ভালো করে ভেবে দেখতে গেলে, প্রত্যেক মানুষেরই জন্মের পেছনে একটা করে রোমহর্ষক গল্প আছে। যে উৎকণ্ঠা, উদবেগ, অনিশ্চয়তা প্রতিটি জন্মকে ঘিরে থাকে– তার সঙ্গে তুলনা চলে আর কীসের?
একজন নারীর সারা জীবনে মোট চারশো বার মাসিক হয় অর্থাৎ সেই নারী তার জীবনে চারশো বার সন্তান জন্ম দেবার জন্য তৈরি হয়ে থাকে। একটি পুরুষ তো প্রতিদিনই লক্ষ লক্ষ স্পার্ম উৎপাদন করতে পারে। সেই লক্ষ অযুতের মধ্যে কখন একটিমাত্র গিয়ে ঠিক মিশ খাবে একটি নারীর গর্ভের ডিমে, তারপর শুরু হবে আর একটি নতুন প্রাণের ইতিহাস। এই মিলন কখনও ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। অনেক দম্পতি বিনষ্ট হয়ে যায়। সে-সব বাধা পেরিয়ে গেলেও, তার পরেও চলবে ন’-দশ মাস প্রতীক্ষা, আঁতুড়ঘর বা হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের দরজার বাইরে শঙ্কাতুর পিতার পায়চারি, একটি সম্ভাবনাকে গর্ভে ধারণ করে করে সহ্যের শেষ সীমায় আসা ভাবী-মাতার মুখ। তখনও কেউ বলতে পারে না, আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানও সঠিক ভাবে বলতে পারেনি, এর পরের মুহূর্তেই যে জন্ম নিতে যাচ্ছে, সে একটি ছেলে না মেয়ে। আমাদের মনে পড়ে না যে আমাদেরও জন্ম এই ভাবে। এই নানা আস্ফালনময় জীবনের মাঝখানে হঠাৎ এই কথাটা মনে পড়লে, হাসি পাবেই।
এই বায়োলজিক্যাল জন্মের আগে থেকেই কাহিনী দানা বাঁধে। একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর বিয়ের সব ঠিকঠাক। হঠাৎ জানা গেল, পাত্রীপক্ষের বংশে একটু খুঁত আছে। অমনি ভেস্তে গেল বিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের দু’জনের মিলিত ভাবে যে এক সেট ছেলেমেয়ে জন্মাবার কথা ছিল, সেই সম্ভাবনাটি নিহত হয়ে গেল, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল আর এক সেট ছেলেমেয়ের নিয়তি। এক প্রেমিকা তার প্রেমিককে শেষ মুহূর্তে নিরাশ করে বিয়ে করল বাপ-মায়ের কথামতন এক গোলগাল পাত্রকে, একটি বাপের সুপুত্তুর ছেলে টাকাপয়সা কিংবা রূপের দরকষাকষিতে শেষ পর্যন্ত বনল না বলে বিয়ে করল না প্রতিবেশিনী মেয়েটিকে–এরা কেউ জানে না, এরা এদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র নিয়ে কী রকম ছিনিমিনি খেলছে। এই ধোঁয়াটে অবস্থাকে যুক্তিসিদ্ধ করার জন্য আগেকার দিনে মাসিপিসিরা বলতেন, যার যেখানে কপালে লেখা আছে, সেখানে বিয়ে হবেই। কেউ খণ্ডাতে পারবে না।
আমি অনায়াসেই কল্পনা করতে পারি, বিয়ের আগে আমার মাকেও অন্তত আট-দশ বার পাত্রপক্ষের সামনে দর্শন দিতে হয়েছে। ঘরজোড়া শতরঞ্চির একপাশে বসে আছেন গুটিকতক সুসজ্জিত গাঁট্টাগোট্টা লোক, প্রত্যেকের সামনে প্লেটে সাজানো সন্দেশ-সিঙাড়া, আর শতরঞ্চির ওপাশে লাজুক, নতমুখী–আমার মায়ের কিশোরী বয়সের শরীর। তখন পাত্রের স্বয়ং আসার রেওয়াজ ছিল না, পাত্রের বাবা-কাকারাই আসতেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে রূপ গুণের পরিমাণ। পরে খবর দেব বলে চলে যাওয়া মানেই কোনও আশা নেই।
শেষ পর্যন্ত বরিশালের এক পাত্রের সঙ্গে আমার মায়ের বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, পাত্রের চেহারাও ভালো এবং বিশেষ দাবিদাওয়া নেই। বিয়ের তারিখ ও লগ্নও যখন ঠিক হয়ে গেল, তারপর কে যেন একজন এসে খবর দিল যে, পাত্রের নিজের কাকা পাগল। যে বংশে পাগলামির ধারা আছে, সে-বংশে বিয়ে দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তক্ষুনি সেই সম্বন্ধ ভেঙে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেওয়া হল আগে বাতিল করা এক পাত্রের সঙ্গে। সেই বাতিল করা পাত্রই আমার বাবা।
বরিশালের সেই ভদ্রলোক যথাসময়ে অন্য একটি কন্যার পাণিগ্রহণ করলেন, এবং তারও দুটি ছেলে হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, ভদ্রলোক পরিণত বয়সে সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তার ছেলেদুটিও পাগল কিনা খোঁজ পাইনি। আমাদের যে আত্মীয়টি শেষ মুহূর্তে খবর এনে আমার মাকে বাঁচিয়েছিলেন, তিনি যদি না আসতেন বা ওই খবরটা না পেতেন, তা হলে আমার হওয়ার কথা ছিল ওই পাগল পিতার সন্তান, এবং হয়তো এতদিনে আমিও পাগলামির পথে…। একা ঘরে এইসব ভাবতে ভাবতে আমি হেসে ফেলি।
আমাদের গোটা ‘রঞ্জন’ বংশের জন্মই একটা হাস্যকর ঘটনা থেকে। আমাদের বাড়ির পুরুষদের সকলেরই নামের মাঝখানে রঞ্জন শব্দটা আছে। যেমন, আমার বাবার নাম চিররঞ্জন, আমার জ্যাঠামশাইয়ের নাম প্রিয়রঞ্জন ইত্যাদি। আমার ঠাকুরদার নাম সারদারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এই সারদারঞ্জন নামের মানুষটির জীবন কাহিনী কী রকম আলোচনা করা যাক।
সারদারঞ্জন পণ্ডিত ছিলেন না, বিশেষ লেখাপড়া করেননি–পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে তা জানা যায়। কিন্তু ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম, কিছু সংস্কৃত শ্লোক ছেলেবেলা। থেকেই শুনে শুনে শিখেছিলেন–সেইগুলিই স্থানে-অস্থানে আউড়ে পণ্ডিতির ভান করতেন। সারদারঞ্জন মূলত পূর্ববঙ্গের অধিবাসী নন। পূর্ববঙ্গে একসময় ব্রাহ্মণের আমদানি করা হত। স্থানীয় কায়স্থ ও বৈশ্য সম্প্রদায় নিজেদের ধনাঢ্যতা ও আর্যয়ানা জাহির করার জন্য স্বগ্রামে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে বাইরে থেকে পুরুত আনাতেন।
আমাদের কুল-গোত্র পরিচয়ে দেখা যায়, আমাদের খড়দা মেল। অর্থাৎ কলকাতার কাছাকাছি খড়দা অঞ্চলে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল। অনেকে যেমন দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়ে একজন নেপালি চাকর সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে, সেই রকম ভাবেই বিক্রমপুরের রায়েরা কলকাতা থেকে সারদারঞ্জনের বাবা অঘোরনাথকে পূর্ববঙ্গে নিয়ে যান। খড়দা থাকার সময় অঘোরনাথের জীবিকা কী ছিল আমি জানি না, তবে পূর্ববঙ্গে এসে তার প্রধান জীবিকা হয় বিয়ে করা। মোটমাট সাঁইতিরিশটি বিয়ে তিনি করে উঠতে পেরেছিলেন। আরও বেশি যে পারেননি–তার কারণ অঘোরনাথ দীর্ঘজীবী হননি। সাঁইতিরিশটি বিবাহের ফলে মোট আশি-নব্বইটি ছেলেমেয়ের একটি বিশাল বংশ তিনি গোটা পুব বাংলায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। মাত্র একশো দশ বছর আগেকার ঘটনা। এদিকে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন সদ্য জন্মেছেন এবং বিদ্যাসাগর মশাই বেদান্ত যে ভ্রান্তদর্শন, এই কথা বলে দেওয়ায় নানান শত্রুর হাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন।
কোন সন্তানটি পুত্র হবে, কোনটি কন্যা তা আগে থেকে ঠিক করার কোনও উপায় নেই। তবুও, সব দেশেই নারী-পুরুষের সংখ্যায় একটা মোটামুটি সমতা থাকে, খুব একটা হেরফের হয় না। কোনও কারণে কোনও দেশে পুরুষের সংখ্যা অকস্মাৎ কমে যেতে পারে–যেমন হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী জার্মানিতে। সেই রকম কোনও কারণেই কি গত শতাব্দীতে বাংলাদেশে পুরুষের সংখ্যা কমে গিয়ে বহু বিবাহের এমন পসার জমেছিল? হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজেই অরক্ষণীয়া মেয়ের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল অনেক। সাধারণ ভাবে যে-সব মেয়ের বিয়ে হবার কোনও উপায় ছিল না– সেই সব মেয়েকে ব্যবসায়ীরা নৌকো ভরে নিয়ে গিয়ে চালান দিত অন্যত্র। গ্রামের নদীর ঘাটে নিয়মিত এসে ভিড়ত সেই সব নৌকো–প্রকাশ্যে মেয়ে চালান হত। ওই সব মেয়েদের বলা হত ভরার মেয়ে। তাদের কোনও জাত নেই। ওই উপায়ের মুসলমান মেয়ের সঙ্গে হিন্দুর বিয়ে হয়ে গেছে, এবং বিপরীত। হিন্দু বাড়ির নতুন বউ লাউকে কদু বলায় হুলুস্থুলু পড়ে গেছে–এ রকম গল্প আছে।
অথচ, রাজামহারাজা কিংবা নবাব বাদশা ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে বহু বিবাহের প্রচলন কোনও কালেই ছিল না আমাদের দেশে। ইতিহাস পুরাণে সে রকম বিশেষ নজির নেই। এমনকী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বা ভোগবিলাসী ঋষিরাও এক-দার। একমাত্র যাজ্ঞবন্ধ্যেরই দুই স্ত্রী দেখতে পাচ্ছি।
মুসলমান সমাজের মধ্যে জাতিভেদ নেই বলে তাদের মধ্যে বিশেষ কোনও শ্রেণি গত শতাব্দীতে বিবাহ ব্যাপারে একাধিপত্য করতে পারেনি। কিন্তু হিন্দুসমাজে জাতিভেদ প্রথার বীভৎসতম দিকটা তখন প্রকট। জাতির পাতি মানতে গিয়ে জ্ঞান, ধর্ম, ন্যায় সব ভেসে গেছে। এবং ব্রাহ্মণ সমাজ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং স্বার্থ বজায় রাখার জন্য এই প্রথাকেও আরও জোরদার করছে। জ্ঞানচর্চা চুলোয় গেছে বিনা পরিশ্রমে লোকের কাছ থেকে কাটা মুলোটা আদায় করা, সংবৎসর খাদ্যের বাঁধা ব্যবস্থা বজায় রাখা এবং ফাউ হিসেবে শ্রদ্ধা-ভক্তি পাওয়া–এর জন্য তারা যে-কোনও নীচতার পরিচয় দিতে প্রস্তুত ছিল। কত রমণীর চোখের জল যে তখন এদেশের মাটি ভিজিয়েছে, এখন তা আর জানার উপায় নেই। এবং যেহেতু বংশমর্যাদা এবং কৌলিন্যের গৌরবই ছিল তখনকার ব্রাহ্মণদের একমাত্র ক্যাপিটাল–সেই জন্যই সেটাকে ফুলিয়ে ফঁপিয়ে দেখবার সহস্র চেষ্টা। নানা রকম বিধিনিষেধ ও ছুঁৎমার্গের প্রচলন হয় সেই সময় থেকে। বিশ্বামিত্র চণ্ডালের বাড়িতে অন্ন ভিক্ষা করেছিলেন কিন্তু গত শতাব্দীর ব্রাহ্মণদের অন্য যে-কোনও অব্রাহ্মণের ছোঁয়া খেতেই আপত্তি। অধিকাংশ উপাধ্যায়রাই যে সেন-আমলে এফিডেবিট করা ব্রাহ্মণ, সে-তথ্য গোপন ছিল। ছুঁৎমার্গের জন্যই সেই সময় থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
যাই হোক, সারদারঞ্জনের বাবা অঘোরনাথ বিয়ে করতে করতে হাঁপিয়ে গিয়েই বোধহয় মারা যান। কুলীনদের তখন খুব রবরবা। ‘স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি’ হলেও আপত্তি নেই, পুরুষদের বংশমর্যাদার কোনও দোষ থাকলে চলবে না। সেই সুবাদে একটার-পর-একটা বিয়ে করা ও সারা বছর ধরেই শ্বশুরবাড়ি নেমন্তন্ন খাওয়া। ছেলেমেয়ে মানুষ করারও কোনও দায়িত্ব নেই। কুলীনদের ভঙ্গ হওয়ার ব্যাপারটা কী, তা আমি এখনও স্পষ্ট বুঝি না, তবে শুনেছি, বিয়ের ব্যাপারে ভঙ্গ কুলীনরাই ছিলেন বেশি তালেবর। বিদ্যাসাগর এদেরই বলেছিলেন, ‘পাষণ্ড ও পাতকী’। এই রকমই এক ভঙ্গ কুলীনকে একসময় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার তো এতগুলো শ্বশুরবাড়ি, সব জায়গায় যাওয়া হয়? তিনি বলেছিলেন, যেখানে ভিজিটের টাকা পাই, সেখানেই যাই।
অঘোরনাথের বহু সংখ্যক ছেলেমেয়ের মধ্যে অন্যতম সারদারঞ্জন নিজেই নিজের পথ দেখে নেন। যোলো বছর বয়সেই তিনি ফরিদপুরের ফুলবাড়ি নামের ছোট শহরের এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে উদ্ধার করেন ও যৌতুক বাবদ সেখানে একখণ্ড জমি আদায় করেন। ছোট্ট বাড়ি তুলে তিনি নিজের বংশ স্থাপন করলেন!
সারদারঞ্জনও পর পর বিয়ে করেই জীবনটা কাটিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন সম্ভবত, কারণ, তার আর কোনও জীবিকা ছিল না। কিন্তু তিনটি মাত্র বিয়ে করেই তিনি হঠাৎ থেমে যেতে বাধ্য হলেন। ততদিনে যুগের হাওয়া পালটাতে আরম্ভ করেছে। এবং আমার বাবা যে মাত্র একটি বিয়ে করেছিলেন–এটা একটি বৈপ্লবিক ঘটনার মতন। অঘোরনাথের কাল থেকে আমার বাবা চিররঞ্জনের কাল–মাত্র ষাট-সত্তর বছরের মধ্যে এই রীতির পরিবর্তন। একে ইংরেজি শিক্ষার কুফল ছাড়া আর কী বলা যায়। তা ছাড়া, বীরসিংহ গ্রামের সেই খর্বকায় ব্রাহ্মণ বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ করার পর বহুবিবাহ বন্ধ করার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছিলেন। বাংলার বিভিন্ন জেলায় এক এক জন কীর্তিমান পুরুষের এক ডজন দু’ ডজন স্ত্রীর সংখ্যাও তিনি প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। এবং বৃদ্ধ বয়সে একটি কিশোরী কন্যার পাণিগ্রহণের অপরাধের জন্য তিনি তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরও মুখ দর্শন করতে চাননি–এই গল্প একসময় সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বরিশাল জেলায় কলমকাটি গ্রামের ঈশ্বরচন্দ্র মুখুজ্যের পঞ্চান্ন বছর বয়সেই স্ত্রীর সংখ্যা ছিল একশো সাত। সেই তুলনায় সারদারঞ্জনের বাবা অঘোরনাথ তো ছেলেখেলা করেছেন মাত্র।
লোকে বলে, দুটি বিয়ে করেই সারদারঞ্জনের আশ মিটে গিয়েছিল। তাঁর দুই স্ত্রী তখন একই বাড়িতে। তখন বিয়ে করে বউকে বাপেরবাড়ি ফেলে রাখার নিয়মটি আস্তে আস্তে অপসৃত হচ্ছে। নেহাত ধনীরা ছাড়া, অন্য সাধারণ গৃহস্থ মেয়ের বিয়ে দেবার পর সাধ্যমতন বস্ত্র-অলংকার দিয়ে তাকে শ্বশুরের ভিটেয় পৌঁছে দিয়ে যায়। তারপর তার ভাগ্য সে বুঝুক।
১২৭৭ সালে আর একটা ব্যাপার হয়ে গেল। ব্রাহ্মণ সমাজে প্রায় বজ্রপাতের মতন ঘটনা বলা যেতে পারে। লক্ষ্মীনারায়ণ মুখুজ্যে নামে এক কুলীন মাত্র ছ’টি বিয়ে করেছিলেন, তার এক স্ত্রী কৃষ্ণমণি ভারী দুঃসাহসিনী। স্বামী তাঁকে নেয় না–এই জন্য খোরপোষের দাবিতে তিনি আদালতে মামলা করে দিলেন। এমন কথা কেউ কখনও শোনেনি। আদালতে সাহেব হাকিমের সামনে লক্ষ্মীনারায়ণ মুখুজ্যে বলল, হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে বউদের ভরণপোষণের দায়িত্ব কুলীনদের থাকে না। তা ছাড়া, আমার এতগুলো বউ, সবাইকে আমি খাওয়াব কী করে? জজ নর্মান সাহেব বললেন, খাওয়াতে পারবে না তো বিয়ে করেছিলে কেন? এখন জেলে যাও!
বাড়িতে একই সঙ্গে দুই স্ত্রীকে নিয়ে সারদারঞ্জন বেশ মুশকিলে পড়েছিলেন। ঝগড়াঝাটির চোটে বাড়িতে কাকচিল বসতে পারে না! মাঝে মাঝে বৈরাগ্যেরও উদয় হয় সারদারঞ্জনের মনে। টাকাপয়সারও খুব টানাটানি, ফুলবাড়িতে তার প্রথম শ্বশুর মারা গেছেন। শ্যালকরা উপুড়হস্ত হয় না। স্বল্প বিদ্যা সম্বল করে সারদারঞ্জন একটি পাঠশালা খুলেছেন, তাতেও বিশেষ আয় নেই।
সারদারঞ্জনের প্রথম পক্ষের বিয়েতে কোনও সন্তান হয়নি, সেই স্ত্রী বাঁজা ও সাঙ্ঘাতিক ভালো স্বাস্থ্য এবং দারুণ মুখরা। দ্বিতীয় বিয়েতে দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে। এই ছেলেটি ছিল সারদারঞ্জনের নয়নের মণি। সারদারঞ্জন ছেলেটিকে এক মুহূর্তও। চোখের আড়াল করতেন না, তার নাম ছিল বিশ্বরঞ্জন, ডাকনাম বিশু, চেহারাটাও খুব ফুটফুটে। এই ছেলেটির একবার কঠিন অসুখ হয়েছিল। বিবরণ শুনে মনে হয় টাইফয়েড। তার সোনার বর্ণ কালি হয়ে যায়। শরীর মিশে যায় বিছানার সঙ্গে, শ্রবণশক্তিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বিশু বিশু বলে ডাকলেও সাড়া দিত না।
প্রথম দিকে স্বাভাবিক নিয়ম মতন কবিরাজি চিকিৎসাই চলছিল। তাতে কোনও ফল দেখা যাচ্ছিল না। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা তখন সদ্য গ্রামাঞ্চলে ঢুকছে, ম্যাজিকের মতন সন্দেহ ও বিস্ময় নিয়ে লোকে গ্রহণ করছে এই পদ্ধতিটিকে। আট-দশ মাইল দূরে একজন এল এম এফ পাশ ডাক্তার আছেন, তাঁকে কল দিয়ে আনা হল এবং তাঁর ওষুধে দু-এক দিনের মধ্যেই রোগীর কিছুটা উন্নতি প্রত্যক্ষ করা গেল। কিন্তু অবস্থা আবার খারাপ হয়ে পড়তেই ডাক্তারকে আবার ডাকা বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কিন্তু ডাক্তারটি চশমখোর, ভিজিটের টাকা অগ্রিম না দিলে তাকে কিছুতেই আনা যাবে না এবং কলকাতা থেকে বিলিতি ওষুধ আনাবার অজুহাতে আরও একগাদা টাকা চেয়ে বসলেন। সারদারঞ্জনের হাতে তখন একটা পয়সা নেই। ঘটিবাটি বন্ধক দেওয়াও হয়ে গেছে। সারদারঞ্জন ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার ছেলেকে আপনি বাঁচিয়ে দিন এবারের মতন! আমি যেমন করে পারি, আপনার দেনা একদিন-না-একদিন শোধ করে দেব।
ডাক্তারটি নিষ্ঠুরের মতন উত্তর দিয়েছিলেন, ওষুধ কোম্পানি কি আপনার এ কথা শুনবে? ওষুধ চাই, আসল বিলিতি ওষুধ, বুঝলেন? না হয় তো এক কাজ করুন। কল। দ্যাট কবিরাজ এগেন। মকরধ্বজ ফজ খাওয়াক। এসব পাড়াগাঁর জায়গায় এতকাল ওই সব কবিরাজি ওষুধ খেয়েই তো লোকে মরেছে। আমাকে এর মধ্যে জড়াবেন না। বিনা। ওষুধ আমি চিকিচ্ছে করতে শিখিনি।
চিন্তায় ভাবনায় দুঃখে সারদারঞ্জন প্রায় পাগলের মতন হয়ে উঠেছিলেন। আর সহ্য করতে পারছিলেন না। নতুন বৈশ্য যুগ এসেছে, কিন্তু সারদারঞ্জন টাকা রোজগারের। কোনও উপায় শেখেননি। শেষ পর্যন্ত কোনও রকম দিশা না পেয়ে তিনি গৃহত্যাগ করলেন। রুগ্ন ছেলে, অনূঢ়া দুই কন্যা ও দুই স্ত্রীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন সারদারঞ্জন।
ফিরে এলেন আট দিন বাদে। নদীর ঘাটে সারদারঞ্জনের নৌকো লাগতেই পাড়া সুদ্ধ লোক সেখানে ছুটে গিয়েছিল মজা দেখতে। কেন না, সারদারঞ্জন নৌকো থেকে নামলেন বরের বেশে, পেছনে লাল চেলি-পরা একটি তেরো বছরের মেয়ে। মস্ত বড় ঘোমটায় তার মুখ দেখা যায় না। বিস্তর পোঁটলাপুটলি সঙ্গে নিয়ে আরও দুটি লোকও এসেছে।
উপায়ান্তর না দেখে অর্থ সংগ্রহের একমাত্র রাস্তা হিসেবে সারদারঞ্জন ঝটিতি আর একটি বিয়ে করে এসেছেন। সম্ভবত কথাবার্তা আগে থেকেই চলছিল। এতদিন সারদারঞ্জন রাজি হননি, হঠাৎ মনস্থির করেই নিকটতম লগ্নে বিয়ে করে ফেলেছেন শুধু পণের টাকাটা পাবার জন্য। শোভাযাত্রা সহকারে নদীর ঘাট থেকে এসে সারদারঞ্জন। যখন নিজের বাড়ির চৌহদ্দিতে পা দিলেন, তার কয়েক ঘণ্টা আগে প্রতিবেশীরা তার ছেলেকে পুড়িয়ে এসেছে। সারদারঞ্জনকে দেখেই দুই স্ত্রী আর্তনাদ ও গালাগালি করতে করতে আছড়ে পড়ে মাটিতে। নতুন বউ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল উঠোনের মাঝখানে। ওই উটকো এবং মোটেই প্রকৃষ্ট ভাবে আনয়ন করা হয়নি যাকে, সেই নব পরিণীতা মেয়েটিই আমার আপন ঠাকুমা।
তৃতীয় বিবাহের পর সারদারঞ্জনের ভাগ্য অনেকটা ফিরে যায়। ছেলের শোক ভুলতে কিছুটা সময় লেগেছিল। তবে নতুন বউ এসেই অতি দ্রুত দুটি পুত্রসন্তান উপহার দিলেন। তারপর একটি মেয়ে, আবার দুটি ছেলে। সবচেয়ে ছোট ছেলেটির মুখ-চোখ অবিকল সারদারঞ্জনের সেই প্রথম মরা-ছেলের মতন, যার চিকিৎসার কারণে এই বিয়ে। লোকে বলাবলি করতে লাগল, সেই ছেলেই আবার তার বাবার কাছে ফিরে এসেছে। একেই বলে মহামায়ার খেলা। সেই ছেলেরও নাম রাখা হল বিশ্বরঞ্জন, কিন্তু ডাক নাম বিশুর বদলে রঞ্জু। ডাক্তারের খরচ জোটাতে না পারার জন্যই প্রথম বিশ্বরঞ্জন মারা গিয়েছিল, তাই সারদারঞ্জন ঘোষণা করলেন, এই কনিষ্ঠ ছেলেকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। ঢাকায় তখন মেডিক্যাল কলেজ হয়ে গেছে, সেখান থেকে পাশ করিয়ে এনে দেশের বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত করাবেন ডাক্তার ছেলেকে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে লোকেরা এসে তার বাড়িতে ধরনা দেবে।
তৃতীয় বিবাহের টাকা থেকেই সারদারঞ্জন কিছু ধানজমি কিনেছিলেন। রায়তদের দিয়ে চাষ করাচ্ছিলেন। হঠাৎ কে যেন একজন বুদ্ধি দিল, ওই নাবাল জমিতে ধান চাষ করে তেমন লাভ নেই, বিঘে প্রতি পাঁচ-ছয় মণ ধান হয় মাত্র, বরং ওখানে পাট লাগানো হোক। পাটের দাম ক্রমশ চড়ছে, জাপানিরা নাকি পাট দিয়ে জামাকাপড় পর্যন্ত বানাবে। পাট কাটা হয়ে গেলে সেই সময়টা খেসারির ডাল। অলস ব্রাহ্মণ হলেও সারদারঞ্জনের কিছু পাটোয়ারি বুদ্ধি ছিল নিশ্চয়ই, কেন না ধান চাষের চিরাচরিত ব্যবস্থা ছেড়ে তিনি। পাটের দিকেই ঝুঁকলেন এবং অবিলম্বে সচ্ছলতার মুখ দেখলেন। তার পাঠশালাটিও ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম হয়ে। উঠলেন এবং স্থানে-অস্থানে ভুল সংস্কৃত শাস্ত্রের বচন উদ্ধার করে নানা সামাজিক বিষয়ে ফতোয়া জারি করতে লাগলেন।
আমার তিন ঠাকুমার মধ্যে অপুত্রক বড়ঠাকুমা বেঁচেছিলেন অনেক দিন। মেজোঠাকুমা তার প্রাণাধিক পুত্রের মৃত্যুর কিছু দিন পরেই মারা যান। ছোটঠাকুমা বা আমার আপন ঠাকুমার নাম ছিল মেঘমালা। ছোট্টখাট্টো চেহারা, কথা বলতেন কম, সারা বাড়িতে তুর তুর করে ঘুরে বেড়াতেন। এক সংকটজনক অবস্থায় তিনি এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন। বুঝেছিলেন, তার একমাত্র কাজ হচ্ছে মুখ বুজে বাড়ির সকলের সেবা করে যাওয়া। তার বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন অনেক ছোট বয়সে, ভাইদের সংসারে মানুষ, বউদিদের লাথিঝাটা খাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তখনকার দিনে শ্বাশুড়ির হাতে বউরা যে রকম অত্যাচারিত হতেন বউরাও তেমনই তার শোধ তুলে নিতেন। ননদের ওপর অত্যাচার করে। পুরুষদের বিরুদ্ধে মেয়েরা তো কখনও একজোট হয়ে দাঁড়াতে পারে না–অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েমানুষই হয় মেয়েমানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। ভাইরা তাই তাড়াতাড়ি করে কোনওক্রমে মেঘমালার বিয়ে দিয়ে পার করে দেয়।
বড়ঠাকুমা ও মেজোর মধ্যে খুব ঝগড়াঝাটি হলেও বড়ঠাকুমার সঙ্গে ছোটঠাকুমার কখনও সে রকম কিছু হয়নি। পুত্রহীনা অসহায় বড়ঠাকুমা মনে মনে জানতেন, এ-সংসারে তার কোনও অধিকারই নেই। সেই জন্যই জোর করে অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। চিৎকার করে, ধমকে, ভয় দেখিয়ে তিনি মাথায় করে রাখতেন। সারা বাড়ি। বাসনপত্র আছড়ে আছড়ে ফেলতেন মাটিতে, রান্নাঘর থেকে চ্যালাকাঠ ছুঁড়ে মারতেন উঠোনে। বাড়িসুদ্ধ সবাই সব সময় তটস্থ। ছোটঠাকুমা একদিনও গলা উঁচু করে একটাও কথা বলেননি। বরং পোষা বেড়ালটির মতন সব সময় ঘুরঘুর করতেন বড় জায়ের পায়ে পায়ে-সুযোগ পেলেই এটা সেটা খাবার জিনিস এগিয়ে দিতেন তার। মুখের সামনে। এবং নিজের সন্তানদেরও এক এক করে তুলে দিয়েছিলেন বড় জায়ের। হাতে।
বড়ঠাকুমা সতিনের ছেলেদের উঠোনে শুইয়ে জবজবে করে সরষের তেল মাখাতেন সারা শরীরে। পুকুরে নিয়ে ঠান্ডা জলেও চান করাতেন জোর করে। গামছা দিয়ে গা ঘষে ঘষে ছালচামড়া তুলে দিতেন প্রায়। খাবার খেতে বসে কেউ এক কণা খাবার ফেললেও তিনি কান ধরে থাপ্পড় কষাতেন ঠাস ঠাস করে। ইস্কুল থেকে ফিরতে যদি কেউ একটুও দেরি করত, তিনি সদর দরজার কাছে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন রণরঙ্গিণী মূর্তিতে। তাদের ঘুম পাড়াবার সময় পিঠে এত জোর চাপড় মারতেন যে ধুপধাপ শব্দ শোনা যেত অনেক দূর থেকে।
মেঘমালা কোনও দিন এসব নিয়ে একটুও মাথা ঘামাননি। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীরা। কেউ কোনও দিন যদি বলে ফেলত, ওবাড়ির বড়বউ সতিনের ছেলেমেয়েগুলোকে কষ্ট দেয়, তা হলেই ঝগড়া করার বদলে কেঁদে ফেলতেন বড়ঠাকুমা।
ওঃ, সে কী কান্না! আমার বড়ঠাকুমার কান্না প্রবাদ-প্রসিদ্ধ ছিল ওই অঞ্চলে। একবার শুরু করলে তিন-চার ঘণ্টার আগে থামতেন না। চিৎকার করে, আদিবাসীদের ধর্মীয় প্রার্থনার চেয়েও তীব্র স্বরে তিনি যেন তার ভেতরের কোনও শারীরিক কষ্টের কথা জানাতেন। চাচাতে চাচাতে দম বন্ধ হয়ে আসত প্রায়। তিনি নদীর পারে গিয়ে একলা একলা চিৎকার করে কাঁদতেন–যেন ওই নদীর মধ্য থেকে কোনও দেবতা এসে তার। দুঃখ দূর করবেন। আমাদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে গিয়ে কাঁদতেন–যেন অরণ্য থেকে আসবে তার উদ্ধারকারী। সেই সময় সারদারঞ্জন তার ধারে কাছে গেলে বড়ঠাকুমা বোধহয় রাগের চোটে ছিঁড়েখুঁটে ফেলতেন তাঁকে। শুধু মেঘমালাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে ভোলাতে পারতেন। ছেলেমেয়েদের হাত ধরে গিয়ে পড়তেন তার পায়ে। তার কিছুক্ষণ পর আলুথালু চুল, উদ্ভ্রান্ত মুখ বড়ঠাকুমাকে সবাই টানতে টানতে নিয়ে আসত বাড়িতে।
আবার বাবা-জ্যাঠামশাইরা এখনও যখন তাদের বড়মায়ের কথা বলেন, তাদের চোখে জল এসে যায়। মাতৃস্নেহের যে একটা আদিম হিংস্র রূপ আছে, ওঁরা শৈশবে তার স্পর্শ পেয়েছিলেন।
সারদারঞ্জনের তখন বেশ সুসময় চলছে। আর্থিক দুরবস্থা ঘুচেছে। বাড়ি-ভরতি ছেলেমেয়ে, তারা পড়াশুনোতেও মোটামুটি ভালো। আমার জ্যাঠামশাই প্রিয়রঞ্জন জেলায় মধ্যে বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে সবাইকে চমকে দিলেন। জেলাবোর্ডের হাইস্কুলে তার ফ্রি স্টুডেন্টশিপ জুটে গেল। আমার বাবা চিররঞ্জন ছিলেন শিশু প্রতিভাবিশেষ। ভালো করে অক্ষরজ্ঞানের আগেই তিনি লম্বা লম্বা পদ্য গড়গড় করে নির্ভুল মুখস্ত বলতে পারতেন। শুভঙ্করের আর্যাগুলো সব ঠোঁটের ডগায়। অবশ্য অধিকাংশ শিশু প্রতিভারই পরিণতি যা, আমার বাবারও তাই হয়েছিল। চিররঞ্জন বড় হয়ে লেখাপড়ায় খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। মোটামুটি পরীক্ষা পাশ করেছেন।
মেজোঠাকুমার দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। প্রথম মেয়ের বিয়ে হয়েছিল দোজবরের সঙ্গে। বিয়ের পরদিনই তিনি পাঁচটি সন্তানের মা হয়ে যান। তার মধ্যে দুটি সন্তান তার চেয়ে বয়সে বড়। আর এক মেয়ে বিয়ের পরেই পশ্চিমে চলে যান। পশ্চিম অর্থাৎ উত্তর প্রদেশ-তখন যার নাম ছিল যুক্ত প্রদেশ! তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা হয়নি।
যাই হোক, এবাড়িতে কন্যাসন্তান বলতে তখন একমাত্র পূর্ণিমা পিসিমা। সাত-আট বছর বয়সে কস্তাপেড়ে শাড়ি পরে ফুরফুর করে দৌড়োদৌড়ি করতেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখবার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন সারদারঞ্জন। তবু দাদাদের কাছাকাছি বসে থেকে পূর্ণিমা কিছু পড়তে লিখতে শিখেছিলেন। এমনকী, আশ্চর্যের বিষয়, তিনি নাকি পদ্য লিখতে পারতেন। দশ-এগারো বছর বয়সেই তিনি বেশ কিছু রচনা করেছিলেন শিবমন্দির, শ্মশান ও নদী বিষয়ে। সেসব পদ্য রচনার কোনও নিদর্শন অবশ্য কেউ রেখে দেয়নি সংগ্রহ করে। তবে জ্যাঠামশাইয়ের কিছু কিছু মনে আছে এখনও। সম্ভবত কবি চন্দ্রাবতী বা তরু দত্তের মতন সুপ্ত কবিপ্রতিভা ছিল পূর্ণিমার মধ্যে, কিন্তু তার বিকাশের কোনও সুযোগ ঘটেনি। বিয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিধবা হওয়ার পরই এই কবিত্ব শক্তি অনেক বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের পর একেবারে চাপা পড়ে যায়।
পূর্ণিমার পরের ভাইয়ের নাম নিখিলরঞ্জন। অপূর্ব সুন্দর তাঁর মুখশ্রী, ধপধপে ফরসা রং। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই খুব গম্ভীর ও বোকা বোকা ধরনের। সবাই বলত, এই ছেলেটা জড়ভরত হবে। পরে অবশ্য তাকে ততটা বোকা মনে হয়নি, বরং ভাবুক স্বভাবটিই প্রকট হয়েছিল। পরবর্তীকালে আমার এই কাকা যে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দেবেন, তার চিহ্ন বাল্যকালেই সূচিত হয়েছিল। যদিও রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবার আগে একটি বিবাহিতা নারীর প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে একটি ঘোরতর সামাজিক কেলেঙ্কারি প্রায় সম্পূর্ণ করে তুলেছিলেন।
একেবারে ছোট ছেলে বিশ্বরঞ্জন সম্পর্কে লোকের ধারণা যে–এই বাড়িরই এক ছেলে পুনর্জীবন প্রাপ্ত হয়ে এ বাড়িতে আবার জন্মেছে। চোখ-মুখ একেবারে যেন হুবহু বসানো, গলার আওয়াজটিও আগের বিশ্বরঞ্জনের মতন। এই কুসংস্কারটি ক্রমশ বাড়ছিল এবং লোকের মুখে মুখে বেশ ছড়িয়েছিল। এই ছেলের সম্পর্কে লোকের অনেক আশা। সারদারঞ্জন কনিষ্ঠ সন্তানটিকে সগর্বে লোকের বাড়ি দেখাতে নিয়ে যান।
সারদারঞ্জনের তখন প্রধান কাজ সকালে বিকেলে রুপো বাঁধানো ছড়িটি হাতে নিয়ে পাড়া বেড়ানো। পরনিন্দা পরচর্চায় দিব্যি সময় কেটে যায়। ঠোঁটের ওপর পুরুষ্টু সাদা গোঁফ, ভুরুতেও দু-একটি পাকা চুল। দেখলে বেশ একটা শ্রদ্ধেয় শ্রদ্ধেয় ভাব আসে। নানা বিষয়ে তিনি ভারিক্কি চালে মতামত দেন, লোকে মানেও। সমাজের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য তিনি সব সময় সচেতন। ব্রাহ্ম সমাজের কিছু লোক ওখানে বক্তৃতা দিতে এসেছিল, স্থানীয় লোকরা তাদের তাড়া করে নদী পার করে দেয়। সারদারঞ্জন তাতে খুব খুশি। শিবতলার সান্ধ্য আসরে বহুক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে সেই গল্প করলেন। তার কিছু দিন পরেই দুর্গাপূজার ভাসানের সময় মসজিদের সামনে ঢাক বাজানো নিয়ে বেশ কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হল। উত্তেজনা ক্রোধে বিস্তারিত হবার আগেই স্থানীয় লোকেরা একটা সালিশি সভা ডাকল। প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন সাহেবকে করা হল সভাপতি। জমিদারের নায়েব তখন অনুপস্থিত বলে হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হল সারদারঞ্জনকে। সারদারঞ্জন সেই সভায় রীতিমতন বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ফেললেন। লোকজনের কথাবার্তা শুনেই বুঝেছিলেন হাওয়া কোন দিকে। জয়নাল আবেদিন দাপটে বক্তৃতা দিয়ে সারদারঞ্জনের দিকে ফিরে বললেন, মুখুজ্যেমশাই জ্ঞানী গুণী লোক, তিনি যা বিধান দেবেন, তাই আমরা মানব। তিনি ভুল বিধান দিতেই পারেন না!
সারদারঞ্জন কিছু বলার আগেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। পাকা অভিনেতার মতন কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, আজকাল কি আর কেউ শাস্ত্র ধর্ম মানে? বিসর্জনের সময় বাজনা বাজাতে হবে, শাস্ত্রের কোন জায়গায় একথা লেখা আছে আমাকে দেখাও তো! মাকে জলে ফেলে দিতে যাচ্ছি, তখন তো কাঁদতে কাঁদতে যাব। তখন কি নেচেকুঁদে ঢাকঢোল বাজিয়ে আনন্দ করা যায়? তুমিই কওঁ জয়নালভাই, তাই পারা যায়? যতক্ষণ পূজা, ততক্ষণ বাজনা-দধিমঙ্গলের পরই কান্না, এই হল নিয়ম! ঠিক কিনা!
সবাই খুব খুশি। সারদারঞ্জন নির্দেশ দিয়ে দিলেন পূজামণ্ডপে যত খুশি বাজনা হবে–প্রতিমা নিয়ে যাবার সময় কোনও বাজনা নয়। তবে হ্যাঁ, একেবারে বিসর্জনের সময়, নদীর ওপরে নৌকোয় নৌকোয় ঢাকের প্রতিযোগিতা হতে পারে বটে! সে প্রতিযোগিতা প্রতি বারই হয়–সেটা চট করে বন্ধ করার সাধ্য সারদারঞ্জনেরও নেই!
সেই মিটিংয়ের পর সারদারঞ্জনের সুনাম আরও বেড়ে গেল। লোকজন আরও বেশি খাতির করে। সারদারঞ্জনের মুখে-চোখে বেশ একটা গর্বের ভাব, সাধারণ ছোটখাটো মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় মুখের দিকে তাকান না পর্যন্ত–একমনে হুঁকোয় টান দিতে থাকেন। সব মিলিয়ে মনে হয় সারদারঞ্জন একজন সুখী মানুষ।
কিন্তু সারদারঞ্জনের জীবনে সবচেয়ে কঠিন আঘাত এল সবচেয়ে বেশি যার ওপর নির্ভর করেছিলেন, তার কাছ থেকেই। ছোটছেলের ওপর সারদারঞ্জনের এত আশা-ভরসা ছিল, সেই বিশ্বরঞ্জন তাকে পদে পদে নিরাশ করতে লাগল। বিশ্বরঞ্জন বাল্যকাল থেকেই বিষম দুরন্ত, ক্রমে ক্রমে তার অত্যাচারে সবাই সন্ত্রস্ত। অন্য লোকের বাড়ির বাগান তছনছ করা শুধু নয়, সমবয়সি ছেলেদের মারধর করা ও নালিশ লেগেই আছে। দুরন্ত ছেলে, বাড়ির কারওর কথা সে গ্রাহ্য করে না-বড় ঠাকুরমার বয়স হয়ে গেছে, তিনিও আর শাসন করতে পারেন না। ইস্কুলের একজন মাস্টারমশাই বিশ্বরঞ্জনকে বেত দিয়ে মারতে এসেছিলেন, দু ঘা মারার পরই বিশ্বরঞ্জন বেত কেড়ে নিয়ে সেই মাস্টারের নাকে এমন ঘুষি মারল যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। তারপর সবাই মিলে বিশ্বরঞ্জনকে প্রচণ্ড মেরে প্রায় আধমরা করে ফেলে। এই ঘটনার পর বিশ্বরঞ্জন একটু শান্ত হয়েছিল, কিন্তু আবার অন্য রকম বিপদ ডেকে আনল।
খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পূর্ণিমার বিয়ে দিয়েছিলেন সারদারঞ্জন, কিন্তু মাত্র সাত মাসের মধ্যেই সে বিধবা হওয়ায় প্রথম আঘাত পেয়েছিলেন। শ্বশুরের ঘর করা বা স্বামী-সম্ভোগ কিছুই ঘটেনি পূর্ণিমার কপালে। তার স্বামী নতুন চাকরি পেয়ে চলে গেল চট্টগ্রামে, সেখানে হঠাৎ কলেরায় মারা যায়। বিধবা পূর্ণিমার দ্বিতীয় বিয়েতে আরও বেশি আঘাত পেয়েছিলেন সারদারঞ্জন কিন্তু তার বুকে মৃত্যুশেল বিধিয়ে দেয় তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান ওই বিশ্বরঞ্জন।