাটা বোঝা যায়, কর্ণ প্রাসাদের বা প্রাসাদে অভ্যাগত কোনও ব্যক্তির জারজ সন্তান; কুন্তির কুমারী কন্যা অবস্থায় তাঁর জন্ম বলে কর্ণের শাস্ত্রীয় সংজ্ঞা কানীন। কিন্তু কুন্তি তো কুমারী, কেমন করে স্বীকার করবেন কানীন এই পুত্রকে? ধাত্রীর সাহায্যে এক পেটিকা শুইয়ে তাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলেন। কোনওদিন কর্ণ ক্ষমা করেননি জন্মক্ষণেই জননীর এই মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতা। অথচ কুমারী কুন্তি কোন ভরসায় সে পুত্রকে প্রকাশ্যে স্বীকার করে লালন করবেন? তিনি তো তখন জানতেন না যে যাঁর সঙ্গে পরে তাঁর বিবাহ হবে তিনি স্বয়ং প্ররোচনা দিয়ে তিনটি ক্ষেত্রজ সন্তানকে জন্ম দিতে বাধ্য করবেন কুন্তিকে। অতএব, কর্ণের জন্মক্ষণে যেহেতু কুন্তির সে আশ্বাস ছিল না, তাই তাঁর বিকল্প আচরণের সুযোগ ছিল না। ব্যাপারটা উভয়পক্ষেই মর্মন্তুদ, তাই কুন্তির আচরণের এবং কর্ণের ক্ষোভের বিচার করতে পারে না পাঠক। পারে না বলে দুঃখ পেলেও নৈতিকতা নিয়ে বিচলিত বোধ করে আরও বেশি এই জন্যে যে, একদিন কুন্তি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কর্ণকে আত্মপরিচয় দিয়ে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করে পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করতে অনুনয় করেন। যথারীতি প্রত্যাখ্যাত হন কুন্তি, সূর্যপুত্র ক্ষুদ্র স্বার্থে দলত্যাগী হতে সম্মত হতে পারেন না।[৫] কিন্তু যে দ্বিধা অনুক্ষণ পাঠকের মনে অস্বস্তি আনে তা হল ঘটনাটির বহুমুখীনতা। জন্মক্ষণে পরিত্যাগও যেমন অনিবার্য ছিল, কর্ণকে পক্ষত্যাগ করতে অনুরোধ করাও তেমনই অনিবার্য। এ অনুরোধের পশ্চাতে শুধু কি অর্জুনের কল্যাণকামনা? চির-অতৃপ্ত যে মাতৃত্ব অপরিণত ভীরু কুমারীকে নিষ্ঠুর করে তুলেছিল তার প্রায়শ্চিত্তের কোনও বাসনাই কি এর মধ্যে নিহিত ছিল না? শত্রুপক্ষীয় পাণ্ডবদের জননী বলেই, অথবা হয়তো জন্মক্ষণে সন্তানপরিত্যাগিনী বলে কর্ণের পক্ষে সহজ হয়নি জননীকে সত্যকার পরিচয়ে মাতৃত্বের স্থান দেওয়া। তিনি তো জানতেন অধিরথ ও রাধা তাঁর পালক পিতামাতা মাত্র, কুন্তিপুত্র হওয়ার গৌরব ত্যাগ করলেন বৃহত্তর সত্যরক্ষার জন্যে, কিন্তু কাজটা সহজ হয়নি। তাই পাঠকের পক্ষেও সহজ হয়নি এ-ঘটনায় সংবেদন নিরূপণ করা। নৈতিক বিচার যেখানে যথার্থ ভাবে প্রযোজ্য হয় না, বিষয়টির অন্তর্নিহিত জটিলতার জন্যে, সেখানে তা শ্রোতা বা পাঠককে বাধ্য করে চিন্তা ও মননের দ্বারা একটি সমাধানের সৃষ্টি করতে এবং হয়তো এ সমাধানও সকলের এক রকম হয় না। ললাটে কুঞ্চনরেখা নিয়েও অকুণ্ঠিত প্রশংসা করে চিন্তাশীল পাঠক। বাকিরা দ্বিধার মধ্যে পড়ে এবং ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গিয়ে সহজ সরল ঘটনা, বর্ণনার সন্ধান করে। জনতার প্রিয় নয় এমন বস্তু; জনতা অস্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করে এর সুগভীর আবেদন, কিন্তু সেটা আবেগ ও মননের মিশ্র সংযোগে নির্মিত হয়, তাই যথার্থ বোদ্ধা ছাড়া এর মর্মে প্রবেশ করা কঠিন তাই এ বস্তু আপন উৎকর্ষের মহিমায় আসীন থাকে, ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে না।
***
১. আদিপর্ব; (১২৩:৩৫)
২. আদিপর্ব; (৯৪:৮৮-৯০, ৯২)
৩. আদিপর্ব; ৬৯:৩৭]
৪. আদিপর্ব; ৫৭:৭১]
৫. আদিপর্ব; (১০৪:১৩)