মমতাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আবু ইব্রাহীম সহসা উদ্যোগ নেয় না, কয়েকদিন চুপ করে বসে থাকে; সে নূতন সেকশনে যোগ দেয়, সিদ্দিক হোসেনের তাড়নায় পড়ে রূপনগরের জমির প্লটের জন্য দরখাস্ত তৈরি করে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চয় থেকে পাঁচ হাজার টাকা তোলার কথা ভাবে। তার মনে হয় যে, মমতা নিজেই ফিরে আসবে, কিন্তু যখন এক সপ্তাহ পার হয়ে যায় তবু মমতা আসে না, তখন সে চারদিনের ছুটি নিয়ে সিরাজগঞ্জ যায়। সেখানে শ্বশুরবাড়িতে রাতে, খাওয়ার পর তার শ্বশুর তাকে বলে, আমার মেয়েটা পাগল; তুমি যে নিতে আইছ, সে জন্য আমি খুশি হইছি। তখন আবু ইব্রাহীম মমতার নীরব মুখের দিকে তাকায়, তার হেলেনের কথা মনে আসে, হেলেন ঢাকায় রয়ে গেছে। কিন্তু আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে যে, মমতাকে ছাড়া তার দিন চলবে না এবং পরদিন সে স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি বৈকুণ্ঠপুর রওনা হয়। গরুর গাড়ির ভেতর মমতা আর শুভ ওঠে, বিন্দু প্রথমে কিছুটা পথ তার সঙ্গে হাঁটে। গাড়ি শহরের উপর দিয়ে, শুকনো কাটাখালী পার হয়ে, বাহিরগোলা রেলস্টেশনের ডান প্রান্ত ঘেঁষে পশ্চিমমুখী মাটির সড়ক ধরে চলতে থাকে। আট মাইল রাস্তা পার হয়ে বৈকুণ্ঠপুরে আবু ইব্রাহীমের পৈতৃক বাড়ির ভিটেয় যখন গাড়ি এসে থামে, তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। আবু ইব্রাহীম পরিবারসহ এখানে একদিন এবং দুটো রাত কাটায়। শেষ পৌষের এই দিনে তাদের হঠাৎ উপস্থিতির ফলে বাড়িতে চাঞ্চল্য দেখা দেয় এবং এক ধরনের উৎসবের আমেজ আসে; কিন্তু তার ভেতরও তাদের উপস্থিতির ফলে সৃষ্ট আনন্দের কথা বলতে বলতে তার অতি বৃদ্ধ পিতা ফসলহানির কথা বলে, জমির অগ্রসরমান বন্ধ্যাত্ব এবং জীবন-যাপন প্রক্রিয়ায় তাদের নির্মম ব্যর্থতার কথা বলে। তার রুগুণ পিতা তার ওপর অনিশ্চিত ঘোলাটে চোখ স্থাপন করে, চাদরের ভেতর থেকে বার করা শীর্ণ হাত শূন্যতার ভেতর সঞ্চালন করে বলে, বাইচা থাহা বড়ই কষ্ট! তার মা তার দিকে ভীরু চোখে তাকায়; সে দেখে এবং তার মনে হয় যে, তার মায়ের নাকের নথটি পূর্বেকার চাইতে আরো বড় হয়ে উঠেছে এবং তার মা আরো শীর্ণ এবং ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। তার দুই ভাই আসে এবং তাদের স্ত্রীরা মাতায় ঘোমটা টেনে নীরবে কাছে দাঁড়ায়। আবু ইব্রাহীমের একবার শুধু প্রচণ্ড বিষণ্ণতা আসে, তার মনে হয়, তার জীবন উত্থান-রহিত, কারণ, তার জীবনের সমগ্র শিকড় এবং পরিচয় বৈকুণ্ঠপুরে আরোগ্যের প্রায় অযোগ্য এক অন্ধকারে পড়ে আছে এবং তার কোনো ক্ষমতাই নাই এই অন্ধকারকে আলোকিত হতে সাহায্য করার। তখন সেই বিষাদের ভেতর সে আনন্দধ্বনি করে ওঠে, পিঠা খাব মা, পিঠা খাব, পিঠা বানাও। তারপর সে রাতে ভেতর বাড়ির ওঠানের মাঝখানে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে নূতন ধানের খড়ের ওপর বসে বাড়ির পুরুষরা গল্প করে, আর নারীরা টেকি ঘরের ভেতর লণ্ঠনের আলোয় চালের গুড়ো কোটে। অনেক রাত দক্ষিণমুখো চার চালা ঘরে মাচার উপর ঢালা-বিছানায় শুয়ে আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে যে, তার বিছানা নরম করে রচনা করার জন্য নিচে খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে; নূতন খড়ের সোদা গন্ধে সে আবিষ্ট হয়ে থাকে। তারপর মমতা যখন এই শয্যায় আসে আবু ইব্রাহীম নূতন শস্যের ঘ্রাণ আর নারীর শরীরের ভালোবাসার ভেতর নিমজ্জিত থেকে অনেক কথা বলে এবং একসময় রূপনগরে জমির প্রটের জন্য দরখাস্ত করার বিষয়ে সে মমতাকে জানায় কারণ সে অবহিত ছিল যে, মমতার উচ্চারিত এবং অনুচ্চারিত একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল, ঢাকায় এক টুকরো জমির মালিক হওয়া, একটু আশ্রয়ের জন্য। মমতা জমি কেনার এই কথাটি মনে রাখে এবং এক দিন পর তারা পুনরায় সিরাজগঞ্জ ফিরলে, রাতে তার শ্বশুর বলে, তুমি জায়গা কিনবার চাইতাছ কেন?
আবু ইব্রাহীম বুঝতে পারে এবং বলে, না, কেবল একটা দরখাস্ত কইরতাছি।
জায়গাটা কোথায়?
মিরপুর, রূপনগরে।
কতটুকু জায়গা? দাম কত?
আড়াই কাঠার প্লট, দাম চল্লিশ হাজার টাকা। দরখাস্তের সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া লাইগব।
ভালো, দরখাস্ত কর। এই রকম আউলবাউলের মতো থাইকো না।
হইব না, খামাখা।
চেষ্টা কইরা দেইখতে দোষ কি! তোমার কাছে টাকা আছে? দরখাস্ত কইরছ?
না করি নাই এখনো, করমু।
আবু ইব্রাহীম শ্বশুর তখন তাকে বলে যে, তারা তো তার পর কেউ নয় এবং সে তাকে কিছু টাকা নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করে। আবু ইব্রাহীম এতে সম্মত হয় না, সে বলে যে, টাকা লাগলে সে পরে জানাবে।
ঢাকা ফিরে আসার পাঁচ ছদিন পর হেলেন তাকে তার অফিসে ফোন করে কুশল জানতে চায়।
আছি ভালোই, আবু ইব্রাহীম বলে।
আমাদের চলে যাওয়ার সময় প্রায় এসে গেল।
একদিন আস না আমার অফিসে।
অফিসে কেন?
এখানেই কথাবার্তা বলা সুবিধা।
আসতে পারি একদিন।
আগে আমাকে ফোন করে জানিয়ে, আমি তোমাকে গেট থেকে নিয়ে আসব।
আজকেই আসি?
এখন?
হ্যাঁ।
আবু ইব্রাহীম গেট পাশ দেখিয়ে হেলেনকে ভেতরে তার রুমে এনে বসায়, তারপর দুটোয় অফিস ছুটি হলে তারা বের হয়ে একটি বাজে চীনে রেস্তোরায় এক কোণে, নিরিবিলিতে বসে। তারা প্রায় কোনো কথাই বলতে পারে না, নীরবে ভেজিটেবল স্যুপ এবং প্রন বল খায়। আবু ইব্রাহীম হেলেনের কানে আর লাল চুনি দেখে না; সেখানে ছোট মুক্তো বসানো সোনার টাব।
কথা বলছ না?
সে হেলেনের মুখের দিকে তাকায়, তার মনে হয় যে, হেলেনের সঙ্গে তার অফুরন্ত কথা বলার ছিল, কিন্তু এখন কোনো কথাই উচ্চারণযোগ্য নয়। স্যুপের বাটি খালি হয়ে গেলে সে হেলেনের মুখের দিকে পুনরায় তাকায় এবং কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, একদিন আমার সঙ্গে যাবে তুমি, এক জায়গায়?
কোথায়?
আমার এক বন্ধুর বাসায়?
সেখানে কি?
কিছু না, এমনি; আমরা দুজন বসে চুপচাপ কথা বলতে পারব।
তোমার বন্ধুর ফ্যামিলি নাই?
সে বিয়ে করেনি।
কোথায় থাকে সে?
মোহাম্মদপুর; যাবে?
হেলেন দীর্ঘক্ষণ কথা বলে না, তারপর বলে, যাব।
আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
মোহাম্মদপুর আমার বাসা থেকে কাছে হবে, তুমি আমাকে ঠিকানাটা দাও, আমি নিজেই চলে যাব।
তখন চীনে রেস্তোরার সেই আধা-আলোর ভেতর, এক নারীর রহস্যময়তার পরিধি সম্পর্কে আবু ইব্রাহীমের অজ্ঞানতার কারণে তার পরবর্তী পতনের ভূমিকা রচিত হতে থাকে; কিন্তু সে তার কিছুই বুঝতে পারে না। সে বলে, কবে আসবে? আগামী শুক্রবারে?
ঠিক আছে। কখন আসবে?
দশটার দিকে।
ঠিক আছে।