০৩. ভিন দেশের ভিন ধর্মের

ভিন দেশের ভিন ধর্মের একটি ছেলেকে বিয়ে করে ফেলার মতো কোজ সাধারণত প্ৰচণ্ড ঝোঁকের মাথায় করা হয়, এবং ঝোঁক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই মনে হতে থাকে, কাজটা ঠিক হয় নি। খুব ভুল হয়ে গেছে। এদের বেলায় এটা ঘটল না। বিয়ের এক বছর পর এক গভীর রাতে লিলিয়ানের মনে হলো, আমি নিশ্চয়ই আমার শৈশবে কিংবা আমার যৌবনে বড় ধরনের কোনো পুণ্যকর্ম করেছি। বড় ধরনের কোনো পুণ্যকর্ম ছাড়া এমন একজনকে স্বামী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে পাওয়া যায় না। লিলিয়ান একা একা কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর চেষ্টা করল তাহেরের ঘুম ভাঙাতে। পারল না। তাহেরের ঘুম ভাঙানো সত্যি সত্যি অসম্ভব ব্যাপার। লিলিয়ানের খুব ইচ্ছা করছিল তাহেরের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে যায়। গভীর রাতে নির্জন রাস্তায় হাত ধরাধরি করে। হাঁটতে হাঁটতে সে তাহেরকে বলে–আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার জন্য আলাদা করে রাখা এই ভালোবাসা কখনো নষ্ট হবে না। কখনো না।

বিয়ের দেড় বছরের মাথায় তাহের ফিফথ এভিন্নুতে নতুন বাড়ি নিল। বিশাল ড়ুপলেক্স। একতলায় খাবার ঘর, বসার ঘর, লাইব্রেরি। কাম স্টাডি রুম এবং একটা গেস্ট রুম। দোতলায় চারটা শোবার ঘর। এত বড় বাড়ির তাদের কোনোই প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাহের ছোট বাড়ি নেবে না। ছোট বাড়িতে তার নাকি দিম বন্ধ হয়ে আসে। ছোট বাড়ি নেবার কথা বলতেই তাহের হাসতে হাসতে বলল, আমার পূর্বপুরুষরা খুব বড় বড় বাড়িতে থাকতেন–বুঝলেন বিদেশিনী; কাজেই আমিও বড় বাড়িতে থাকব। বেতন যা পাই সেখান থেকে টাকা আলাদা করে রাখব। বছর পনের পর সেই টাকায় দশ একর জায়গা নিয়ে এমন বাড়ি বানাব যে তোমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাবে।

হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে তাহের যা পায় তা তার জন্য যথেষ্ট–জমানো দূরে থাকুক মাসের শেষে সে শেষ কোয়ার্টারটিও খরচ করে শুকনো মুখে লিলিয়ানকে বলে–লিলি! তোমার কাছে কি গোটা বিশেক ডলাব হবে? তখন তাহেরের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে লিলিয়ানের চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে–I love you, I love you… সে অবশ্যি চেঁচিয়ে বলে না। মনে মনে বলে যেন তাহের কখনো ধরতে না পাবে। যেমন ধরা যাক, তাহের কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে যখন বলে–বাহ তুমি তো একসেলেন্ট কাঁপাচিনো কফি বানাতে শিখে গেছ? এসো আমরা একটি কফি শপ চালু কবি। কফি শপের নাম হবে–লিলিয়ানস কাঁপাচিনো। তখন লিলিয়ান মনে মনে বলে–I love you, I love you, ঈশ্বর মানুষকে প্রচুর ক্ষমতা দিয়েছেন, মনের কথা বুঝবার ক্ষমতা দেন নি। যদি দিতেন তাহলে তাহের বুঝতে পারত কী গাঢ় ভালোবাসায় লিলিয়ান এই মানুষটাকে ঘিরে রেখেছে।

 

তাহের অনেক রাত জেগে পড়াশোনা কবে। এই সময়টা লিলিয়ান তাকে বিরক্ত করে না। বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে ভাবে–ঈশ্বর আমাকে এত সুখী কেন করলেন? এর একশ ভাগের এক ভাগ সুখী হলেও তো আমার জীবনটা সুন্দর চলে যেত।

ভালোবাসা ব্যাপারটা কী লিলিয়ান বুঝতে চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। তার ধারণা ভালোবাসা নামের ব্যাপারটায় শরীরের স্থান খুব অল্প। নেই বললেই হয়। আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণ উল্টো কথা মনে হয়। মনে হয় ভালোবাসায় শরীর অনেকখানি। অনেকখানি না হলে কেন তার সারাক্ষণ এই মানুষটাকে ছুয়ে থাকতে ইচ্ছা করবে? মন ছোঁয়া সম্ভব নয় বলেই কি শরীর ছোঁয়ার এই আকুলতা?

আচ্ছা, তার যেমন সারাক্ষণ মানুষটাকে ছুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে ঐ মানুষটারও কি তাই করে? সরাসরি জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করে, লিলিয়ান ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেছেতাহের প্রশ্নটা ধরতে পারে নি। যেমন লিলিয়ান একদিন জিজ্ঞেস করল, শোন তাহের আমরা যখন বাগানে হাঁটি–অর্থাৎ পাশাপাশি আমরা হাঁটছি। তখন তোমার কোন দিকে হাঁটতে ভালো লাগে? অর্থাৎ আমার পাশাপাশি হাঁটতে ভালো লাগে, না আমার আগে আগে, না পেছনে পেছনে?

তাহের গম্ভীর হয়ে বলেছে–মাই ডিয়ার বিদেশিনী! আমার বাগানে হাঁটতেই ভালো লাগে না। আমার ভেতর বাগান-ভীতি আছে। আমাদের গ্রামের বাড়ির চারপাশে বাগান। ঐ বাগানে একবার আমাকে সাপে তাড়া করেছিল। সেই থেকে বাগান-ভীতি।

আচ্ছা ধর, বাগানে না। রাস্তায় হাঁটছি তখন?

মাই ডিয়ার বিদেশিনী! রাস্তায় হঁটিতেও আমার ভালো লাগে না। আমেরিকাব রাস্তাগুলি হাঁটার জন্য নয়, গাড়ি নিয়ে চলার জন্য।

লিলিয়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছে, তুমি সব সময় আমাকে বিদেশিনী বলো কেন??

তুমি বিদেশী মেয়ে, এই জন্যই বিদেশিনী বলি।

বিদেশী মেয়ে বলে কি তোমার মনে কোনো ক্ষোভ আছে?

বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই।

খুব অস্পষ্টভাবে হয়তো আছে। এত অস্পষ্ট যে তুমি নিজেও জানো না।

যদি থাকে তুমি কী করবে?

তোমার সেই ক্ষোভ, সেই হতাশা দূর করার চেষ্টা করব।

কীভাবে করবে?

প্ৰথমে আমি তোমার ভাষা শিখব।

বাংলা ভাষা শিখবে?

হ্যাঁ।

নিতান্তই অসম্ভব ব্যাপার। বাংলা ভাষা হচ্ছে পৃথিবীব কঠিন ভাষাগুলিব চেয়েও কঠিন। হিব্রু বাংলা ভাষার তুলনায় শিশু।

কেন বাজে কথা বলছ?

মোটেও বাজে কথা বলছি না। ইংরেজি s অক্ষরের ধ্বনির কাছাকাছি আমাদের তিনটা অক্ষর আছে শ, স, ধ। আবার z অক্ষরের কাছাকাছি আছে তিনটা অক্ষর–জা, য, ঝ।

এরকম সব ভাষাতেই আছে।

আমাদের আরো অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার আছে। যেমন ধর–আমার শীত লাগে, এর এক রকম মানে; আবার আমার শীত শীত লাগে–এর অন্য রকম মানে। শীত শব্দ দুবার ব্যবহার করা মাত্র অর্থ বদলে গেল। সে দারুণ কঠিন ব্যাপার।

কঠিন ব্যাপার হলে তুমি আমাকে সাহায্য কর।

পাগল হয়েছ? আমি নিজেই বাংলা জানি না, তোমাকে সাহায্য করব কী? মেট্রিকে বাংলা ফার্স্ট পেপারে ৩৬ পেয়েছিলাম। কানের পাশ দিয়ে গুলি গিয়েছে।

তার মানে তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?

না।

নে কেন?

আমি তার প্রয়োজন দেখছি না।

আমি দেখছি। তুমি যে ভাষায় কথা বলো, আমি সেই ভাষা জানব না তা হতেই পারে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কাজেই আমি তোমার ভাষায় কথা বলতে চাই।

আমিও তোমাকে ভালোবাসি, তার মানে এই না যে রাত জেগে আমাকে তোমার গ্রিক ভাষায় কথা বলতে হবে।

আমার ভাষা কিন্তু গ্রিক না।

সব বিদেশী ভাষাই আমার কাছে গ্রিক ভাষা।

আমি তো তোমাকে আমার ভাষা শিখতে বলছি না। আমি শুধু বলছি তোমার ভাষা শেখার ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য কর।

ফাইন, সাহায্য করব! ভাষা শেখা ছাড়া আর কী কী জিনিস শিখতে চাও? একবারে বলে ফেলে।

আমি তোমাদের দেশের রান্না শিখতে চাই।

আর কী?

তোমাদের দেশের রীতি নীতি, আদব-কায়দা। ভাসাভাসা শেখা নয়। খুব ভালোমতো শেখা, যেন তুমি কোনোদিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে না বলো–কেন যে বিদেশী একটা মেয়ে বিয়ে করলাম।

তাহের হাসতে হাসতে বলল, তুমি চেষ্টা করছি পুরোপুরি একটি বাঙালি মেয়ে হয়ে যেতে।

হ্যাঁ। খুব কি কঠিন?

ভয়ঙ্কর কঠিন।

মোটেই কঠিন না। আমি ঠিক কবেছি বাংলাটা পুরোপুরি শেখা হয়ে গেলে আমি তোমাকে নিয়ে তোমার দেশে যাব। বাঙালি মেয়ে হবার মূল ট্রেনিং আমি দেশে গিয়ে নেব।

পাগল হয়েছ! দেশে যাবার কথা আমি চিন্তাও করি না।

কেন চিন্তা কর না?

দেশে আমার কেউ নেই।

তোমার বাবা-মা মারা গেছেন তা জানি, তাই বলে আর কেউ থাকবে না, তা কী করে হয়?

আমার বাবা-মা নেই, আমার কোনো ভাই-বোনও নেই। একটাই বোন ছিল। ছোটবেলায় মেনিনজাইটিসে মারা গেছে।

বাড়িঘর তো আছে, না তাও নেই?

একটা বাড়ি আছে তাও গ্রামের দিকে। শহরে কোনো বাড়িঘর নেই।

গ্রামের বাড়িতে কে থাকে?

কেউ থাকে না। তালাবদ্ধ থাকে। দরজা-জানালা কিছু কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে, তবে খুব বেশি নিতে পারে নি। বাড়ির সঙ্গে বিরাট আম-কঁঠালের বাগান আছে। আমার এক দূর-সম্পর্কের চাচা সেই বাগান দেখাশোনা করেন। বাগানের আয় তিনিই ভোগ করেন। তাঁকে আমি মাঝে মাঝে কিছু ডলার পাঠাই যাতে তিনি বাড়িটা দেখেশুনে রাখেন।

লিলিয়ান আগ্রহ নিয়ে বলল, খুবই ভালো কথা। মনে হচ্ছে তোমাদের পৈতৃক বাড়ি বাসযোগ্য অবস্থায় আছে। এই সামারে চল দুমাস থেকে আসি।

পাগল হয়েছ? সামারে আমি থাকব ভিয়েনা।

কোনোক্রমেই কি যাওয়া সম্ভব না?

না। তাছাড়া লিলিয়ান সামারে বাংলাদেশ তোমার ভালোও লাগবে না। ট্রপিক্যাল কান্ট্রি। প্ৰচণ্ড গরম। টেম্পারেচার চৌত্ৰিশ ডিগ্রি পয়ত্ৰিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে। হাই হিউমিডিটি। গা থেকে আলকাতরার মতো ঘাম বের হয়।

আমার কোনোই অসুবিধা হবে না।

হবে। আমার পৈতৃক বাড়িতে ইলেকট্রসিটি নেই। হাতপাখা হচ্ছে একমাত্র পাখা। প্রচণ্ড মশা। বাড়ির চারদিকে বাগানটা সুন্দর, কিন্তু সুন্দর হলেও বাগানে হাঁটতে পারবে না। বর্ষায় প্যাচপ্যাঁচে কাদা হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে আছে সাপের উপদ্ৰব।

তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি।

ভয় দেখানোব চেষ্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি। ভয় দেখাতে চাইলে বলতাম, আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, এবং ফুলহাতি ঘুরে বেড়ায়। আমি মশার কথা বলেছি, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা বলি লিলিয়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব আশা ছিল আমি এই সামারেই তোমার পৈতৃক বাড়ি দেখতে যাব।

তোমার আশা আপাতত পূর্ণ হচ্ছে না। কোনো একদিন নিশ্চয়ই হবে। বাংলাদেশের মশা তোমাকে দেখিয়ে আনব। সব মশা এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ইয়া সাইজ। একেক জন এক ছটাক দেড় ছটাক করে রক্ত খায়। রক্ত খেয়ে বমি করে ফেলে দেয়, আবার খায়। হা হা হা।

 

তাহেরের ভিয়েনায় এক মাসের জন্য যাবার কথা ছিল। সেটা বেড়ে হয়েছে দুমাস। সেমিনারের শেষে একটা শর্টকোর্স শেষ করে সে ফিরবে। তাহের খুব খুশি। লিলিয়ানের খারাপ লাগছে। বেশ খারাপ লাগছে। খারাপ লাগছে। এই ভেবে যে তাহের বুঝতে পারছে না তাহেরকে ছেড়ে একা একা বাস করা তার জন্য কত কষ্টের। সে তো অনায়াসে বলতে পারত-লিলি, তুমিও আমার সঙ্গে চল। ঘরদুয়াব তালাবন্ধ থাকুক। এই কথা একবারও বলছে না।

তাহেরের ফ্লাইট বুধবারে। সে মঙ্গলবার নাশতার টেবিলে কফি খেতে খেতে বলল, লিলি তুমিও চল। আমি সেমিনার করব, কোর্স করব–তুমি শহরে শহরে ঘুরবে। শুধু রাতে আমরা এক সঙ্গে ঘুমুব। এখানে একা একা এত বড় বাড়িতে থাকার তোমার দরকার কী? শেষে ভয়টয় পাবে।

না। আমি ভয় পাব না।

ভয় না পেলে থাক। বাড়ি খালি রেখে যাওয়া ঠিক না।

লিলিয়ানের কান্না পাচ্ছে–কেন সে বলতে গেল না। আমি ভয় পাব না। তাহের বলমাত্র সে বাজি হলো না কেন? এখন কি সে বলবে–আমি একা একা এখানে থাকতে চাচ্ছি না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। তুমি আমার জন্যও একটা টিকিট করা। না, তা বলা সম্ভব না। এমন ছেলেমানুষি কিছু সে করতে পারবে না।

লিলিয়ান।

হুঁ।

তুমি স্বীকার না করলেও আমি বুঝতে পারছি দুমাস একা একা থাকা তোমার জন্য কষ্টকর হবে। তোমাকে আমি একটা সাজেশান দেই। তুমি তোমার বাবা-মার কাছ থেকে ঘুরে আস। ওদের রাগ ভাঙিয়ে আস।

ওদের রাগ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই বলেই তুমি এমন কথা বললে। এই রাগ ভাঙবার নয়।

আমার ধারণা তাদের সামনে গিয়ে তুমি কান্নাকাটি শুরু করলেই–রাগ গলে জল হয়ে যাবে। চেষ্টা করে দেখ।

চেষ্টা করে লাভ হবে না। আমার পজার চাচা মারা গেছেন, কেউ আমাকে এই খবরটাও দেয় নি। আমি জেনেছি। অন্য একজনের কাছে।

এরা কোনোদিনই তোমাকে গ্ৰহণ করবে না?

তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, কিংবা মারা গেলে হয়তো বা করবে।

তোমাকে ছেড়ে যাবার প্রশ্ন উঠে না। মৃত্যু বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। যে প্লেনে উঠছি সেই প্লেনটাই ক্র্যাশ করতে পারে। তবে তোমাকে পৈতৃক বাড়ি না দেখিয়ে আমি মরব না। এ বিষয়ে নিশ্চিত থাক।

লিলিয়ানের খুব খারাপ লাগছে। হঠাৎ মৃত্যু প্রসঙ্গ চলে এলো কেন? এই প্রসঙ্গ তো আসার কথা ছিল না।

লিলিয়ান।

হুঁ।

আমি প্রতিদিন একবার টেলিফোন করব।

আচ্ছা।

তোমার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে একটা খাম রেখে যাচ্ছি। আমি বাসা থেকে বেরুবার পর খাম খুলবে। তার আগে নয়।

কী আছে খামে?

কিছু না। আরেকটা কথা, তুমি যদি একা থাকতে ভয় পাও তাহলে ঘরে তালা দিয়ে পরিচিত কারোর বাড়িতে উঠে পড়বে। কিংবা কোনো হোটেলে।

আমি ভয় পাব না।

তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে এখনি ভয় পাচ্ছ। আমি চোখের ডাক্তার। চোখ বিশেষজ্ঞ। চোখ দেখে অনেক কিছু বলে দিতে পারি। হা হা হা।

লিলিয়ান তাহেরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, I love you.

লিলি!

হুঁ।

এই দুমাসে তুমি কি দয়া কবে একটা কাজ করবে, গাড়ি চালানোটা শিখে নেবে? এটা কোনো কঠিন ব্যাপার না। ড্রাইভিং-এর যে-কোনো স্কুলে ভর্তি হলেই হবে। গাড়ি চালানো জানলে তুমি আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারতে। দুজন গল্প করতে করতে যেতাম। এখন যাব। ক্যাবে করে। বিশ্ৰী ব্যাপার।

তাহের ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র লিলিয়ান ড্রয়ার খুলল। সেখানে একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা–প্ৰিয় লিলি, খামের ভেতর একটা ভিয়েনা যাবার ওপেন টিকিট আছে। টিকিটাটা তোমার জন্য। যখন ইচ্ছে করবে তুমি চলে আসবে। আমি জোর করেই তোমাকে নিয়ে যেতাম। যাই নি। কারণ আমি সারাদিন থাকব ব্যস্ত, তুমি একা একা হোটেলে বসে থাকবে। নিজের স্বার্থে তোমাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করল না। এরচে ওপেন টিকিট ভালো। এখানে একা একা থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়লে চলে আসবে। তখন ভিয়েনার হোটেলে বসে বিরক্ত হলেও আমাকে দোষ দিতে পারবে না। কারণ তুমি এসেছ নিজের আগ্রহে। হা হা হা।

লিলিয়ান সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করল। যদি বুকিং পাওয়া যায়। সম্ভব হলে আজ।

ট্রাভেল এজেন্টের বোবট গলার মেয়েটি বলল, আগামী পনের দিন বুকিং পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সামারে ইউরোপ যাবার টিকিট কনফার্ম করা কঠিন দলবেঁধে টুরিস্টরা যাচ্ছে। তবে তোমাকে আমি ওয়েটিং লিস্টে রেখে দিচ্ছি। কিছু পাওয়া গেলে জানাব।

 

অনেকদিন পর লিলিয়ান একা একা ঘুমুতে গেল। এবং আশ্চর্য অনেকদিন পর ভয়ঙ্কর স্বপ্নটা সে আবার দেখল। এবারের স্বপ্ন আরো স্পষ্ট। যেন স্বপ্ন না, পুরো ব্যাপারটা বাস্তবে ঘটে যাচ্ছে। সে দেখল–বিশাল প্ৰাচীন শ্যাওলা পড়া এক অট্টালিকা। সে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। লোহার প্যাচানো সিঁড়ি। সে উঠেই যাচ্ছে। সিঁড়ি শেষ হচ্ছে না। হঠাৎ সিঁড়ি শেষ-নিচে নামতে চেষ্টা করল। কী আশ্চৰ্য, নিচে নামারও ব্যবস্থা নেই। সে এখন কী করবে? তাহেরের কথা শোনা যাচ্ছে। সে অনেক দূর থেকে ডাকছে। তার গলার স্বর ক্ষীণ। প্ৰায় অস্পষ্ট।

লিলিয়ান! লিলিয়ান। তুমি কোথায়?

আমি এখানে।

তুমি আমাকে বাঁচাও। আমি ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছি। ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। তুমি বাঁচাও আমাকে।

আমি নামতে পারছি না। আমি আটকা পড়ে গেছি।

আমাকে বাঁচাও। লিলিয়ান, আমাকে বাঁচাও।

আমি আটকা পড়ে গেছি।

সিঁড়ি দুলছে। প্রচণ্ড শব্দে দুলছে। দুলুনিতে লোহার রেলিং খুলে আসছে। অনেক দূর থেকে তাহেরের অস্পষ্ট স্বর কানে আসছে। খুব বাতাস দিচ্ছে। বাতাসের কারণে কিছু শোনা যাচ্ছে না।

লিলিয়ান জেগে উঠল। ঘড়িতে একটা দশ বাজে। লিলিয়ান বাকি রাতটা বারান্দায় রকিং চেয়ারে বসে কাটাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *