০৩. মশা কেন ভূত হবে না

৩. মশা কেন ভূত হবে না

পরের দিন নান্টুকে আবার বল্টুর বাসায় দেখা গেল। বল্টু তখন ঘরে তার টেবিলের নিচে উবু হয়ে শুয়ে আছে। অন্য যেকোনো মানুষ হলে জানতে চাইত, একজন মানুষ এত জায়গা থাকতে কেন টেবিলের নিচে উবু হয়ে শুয়ে থাকবে। কিন্তু নান্টু কখনো নিজে থেকে কিছু প্রশ্ন করে না। সে বল্টুর পাশে বসে নিজের গালে হাত দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে বল্টুকে দেখতে থাকে। তখন বল্টুকে জিজ্ঞেস করতেই হলো, “তুমি কী দেখছ?”

নান্টু উদাস ভঙ্গিতে বলল, “নাহ্ কিছু না।”

বল্টুর বৈজ্ঞানিক মন উত্তরটায় খুশি হলো না, বলল, “তুমি তাকিয়ে আছ, তার মানে তুমি নিশ্চয়ই দেখছ। তাকিয়ে থাকলে আলো চোখের লেন্সের ভেতর দিয়ে রেটিনাতে পড়ে তখন দেখা যায়। তুমি দেখছ– একশবার দেখছ।”

“ঠিক আছে তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে থাকি।” বলে নান্টু তার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

বল্টু কিছুক্ষণ নান্টুর দিকে তাকিয়ে রইল। সে একটু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, একজন মানুষ চোখ খুলে তাকিয়ে থাকলে যে রকম অস্বস্তি হয়, চোখ বন্ধ করে থাকলেও সে রকম অস্তিত্ব হয়। বল্টু টেবিলের তলা থেকে উঠে বসে বলল, “এই ছেলে।”

নান্টু বলল, “উ।”

“তুমি চোখ খোলো।”

“খুলব?”

“হ্যাঁ।”

“আমকে বকবে না তো?”

“না, বকব না।”

নান্টু তখন আস্তে আস্তে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকাল। বল্টু মুখ গম্ভীর করে বলল, “তুমি কোনো দিন বিজ্ঞানী হতে পারবে না।”

নান্টু মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল, বলল, “ঠিক আছে।”

“কেন পারবে না, জানো?”

“না।”

“বিজ্ঞানী হতে হলে সব সময় সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে হয়। সবকিছু জানতে হয়। তুমি কোনো প্রশ্ন কর নাই।”

নান্টু আবার মাথা নাড়ল; বলল, “ঠিক আছে।”

বল্টু রেগেমেগে বলল “না, ঠিক নাই। তুমি এই ঘরে ঢুকে দেখেছ আমি টেবিলের নিচে শুয়ে আছি। দেখ নাই?”

নান্টু মাথা নাড়ল; বলল, “দেখেছি।”

“তাহলে তুমি কেন জিজ্ঞেস করো নাই, বল্টু ভাইয়া, তুমি টেবিলের নিচে শুয়ে শুয়ে কী করছ?”

নান্টু মাথা চুলকে বলল, “আমি ভেবেছি, তুমি মনে হয় সব সময় টেবিলের নিচেই থাক।”

“তাই ভেবেছ?”

“হা।”

“কেন?”

“আগের দিন তো তুমি উল্টো হয়েছিলে সেই জন্যে। আমি ভেবেছি, তুমি মনে হয় সব সময় উল্টাপাল্টা হয়ে থাক।”

বল্টু রেগে বলল, “আমি কখনো উল্টাপাল্টা হয়ে থাকি না। আমি টেবিলের নিচে শুয়ে শুয়ে একটা কাজ করছিলাম।”

নান্টু বলল, “ও।”

বল্টু হতাশ হয়ে বলল, “ও বললে হবে না। তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আমি কী করছিলাম।”

নান্টু জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করছিলে?”

সঙ্গে সঙ্গে বল্টুর চোখ-মুখ একশো ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। চোখ বড় বড় করে বলল, “এই দেখো, পিঁপড়ারা একটা তেলাপোকা টেনে টেনে নিচ্ছে। দেখেছ?”

নান্টু মাথা নাড়ল। বল্টু বলল, “এখন এটা দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?” নান্টু নাক কুঁচকে বলল, “তেলাপোকা! ইয়াক থুঃ!”

বল্টু বলল, “উঁহু। এটা দেখে ইয়াক থুঃ বললে হবে না। বিজ্ঞানীরা। কখনো কোনো কিছু দেখে ইয়াক থুঃ বলে না।”

নান্টু বলল, “ও।”

“এখন বলো, এটা দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে?” নান্টু মাথা চুলকে বলল, “ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করার দরকার।”

বল্টু হা হা করে উঠল, বলল, “সর্বনাশ! তুমি কী বলছ পাগলের মতো। এটা পরিষ্কার করবে কেন? এটা হচ্ছে একটা আস্ত ল্যাবরেটরি। এটা দিয়ে গবেষণা করতে হবে। পিঁপড়ার দিকে তাকিয়ে তুমি প্রশ্ন করবে, কেমন করে পিপড়ারা জানে এদিক দিয়ে যেতে হবে। বুঝেছ?”

নান্টু মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি।”

“আমি সেটাই করছি। পিপড়াগুলো নিয়ে গবেষণা করে বের করছি, তারা কেমন করে যায়।”

একটু পরে দেখা গেল, নান্টু আর বল্টু দুজনই টেবিলের নিচে উবু হয়ে শুয়ে শুয়ে পিপড়াগুলো দেখছে। ঘণ্টাখানেক পর দুজনকে টেবিলের তলা থেকে বের হয়ে আসতে দেখা গেল, পিপড়ার কামড়ে দুজনই খানিকটা অস্থির–কিন্তু বল্টু শেষ পর্যন্ত বের করেছে, পিঁপড়ারা যাওয়ার সময় এক ধরেনর গন্ধ রেখে যায়। সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে অন্য পিপড়ারা তাদের সারি ঠিক রাখে।

কিন্তু এই গবেষণার জন্য বল্টুর খানিকটা মূল্য দিতে হলো। দুপুরবেলা গোসল করে রিতু শাড়ি পরে শরীরে একটু পারফিউম দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তার সবচেয়ে প্রিয় পারফিউমের বোতলটার অর্ধেক হাওয়া হয়ে গেছে। সে চোখ কপালে তুলে বলল, “আমার পারফিউম কে শেষ করেছে কে?”

এর উত্তর জানার জন্য অবশ্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই, এই বাসায় এ ধরনের ঘটনা ঘটায় শুধু বল্টু। রিতু হুঙ্কার দিয়ে বলল, “বল্টু!”

বল্টু কাছেই ছিল; বলল, “বলো আম্মু।”

“তুই এই পারফিউম নিয়েছিস?”

বল্টুর চোখে-মুখে অবাক হওয়ার একটা ছাপ পড়ল, বলল, “পিপড়া নিয়ে গবেষণার সময় …”

রিতু হুঙ্কার দিয়ে বলল, “কী বললি?”

বল্টু ধৈর্য হারাল না, বলল, “আম্মু, তুমি আমাকে কথাটা শেষ করতে দাও নি, আমি কথাটা শেষ না করলে তুমি কেমন করে জানবে?”

রিতু খপ করে বল্টুর কলার ধরে বলল, “এতগুলো পারফিউম নষ্ট করেছিস? তুই জানিস, এই শিশির দাম কত? আমার এক মাসের বেতন…”

বল্টু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আম্মু! তুমি বুঝতে পারছ না। আমরা যখন বুঝতে পারলাম পিপড়ারা গন্ধ শুঁকে এঁকে যায়, তখন তাদের রাস্তায় আমরা এই পারফিউম ঢেলে দিয়েছি! সব পিপড়ার তখন মাথা খারাপ হয়ে গেল! কে কোন দিকে যাবে বুঝতে পারে না–একেবারে উল্টাপাল্টা অবস্থা। তুমি যদি নান্টুকে দেখতে …”।

“কী হয়েছে নান্টুর?”

“পিঁপড়া ওর প্যান্টের ভেতর ঢুকে যা কামড় দিয়েছে!” বল্টু পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে আনন্দে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলল, “বাসায় তোমার এই পারফিউমটা ছিল বলে এক্সপেরিমেন্টটা করতে পেরেছি! না থাকলে যে কী করতাম!”

রিতু চোখ বড় বড় করে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল আর বল্টু মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উল্টো দিকে হেঁটে চলে গেল, রিতু তাকে কিছু বলারও সুযোগ পেল না।

.

কদিনের মধ্যেই দেখা গেল, নান্টু আর বল্টুর মধ্যে এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছে। নান্টুর কোনো কাজ না থাকলে সে বল্টুর কাছে এসে বসে থাকে। বল্টু একটানা কথা বলে যায়, নান্টু গালে হাত দিয়ে সেগুলো শোনে। বল্টুর পেটে যে এত কথা ছিল সেটা সে নিজেও জানত না, আর তার টানা কথা বলা শুনতে যে নান্টুও কখনো ক্লান্ত হবে না সেটাও সে জানত না। বল্টু বৈজ্ঞানিক বিষয় ছাড়া অন্য কিছু বিশেষ জানে না। তাই তার সব কথাই হয় বিজ্ঞান নিয়ে। হাতে একটা পেনসিল থাকলে সে বলে, “এই পেনসিলের সিসটা দেখেছিস? (ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পর “তুমি” “তুইয়ে নেমে এসেছে) এটা কিন্তু সিসা না। এটা হচ্ছে গ্রাফাইট। গ্রাফাইট চিনেছিস? কয়লা। কয়লা আর গ্রাফাইটে কোনো পার্থক্য নাই। হীরা আর কয়লাতেও কোনো পার্থক্য নাই। আমি বুঝি না, মেয়েরা হীরার গয়না পরতে এত পছন্দ করে কেন! হীরা আর কয়লা তো একই জিনিস। তাহলে তারা তো ইচ্ছা করলে কয়লার গয়নাও পরতে পারে! কত সস্তায় তাহলে গয়না কিনতে পারবে। পারবে না?”

না কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ে। বল্টুর হাতে যদি একটা কাগজ থাকে তাহলে বলবে, “দেখেছিস, কাগজ? ইন্টারেস্টিং জিনিস। যেদিন বৃষ্টি হয় বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকে, সেদিন কাগজ সাইজে বড় হয়ে যায়। যদি দিনটা শুকনা থাকে তাহলে কাগজটাও ছোট হয়ে যায়। কাগজ দিয়ে আমি একটা যন্ত্র বানিয়েছিলাম, বৃষ্টি হলেই সেটার কাটাটা দেখাত বৃষ্টি। যন্ত্রটা বেশি কাজে লাগে নাই, জানালা দিয়ে তাকালেই তো দেখা যায় বৃষ্টি হচ্ছে, যন্ত্র দিয়ে কী করব? ঠিক বলি নাই?”

নান্টু কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল যে বল্টু ঠিকই বলেছে।

কিংবা বল্টু যদি এক গ্লাস পানি খায় তাহলে চোখ বড় বড় করে বলবে, “পানি! দুনিয়ার সবচেয়ে আজব জিনিস! পানি যখন জমে বরফ হয়, তখন তার সাইজ বড় হয়ে যায়। সেই জন্যে বরফ পানিতে ভাসে। আমাদের শরীরের কতটুকু পানি, জানিস?”

নান্টু মাথা নেড়ে জানায় যে সে জানে না। বল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, “তোর শরীরের পানিটুকু যদি আলাদা করা যেত, তাহলে সেটা তোর কাঁধ পর্যন্ত আসত। চিন্তা কর, তোর কাঁধ পর্যন্ত থলথলে পানি! কী আজব! তোর শরীরে কতটুকু ফসফরাস আছে জানিস?”

না কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে জানায় সে জানে না। বল্টু তখন বলে, “একটা ম্যাচের কাঠি বানাতে যতটুকু ফসফরাস লাগে, ততটুকু! ফসফরাস কী জানিস?”

বল্টু তখন নান্টুর কাছে ফসফরাসের ব্যাখ্যা করতে থাকে, নান্টু বাধ্য ছেলের মতো সবকিছু শোনে। বল্টু যে রকম কথা বলতে পছন্দ করে, নান্টু ঠিক সে রকম কথা শুনতে পছন্দ করে। নান্টু দেখে, মাঝে মাঝে বল্টু অবশ্যি একটু অধৈর্য হয়ে যায়। একদিন টানা আধঘণ্টা এবোলা ভাইরাসের ওপর বক্তৃতা দিয়ে গেল। নান্টু ধৈর্য ধরে পুরোটা শুনল, কিন্তু একটা কথাও বলল না। বল্টু হঠাৎ কথা থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি আমার কথা শুনছিস?”

নান্টু মাথা নাড়ে। বল্টু তখন চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে বল দেখি এবোলা ভাইরাস কেন এত ভয়ঙ্কর?”

নান্টু মাথা চুলকে বলল, “সেটা তো জানি না।”

“তাহলে এতক্ষণ যে তোকে বললাম সেটা শুনিস নাই?”

নান্টু মাথা নাড়ল, বলল, “শুনেছি। কিন্তু বুঝি নাই।”

“বুঝিস নাই, তাহলে জিজ্ঞেস করিস না কেন?”

নান্টু হাসি-হাসি মুখে বলল, “আমার শুনতেই ভালো লাগে। কথা বলার সময় তোমার নাকটা একবার মোটা হয়, একবার চিকন হয়–সেটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।”

বল্টু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না নান্টু, না। তোর খালি শুনলে হবে না। তোকে বুঝতেও হবে। বোঝার জন্যে তোকে প্রশ্নও করতে হবে।”

নান্টু বলল, “ঠিক আছে।”

“প্রশ্ন কর দেখি। এখনই একটা প্রশ্ন কর।”

নান্টু মাথা চুলকাল, বলল, “করব?”

“হ্যাঁ, কর দেখি একটা প্রশ্ন।”

নান্টু অনেকক্ষণ চিন্তা করল। মাথা চুলকাল, ঠোঁট কামড়াল, চোখ বন্ধ করল, তারপর খুলল। তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মানুষ মরে গেলে ভূত হয়। ভূত মরে গেলে কী হয়?”

নান্টুর প্রশ্ন শুনে বল্টু কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “এটা তোর প্রশ্ন?”

নান্টু ভয়ে ভয়ে বলল, “হ্যাঁ।”

“এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না।”

“কেন?”

“একটা ভূত মরে কী হয় সেটা জানার জন্যে একটা ভূতকে ধরতে হবে, তারপর সেটাকে মারতে হবে।”

“ভূতকে কীভাবে মারে?”

“জানি না। মনে হয় পিটিয়ে।”

“কী দিয়ে পিটাবে?”

বল্টু বলল, “সেটাও জানি না। মনে হয় লাঠি দিয়ে।”

নান্টু পুরো ব্যাপারটা বুঝে ফেলায় মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “আমার কী মনে হয় জানো?”

“কী?

“ভূত মরলে গেঞ্জি হয়।”

বল্টু চোখ কপালে তুলে বলল, “গেঞ্জি?”

“হ্যাঁ, গেঞ্জি। ছোট ভূত মারা গেলে ছোট গেঞ্জি, বড় ভূত মারা গেলে বড় গেঞ্জি।”

বল্টু কিছুক্ষণ নান্টুর দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। কোনো কথা বলল না। নান্টু আবার কিছুক্ষণ তার ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করে বলল, “আচ্ছা, বল্টু ভাইয়া …”

বল্টু সন্দেহের চোখে নান্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “কী?”

“মানুষ মরে গেলে যদি ভূত হয়, তাহলে মুরগি মরে গেলে কি মুরগির ভূত হতে পারে না?”

বল্টুকে এবার খুব চিন্তিত দেখায়, খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “মনে হয় হতে পারে।”

“তাহলে আমরা যে মুরগি খাই, সেই মুরগিদের ভূত কি আমাদের ওপর খুব রাগ হয় না?”

বল্টু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হতে পারে।”

“তাহলে কি মুরগির ভূতগুলি রাতে এসে আমাদের মাথায় ঠোকর দেবে না?”

বল্টু কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে বলল, “মনে হয় দেবে।”

নাকে খুব চিন্তিত দেখাল, বলল, “তাহলে আমাদের কি মুরগি খাওয়া ঠিক হবে?”

বল্টু কী বলবে বুঝতে না পেরে নিজের মাথা চুলকাতে শুরু করে। যে নান্টু আগে কখনো কোনো প্রশ্ন করে নি, এখন হঠাৎ করে তার যেন প্রশ্ন করার একটা ঝোঁক চলে এল। সে বড় বড় চোখ করে বল্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বল্টু ভাইয়া!”

বলু ভয়ে ভয়ে বলল, “কী?”

“মুরগি মরে যদি মুরগি ভূত হতে পারে, তাহলে কি মশা মরে মশার ভূত হতে পারে না?”

বল্টু মাথা চুলকে বলল, “হতে তো পারেই মনে হচ্ছে।”

“তাহলে আমরা যে মশা মারি, সেই মশাগুলি মরে মশার ভূত হয়ে আমাদের কামড়াতে আসে না?”

বল্টু কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “আসতেই পারে।”

“তাহলে আমাদের কি মশা মারা উচিত?”

বল্টু কী বলবে বুঝতে পারে না, তাই একটু মাথা চুলকালো। নান্টু গম্ভীর মুখে বলল, “মশা থেকে মশার ভূত কি বেশি ডেঞ্জারাস না? মশা কামড়ালে আমরা দেখতে পাব, মশার ভূত যখন কামড়াবে আমরা তো দেখতেও পাব না। কী ভয়ঙ্কর!”।

বল্টু এবার আর কোনো কথা বলল না। নান্টু আবার তার ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করতে থাকে। তারপর বল্টুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস

করতে চাচ্ছিল। বল্টু তাকে থামাল, বলল “নান্টু, শোন।”

“কী?”

“তোকে আমি বলেছিলাম না প্রশ্ন করতে?”

“হ্যাঁ, বলেছিলে। সে জন্যেই তো প্রশ্ন করছি।”

“আমার মনে হয় তোর আর প্রশ্ন করার দরকার নাই।”

“দরকার নাই?”

“না,” বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “তোর প্রশ্নের উত্তর বের করা খুব কঠিন।”

নান্টু বলল, “ঠিক আছে তাহলে, আর বেশি প্রশ্ন করব না।” নান্টু একগাল হেসে বলল, “আমার প্রশ্ন করতে ভালোও লাগে না।”

বল্টু বলল, “সেটাই ভালো। তুই যত কম প্রশ্ন করবি ততই ভালো।”

.

পরদিন নান্টু নিজে তার প্রথম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে ফেলল। সকালবেলা সে একটা ছোট শিশি নিয়ে বল্টুর কাছে হাজির হলো, চোখ বড় বড় করে বলল, “বলু ভাইয়া, এই দেখো!”

নান্টুর হাত থেকে শিশিটা নিয়ে বল্টু বলল, “কী?”

“এই শিশির ভেতর একটা ভূত আটকে ফেলেছি।”

বল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, “ভূত আটকে ফেলেছিস?”

“হ্যাঁ। মশার ভূত।”

“মশার ভূত?”

নান্টু দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, “একটা মশা ধরে শিশিটার ভেতর ঢুকিয়ে ছিপিটা শক্ত করে আটকে দিয়েছি।”

বল্টু কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “কেন?”

“তুমি বোঝো নাই? ভেতরে মশাটা কয়েকবার লাফঝাঁপ দিয়ে মরে গেছে। মশা মরে গিয়ে ভূত হয়েছে, সেই ভূতটা শিশিটার মধ্যে আটকা পড়েছে। ছিপিটা এত শক্ত করে লাগিয়েছি যে ভেতর থেকে বের হতে পারবে না!”

বলু কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে নান্টুর দিকে তাকিয়ে রইল। নান্টু বলল, “বল্টু ভাইয়া, ভালো করে দেখো দেখি, মশার ভূতটা দেখা যায় নাকি। ভূতেরা তো খালি অন্ধকারে বের হয়, তাই না?”

বল্টু মাথা চুলকে বলল, “আমি ঠিক জানি না …”

নান্টুর উৎসাহের জন্য শিশিটাকে অন্ধকারে নিয়ে দেখতে হলো, কিছু দেখা গেল না। কিন্তু তাতেও নান্টুর উৎসাহ কমে গেল না। বলল, “মনে হয় অন্ধকারে মশার ভূতটা বের হয়, কিন্তু অন্ধকার বলে আমরা দেখতে পাই না। তাই না, বল্টু ভাইয়া?”

বল্টু বলল, “মনে হয় তা-ই।”

“দেখা না গেলেও ক্ষতি নাই, আমরা তো জানি ভূতটা ভেতরেই আছে। বের হবে কেমন করে, তাই না বল্টু ভাইয়া?”

বল্টু আবার মাথা নাড়াল।

নান্টু বলল, “বল্টু ভাইয়া, তোমার সব বৈজ্ঞানিক জিনিসপত্রের সঙ্গে এটা রেখে দাও।”

কাজেই বল্টুর চুম্বক, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক তার, পেরেক, ভিনেগাররের বোতল, থার্মোমিটার, টিকটিকির শুকনো লেজ, সিরিঞ্জ, রৰারের নল, চোঙা, প্লয়ার্স, ভাঙা ঘড়ি–এসবের পাশে শিশিটা সাজিয়ে রাখতে হলো। নান্টুর উৎসাহের কারণে শিশির ওপরে বড় বড় করে লেখা হলো : “সাবধান! মশার ভূত।”

.

এ ঘটনার পর থেকে বল্টু অবশ্যি নান্টুকে বিজ্ঞানী বানানোর চেষ্টা বন্ধ করে দিল। সে বুঝতে পেরেছে–সবাই যে রকম কবি না, কেউ কেউ কবি; সে রকম সবাই বিজ্ঞানী না, কেউ কেউ বিজ্ঞানী!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *