মতিঝিলের বারোতলা দালানের নতলায় ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের অফিস রহমান ট্রেডিং কোম্পানি। দুকামরার অফিস। দুকামরার একটায় কর্মচারীরা বসে, অন্যটা দুভাগ করা হয়েছে। সেই দুভাগের একভাগে ওয়াদুদ সাহেবের অফিস ঘর, অন্যটা তাঁর খাস কামরা। খাস কামরা সুন্দর করে সাজানো। বিরাট একটা জানালা। জানালার দিকে পেছন ফিরে ওয়াদুদ সাহেব বসেন। কারণ জানালা দিয়ে তাকালে তার মাথা ঘোরে। তার উচ্চতা-ভীতি আছে। তিনি বসেন নিচু রিভলভিং চেয়ারে। মানুষটা বেটে বলে চেয়ারে বসলে তাঁকে প্রায় দেখাই যায় না। তার সামনে প্রকাণ্ড টেবিল। টেবিলটাই ঘরের অনেক জায়গা নিয়ে নিয়েছে।
ওয়াদুদুর রহমান সাহেব তার খাস কামরায় খালিগায়ে বসেছিলেন। মানুষটা অতিরিক্ত রকমের ফরসা। বয়সের কারণে শরীরে থলথলে ভাব চলে এসেছে। তার কাঁধে ভেজা একটা টাওয়েল। টেবিলের সামনে এক কাপ কফি। মুখ বিকৃত করে তিনি কফিতে চুমুক দিচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে কফিটা তিনি ওষুধের মতো খাচ্ছেন। দিলশাদকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি হাসিমুখে তাকালেন। দিলশাদ বলল, ব্যাপার কী?
ওয়াদুদুর রহমান বললেন, কোন ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছ? নেংটো হয়ে বসে আছি কেন? ঘরের এসি নষ্ট। ঠিক করার জন্যে মিস্ত্রি এনেছিলাম। গাধাটা কিছুই জানে না। কী সব খুটখাট করেছে। এখন পুরো নতলায় কারেন্ট অফ। গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। চলে যেতাম। তুমি আসবে বলেছ, কাজেই বসে আছি। প্রতীক্ষা করছি। সুন্দরী শ্যালিকা গোপনে দেখা করতে চাচ্ছে– এই সুযোগ হারাবার মতো বোকা আমি না। এখন বলো তোমার কী খবর?
ভালো।
জগতের কুৎসিততম কফি খেতে চাইলে খাওয়াতে পারি। খাবে?
দিলশাদ বসতে বসতে বলল, জি-না।
ওয়াদুদুর রহমান বললেন, এত দূরে বসো না তো দিলু। আমার পাশে এসে বসো। যেন ইচ্ছা করলেই আমি তোমার হাত ধরতে পারি। সুন্দরী শালীদের হাত ধরায় পাপ হয় না। হা হা হা। আচ্ছা, তোমার অনুমান শক্তি কেমন তার একটা
পরীক্ষা হয়ে যাক। বলো তো অফিসের বড় সাহেবদের খাস কামরার টেবিলটা খাটের মতো প্রকাণ্ড হয় কেন? দেখি তোমার অনুমান।
দিলশাদ বিব্রত গলায় বলল, দুলাভাই, আমার অনুমান ভালো না।
তোমাকে একটু হিন্টস দিচ্ছি। সেইসব বড় সাহেবদের অফিসেই প্রকাণ্ড টেবিল থাকে যাদের সুন্দরী স্টেনো থাকে। এখন পারবে, না আরো হিন্টস লাগবে? হা হা হা।
দিলশাদ অস্বস্তি বোধ করছে। সে অস্বস্তি কাটাবার জন্যে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওয়াদুদুর রহমান হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, দুএক দিনের ভেতর তোমার বাসায় যাব বলে ঠিক করে রেখেছি। এমন সব ঝামেলায় জড়িয়েছি, যেতে পারছি না। আসল খবরই জিজ্ঞেস করা হয় নি। নাতাশা কেমন আছে? ওর খবর কী?
আগের মতোই।
স্টেবল কি-না সেটা বলো।
বুঝতে পারছি না।
তোমার তো বুঝতে পারার কথাও না। ডাক্তার কী বলছে?
ডাক্তার সাহেব বলছেন– স্টেবল। উনি আমেরিকার এক হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করেছেন। ওকে নিয়ে গেলেই অপারেশন হবে।
নিচ্ছ কবে?
সামনের মাসের দু তারিখে যাব। হাতে এখনো এক মাসের মতো আছে।
টাকা পয়সার ব্যবস্থা কী করেছ?
দিলশাদ সহজ গলায় বলল, জোগাড় করার জন্যে এখন পথে নেমেছি। প্রথমেই আপনার কাছে এসেছি।
আমার কাছে আসার দরকার ছিল না। আমি নিজেই তোমার কাছে যেতাম। তোমাকে তিন লাখ টাকা যাতে দিতে পারি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। ব্যবসা যারা করে তাদের কাছে ক্যাশ টাকা থাকে না। সাধারণ মানুষ এটা বুঝতে পারে না। খুব বড় বড় ব্যবসায়ীও দেখবে বিপদের সময় বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা বের করতে পারছে না। যাই হোক, তোমার টাকা কী পরিমাণ লাগবে?
অপারেশন আর হাসপাতাল খরচ লাগবে কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজার ডলারের মতো।
তার মানে প্রায় এগার লাখ টাকা লাগবে। তোমাকে আরো আটের জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
হ্যাঁ।
পারবে?
পারব।
ভেরি গুড। তুমি আটের ব্যবস্থা কর। আমারটা আমি ডলার করে তুমি প্লেনে উঠার আগে আগে তোমার হাতে দিয়ে দিব। কিংবা এমন ব্যবস্থা করব যেন আমেরিকায় তুমি ডলার পেয়ে যাও।
থ্যাংক য়্যু দুলাভাই।
থ্যাংকস দেয়ার কিছু নেই। নাতাশা শুধু তোমার মেয়ে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সে আমাদেরও মেয়ে। ওর খবর শোনার পর সারারাত আমি ঘুমুতে পারি নি। তোমার আপা চিৎকার করে কেঁদেছে।
দিলশাদ বলল, দুলাভাই, আপনার টাকাটা আমি ফেরত দেব। দেরি হবে, কিন্তু ফেরত দেব। আমি আপনার কাছ থেকে ভিক্ষা হিসাবে নিচ্ছি না। ধার হিসেবে নিচ্ছি।
ধার না ভিক্ষা এইসব পরে বিবেচনা করা যাবে। আপাতত আমরা আলোচনাটা অন্যখাতে নিয়ে যাই। তার আগে বলো কিছু খাবে? মনে হচ্ছে সরাসরি অফিস থেকে এসেছ। খিদে লেগেছে নিশ্চয়ই। সিঙারা খাবে?
খাব।
রিলাক্সড হয়ে বসো তো। বিপদ-আপদ থাকবেই। বিপদ-আপদ মাথায় নিয়েই আমাদের বাস করতে হবে। অবশ্যি গরম যা পড়েছে এতে রিলাক্সড হওয়াও কঠিন। বুঝলে দিলু, দেশটা মরুভূমি হতে বেশি বাকি নেই। কিছুদিনের মধ্যেই দেখবে কোরাবানির হাটে উট পাওয়া যাবে।
দিলশাদ স্বস্তি বোধ করছে। নিজের মুখে টাকা চাওয়ার বিড়ম্বনায় যেতে হয় নি। পৃথিবীর সবচে’ গ্লানিকর কাজ হচ্ছে টাকা ধার চাওয়া। যে চায় সেও গ্লানির ভেতরে পড়ে, যার কাছে চাওয়া হয় সেও পড়ে। এই গ্লানি কোনোভাবেই দূর হয় না।
দিলু!
জি।
পার্সোনাল একটা প্রশ্ন তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছি। কিছু মনে করো না। জবাব দিতে না চাইলে জবাব দেবার দরকারও নেই। মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করব বলে ভাবি। শেষে আর জিজ্ঞেস করা হয় না।
দিলশাদ শুকনো গলায় বলল, কী জানতে চাচ্ছেন বলুন।
সাজ্জাদের ব্যাপারটা কী বলো তো?
দিলশাদ হালকা গলায় বলল, বলার মতো কোনো ব্যাপার নেই।
তোমার এই দুঃসময় আর সে জঙ্গলে পড়ে আছে। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ফানি লাগছে।
দিলশাদ কিছু বলল না। অফিসের পিওন সিঙাড়া নিয়ে এসেছে। পিরিচে ঢাকা চা। দিলশাদ সিঙাড়া হাতে নিল। ওয়াদুদুর রহমান একটু ঝুঁকে এসে বললেন, তোমার আপার কাছ থেকে শুনলাম তোমার এবং সাজ্জাদের মধ্যে লিগাল সেপারেশন হয়ে গেছে। আমি অবশ্য তার কথায় কোনো গুরুত্ব দেই নি। তোমার আপার স্বভাবই হলো অকারণে কথা বলা। যেখানে সমস্যা নেই সেখানে সমস্যা দেখা। ইদানীং তার ধারণা, আই অ্যাম ইন লাভ উইথ অ্যানাদার উওম্যান। সেই উওম্যানের সঙ্গে আমি বিছানা শেয়ার করছি। তোমার আপা এ ভেরি স্ট্রেঞ্জ ক্যারেক্টার।
দিলশাদ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপা আমার ব্যাপারে ঠিকই বলেছে।
ঠিক বলেছে? বলো কী?
দিলশাদ লক্ষ করল ওয়াদুদুর রহমানের চোখ চক চক করছে। আনন্দের কোনো ঘটনা শোনার সময় মানুষের চোখ চক চক করে। এটা কি আনন্দের কোনো ঘটনা?
দিলশাদ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, আপা একটু বেশি বেশি বলেছে। সেপারেশন তো বটেই। ও থাকে এক জায়গায়, আমি থাকি আরেক জায়গায়। তার মানে কিন্তু ডিভোর্স না। তবে অনেক দিন থেকেই আমাদের সমস্যা হচ্ছে। আমরা মানিয়ে নিতে পারছি না। ঘৃণা পুষে একসঙ্গে বাস করছি। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে বাড়ি মাথায় তুলছি। লিগাল সেপারেশন হলে দুজনের জন্যেই ভালো। সব ভালো তো আর সবসময় হয় না। এখন যা হয়েছে তা হচ্ছে। মন্দের ভালো। দুলাভাই, এখন উঠি।
তোমার আপার কথা শুনে রাগ কর নি তো!
রাগ করব কেন? রাগ করার মতো কিছু তো বলেন নি।
আরো কিছুক্ষণ বসো। শালী-দুলাভাই গল্প তো কিছুই হলো না। নির্জন অফিস ঘর। শালী-দুলাভাই। এর মজাই অন্যরকম। হা হা হা। শোন দিলু, এক ঘণ্টার মধ্যেই আমার গাড়ি চলে আসবে। গাড়ি এলে আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব। এই এক ঘণ্টা ইন্টারেস্টিং সব জোকস বলব।
দুলাভাই, আরেক দিন এসে আপনার জোকস শুনব। রসিকতা শোনার মতো মানসিক অবস্থা আমার না। তারপরেও শুনব। আজ আমাকে ছুটি দিন।
এখন কি বাসায় যাবে?
না। কলাবাগানে বাবার কাছে যাব। আপনার সাহায্য যেমন চাইলাম, বাবার কাছেও সাহায্য চাইব।
উনাকে তো তুমি আজ পাবে না। আজ বুধবার না? বুধবারে উনি তাঁর পীর সাহেবের কাছে যান। সারারাত মারফতি সব ব্যাপার হয়। বৃহস্পতিবারে তিনি ফিরে এসে ঝিম ধরে থাকেন। হা হা হা। সরি, শ্বশুরকে নিয়ে হাসাহাসি করছি! ঠিক হচ্ছে না। তাছাড়া ঐ পীর ব্যাটার কিছু ক্ষমতা আছে বলেও মনে হয়। এট লিস্ট থট রিডিং-ফিডিং জানে। ঐ দিন কী হয়েছে শোন। আমি আব্বার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে গেলাম তার কাছে। কাছে গিয়ে বসতেই উনি আমাকে বললেন, বাবা, আপনার চামড়ার ব্যবসা কেমন হচ্ছে? আমি বলতে গেলে হতভম্ব।
আপনার কি চামড়ার ব্যবসা আছে?
আগে ছিল না, এখন শুরু করেছি। সেমি ফিনিশড লেদার এক্সপোর্ট করছি। পীর সাহেবের তো সেটা জানার কথা না, তাই না?
বাবার মতো আপনিও তাহলে উনার ভক্ত হয়েছেন?
কিছুটা তো হয়েছিই। আমি আবার অল্পতেই ভক্ত হয়ে যাই। তোমার প্রতি আমার ভক্তি যে কী পরিমাণে তা জানলে সর্বনাশ হয়ে যেত। এমন কোনো সপ্তাহ যায় না যে সপ্তাহে আমি তোমাকে স্বপ্নে না দেখি। কিছু কিছু স্বপ্ন আবার এক্স রেটেড। হা হা হা।
দুলাভাই, আমি যাই।
যাচ্ছ যাও। শুধু একটা কথা বলে দিয়ে যাও। এই বয়সেও বডি এরকম ফিট কী করে রাখ? তোমাকে দেখলে মনেই হয় না তোমার বয়স আঠার-উনিশের বেশি। তোমার আপাকে আমি প্রায়ই তোমার উদাহরণ দেই। লাভ হয় না কিছুই। কপকপ করে সারাদিন খায় আর থলথলা মোটা হয়। মোটা মেয়েমানুষ নিয়ে বিছানায় শোয়া যায়? বিদেশ হলে এতদিনে ডিভোর্স হয়ে যেত।
দিলশাদ কিছু বলল না। উঠে দাঁড়াল। দুলাভাইয়ের সব কথা সে ঠিকমতো শুনেও নি। আজকাল কী যেন হয়েছে, মন দিয়ে সে বেশিক্ষণ অন্যের কথা শুনতে পারে না।
ওয়াদুদুর রহমান খালি গায়েই শালীকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
.
দিলশাদ তার দুলাভাইয়ের অফিসে যখন গিয়েছিল তখন ঝলমলে রোদ ছিল। অফিস থেকে সে বের হয়েই দেখল আকাশ মেঘলা। বৈশাখ মাসের মেঘলা আকাশ ভালো না। হঠাৎ বাতাস দিতে শুরু করবে। দেখতে দেখতে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। নাতাশা ঝড় ভয় পায় না, বজ্রপাত ভয় পায়। বজ্রপাতের শব্দে আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ে। ছোটবেলায় আকাশ অন্ধকার হলেই দুহাতে কান চাপা দিয়ে বসে থাকত। মেয়েকে একা রেখে এরকম দিনে কোথাও যাওয়া ঠিক না। দুলাভাইয়ের কথা অনুযায়ী বাবাকে বাসায় পাওয়াও যাবে না। বাবার বাড়িতে যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে দিলশাদ নিজের বাসায় ফিরে যাওয়া ঠিক করে রিকশা নিল। রিকশায় চলতে শুরু করা মাত্র বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাস। দিলশাদ মত বদলাল, বাবার বাড়িতে যাওয়া ঠিক করল। সে নিশ্চিত বাবাকে পাওয়া যাবে না। তার পরেও সে রিকশাওয়ালাকে বলল, কলাবাগানের দিকে যেতে। তার হঠাৎ করেই মার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। সে মনে মনে ঠিক করল, যদি বাবা বাসায় না থাকেন, শুধু মা একা বাসায় থাকেন, তাহলে সে মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদবে।
.
হাদিউজ্জামান সাহেব বাসায় ছিলেন। বারান্দায় বেতের ইজিচেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছিলেন। তার বসার মধ্যে কেমন জবুথবু ভাব। সম্প্রতি দাড়ি রাখা ধরেছেন। গালভর্তি ধবধবে সাদা দাড়ি। সাদা দাড়ি মানুষের চেহারা কোমল করে, তাকে করে নি। তাঁর মধ্যে আলদা কাঠিন্য চলে এসেছে।
দিলশাদ রিকশা থেকে নেমেই বাবাকে দেখল। তিনিও মেয়েকে দেখলেন। মনে হলো তিনি ঠিক চিনতে পারছেন না। তিনি ভুরু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দিলশাদ বলল, কেমন আছ বাবা?
তিনি মাথা নাড়লেন। সেই মাথানাড়া থেকে ভালো-মন্দ কিছু বোঝা গেল না। দিলশাদ বলল, ভেবেছিলাম তোমাকে পাব না। শরীর ভালো আছে?
হুঁ।
বাইরে বসে আছ কেন? বৃষ্টি দেখছ?
হাদিউজ্জামান সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়ের মুখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। দিলশাদ বলল, দুলাভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম, উনি বললেন, আজ বুধবার, আজ নাকি তোমাকে পাওয়া যাবে না। বুধবারে পীর সাহেবের সঙ্গে তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে।
আজ যাই নি, শরীরটা খারাপ।
শরীর খারাপ? কী হয়েছে?
সব মিলিয়ে খারাপ, আলাদা করে বলার কিছু না।
মা বাসায় আছে বাবা?
না। কার বিয়েতে যেন গেছে। দুপুর দুটার মধ্যে চলে আসার কথা। এখন সাড়ে চারটার মতো বাজে। এখনো আসছে না। বেকুব মেয়েছেলে। আসতে দেরি হবে বলে গেলেই হতো। দুটার মধ্যে চলে আসব বলার দরকার কী? কাজের মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। এক কাপ চা যে খাব সে উপায় নেই।
আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি দুপুরের খাওয়া খেয়েছ?
হাদিউজ্জামান সাহেব জবাব দিলেন না। দুপুরের খাবার তিনি খান নি, স্ত্রীর উপর রাগ করেই খান নি। মেয়েকে তা বলতে ইচ্ছা করছে না।
দিলশাদ বলল, মা’র জন্যেই কি তুমি বারান্দায় বসে আছ?
হাদিউজ্জামান সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। কথা এমনিতেই তিনি কম বলেন। ইদানীং কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। নিজে তো কথা বলেনই না, অন্য কেউ কথা বললেও বিরক্ত হন।
দিলশাদ চা বানানোর জন্যে রান্নাঘরে চলে গেল। তার মা’র রান্নাঘর খুব গোছানো। একজন অন্ধও যদি রান্নাঘরে ঢুকে সে বলে দিতে পারবে কোথায় কী আছে। দিলশাদের ধারণা, তার মা’র রান্নাঘরের মতো পরিষ্কার ছিমছাম রান্নাঘর ঢাকা শহরে আর কারো নেই।
চা বানিয়ে দিলশাদ বারান্দায় চলে এলো। হাদিউজ্জামান সাহেব আগের মতোই বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিনি মেয়ের হাত থেকে অনাগ্রহের সঙ্গে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, নাতাশা কেমন আছে?
আগের মতোই আছে।
তোর মা’র কাছে শুনলাম ওকে বাইরে নিয়ে যাবার সবকিছু ফাঁইনাল হয়েছে।
হ্যাঁ।
ভিসা হয়েছে?
না।
মেয়ে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া তো বিরাট খরচান্ত ব্যাপার।
হ্যাঁ।
টাকা পয়সার ব্যবস্থা কী হয়েছে?
এর-তার কাছে চেয়ে-টেয়ে জোগাড় করছি।
ভিক্ষা?
দিলশাদ কঠিন গলায় বলল, ভিক্ষা না, ধার।
ধার শোধ করবি কীভাবে?
একটা ব্যবস্থা হবেই।
হাদিউজ্জামান সাহেব বিরক্তমুখে বললেন, ব্যবস্থা হবে বললেই তো আর ব্যবস্থা হয় না। তার জন্যে পরিকল্পনা থাকতে হয়। তোর পরিকল্পনাটা কী?
কোনো পরিকল্পনা নেই বাবা। ভাবার মতো সময় পাচ্ছি না। আমি যে কী পরিমাণে অশান্তিতে আছি তোমাকে বুঝাতে পারব না। রাতে ঘুমুতে পারি না। শেষরাতে ঘুমাই। ঘুমের মধ্যে কুৎসিত কুৎসিত সব স্বপ্ন দেখি। এত কুৎসিত যে ঘুমের মধ্যেই গা ঘিন ঘিন করে।
দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমি পীর সাহেবের কাছে তোর মেয়ের কথা বিস্তারিতভাবে বলেছি উনি বলেছেন, ভয়ের কিছু নেই। দুরুদে শেফা বলে একটা দুরুদ আছে। তিনি তোকে ঐ দুরুদ এগার লক্ষবার পড়ে মেয়ের দুই চোখে ফুঁ দিতে বললেন। ফুঁ দেওয়ামাত্রই রোগ আরাম হতে শুরু করবে ইনশাল্লাহ। এই দুরুদ তোকেই পড়তে হবে, অন্যকেউ পড়লে হবে না। বুঝতে পারছিস?
হুঁ, এগার লক্ষবার একটা দুরুদ পড়া তো সহজ ব্যাপার না।
রোগটাও তত সহজ না। কাশি না যে কফ সিরাপ খাইয়ে দিবি। জটিল ব্যাধি।
এগার লক্ষবার পড়তে অনেক দিন লাগবে।
লাগলে লাগবে। তুই শুধু নিগেটিভ দিক নিয়ে ভাবছিস কেন? রাত-দিন খেটে দুরুদটা পড়ে ফেল। তারপর কোনো ইমপ্রুভমেন্ট না হলে মেয়েকে বাইরে নিয়ে যা।
আমি বাবা ওকে দ্রুত আমেরিকা নিয়ে যাব।
দুরুদ পাঠ শেষ হোক, তারপর নিয়ে যা।
আমার হাতে এত সময় নেই বাবা।
হাদিউজ্জামান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোদের সবচে বড় সমস্যা হলো বিশ্বাসের সমস্যা। তোকে দোষ দিচ্ছি না। আমরা বাস করছি অবিশ্বাসের যুগে। আইয়েমে জাহেলিয়াতের সময় যে অবিশ্বাস ছিল এখন আবার আমরা সেই অবিশ্বাসের দিকেই যাচ্ছি। বড়ই আফসোসের কথা।
দিলশাদ নরম গলায় বলল, বাবা, আমি দোয়াটা পড়ব। অবশ্যই পড়ব। কিন্তু আমি দোয়া শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করব না।
হাদিউজ্জামান বিরক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দিলশাদ নরম গলায় বলল, তুমি আমাকে এখন কিছু সাহায্য কর বাবা। আমি জানি তোমার কাছে টাকা আছে। বেশি না হলেও আছে। যা আছে তুমি আমাকে দাও। আমি তোমার প্রতিটি টাকা গুনে গুনে ফেরত দেব।
কোত্থেকে দিবি?
দরকার হলে পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করব।
নাটক নভেলের মতো কথা বলছিস কেন? বাস্তব কথা বল। ফট করে বলে ফেললি পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করবি? ভিক্ষা করা এতই সহজ?
খুব কঠিনও না। এখন তো ভিক্ষাই করছি। বাবা, তুমি বলো তোমার কাছে কত টাকা আছে। যা আছে সব তুমি আমাকে দিয়ে দাও। কত আছে তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্টে?
হাদিউজ্জামান সাহেব মেয়ের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের উপর তার কোনো মমতা হচ্ছে না। রাগ লাগছে। বিপদ-আপদ মানুষের আসে। সেই বিপদ সামলাবার চেষ্টা করতে হয়। সাহসের সঙ্গে করতে হয়। মাথা নিচু করে বিপদ মোকাবেলা করা যায় না, মাথা উঁচু করে করতে হয়। তার উপর মেয়ের অবিশ্বাসও তাকে কষ্ট দিচ্ছে। বারবার জানতে চাচ্ছে ব্যাংকে কত আছে। আশ্চর্য!
সেভিংস অ্যাকাউন্টে তার আছে দুই লক্ষ তিন হাজার সাত শ’ তের টাকা। এটা গত মাসের হিসাব। ইন্টারেস্টে এক মাসে কিছু বেড়েছে। তিনি দিলশাদের নামে দুই লক্ষ টাকার একটা চেক কেটে রেখেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথা ছিল দুজনে মিলে চেকটা মেয়ের হাতে দিয়ে আসবেন। এতে মেয়ে অনেকটা সাহস পাবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিপদে অর্থ যে সাহস দেয় অন্য কিছু সেই সাহস দিতে পারে না।
হাদিউজ্জামান উঠলেন। আসরের নামাজের সময় হয়ে আসছে। অজু করা দরকার। তিনি দিলশাদকে বললেন, একটু বোস, আমি নামাজটা পড়ে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না।
দিলশাদ শুকনো মুখে বারান্দায় বসে রইল। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাজ পড়ছে। নাতাশার জন্যে তার খারাপ লাগছে। সে ভয় পাবে কিন্তু ফুলির মাকে ডাকবে না। একা একা কষ্ট পাবে। দিলশাদ ঘড়ি দেখল। দুটা বাজে। ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। কোনো অলক্ষণ কি? ঘড়ি কেন বন্ধ হবে? সেদিন মাত্র নতুন ব্যাটারি কেনা হলো।
হাদিউজ্জামান সাহেব নামাজ শেষ করতে অনেক সময় নিলেন। তিনি বারান্দায় এলেন চেক হাতে নিয়ে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটাকে এই টাকাগুলো দেয়ার তার ইচ্ছা ছিল। দেয়া হলো না। মনোয়ারা তার মেয়ের আনন্দিত মুখ দেখতে পেল না। এটা একদিকে ভালোই হয়েছে। মনোয়ারার জন্যে উচিত শাস্তি। কেন সে দুপুরে ফেরার কথা বলে এখনো ফিরছে না? তিনি না খেয়ে বসে আছেন। একা একা তিনি খেতে পারেন না। তার খাওয়ার সময় মনোয়ারাকে সামনে থাকতে হয়।
দিলু!
জি বাবা।
নে মা। এই চেকটা রাখ। দুই লাখ টাকার চেক। এখন ভাঙাবি না। ভাঙালে খরচ হয়ে যাবে। সেভিংস অ্যাকাউন্টের চেক, জমা দেবার আগে আমাকে বলবি। আমি ব্যাংক ম্যানেজারকে চিঠি দেব। আমার চিঠি ছাড়া এতগুলি টাকা তারা রিলিজ করবে না।
দিলশাদ চেক হাতে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ ভিজে আসছে। বাবা না হয়ে মা যদি চেকটা তাকে দিত তাহলে সে হয়তো চিৎকার করে কেঁদে একটা কাণ্ড করে বসত।
হাদিউজ্জামান সাহেব বললেন, সেভিংস অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে জানতে চাচ্ছিলি– দুই লক্ষ তিন হাজার সাতশ’ তের টাকা আছে। তিন লক্ষ টাকা ছিল, গ্রামের স্কুলে এক লক্ষ টাকা সাহায্য করেছি। ওরা একটা লাইব্রেরি বানিয়েছে। তখন তো আর জানতাম না তোর এতবড় বিপদ হবে।
দিলশাদের চোখ বেয়ে পানির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। হাদিউজ্জামান। সাহেব বললেন, বিপদে অস্থির হবি না। অস্থির হলে বিপদ কমে না। বিপদ বাড়ে। আরেকটা কথা তোকে বলি– টাকা-পয়সা যদি জোগাড় না হয় অস্থির হবি না। ভাববি এটাও আল্লাহর ইশারা। আল্লাহর ইশারা ছাড়া জগতে কিছু হয় না। তোর মেয়েকে আমার রোজ দেখতে যেতে ইচ্ছা করে। তোরা বাসা নিয়েছিস তিনতলায়। ডাক্তার আমাকে তিন ধাপ সিঁড়ি ভাঙতেও নিষেধ করেছে। ইচ্ছা করলেও যেতে পারি না। তোর মাকেও আমি তোর বাসায় যেতে নিষেধ করেছি। তার বিশ্রী কাঁদুনি স্বভাব আছে। সে নাতাশাকে দেখলেই এমন কান্নাকাটি শুরু করবে যে তোর মেয়ে ভয় পেয়ে যাবে। তার মনোবল যাবে ভেঙে। এই অবস্থায় মনোবল ভাঙা খুব খারাপ।
বাবা আমি যাই?
আচ্ছা মা, যাও।
যাই বলেও দিলশাদ দাঁড়িয়ে থাকে। তার ইচ্ছা করছে বাবাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। মনে হচ্ছে বাবাকে ছোঁয়ামাত্র বাবার ভেতর থেকে অনেকখানি সাহস তার ভেতর চলে আসবে। কিন্তু বাবার সঙ্গে তার দূরত্ব অনেক বেশি। হাজার ইচ্ছা করলেও বাবাকে সে ছুঁতে পারবে না, কিংবা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারবে না। হাদিউজ্জামান সাহেব দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাই বলেও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোরা সবসময় ইনডিসিশনে ভুগিস– এটা আমার অসহ্য লাগে।