১১.
কমলাকে ছেড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হয় রঘুনাথের।
আসার সময় কমলাও কেমন ম্লান বিধুর দৃষ্টিতে তাকায়। অনেক কিছু তার বলার থাকে, সে মুখ ফুটিয়ে বলতে পারে না। সময় তখন ঘোড়ার মতো লাফায়। গুছিয়ে রাখা কথাগুলো সব ছেঁড়া মালার ফুলের মত এলোমেলো হয়ে পড়ে। অন্য কোনো প্রসঙ্গ এসে গিলে নেয় নির্দিষ্ট সময়।
ইদানীং কলাবতীর পাশে ইচ্ছে করে ঘুমায় না কমলা। অজুহাত দেখিয়ে বলে, অনেক রাতঅবধি আমি রেডিও শুনি। রেডিওর নাটকগুলো কী যে ভালো একবার শুনতে শুরু করলে শেষ না শুনে ছাড়া যায় না। আমি রেডিও শুনলে তোমার ঘুম চটকে যাবে মা। তোমাকে তো ভোরে উঠতে হয়। তোমার কষ্ট হবে।
রঘুনাথ আসবে তাই মিথ্যে কথার জাল বোনে কমলা। ওর জন্য রাত জাগতে কোনো কষ্ট হয় না তার। জানলা খুলে নেশাগ্রস্তের মতো ঠায় বসে থাকে সে। দৃষ্টি নিবদ্ধ ধুলো পথের দিকে। তাঁতশালের মাকুর মতো রঘুনাথেরও আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে সে বুঝতে পারে না। সে জানে-চোরের দশ দিন তো মালিকের একদিন। সেদিনটাতে যে কী হবে। শিউরে ওঠে রঘুনাথ। কমলা তাকে সাহস জুগায়, ভয় পেও না। আমি তো আছি। পৃথিবীর সবাই একদিকে গেলেও আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। তাতে আমার যা হবার হোক। যে নিজের কাছে সাচ্চা, সে কেন অন্যকে ভয় পাবে।
কমলার ভালোবাসা ফুল ছুঁয়ে দেওয়ার মতো সুন্দর।
রঘুনাথ ওর ভালোবাসাকে ছুঁতে পারে, বুঝতে পারে। কমলা দল বেঁধে নাইতে আসে বুড়িগাঙে খরাবেলায়। কখনও সে চলে আসে পাকুড়তলার কলটাতে জল নিতে। এগুলো সব অজুহাত। যদি একবার রঘুনাথের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায় এই আশায়। আশা যে সবদিন পূরণ হয় তা নয়।
রঘুনাথের ঘাস ফড়িংয়ের স্বভাব। সে এক জায়গায় স্থিতু হতে জানে না। ইদানীং ওর বামুনপাড়ায় যাতায়াত বেড়েছে। সূর্যাক্ষ বন্ধুত্ব করেছে ওর সঙ্গে। দেবোত্তর ঠাকুরের বাড়িতে ওর এখন ঘনঘন যাতায়াত। কমলার মনটা অস্থির হয়ে ওঠে দ্বীপীর কথা ভেবে। দ্বীপীর মতো মেয়ে হয় না।
কমলার চোখের চাহুনি, চেহারা, কথা বলার ধরন দেখে দুর্গামণির মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে অনেকদিন আগে। রঘুনাথও নিজেকে বদলে নিয়েছে, সে এখন মায়ের কাছে ধোঁয়াশা দূরের জমি।
একদিন বাঁধের গোড়ায় দুর্গামণি ওদের দেখে ফেলে, এমন অন্তরঙ্গ মুহূর্ত গ্রামসমাজে অচল এবং দৃষ্টিকটু। কমলা হেসে গড়িয়ে পড়ছিল রঘুনাথের উপর। নির্বিকার রঘুনাথ প্রতিক্রিয়াহীন। ঘনিষ্ঠতা না থাকলে এমনটা সম্ভব নয়। কিন্তু এই অসম ঘনিষ্ঠতা দুটি সবুজ মনে আগুন ধরায়। সেই আগুন এক সময় তৈরি করে দাবানল। পুড়িয়ে খাক করে দেয় সংসার। ভয়ে দুর্গামণির চোখের তারা কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসে। রঘুনাথকে একলা পেয়ে কাছে ডেকে বলে, সুফল ওঝার মেয়েটার কি নাম রে? বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। রঘুনাথ মায়ের ভেতরের কথা আঁচ করতে পেরে চুপ করে থাকে। দুর্গামণি গলা চড়িয়ে বলে, ইখনকার ছেলেমেয়েদের কুনো লাজ-লজার বালাই নেই। ওরা যে নিজেদের কী ভাবে তা কে জানে। তা বাপ, তুরে এট্টা কথা বলি মন দিয়ে শুন। ঘরে তুর বাপ নেই। তুর কাকা থেকেও নেই। আপদ-বেপদ কিছু হলে আমি তুরে বাঁচাতে পারব নাই।
-কী বলতে চাইছো তুমি স্পষ্টাস্পষ্টি বলো তো? রঘুনাথের কথায় পোড়া লঙ্কার ঝাঁঝ।
-বলছিলাম কি ওই সুফল ওঝার মেয়েটার সঙ্গে বেশি ঢলাবি না। ওরা বড়ো ঘরের বিটি। ওদের গায়ে চট করে কাদা লাগে না। যত দোষ এই গরিব গুরবোদের-মনে রাখিস। দুর্গামণি আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলল, ওর লজর দেখে আমার ভালো ঠেকেনি। মন বলছে তুর উপরে মেয়েটার টান জমেছে।
-সে আমি কি করে বলব? আমি হাত গুনতে জানি না। রঘুনাথ মুখ বেঁকিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইল।
দুর্গামণি তাকে ছাড়ল না, সত্যি করে বলতো–কবে থিকে ওর সাথে তুর আলাপ?
-কী যা তা বলছো! রঘুনাথ মায়ের দিকে বেজার চোখে তাকাল।
–যা তা নয় বাপ। ঠিক বলচি। দুর্গামণি জোরের সঙ্গে বলল, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ লয়। আমি মা। আমাকে তুই ফাঁকি দিবি?
রঘুনাথ মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
দুর্গামণি ভাঙা গলায় বলল, বাপরে, এ কাজ তুর ঠিক কাজ হচ্চে না! পথ ছেড়ে দে। মেয়েটারে তুই যেতে দে। ওরে এটকে রাখলে তুর কষ্ট বাড়বে। সে-ও জ্বলবে।
রঘুনাথ বোবাদৃষ্টি মেলে তাকাল, মাকে তার বোঝানোর কোনো ক্ষমতা নেই। মার কাছে তাদের সম্পর্কটা যেন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
অন্ধকারে রঘুনাথ হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে। কমলার সঙ্গে দেখা হলে তার মনটা ফুরফুরে কাশফুলের মতো দোলা দিয়ে ওঠে। বুকের ভার কমে গিয়ে হালকাবোধ হয়। ঘরে ফিরে গিয়ে এখন তার ঘুম আসবে।
রাস্তার ধারে ঝাঁকড়া মাথার গাবগাছ অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে মূর্তিমানের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাবতলায় এসে দম নিল রঘুনাথ। এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে কমলার সঙ্গে দেখা করার কোনো অর্থ হয় না। সুফল ওঝা টের পেলে তার সর্বনাশ করে ছাড়বে। সুফল ওঝার রাগী মুখটা মনে পড়তেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল সে। ওই মুখটাকে সে আর দেখতে চায় না।
দূরে রাস্তার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসছে দু-জন লোক। ওদের একজনের হাতে হ্যারিকেন আর অন্যজনের হাতে লাঠি, কোদাল। ওরা শেকড়বাকড়ের খোঁজে পাশের ঝোপে গিয়েছিল। কিছু শেকড় অমাবস্যায় তোলার নিয়ম। নাহলে সঠিক প্রয়োগ ঘটে না। রঘুনাথ কিসের আশঙ্কায় গাছের আড়ালে চলে গেল। দূর থেকে সুফল ওঝার গলাটা সে ঠিক চিনতে পেরেছে। অসময়ে তাকে দেখলে হাজার প্রশ্ন ভেসে আসবে। চোর বলে সন্দেহ করতে পারে। ইচ্ছে করলে রটিয়ে দিতে পারে বদনাম। রঘুনাথ কোনো ঝুঁকি নিতে চাইল না। গাবগাছের আড়ালে গিয়ে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
সুফল ওঝার হাতের হ্যারিকেনটা দুলছিল। তার অন্য হাতে চটের থলি। মাটি সমেত শেকড়বাকড় বেরিয়ে আছে বাইরে। এগুলো ধুয়েমুছে সাফসুতরো করে তার ব্যবসা চলবে। ঝাড়-ফুক করে অবস্থা ফিরে গিয়েছে সুফল ওঝার। ঘরের খড়ের চাল সরিয়ে টিন দিয়েছে মাথার উপর। সেই টিনের চালে টিনের ময়ুর দোলে হাওয়ায়। দূর থেকে তা দেখতে পায় গ্রামের সবাই। অনেকের চোখ ঈর্ষায় করকরিয়ে ওঠে। সুফল ওঝার সেসব দিকে কোনো খেয়াল নেই। সে নিজের কাজে পাগল। নিজের ব্যবসা নিয়ে মাতাল।
দু-জন মানুষ গাবগাছ ছাড়িয়ে চলে যেতেই স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বাঁচল রঘুনাথ। তার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
রাতের আঁধারে শেকড় তোলার ঝুঁকি অনেক। ঝুঁকি ছাড়া আজকাল কোনো কাজ হয় না। কমলা হাসতে হাসতে বলে, ডরেছে কি মরেছো। আমার বাবাকে দেখো এই বয়সেও এ-গাঁ সে-গাঁ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওই মানুষটার কোনো ভয়ডর নেই।
আজ অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে রঘুনাথ। ভাগ্যিস সুফল ওঝা রাতকালে ঘরে ছিল না। ঘরে থাকলে বিপদ বাধত। বয়স বাড়লে মানুষের ঘুম পাতলা হয়।
রাস্তায় উঠে এসে রঘুনাথের ইচ্ছে করল দৌড়ে বাঁধের ধারে চলে যেতে। কিন্তু বাধ সাধল বৃষ্টি। গুড়গুড় শব্দে রাগ উগরাল মেঘ। হাওয়া এসে মারতে লাগল শপাং শপাং চাবুক। গাছ কেঁপে গেল, উড়ে গেল ধুলো। চোখে হাত চাপা দিয়ে রঘুনাথ ধুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। বৃথা সেই চেষ্টা। দুড়দাড় শব্দে বৃষ্টি নামল। ভোরের বাতাস ভিজিয়ে দিল জলের ধারা। শুধু গাছপালা নয়, রঘুনাথও ভিজে গেল জলের ছাঁটে। ভিজে সপসপে হয়ে ঘরে ফিরল সে।
দুর্গামণি এখনও জেগে আছে রঘুনাথের প্রতীক্ষায়। ছেলেকে বিছানায় না দেখে তার মনে চিন্তা মাগুরমাছের কাঁটা মেরেছে। আর ঘুমাতে পারেনি সে। ছেলেটা রাতকালে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কোথায় যায়, কেন যায়? এ-ও কি সেই নেশা? এই সবে ষোল ছাড়িয়ে সতেরোয় পা রেখেছে রঘুনাথ, এর মধ্যেই এত কিছু। দুর্গামণির সব হিসাব ওলোট পালোট হয়ে গেল। নিজের যৌবনকালের কথা মনে পড়ল। তখনও প্রেম-পীরিত সব ছিল। ছিল এক বন্য উগ্রতা। শ্যামের বাঁশি শুনে রাধা কি যায়নি যমুনায়! শুধু রাধা নয়, শ্যামও গিয়েছে ছুটে। তখনও চাঁদ ভাসত আকাশে, সূর্য হাসত পুবের কোণে। তবু দুর্গামণি কোনোমতে মেনে নিতে পারে না। অসহায়ভাবে সে রঘুনাথের মুখের দিকে তাকাল, বেছানা ছেড়ে কুথায় গেছিলিস এত রাতে?
-বাঁশতলায়। নামুচাপ পেয়েছিলো। রঘুনাথ হাত কচলায়।
–মিচে কতা কোস নে। ধমক দিতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠল দুর্গামণির, তুর বাপ ঘরে নেই। এখুন এসব কাজ কি তুর পক্ষে ভালো দেকায়। ধরা পড়লে সারা গায়ে ঢিঢি পড়বে। তখুন এই পোড়ামুখ নিয়ে বেরতে পারবি?
রঘুনাথ ঘাবড়াল না, দুর্গামণির চোখের দিকে সরাসরি তাকাল, কমলার সাথে দেকা না হলে আমার নিদ হত না। ওর সাথে দেকা করে এয়েচি, এতে পাপ কুথায়?
–পাপ থাকে মানুষের মনে। কার মুখ তুই চাপা দিবি, বাপ। দুর্গামণির থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথ বলল, যা সত্যি তাকে আমি চাপা দিব কেন যা সত্যি তার থেকে তো ট্যাঁক গজায়। সেই ট্যাঁক থেকে গাছ হয়। গাছ সেই থেকে ফুল হয়, ফল হয়। এসব যদি পাপ না হয়, তাহলে আমারটাও পাপ নয়।
-চুপ কর। ও কথা বলিস নে। দুর্গামণি বর্ষার বাদল মেঘের মতো ভেঙে পড়ল।
.
ঝমঝমানো বৃষ্টি থামতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল দুলাল। কাজ ছেড়ে বসে থাকা কাজের মানুষের পক্ষে সব চাইতে বুঝি কঠিন কাজ। চারপাশে জল ঝরে পড়ছিল টুপটাপ। অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছিল চতুর্দিক জুড়ে। ইন্দু চোখ ঘুরিয়ে বলল, হাঁ দেখো গো, মাত্রর ক’দিনের বরষাতে সব কেমুন পান্টি গেচে। গাছপালাকে চেনা যায় না, প্রথম বে-হওয়া ম্যায়ার মতো লাগছে।
দুলাল ভরসায় চোখে তাকাল, তা যা বলেচো। তারপরই তার কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে গেল, এতবার এলাম-গেলাম তবু মনটা ও-দেশে বাঁধা পড়ল না। আমার এই দেশটা কতো সোন্দর গো। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। ভালো করে দেখলে আর চোখ ঘুরানো যায় না।
বৃষ্টি থেমেছে কিন্তু হাওয়ায় ভাসছে জলীয়ভাব। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ জলকণা আত্মগোপন করে আছে বাতাসে। কদিনে অশ্বত্থগাছের পাতা আরও লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছে জলের সোহাগে। আখ খেতের দিকে তাকালে আর চোখ ঘোরানো যায় না, প্রতিদিনের দেখা আখগাছগুলো যেন স্ফুর্তিতে টগবগিয়ে উঠছে গাঙ পালানো হাওয়ায়। আলোর ঘাসও স্পর্ধা নিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।
দুলালদের যাওয়ার সময় ভূষণীবুড়ির গলা বুজে আসে কান্নায়। যত না কান্না আসে তার চেয়ে বেশি আসে কাঁপুনি। ছেলে বউ বাইরে থাকার অর্থ ভ্যারেণ্ডা গাছের মতো একা হয়ে যাওয়া। লোক বলে-একা না বোকা, ঠিক কথা। একা মানুষের মনটা সব সময় যেন ডানা ভাঙা পাখি, উড়তে পারে না। শুধু চিন্তা ভাবনার মেঘগুলো হানা দিয়ে কালো করে দেয় মুখখানা। দুলাল চলে যাওয়া মানে কলিজা উপড়ে বুড়িগাঙে ভাসিয়ে দেওয়া। অনেকদিন পরে ভূষণী বুড়ির সুবর্ণার মুখটা মনে পড়ল। সময় নদীর স্রোতের চেয়েও দ্রুতগতিতে বয়ে গেছে। সময়কে আটকে রাখবে এমন বলবান কোথায়? সুবর্ণা ধাওড়া পাড়া ছাড়ার আগে বলেছিল–সে আবার আসবে। কত বছর চলে গেল, ফি-বছর অশ্বত্থ গাছে নতুন পাতা গজায়, নতুন আলো এসে সেই তেল চকচকে পাতায় চুম্বন এঁকে দেয়, সব কিছুই হয় চারপাশ জুড়ে…শুধু কথা দিয়ে যাওয়া সুবর্ণা আর ফেরে না। সেদিন সুবর্ণাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল, ভূষণীবুড়ির মনে হচ্ছিল সুবর্ণাই নীলকণ্ঠর আসলি জোড়া। এ যেন যেমন হাঁড়ি তেমন সরা, একেবারে মাপে মাপে। বাবুঘরের বিটিদের খেয়াল-খুশি বোঝা দায়। সুবর্ণা যদি হিসাব মতো দুলালের পাশে দাঁড়াত তাহলে ছেলেটাকে আজ মাথায় বোঝা নিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে ভিন দেশে খাটতে যেতে হত না। ওদের অনেক ছিল। দুলাল কি তার থেকে কিছু পেতে পারত না? আসলে স্নো-পাউডার ঘষা সুর্বণা যা বলেছিল তা শুধু কথার কথা। একটা দীর্ঘশ্বাস ভূষণী বুড়িকে হারিয়ে দিয়ে মিশে গেল বাইরে। ভূষণীবুড়ি গলার কাঁপুনি থামিয়ে কোনোমতে বলল, শরীলের উপর লজর দিবি। শুধু কাজ কাজ করে শরীলটাকে ধসিয়ে দিবি তা যেন না হয়।
এবার ইন্দু সরে এল ভূষণীবুড়ির সমর্থনে, মা, তুমার বিটা আমার এট্টা কতাও শুনে না। মানা করলে আমারে করে মারতে আসে। লোকজন কুনো মানামানি নাই।
-ওঃ, মারবে সস্তা! তুমারে মারতে আসলে তুমিও চড়ে বসবা। ছাড়বা না। ভূষণীবুড়ি উল্টো সুরে রামায়ণ শুরু করল, তুমার শ্বশুরও অমন ত্যাড়াবেঁকা ছিল। নিশা করতে মানা করলে গজরাত। তবে আমিও কম ছিলাম না। দেশী মদের বোতলে আমি কাঁচা তেঁতুল সিজিয়ে মাড় করে রেখে দিতাম। ইবার কত খাবি খা। খাওয়া তো দূরে থাক রাগে শুধু খাবি খেত মানুষটা। অতীত একবার পিছু ধরলে ঘর ফেরে না। ভূষণীবুড়ি ছেলের মাথায় হাত রাখল, মেয়েটার লিয়ে ভাববি না। আমি তো আচি, আমি তো মরে যাইনি। বেশি বেগারবাই দেখলি পরে সে ঢ্যামনারে আমি টাইট দিয়ে ছেড়ে দিব। হারামীর ছানাটা ভেবেচেটা কি। ইবার কিছু হলে কতো ধানে কত চাল হয় তা আমি গুনে গুনে জামাইবাবাধনকে দেখিয়ে দেব। তুই মন শান্তি করে যা।
গরম দুধ জুড়ানোর মতো মনটা কি সহজে জুড়োতে চায়!
বিন্দুমণিকে নিয়ে দুলালের চিন্তার শেষ নেই। বিয়ের পরে রোজ তাকে চোখের জল ফেলতে হয়। রোজ শ্রীকান্ত তাকে লেবু চিপকানোর মতো চিপকায়। এমনিতে সংসারের যাতাকলে ভুষি হয়ে গিয়েছে তার জীবন, তার উপর ঘরের মানুষটার অত্যাচার তার মাথাটাকে বিগড়ে দিয়েছে।
দুবেলা খেতে পেলে কি সুখে থাকে মেয়েরা?
ইন্দু তবু মেয়েকে বোঝাতে কসুর ছাড়েনি। দুলালও তার পাশে ছিল সেই সময়। চোখের জল মুছে বিন্দু তাদের বলেছিল, তুমরা যাচ্ছ যাও। ও বেশি কিছু বাড়াবাড়ি করলে আমি পুটলি বেঁধে ঘর ফিরি যাবো। আর আসবো নি। কেনে আসব? আমার পিঠের চামড়া কি মোষের? শুধু পড়ে পড়ে মার খাবো। তুমরা কুনোদিন আমাকে মারোনি। ও কুথাকার কে হরি গো?
বিন্দুর মনের সব ক্ষোভ জ্বালা অশান্তি জড়ো করলে পণ্ডিত বিলের চাইতে আড়েবাড়ে বড়ো হবে। অশান্তির পাক আর ঘাঁটতে চায় নি দুলাল। বসন্তপুর ধ্যাওড়ার মুরুব্বির হাত ধরে বলেছে, খুড়াগো, মেয়েটা রইল, ওরে দেকো। ও তুমাদের লাতনির বয়সী গো। ভুলচুক করলে ওরে নিজের ভেবে মানিয়ে নিও। তারপর বেয়াই মশাইয়ের হাত ধরে সে কী বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। বেয়াই মশাই পেছনের মালাইচাকি চুলকে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ভয়ের কিছু লাই, চিন্তার কিছু লাই। সব ঠিক হয়ে যাবেন। তুমার ঘরের বিটি তো আমার ঘরের বিটি। ওসব নিয়ে ভেবো না। মন হালকা করে যাও। কাজ থিকে ফিরলে আবার এসে দেকা করে যেও।
জামাইয়ের দাবি ছিল সাইকেলের। এ বাজারে একটা সাইকেলের দাম মেরে কেটে মেলা টাকা। এত টাকা আসবে কোথা থেকে? ভাবতে ভাবতে দুলাল যেন বুড়িয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ইন্দুবালাই চিন্তামুক্তির আলোটা দেশলাই কাঠির মতো ফস করে জ্বেলে দিল, যে চার কাঠা জমিন আচে ওটা বেচে দাও। মানুষ থাকলে অমন জমিন ঢের হবে।
–দায়ে-অদায়ে শুধু ওইটুকুই তো ছিল! দুলালের চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল।
ইন্দু তাকে বুঝিয়ে বলল, দায়ে-অদায়ে তো প্রয়োজনের জিনিস লাগে গো। মেয়েটা ভালো থাকলে, ওর মুখে হাসি ফুটলে আমাদের আর বুড়া-বুড়ির কি চাই।
-ঠিক আছে, তুমার মতই আমার মত। দুলাল ঘাড় গুঁজে চলে গিয়েছিল গোঁসাই পাড়ায়। মাঝের গাঁয়ের নীলু বামুন বন্দকী কারবার করে। জমিটার উইল বাঁধা দিয়ে যদি কিছু টাকা দেয়? সুদ যা লাগবে শোধ করে দেবে সে।
বেঁচে থাকলে কারোর টাকা সে মারবে না।
নীলাক্ষ কথা রেখেছিলেন। সব শুনে বললেন, ঠিক আছে ঢাকা আমি দেব কিন্তু মুনিষ খেটে ফিরে আসার পর আমার টাকা ফেরত দিতে হবে। তখন আমি একদিনের জন্যও টাকা ফেলে রাখতে পারব না।
-সে ভাবতে হবে নি বাবু। গরিবের কতা চট করে নড়চড় হয় না। দুলাল অনুগত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে হাত কচলায়।
লেখাপড়া শেষ হলে টিপছাপ দিল দুলাল। টাকাগুলো গুণে নিয়ে সে আর দাঁড়াল না। সোজা বাঁধ ধরে চলে এসেছিল ঘরে।
বেয়াইঘর থেকে ফেরার সময় তেড়েফুঁড়ে বৃষ্টি এল। বেলগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়েও শরীর বাঁচাতে পারল না ওরা। ফাঁকা জায়গায় মাথা বাঁচানো দায়। ভিজে-নেয়ে ওরা ফিরে এল ধাওড়াপাড়ায়। তারপর থেকে শুরু হয় ফেরার মহড়া। বুকের পাথর নেমে যেতে বড়ো খুশি খুশি দেখাচ্ছিল দুলালকে, ইবার শান্তি মনে যেতে পারব। বেয়াই-মশাই আমার গা ছুঁয়ে কথা দিয়েচে-মেয়েটার কুনো ক্ষতি হবে না। আঃ, আজ বড়ো ভাল লাগছে গো!
বিদায়পর্ব শেষ হতেই বাঁধে উঠে এল ওরা।
দুলাল মুখ মুছে নিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। অন্তত জনা পনের ছেলে-মেয়ে মাঝবয়েসী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তাদের দেখার জন্য। সাধারণত এপাড়ার খুব কম মানুষ বাইরে যায়। বাইরে যাওয়া বললে ওদের কাছে বড়োজোর দেবগ্রাম–বেথুয়াডহরী নয়ত কালীগঞ্জের হাটে যাওয়া। এই যাওয়াতেও বিচ্ছেদের ব্যথা আছে।
পথের এক পাশে দাঁড়িয়ে চোখ টান করে বাঁধের দিকে হাপুস নয়নে চেয়েছিল ভূষণীবুড়ি। ধীরে-ধীরে ছোট হয়ে আসছিল ওদের দৃশ্যমান শরীর। বাঁক পেরতেই ওদের আর দেখতে পেল না সে। সাদা শাড়ির ময়লা আঁচল দাঁত দিয়ে চিপে শরীর বাঁকিয়ে কেঁদে উঠল সে। এমন সশব্দ ভগ্ন কান্নার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউ। সচকিত মানুষ এবার দৃষ্টি ঘোরাল ভূষণীবুড়ির উপর। সহানুভূতি, সমবেদনায় কলকলিয়ে উঠল জড়ো হওয়া গ্রামীণ মানুষ। বাতাস শুধু শুনতে পেল কাতর ভূষণীবুড়ির কণ্ঠস্বর, ইবার আমার কী হবে গো, ইবার আমি কারে লিয়ে থাকবো গো-ও-ও। আমার কলিজার ধন, পরানের টুকরা মুনিষ খাটতে চলে গেল গো-ও-ও-ও।
দুহাতে ধুলো আঁকড়ে ভূষণীবুড়ি মাটির মা হয়ে উঠল ক্রমশ।
.
১২.
টানা বৃষ্টিতে পুরো নেতিয়ে গিয়েছে কালীগঞ্জের অঞ্চল।
জগৎখালি বাঁধের উপর এখন প্যাচপ্যাচ করে কাদা। চন্দন রঙের ভেজা মাটি পেছল বড়ো। পা টিপে টিপে সাবধানে না হাঁটলে যে কোনো সময় বেসামাল হবে এই শরীর। চুনারাম এখন তাই ভয়ে বাঁধের উপরে খুব কম যায়। নেহাত ঠেকায় না পড়লে সে এড়িয়ে যায় বাঁধ ধার।
এখন বাঁধে দাঁড়িয়ে পুরো পণ্ডিত বিলটাকে দেখতে পায় গাঁয়ের মানুষ। বিল যেন ফুলেফেঁপে সাগর। সেখানে দিন রাত তালডিঙা নিয়ে মাছ ধরছে জেলেবস্তির লোকেরা। শুধু মাছ নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসেছে বিলে। বর্ষার সময় ডাহুক আর মেছো বকের চেহারা বুঝি পাল্টে যায়। গুড়গুড়ি বালিহাঁসগুলোকে যেন চেনাই যায় না। ওরা ডুব দেয়, কিছু দূরে গিয়ে আবার ওঠে। আবার ডুব দেয়, আবার ওঠে…এভাবেই চষে বেড়ায় সারা বিল। ওদের কালো কুচকুচে পাখনা থেকে তেল গড়ায়। চকচক করে পুরো শরীর। ওদের ছানাগুলো মা-বাবার পিঠের উপর চেপে আকাশ দেখে, বিলের জলের শোভা দেখে মোহিত হয়। শুধু মন খারাপ মেছেচিল আর মাছরাঙার। ভরা বিলে মাছের হদিশ পেতে তাদের কালঘাম বেরিয়ে পড়ে। এই বাড়তি জল সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের। জল না মরলে মনের মতো শিকার পাওয়া যাবে না। তখন পোকামাকড় ব্যাঙ গেঁড়ি-গুগলি খেয়ে বাঁচতে হবে।
বৃষ্টি হলে পিছু-নাচানো পাখিগুলোর সুখ ধরে না। ওরা নলখাগড়ার ঝোপে বসে মজা দেখে। কখনও ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় জলশোলার বনে। এখন বিল সবুজ হয়ে আছে জলশোলাগাছে। শুধু জলশোলা নয়, কত যে বুনোফুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নাকছাবির মতো ফুটে আছে বিলের জলে-যার দিকে একবার তাকালে চোখ ফেরাতে পারে না রঘুনাথ। চোখের আর কী দোষ। গত সাত-আটমাস বৃষ্টি হয়নি একফোঁটা। খটখটে মাটি ভাপ ছাড়ছিল হরদম। চারপাশে শুধু পাতা ঝলসে যাওয়ার কুঁচুটে ঘ্রাণ। এখন চারপাশ জুড়ে শুধু সবুজের সুঘ্রাণ বাতাসে ভাসছে, পুরো এলাকাটাই হঠাৎ করে ধনী হয়ে উঠেছে বৃষ্টির জাদুস্পর্শে।
রঘুনাথ খেজুরগাছটার গোড়ায় এসে দাঁড়াল।
এসময় কমলার আসার কথা। লোকমুখে খবর পাঠিয়েছে সে। তার বিশেষ কী যেন দরকার। কী যে দরকার-ভাবছিল রঘুনাথ।
ক’দিন থেকে তার মনের অবস্থাও ভালো নেই, মেঘলা হয়ে আছে সব সময়। দুর্গামণির ভীতু চোখের দিকে সে এখন আর তাকাতে পারে না। ওর মনে ভয় ঢুকেছে। সে ভয় তাড়াবে কে? দুর্গামণির ধারণা হয়েছে-রঘুনাথকে সুফল ওঝা মেরে ফেলবে। এই অসম প্রেম সে কোনোদিন মেনে নেবে না।
কাশীনাথও মুখিয়ে আছে রঘুনাথকে জব্দ করার জন্য। এক কোপে পেলে সে আর দুকোপে যাবে না। বুনোপাড়ার ছেলে হয়ে তার বোনের হাত ধরেছে, ভাবা যায়? ঘোর অপরাধ। এই জঘন্য অপরাধের চরম শাস্তি হওয়া দরকার। শাস্তি যাতে সঠিক ভাবে দেওয়া যায় সেইজন্য গোপনে প্রস্তুত হচ্ছে সে।
রঘুনাথের এখন সামনে সমূহ বিপদ। তবু সে কমলার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে এসেছে। কতদিন দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। রাতে সে ছটফট করে, ঘুম আসে না। চোখের তারায় কমলার ছবি নড়ে ওঠে সর্বদা। মনের ভেতর কমলা পোষমানা টিয়াপাখির মতো কথা বলে।
আনমনে হাঁটতে গেলে হোঁচট খায় রঘুনাথ। হু-হু করে জ্বলছে বুড়ো আঙুলটা। কষ্ট হজম করে রঘুনাথ রাস্তার দিকে তাকাল। এদিকটা বেশ নির্জন। ফাঁকা ফাঁকা।
হেলেপড়া খেজুরগাছে বসে আছে মাছরাঙা পাখি। পাখিটারও চিন্তা। পাখির আবার কিসের চিন্তা-রঘুনাথ ভাবল। ওদের আকাশ আছে। খাঁচার চাইতে আকাশ কত বড়ো। ওদের গোপন ব্যাধির মতো ছোট জাত বড়ো জাত নেই। ওদের ধনী দরিদ্র নেই। ওরা সবাই মাছরাঙা।
বিলের জলে মুখ ভেঙ্গাচ্ছে সরু সরু ধানগাছ। গাছগুলো জল পেয়ে সব বেড়ে গেছে। ওসব গাছে ধান হবে না। দিনভর শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে খাড়া তীরের মতো। ওরা যে দাঁড়িয়ে থাকে দিনের পর দিন-ওদের কষ্ট হয় না।
জলা ধানগাছগুলোর ভেতর দিয়ে এঁকে-বেঁকে ঢোঁড়াসাপটা চলে গেল। রঘুনাথ দেখল ওদের গতিময় যাতায়াত। হাসি পেল। যেন অকাজের লোক, বেশি কাজ দেখাচ্ছে। ওদের চাইতে মেটে সাপগুলো ঢের ভালো। গায়ে পা পড়ে গেলেও ফুঁসে ওঠে না, মাটির চেয়েও শান্ত। শুধু ঝামেলা হয়, বুক ধকধকিয়ে ওঠে হঠাৎ ফণা তুলে দাঁড়ানো মাঠ খরিসসাপকে দেখলে। পালাবে না ছোবল মারবে–তা ওদের চোখ দেখে বোঝা যায় না। শুধু শরীর টানটান করে সতর্ক থাকতে হয়। না হলে বিপদ। ওরা তো সাক্ষাৎ যম। রঘুনাথের গা সিরসিরিয়ে উঠল।
দূর থেকে রঘু দেখতে পেল ছাতা হাতে নিয়ে কমলা আসছে, ওর পাশে দশ-বারো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। সম্ভবত ওর কাকা-জেঠার মেয়ে। ওর মা পাঠিয়েছে পাহারা দেবার জন্য। যে-ই পাঠাক না কেন, রঘুনাথ আজ ভয় পাবে না। সে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। হুমড়ে পড়া হাওয়া বাঁচাল শরীরে ছুটে গেল বিলের দিকে। খলবল করে নড়ে উঠল জল। ঢেউ উঠল ছোট-ছোট। রঘুনাথ বুঝতে পারল, ওগুলো ঢেউ নয়, হাসির ঝলক।
প্রেমে পড়লে মানুষ শুকনো গাছে ফুল দেখে। তখন ভূত-ভবিষ্যৎ ভুলে যায়। মাঝ বিলের তালডিঙার মতো প্রেমের ভবিষ্যৎ, এই ভেবে নিশ্চিত হলো রঘুনাথ। কমলা সব ব্যাপারে সাহসী। সংকোচহীন।
সে এসে নুয়ে পড়া খেজুরগাছটার পাশে এসে দাঁড়াল। তার পাশে ঠাকুরের ঘটের মতো দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা। কমলা অস্বস্তি কাটিয়ে বলল, তোমাকে আমার ভীষণ দরকার। আজ বেথুয়া থেকে আমাকে দেখতে লোক এসেছিল। আমাকে দেখে ওদের পছন্দ হয়েছে। আজই পাকা কথা বলতে চায়। আমি রাজি হইনি। ওরা আবার দশ দিন পরে আসবে।
কমলা মন খারাপ করা চোখে তাকাল, ওর কাঁদো-কাঁদো মুখ। রঘুনাথ বিল থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, হঠাৎ করে যে এত বিপদ এসে যাবে ভাবতে পারি নি। কী যে করব, মাথায় কিচু ঢুকচে না।
-তোমাকেই তো ভাবতে হবে। এখন বোবা হয়ে থাকলে বিপদ ঘটে যাবে। কমলার গলা কঠিন হয়ে উঠল ধীরে-ধীরে, আমি আর পারছি না ঘরবার সামলাতে। তাছাড়া আমার অত শক্তিও নেই। এ সময় আমার পাশে তোমার দাঁড়ানোর দরকার।
-বলো আমারে কী করতে হবে?
কমলা দুঃসাহসী হয়ে উঠল, চলো, আমরা পালিয়ে যাই।
কুথায় পেলুবো? বড়ো অসহায় শোনাল রঘুনাথের গলা।
–যেদিকে দুচোখ যায়। এত বড়ো পৃথিবীতে পালাবার জায়গার কি অভাব? শুধু ইচ্ছেটা থাকলেই হবে। জোর করল কমলা।
পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা কী ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ওকে কিছু বলতে হল না, ও পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল বিলের ধারে। আলোচনার গুরুত্ব বুঝে বোবা হয়ে গিয়েছে মেয়েটা।
ভুল করে শ্বাস ছেড়ে কমলা যেন রুইমাছের মতো ভেসে উঠল, যা বলার এখনই বলো, আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। দোকানে যাচ্ছি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি। তবু মা সঙ্গে বোনকে পাঠাল।
–তুমি যদি সুফল ওঝার মেয়ে না হতে তাহলে আমি আরও জোর পেতাম।
–সুফল ওঝার মেয়ে হওয়া কি পাপের?
-না, তা নয়। রঘুনাথ কমলার মন জুগিয়ে বলল, তুমি যা আমাকে করতে বলবে তাতেই আমি রাজি আচি।
-তাহলে ঘর কবে ছাড়বে?
–যেদিন তুমার মন হবে।
-বেশ। এখন আমি আসছি। কমলা এগিয়ে গিয়ে তার বোনকে ডাকল, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে রঘুনাথকে একবার দেখল। রঘুনাথের দু-চোখে বিছিয়ে গিয়েছে শঙ্কা। এর পরিণতি কোথায় তা সে জানে না। সে শুধু জানে–তার কমলা আছে, কমলা থাকবে। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। ঘরসুদ্ধু মানুষ এ বিয়েতে মত দিয়েছে। তার বাবা গর্ব করে বলছে, মেয়ে আমার বড়ো ঘরে পড়বে গো! এই পচা গা ছেড়ে মেয়ে আমার ঢেউনের বাসিন্দা হবে। সবই মা মনসার কৃপা। হাঁড়ির ঝি চণ্ডীর দয়া।
কাশীনাথ কমলার বিয়ে নিয়ে তেমন বেশি আগ্রহী নয়। কেন না কমলা তার মান-সম্মান রেখে কথা বলে না। আজকাল তার ব্যবহার অনেকটাই পাগলের মতো। চাহনিও বদলে গিয়েছে পুরোপুরি। সংসারের কাজে-কর্মে তার মন নেই। সব সময় কী যেন ভাবতে থাকে সে। কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে। বোনের এই অন্যমনস্ক মনটাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না কাশীনাথ। হাজার বুঝিয়ে যখন কাজ হল না, তখন হাল ছেড়ে দিয়েছে সে। কমলাও চায় না দাদা গায়ে পড়ে তার সঙ্গে আলাপ করুক।
যার এত অনীহা, সেই কাশীনাথ খুশি হয়েছে পাত্রর সঙ্গে কথা বলে। মেয়ে দেখে পছন্দ হয়েছে ছেলের মা এবং আমার। ওরা পণ নেবে না, খালি হাতেই বৌ করে নিয়ে যাবে কমলাকে।
কলাবতী এতটা আশা করেনি। কমলাকে আড়ালে ডেকে সে বুঝিয়ে বলল, যাচা অন্ন ছাড়তে নেই মা। পরে তাহলে কপাল চাপড়াতে হয়। কমলা ঠোঁট কামড়ে বলেছিল, এ বিয়েতে আমার মত নেই, মা।
মত নেই, তার মানে? হাঁ-হয়ে গিয়েছিল কলাবতীর মুখ, এত ভালো ছেলে। এ ছেলেকে না করে দিলে শেষে তোর কপালে কানা-খোঁড়া জুটবে। তাছাড়া তোর মামা এনেছে সম্পর্কটা। মামার মান-সম্মানের কথা একবার ভাববি নে, মা।
বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। এ নিয়ে আমি কোনো আপোষ করতে চাই না। কমলার গলা থেকে ঝলকে ঝলকে নেমে এল বিরক্তি, আমাকে জোর করো না। জোর করলে এর ফল মারাত্মক হবে।
-তোর বাবাকে আমি কী বলব? মহাফ্যাসাদে পড়ে কলাবতী তাকাল।
–যা হোক একটা কিছু বানিয়ে বলে দাও।
–মিথ্যে কথা বলব?
–মিথ্যে কথা তো তুমি নিজের জন্য বলছো না, আমার জন্য বলছো। মেয়ের ভালোর জন্য মিথ্যে কথা বললে তোমার কোনো পাপ হবে না। কমলা নির্দ্বিধায় বলল কথাগুলো।
বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে সময় নেয় কলাবতী। এ কী শুনছে সে। দিনে দিনে মেয়েটার এ কী হলো? এই কমলাকে সে তো আগে চিনত না। যে মেয়েটা ভালো করে গুছিয়ে কথা বলতে পারত না, তার মুখে এমন কথা কে জুগাল? আর ভাবতে পারছিল না কলাবতী। মাথাটা বড্ড ধরেছে। মনে হয় চোরা গ্যাস- অম্বলের ফল।
মেজাজটা খিটখিটে হয়ে উঠল কলাবতীর, ওই বুনো ছেলেটার সঙ্গে তোর শেষ কবে দেখা হয়েছিল?
কমলা অকপটে বলল, ওর সাথে আমার রোজই দেখা হয়।
-কাজটা ভালো করছিস না, কমলা।
-ভালো-মন্দ আমি জানি না। আমার মন যা চায়, আমি তা করি। কমলা জেদ ধরে দাঁড়াল। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ে সে যেন অবজ্ঞাকে ছুঁড়ে দিতে চাইছিল কলাবতীর মুখের উপর।
কলাবতী আশ্চর্য হয়ে বলল, তুই যে এত বদলে যাবি আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তোর বাবার এত নামডাক। তার মেয়ে হয়ে তুই যদি এসব করিস তাহলে লোকে কি ভাববে?
-কে কি ভাবল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কলাবতীর মুখের দিকে তাকাল কমলা, তুমি এখন যাও মা। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। তবে একটা কথা, জোর করতে যেও না।
–জোর করব না? কলাবতীর কণ্ঠস্বরে বিস্ময়, আমি চাই–তোর ভালো হোক। তুই সুখি হ।
–তাহলে আর কেন কথা বাড়াচ্ছ। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
-তুই এখনও আগুন আর জলের ফারাক বুঝিস না। তোর উপর কি সব ছেড়ে দেওয়া যায়, নাকি তা সম্ভব!
-তা যদি না পারো তাহলে তোমারই কষ্ট বাড়বে। কমলা জোরের সঙ্গে বলল, একটা পাগলও নিজের ভালোটা বোঝে। আমি তো পাগল নই, পুরোপুরি সুস্থ। তাহলে আমি কেন নিজের ভালো বুঝব না?
-যা ভালো বুঝিস কর তবে ভেবে-চিন্তে। পরে যেন কাঁদতে না হয়।
-কাঁদব না মা, আমি তো তোমার মেয়ে। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে কমলা তার কষ্টটাকে বশে রাখার চেষ্টা করল।
কমলা চলে যাওয়ার পর বিলের ধারটা বড়োই ফাঁকা লাগছিল রঘুনাথের। এমন যে ঝড় উঠবে ভাবতে পারেনি সে। মন টলে গিয়েছে বারবার। কমলার যা মানসিক শক্তি, সেই শক্তি রঘুনাথের ভেতরে কেন জন্ম নিল না? কেন বারবার হেরে যাচ্ছে সে। কেন দু’পা এগিয়ে পিছিয়ে আসছে দশ পা? এ অবস্থায় একবার যদি সূর্যাক্ষর সঙ্গে দেখা হত তাহলে বুক উজাড় করে সব কিছু বলতে পারত রঘুনাথ। সব শুনে সূর্যাক্ষ তাকে সঠিক রাস্তাটা দেখিয়ে দিতে পারত। অনেকদিন হল মানিকডিহি যাওয়া হয় নি তার। সময়গুলো বুনো খরগোসের মতো ছুটে পালিয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে রঘুনাথের মনে পড়ে গেল হাবুল চোরের কথা। লুলারামও তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে পারে। ওদের অভিজ্ঞতার মূল্য তাকে দিতেই হয়। ওরা ঝুরি নামানো বটগাছের মতো।
লুলারামের প্রস্তাব মেনে নিলে টাকার কোনো অভাব হবে না রঘুনাথের। সে জানে–অর্থবল মহাবল। এর কোনো বিকল্প নেই। গ্রামসমাজে চট করে কেউ টাকা দিতে চায় না। অনেকেই টাকাকে ভালোবাসে নিজের চাইতে। সেই টাকার জন্য সে যদি একটু নীচে নামে তাহলে দোষ কোথায়? হাতে টাকা এলে কমলার সব অনুরোধ সে মেনে নিতে পারবে। কমলাকে আর দুঃশ্চিন্তার বোঝ মাথায় নিয়ে জীবনযাপন করতে হবে না।
একটা পিটুলিগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রঘুনাথ দু’ভাগ হয়ে যাওয়া রাস্তাটার দিকে তাকাল। একটা রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে হাবুল চোরের বাড়ি, অন্য রাস্তাটা বাঁক খেয়ে ছুঁয়ে দিয়েছে সূর্যাক্ষর ঘর। কোনটা বেশি নিরাপদ বুঝতে পারে না রঘুনাথ। সে যেন অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে নিভে যাওয়া লম্ফ।
.
ধুলোর পথ টানা বর্ষায় রূপবদল করে চ্যাটচেটে কাদা। সতর্ক হয়ে পা না ফেললে পিছলে পড়ার ভয়। বড়ো ইস্কুলটার কাছে এসে রঘুনাথ শুনতে পেল কাশীনাথ তাকে ডাকছে। আজ কাশীনাথের সঙ্গে কোনো দলবল নেই, সে একা। ফলে রঘুনাথ সাড়া দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মুখ তুলে শুধাল, কী ব্যাপার কাশীদা?
তোর সাথে দুটো কথা আছে, দাঁড়া। জোরে পা চালিয়ে কাশীনাথ এগিয়ে এল, তোর কাছে বিড়ি আছে? যদি থাকে, দে। মাথাটা বড্ড ধরেছে। আর ভালো লাগছে না।
রঘুনাথ অবাক চোখে তাকাল কাশীনাথের দিকে। এত নরম কথার অর্থ বুঝতে পারল না সে। শয়তানের ছলের অভাব হয় না। আজ কি উদ্দেশ্য নিয়ে কাশীনাথ তাকে দাঁড় করাল ঠিক বুঝতে পারল না রঘুনাথ। তিতকুঁড়ো ঢোক গিলে রঘুনাথ হালকা গলায় বলল, তুমি আবার বিড়ি খাওয়া কবে থেকে ধরলে?
কাশীনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলল, তাহলে তুই যে খাস? তুই তো আমার চাইতে অনেক ছোট।
পানসে হাসি ছড়িয়ে গেল রঘুনাথের মুখে, বিড়ি খেতে বয়স লাগে নাকি? বিড়ি খেতে গেলে শুধু কলিজার জোর দরকার। এই জোরকে অনেকে বলে দোম। তা বিড়ি যে খাবা–তুমার বুকে দোম আচে তো?
–আছে কী না নিজের চোখেই দেখ।
এবার আর বিড়ি না দিয়ে পারল না রঘুনাথ। শুধু বিড়ি নয়, সেই সঙ্গে ম্যাচিস বাক্সটা সে এগিয়ে দিল।
কাশীনাথ বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে রঘুনাথকে দেখছিল। অস্বস্তি হতেই রঘুনাথ শুধোল, অমন করে কী দেখচো কাশীদা?
-সত্যি কথা বলব? তোরে দেখছি।
ছ্যাঃ, বেটাছেলে আবার বেটাছেলেকে দেখে নাকি?
–কেন আমি দেখছি। এতে কোনো অন্যায় হয়েছে নাকি? কাশীনাথ ঝুঁকে পড়ল সামনে, কমলা তোর কথা খুব বলে। ও যে কত বোকা তা আমি এখন বুঝতে পারছি। আমার মনে হয় বোনটার মাথার ঠিক নেই। তা সত্যি করে বলতো–ওকে তুই কিছু খাইয়েছিস নাকি?
–এসব কী বলচো? রঘুনাথ ঘাবড়ে গেল, আমার বাপ-ঠাকুরদা ওসব বিদ্যে জানে না। ওসব বিদ্যে তো তুমার বাপ জানে, তাকে গিয়ে শুধধাও।
-না, না। তার কোনো দরকার হবে না। কাশীনাথ ঢোক গিলল। প্রসঙ্গ বদলে বলল, কোথায় গিয়েচিলিস অবেলায়?
দাদুর শরীল খারাপ, জ্বর। সাত দিন হয়ে গেল, ভালো হচ্ছে না। রঘুনাথের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল, বড় কাহিল হয়ে গিয়েছে বুড়া মানুষটা। হাঁটতে চলতে পারে না। বসে থাকলেও টলে পড়ে।
–চটা ডাক্তারের পুরিয়া দিস নি? কাশীনাথ প্রশ্ন করল।
রঘুনাথ সহজভাবে বলল, হ্যাঁ দিয়েছি। কিন্তু তাতে কুনো কাজ হয়নি।
-নেশা ভাঙ করলে পুরিয়া-ওষুধে কাজ হয় না। এর জন্য কড়া-ডোজ দরকার।
সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়ল রঘুনাথ।
কাশীনাথ বিজ্ঞের মতো বলল, এখনকার জ্বর-জ্বালা সব আলাদা। এক ওষুধে কাজ হয় না এখন। এসব জ্বর বাগে আনতে গেলে হাসপাতালের বড়ি-ইনজেকশন দরকার।
কাশীনাথের কথাটা ভুল নয়। চুনারামের জ্বরটার মতিগতি বোঝা গেল না সাত দিনে। সেদিন পণ্ডিত বিলে ছিপ ফেলতে গিয়েছিল চুনারাম। রোদ ফোঁটা দুপুর। বর্ষা কদিন ঢেলেই এখন ক্লান্ত। দম নিচ্ছে। কেঁচো খুঁড়ে মালাই চাকি ভরে ঘর থেকে বঁড়শি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল চুনারাম। বাঁশতলার ছায়ায় বসে বঁড়শি ফেলেছিল সে। হঠাৎ কেঁপে বৃষ্টি এল। চুনারাম প্রথমে ভেবেছিল–এই বৃষ্টি বুঝি ছাগল তাড়ানোর বৃষ্টি। কিছু পরে তার ভুল ভেঙে যায়। বৃষ্টি থামল না, ঝরল শুধু ঝরল। গোরুর মতো ভিজে গেল চুনারাম। সব বর্ষার জল সমান হয় না। এ বরষার জল গায়ে বসে গেল চুনারামের। এই ফাঁকে একটা দেড়হাত মাপের বাণ মাছ ধরল সে বঁড়শি গেঁথে। জলে বাণ মাছ কেন, চুনো মাছেরও তাগত কম নয়। ছিপে টান ধরতেই সে ভেবেছিল রাক্ষুসী বোয়াল। পরে জলের উপর ছরছর করে উঠতেই শুধু সূচলো লেজটুকু দেখা যায়। চোখের দৃষ্টি কমেছে। ছানি পড়েছে দু-চোখে। ফলে বাণ মাছের লেজকে তার ঢোঁড়াসাপের লেজ বলে ভ্রম হয়। পরে ডাঙায় তুলতে সেই ধন্দ কেটে গেল। খুশিতে ভরে গেল চুনারামের মনটা। বাণ মাছটা তিন পোয়ার কম হবে না। আহা, পেকে হলদে হয়ে আছে মসৃণ দেহ। শুধু শিরদাঁড়ার কাঁটাগুলো করাতের মুখের মতো খ্যাচখ্যাচ করে লাগে। হাতে ঢুকে গেলে যন্ত্রণা শুরু হয়। মাছ ধরার আনন্দে মাথায় জল বসে গিয়েছিল চুনারামের। হুঁশ ফিরল যখন মাথার জল শুকিয়ে গেল মাথায়। প্রথম রাতে খুঁক খুঁকে কাশি, ভোররাতে তেড়েফুড়ে জ্বর এল গায়ে। তাকে সামলানো দায়। জড়িবুটি চলছিল কদিন। তাতে কাজ হল না। শরীর ঝিমিয়ে গেল ক্রমে ক্রমে। হারিয়ে গেল ভেতরের শক্তি। বুড়াটা যেন আরো বুড়িয়ে গেল চোখের সামনে। জ্বর উঠলে আনশান বকত সে। কখনও গান ধরত চেঁচিয়ে। কখনও কাঁদত সুর করে। দুর্গামণিকে বলত, যাও বউমা, আমার ছেলেটারে ডেকে আনো। যদি না যেতে পারো তাহলে খপর পাঠাও। আমার মন কু গাইচে। কখন চক্ষু বুজে আসবে তা মা শীতলাবুড়ি জানে।
চুনারামের শরীরের অবস্থা ভালো নয়, চটা ডাক্তার তার রোগ সারাতে পারল না। পুরিয়া ফেল মেরে গেল ধুমজ্বরের কাছে। চটা ডাক্তার নিজের মুখে বলল, রঘুরে, তোর দাদুকে কালীগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যা। ওখানকার বড় ডাক্তারের হাতযশ আছে। তোর দাদুকে ভালো করে দেবে।
চুনারাম হেঁটে যেতে পারবে না। যেতে গেলে খাটিয়ায় নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য কম করে চারটে মানুষ দরকার। ধাওড়াপাড়ার এখন যা অবস্থা তাতে চারজন কেন দুইজন পাওয়াই মহা ঝামেলার। কে আর হাসপাতালে যেতে চায় হাতের কাজ ফেলে? পুরুষ যারা ছিল বর্ষা পড়ার সাথে সাথে তারা চলে গিয়েছে খাটতে। ধান বোয়া শেষে ধান কেটে ঘরে ফিরবে ওরা। এসব করতে আরও মাস তিনেকের ধাক্কা। ঘরের মানুষ ঘরে না ফেরা পর্যন্ত চলবে অপেক্ষা।
কাশীনাথ চলতে চলতে আচমকা বলল, একটা কথা রাখবি, রঘু? পারলে কমলাকে তুই ভুলে যা। ওতে দুজনেরই মঙ্গল।
জগৎখালির বাঁধ ইস্কুল ধার থেকে সোজা চলে গিয়েছে বসন্তপুর ধাওড়া এবং সেখান থেকে পাণ্ডবপাড়া, ঘাসুরিডাঙা, এড়েডাঙা ছুঁয়ে একেবারে পলাশী-রামনগরের সুগারমিল। দু-ধারে বিস্তীর্ণ সোনা ফলানো মাঠ এখন আখ আর পাটের সংসার সামলাতে হিমসিম। মাটি এখানকার হারিয়ে দেবে চন্দনের বাহার। খোলা আকাশ বুড়িগাঙের উপর বিছিয়ে দেয় আবরণহীন শয্যা। এমন নৈসর্গিক পরিবেশে কাশীনাথের কথাগুলো রঘুনাথের মনটাকে বাসিফুলের মতো ম্লান করে দিল। সে কী জবাব দেবে কিছু বুঝতে না পেরে কাশীনাথের দিকে অবাক করা চোখে তাকাল, তুমি একথা কেন বললে ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম না। কমলা তুমার বুন হলেও সে তো আমার গাঁয়ের মেয়ে। কমলাকে জড়িয়ে তুমার এমন কথা বলা কি শোভা দেয়?
-কেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছিস, রঘু? তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল কাশীনাথ, তোদের মধ্যে প্রেম চলছে এটা অনেকদিন আগে আমি টের পেয়েছি। কমলাকে আমি চিনি। সে আমার কাছে কোনো কথা লুকাতে পারেনি। আমি ওর চোখ দেখে মনের কথা সব বুঝে গিয়েচি।
-কী ওর মনের কথা? রঘুনাথের কণ্ঠস্বরে আগ্রহ ফুটে উঠল।
কাশীনাথ ধীর-স্থিরভাবে বলল, তোর জন্য ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। এসব প্রেম-পীরিতি বেশিদিন টেকসই হয় না। হলেও টোল খেয়ে যায়। তখন দুটো জীবনই বরবাদ হয়।
–তুমি যেটাকে বরবাদ ভাবচো আমি যদি ভাবি সেটাই আমার জেবন-তাহলে?
-আমার ভাবাভাবি নিয়ে তোদের কি এসে যায়? ঝাঁঝালো সুরে বলল কাশীনাথ, দুটো জীবন নষ্ট হয়ে গেলে আমার খারাপ লাগবে। গ্রাম বলে তোকে এত বোঝাচ্ছি। শহর হলে কবে খালাস হয়ে যেতিস।
–তুমি কি আমাকে জানের ভয় দেখাচ্ছ? রঘুনাথের চোখের তারা কেঁপে উঠল, শুনে রাখো আমার আর জান-প্রাণের কুনো ভয় নাই। মার পেট থেকে জন্মেচি যখন মরব তো একদিন। সে যখন মরব তখন দেকা যাবে।
মনে রাখিস, পিঁপড়ের পাখা গজায় মরবার জন্য। কাশীনাথের শরীর কাঁপছিল রাগে, এখনও নিজেকে সামলে নে রঘু না হলে এর মাশুল তোকে দিতে হবে। সুফল ওঝার কত লম্বা হাত তা তুই জানিস নে। জানলে পরে খরিস সাপের গর্তে হাত ঢোকাতিস না!
এসব শোনানোর জন্যি কি তুমি আমাকে ডাকলে? অসিহষ্ণু রঘুনাথের আর কিছু ভালো লাগছিল না, কাশীদা, এবার তুমি যাও। আমাকে একলা যেতে দাও। সাপ-আর নেউলে কুনো সম্পর্ক হয় না।
-ঠিক আছে। তোকে যা বলার আমি বলে দিলাম। পরে আমাকে দোষ দিবি না। কাশীনাথ ঘাড় নাড়ল, তুই তোর বাপ-মায়ের এক ছেলে। আর দুটা ভাই-বোন থাকলে কোনো কথা ছিল না। ওরা সামলে নিতে পারত। কাশীনাথ নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। ইচ্ছে করেই হাঁটার গতি শ্লথ করে দিল রঘুনাথ। কাশীনাথের উপস্থিতি তার কাছে অসহ্য লাগছিল। চোখ কুটকুট করছিল তার। শয়তান মানুষের ছলচাতুরির কোনো অভাব হয় না। কাশীনাথ একরকম শাসিয়ে গেল তাকে। এমনকী প্রাণের হুমকিও দিয়ে গেল। রঘুনাথ মরতে ভয় পায় না। তবে সে যদি মরে, মরার আগে আর দশটাকে মেরে তবেই সে মরবে। কমলার জন্য এ জীবনটা কিছু নয়। এ জীবনটা সে কমলার কাছে বন্ধক রেখেছে যে। তার এবড়ো-খেবড়ো জীবনে কমলাই ফুল ফুটিয়েছে। ফলে তাকে অবহেলা করলে তার পাপ হবে।
হাসপাতালের বড় ডাক্তার মাটির মানুষ। রঘুনাথ তাকে যতদূর সম্ভব অসুখের কথা বুঝিয়েছে। রুগী না এলে সাধারণত ওষুধ পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবু সদয় হলেন। হাসপাতালের টিকিটের উপর ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, যাও, কম্পান্ডারবাবুর কাছ থেকে ওষুধটা নিয়ে নাও। যেমন বললাম–তেমন খাওয়াবে। যদি দেখ জ্বর তিন দিনের মধ্যে কমল না তখন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কথাটা মনে রেখো। হাসপাতালে ওষুধ আনতে গিয়ে অবনীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল রঘুনাথের। অবনী হাসপাতালের কর্মচারী। ছোটখাটো চেহারার মানুষটার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক সরলতা ফুলের সুগন্ধর মতো ছড়িয়ে আছে। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, মোটা ভ্রূ’র লোকটাকে দেখে রঘুনাথের হঠাৎ করে তার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। কতদিন হল ঘর ছেড়েছে গুয়ারাম। আজ সে গায়ে থাকলে রঘুনাথকে ওষুধ নিতে হাসপাতালে আসতে হত না। সংসারের প্রথম দফার ঝড়টা সব সময় সামাল দেয় গুয়ারাম। চুনারাম একটা শক্ত খুঁটি। আজ সেই মানুষটাই জ্বরে কাতরাচ্ছে।
আউটডোরের সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে অবনী শুধিয়েছিল, ও ছেলে, তোমার ঘর কোথায় গো? একা এসেচ না সঙ্গে আর কেউ আচে?
রঘুনাথ পায়জামা গুটিয়ে আরাম করে বসে বলেছিল, বাপ গিয়েচে রাঢ় দেশে মুনিশ খাটতে। ঘরে মা আর দাদু আচে। ওরা আসতে পারবেনি। দাদুর গায়ে জ্বর। ওর জন্যি তো ওষুধ লিতে এয়েচি।
লম্বা লাইনটা দেখে অবনী উশখুশিয়ে বলল, দাও তুমার টিকিটটা দাও। যা ভিড়। দেখি ভিতর থেকে বাবুকে বলে ওষুধটা আনতে পারি কিনা।
টিকিটটা নিয়ে অবনী চলে যেতেই রঘুনাথ ভাবছিল-সংসারে মানুষ যে কত রকমের আছে তার কোনো গোনাগুণতি নেই। যেচে আজকাল কেউ কারোর উপকার করে? এমন বোকামানুষ দেশ-গাঁয়ে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কাগজে মোড়ানো দু-রকম বড়িগুলো অবনী রঘুনাথের হাতে দিয়ে বলল, সাদা বড়িটা দিনে তিনবার। সকাল-দুপুর আর রাতে। আর এই লালচে বড়িটাও দিনে তিনবার। বুঝলে? রঘুনাথ ঘাড় নাড়তেই অবনী দাঁত বের করে শিশুর মতো হেসে উঠল, একদিন সময় করে তুমাদের হলদিপোঁতা ধাওড়ায় যাব। গাঁ ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। গা ঘুরলে মন ফুরফুরে হয়, মনের শান্তি বাড়ে। রঘুনাথ হাঁ করে শুনছিল সব। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কথা বলতে ভালোবাসে এটা দিব্যি বুঝতে পারল সে। কোনোরকম স্বার্থ ছাড়াই অবনী তার ওষুধ এনে দিয়েছে। রঘুনাথ সংকোচ সরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমাদের ঘর কুথায় গো? নেশ্চয়ই নদীয়া জিলায় তুমাদের ঘর নয়?
-ঠিক ধরেচো। আমরা এ জেলার নই। এ জেলায় আমি শুধু পেটের দায়ে। জমিজমা নেই। চাকরি না করলে যে আমাদের পেটে ভাত জুটবিনি। অবনীর পাংশু মুখ থমথমে হয়ে উঠল।
রঘুনাথ লজ্জা কাটিয়ে বলল, আমাদের গাঁয়ে যেও। চালের উপর পুঁইশাক হয়েছে। কেটে দেবো।
–না বাবা, পুঁইশাকের জন্য নয়। যদি যাই তো শুধু তুমাকে দেখতে যাব। অমায়িক হেসে অবনী তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বোলাতে লাগল, তুমার দাদু ওষুধ খাওয়ার পর কেমন থাকে জানিও। তেমন হলে তুমি আমার সাথে দেখা করো। আমি ডাক্তারবাবুকে বলে ভালো ওষুধ লিখিয়ে নেব। অবনীর কথায় কী জাদু ছিল, যার ছোঁয়ায় রঘুনাথের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল, সে অবাক করা চোখে অবনীকে দেখছিল। তার মনে হল গুয়ারাম যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দু-চোখে উপছে পড়ছে স্নেহের সমুদ্র।
বেলা বাড়ে। রঘুনাথ ব্যস্ত হয়ে উঠল, আমি যাই। ঘরে মেলা কাজ পড়ে আচে। আজ দাদুর গা-হাত-পা মুছিয়ে দেব। যাওয়ার সময় বাজার থেকে সাবু কিনতে হবে। সাবু ছাড়া দাদু এখন কিছু খাচ্চে না। মুখে অরুচি হয়েছে।
যাও, যাও। তুমার অনেক সময় নষ্ট করে দিলাম। খাকি প্যান্ট-জামার ধুলো ঝাড়ল অবনী, তা বাবা, তুমার নামটা তো জানা হলো না। কী নাম তুমার?
–আজ্ঞে, রঘুনাথ রাজোয়ার। পাকুড়তলায় গিয়ে আমার নাম বললেই হবে। সবাই আমাদের ঘর দেখিয়ে দেবে। রঘুনাথের কথাবার্তায় সারল্য ফুটে উঠল।
অবনী অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে উঠল, তুমার মতোন আমারও এট্টা ছেলে আচে। ওর নাম শুভ। বাঁধধারের বড়ো ইস্কুলে পড়ে। এর পরের বার এলে আমার কুয়াটারে এসো। শুভ’র সাথে আলাপ হয়ে যাবে।
রঘুনাথ পাকা রাস্তায় উঠে এলেও অবনীর মুখটা তার মন থেকে মুছে গেল না। কিছু কিছু ছবি থাকে যেগুলো স্মৃতিতেও রক্তমাংসের মুখ। অবনী ছবি নয়, রক্তমাংসের মানুষ। ওর শরীরে হাড়ের চাইতে স্নেহ-দয়া-মায়া বেশি। এমন মানুষ সবার বন্ধু হয়। এমন মানুষ এ সমাজে দুর্লভ।
সেই দুর্লভ অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে একা পথ হাঁটছে রঘুনাথ।
কাশীনাথকে আর দেখা যায় না, পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে তার স্বাভিমানী চেহারা।
.
দিনভর বৃষ্টির কোনো বিরাম নেই। গাছের পাতা চুঁইয়ে জল ঝরছে হরদম। মাটি ভিজে নরম হয়ে আছে হলদিপোঁতার মুখখানা। বাঁধের উপর হাঁটতে এখন ভয় পায় দুর্গামণি।
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়েছে চুনারাম।
দেশ-গাঁয়ে এখন আকাল চলছে কেরোসিনের। চড়া দামে বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে কেরোসিন। এর চেয়ে মিঠে তেলের প্রদীপ ঢের ভালো। একবার ধরালে টিমটিম করে চলে অনেকক্ষণ। ঘর আলো নিয়ে কথা।
রঘুনাথ বিছানা নেওয়ার পরেই শুরু করেছে নাকডাকা। ছেলেটা ওর বাপের স্বভাব পেয়েছে। বিয়ের রাতে মানুষটার নাক ডাকার শব্দে ঘুমাতে পারেনি দুর্গামণি। মাস দুয়েক পরে তা মানিয়ে যায়। এই নিয়ে পাড়ার বউদের অনেক কথা শুনতে হয়েছিল তাকে।
-কী ব্যাপার চোখের কোল বসে গিয়ে কাচের গায়ে কালি পড়েছে যে! শরীল সামলে মৌজ-মোস্তি কর। নাহলে মরবি।
ইঙ্গিতটা ভালো নয় তবু হেসে সব হজম করেছিল দুর্গামণি। নাকডাকার কথা সে বলতে পারেনি ওদের। বললে ওরা বিশ্বাসই করবে না। এরও অনেক পরে পেটে আসে রঘুনাথ। স্পষ্ট মনে আছে–বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল দুর্গামণি। শাশুড়ি তার গায়ে-পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, ভয় পাবে কেন গো বিটি। তুমার নারী জেবন সার্থক হল। গাছে ফল না ধরলে সে আবার কিসের গাছ? যাই, শীতলাথানে গোটা ফল চড়িয়ে আসি। বলেই একটা গোটা পেয়ারা নিয়ে সে খুশি মনে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে সন্ধের পর থেকে। আজ আর খুশি মনে ঘর থেকে বেরতে পারল না দুর্গামণি। মনের ভেতর পশ্চিমী হাওয়া বইছে তার। বুড়িগাঙের জল বেড়ে বুঝি বান আসবে এখুনি। কোনোমতে নাকে-মুখে গুঁজে সে দুটো খেয়েছে। খাওয়ার সময় রঘুনাথের মুখের দিকে তাকাতে তার কষ্ট হয়েছে। ছেলেটার যে কী হল তা মা শীতলাবুড়িই জানে। যতদিন যাচ্ছে তত যেন ঝিমিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। মনে তার কোনো স্ফুর্তি নেই। আগে গাঙের জলের মতো সে উছলে উঠত কথায় কথায়। এখন উচ্ছ্বাস তো দূরে থাক এক চিলতে হাসিও তার ঠোঁটে দেখা যায় না। সারাক্ষণ কী যেন ভাবছে। কী ভাবছে তা আর অজানা নয় দুর্গামণির। সুফল ওঝার মেয়েটাই তার মাথা খেয়েছে। বড় ধড়িবাজ মেয়েটা। পুকুরের চালাক রুইমাছের মতো খেলিয়ে একদিন সে সরে পড়বে। এসব মেয়েরা নিজের ভবিষ্যৎ-এর কথা আগে ভাবে। ওদের কাছে প্রেম-পীরিতি কাঁচা বয়সের শরীরের খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। দুদিন গেলেই সেই ভালোবাসার রঙ ফিকে হয়ে আসবে। তখন আম একদিকে আঁটি আর একদিকে পড়ে থাকবে। আমে-দুধে গড়াগড়ি খাবে। রঘুনাথ আঁটির মতো শরীর নিয়ে বেঁচে থাকবে। একবার যদি কেউ মন খুবলে দেয় সে মনের কি দাম থাকল? খুবলে খাওয়া ফল আর খুবলে খাওয়া মন দেবতার ভোগে লাগে না। দুর্গামণির শরীর শক্ত হয়ে গেল চলতে-চলতে।
এখন বাঁধের উপর আঁধার নেমেছে চাপ চাপ। মাত্র বিশ হাত নীচে খলবল করছে বুড়িগাঙ। মাঠ-আগোলদারের গলা ভেসে আসছে বাতাসে। সাঁঝ লাগার মুখেই খেয়ে নেয় চুনারাম। রঘুনাথও দাদুর পাশে বসে পড়ে খাওয়ার জন্য। এসব সেই কবেকার অভ্যাস, চট করে ছাড়তে চায় না। সাঁঝরাতে খেয়ে ভোররাতে ওঠা ওদের স্বভাব।
দুর্গামণি দূরের ঘরগুলোর দিকে তাকাল। টিমটিম করছে ঘরগুলো। বেশির ভাগ ঘরই অন্ধকার। বাঁধ থেকে পাড়ার মধ্যে নেমে এল দুর্গামণি। এসময় বাঁধের উপর লোক চলাচল কম। শুধু যারা কালীগঞ্জে তাস খেলতে যায় তাদের কথা আলাদা। তারা সাইকেলের প্যাডেল ঘোরায়, হাতে দুই ব্যাটারির টর্চ। ঝড়-বৃষ্টিকে ওরা তোয়াক্কা করে না।
আজ ওদের দেখা পেল না দুর্গামণি। নিশ্চিন্তে সে পাড়ার ভেতর ঢুকে এল। ভূষণী বুড়ির ঘরটাতে আলো নেই। তরল আঁধারে ঘরটাকে কেউ চুবিয়ে দিয়েছে। মনসা গাছটাকে পাশ কাটিয়ে দুর্গামণি উঠোনের দিকে এগিয়ে গেল। দু-একটা জোনাকি মাথার উপর পিটপিট করে জ্বলছে। আজ আর জ্যোৎস্না ফুটবে না, আকাশের কপালের টিপ হয়ে হাসবে না চাঁদ। আজ ঘোরতর অমাবস্যা।
আঁধার রাতকে তবু দুর্গামণির শুভ মনে হয়।
আগড় খুলে সে ঢুকে যায় ভূষণী বুড়ির উঠোনে। পোষা কুকুরটা তাকে দেখে লেজ নাড়ে। শব্দ করে কুঁইকুঁই। কুকুরের এই শব্দ ভূষণীবুড়ির কাছে সংকেত পৌঁছে দেয়। বিছনায় সতর্ক হয়ে বসে ভূষণীবুড়ি অন্ধকারের দিকে তাকাল। পায়ের শব্দটা ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। ভূষণীবুড়ি অন্ধকার চিরে গলা ভাসিয়ে দিল, কে, কে?
–আমি দুর্গা। নিচু গলায় উত্তর দিল দুর্গামণি।
-ওঃ, গুয়ার বউ। আয়, আয়। তারপর সে অন্ধকারে হাতড়ে খুঁজতে লাগল দেশলাই, না পেয়ে বিরক্তি উথাল উঠল তার শরীরে, দিয়াসিলাইটা যে কুথায় রেকেচি কে জানে। দাঁড়া বউ, দাঁড়া। খুঁজে দেখি। খুঁজতে খুঁজতে ভূষণীবুড়ি একসময় দেশলাইটা পেয়ে গেল। ডিবরি ধরিয়ে ডাকল, আয় বউ, ভিতরে আয়। পথ দেখানোর জন্য ডিবরিটা উঁচু করে তুলে ধরল সে।
দুর্গামণি মাথা নিচু করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। বারো বাই বারো হাত মাপের ঘর, মাথার উপর পচা বড় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ভরা বর্ষায়। রোদ উঠলে এই দুর্গন্ধ আরও বাড়বে।
দুর্গামণি কপাল কুঁচকাল, মাসী গো তুমার কাছে আসতে হল। দিনমানে সময় পাই না, তাই রাতকালে এলাম।
-বল বউ বল, আমায় কি করতে হবে?
–আমার ভারি বিপদ গো।
–কি বিপদ, কিসের বিপদ?
–ছেলেটা মুটে কথা শুনচে না। ওর মতিগতি বুনো হাওয়ার মতোন, আমি কিছু বুঝতে পারছি । দুর্গামণি হাঁপ ছেড়ে তাকাল।
-এখন কাঁচা বয়স, অক্ত টগবগ করে ফুটচে।
–তা লয় মাসী। ও মেয়েছেলের খপ্পরে পড়েচে।
-একী সব্বেনাশের কথা রে? ভূষণী বুড়ি নড়ে-চড়ে বসল, তা মেয়েছেলেটার নাম কি? কুথায় থাকে?
-তারে তুমি চেনো। দুর্গামণির উত্তেজনার পারদ চড়ছিল, সুফল ওঝার মেয়ে কমলা গো। সে আমার ছেলের পেছনে লেগেচে। আর ছেলেও চামএঁটুলির মতন ওর গায়ে লেগে গিয়েচে। শুতে বসতে খেতে মেয়েটার নাম না নিলে ও ক্ষ্যাপা হয়ে যায়। এখুন বলচে–তারে ব্যা করবে।
মুহূর্তে ভূষণীবুড়ি ফিরে গেল তার যৌবনে। নীলকণ্ঠর মুখটা ঘাই দেওয়া বোয়ালমাছের মতো নড়ে উঠল তার মনে। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে দুর্গামণির দিকে তাকাল, এই বয়সটাতে ছেলে-মেয়েদের এট্টু উড়ুউড়ু স্বভাব হয়। ভাদুরে কুকুরগুলার মতো ছুঁকছুঁক করে। এটাকে পীরিত করা বলে না, বলে কেচ্ছা। রঘুকে এ পথ থিকে সরাতে হবে। তবে এতে সুফল ওঝার যদি গোপন চাল থাকে তাহলে আমি পারব না। তখন তোরে যেতে হবে বাদকুল্লা। সিখানে মস্ত বড় গুণিন আচে। সে গুরুমারা বিদ্যে জানে। এক ফুঁঃয়ে পাশার ছক বদলে দেবে।
–আমি অতদূর কি যেতে পারব, মাসী?
–এখুনি তোকে যেতে হবে না। আগে আমি চিষ্টা করে দেখি। আমি ফেল হয়ে গেলে ছেলে বাঁচাতে তুকে সিখানে যেতে হবে। ভূষণীবুড়ির নিরাসক্ত কণ্ঠস্বর, এবার খোলসা করে বল তো কি হয়েছিল?
দুর্গামণি যতটুকু বলা যায় ঠিক ততটুকুই বলল, আমার ঘরের রঘুটা রাতকালে মেয়েটার ঘরে চলে যায়। ভাবো তো ওর মা-বাপ যদি টের পায় ছেলেটাকে কেটে দু-টুকরো করে দেবে। দুর্গামণি কথা শেষ করে ফুঁপিয়ে উঠল, তুমি তো জানো–ওর বাপ ঘরে নেই। এখুন যদি কিছু হয়ে যায়, আমি কি মানুষটার কাছে জবাব দিব।
ঠিক আছে, মাথা ঠাণ্ডা করে বস। গণনা করে দেখি কতদূর কী করা যায়। মাটিতে খোলামকুচির দাগ কেটে আঁকিবুকি করল ভূষণী বুড়ি। তারপর মুখ উঠিয়ে চোখ কপালে তুলে বলল, কেস সুবিধের লয়। ওরে বশীকরণের শিকড়ি খাইয়েছে পানের সঙ্গে।
-রঘু তো পান খায় না। বিস্ময়ে দুর্গামণির চোখ অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। ভূষণী বুড়ি বেদম কেশে বলল, আমার গণনা তো ভুল হবার নয়। ঠিক আছে–আমি আবার গুণচি।
আবার মাটির মেঝেতে আঁকিবুকি দাগ কাটল ভূষণীবুড়ি, দীর্ঘসময় ধরে গণনা করে বলল, বলছিলাম না, আমার গণনা ভুল হবার নয়। আবার দুয়ে দুয়ে চার হল। সব ঝামেলা মিটে গেল।
-তার মানে? দুর্গামণির অবুঝ চোখে জিজ্ঞাসা।
–তুই কাল সকাল সকাল আসবি। আমি তোকে মাদুলি বানিয়ে দেব।
–মাদুলি?
-হ্যাঁ। অস্ত্র ছাড়া লড়াই হবে কি করে? ভূষণীবুড়ির ঠোঁটে স্বস্তির হাসি খেলে গেল, ওই মাদুলির একুশটা গুণ। ওই মাদুলি ধারণ করলে শুধু কমলা কেন ডাকিনী যোগিনী কেউই ছুঁতেও সাহস পাবে না।
-বল কি? দুর্গামণির গলা কেঁপে উঠল বিস্ময়ে, তাহলে কাল আমি ঠিক সকালে আসব।
-আসার সময় পেছন ফিরে তাকাবি না। পেছন ঘুরে দেখলে হওয়া কাজ হয় না। ভূষণীবুড়ি সতর্ক করল।
দুর্গামণি তাকে পাল্টা চাপ দিল, ফিসফিসিয়ে বলল, আমি যা বললাম এ কথা যেন দু-কান না হয়। তাহলে সুফল ওঝা রঘুর ক্ষতি করে দেবে।
সুফল তো ছেলেমানুষ, ওর মরা বাপেরও ক্ষেমতা হবে নি। আত্মসম্মানে ঘা লাগতেই চটে উঠল ভূষণীবুড়ি।
শেকড় ছোঁয়ানো ফণা তোলা সাপের মতো ঝিমিয়ে গেল দুর্গামণি, গলা খাদে নামিয়ে কুণ্ঠিত হয়ে বলল, মনে দুখ লিয়ো না। কী বলতে কি বলে ফেলেচি। ছেলের চিন্তায় মাথাটা আমার ঠিক নেই।
–যা বউ, কতা আর বাড়াস নে। কাল সকালে আসিস। ভূষণীবুড়ির কথায় গাম্ভীর্য ফুটে উঠল।
দুর্গামণি ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কিছুটা হলেও তার মনের ভার কমে এসেছে। দয়ালের মৃত্যুর পর ভূষণী ময়ূরভঞ্জ চলে গিয়েছিল। সেখানে বেশিদিন থাকেনি তবু যা শিখে গাঁয়ে ফিরেছে তার দাম নেহাৎ কম নয়। নীলকণ্ঠকে কি সে বশ করেছিল মন্ত্রবলে? যারা নিন্দুক তারা এ কথা আজও রটিয়ে বেড়ায়।
ভূষণী বুড়ির হৈ-চৈ নেই। সে বয়স্ক কুসুমগাছের মতো গম্ভীর আর লক্ষ্যভেদী। তার মন্ত্র সাপের মতো এঁকেবেঁকে নয়, চলে তীরের মতো সোজা। মা শীতলার দয়া হলে রঘুর প্রেমের ঘুড়িটা কমলার মনটাকে কেটে দিয়ে ছেইরে হয়ে উড়বে। তার নাগাল আর কোনোভাবে পাবে না রঘুনাথ। হাওয়ায় ভাসা ঘুড়ি আর চৈত্রমাসের ফাটা শিমুলতুলোর স্বভাব একই।
.
১৩.
টানা বর্ষায় ভরে উঠেছে মাঠ-ঘাট।
ফিটকিরি রঙের জলগুলো ফিট ব্যামোর রুগির মতো শুয়ে আছে অসাড়। মাঠপালান হাওয়ায় সেই জলে মাঝেসাঝে সুড়সুড়ি দেওয়ার মতো ঢেউ ওঠে। চার আঙুল উঁচু সেই টেউগুলো গুডুলপাখির মতো জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দৌড়োয়। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে রঘুনাথ এসবই দেখছিল।
বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা পুরোপুরি থেমে যায়, আবার উৎপাত শুরু হয় সাঁঝের পর থেকে। লাল-চা খেয়ে ঘর থেকে বেরনোর সময় দুর্গামণি বলল, অবেলায় আবার কুথায় যাবি বাপ। ঘরে থাক। কখন যে বৃষ্টি হামলা চালাবে তার তো কুনো ঠিক নাই।
রঘুনাথ একবার ভাবল-সে বেরবে না। কিন্তু বিকেল হলে মনটা কেমন ছটফট করে, ঘরে বসে থাকতে একেবারে মন সায় দেয় না। বাইরে না বেরলে গুমোট হয়ে থাকে মন। এসময় জামতলায় বসে বিড়ি ফুকলে এমন সুখ আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
কমলার সঙ্গে বুড়িগাঙের পাড়ে দেখা হয়েছিল রঘুনাথের। ওর শাঁখের মতো মাজা শরীর চিন্তায় নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল। এমন মনমরা, গোড়াকাটা গাছের মতো ঝিমুনিভাব কোনোদিন দেখেনি রঘুনাথ। ফলে এগিয়ে গিয়ে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে তেমন সাহস আর হল না। ওদের ঘনিষ্ঠতার খবরটা সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিন ঘরে এসে সুফল ওঝা শাসিয়ে গেল দুর্গামণিকে, ছেলেকে সামলাও। ওর নজর এখন উপরপানে। নিজেকে যদি না বদলায় তাহলে পরে ওর ডিমা দুটা আমি উপড়ে নেব।
কথাটায় কাঁপুনি ছিল, জুরো-রুগির মতো কেঁপে গিয়েছিল দুর্গামণি। কাঁচা পয়সার মুখ দেখে সুফলের মাথা ঘুরে গিয়েছে। পয়সার গরমে তার এখন ধরাকে সরাজ্ঞান।
গুয়ারাম ঘরে থাকলে এমন অন্যায় মেনে নিত না। এমনিতে সাত চড়ে রা কাড়ার মানুষ নয় সে। তবু অন্যায় দেখলে তার মাথায় কাঁকড়াবিছে কামড়ে দেয়। পারুক না পারুক সে প্রতিবাদ করবে গলার রগ ফুলিয়ে।
দুর্গামণির অপমান হজম করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। সুফল ওঝা কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে হঠাৎ আসা ঝড়ের মতো মিলিয়ে গেল। সেই থেকে মনের ভেতর তছনছ শুরু হয়েছে দুর্গামণির। একা একা সে জ্বলছে। একথা চুনারাম বা রঘুনাথকে সে বলতে পারেনি। যদি সে বলত তাহলে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যেত তাদের উঠোনে। সুফল ওঝাকে আর মাথা উঁচু করে সাইকেল নিয়ে চলে যেতে হত না।
দুর্গামণির মনটা থেঁতলে যাওয়া কুমড়োর মতো রস চুয়াচ্ছে সর্বদা। ভয়টা তাকে তাড়া করছে মাঝে মাঝে।
পশ্চিমে সূর্য ঢলে যেতেই রঘুনাথ উঠে দাঁড়াল ঘরে ফেরার জন্য। আজও সূর্যাক্ষর সঙ্গে তার দেখা হল না। আর ক’মাস পরে ওর পরীক্ষা। দ্বীপীর কথা তার মনে পড়ল। দ্বীপী কেমন আছে কে জানে।
রঘুনাথ ধাওড়াপাড়ার দিকে হাঁটছিল। বাঁধের উপরটা প্যাচপ্যাচ করছে কাদায়। এঁটেলমাটির কাদা পা-হড়কে দিতে পারে যে কোনো সময়।
রঘুনাথের পা হড়কাল না, তাকে জোর করে ঠেলা মেরে বাঁধের উপর ফেলে দিল কাশীনাথের দলবল। ওরা তৈরি হয়েই এসেছিল। রঘুনাথের বুকের উপর একজন চড়ে বসে বলল, ঢ্যামনার বাচ্চা। আজ তোর একদিন কী …আমাদের একদিন। আজ ভাদুপরবের চোলাই তোর পেট থেকে বের না করে ছাড়ব না।
–তুমরা কি চাও? রঘুনাথ জানতে চাইল বহু কষ্টে।
–আমরা চাই তোর টাটকা মাথা। কথা ফুরোল না, আর আগেই চড় কিল ঘুষিতে তৎপর হয়ে উঠল হিংস্র হাতগুলো। রঘুনাথ দেখল মাত্র হাত পাঁচেক দুরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে কাশীনাথ। ওর ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন গর্ব। সেই গর্বে কঠিন হয়ে উঠছে ওর ঠোঁট দুটো।
এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না রঘুনাথ। আচমকা আক্রমণে সে কিছুটা কাহিল। পর মুহূর্তে সে গা ঝাড়া দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল হামলে পড়া তিনজনকে। তারপর চিৎকারে বাতাস ফাটিয়ে ঠুকরে উঠল সে, বেধুয়ার ছা’রা আমাকে মারচে, দাঁড়া দেকাচ্ছি মজা। রঘুনাথ বাঁধের গোড়ায় একটা আধলা ইট দেখতে পেয়ে ছুটে গেল ক্ষিপ্র গতিতে। আধলা ইটটা তুলে নিয়ে সে বুনো মোষের মতো তেড়ে গেল রুদ্ধশ্বাসে। মাটি কেঁপে গেল যেন। যেন ঝড় উঠল। ভেঙে গেল বাঁধ। সজোরে ইটটা কাশীনাথের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল সে। পাখিমারা টিপ ব্যর্থ হল না। আধলা ইটের আঘাতে কাশীনাথ বাপ রে বলে ঠিকরে পড়ল কাদায়। চারপাশে ছড়িয়ে গেল কাদাজল। রে-রে করে তেড়ে এল বাদবাকিরা। সামনাসামনি লড়াই হলে রঘুনাথ ওদের সঙ্গে পারবে না। ওরা অবশ্যই তাকে ঘায়েল করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে।
বেড়ার পাশ ধরে বুনো বেগে ছুট দিল রঘুনাথ। হঠাৎ একজনের গরম নিঃশ্বাস তার ঘাড়ের উপর পড়তেই সে পাশের বেড়ার দিকে তাকাল। ঝিঙেলতা জড়িয়ে আছে কঞ্চির বেড়ায়। মাঝেমাঝে হলুদফুল ফুটে আছে ঝিঙেগাছের গয়নার মতো। কিছু দূরে দূরে খুঁটিবাশ পোঁতা।
জয় মা শীতলাবুড়ি। রঘুনাথ বেড়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখের পলকে টান দিয়ে একটা খুঁটি বাশ উপড়ে নিল। বাঁশটা আঁকড়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরে বুঝি অপদেবতা ভর করল। মাথার উপর খুঁটিবাশটা তুলে ধরে সে বোঁ-বোঁ শব্দে উন্মাদের মতো ঘোরাতে লাগল, আয়। মায়ের দুধ খেয়ে থাকলে এগিয়ে আয়।
মুখের দুপাশে গাঁজরা উঠে এল রঘুনাথের। সে গো-হাঁপানো হাঁপাচ্ছে। তার বুক কামারশালার হাঁপরের মতো ওঠা-নামা করছে ঘনঘন। খুঁটিবাঁশটা মাথার উপর তুলে সে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।
বিকেলবেলায় স্বাস্থ্যরক্ষার কারণে অমলকান্তিবাবু রোজ হাঁটতে বেরন। তিনি হঠাৎ খণ্ডযুদ্ধের এই দৃশ্য দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলেন। স্কুলের ছেলেরা খোলা বাঁধের উপর নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে এটা কোনোমতে বরদাস্ত করা যাবে না। তিনি দূর থেকে চিৎকার করে উঠলেন, এ্যায়, লাঠি ফেলে দাও। কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমাদের? কেন নিজেদের মধ্যে মারামারি করছ? অমলকান্তিবাবু পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন। অন্ধকার তখনও পুরোপুরি গাঢ় হয়নি। রঘুনাথকে চিনতে পারলেন তিনি, এ্যায় রঘু। বাঁশটা নামাও। মারামারি করলে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?
রঘুনাথ হাতটা শিথিল করতেই খুঁটিবাশটা তার পায়ের কাছে পড়ে গেল। মুখের গাঁজরা মুছে নিয়ে রঘুনাথ উত্তেজনায় ভেঙে পড়ল, মাস্টারমশাই, ওরা ভেবেছিল একলা পেয়ে আমাকে গুম করে দেবে। কিন্তু মা শীতলাবুড়ি আমাকে বাঁচিয়ে দিলো।
-শান্ত হও। মাথা ঠাণ্ডা করো। অমলকান্তি বোঝাবার চেষ্টা করলেন, এ্যায়, তোমরা কারা? কোথায় থাকো? কেন এসব করছো? এসব করে কি সুখ পাও তোমরা?
তিনটে ছেলে হকচকিয়ে তাকাল।
কাশীনাথ মাটি আঁকড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে কোনোমতে। ওর সারা শরীর কাদায় মাখামাখি। কপাল চুয়ানো রক্ত গালের দু’পাশে জমাট বেঁধে জোঁকের মতো শুয়ে আছে। তবু ও টলতে-টলতে অমলকান্তিবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল, স্যার, এই রঘু…আমার বোনের সর্বনাশ করে দিয়েছে। আমার বোন। কথা শেষ করতে পারল না কাশীনাথ, কান্নার ঝড়ে গুমরে উঠল সে।
অমলকান্তিবাবু কাশীনাথের কাঁধের উপর হাত রেখে বললেন, শান্ত হও। তোমাকে আমি ভালো ছেলে বলে জানতাম। বড়ো হচ্ছে। এখন পথে-ঘাটে মারামারি করা কি তোমাদের শোভা দেয়?
কাশীনাথ মুখ নামিয়ে নিল না; সংকোচ, লজ্জা বা অনুশোচনা কোনোকিছুই তার মধ্যে সংক্রামিত হল না। অমলকান্তিবাবুর চোখে চোখ ফেলে সে বলল, আজ রঘু বেঁচে গেল কিন্তু আজকের দিনটাই শেষ দিন নয়। তিনশো পঁয়ষট্টি দিন নিয়ে একটা বছর হয়। একটা দিন বরবাদ হলে কিছু যায় আসে না। কাশীনাথ এবার তার সঙ্গীদের দিকে তাকাল, চল। এক মাঘে শীত যাবে না। রক্তের বদলা আমি রক্ত দিয়ে নেব। আমিও সুফল ওঝার ছেলে। যত বড়ো ফণা তুলুক না কেন সাপ-সেই সাপের বাঁচা-মরা সব আমার হাতেই থাকল।
টিপটিপিয়ে বৃষ্টি শুরু হতে ওরা আর দাঁড়াল না, জামতলা পেরিয়ে দৌড় লাগাল গাঁয়ের দিকে।
বৃষ্টির শব্দটা কখনও কখনও যুদ্ধের শব্দ বলে মনে হয়।
অমলকান্তিবাবু ছাতার নীচে ডেকে নিয়েছেন রঘুনাথকে, তোমাদের সমস্যাটা কি বলো তো?
রঘুনাথ দ্বিধা সরিয়ে তাকাল, ওর বুনের সাথে আমার ভাব হয়েছে। কিন্তু ওরা কমলাকে আমার সাথে মিলামেশা করতে দেবে না। আমি ছোট জাত। এই নিয়ে ওদের মনে গুঁজকাটালি।
মেয়েটা কি সত্যি তোমাকে ভালোবাসে?
রঘুনাথ অবাক চোখে তাকাল, আমার সাথে ঘর বাতে না পারলে কমলা পাগল হয়ে যাবে। এখুনই পাগল হয়ে গিয়েচে। মা-বাপ ওকে অন্য জায়গায় ব্যা দিবে।
সমস্যাটা অনেক গভীরে। কী উত্তর দেবেন ভেবে পেলেন না অমলকান্তিবাবু। গ্রাম- সমাজের দ্রুত বদল ঘটছে। বর্ণবৈষম্য এখনও গোপন-রোগের মতো ছড়িয়ে আছে গ্রামে-গঞ্জে। খবরের কাগজের পরিসংখ্যান কিংবা সরকারি বিজ্ঞাপন দেখে এর অনুমান করা যাবে না। যতই আলো এসে পড়ুক তবু এই কঠিন চাপবাঁধা অন্ধকার সহজে অপসারিত হবার নয়।
কালীগঞ্জ-লাখুরিয়ায় অমলকান্তিবাবুর অনেকগুলো বছর অতিবাহিত হল। এখনও কুসংস্কারের সব লৌহকপাট তিনি কি ভাঙতে পারলেন? এসব সমাজ সংস্কারের কাজ সফলভাবে করতে গেলে যে শিক্ষার প্রয়োজন হয়, সেই পরিকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি।
ধাওড়াপাড়ার কাছে এসে অমলকান্তিবাবু বললেন, তুমি এবার বাড়ি যাও। আমি এখান থেকে ফিরব। আজ যা আবহাওয়ার অবস্থা, আজ বেশিদূর যাওয়া আমার উচিত হবে না।
অমলকান্তিবাবু ফিরে যেতেই রঘুনাথ ঘরের দিকে গেল না। কী মনে করে সে সোজা চলে গেল বুড়িগাঙের কোলে। সারা শরীর কাদা-জলে মাখামাখি। এ অবস্থায় ঘরে ফিরলে দুর্গামণির প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হবে।
নিজের দিকে একবার তাকাল রঘুনাথ, তারপর বুড়িগাঙের পাড় থেকে সে সশব্দে লাফিয়ে পড়ল জলের উপর। অন্ধকারে সাঁতরে সে চলে গেল বহুদূরে। ক্লান্ত হয়ে আবার ফিরে এল পাড়ে। কপালের কাছটা সুপারির মতো ফুলে আছে। এতটাই ফোলা যে দুর্গামণির নজর এড়াবে না। এ ফোলা সহজে মেলাবারও নয়।
ভেজা কাপড়ে বাঁধের উপর উঠে এল রঘুনাথ। তার গা-হাত-পা টলছে। বাতাস লাগা বাঁশপাতার মতো মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠছে শরীরটা। একটা শীতভাব এখন ছড়িয়ে আছে চারপাশে। ভোরের দিকে এই শীতানুভূতি আরো তীব্র হয়।
দুর্গামণির মন খারাপ থাকলে মুখের দোক্তা তেতো লাগে। বিড়ি খেলে তখন মগজের চিন্তাগুলো ফাঁসজাল কাটা টুনটুনি পাখির মতো উড়ে পালায়। মাঠে-ঘাটে খাটতে গেলে বিড়ি না হলে তাদের চলে না। নেশার জিনিস কঠিন কাজে সরল গতি আনে। দুর্গামণির মায়ের মা বিড়ি খেত। তার মা বিড়ি না পেলে সংসারে অশান্তি বাধিয়ে দিত। শুধু শুকনো নেশা নয়–তরল নেশাতেও তার আসক্তি প্রবল। বিশেষ করে ভেলিগুড়ের মদ পেলে সে মাংসের বাটিও ঠেলে দেবে।
নেশা করার ধারাটা দুর্গামণি ধরে রেখেছে। রঘুনাথ বড়ো হওয়ার পর থেকে নেশা করতে তার বাধো বাধো ঠেকে। তবু মন ছটফটালে লম্ফর আগুন থেকে বিড়ি ধরিয়ে সে সুখটান দেয়। পুরুষের মতো ধোয়া ছাড়ে, ধোঁয়া গেলে।
চুলার পাশে গালে হাত দিয়ে তুষজ্বাল ছুঁড়ে দিচ্ছিল দুর্গামণি। আগুনের হলকা চুলার ঝুঁটি ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার। রঘুনাথ দুর্গামণিকে পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেই ধরা পড়ে গেল, কুথায় গেচিলিস, এত রাত হলো যে?
মুখ তুলে রঘুনাথের দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠল, কপালের কাছটা ফুলালি কিভাবে?
-বাঁধের ধারে পা পিছলে পড়ে গেলাম। বড্ড লেগেছে। কাদা-জলে সারা গা-গতর ভরে গেল। বুড়িগাঙে তাই ডুব দিয়ে ফিরলাম। রঘুনাথ আসল ঘটনা লুকোবার চেষ্টা করল।
-মিছে কথা কেন বলচিস বাপ? দুর্গামণির মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল, ভেজা মাটিতে পড়ে গেলে কি কপাল এমন ফোলেরে! তোরে নেশ্চয়ই কেউ মেরেচে। বল, কে মেরেচে তুরে?
-আমাকে মারবে কার ঘাড়ে এত সাহস আচে? রঘুনাথ বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, আমার গায়ে হাত তুলার লোক এ গাঁয়ে জন্মায়নি।
তবু মন থেকে সন্দেহ মুছল না দুর্গামণির, এই ছেলেই তার যত চিন্তার গোড়া। ঝিম ধরে বসে থেকে দুর্গামণি তুষ ঠেলে দিচ্ছিল চুলার ভেতর।
কমলা কী চায় সে এখনও বুঝতে পারছে না স্পষ্ট। বয়স্ক মানুষের ঝাপসা দৃষ্টির মতো তার কাছে সব ধোঁয়াশা ঠেকে এখন। ভালোবাসায় শক্তি প্রবল। কিন্তু সেই শক্তি কি কমলার ভেতরে আছে? গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায় অনেকে। কমলা কোন দলে এখনও স্পষ্ট বুঝতে পারে না দুর্গামণি। ফলে ভয় তার মনে তাঁবু গেড়ে আছে।
কলাবতীর সঙ্গে কদিন আগে দেখা করতে গিয়েছিল দুর্গামণি। কিন্তু কলাবতী তার উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিল না। এমন কী বসতেও বলল না সকালবেলায়। ওর চেহারায় ফুটে বেরচ্ছিল চাপা রাগ। দুর্গামণি গায়ে পড়ে বলল, দিদি, সবই তো জানো, এখন আমার কী করণীয় বলে দাও।
-আর ন্যাকা সেজো না। ফুঁসে উঠেছিল কলাবতী, ষাঁড় লেলিয়ে দিয়ে আমাকে বলছ গোরু সামলাও? যাও, যাও। আমার কাছে আর নাকে কেঁদো না। আমি তোমার মনের ইচ্ছে সব বুঝে গিয়েচি। আমার মেয়েটার সরল মনের সুযোগ নিয়ে তোমরা জাতে উঠতে চাইছ।
–এ কী বলচো গো দিদি? জাত কি পাকুড়গাছ, যে মন চাইলে উঠে যাব। দুর্গামণি দ্বিধার সঙ্গে বলল, ভুল বুঝো না দিদি। এতে আমার কুনো হাত নাই।
–নেই তো এসেছ কেন? মুখ দেখালে কি ঝামেলা সব মিটে যাবে। কলাবতী ফুঁসছিল, তোমার ছেলের জন্য আমাদের নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ হয়েছে। গাঁয়ে আমি মুখ দেখাতে পারছি না। কী কষ্ট! কলাবতীর ঠোঁট ফুলে উঠল, তারপর সেই ফোলানো ঠোঁট কান্নার রঙে মিশে গেল। হকচকিয়ে দুর্গামণি বলল, কেঁদো না দিদি, সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমার ঘরের কমলাকে টুকে ডাকো। ওর সাথে দুটা কতা বলে যাই।
-কী আর কথা বলবে, কথা বলার আছেই বা কি! কলাবতী এড়িয়ে যেতে চাইলেও দরজার আড়াল থেকে নিজেকে বের করে আনল কমলা। একটা বড়ো পিড়ি পেতে দিয়ে সে বলল, সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছে, বসো।
বসতে আসিনি, মা। দুটা কথা বলে চলে যাব।
–হ্যাঁ- হ্যাঁ বলো। কী বলতে চাও? কমলার কথা-বার্তায় কোনো জড়তা নেই।
দুর্গামণি কমলার মুখের দিকে অদ্ভুত এক মায়ার দৃষ্টি মেলে তাকাল, তুমাকে এট্টা প্রশ্ন শুধাই মা, তুমি যা করচো তা কি বুঝে-শুনে করচো?
কমলা অবিচলিত দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকাল, নিজের ভালোটা ক্ষ্যাপাও বোঝে। আমি ক্ষ্যাপা পাগলা কোনোটাই নই। মন চেয়েছে তাই মনের ডাকে সায় দিয়েছি।
দুর্গামণি মনে মনে খুশি হলেও তার উচ্ছ্বাস বাইরে সে মেলে ধরে না। কলাবতীকে সে আর দুঃখী দেখতে চাইল না।
মাথা উঁচু করে সে বেরিয়ে এল সুফল ওঝার দাওয়া থেকে।
বিয়ে নিয়ে তার মনেও অনেক টুকরো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বিয়ের পরে প্রথামত ঘরের চালে উঠে গিয়েছিল বরবেশী গুয়ারাম। চাল থেকে সে কিছুতেই নিচে নামবে না। দুর্গামণি কাতর হয়ে ছড়া কেটেছে তাকে নামানোর জন্য।
চাল থিকে নামো তুমি
নিড়ান দিয়ে পুষব আমি।
তুমি ভাতার, তুমি সোয়ামী
সুহাগ দিব অঢেল আমি।
যেও না গো যেও না,
মাথার দিব্যি যেও না।
নেশায় আচে গু-গোবর
খেও না গো খেও না।
কত বছর পেরিয়ে গেল তবু ছড়াটা এখনও মাঝেমাঝে ঢেউ দিয়ে যায় দুর্গামণির মনে। আজ আরও বেশি করে মনে পড়ছে কেন না কমলা যদি তার ঘরের বউ হয়ে আসে সে কোনোদিন তার বরের মন ভেজানোর জন্য এমন ছড়া কাটবে না। কমলার কাছে এই পরিবেশ তেল আর জলের মতো, কোনোদিনও মিশ খাবে না।
দুর্গামণির টানে যুবক গুয়ারাম চলে যেত হরিনাথপুরের কদবেলতলায়। বাঁধের ধারে দুর্গামণিদের ঘরে গিয়ে সে মুখ গুঁজে পড়ে থাকত। দুর্গামণির বাবা-দাদা ওকে কত গায়ে চিমটি কাটা কথা বলত। তবু হুঁশ ছিল না গুয়ারামের। কী কথায় তার দাদা একদিন মারতে গিয়েছিল ওকে। সেদিন মুখ নিচু করে পাড়া থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল গুয়ারাম। যাওয়ার সময় বলে গেল, আর কুনোদিন কদবেলতলা ধাওড়ার মুক দেখবো না।
কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পারেনি। বাঁধের ক্ষ্যাপা জল যেমন বাঁধ ভেঙে দেয় তেমনি ভেসে গিয়েছে তার প্রতিশ্রুতি। তিন দিনের মাথায় আবার ফিরে এসেছে গুয়ারাম, সরকারি টিউকলের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে বলেছে, জান ইখানে, দেহটা কি না এসে থাকতি পারে? জানো, দুর্গা, কাল রাতভর তুমার জন্যি ঘুমোতে পারিনি। আর সে কী কষ্ট, চোখ বুজলেই তুমার মুখ, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না–তাই তুমার কাচে পেলিয়ে এলাম।
-দাদা দেকলে তুমাকে আবার অপমান করবে। দুর্গামণির অসহায় চাহনি।
–অপমান করলেও আমার কিছু করার নেই। পীরিতির হাঁড়িকাঠে যে একবার গলা দিয়েছে সে কি রেহাই পায় গো?
-এতই যদি সোহাগ-দরদ তাহলে আমারে লিয়ে চলো। আমার আর ভালো লাগচে না।
শেষ পর্যন্ত বিয়ের ফুল ফুটেছিল দুর্গামণির। চুনারাম এসে তার বাপের সাথে কথা বলে দিনক্ষণ সব ঠিক করে যায়। বিয়ে চুকে যাওয়ার পরে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে গুয়ারাম। বছরখানিক সে দুর্গামণিকে ঘুমাতে দেয়নি, শরীর জুড়িয়েছে বিছানায়। দুর্গামণিও প্রথম বর্ষার নদীর মতো শুষে নিয়েছে তাপ-উত্তাপ। সেই বাপের ছেলে রঘুনাথ, তার কাছে বেশি কিছু সংযম আশা করে না দুর্গামণি।
খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকতে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়।
রঘুনাথের বিছানার পাশে চুপচাপ বসে থাকে দুর্গামণি। গো-ধরা ছেলেটাকে বোঝাবে কার সাধ্যি।
দুর্গামণি কমলার প্রসঙ্গ তুলতে গেলেই রঘুনাথ তাকে থামিয়ে দেয়, কানের কাচে ঘ্যানঘ্যানর করো না তো, আর ভাল লাগে না। যাও গে, শুয়ে পড়ো।
-ঘুম আসে না রে বাপ, তুর চিন্তায় মরি। আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল দুর্গামণি। ফোঁপানী এক সময় কান্নায় বদলে যায়। সেই কান্নার ধ্বনি বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। রঘুনাথ দু’হাতে ভর দিয়ে বিরক্তিতে উঠে বসে বিছানায়। দুর্গামণির মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতরটা জ্বালাপোড়া করে ওঠে। দুর্গামণির কান্না যেন শুঁয়োপোকা হয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার কানের গহ্বরে। শরীর ঝাঁকিয়ে রঘুনাথ চিৎকার করে ওঠে, তুমি আমার ভালো চাও না, কুনোদিনও ভালো চাও না। তার চেয়ে এট্টা কাজ করো,আমারে বিষডিবা এনে দাও। আমি খেয়ে মরি। আমি না মরা অব্দি তুমাদের কারোর শান্তি হবে না। বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল রঘুনাথ।
-যাস নে বাপ, ফিরে আয়। দুর্গামণির আকুল কণ্ঠস্বর বুড়িগাঙের জলে গড়িয়ে গেল।
.
১৪.
সকালবেলায় মেঘের গোমড়া মুখ দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল দুলু কাহারের। কাজে না গেলে মনটা উশখুশ করে হরসময়। লালগোলা ট্রেন তাকে যেন ডাকে। চেনা গাছপালা মাঠঘাট নদী বিল সবাই যেন হাত উঁচিয়ে ডাকে। এক নিঃসীম শূন্যতা খাঁ-খাঁ করে বুকের ভেতর। ঘরে মন না ধরলে দুলু সময় কাটাতে চলে যায় পণ্ডিত বিলে। ওখানে বালিহাঁসের দল এসেছে ডিম পাড়তে। উলের বলের চেয়েও ছোট ছোট পাখিগুলো ভারি অদ্ভুত কায়দায় সাঁতার কাটে। ডুব আর সাঁতার এই হল পাখিগুলোর এগিয়ে যাওয়ার নিয়ম। ওরা ডিম পাড়ে নলখাগড়া অথবা শোলার বনে। একটা দুটো ডিম নয়, সব মিলিয়ে ছটা-সাতটা।
পাখির ডিম নয়, যেন পাখিগুলোকেই ভালোবাসে দুলু। তবে এই বিলের ধারে দাঁড়ালে আগের মতো তার এখন আর মন খারাপ করে না। ডান হাতটা কাটা যাওয়ার পর তার ভাগ্যটা বুঝি কেউ কেটে দিয়েছে ধার ব্লেডে এলোমেলো। পাল কোম্পানি কাটা হাতের কোনো ক্ষতিপূরণ দিল না। অথচ দুর্ঘটনার সময় তারা চাপে পড়ে কথা দিয়েছিলেন, সবরকম আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবেন। দুলু শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরেছে। সামান্য কটা টাকার জন্য পালবুড়ার কাছে গিয়েছিল। পালবুড়া মুখের উপর বলেছিলেন, যা দেবার সব দিয়েছি, আর আমার দ্বারা হবে না। একটা অকম্ম মানুষকে সারাজীবন ধরে পোষা কি সম্ভব? যা হবার হয়েছে, এবার আমায় মাফ করো।
হাত তুলে দিলেন পালবুড়া ফলে খালি হাতে ফিরে আসতে হল দুলুকে। বাঁশঝাড়ের কাছে এসে দুলু নিজের দুঃখ না সামলাতে পেরে কাঁদল। একটা হাত না থাকলে মানুষ কি বেকম্মা হয়ে যায়? ভুলে যেতে হয় সেই অসহায় মানুষটাকে? এসব হিসাব দুলুর মাথায় ঢোকে না। মানোয়ারা তার দ্বিতীয় আঘাত।
সবাই তাকে হাসপাতালে দেখতে এসেছে, সে আসেনি। অথচ এই মানোয়ারা একদিন গমকলে না এলে ভাত হজম হত না তার। ঠোঁট উল্টে বলত, বেছানায় শুয়ে আমি আটাচাকির ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দ শুনি। গায়ে আটা লাগলে মনে হয় সুগন্ধি পাউডার মেখেচি।
কথা শুনে মন ভরে যেত দুলুর। হা করে গিলত মানোয়ারার কথাগুলো। মনের ভেতর শিহরণের ঝড় বয়ে যেত। মানোয়ারা যা পারে অন্যমেয়ে তা বুঝি কোনোদিনও পারবে না। অথচ এই মানোয়ারা দুলুর হাত ধরে কাতর গলায় বলেছিল, আমাকে ভুলে যাবে না তো? ভুলে গেলে তুমি আমার মরামুখ দেখবে।
মানোয়ারার মিষ্টি হাসি বিষাদে মিলিয়ে যেত ঠোঁট থেকে। ভরা বুকে ছায়া পড়ত শোকের। গায়ে টাইট হয়ে বসে থাকত ঘটিহাতা ব্লাউজ। ছাপা শাড়িটা মানোয়ারাকে চোখের পলকে বানিয়ে দিত পরী। আটাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত সে, তার কথা আর ফুরোত না। দুলু ওর হাতে টাকা ধরিয়ে দিলে খুশিতে উথলে উঠে মানোয়ারা বলত, আজ চাল না কিনে এট্টা আতরের শিশি ঘরে নিয়ে যাবো। চাল তো খাওয়ার জিনিস, আর আতর হল মনের জিনিস।
দুলুর হাত কাটা যাওয়ার পর মানোয়ারা আর আটাকলে আসে না। দুলু যখন সদরে ভর্তি ছিল, সেখানেও সে যায় নি। অথচ দুল ভাবত আজ নিশ্চয়ই মানোয়ারা আসবে। মুখোমুখি বসে দু-দণ্ড কথা বলে চলে যাবে। মানোয়ারা আসে না। শুধু হতাশা আসে দুলুর মনের বাগানে। ওপরওয়ালা সাজা দিলে তার কি দোষ? সে তো পণ্ডিতবিলের ঢেউ। যে দিকে হাওয়া, সেদিকে তো ঢেউ গড়াবে।
পণ্ডিতবিলের পাড়ে এখন দুলুর সাথে দেখা হলেও কথা বলে না মানোয়ারা। মুখ ধাপিয়ে চলে যায় শামুক-শঙ্কায়। দুলু ডাকলেও সাড়া দেয় না সে। অথচ সে নিজেও বুঝতে পারে না তার কোথায় সমস্যা।
মানোয়ারার আব্বা চাঁদ মহম্মদ মসজিদে কাজ করত। তবু সংসার চালাতে হিমসিম খেত সে। প্রায়ই কাঁধে লম্বা ভিক্ষার ঝুলি ঝুলিয়ে ইনসাল্লা বলে সে বেরিয়ে যেত ঘর থেকে। দেহতত্ত্ব, ঠার-ঠোকর গান গেয়ে সে খুশি করার চেষ্টা করত গ্রামবাসীদের। রূপকাশ্রয়ী গান ভালো লাগত না অনেকের। মেয়েরা গালে টুসকি ফেলে লাজুক স্বরে বলত, ও চাচা, তুমার ফকিরি গান থামাও এবার। দু-চারটে ফাজিল-ফুক্কুড়ি গানের চচ্চড়ি শুনাও। মন ভরে যাক।
হাওয়া বদলাচ্ছে। এখন দরগা, মাজার কিংবা পীরবাবার মেলায় ফকিরি গানের চল কমেছে। এখন ছেলে-বুড়া, ছুঁড়া-ছুঁড়ি সবাই টংটংয়ে গান শুনতে চায়। তাদের বাধ ভাঙা আগ্রহ। গানে মন না ভরলে দান দেবে না দর্শক সাধারণ। তাই পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে চাঁদ মহম্মদ গান ধরে,
ও রসের লাগর, যেওনি গো যেওনি
অমন করে চুমা খেলে শরীল যে ভরলোনি।
ভরা শরীলে বাঁধ ভেঙেছে যৌবন হলো কৈ-মাছ
এসো ভোমর, ডাকি তুমারে মধু খেয়ে লড়াও গাছ।
গাছ লড়াও গো, লড়াও গো,
মধু ঝরাও গো, ঝরাও গো!
এ আদি খেলা, সারা বেলা
চকমকি আর শোলা গো-ও-ও-ও।
শরিফ মেলায় ফকিরি গানের মজলিস বসে সারা রাত। সেই আসরে চাঁদ মহম্মদ হাজির হয় দলবল নিয়ে। ফকিরি গানের পাশাপাশি রঙগানের ফোয়ারা ছোটে। তার বুড়া কণ্ঠা পেরে ওঠে না। শুধু কবি মনটা গর্জায়। চাঁদ মহম্মদ গুনগুনিয়ে ওঠে নতুন গানের কলি ঠোঁটে তুলে,
মক্কা-মদিনা পীরের থান
কেউ কি রুখেছে চাঁদের গান?
এ গানে দেহ কাঁপে, মন কাঁপে, কাঁপে বুকের ধ্বনি
এ গানে প্রেম-মহব্বত, যুগের হাওয়া, উপড়ে নেয় চোখের মণি।
আম্মা ছোট, বিবি বড়ো আব্বাজান হলো চাকর
সিটি মারে লেংড়া রাখাল দেখলে মেয়ে ডাগর।
ঘরের মেয়ে মেম সেজেছে, তুমার আবার ভয় কী
বগলকাটা বেলাউজ, লাল লিপিস্টিক ইংরিজিতে কয় কি?
দোল খাওয়া স্বর্ণলতার মতো ঝাঁকুনি দিয়ে মানোয়ারা চলে যাচ্ছে বিলের পাড় ধরে ঘরের দিকে। দুলুর বুক ভেঙে যায় টিকটিকি কামড়ানো ডানা ভাঙা মথের মতো। এই মানোয়ারা কখনোই তার চেনা মানোয়ারা নয়। সেই সহজ সরল মানোয়ারাকে তার পাড়ার সাদাত ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে টাকার লোভ দেখিয়ে পুরে দিয়েছে স্থায়ী খাঁচায়। পাখি এখন সাদাতের দানা খায়, সে এখন কারোর কথা শুনবে না।
দুলু তবু আশা ছাড়েনি, একদিন কালীগঞ্জ বাজারে সে মানোয়ারার হাত ধরল জোর করে। টানতে টানতে নিয়ে গেল মাছবাজারের পেছনে, ওদিকে লোকজন কম, শান্তিতে কথা বলা যাবে। মানোয়ারার চোখে কোনো অনুশোচনার বুদবুদ ছিল না, বরং সে তৃপ্ত, পলিপড়া মাটির চেয়েও সুখী। দুলু তাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, তুমি যে বলতে আমার সাথে সাদী না হলে মরে যাবে–এ সব কি মিছে কথা? বলো? চুপ করে থেকো না। আজ তুমাকে বলতেই হবে।
আগে হাত ছাড়ো তারপর যা বলার বলব। ঝ্যানঝ্যান করে উঠল মানোয়ারার গলা, তখন তোমার দু-হাত ছিল, এখন ডান হাতটাই কাটা। এক হাত নিয়ে যে নিজেকে পুষতে পারে না, ভিখ মেঙ্গে খায়–সে আবার আমারে পুষবে কি করে? ঘৃণা, বিতৃষ্ণা থিকথিকিয়ে ওঠে মানোয়ারার চোখে, খবরদার তুমি আমাকে আর কুনোদিন ছোঁবে না। শুনে রাখো এখন আমি সাদাতের বেগম হয়েচি। সে আমারে সুখ দেয়, সব দেয়। তুমি আর আমাদের মাঝখানে এসে কাবাবের হাড্ডি হয়ো না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঠমকে-চমকে চলে গেল মানোয়ারা। ওর শরীর থেকে গড়িয়ে নামা আতরের সুবাসটা বাতাস মাতিয়ে রাখল বেশ কিছু সময়।
দুলু আর কিছু ভাবতে পারল না, মাথার চুল চেপে বসে পড়ল মুথাঘাস ভর্তি মাঠটাতে। হুড়হাড়, দুড়দাড় করে ধসে পড়ছে বিশ্বাসের পাড়। এ দুনিয়ায় ভালোবাসা, প্রেম-মহব্বত বলে কোনো জিনিস নেই দুলুর কাছে। তার এই শুকনো জীবনের কি দাম আছে?
ললাট ওস্তাদের সঙ্গে সেই সময় তার বাঁধের আড়ায় দেখা হল।
সব শুনে ললাট ওস্তাদ মুখ দিয়ে সমবেদনার চুক চুক শব্দ করে মড়ার খুলির ভেতর চোলাই ঢেলে এগিয়ে দিলেন দুলুর দিকে, খা বেটা খা। খেয়ে বাঁচ। এ এমন কারণবারি যা খেলে বুকের ভরা বস্তা সরে যাবে। বড়ো হালকা হয়ে যাবি বাপ। নারী হলো গিয়ে প্রকৃতি, মা। জগৎ-জননী। মহাশক্তি। কালী তারা ব্রহ্মময়ী। তারা ছলনাময়ী, আবার স্নেহময়ী। তারা অসুরনাশিনী, আবার বিপরীত বিহারে কামিনী। তুই ভুলে যা বেটা। তুই সাধক, তুই পূজক। তুই চাঁদ, তুই-ই সূর্য। তুই তার গলায় নর মুণ্ডমালা। যা আজ তোর বাগদীক্ষা হয়ে গেল। আজ পূর্ণিমা। শুধু জপ কর–শব্দ ব্রহ্মা, শব্দ ব্ৰহ্ম।
ললাট ওস্তাদ নিজেও দুলে দুলে সুরা পান করলেন। তারপর ডান হাত উর্ধ্বে তুলে ঝংকার দিয়ে গান ধরলেন, ডুব দে মন কালী বলে/হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।
সুর সাঁতার কেটে গেল তার ছোট্ট দাওয়ায়। সুরা পান শেষ করে গাঁজার কষ্কে সাজল ললাট ওস্তাদ, অবশেষে শিবটান দিয়ে বলল, আজ থিকে আমি ললাট ওস্তাদ নই, ললাট গুরুজী। গুহ্য তত্ত্বকথা আমি যথাসময়ে দেব। নারীর পিছু টান আর তোর ভেতরে থাকবে না। জয় মা তারা। নে টান দে।
গাঁজার কলকেটা দুলর দিকে বাড়িয়ে দিলেন ললাট ওস্তাদ, দমে দমে বুকটা ভরিয়ে নে। ভরা বুকে কেউ আর ঢুকতে সাহস পাবেনি। তুই শিমুলতুলার মতো শুধু উড়বি আর উড়বি।
গাঁজার কল্কেয় টান দিয়ে মেজাজটা হালকা হলেও পেটের চিন্তাটা তাকে কোণঠাসা করে দেয়। পালবুড়া তাকে আর কাজে নেবে না। যার ডান হাত নেই, তাকে দিয়ে আর কী কাজ হবে?
দুল ভয়ে ভয়ে ললাট ওস্তাদের পায়ের কাছে বসল, গুরুজী, এট্টা কথা ছিল। অভয় দিলে বলি।
–গুরু পিতা সমান। তার কাছে তোর ভয় না পেলেও চলবে।–তুলে তাকালেন ললাট ওস্তাদ।
ঢোক গিলে দুলু বলল, আমার ডান হাতটা ওপরওয়ালা নিয়ে নিয়েছে। এখুন আমি বাঁচব কি নিয়ে, খাবো কি? ঘরে যে বুড়া বাপ–তারে কি খাওয়াবো?
জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। ললাট ওস্তাদ মুখ ফাঁক করে বললেন, হাত গিয়েছে, তোর গলার সুর তো যায়নি। কাল থিকে তুই টেরেনে-টেরেনে ভিখ মাঙবি। বাউল, শ্যামা সঙ্গীত, রসগান, টুসু ভাদু সব গাইবি। তোর উপর আমার আশীর্বাদ রইল। গুরু আশীর্বাদ বৃথা যাবে না। আগে আমি এ পথের পথিক ছিলাম। বাদ্যযন্ত্র, একতারা, ঘুঙুর সব আচে। তুই লিয়ে যা। আমি তোরে সব দিলাম।
ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে আখড়া থেকে বেরিয়ে এল সদ্য দীক্ষিত দুলু। বেঁচে থাকার সুতীব্র ইচ্ছাটা তার ভেতরে শেকড় চারিয়ে দিল গোপনে।
দুল এখন লালগোলা ট্রেনে একতারা বাজিয়ে, পায়ে জোড়া ঘুঙুর বেঁধে সবধরনের গান গায়, হালকা গানের গভীরে মাঝে মাঝে শুশুকের শ্বাস নেওয়ার মতো ভেসে আসে বাউলগানের কলি, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কি’ কিংবা গোলেমালে গোলেমালে পীরিত করো না, পীরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না’…..ইত্যাদি গানের তালে তালে তার পুরো শরীর দোলে, এমন কী কাঁধের কাছ থেকে কাটা হাতটা শীর্ণ হয়ে তাল ঠোকে সুরের মায়াবী ইশারায়। গান গাওয়ার সময় দুলুর শরীরে কেউ যেন ভর করে, ললাট ওস্তাদ যেন তার কানে কানে বলেন, দুলুরে, আমার ক্ষ্যাপা বেটা, তোর সুরের জালে পুরো জগৎ মোহিত করে দে। একমাত্র সুরই পারে প্রেমিক হয়ে প্রেমিকার কাছে পৌঁছোতে।
দুলু দরদ দিয়ে গায়, ওরে আমার জীবন গেল, যৌবন গেল … রইল না আর কিছু। সোনার শিকলি গায়ে জড়ালো, সার ছাড়লো না পিছু। দয়াল গুরুজী, এখুন আমি যাবো কুথায়?
মানোয়ারার ছিপছিপে গতর ঈষৎ পৃথুলা হয়েছে সুখের ছোঁয়ায়। সুখ ওর সেগুন কাঠ শরীরে পালিশ এনেছে স্বাচ্ছন্দের। এখনও হাসলে ঝকমকিয়ে ওঠে ওর দাঁতগুলো, গলার সঙ্গে লেপটে থাকা রূপোর হারটা মক্কা-মদিনার লকেট সমেত দোলে। কোঁকড়া চুলের নিবিড় রেশমীভাব এখনও লাউআঁকশির মতো পেঁচিয়ে নেমে আসে জুলফি বরাবর। কপালের সবুজ টিপটা দুই ভ্রূ-র মাঝখানে টিয়াপাখির মতো ওড়ে।
দুলু বাউল সাজলেও মানোয়ারার বুনটিয়া রূপের কাছে হার মানে, কোথা থেকে হাহাকার ছুটে এসে ভরাট করে দেয় প্রেমিক-হৃদয়। ঠোঁট-ঠোঁট চেপে কোনোমতে কান্নার বেগকে সামাল দেয় দুলু। পণ্ডিত বিলের ছায়ায় সে আর মানোয়ারার মুখটাকে দেখতে পায় না, বরং একটা লাল কৈ-ফুল বিলের জলে ফুটে ওঠে বাধ্য যুবতীর মতো। দুলু সেই দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘা নিজে শুকোবার চেষ্টা করে।
ঘা শুকোয় কিন্তু থেকে যায় দাগ।
.
১৫.
টানা বৃষ্টিতে শুধু কদমগাছ নয়, রূপ বদলে গেছে পুরো গ্রামের। সব থেকে বেশি বদল ঘটেছে বুড়িগাঙের। বৃষ্টির জাদুছোঁয়ায় বুড়িগাঙ এখন কিত-কিত খেলা কিশোরী। তার জলের রঙ এখন আর মাঠদিঘির জলের মতো কাচবরণ নয়, মাটিগোলা।
কালও হালকা কুয়াশার চাদর সাহেবমাঠ থেকে উঠে এসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছিল হলদিপোঁতা ধাওড়ায়। আর মাঝের গাঁয়ের আলিঘাস আর চাপ-ঘাসের শরীরে জড়িয়ে গিয়েছিল শিশির। জলাখেতের ধারে কচুগাছগুলো সারা অঙ্গে সবুজ জড়িয়ে ছটফট করছিল পূর্ণতার জন্য। এ সময় কচুগাছের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ মিশে থাকে। এই গন্ধটা একবারে কচুগাছের শরীর নিঃসৃত, এই সুবাসের সঙ্গে আর কারোর বুঝি মিল নেই। রঘুনাথ হাঁস খোঁজার তাগিদে কালীগঞ্জ বাজারে গিয়েছিল সেই সাত সকালে। অনেক বেলাঅবধি বসে থেকেও হাঁসের খোঁজ সে পেল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। আর ঠিক তখনি দুলু এসে তার ঘাড়ের ওপর হাত রাখল, কি রে, এখানে বসে জু নিচ্চিস-ঘর যাবি নে?
দুলুকে এ সময় দেখে রঘুনাথও কিছুটা অবাক চোখে তাকাল, তুমি এ সময়? কোথা থেকে এলে গো? আজ বুঝি দেবগ্রাম যাওনি?
নিষ্প্রভ হাসল দুলু, না, আজ আর যাওয়া হল না ভাইরে। বাপটার শরীর খারাপ। তারে হাসাপতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলাম। এখুন যাই, তার জন্যি খাবারের ববস্থা করতি হবে।
-তুমার বাবার কি হয়েছে?
-তার কি রোগ জ্বালার শেষ আচে? বয়স হলে যা হয়। হাজার রোগের ফ্যাঁকড়া বেরয়। দুলু মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল, আল্লা-রহিম, হরি যিশু কুথায় গেলে তুমরা?/একা আমি, একা সে …. করে দিও না গুমরা। দুলু বিড়বিড়িয়ে উঠে মুখ নামিয়ে আনল সহসা, রঘুনাথের দিকে তাকিয়ে সে বলল, চা খাবি? তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারা সকাল কিছু খাসনি? রঘুনাথ ইতস্তত গলায় বলল, ভিজে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি, তবে চা খাইনি বহুক্ষণ হল। আসলে কী জানো চা খেতে মন হয়নি। তুমি যখন বললে তখন চলো–দুজনে মিলে চা খেয়ে আসি।
পাশাপাশি হেঁটে ওরা চায়ের দোকানে এসে ঢুকল। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে জল ফুটছিল টগবগিয়ে। সামনের কাঠের তাকে সাজানো আছে বিস্কুটের বোয়ামগুলো। গোল, চৌকো, রঙিন, ভূসভূসিয়া….. কত রকমের বিস্কুট। দুটো চৌকো বিস্কুট দিতে বলে দুলু ঘনিষ্ঠ গলায় শুধোলদা, বল, কালীগঞ্জ বাজারে কি করতে এয়েচিস?
মনসা পুজোয় হাঁস বলি দেবে। মা মানসিক করেছিল আমার জন্য। রঘুনাথ কথা শেষ করতেই দুলু কেমন বিষণ্ণ চোখে তাকাল, মা-রতন পরম রতন, বুঝবি না রে এখুনি/ফুল বোঝে তার আসলি রূপ পাপড়ি ঝরে যখুনি। দুলু টেনে টেনে আবেশী গলায় বলল, ছোটবেলায় মা মরল, এখুন তার মুখটাই মনে পড়ে না। সব ঝাপসা ঠেকেরে, হাতড়ে হাতড়ে আমি তার মুখটা জড়ো করার চেষ্টা করি। হয় না, সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। আমার গুরুজী ললাট ওস্তাদ বলে-মা হল–জগৎমণি, জগৎজননী,/মা হলো চাঁদ-সূর্য শৌর্য বীর্য স্নেহের খনি চোখের মণি/জগৎ জননী। মা হল মা। এর কুনো বদল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে রঘুনাথ জিজ্ঞেস করল, দুলুকাকা, হাঁস কুথায় পাবো বলতো?
ভ্রূ কুঁচকে দুলু বলল, এ নিয়ে অত ভাবনা কেনে? কাল রোববার। দেবগ্রামের হাটে চল আমার সঙ্গে। তোরে আমি দেখে-শুনে হাঁস কিনে দেব।
দেবগ্রামের গোরুর হাটে অনেক বেপারী হাঁস-মুরগির ঝাঁকা নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। ঝাঁকার মুখে লাগানো থাকে দড়ির ফাঁসজালি। অল্প একটু টান দিলেই ছড়ানো গোলমুখ বন্ধ হয়ে হাতের মুঠোয় চলে আসে। দিনভর হাঁসের প্যাঁক-প্যাঁক ডাক, বেপারী গলা ফাটানো চিৎকারে ভরিয়ে রাখে দেবগ্রামের গো-হাটের বাতাস। হাট নয়তো যেন রোববারের মেলা। বাসে যেতে যেতে রঘুনাথ কত দিন যে দেখেছে এমন দৃশ্য। গোরুর লেজ মুচড়ে দিয়ে বেপারী আর ক্রেতা ছুটছে গোরুর পেছন পেছন। গোরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার এ এক অভিনব আয়োজন। চা-বিস্কুটের দাম মিটিয়ে দুলু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল, বেলা হল এবার তাহলে গাঁয়ের দিকে যাওয়া যাক। তা বাঁধে বাঁধে যাবি, না পাড়া ঘুরে যাবি?
রঘুনাথ হাসল, পাড়া ঘুরে যাওয়াই ভালো। কত কি দেখা যায়। দুলু পিন ফোটানো বেলুনের মতো চুপসে গেল হঠাৎ। মানোয়ারার পরিবর্তনটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না মন থেকে। লোক মুখে সে খবর পেয়েছে মানোয়ারের বাপ চাঁদ মহম্মদ মোটা টাকা নিয়ে মেয়েটাকে বেচে দিয়েছে সাদাতের কাছে। চাঁদ মহম্মদের টাকার লোভ ছিল এ নিয়ে দুলুর মনে কোনো সন্দেহ নেই। টাকার জন্য সে গান গায়, দেহতত্ত্ব চর্চা ছেড়ে চুটকা গানে মনভরায়। তার কাছে আল্লা রসুল করিম হরি যিশু ভগবানের চাইতে টাকার শক্তি ঢের বেশি মনে হয়। সে এখন মসজিদের দেখভালের কাজে যায় না, ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে মৌজ করে, মেয়ের গতরখাটা পয়সায় পেট ভরায়। সুখপাখিটা ওর শরীরে এখন বাসা বেঁধেছে। এমন কী নড়ে-চড়ে দানা খেতে চায় না।
কী যুগ পড়ল! মানুষ এত তাড়াতাড়ি চোখ উল্টে নেয় কী ভাবে? তাহলে কি মানুষের চোখের পর্দা খাটো হয়ে আসছে দিনে দিনে? বেইমান, অকৃতজ্ঞ, স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে মানুষ জাত। দুলুর সরল চোখের তারা বালি ঢুকে যাওয়ার মতো করকরিয়ে ওঠে, মনে মনে হাঁপিয়ে উঠে চোখ রগড়ে নিয়ে সে দূরের দিকে তাকায়।
রোদ ঝলমল করছে চারপাশে। বড়ো তেঁতুলগাছটার ভেতর থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির ডাক অনবরত। পাখির মতো সুরেলা গলায় কথা বলত মানোয়ারা, আটাকলে খদ্দের না থাকলে দুলু মন দিয়ে কথা গিলত মানোয়ারার। পালবুড়া রেগে যেত ওর মুখোমুখি বসে থাকার ধরন দেখে, টিপ্পনি ছুঁড়ে দিত বুড়োটা, আমার আটাচাকিকে, তোরা দেখছি রাধাকৃষ্ণের কদমতলা বানিয়ে ছাড়বি। তা বাপ, যা করো করো আমার বদনাম যেন না হয়। সেদিক পানে এট্টু খেয়াল রেখো।
মানোয়ারা আটাচাকিতে ঢুকলে চট করে আর ঘর যাওয়ায় মন করত না। দুলু কিছু বললে সে ঠোঁট ওল্টাত অভিমানে, গোলাপী গালে টুসকি ফেলে বলত, আমারে খেদিয়ে দিচ্চো, আমি যাবো না যাও। দেখি তুমি কি করতে পারো? অন্ধকারে মুখঢাকা গাছের মতো চুপচাপ বসে থাকত মানোয়ারা, দুলু তাকে ছুঁয়ে দিলে সে জলোচ্ছাস হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত দুলুর গেঞ্জি পরা ঘামগন্ধ ভরা বুকের উপর। আঠা লাগানো সিনেমার ছবির মতো সেঁটে থাকত সে, বিপরীত উষ্ণতায় দুলু টের পেত জীবনের মহার্ঘ্য সুঘ্রাণ। ছাপা শাড়িতে শরীর মুড়িয়ে মানোয়ারা শাহাজাদীর চোখে তাকাত, তুমারে ছাড়া আমি বাঁচব না গো, আমাকে খেদিয়ে দিলে আমি তুমার ঘরের ছিমুতে ঘুরঘুর করব। আল্লা কসম, আমি তুমার জন্য আমার এই বদন চোখের নিমেষে কুরবানি দিতে পারি। আর শুনো আমারে এড়িয়ে গেলে তুমি আমাকে জ্যাঁতা কুনোদিন পাবে না। বিলের জলে আমার দেহ দেকবে কৈ ফুল হয়ে ভাসচে।
-তোবা, তোবা। অমন কথা কয়ো না। আমার কলিজা ফাটি যাবে। দুলু শক্ত হাতের বেড়ে পেঁচিয়ে ধরত মানোয়ারার শরীর, গুড়কলের মেসিনের মতো পিষে বের করে আনতে চাইত মনের রসতৃপ্তি, চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিত মানোয়ারার সংরক্ষিত ওষ্ঠযুগল। মানোয়ারার চোখ বুজে যেত অপার্থিব আনন্দে, ঠোঁট ফাঁক করে বিড়বিড় করে বলত, আমারে মেরে ফেল। প্রেম-পীরিতে এত জ্বালা আগে জানতামনি। সেই মানোয়ারা এখন খাঁচা ভেঙে উড়ে যাওয়া বনটিয়া, তাকে দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। সে এখন সাদাতের বাগানে শিস দেয়, হাসে, খেলে, ঘুরে বেড়ায়। তার চেহারায় ছায়া পড়ে নুরি বেগমের, নুরি বেগম তার মা।
রূপসী নুরি চাঁদ মহম্মদের অভাবকে মানিয়ে নিতে পারল না শেষ পর্যন্ত। চাঁদ মহম্মদ আজান দিতে ভোরবেলায় মসজিদে চলে গেলে নুরি দু’হাত উর্ধ্বে প্রসারিত করে দোয়া মাঙত আল্লাতালার। বিড়বিড় করে বলত, আমারে আজাদ করে দাও রহিম। আমার ঘরের মানুষটা দোজকের কীট। ও আমার জীবন-যৌবন ছারখার করে দেবে। আমি জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবো রসুল। দোয়া করো। আমার জান বাঁচাও।
দশ বছর ঘর করার পর নুরি বেগম পালিয়ে গেল আতিফের সঙ্গে। আতিফের বহরমপুরে কাঁচা মালের ব্যবসা। কাঁচা ব্যবসায় কাঁচা টাকা। তার কাছে নুরি বেগম খরিদ করা বাঁদী।
যতদিন রূপের জৌলুষ ছিল ততদিন কোনো সমস্যা হল না খাওয়া পরার। রূপ ঢলতেই কদর ঢলে গেল ভিন্ন দিকে। আতিফের দু-চোখের বিষ এখন নুরি বেগম। একদিন ঘর থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল আতিফ। তার কাঁচা-পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে ভর্ৎসনা করে বলল, আর আমাকে জ্বালাচ্চো কেনে, ইবার ঘাড় থিকে নামো। ঢের হল, আর পারচি নে। ইবার আমারে ছেড়ে অন্য কাউকে দেখো। তা যদি না হয়, চাঁদের ঘরে ফিরে যাও। সে তুমাকে তো তালাক দেয়নি। শুনেছি সে নাকি এখন দয়ার সাগর। মসজিদ ঝাডপুছ করে। সাঁঝের বেলায় ফকিরি গান গায় মসজিদের চাতালে বসে। আর কিছু না হোক তুমার বুড়া বয়সে টেইম পাশ হয়ে যাবে।
নুরি বেগম আতিফের পা ধরে কাকুতি-মিনতি করে অঝোর ধারায় কাঁদল, ওগো, তুমার দুটা পায়ে ধরি, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। তার চেয়ে ফলিডল এনে দাও আমি খেয়ে মরি।
-ছিঃ ছিঃ, একী কথা! যে মোল্লার দাড়ি আছে, তার কি কুনো গুনাহ করা সাজে? তুমার জন্যি আমি কেনে দোজকের মাটি খরিদ করে রাখব? হাঁড়িচাচা পাখির মতো লালচে দাড়িতে হাত বুলিয়ে সে সজোরে ঝটকা দিয়ে পা’টা ছিনিয়ে নেয় নুরি বেগমের দখল থেকে। ঝড়ের গতিতে ঘর ছাড়ার আগে সে শাসিয়ে যায়, আর এক ঘণ্টা সময় দিলাম ঘর ছেড়ে চলে যাবে। নাহলে কেটে বস্তায় পুরে ভাগীরথীর জলে ভেসিয়ে দেব। তুমার মতন পাপী মেয়েমানুষের মানসো শ্যাল-কুকুরকে খাওয়ানোও পাপ।
নুরি বেগমের আর অপমান সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। কাঁপতে কাঁপতে রোদ মাথায় সে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। শেষে দশ ঘাটের জল খেয়ে বাস-স্ট্যান্ডের কাছে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়। চাচ বেড়ার ঘর, স্যাঁতসেতে, আলো-বাতাস ঢোকে না। সেখানে মুটে বদনার সে দাসী হয়ে বেঁচে আছে।
নুরি বেগমের কথা মাঝেমধ্যে কানে আসে মানোয়ারার। ময়ূরের পেখম ঝরে গেলে কেউ তার দিকে তাকায় না। বোবা কোকিলকে কে খাঁচায় ভরে পুষবে, দানা খাওয়াবে?
সাদাত তার শরীর নিয়ে জোর করতে চাইলে মানোয়ারা বেঁকে বসে, আগে নিকে হোক, তারপর। অত তাড়াহুড়োর কী আচে মিঞা। গাছের ফল রয়ে-সয়ে খাও। এ তো ঝরে যাওয়ার জিনিস নয়।
সাদাতের বাহুবন্ধনে যাঁতাকলের মটরদানার মতো পিষ্ট হতে থাকে মানোয়ারা খাতুন। তার মুগ্ধ চোখ দেখতে থাকে সাদাতের আবেগ থরো থরো মুখখানা। দুলু কাহারের কথা মনে করে সে আর কষ্টের পুকুরে ঝাঁপ দিতে চায় না। অতীত তার কাছে সবসময় কাঁটার ঝোপ, বর্তমান তার কাছে খুশবুদার বসরাই গোলাপ। পণ্ডিতবিলের পাড়ে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেল দুলু। পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা থেতলে গেল আধলা ইটে। কনকন করছিল নখের চারপাশ। রক্তে মাখামাখি হয়ে বুড়ো আঙুলটাকে মনে হচ্ছিল ঢোঁড়াসাপের থেতলে যাওয়া মাথা। রঘুনাথ তার পাশেই ছিল, হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে দুলু বিমূঢ়ভাবে তাকাল, তেমন কুনো চোট লাগেনি, যা লেগেছে তা আমি সামলে নিতে পারব। উবু হয়ে রক্ত মুছে দুলু খাড়া হয়ে দাঁড়াল। মাটিতে ঢুকে যাওয়া আধলা ইটটা হাতে জোর করে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল পণ্ডিত বিলের জলে। খপাৎ করে শব্দ হল জলের, চারদিকে ছিটিয়ে গেল জল ঢেউ তুলে। আর সাথে সাথে মেঘভরা জলবাহী আকাশের নীচ দিয়ে ডানা মেলে উড়ে গেল কয়েকটা মেছোবক আর মাছরাঙা পাখি। বালিহাঁসগুলো কাতর চোখে তাকিয়ে ডুব আর সাঁতারের নিপুণ কৌশলে পৌঁছে গেল নিরাপদ দূরত্বে। তারপর গলা ফাড়িয়ে ডাকতে লাগল ভয়ে।
নিজেকে সামলে নিয়ে দুলু উদভ্রান্ত স্বরে বলল, শোন রঘু, তোকে এট্টা কথা বলি। তুই আমার ভাইপোর মতো, তোরে আমার ভালো লাগে। এ সনসারে মেয়েছেলে থেকে তফাৎ-এ থাকবি। ওরা হল ছুতোর মিস্ত্রির তুরপুনের মতো। তোর কলিজা ফুটা করে সেখানে উইয়ের বাসায় ভরিয়ে দেবে। আর এট্টা কথা। ভালোবাসা আর উইয়ের বাসা-দুটাই বড়ো পলকা জিনিস। ম্যাচিস কাঠির মতো পুটপুট করে ভেঙে যায়। আর তখনই সেই খোখলা দিয়ে বেনেজল ঢুকে তোর চৌদ্দগুষ্টির মুণ্ডু চটকে ছেড়ে দেবে।
রঘুনাথ হাসতে গিয়েও হাসল না, হালকাভাবে মুখ মুছে নিয়ে সে দুলুর মুখের দিকে পুলিশ-নজরে তাকাল, কী হলো দুলুকাকা, মনে হতিচে চোট খেয়েছো। আরে ছাড়ো ওসব কথা। আমার দাদু বলে নিজে বাঁচলে বাপের নাম। কার জন্যি ভাববা তুমি। খবরদার, কারোর জন্যি ভেবো না। ভেবে ভেবে দিমাগ তুমার বরবাদ হবে, আসল কাজের কাজ কিছু হবে না।
–এসব বলা সহজ, করে দেখানো কঠিন রে! দুলু বাতাস ভরাল দীর্ঘশ্বাসে, আমার মনের অবস্থা ভালো নেই, গলা দিয়ে গান বেরুচ্চে না। কার জন্যি গাইব। যার জন্যি গাইতাম–সে এখন অন্যের খাঁচায় বুলি বলচে। আমাকে আর চেনেই না।
–সেই মহারানী কে শুনি, কী তার নাম? রঘুনাথ উৎসাহী হল।
–তার কথা না শোনাই ভালো। তার কথা বলতে গেলে আমার জিভ উল্টায় না।
তবু বলি সে মোকামপাড়ার মেয়ে। চাঁদ মহম্মদের বিটি, মানোয়ারা। দুলু দ্বিধাহীন ভাবে কথাগুলো বলে রঘুনাথের মুখের দিকে তাকাল।
রঘুনাথ বিজ্ঞ স্বরে বলল, দুলুক, এট্টা কথা বলি যদি কিছু মনে না করো।
-হ্যাঁ হ্যাঁ বল। উৎসাহিত হল দুল।
–তুমি মানোয়ারার এট্টা পুতুল বানিয়ে এই বিলের জলে ভাসিয়ে দাও। দেখবা সব হিসাব চুকে বুকে যাবে। তুমার আর কুনো কষ্টই হবে না।
বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা যায় বহু দূর। মেঘের মিছিল যেন ঘোড়ায় চেপে মেঘপাহাড়ের দিকে চলে যাচ্ছে টগবগিয়ে। দৌড়ে বেড়ানো মেঘগুলো চোখ ড্যামা ড্যামা করে দেখছে পাগলা ঘোড়ার কক্সরত। খিরিষগাছের তলায় দাঁড়ালে কোমল স্তর মেঘের তুলোর শরীর দেখা যায়। এ যেন বড় হয়ে যাওয়া কোন যুবতীর গোপন রূপবাহার।
রঘুনাথ উদাস হয়ে দেখছিল মেঘেদের ঘরবাড়ি। দুলু থুতনি চুলকাতে চুলকাতে বলল, আজ যাই। আবার হাসপাতালে যেতে হবে ভাত নিয়ে। ঘরে কেউ নেই। আমাকেই এক হাতে সব করতে হবে।
-তুমার অসুবিধা হলে বলো। আমিও তুমার সাথে চলে যাব।
-না, না। তার আর দরকার হবে নি। তবে সাবধানে চলা-ফেরা করবি। গাঁয়ে তোর শত্তরের অভাব নেই। দুলুর বুকটা ধড়ফড় করে উঠল।
রঘুনাথ হাসতে হাসতে বলল, সে আমি জানি। তবে কেউ আমার কুনো ক্ষতি করতে পারবে নি। আমার ক্ষতি করতে এলে তার নিজেরই ক্ষতি হয়ে যাবে।
–তুই এত মনের জোর কুথা থেকে পাস? দুলু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
রঘুনাথ ভেবে নিয়ে বলল, আমার শক্তি আমার মা। জানতো আমার মায়ের নাম দুর্গা। দুর্গার দশ হাত। দশ হাতে দশ রকমের অস্ত্র। এছাড়া কপোতাক্ষবাবু, অমল মাস্টার–ওদের আমার ভালো লাগে।
রঘুনাথের কথা শুনে দুলু সশব্দে হাসতে গিয়েও থেমে গেল, অমল মাস্টারের কথা আর বলিস নে। সেদিন আমি না থাকলে এই ভরা বিলে ডুবে সে মরে যেত।
-কেন কি হয়েছিল?
–কি হয়েছিল তা আমি কি জানি। জলকাজ সারতে এসে দেখি–এট্টা মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে বিলে। কোনো কিছু না ভেবেই ঝেঁপিয়ে পড়লাম। এক হাতে সাঁতরে গিয়ে তারে কোনোমতে বাঁচালাম। শেষে দেখি কিনা হাইস্কুলের ছোকরা মাস্টর। কী সব ভূত নেই, মন্ত্র নেই, বাণ মারা নেই, সভা করে ফিরছিল। কারা তাকে বিলের জলে ঠেলে ফেলে দিয়ে পেলিয়ে গেছে। দুলু হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, তবে আমি না থাকলে সেদিন মাস্টুরের দফারফা হয়ে যেত। তাও যা জল খেয়েছিল তা বের করতে আমাদের বাপ-বেটার ঘাম ছুটে যায়।
–এ সব কথা তো জানতাম না। রঘুনাথ অবাক হয়ে বলল।
-সব কথা কি সবার জানা সম্ভব? তুই থাকিস ধাওড়া পাড়ায়, আমি থাকি মোকামপাড়ায়। কথার কি পাখির মতোন ডানা আচে যে উড়ে যাবে?
–তা ঠিক। রঘুনাথ ঘাড় নাড়ল, তারপর কি হলো, মাস্টুরকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে বুঝি?
–তোর কি মাথা খারাপ না পেট খারাপ? হাসপাতালে নিয়ে গেলে আমি যে ফেঁসে যেতাম। দুলু মাথা নাড়ল, জলে ডোবা কেস, পুলিশ কেস। শেষে পুলিশ বলবে আমিই ঠেলা মেরে ফেলে দিয়েচি–তখুন?
-মাস্টার ভালো মানুষ, ও কেনে তুমার নামে মিছে কথা বলবে?
–আমার গুরুজী বলে কালো চুলের ভালো করতে নেই। কালো চুলের ভালো করলে হাড়ে হাড়ে ঠকতে হয়। দুপুর ঠোঁটে সরল হাসির ঢেউ খেলে গেল। রঘুনাথ বলল, মাস্টরকে আমি কতো বুঝিয়েছি, তবু মাস্টার বুঝবে না। মাস্টুরের ধারণা মন্ত্র পড়ে সাপের বিষ নামে না। ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই। একথা গাঁয়ের মানুষকে বোঝালে বুঝবে কেনে? যারা এসব ভাঙিয়ে করে খাচ্ছে তাদের যে বিপদ। তারা কেনে মাস্টুরকে ছেড়ে কথা বলবে? গাঁয়ে থাকতে হলে গাঁয়ের মানুষের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে হবে। নাহলে সাঁঝের আঁধারে বিলের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে এ তো জানা কথা।
–ছোকরা মাস্টুরটার মাথা খারাপ। জিন-পরী নেই একথা বললে মোকামপাড়ার কেউ কি মানবে? কেউ মানবে না। সব ক্ষেপে যাবে। দুলু চুপ করে গেল। রঘুনাথ ঝাঁঝালো গলায় বলল, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালে জান তো যেতেই পারে। সেই আগের গাঁ কি আর আচে গো? তলায় তলায় গাঁ যে অনেক বদলে গিয়েচে।
-হ্যাঁ, তা ঠিক। মেঘে মেঘে বেলা অনেক গড়ে গিয়েছে। দুলু কপালে ভাঁজ ফেলে রঘুনাথের দিকে তাকাল।
একটাই পথ মোকামপাড়া সটান চলে এসেছে পণ্ডিত বিলে। পথের ডান দিকে জল, বাঁ দিকে হাড়মটমটি, কচা আর আঁশশেওড়ার ঝোপ। সেখানে ক্যাচকেচি পাখি থপর থপর করে হাঁটে, সারাটা দিন ওদের কাজিয়ার কোনো কামাই নেই, জীবনটা বুঝি ওদের লড়াই-ঝগড়া করে কেটে গেল। ক্যাচকেচি পাখিগুলোর তবু মিলের কোনো শেষ নেই। গাঁয়ের অনেক মানুষ ওদের সাতভায়া পাখি বলে। সাত ভাই কার অভিশাপে পাখির রূপ নিয়ে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দুলু মুখ ঘুরিয়ে বলল, বেলা অনেক হল, এবার আমি যাই। তুই যদি কাল দেবগ্রামে যাস তাহলে পরে আমার সাথে দেখা করিস। আমি সাড়ে সাতটার বাসে যাবেন। তোর মন হলে চলে আসিস। তাহলে দুজনে মিলে দরদাম করে হাঁসটা কিনতে পারব।
রঘুনাথ আর দেরি না করে বিলধারের পথটায় উঠে এল। এ পথটায় ছায়া আছে গাছের। বৃষ্টি-বাদলা দিনের রোদ কখনও সখনও চাঁদি গরম করে দেয়। গুমোট ভাবটা অসহ্য লাগতেই রঘুনাথ বুকের কাছে হাতটা নিয়ে এল। ঘামে জবজব করছিল হলদেটে গেঞ্জিটা।
আজ অশ্বত্থতলায় শ্রী শ্রী মনসা দেবীর পুজোর সভা আছে। সেখানে পাড়ার সবাই জড়ো হবে। পুজোর খরচ, কে কত চাঁদা দেবে, কে কি কাজ করবে এসবই দশ জনের হাজিরাতে ঠিক করে দেবে চুনারাম। দশের কাজ দশে মিলে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো। একার কোনো মত বারোয়ারি কাজে খাটবে না।
ফি-বছর মনসা মায়ের পুজোয় সুফল ওঝার একটা বড়ো দান থাকে। কোনো বছর ফল-প্ৰসাদ, কোনো বছর মাইকের দাম সে দিয়ে দেয়। ওর দলবল এসে পাকুড়তলায় ঝাঁপান গায়, মনসামঙ্গলের গান করে। পাড়ার ছেলে বুড়ো বউ-ঝিরা সেই গান কত ভক্তি সহকারে শোনে। বেহুলার দুঃখে তারাও চোখের জলে বুক ভাসায়। আহারে, বাসর ঘরে যার সোয়ামী মরল তার জন্য কি দুঃখ হবে না কারোর?
এ বছর নাগপঞ্চমী পুজো পূর্ণিমার ব্রতোপবাস এর ঠিক পাঁচ দিন পরে পড়েছে। ওই দিন গাঙ ধারে মেলা বসবে ওঝা গুণিনদের। বর্ধমান মুর্শিদাবাদ এমন কি বীরভূমের ওস্তাদ গুণিন আসবে সেই মেলায়। তারা খালি হাতে আসা পছন্দ করে না, তাদের সঙ্গে মাদুলি-তাবিজ-এর মতো থাকবে সাপঝাঁপি। সেই সব ঝাঁপিতে মাথা নিচু করে চুপচাপ পড়ে থাকবে বিষধর সাপ। এমন হরেকরকমের সাপ দেখার মওকা বছরে মাত্র একদিনই আসে। আর এই দিনটার জন্য মুখিয়ে থাকে সুফল ওঝা। কত গুণী মানুষের পায়ের ধুলোয় ভরে উঠবে গাঙের ধার। উৎসবের ক’দিন দুলু যাবে না দেবগ্রাম। ললাট ওস্তাদের সঙ্গে সে আসবে এই অভিনব মেলায়। এখানে কবির গানের সঙ্গে লড়াই জমে দেহশক্তির। যে জিতবে সে হবে মেলার সেরা। যার সাপ ফণা তুলবে বেশি, সে হবে সাপেদের ওস্তাদ। এভাবেই দশটা শাখায় নাম উঠিয়েছে সুফল ওঝা। ফলে তার বিরামের কোনো প্রশ্ন নেই। সব কিছু একবার ঠিকঠাক বুঝে নিলে যে কোনো কাজই সহজ হয়ে ওঠে, গলানো ভাতের চেয়েও সহজ এবং সরল।
সুফল ওঝার এ কয়দিন নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। সে মেলা কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য। তার কথাতেই অনেকে মাথা হেঁট করে। অশ্বত্থতলার সভা শেষ হয় বিনা বিবাদে। চুনারাম খুশি খুশি মুখ করে বলল, ধাওড়াপাড়ায় পুজা হবেনি, এ তো হতে পারে না। তা বাপু, তুমরা যে সব এগিয়ে এলে, ব্যবস্থা করলে এতে আমার মন ভরে গেছে। মা মনসা আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করে। তারে আমাদের খুশ রাখা দরকার। মা খুশ তো, বেটা খুশ। বেটা খুশ হলে আর ভাবনা কী। সমবছর আমাদের ভালো যাবে। মা মনসার রোষ থিকে আমরা সবাই বাঁচব গো। পাকুড়তলায় মাটি দিয়ে পুজোর বেদী বানিয়েছে ধাওড়াপাড়ার উঠতি বয়সের ছেলে ছোকরা। তাদের অনেক দিনের ইচ্ছে এবছর কালীগঞ্জ হরিনাথপুরের মতো প্যাণ্ডেল বেঁধে পুজো হোক। পুজোয় দিনভর বাজুক মাইক।
দেবগ্রামের হাট থেকে মনসামঙ্গলের ক্যাসেট কিনে এনেছে দুলু। চিকচিকিতে মোড়ানো সেই ক্যাসেটটা দুল রঘুনাথের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এর দাম তাদের দিতে হবে না। এটা মনসাপুজোয় আমার চাঁদা। দেবগ্রাম গোরুর হাটে ক্যাসেটটা বাজছিল। গানগুলো শুনে মনটা ভরে গেল। তাই ভাবলাম-এটা তোদের জন্যি লিয়ে যাই। দুলু তার কাটা হাত নাড়িয়ে শরীর দুলিয়ে হাসল, পুজোর সময় আসবখন। তখন এসে ক্যাসেটের গানগুলো সব শুনে যাবে। আহা, কি গান! মনসা মঙ্গলের সুর কানে ঢুকলে মন জুড়িয়ে যায়। এসব গানের মূল্য আলাদা। তোদের ওই ফোচকামো গানের মতো নয়।
দুলু চলে যাওয়ার পর বেদী তৈরি করার কাজে লেগে গেল রঘুনাথরা। ঝুড়ি ঝুড়ি বুড়িগাঙের মাটি এনে তৈরি হল বেদী। মনসা পুজোর পরেই ভাদ্রমাস চলে আসবে। শুরু হবে কম পুজোর তোড়জোড়। ধাওড়াপাড়ার বউ-ঝিউড়িরা মেতে উঠবে করম পুজোর আয়োজনে। সে সময় ভাদুগান আর করমগানে নড়ে উঠবে মেয়েদের ঠোঁট। কটা দিন সারা পাড়া ঘিরে উৎসবের আয়োজন। রঘুনাথের এসব উৎসব অনুষ্ঠান পরব মেলাখেলা ভালো লাগে। কটা দিন অন্যরকম মনে হয় তার। অভাবী জীবনে এইটুকু সুখ-আনন্দ লটারি পাওয়ার চেয়েও মনোমুগ্ধকর। মাসকলাই হাতে নিয়ে মেয়েরা সুর করে গাইবে, কলাইরে, তুরে আমরা কী করে ভুলাইরে, ক্ষেতেরে, জমিরে ফুলুক শুধু মাসকলাইরে, ঘরে-বাইরে শুধু সুখের কলাইরে, ও মাটি তুর ভুখ কি ভরে রে, ফুল আসুক গোছ গোছা, ঘরদোর সব ঝাড়াপুছা, দেশ দুনিয়ায় ফুল ফুল ফুলুনী, শরীল হেলিয়া দুলিয়া কলাইদানা ঝাড়ুনী, কলাইরে কলাইরে, খেতিবাড়িতে সুখের সাথে ঢলাইরে ঢলাইরে, রক্ষা কর ধরিত্রী মাতা, অঢেল কলাই ফলাইরে ফলাইরে।
পরবে শুধু মানুষ নয়, সুখী হয়ে ওঠে মাঠঘাট পশুপাখি গাছপালা। পরব এলে বদলে যায় রোদের রঙ।
বসন্তপুর ধাওড়া থেকে টেপ নিয়ে এসেছে শ্রীকান্ত। সে ভূষণীবুড়ির নাতজামাই। পুজার কদিন সে ভূষণীবুড়ির ঘরে থাকবে। দুপুরে পাত পেড়ে খিচুড়ি খাবে পাকুড়তলায়। রাতে দুর্গামণি তাকে নেমন্তন্ন করেছে খাওয়ার জন্য।
মা মনসার প্রিয় নৈবেদ্য হাঁস। কাঁচা দুধ আর কলা। ভেজানো মুগ কলাই। কাঁচা দুধ না হলে মায়ের পুজো হবে না। সেই সঙ্গে চাই-নকুলদানা বাতাসা ফলফলাদি। পাড়ার মেয়েগুলো সাদা ফুল, লাল ফুল তুলে রেখেছে সাজি ভরে। ফুল তোলায় তাদের কী আনন্দ! ওরা যেন শিশির চুবানো ঘাসের চেয়েও ঝকমকে। মায়ের পুজো নিয়ে রঘুনাথের যেন ব্যস্ততার আর শেষ নেই। রঙিন শাড়ি দিয়ে ঘেরা হবে বেদী। তার মাঝখানে মা আলো করে বসে থাকবেন। তার শরীরে শাটিংয়ের ঝলমলে পোশাক। মাথায় শোলার মুকুট। হাতে ফণাধারী সাপ, পায়ের কাছে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকবে মায়ের অনুগত সাপ। অষ্টনাগ, ষোল বোড়া… আরও কতধরনের কত জাতের সাপ। মায়ের মাথায় ছায়া দেবে পঞ্চনাগ। ফি-বছর ঘটপুজো হত, এবার আর ঘটপুজো নয়। প্রতিমার দাম দিয়েছে সুফল ওঝা। এ পুজো সে নিজের ঘরে করতে পারত কিন্তু মনসা পুজোয় ভুল হলে কোনো ক্ষমা নেই। মা প্রচণ্ড রাগী। বদলা না নিয়ে ছাড়বে না। উপায় না দেখে সুফল ওঝা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারা বছর মা মনসাকে নিয়ে তার কাজ কারবার। মাকে খুশ না করতে পারলে সে যে দুঃখের সাগরে ডুবে যাবে। ফলে ধাওড়া পাড়ার পুজোয় সুফল ওঝার প্রভাব অনেক। সে সরাসরি না থাকলে দূর থেকে কলকাঠি নাড়ে। তবে এ বছর তার মন ম্যাদামারা। আচারের নুন দেওয়া লেবুর মতো চুপসে গেছে। এর কারণ রঘুনাথ। রঘুনাথ তার মেয়ের সঙ্গে লটঘট করছে। বাপ হয়ে কে মেনে নেবে? ছেলেটার বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়ার বাসনা। ধাওড়া পাড়ার অনেকেই রঘুনাথের কেসটা জানে, তারাও মনে মনে খুশি নয়। সকাল থেকে মাইক বাজছে জোর কদমে। কালীগঞ্জ বাজার থেকে মাইক ভাড়া করে এনেছে লুলারাম। মাইকের যাবতীয় খরচাপাতি সব তার। লুলারামের মাথার কোনো ঠিক নেই। সব সময় তার মনে অশান্তি লেগে আছে। ঢিলি কোথায় গিয়েছে তার খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। দুলু কাহারের ঘর গিয়েছিল লুলারাম। তার হাত ধরে বলে এসেছে, তোর বৌদিকে পাওয়া যাচ্চে না। শুনেছি সে নাকি দেবগ্রামের বাসে চেপে কুথায় চলে গিয়েছে। দু-একজন তারে ভিখ মেঙে খেতে দেখেছে। লোকমুখে খবর পাই কিন্তু আনতে গিয়ে দেখি সে সিখানে নেই। তুর কাকি তো আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলচে। আমি আর পারচি নে। হেঁপসে উঠেছি। তুই তো এদিক সেদিক যাস। তোর সাথে দেখা হলে তরে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়। আমার মন বলচে তুর দ্বারা এ কাজ সম্ভব হবে।
গাঁ ছেড়ে এত দীর্ঘসময় ঢিলি কোথাও থাকে না। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে এখবর কেউ জানে না। তবে মরে গেলেই বুঝি ভালো হত, লুলারামে গলার কাঁটা নেমে যেত। নূপুর আর নোলক যেভাবে তার দিকে তাকায়–সেই নীরব দৃষ্টি কোনো মতেই সহ্য করতে পারে না লুলারাম। মেয়ে দুটোর চোখে সে অপরাধী হয়ে গেছে। ওরা বড়ো হচ্ছে। ওরা ঝারির ঘটনাটা জানে। সব জানার পরে লুলারামকে তারা ক্ষমা করবে কি ভাবে? নানা কারণে মনে মনে পুড়ে খাক হয়ে গেছে লুলারাম। তবু মনসা পুজোয় মাইক দিতে পেরে সে খুশি। দিন চারেক আগে ঘরে একটা চিতি সাপ বেরিয়েছিল। সামনে মনসা পুজো বলে সাপটাকে মারেনি সে। মা মনসার বাহন পুজোর আগে দেখা দিলে সেই ঘরে দেবীর পুজো আবশ্যক হয়ে পড়ে। লুলারাম ভেবেছিল ঢিলি ফিরে এলে সে পুজোর বন্দোবস্ত করবে। কিন্তু তা আর হয়নি। ঢিলি তার অশান্তিকে হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পাড়ায় সবার চোখে ধীরে ধীরে অপরাধী হয়ে যাচ্ছে সে। এমনকী ঝারিও তাকে ভালো নজরে দেখছে না। সেদিন তো কলতলায় মুখের উপর বলে দিল, কী পাষাণ গো তুমি? যার সঙ্গে এত বছর তুমি ঘর করলে একবার তার খোঁজ নেবে না? সে তুমার বউ। মেয়ে দুটার মুখ চেয়ে তারে খুঁজে আনা তুমার দায়িত্ব।
ঝারির মুখের উপর লুলারাম একটা শব্দও বলতে পারেনি। ভিকনাথের বউটা আগের চেয়েও জেল্লাদারী হয়েছে। সামান্য আটপৌরে শাড়িতে তার রূপ যেন ফেটে বেরায়। মুখের হাসিটারই দাম লাখ টাকা। এ পাড়ায় বউ হয়ে আসার পর সে একদিনও খাটতে যায়নি। ভিকনাথই নিষেধ করে বলেছে, তুমি ঘরের বউ ঘরে থাকবা। আমার হাত-পা যত দিন সচল আছে, তুমারে আমি খাটতে যেতে দেব না। আমি চোখ মুদলে তোমার যা ইচ্ছে তাই করো।
-ছিঃ, কী কথা শোনাও সকাল সকাল! অভিমানে ঝারির মুখ ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে খসখসে ডুমুরের পাতা, যা বলেচো–আর কুনোদিন অমন কতা বলবা না। ওকথা শোনার আগে আমার যেন ছাতি ফেটে যায়।
লুলারামের সুখসঙ্গ ঝারি কোনো দিন ছাড়তে পারবে না, তা বলে সে যে তার ঘরের মানুষটাকে অবজ্ঞা করে তা নয়। ভিকনাথ সক্ষম পুরুষ তবু কী ভাবে যে ঝারি লুলারামের উপর ছিনে-জোঁকের মতো লেপটে গেল তা এখন আর সে মনে করতে পারে না। তবে এ ব্যাপারে প্রথম এগিয়ে আসে লুলারাম। ঝারির চাইতে সে বয়সে অনেক বড়ো হবে। বয়স্ক হলেও তার যৌন-আচরণে বয়স্কতার কোনো ছাপ নেই বরং সে অনেক বেশি তরুণ, চনমনে প্রাণ-ভ্রমর। লুলারাম দু-হাত ভরে তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এ পাড়ায় কারোর গলায় সোনার হার নেই শুধু ঝারি ছাড়া। দুটো চোঙা মাইক দুদিকে মুখ করে বেঁধে দিয়েছে রঘুনাথ। বেদীটাকে কে ঘিরে দিয়েছে কমলার কাছ থেকে চেয়ে আনা শাড়িতে। মুখ ফসকে বলার সাথে সাথেই কমলা শাড়ি তিনটে গুছিয়ে ভাঁজ করে রঘুনাথের হাতে দিয়ে দিল, যাক শেষ অবধি আমিও তোমাদের পুজোয় কাজে লেগে গেলাম। শাড়িগুলো যেন ফুটো না হয় সেদিকে খেয়াল রেখো। গত বছর পাড়ার ছেলেরা প্যান্ডেল বাঁধতে গিয়ে আমার একটা শাড়ি ফুটো করে দিয়েছে।
রঘুনাথ তাকে অভয় দিয়ে বলেছে, তুমার ভয় নেই। যেমন শাড়ি তেমনই ফেরত দিয়ে যাবো। আমার উপর তুমি বিশ্বাস রাখতে পারো। রঘুনাথের কথা শুনে কমলা দাঁত দেখিয়ে হেসেছে, তোমাকে বিশ্বাস করবে না তো কি আকাশের তারাকে বিশ্বাস করব? তুমি আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে। বলেই সে হাত চেপে ধরেছিল রঘুনাথের, যাকে মন দিয়েছি তাকে তিনটে শাড়ি দিলে কী হয়? তুমি জানো না, তুমি আমার কোথায় আছো!
শাড়িগুলো লাগাতে গিয়ে বারবার করে এসব কথা মনে পড়ছিল রঘুনাথের।
মাইকে মা মনসার পাঁচালি বাজছে। এ বারের পুজো গেল বারের পুজোকেও ছাপিয়ে গেল। একটা পুজোকে কেন্দ্র করে পাড়ার সব মানুষের এমন প্রাণঢালা যোগদান এর আগে দেখা যায়নি।
রঘুনাথ অশ্বত্থতলা থেকে ঘরে এসেছিল কী যেন কাজে। তাকে দেখে দুর্গামণি বলল, বুড়িগাঙ থেকে ডুব দিয়ে আয়। আজ আর তুকে খেতি দেব না। আজ তুর উপোস।
উপোসে থাকা কষ্টের। তবু রঘুনাথ মায়ের মুখের উপর না বলতে পারে না। কত কষ্ট করে দুর্গামণি হাঁস কেনার টাকা জোগাড় করেছে তা নিজের চোখে দেখেছে রঘুনাথ। গ্রামের কেউ সামান্য কটা টাকা উধার দিতে চায় নি। বর্ষা বাদলের দিনে নগদ টাকা কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। টাকার বদলে চাল গম অনেকেই ধার দিতে চায়। সব সময় চাল-গম দিয়ে কি সংসারের সব চাহিদা মেটে?
মন খারাপ করে খুঁটিবাঁশে হেলান দিয়ে বসেছিল দুর্গামণি। অতগুলো টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে ভাবছিল সে। রঘুনাথের মানসিকটা যে করেই হোক এ বছর শোধ করতে হবে। ছেলেটার অসুখ মা মানসার দয়ায় ভালো হয়েছে। মুখ রেখেছে মা মনসা। দেবী আসছে। তার সেবা যত্ন না করলে সংসারের উন্নতি হবে না। মা মনসাই তো তার ভরসা, আঁধার রাতের বাতি।
তার মন খারাপ দেখে চুনারাম আগ বাড়িয়ে বলেছিল, কী হয়েছে বউমা? মুখ বেজার করে বসে আচো যে।
-রঘুর মানসিকটা এ বছর মনে হয় শোধ হবে না। উত্তর দিয়েছিল দুর্গামণি, হাঁস বলি দিব বলেছিলাম। কিন্তুক হাঁস যে কিনব তার টাকা কুথায়?
ওঃ, এই কথা। চুনারাম ফোকলা হেসে বলেছিল, কত টাকা লাগবে তুমার? যেন খাজানার সন্ধান পেয়েছে চুনারাম, সেই ভাঙাচোরা মুখের দিকে তাকিয়েছিল দুর্গামণি। মানুষটা বলে কি, মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? দুর্গামণির ভাবনা ওলোট-পালোট হয়ে গেল। যে মানুষটার বিড়ি খাওয়ার পয়সা জোটে না সে দেবে টাকা? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুর্গামণির মনটা হঠাৎ উদাস হয়ে গেল।
তাকে চমকে দিয়ে ঈষৎ কুঁজো গতর সামান্য সোজা করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল চুনারাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল হাতে একটা বাঁশের পাপ নিয়ে। সেই শুকিয়ে যাওয়া বাঁশের পাঁপটা রঘুনাথের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চুনারাম বলল, এটা আমার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার। যা দা নিয়ে আয়। দেকি এর ভিতরে কতো মাল-কড়ি জমেছে। চোখ বিস্ফারিত করে তাকাল দুর্গামণি। সে অপলক তাকিয়ে ছিল তরলাবাশের শক্ত-পোক্ত মোটা পাঁপটার দিকে।
রঘুনাথ দায়ের খোঁজে চলে গিয়েছে ঘরের দিকে। চুনারাম একটা বিড়ি ধরিয়ে তরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, তুমি চিন্তে করবে না বউমা। তুমার হাঁস কেনার টাকা হয়ে যাবেন। দু-সাল থিকে ইতে আমি টাকা ভরচি। উঠিয়ে দেখো, কত্তো ভারি। এ পয়সা আমার বহু কষ্টের পয়সা। পেট কেটে এসব আমি জমিয়েচি। এ টাকা আমি গুয়ারেও দিইনি। কিন্তু নাতির কতা, তুমার কতা আলাদা। তুমাদের দুজনার জন্যি আমি আমার সব দিয়ে দিতে রাজি আছি।
দুর্গামণি স্বপ্নাবিষ্টের চোখে তাকাল। মানুষটাকে চিনতে তার ভুল হয়েছিল। মনে মনে অনুতপ্ত হল সে। মানুষ চেনা অত সহজ নয়, মাটি চেনার চেয়েও কঠিন।
গ্রামসমাজে খুঁটিবাঁশে পয়সা জমানোর রেওয়াজ বহু পুরনো। দুর্গামণির বাবাও পয়সা জমাত খুটিবাঁশে। খুঁটিবাঁশে জমালে সেই পয়সা নয়-ছয় বা চুরি চামারী হবার সুযোগ খুব কম থাকে। খুঁটিবাঁশের মাঝখানে পয়সা ফেলবার জন্য ছিদ্র থাকে। সে ছিদ্র বড়ো সূক্ষ্ম। পয়সা ঢুকবে কিন্তু কোনোভাবে বের করানো যাবে না। দিনে দিনে ভরে উঠবে বাঁশের পাঁপ। পাঁপ ভরে গেলে একমাত্র ছিদ্রটাই হবে পয়সা বার করার উপায়। আর ঘরের খুঁটি কাটলে ঘর দাঁড়িয়ে থাকবে কীভাবে? অর্থাৎ কাটা খুঁটি বদলাতে হবে সাথে-সাথে। নাহলে ঘর মুখ থুবড়ে পড়বে মাটিতে। চুনারাম অতশত ঝামেলাবাজির ধার ধারে না, খুঁটি বাঁশ নয়, সে পাপ বাঁশেই পয়সা জমাতে ভালোবাসে।
দুর্গামণি অবাক হওয়া চোখে তাকিয়ে আছে সেই পাঁপ বাঁশটার দিকে। চালে গোঁজা দা-টা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে চুনারামের সামনে দাঁড়াল রঘুনাথ, দাদু, এই নাও। কাটো- ফাড়ো যা খুশি করো–
-তুই থাকতে আমি কেনে দা-এ হাত দিব? চুনারাম কৌতুক হাসি ছড়িয়ে দিল পুরো মুখে।
দাদুর কথা কোনোদিনও ফেলতে পারে না রঘুনাথ, সে হাত বাড়িয়ে বাঁশের পাঁপটা নিয়ে দায়ের আঘাতে দু-ফাঁক করে দিল চোখের নিমেষে। ঝনঝন শব্দে পয়সা এবং ভাঁজ করা টাকা লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়, যেন টাকা নয়, পয়সা নয় এও যেন নক্ষত্রপতন।
দুর্গামণির ইতস্তত ভাবটি বেড়ে গেল। চুনারাম তা লক্ষ্য করে বলল, পয়সাগুলা বুঝে নাও। লক্ষ্মী চঞ্চলা, এদিক-ওদিক হতে দিও না।
উবু হয়ে পয়সা কুড়াচ্ছিল দুর্গামণি। রঘুনাথ আনন্দের সঙ্গে বলল, মা, কত হল ইবার গুণে ফেলো।
মাথা নেড়ে পয়সা গোণা শুরু করল দুর্গামণি। সব শেষে গা ঝাড়া দিয়ে সে বলল, সব মিলিয়ে একশ সতেরো টাকা হয়েছে। আমার হাঁস কিনতে অত টাকা লাগবেনি।
-না লাগুক, ও পয়সা তুমার কাছে রাখো বউমা। চুনারাম ভারি গলায় বলল, আমার কাছে থাকলি পরে সব খরচা হয়ে যাবে। তুমি মেয়েমানুষ। তুমাদের চাপা হাত।
পাঁপ-চেরা পয়সায় হাঁস কিনেছে রঘুনাথ। মানসিক শোধ করতে পারলে দুর্গামণিরও খুশি ধরবে না।
পরবের দিনে তার মোটা ঠোঁট দুটো স্ফুরিত হল আনন্দে।
অশ্বত্থ তলায় সাইকেল নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল কাশীনাথ। কমলার শাড়ি দিয়ে ঘেরা হয়েছে মনসা মায়ের মণ্ডপ। এই দৃশ্য দেখতে গেলে তার চোখের ভেতরটায় কে যেন ছুঁড়ে দেয় কচার রস। করকরিয়ে ওঠে কাশীনাথের চোখ দুটো, এ শাড়ি কোথায় পেলি তোরা, এ তো আমার বোনের শাড়ি।
পাশে দাঁড়ানো রোগা ছেলেটা মিনমিনে স্বরে বলল, তুমার বোনের শাড়ি কিনা জানি না তবে এ শাড়ি রঘুদা চেয়ে এনেচে গাঁ থেকে। পুজো হয়ে গেলে ফের ঘুরিয়ে দিয়ে আসবে।
–এ কী মামার বাড়ি নাকি? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা– কাশীনাথ ছুটে গেল পাকুড়তলায়। দস্যু হাতে সে পটাপট ছিঁড়ে ফেলল সেলাই।
লম্বা ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে বাধা দিতে চাইলে কাশীনাথ তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। একটা মোক্ষম খিস্তি দিয়ে বলল, হিম্মোত থাকলে তোর মায়ের পরনের শাড়ি খুলে নিয়ে এসে পুজো কর। পরের ধনে পোদ্দারী করে কি লাভ?
দাঁড়াও রঘুদাকে ডাকচি।
–ডাক গে যা তোর বাপকে। কার ঘাড়ে কটা মাথা সব আমার জানা আছে। ঠুকরে আস্ফালন করে উঠল কাশীনাথ।
রঘুনাথকে ডাকতে হল না তার আগেই অশ্বত্থতলায় পৌঁছে গেল সে। কাশীনাথকে মণ্ডপের শাড়ি খুলতে দেখে তার মাথায় বুঝি কাঁকড়া বিছে কামড়ে দিল। হুঙ্কার ছেড়ে দূর থেকে সে বলল, খবরদার কাশীদা, মণ্ডপের গায়ে হাত দিও না। বহু কষ্ট করে সুতো দিয়ে জুড়েচি।
–তুই জুড়েছিস তো আমার কী?
-কী মানে? এটা দশজনের পুজো।
—কমলার শাড়ি কোথায় পেলি? নিঃশ্বাস তেতে উঠল কাশীনাথের।
–তুমার বুন দিয়েছে। পুজা শেষ হলে দিয়ে আসব।
–না, এক্ষুনি আমি শাড়ি খুলে নেব।
–মনসাবুড়িকে তুমি অগ্রাহ্য করতে পারো না।
কাশীনাথ রঘুনাথের নিষেধ না শুনেই পড়পড় করে টানতে লাগল শাড়ি। চারধার ঘেরা মণ্ডপটা ফাঁকা হয়ে গেলে চোখের নিমেষে। সরে গেল আলো-ছায়া পরিবেশ।
নিমেষে মাথায় রক্ত উঠে গেল রঘুনাথের। সে ছুটে গিয়ে বেড়া থেকে উপড়ে আনল খুঁটিবাঁশ। তারপর কাশীনাথকে পেটাতে লাগল সজোরে। কাশীনাথ এই অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তিনটে-চারটে ঘা ওর পিঠে পড়তেই বাপরে বলে মাটি নিল কাশীনাথ। অশ্বত্থতলার ধুলো ওর মুখের ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেল এক মুঠো। প্রাগৈতিহাসিক পশুর মতো কাতরাচ্ছে কাশীনাথ।
অশ্বত্থগাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে মেঘেদের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছিল, চলমান মেঘের ছায়া ভাসছিল বুড়িগাঙের জলে, সারিবদ্ধ আখক্ষেতে বাতাস আছড়ে পড়ে শব্দ তুলছিল গণ্ডগোলের। মনে হচ্ছিল কোনো জনবল বাজার এলাকায় হঠাৎ হামলাকারী আর প্রতিরোধকারীর তুমুল বিবাদ বেধেছে, আর সেই বিবাদের জেরে উৎপন্ন হল্লা স্থানীয় এলাকা ছাড়িয়ে লোকালয়ে ছিটকে যাচ্ছে।
বাঁশের আঘাতে ধুলোয় লুটিয়ে গোঙাচ্ছিল কাশীনাথ।
তার গায়ে যে রঘুনাথ হাত তুলতে পারে–এটা স্বপ্নেও ভাবেনি। অপমান কুরেকুরে খাচ্ছিল তাকে। এভাবে পড়ে পড়ে মার খেলে মৃত্যু অনিবার্য-এই ভেবে মাটিতে দু’হাতের ভর দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল কাশীনাথ। মুখের ধুলো থুঃ শব্দে সামনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে গ্রামের দিকে দৌড়তে লাগল প্রাণপণে।
পুটুস আর অ্যাশশেওড়ার ঝোপে ছেয়েছিল বাঁধের উল্টো দিকের এলাকাটা। দিনের বেলায় ব্রাত্য থাকে ওই জায়গা, সাধারণত অশৌচ হাঁড়িকুড়ি, গ্রামের নোংরা-আবর্জনা সব ডাঁই হয়ে থাকে ওখানেই। কাশীনাথ টলোমলো শরীর নিয়ে নোংরা মাড়িয়ে ছুটছে। ডগর কাঁসি ঢোল চড়বড়ি বাজনা থামিয়ে পাড়ার ছেলেগুলো রে-রে শব্দ মুখে তুলে পিছু নিয়েছে ওর। মুহূর্তে উৎসবের পাখিটা বিষণ্ণ হয়ে নেমে এল পথের ধুলোয়।
রঘুনাথ বাঁশের মাচায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসল। খরানীকালের মুথাঘাসের মতো নিষ্প্রভ হয়ে উঠল তার মুখমণ্ডল। আজ এ কী করল সে? কাশীনাথকে ওভাবে বাঁশ-পেটা করা তার উচিত হয়নি। একথা নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সুফল ওঝার কানে তুলবে। গ্রামের বাতাস গুজবের জীবাণুর ধারক এবং বাহক। কমলা শুনলে কী ভাববে তাকে নিয়ে?
রঘুনাথের ভেতরের ঘুমন্ত অসুরটা এভাবেই মাঝেমাঝে জেগে ওঠে, তাকে তখন থামানো যায় না, সংযমের বেড়ায় আটকে রাখা অসম্ভব। এই বুনো রাগ আর জেদ তার সর্বনাশ না করে ছাড়বে না।
কাশীনাথের সাইকেলটার দিকে নজর গেল রঘুনাথের। কোনো সহানুভূতি নয় রাগ এসে বাঘহাতা ঘাসের মতো দখল নিল মনের জমি। রঘুনাথ গা ঝাড়া দিয়ে এগিয়ে গেল সাইকেলটার কাছে। কাশীনাথ তাকে জানে মারতে চেয়েছিল বাঁধের ধারে। অন্ধ একগুঁয়ে রাগ রঘুনাথের ভেতরটা ফোপরা করে দিচ্ছে। ভাঙা, চিড় খাওয়া সম্পর্ক বেলের আঠায় জোড়ে না। তাকে জোড়া লাগানোর কথা ভাবাও ভুল।
রঘুনাথ এগিয়ে গিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে বাঁধের দিকে চলে গেল। এমন পাপী মানুষের কোনো জিনিস ছুঁয়ে থাকাও পাপ। রঘুনাথ হাত উঁচিয়ে সেই লম্বা কালো ছেলেটাকে ডাকল।
ছেলেটা তার সামনে আসতেই রঘুনাথ তার মত বদলে বলল, যা এটা নিয়ে গিয়ে শেরপুরের ভেতরটায় রেখে আয়। এই জিনিস মার বেদীর সমুখে থাকুক এ আমি চাইনে।
ছেলেটা সাইকেল ঠেলতে-ঠেলতে চলে যাচ্ছে শেরপুরের দিকে।
এখন চতুর্দিকে ঢ্যাঁড়শ ফুলের চেয়েও নরম রোদ উঠেছে। বৃষ্টি ধোওয়া রোদের আভিজাত্যই আলাদা। এই রোদ মানুষের মন খারাপ সারিয়ে দেয়। আর কিছুক্ষণ পরেই পুজোয় বসবে চুনারাম। এ পাড়ায় ব্রাহ্মণ আনে না বাইরে থেকে। আনার ইচ্ছে থাকলেও ব্রাহ্মণরাই আসতে চায় না। সংস্কারের বেড়াটা তখন কাঁটার ঝোপের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়ায় উভয়ের মাঝখানে। তাই এ পাড়ার কেউ বহুযুগ ধরে বামুনের দ্বারস্থ হয় না। তারা নিজেরাই নিজের হিত-কামনায় পুরোহিত।
দূর থেকে রঘুনাথ দেখল বৃদ্ধ চুনারাম খালি গায়ে তার সোডায় কাঁচা ধুতিটা পরে হেঁটে আসছে। তার হাতে একটা ভেড়ার লোমের আসন, সদ্যস্নান সারায় তার পাকা চুলগুলো চকচক করছে রোদ-হাওয়ায়। পুরোহিত বেশে চুনারামকে মানাচ্ছে মন্দ নয়। আজ যে পরব, আজ যে শ্রীশ্রী মনসা মায়ের পুজো একথা শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতিও বলে দিচ্ছে বারবার।
দুধের যেমন মাখন, ফুলের যেমন সুবাস, তেমনি মনসা পুজোয় ঝাঁপান না হলে মানায় না। ঝাঁপান নিয়ে সুফল ওঝার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। ভিকনাথ তার পেছন-পেছন ঘুরছে সকাল থেকে। শুধু আজ নয়, বেশ কয়েক মাস হল তার মাথায় নেশা চেপেছে–তাকে মন্ত্রবিদ্যা শিখতে হবেই হবে।
ভিকনাথ তার সঙ্গ নেওয়ায় সুফল ওঝার লাভ ছাড়া লোকসান হয়নি। ভারি থলিটা এখন তাকে আর বয়ে বেড়াতে হয় না। ভিকনাথ বড়ো অনুগত। সুফল ওঝার হাত থেকে থলিটা কেড়ে সে নিজের দায়িত্বে নিয়ে নেয়। ওস্তাদের মন না পেলে মন্ত্র পাবে না সে।
সুফল ওঝা ভিকনাথকে বলেছে, মন্ত্র তো শুধু মুখের বুলি। সেই বুলিতে শক্তি আর ভক্তি মিশালে তবে গিয়ে মন্ত্র হয়। শক্তি আমি দেব। শুধু ভক্তিটা তোর ভেতর থেকে তৈরি হবে। আর তা যদি না হয় আমি তোর গায়ে মন্ত্র খোদাই করে দিলেও কোনো লাভ হবে না। মনসা মায়ের পাঁচালি হয়ে যাবে তা।
কথাটা শোনার পরে বিমর্ষ হয়ে গিয়েছে ভিকনাথ। তার মন্ত্র শেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হল ঝারিকে টাইট দেওয়া। বউটাকে উচিত শিক্ষা না দিলে সে যে ডানা মেলে প্রজাপতির মতো উড়ছে। লুলারামের সঙ্গে তার ঢলাঢলি এখন বড় চোখে লাগছে ভিকনাথের। পাড়ার লোকে দোষ দিচ্ছে তাকে। অনেকে আবার মুখের উপর বলছে, বউ সামলাতে পারো না তো বিয়ে করেছিলে কেনে? অমন বেবুশ্যে বউ থাকার চাইতে না থাকাই ভালো।
কথাগুলো কানে গেলে ঝিমিয়ে যায় ভিকনাথ। সে তখন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। কথাগুলো সাপের মতো ছোবল মারে বুকে। দশ লোকে যা বলে তা মিছে কথা নয়। এক মুখকে চাপা দিলেও দশটা মুখ তো চাপা দেওয়া সম্ভব নয়। কলঙ্ক আর কুৎসা বর্ষায় বুড়িগাঙের চেয়েও দ্রুত দৌড়ায়। ভিকনাথ মনে মনে ভেবেছে–অগ্নিবাণ মেরে সে শেষ করে দেবে লুলারামকে। ওর পুরো সংসার ছারখার হয়ে যাবে। ওর বউ পাগল হয়ে উদোম শরীরে ঘুরবে। ওর মেয়েদুটো দেবগ্রামে গিয়ে শরীর বেচে খাবে। ওর বুড়া বাপটার কুষ্ঠ রোগে পাপের পোকা কিলবিলিয়ে নড়বে।
সুফল ওঝাকে সব বলেছে ভিকনাথ। সব শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছে সুফল ওঝা। ভিকনাথ তার পা-দুটো আঁকড়ে ধরে বলেছে, ওস্তাদ, তুমার এই পা দুটা আমার ভরসা। মনে আমি কিছু লুকিয়ে রাখতে পারি নে। আমার মন পাকাটির চেয়েও পলকা। চাপ দিলে পুট-পুট করে ভেঙে যায়। ও হারামীটাকে তুমি জানে মেরে দাও বাণ মেরে। আমি সারাজীবন তুমার কেনা গোলাম হয়ে থাকব। ওর জন্য আমি রাতে ভালো ঘুমাতে পারি না। ওই হারামীর ছা-আমার সোন্দর বউটাকে ছিনিয়ে নিল।
–সব হবে, শান্ত হও। সুফল ওঝা বিড়ি ধরিয়ে চৈতন্যবকের মতো ঘাড় নাড়ে। ভিকনাথ তবু শান্ত হয় না, মেনিমুখো বেড়ালের মতো তাকায়, তুমি আমারে শান্ত হতে বলচো কিন্তুক আমি কী করে শান্ত হই বলো তো! আমার মাথায় বোলতা কেমড়ে দিয়েছে। তার যন্তনায় আমি জ্বলে মরচি। লুলারাম পয়সা করে আমার সনসারটা ভেঙ্গে দিলো। ঝারি এখন আমার কাছে শুতে চায় না। ওর এখন বড়োলোক হবার মন হয়েছে। তাই বুকে কিল মেরে বোবা হয়ে পড়ে আচি। চোকে সর্ষের ফুল দেখচি।
অত ভাবিস নে। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভিকনাথের ঘাড়ের উপর হাত রাখল সুফল ওঝা, আমি তো আছি, আমি তো মরে যাইনি। তোকে এট্টা কাজ করতে হবে। গুয়ার ব্যাটাটাকে এট্টু টাইট দিতে পারবি? ও কমলার পেছনে লেগেছে। মেয়েটাকে এট্টু বাইরে বেরতে দেয় না। সব সময় চামটুলির মতো জড়িয়ে আচে।
-কী করতে হবে বলো? খুশি না হলেও ভিকনাথ মন রাখার জন্য বলল, ঠিক আছে, কাজটা কি বুঝিয়ে বলো। যদি আমার দ্বারা হয় তাহলে ঠিক করে দেব।
সুফল ওঝা গা ঝাড়া দিয়ে বলল, কাজ সামান্যই। মেরে ওর পা দুটো উল্টে দিতে হবে। পারবি?
চোখ-মুখ শুকিয়ে ভিকনাথ বলল, ওর গায়ে হাত তুলতে আমি পারবানি। ওর বাপ গুয়া আমাকে অক্ত দিয়েছিল। ধাওড়া পাড়ার কেউ তখন পাশে দাঁড়ায়নি।
ঠিক আছে, যা ভালো বুঝিস কর। সুফল ওঝা মাথা চুলকে কপট হাসল, তবে লুলারাম ওই ঝাড়েরই বাঁশ। লুলারাম তোর সব্বেনাশ করেছে। তুই তার সব্বোনাশ করতে চাস। গুয়ার ব্যাটাটা কমলার মন বিষিয়ে দিয়েছে। আমিও ওর মন ছ্যারাবেরা করে দেব। সহজে ছাড়ব না আমি। এমন বাণ মারব যে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরবে।
ভয়ে হিম হয়ে গেল ভিকনাথের শরীর, কথা জড়িয়ে গেল তার, না, মানে, ইয়ে…
-থাক আর তোকে তোতলাতে হবে না। আমি তোর মনের ভাব বুঝে গিয়েচি। সুফল ওঝা কঠোর চোখে তাকাল, কত ধানে কত চাল হয় সে হিসেব আমার সব জানা আছে। যার গাল টিপলে এখনও দুধের ঘেরান যায়নি, সে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। মুখের হাজার দোষ, বুঝলি কি না?
ভিকনাথ অনুগত ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ল, সে আমি বুঝেচি ওস্তাদ। তবে তুমার পায়ে ধরি–তুমি আমার কেসটা ভুলে যেও না। ঝারিকে ঘরে ফিরিয়ে দাও। আমার ভাঙা সনসার জুড়ে দাও। দোহাই তুমার।
ভিকনাথের আকুতি দীর্ঘশ্বাস বাতাসকে বেদনাবিধুর করে তোলে, তার মজাটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সুফল ওঝা।