০৩. ভাত-কাপড়ের ভরসা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শাশুড়ী যতই চুপ ক’রে থাকুন এবং হেম যতই ভাত-কাপড়ের ভরসা দিক, কনকের বুকের মধ্যে যেন ঢিপ্ ঢিপ্ করতে থাকে তরুর অবস্থাটা চিন্তা ক’রে। কিছুতেই সে স্বস্তি পায় না; তরুর দিকে চোখ পড়লেই চোখে জল এসে যায় তার।

হয়ত এতটা উদ্বেগ অকারণ, কিছুই হয়ত হবে না শেষ পর্যন্ত, হয়ত ওবেলাই মিটে যাবে সব– তবু একটা আকারহীন অজ্ঞাত আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে থাকে সে। মনে হয়, এ ঠিক হচ্ছে না; তাদের তরফ থেকে কিছু একটা করা দরকার, যেমন ক’রেই হোক এটা মিটিয়ে নেওয়া দরকার। যদি– যদি শেষ পর্যন্ত হারানেরও বিষ-নজরে পড়ে যায় তরু এই ঘটনা উপলক্ষ ক’রে?

দোষ তরুর নেই সত্যি কথা–কিন্তু পুরুষের মন কি সুক্ষ্ম ন্যায়বিচার ধরে চলে!

তা যদি চলত তবে কনকেরই বা এ অবস্থা হবে কেন?

কনকের এতটা উদ্বেগের কারণ যে ঐখানেই।

তার নিজের কথা ভেবেই তরুর জন্যে এত দুশ্চিন্তা।

আহা যে পেয়েছে, সে সুখী হয়েছে– সে আর না হারায়, সে সুখ থেকে না বঞ্চিত হয়।

পোড়া ঘায়ের ক্ষতটা তরুর বুকের ওপর– আর কনকের বুকের মধ্যে, আজও সমান দগদগ করছে।

অথচ তার এ কথা কাউকে বলবার নয়–জানাবার নয়। কাউকে খুলে বলতে পারলেও হয়ত একটু শান্তি পেত সে। কিন্তু কী বলবে? তার এ অদ্ভুত অবস্থা–ত্রিশঙ্কুর মতো স্বামীর হৃদয়াকাশে ঝুলে থাকা কে বুঝবে? হয়ত বলবে বাড়াবাড়ি, আদিখ্যেতা। সহানুভূতির পরিবর্তে উপহাসই করবে তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই দোষ দেবে–বলবে তারই অক্ষমতা, স্বামীর মন সে দখল করতে পারে নি। মেয়েমানুষের পক্ষে চরম অপমানের কথা এটা। আর সেই কারণেই সে কাউকে বলে না, নিজের বাবা-মার কাছে ও না। তাঁরা জানেন– বোধহয় সবাই জানে, কনক সুখী, স্বামী-সৌভাগ্যবতী।

আর বাস্তবিকই–সে যে কী–সৌভাগ্যবতী না দুর্ভাগ্যবতী–তা সে যে নিজেই বুঝতে পারে না এক এক সময়। কারণ ঠিক স্বামী-পরিত্যক্তা বলতে যা বোঝায়–এদেশে মেয়েরা যাকে বলে ‘বর নেয় না’–সে অবস্থাও তো তার নয়। স্বামীর ঘরে থাকে স্বামীর পাশে শোয়, স্বামী তাঁর সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সুবিধা দাবি করেন, হাতে হাতে পান-জল কাপড়- জামা যুগিয়ে দিতে হয়– প্রয়োজন মতো কথাও বলেন সহজেই–রাত্রে শোবার পর কনক পা টিপে দেয়, সে সেবাটা তিনি অত্যন্ত আরামের সঙ্গেই উপভোগ করেন।

কোন অসদ্ব্যবহারও করে না হেম। এমনিতেই তার মেজাজটা ইদানীং একটু রুক্ষ হয়েছে–সেটা মা বোন সকলের সঙ্গে ব্যবহারেই সমান প্রকাশ পায়–হয়ত কনকের বেলাও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। তেমনি, অতিরিক্ত রূঢ়তা কিছু প্রকাশ পেয়েছে তার প্রতি, এমন নালিশও কনক করতে পারবে না। এমন কি, বহুদিনের ব্যবধানের মধ্যে মধ্যে তাদের দৈহিক মিলনও ঘটে–তবু কনক জানে যে হেম তাকে আজও পর্যন্ত ঠিক স্ত্রী বলে গ্রহণ করতে পারেনি। প্রয়োজনের আসবাব এই পর্যন্ত, তার প্রতি সপ্রেম তো দূরের কথা– সকাম কোন আসক্তিও বোধ করে না। আর তা জানে বলেই ঐ দৈহিক মিলনের দিনগুলো তার পক্ষে আরও বেদনাদায়ক আরও অপমানকর হয়ে ওঠে। কে জানে কেন, তার কেবলই মনে হয় হেম তাকে মূক পশুর মতো মনে করে, আর সেই ভাবেই আচরণ করে। সে দিনগুলোর অপমান ভুলতে তাই কনকের বহুদিন সময় লাগে। অথচ তার দোষ কি– সে কিছুতেই বুঝতে পারে না।

মোটামুটি তার চেহারা খারাপ নয়–লোকে বলে ভালই, অন্তত তাই সে শুনে এসেছে চিরকাল। বয়স বরং হেমের তুলনায়, মানান-সই যা, তার চেয়ে অনেকটাই কম। তার বিয়ের সময় এ নিয়ে আত্মীয়মহলে অনেক কথা উঠেছিল। কিন্তু অত বিচার করা সম্ভব ছিল না তার বাবার, অনেকগুলি বোনের একটি সে। তার দিদির বিয়েতেই তার বাবা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন, এই যা পাত্র পেয়েছেন তিনি ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিলেন। তা হোক, কনকের অন্তত সেজন্য কোন নালিশ ছিল না। বয়স যাই হোক-সে বয়সের ছাপ হেমের মুখে আজও পড়ে নি। যথেষ্ট রূপবান সে, বিয়ের পরের দিন দিনের আলোয় বরকে দেখে কনকের মন তৃপ্তিতেই ভরে গিয়েছিল।

কিন্তু ফুলশয্যার রাত্রেই তার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। বর রান্নাঘরে শুতে চেয়েছিল–সম্ভবত ফুলশয্যা সম্বন্ধে কোন মোহ বা ভুল ধারণা কনকের না হয় সেই জন্যেই। সেদিনটা মা বোন বকাবকি ক’রে ঠেকালেও পরের দিন থেকে আজও সে রান্নাঘরেই শুচ্ছে। স্ত্রীর সঙ্গে সে কথাও বলে নি দীর্ঘকাল, খুব প্রয়োজন ছাড়া, কোন প্রণয়সম্ভাষণ তো দূরের কথা। ওরা বাপের বাড়িতে শিখিয়ে দিয়েছিল স্বামীর পা টিপতে হয়– সেই মতো সব লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে সে নিজে থেকেই পা টিপতে শুরু করেছিল। কোন বাধা দেয় নি হেম। কোন সেবাতেই তার অরুচি নেই–সবই তার প্রাপ্য বলে গ্রহণ করে। অথচ কনকেরও যে কিছু প্রাপ্য থাকতে পারে, তাকেও যে কিছু প্রতিদান দেওয়া উচিত, সেইটে তার মাথাতে ঢোকে না। ও শুনেছে ওর মেজ ননদের মুখে ওদের মাসশাশুড়ীর কথা, মেসোমশাই ফুলশয্যার দিন মধ্যে বালিশ রেখে শুয়েছিলেন, জীবনে কখনও গ্রহণ করেন নি স্ত্রীকে। সেই মেসোমশাই নাকি বুড়ো বয়সে রক্ষিতা হারিয়ে সেবা নেবার জন্য স্ত্রীর কাছে এসে উঠেছেন। এই রকমই এদের ধারা নাকি / কনক ভাবে মধ্যে মধ্যে–আর সে সম্ভাবনার কথা মনে হ’লে শিউরে ওঠে।

অবশ্য আগের মত কঠোরতা আর নেই। এমন কি সাংসারিক পরামর্শও কোন কোন সময় নিজে থেকেই যেচে নেয় তার কাছে। এর মধ্যে একদিন কনকের শরীর খুব খারাপ হ’তে মৌড়ির হাসপাতাল থেকে ওষুধ এনে দিয়েছিল শাশুড়ীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। মেয়েদের অসুখ হ’লে ডাক্তার দেখাতে হবে কি ওষুধ খাওয়াতে হবে– এটা শ্যামার মতে বাড়াবাড়ি। বৌদের জন্যে আবার এত! একটা যাবে আর একটা হবে।’বেঁচে থাক আমার মোহনবাঁশী, কত শত মিলবে দাসী!’ ঠিক ওর সম্বন্ধে এসব কথা না বললেও বৌদের সম্বন্ধে এই ধরনের বহু মন্তব্য করতে শুনেছে কনক–সুতরাং তাঁর মনোভাব জানতে বাকি নেই।

কিন্তু এতেও তৃপ্ত নয় কনক। সে জানে যে এটা নিতান্তই মায়া, স্নেহ। পাখি পুষলেও মায়া হয়–এ তো মানুষ। সে যে দিয়েছে অনেক। এ সংসারে ঢুকে পর্যন্ত দিনরাত পরিশ্রম করছে, নীরবে প্রতিটি লোকের স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করে যাচ্ছে, ওর জন্য একটুখানি অন্তত করতে বাধ্য হেম।

আসলে হয়ত তার বিধবা মেজ ননদ ঐন্দ্রিলাই বিষিয়ে দিয়ে গেছে তার মন। তা নইলে হয়ত এতটা মাথা ঘামাত না। ঐন্দ্রিলা তাকে গোপনে সব কথাই বলে গেছে। এই রেল অফিসে ঢোকবার আগে নাকি হেম থিয়েটারে চাকরি করেছিল কিছুদিন। সেইখানে নলিনী বলে এক অভিনেত্রীর সঙ্গে খুব প্রেম হয় ওর। একেবারে নাকি তাকে নিয়ে পাগল হ’তে বসেছিল। সেইটে হাতেনাতে ধরা পড়েই নাকি সে চাকরি যায়। কিন্তু তবু তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যায় নি–তাও জানে ঐন্দ্রিলা। কনকের বৌ-ভাতের দিনও তাকে নিমন্ত্রণ করেছিল এবং সেও এসেছিল।’গরদের শাড়ি পরে এসে সোনার জিনিস দিয়ে মুখ দেখে গেল–মনে নেই তোমার?’ প্রশ্ন করেছিল ঐন্দ্রিলা।

খুবই মনে আছে কনকের। কারণ সে মহিলার চালচলন বেশভূষা সবই ছিল উপস্থিত সমস্ত অভ্যাগতা থেকে স্বতন্ত্র। তাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত ও বিব্রত ছিল হেম–তাও লক্ষ করেছে কনক, ঘাড় হেঁট ক’রে বসে থাকা সত্ত্বেও। আরও মনে আছে এই জন্যে যে, তাকে নিয়ে বড় ননদের শ্বশুরবাড়ির মধ্যে বেশ একটা চাপ গুঞ্জরণ উঠেছিল। মহাশ্বেতার মেজ জার হাসি আর মন্তব্যটা কনকের আদৌ ভাল লাগে নি। তখনই কেমন খট্‌কা লেগেছিল।

কিন্তু ঐন্দ্রিলা ঐখানেই থামে নি।

আরও কিছু বলেছিল কনককে।

ঐন্দ্রিলা অদ্ভুত, তাকে দেখলে ভয় করে কনকের, সাক্ষাৎ হুতাশনের মতো জ্বলে ও জ্বালিয়ে বেড়ায় সর্বদা। ওর সম্বন্ধেও যে তার কোন প্রীতি নেই তাও কনক জানে। আসলে কেউ সুখে আছে-এটা সুদূর কল্পনাতে অনুমান করলেও জ্বলে ওঠে সে। সে সুখের মূলসুদ্ধ উৎপাটিত না করা পর্যন্ত যেন তার শান্তি থাকে না।

সেইজন্যেই এত কথা বলেছিল ওকে ঐন্দ্রিলা–প্রীতিবশত নয়।

স্বামী যে তাকে ভালবাসে এমন অসম্ভব দুরাশা যেন কনক কখনও না পোষণ করে। এইটেই বার বার বোঝাতে চেয়েছিল সে।

হেমের মন পড়ে আছে বহুদূরে।

উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের দিকে চেয়ে চোখ বেঁধে আছে তার। পতঙ্গের মত সেই দিকেই শুধু লক্ষ্য–সামান্য মাটির প্রদীপ কনকের সাধ্য নেই যে সে পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে। তার মাসতুতো দাদা গোবিন্দর দ্বিতীয়পক্ষের বৌ রানীই নাকি সেই জ্যোতিষ্ক। ইদানীং দীর্ঘকাল ধরে তার জন্যেই নাকি ঐন্দ্রিলার দাদা পাগল। সে নাকি মহা খেলোয়াড় মেয়ে, ধরাও দেয় না ছেড়েও দেয় না, শুধু অবিরাম খেলায়। হেমও নাকি বেশি কিছু চায় না–তাকে দেখে তার কথা শুনেই সে মুগ্ধ। সেইটুকু পেলেই খুশি সে। আর সেটুকু পাবার কোন বাধাও নেই। তাই সে মোহ খুব তাড়াতাড়ি ঘুচবে হেমের, এমন অসম্ভব আশা যেন কনক না মনে ঠাঁই দেয়।

রানীদিদিকে দেখেছে কনক। মুগ্ধ হবার মতোই মেয়ে।

শুধু রূপেই নয়–রূপোসী মেয়ে কনক আরও দু-একজন দেখেছে, কিন্তু তারা যেন পুতুলের মতো, আলতো সন্তর্পণে রেখে রূপ বাঁচাতেই তারা ব্যস্ত, প্রাণহীন অহঙ্কারের পুতুল এক-একটি। কিন্তু রানীদি তেমন নয়–কারুর মতোই নয়, সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অত উচ্ছল প্রাণশক্তি আর কারুর মধ্যে দেখেছে বলে কনকের মনে পড়ে না। হাসিতে-খুশিতে কথায়-বার্তায় কাজকর্মে অনন্য সে।

যদি সত্যিই সে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে থাকে হেমের, আর মন যদি সেখানে বাঁধা পড়ে থাকে, তাহলে কনকের বিশেষ কোন আশা নেই, তার সেও বোঝে।

তাই তার আরও হতাশা, আরও অতৃপ্তি। যেটুকু পায় তাতে মন ওঠে না–ঐন্দ্রিলার দেওয়া বিষ তার ক্রিয়া করেছে মনে, সে কেবলই দেখে স্বামী তার সম্বন্ধে বিদ্বিষ্ট না হোন– উদাসীন।

তাই অন্তর তার তৃষ্ণার্ত হয়েই থাকে। আর কেবলই মনে হয় বিবাহিতা মেয়েদের সব সুখ-সৌভাগ্যের বড় কথা হ’ল স্বামী-সোহাগ, তা থেকে যেন কোন দুর্ভাগিনী কখনও বঞ্চিত না হয়।

যে কখনও পায় নি তার কথা তবু আলদা, যে একবার পেয়েছে সে তা হারিয়ে বাঁচে কি ক’রে।

ঐন্দ্রিলা ওর মহা সর্বনাশ করেছে জেনেও তাই কনক তাকে মার্জনা করে। বোঝে যে এই জ্বালাই তার স্বাভাবিক। তার বিশেষ দোষ নেই, বেচারি!

আজ তাই তরুর জন্যও ওর এত দুশ্চিন্তা।

বেলা বারোটা নাগাদ হারানের গলা পাওয়া গেল বাইরে।

’দাদা আছেন নাকি, দাদা?’

হেম ঘরেই ছিল, অফিস যাওয়া তার হয় নি, সে-বেলা উৎরে গিয়েছিল, আর বোধ হয় যাওয়ার মতো মানসিক অবস্থাও ছিল না। সেই সময়, কনক তরুকে ঠেলে ঘাটে পাঠাবার পর সে যা কটা কথা বলেছিল হেম, তারপরই আবার ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল। আর ওঠেও নি, কথাও বলে নি কারুর সঙ্গে। স্নানাহারের তো প্রশ্নই ওঠে না। শ্যামা অবশ্য বসে নেই তাঁর অভ্যস্ত কাজ ঠিকই ক’রে যাচ্ছেন, কিন্তু সে কতকটা কলের পুতুলের মতো, তাঁরও যে বেলার দিকে নজর আছে তা মনে হয় না।

ভোরের রান্না বাদে সাধারণ গৃহস্থর যা রান্না কনকই করে। আজ যতটা সম্ভব সংক্ষেপে সে-পর্ব শেষ ক’রে তরুকে ধরে এক রকম জোর ক’রেই একগাল ভাত খাইয়ে দিয়েছে–তারপর থেকে সে-ও চুপ ক’রে বসে আছে দাওয়ায়। হেমের এই অবস্থায় স্নান করতে যাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত হবে কিনা তাও বুঝতে পারছে না সে। হয়ত মা’রই একসময় খেয়াল হবে, তিনিই বললেন। অথবা শেষ পর্যন্ত হেমই উঠবে। কনকেরও সমস্ত মনটা ভারী হয়ে আছে, এদিকে বিশেষ তাগিদ নেই। তাই চুপ ক’রে অপেক্ষাই করছে সে ঘটনার গতি স্বাভাবিকভাবে আবর্তিত হবার।

হারানের গলা পেয়ে সে-ই ছুটে বাইরে এল, ‘ঠাকুর জামাই যে, কী ভাগ্যি! আসুন আসুন–ভেতরে আসুন। অমন পরের মতন বাইরে থেকে ডাকছেন কেন?’

কনকই যে আগে বেরিয়ে আসবে তা বোধ হয় ভাবে নি হারান, সে একটু থতমত খেয়ে গেল। কোনমতে কাষ্ঠহাসি হেসে বললে, ‘আর বৌদি, ব্যাপার-গতিকে পরই হ’তে বসেছি।’

তারপরই আবার গম্ভীর হয়ে বললে, ‘আমি আর এখন ভেতরে যাব না, আপনি দয়া ক’রে আপনার ছোট ননদকে বলুন যে, কেলেঙ্কারি যা হবার তা তো চরমই হ’ল, বাকি তো কিছু রইল না। এখন তার যদি সে ঘর করবার ইচ্ছে থাকে, তাহ’লে এক্ষুনি এই দণ্ডে আমার সঙ্গে যেতে হবে। নইলে সে-মুখো যেন আর কখনও না হয়।’

‘ছি ছি! কী সব বলছেন ঠাকুরজামাই। বেশ তো, তাই না হয় হ’ল–তা একটু ভেতরে আসতে দোষ কি। জামাই মানুষ, বাইরে দাঁড়িয়ে এমন করে ভরদুপুরবেলা–। চলুন চলুন। যা বলবার আপনিই বলুন না তাকে, আমরা কেন আর নিমিত্তের ভোগী হই।’

‘না না, ওসব আদর-আপ্যায়ন এখন থাক। ওসব আমার এখন ভাল লাগছে না। আপিস কামাই হ’ল মিছিমিছি–। আবার এই ঠেকো-রোদ্দুরে এতটা পথ যেতে হবে–।’

‘তাই তো বলছিলুম, নেয়ে খেয়ে বেলা পড়লেই না হয় যাবেন। আপিস তো গেলই, শুধু শুধু এখনই ছুটে লাভ কি। আসুন আসুন, একটা কথা রাখুন, আমি আপনার গুরুজন হই–তায় কুটুম, আমার কথা রাখতে হয়।’

বোধ হয় চক্ষুলজ্জা এড়াবার জন্যেই, একেবারে ওর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল হারান। তারপর একটু চেষ্টাকৃত কর্কশ কণ্ঠেই বলল, ‘মাপ করবেন বৌদি, যদি ছোট হয়ে বড়কথা বলে ফেলি। কুটুম কিসের, বোয়ের সম্পর্কেই তো। এ কুটুম্বিতেয় আমার আর রুচি নেই। আপনি দয়া ক’রে ওকে গিয়ে বলুন–আমি ঠিক ঘড়িধরা আর পাঁচ মিনিট এখানে দাঁড়িয়ে থাকব। এর মধ্যে যদি আসতে পারে–আর সেখানে থাকতে চায় তো আসবে, নইলে এই শেষ!

ওর ভাবভঙ্গি দেখে এই উদ্বেগের মধ্যেই হাসি পেয়ে গেল কনকের। যেন যাত্রার দলের সেনাপতি। মনে পড়ল হারানের থিয়েটার করার খুব শখ, পাড়ার ক্লাবে খুব নাকি নামও ওর।

হাসি পেল বলেই বোধ হয় অপমানটা গায়ে লাগল না। সে আরও কি বলতে যাচ্ছিল, হয়ত হাতটাই ধরত শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তার আগেই হেম বেরিয়ে এল। সেই অবস্থাতেই এসে দাঁড়াল ভগ্নীপতির সামনে।

‘পাঁচ মিনিটও তোমার থাকবার দরকার নেই, তুমি এখনই পথ দেখতে পার। কী করতে যাবে আমার বোন সেখানে আবার শুনি–খুনহ’তে? শেষ করেই তো এনেছিলে দুজনে মিলে, এখনও যেটুকু প্রাণ ধুকধুক করছে কণ্ঠার কাছে, সেটুকুও না নিঃশেষ করতে পারলে বুঝি তোমাদের দিদি-নাতির মনস্কামনা পূর্ণ হচ্ছে না? রাস্কেল কম্‌নেকার! আবার মেজাজ দেখানো হচ্ছে। তোমাদের পুলিশে দিতে পারি জানো? তোমাকে আর তোমার এই ডাইনী ঠাকুমাকে! আর তাই দেওয়াই উচিত। নইলে আরও কার কি সর্বনাশ করবে তার ঠিক কি! … তুমিও যেমন, ঐ রাস্কেলকে আবার মিষ্টি কথায় ঘরে ডাকছ!

হারান হেমের উগ্রমূর্তিতে কেমন যেন একটু নরম হয়ে এসেছিল গোড়ার দিকটায়, কিন্তু দু-দুবার ‘রাস্কেল’ শুনে তার মুখও অগ্নিবর্ণ ধারণ করল। সে বলল, ‘বেশ তো–তাই দিন না দেখি কত মুরোদ! থানাপুলিশ আমরাও করতে জানি। সে কোমরের জোর আমাদের আছে। …যা ঢ্যাঁটা আপনার বোন! বাড়িতে ঠাকুমা দিদিমা থাকলে অমন একটু- আধটু শাসন করেই। তার জন্যে কোন্ ভদ্দরলোকের মেয়ে ভাতের ওপর ঠ্যাকার ক’রে না খেয়ে পড়ে থেকে এমন হুট্‌ ক’রে একা একা চলে আসে তাই শুনি! এ তো কুলত্যাগ করা।

আর কেউ হ’লে ঘরে নেবার নাম করত না। পাড়াঘরে শুনলে বলবে কি? আর শুনতেই কী বাকি আছে! কেলেঙ্কারে যে মুখ দেখাতে পারব না আমরা।––তবু তো ঠাকুমার অনেক সহ্য–বললেন, যা হবার হয়ে গেছে, এবারের মতো মাপ কর, ওকে নিয়ে আয়। ঠাকুমা এখনও এ বাড়িকে চেনেনি তো!.. বেশ, থাক না আপনার বোন এখানে। চিরদিনই পুষুন। হয়ত কাজেও লাগাতে পারবেন। কিন্তু মনে থাকে যেন, সে দরজা চিরদিনের জন্যে বন্ধ হ’ল। এই শ্বশুরবাড়িতে লাথি মেরে আমি চলে যাচ্ছি!’

সে হন হন ক’রে বেরিয়ে গেল।

হেম প্রলয়ঙ্কর মূর্তি ধরে পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছিল। বোধ করি গিয়ে গলা টিপেই ধরত। কনক সব লাজলজ্জা ভুলে পেছন থেকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরল, ‘করছ কি! হাজার হোক ও জামাই। একদিন হাঁটু ধরে ওর হাতে বোনকে তুলে দিয়েছ। ও শত অপমান করলেও আমাদের সয়ে যেতে হয়। বোনের কথাটাও ভাবো, ওর যে সারাজীবন এখনও সামনে পড়ে।’

অগত্যা হেম নিরস্ত হ’ল। ততক্ষণে হারানও ওদের বাগান পেরিয়ে একেবারে বাইরে রাস্তাতে গিয়ে পড়েছে–ছুটে যাওয়াও আর সম্ভব নয়।

কিন্তু ইতিমধ্যে ততক্ষণে অশ্রুমুখী তরু বেরিয়ে এসেছে।

‘আমি যাই বৌদি, আমার অদৃষ্টে যা আছে হবে। যদি আর দেখা না হয়, দোষঘাট যা করেছি, মাপ ক’রো—’

কিন্তু সে আর এগোবার আগেই হেম তার একখানা হাত চেপে ধরল, ‘খবর-দার! এক পা বাড়ালে কেটে দুটুকরো ক’রে ঐ পগারে ফেলে দেব। তারপর আমার অদৃষ্টে যা আছে হবে। কতবড় ছোটলোক! শ্বশুরবাড়িতে লাথি মেরে চলে গেল, আর তুই এ বাড়ির মেয়ে হয়ে সেখানে যাবি শেষে ঘর করতে!… আবার বলে কিনা –কাজেও লাগাতে পারেন! আমি ওদের মতো বোনকে দিয়ে রোজগার করাই কিনা!–হ্যাঁত্তোর ছোটলোকের ঝাড়!…থাক তুই মনে করব তুইও খেঁদির মতো বিধবা হয়ে এসেছিস!’

॥২॥

এসব ঘটনা যখন ঘটে তখন ঐন্দ্রিলা এখানে ছিল না। এমন প্রায়ই থাকে না সে আজকাল। বিধবা হবার পর সর্বস্বান্ত হয়ে যখন চলে আসে তখন আর কোনদিন শ্বশুরবাড়ি সে যাবে না– এই প্রতিজ্ঞা করেই এসেছিল। আর যাবার কথাও নয়, কারণ তার শাশুড়ী সে সময় যে চরম দুর্ব্যবহার করেছিলেন তা ক্ষমার অযোগ্য। অবশ্য তাঁর তরফ থেকে সে দুর্ব্যবহারের একটা কৈফিয়ৎ ছিল। তাঁর বিশ্বাস তাঁর স্বামী এবং পুত্রের অকালমৃত্যুর জন্য ঐন্দ্রিলাই দায়ী। ওরই বিষনিঃশ্বাসে তাঁর সোনার সংসার শুকিয়ে গেল। এ বিশ্বাস তিনি চেপে রাখারও চেষ্টা করেন নি। হেমকেও সেকথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রতিজ্ঞা যা-ই করুক, কিছুদিন এখানে থাকার পর এখানটাও অসহ্য হয়ে উঠল যখন– তখন চরম একটা রাগারাগি ক’রে সেই শ্বশুরবাড়িতেই আবার গিয়ে উঠল ঐন্দ্রিলা। ভাগ্যক্রমে তাদেরও সেটা খুব দুঃসময় চলছে। ওর শাশুড়ী শয্যাগত, জা পোয়াতি, ননদের অসুখ– কে কার মুখে জল দেয় তার ঠিক নেই। সুতরাং তারাও বেঁচে গেল ওকে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে পেয়ে। সাদর অভ্যর্থনা ও সস্নেহ আচরণের কোন অভাব ঘটল না, এমন কি ওর শাশুড়ীর মুখ থেকেও অভাবনীয় মিষ্টবাক্য বেরোতে লাগল।

কিন্তু যে মেয়ে বাপের বাড়িতে বনিয়ে চলতে পারে নি সে শ্বশুরবাড়িতে বনিয়ে চলবে– এটা সম্ভব নয়। একদা সেখানেও অশান্তি চরমে উঠল। তাছাড়া তাদের ও প্রয়োজন ফুরিয়েছে তখন, তাদের মনের আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে। অগত্যা আবারও এখানে এসে উঠতে হ’ল। সে সময় উপলক্ষ্যও জুটে গিয়েছিল একটা– ফিরে আসাটা খুব বেমানান হয় নি।

তারপর থেকেই এই চলেছে। যখন আসে তখন ভালমানুষ– তার পরও দু-তিন মাস বেশ থাকে। মেজাজ ভাল থাকলে রান্নাবান্নাও করে, তাও না থাকলে কাপড় জামা বিছানার চাদর যেখানে যা আছে, একরাশ ক্ষার ফুটিয়ে দমাদম কাঁচতে বসে। কিম্বা বাগানের তদ্বির ক’রে বেড়ায়। মুখের উগ্রতা তখনও প্রকাশ পায় তবে সেটা মারাত্মক নয়। কিন্তু কোনমতে মাস তিনেক কাটলেই আবার অসহ্য হয়ে ওঠে, ওরও এদেরও। আবার একদিন কোন একটা তুচ্ছ ও হাস্যকর রকমের উপলক্ষ্য ধরে প্রচণ্ড কলহ সৃষ্টি করে– এবং সে কলহ চরমে উঠলে– চরমেই ওঠে– আবারও মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যায়।

এখান থেকে শ্বশুরবাড়িতেই যায় সে সাধারণত। সোজা গিয়ে উঠলে তারাও ঠিক বাধা দিতে পারে না। এক সময় ওকে বড়ই প্রয়োজন লেগেছিল, আবারও হয়ত লাগতে পারে ভেবে– অথবা চক্ষুলজ্জায়, তারাও আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। সম্পত্তিতে অধিকার থাক বা না থাক, বাড়ির বৌ এবং নাতনী– দু’চার দিনের জন্যেও আশ্রয় না দিলে পাড়াঘরে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে উঠবে

কিন্তু সেখানেও সেই মাস দুই তিন, বড় জোর। তারপরই আবার একটা বড় রকমের ঝগড়া– শাপশাপান্ত গালিগালাজ– কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসা। সেই পুরাতন নাটকের পুনরভিনয়। এই-ই চলছে দীর্ঘকাল।

ঈষৎ পরিবর্তন হয় মধ্যে মধ্যে অবশ্য। যখন কোন এক আকস্মিক কারণে অল্প কালের মধ্যেই কোথাও প্রবল ঝগড়া হয়ে যায়–তখন মধ্যে মধ্যে কলকাতাতে বড় মাসিমার কাছেও ওঠে। তবে সেখানে স্থান কম, অসুবিধাও ঢের। সুতরাং খুব বিপাকে না পড়লে সেখানে যায় না।

তরু যেদিন আসে সেদিন ঐন্দ্রিলা শ্বশুরবাড়িতেই ছিল। সংবাদটা পেতে তার একদিনের বেশি দেরি হয় নি। এ সব সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে কখনই খুব দেরি হয় না, এ ক্ষেত্রে হারানদের পাড়ার লোকেরা বহুদিন পরে পরিবেশন করার মতো এমন মুখরোচক সংবাদ পেয়ে– (দু-দুবার বৌ পালানোর খবরটা মুখরোচক তো বটেই) উপযুক্ত উৎসাহের সঙ্গেই তা প্রচার করেছে। ঐন্দ্রিলাও খবর পেয়েই চলে এল এখানে। বিধবা হবার পর এই প্রথম বোধ হয়, রাগারাগি না ক’রে এল সেখান থেকে।

সেটা বিকেলবেলা, তরু বিষণ্নভাবে বড়ঘরের সামনের সিঁড়িটাতে বসে ছিল চুপ ক’রে। ঐন্দ্রিলাকে দেখে তার মাথাটা আরও হেঁট হয়ে গেল। সম্ভবত দাদার কথাটা মনে ক’রেই। দু-দুবার ইঙ্গিত করেছে হেম। ইঙ্গিত কেন, স্পষ্টই বলেছে কথাটা। বিশ্রী তুলনা। দারুন মর্মঘাতী শব্দ। হে ঈশ্বর তেমন সর্বনাশ যেন কখনও না হয়। যা করেছে করেছে– তবু সে বেঁচে থাক, সুস্থ থাক।… কাল থেকে অন্তত হাজার বার এই প্রার্থনা করেছে সে মনে মনে। মনে মনেই সিদ্ধেশ্বরীতলায় মাথা খুঁড়েছে।

আজ এখন ঐন্দ্রিলাকে দেখে সেই কথাটাই মনে পড়ল আবার। শিউরে উঠল সে সঙ্গে সঙ্গেই। হে ঈশ্বর! এই হুতাশন হয়ে বেঁচে থাকা! অতি বড় শত্রুরও যেন এমন অবস্থা না হয়! ঐ বুড়িও বোধ হয় এই অবস্থারই পরিণতি। হে ভগবান! আবারও শিউরে উঠল সে।

ঐন্দ্রিলা এত জানত না। জানলেও অত সূক্ষ্ম জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাত কিনা সন্দেহ। এ অবস্থা ঐ দুঃখ অনুমান করার মতো– উপলব্ধি করার মতো সহজ ছাড়া। সেই জন্যই তাকে অমন দমকা বাতাসের মতো বাড়ি ঢুকতে দেখে শুধু তরু নয়, কনকও কাঠ হয়ে গিয়েছিল।

ঐন্দ্রিলা কোন দিকে না তাকিয়ে একেবারে সিঁড়ির সামনে এসেই দাঁড়াল, ‘ওমা, যা শুনলুম তা তাহ’লে সত্যি? আমি বলি কথার কথা… তাহ’লে সবই সত্যি বল্! তোকে নাকি ওরা দুজনে মিলে খুন করতে গিয়েছিল? গরম লোহা পুড়িয়ে নাকি সর্বাঙ্গে ছ্যাঁকা দিয়েছে?… কী হবে মা!

তারপর একটু থেমে, যেন কতকটা বিজয়গর্বের সঙ্গে চারদিকে চোখ বুলিয়ে ‘একটু বসি বাবা, এতটা হেঁটে এসে কোমর ধরে গেছে’– বলে সেই সিঁড়িতেই তরুর পাশে বসে পড়ল।

‘এই শুনলুম এত ভাল বে হয়েছে ত্যাত ভাল বে হয়েছে– কত কথাই শুনলুম। জিনিসপত্তর ঢেলে দিলে মায়ে-বেটায়, সোহাগী ছোট মেয়ের ঘটা ক’রে বিয়ে হ’ল–তা

এই বিয়ের ছিরি! বলি সেই তো আমার মতোই সব ঘুচিয়ে-পুচিয়ে এসে উঠতে হ’ল বাপের বাড়ি।’

তরু আর শুনতে পারল না, ডুকরে কেঁদে উঠে ছুটে চলে গেল খিড়কীর বাগানের দিকে। কনকও প্রতিবাদ না ক’রে পারল না। যদিও সে তার এই মেজ ননদটিকে যথেষ্ট ভয় করত, তবু মৃদু তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলল, ‘ওকি কথার ছিরি, মেজঠাকুরঝি!….. ষাট ষাট! ওদের ও দুর্দিনের মন কষাকষি– দুদিন পরেই আবার ঠিক হয়ে যাবে। ঘুচিয়ে- পুচিয়ে চলে আসতে হবে কেন!…. অমন কথা কেউ বলে! একে কাল থেকে কেঁদে কেঁদে সারা হয়ে গেল মেয়েটা!’

ঈষৎ যেন একটু অপ্রতিভই হয়ে পড়ে ঐন্দ্রিলা, ‘না আমি অত ভেবে বলি নি। সত্যিই তো, আমার মতো জন্ম জন্ম ধরে এত পাপ তো আর কেউ করে নি– কেনই বা অমন হবে। যা হবার এই আমার কপালের ওপর দিয়েই হয়ে গেল, আর তাই যাক। আর কারুর এমন হয়েও কাজ নেই।… আর হবেই বা কী জন্যে বলো, ওর কপাল যে ঢের ঢের ভাল; আজ বলে নয়, চিরদিনই ভাল। মা ভাই ভাজ সকলেরই আদরের নিধি ও–বরেরও নয়নের মণি হয়ে থাকবে বৈকি।…. তা-হ’লে এমনটা হ’লই বা কেন? তরু ঠিক এল কবে? কাল তো? তা তারপর আর কোন খোঁজখবর করে নি ওরা?’ খাপছাড়াভাবে হঠাৎ প্রশ্ন ক’রে বসে সে।

অর্থাৎ বিষ আর কৌতূহলের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত কৌতূহলেরই জয় হয়। কনকের এই সস্নেহ সহানুভূতি যথারীতিই ঐন্দ্রিলার সর্বাঙ্গে বিষের জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল, দৃষ্টিও কঠিন হ’তে শুরু করেছিল, কিন্তু সে ঝগড়া এখন শুরু করলে ইতিহাসটা পুরোপুরি শোনা হয় না বলেই সেটা এখন মূলতুবি রাখল।

‘তা করবে না কেন? কালই তো ঠাকুরজামাই নিতে এসে ছিলেন দুপুরবেলা!’

‘তারপর? তা হ’লে গেল না কেন?’ তীক্ষ্ণ বিরস কণ্ঠে প্রশ্ন করল ঐন্দ্রিলা।

এ নাটকের এমন দ্রুত পরিসমাপ্তি নৈরাশ্যজনক বৈকি।

‘তোমার দাদা মত করলেন না।’

‘দাদা মত করলেন না? কেন? বোন পোষবার খুব শখ বুঝি দাদার? একটা বোন ভাগ্নীকেই পুষতে পারে না, আবার আর একটার দায় ঘাড়ে নিতে যায় কোন আক্কেলে! ভীমরতি ধরেছে নাকি দাদার?’

ঝড় যে কখন কোন্ দিক থেকে উঠবে ঐন্দ্রিলার রসনায়– তা আজও কোন হদিস পায় না কনক।

অগত্যা তাকে সংক্ষেপে কালকের ঘটনাটা খুলে বলতে হয়।

‘বেশ করেছে দাদা! ঠিক করেছে! কেন কিসের জন্যে এত অপমান সয়ে সেখানে মেয়ে পাঠাব আমরা! ইস! ভাত দেবার ভাতার নয়, নাক কাটবার গোসাই! না খেয়ে সেখানে শুধু মার খাবার জন্যে পড়ে থাকবে, না? কেন, মেয়ে-জন্ম কি এতই ফ্যালনা একেবারে! তরি কোথায় গেল, ও যেন না কোন দুঃখু রাখে মনে। কী হয়েছে, একটা পেট তো! চলেই যাবে। দু’বোন বসে যদি ঠোঙা তৈরি করি তাহ’লেই দুটো পেট চলে যাবে আমাদের। আজকাল রোজগারের কত রাস্তা হয়েছে। বলি এই তো মা– পাতা বেচে কত পয়সা কামায়!’

আবরও সেই তুলনা।

কনক বিব্রত বোধ করে কিন্তু কেমন ক’রে ওকে সামলাবে ভেবে পায় না। তাকে বাঁচিয়ে দেন শ্যামা। তিনি এতক্ষণ বাগানে শশাগাছের মাচা ঠিক করছিলেন, তরুকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যেতে দেখে এবং ঐন্দ্রিলার গলার আওয়াজ পেয়েই ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিলেন। তিনি উঠোনে ঢুকে বললেন, ‘ওর ভাবনা আর এখন থেকে তোমাকে ভাবতে হবে না মা, তুমি তোমার নিজের চরকায় তেল দাও গে!’

বোধ করি এইটেরই অপেক্ষা করছিল ঐন্দ্রিলা। সে এবার নিজমূর্তি ধারণ করল। কনকের সহানুভূতির আয়নাতে নিজের অবস্থাটা প্রত্যক্ষ ক’রে সেই থেকেই জ্বলছিল সে, এখন কৌতূহল অবসান– সে বিষ উদ্ধার করতে কোন অসুবিধাও নেই।

সে তো জানিই, আমার কপালই যে এমনি, ভাল বলতে গেলেও মন্দ হয়ে যায়। ঠিকই তো, আমার যা-খুশি হোক গে, তোমাদের সোহাগী মেয়ের পায়ে কাঁটাটিও না ফোটে। আমার সঙ্গে তুলনা করলেও বুক ফেটে যায় তোমাদের। কৈ, আমার জন্যে তো এত প্রাণ কাঁদতে দেখি নি কখনও! আমিও তো মেয়ে। আমিও তো সইছি এই দুঃখ। আমি কিছু ফ্যালনা নই। রূপেগুণে আমার পাশে দাঁড়াতে পারে ও? চিরকাল তোমাদের এই এক- চোকোমি দেখে এলুম। ভাল হবে না– বুঝলে? তোমাদের কখনও ভাল হবে না। এত অর্শদর্শ ভাল নয়, এত একচোকো যারা তাদের কখনও ভাল হয় না! ইত্যাদি ইত্যাদি।

কনক বেগতিক দেখে অনেক আগেই চলে গিয়েছিল বেরিয়ে তরুর কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বাগানের শেষপ্রান্তে, পুকুরেরও ওধারে– অর্থাৎ শ্রুতিসীমার বাইরে।

শ্যামার এ সবই গা-সওয়া। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তা আমরা যদি এতই মন্দ আর একচোকো তো আমাদের কাছে আসো কেন মা আমাদের হাড় ভাজা ভাজা করতে! আমরা তো কোনদিন এরেবেরে আনতে যাই না! আজও তো কৈ আসতে বলি নি! যেখানে সুখে থাকো, যারা ভাল– তাদের কাছে সেখানে থাকলেই তো পারো।’

‘বাব্বা! এত বিষ তোমাদের মনে মনে! এত বিষ হয়েছি যে আর এক দণ্ডও সহ্য হচ্ছে না আমাকে!…. না, তোমার ঐ আত্তরাসী রাঙের রাধা মেয়ের অসুবিধে হবে আমি থাকলে? আমার মুখ দেখলে আমার হাওয়া লাগলেও ওর মন্দ হবে বোধ হয়?…. তাই ওর বিয়ের সময় একটা ছুতো ক’রে ঝগড়া বাধিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলে আমায়? মনে করো আমি কিছু বুঝি না– না!…. কেন, কিসের জন্যে আমি যাব? আলবৎ থাকব। যদ্দিন খুশি তদ্দিন থাকব। কৈ, তাড়াও দিকি, কেমন তাড়াতে পারো। অমন বিয়ে দিয়েছিলে কেন আমার যে দুদিন না যেতে যেতে সব ঘুচে যায়! এখন যাও বললে আমি শুনব কেন? আমার একটা ব্যবস্থা ক’রে দাও– মাসোয়ারা বন্দোবস্ত করো, বাড়ি কিনে দাও– আমি চলে যাচ্ছি। অমনি অমনি তোমাদের সুবিধে ক’রে দিতে চলে যাব– তা স্বপ্নেও ভেবো না!

এ রকম কতক্ষণ চলত তা বলা কঠিন। কোন যুক্তি-তর্কে বোঝানোর চেষ্টাও বাতুলতা। তরুর বিয়ের সময়ে তুচ্ছ ছুতো ক’রে ঝগড়া বাধিয়ে ঐন্দ্রিলাই চলে গিয়েছিল। কিন্তু সে কথা বলেও লাভ নেই। এখন প্রথম প্রশ্ন ওকে থামানো। কিন্তু কেমন ক’রে থামাবেন তা শ্যামা ও ভেবে পান না। যতটা অপ্রীতি আরও ঘটাতে পারলে ও আবার রাগ ক’রে ঝগড়া ক’রে চলে যায়, ঠিক ততটা এই সন্ধ্যাবেলা করতে ইচ্ছাও করে না। বিশেষত কাল থেকে তাঁর মনটা অত্যধিক দমে গেছে। এমন কখনও হয়নি এর আগে। হয়ত এটা বয়স বাড়বারই লক্ষণ। তা ছাড়া ভরসন্ধ্যাবেলায় কিচি কিচি ঝগড়া ঘোর অলক্ষণ, ভদ্রলোকের বাড়ির পক্ষে বেমানান তো বটেই। অনেক হয়েছেও তাঁর জীবনে, আর কোন অলক্ষণ ঘটতে দিতে সাহস হয় না তাঁর; কিন্তু বিপদ হয়েছে এই যে, এখন মিষ্টি কথা বলতে গেলেও ও শান্ত হবে না, তার মধ্যে কোন মতলব খুঁজে বার ক’রে আরও চেঁচাতে থাকবে। পেয়েও বসবে খানিকটা।

প্রমাদ গুনছেন শ্যামা– এমন সময় এক অঘটন ঘটল। সহসা হেম এসে পড়ল। অঘটনই বলতে হবে, কারণ কোনদিনই এত সকাল সকাল সে বাড়ি ফেরে না। সম্ভবত কালকের ঘটনার জের তার মনকেও ভারী ক’রে রেখেছিল, তাই অফিসের ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে এসেছে।

হেমকে দেখেই ঐন্দ্রিলা একেবারে চুপ ক’রে গেল। যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল। হঠাৎ যেন শামুকের খোলায় আঘাত লাগার মতো গুটিয়ে ছোট হয়ে গেল সে। আস্তে আস্তে ঘাটে গিয়ে কাপড় কেচে এসে সহজভাবেই ঘরে গিয়ে ঢুকল।

তার এ ভাবান্তরের কারণ ছিল। আসার সময় মেয়ে সীতাকে আনতে পারে নি। সে মেজকাকীর সঙ্গে তার বাপের বাড়ি গেছে, আজ বিকেলে ফেরবার কথা। ঐন্দ্রিলা বার বার বলে এসেছে যখনই ফিরুক, এমন কি রাত হয়ে গেলেও যেন তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে কথার অন্যথা করতে তাদের সাহস হবে না। পাঠাবে তারা নিশ্চয়ই। হয়ত ছোটকাকার সঙ্গেই পাঠাবে। যে কোন মুহূর্তেই তারা এসে পড়তে পারে। সে সময় যদি বড় রকমের একটা ঝগড়া–’হাড়াই-ডোমাই’ গোছ চলতে থাকে তো ওদের কাছে বড্ড খেলো হয়ে যাবে। তার ওপর দাদা যা মেঘের মতো মুখ ক’রে এসে ঢুকল এখন কোন কথা বললে সে হয়ত এমন রূদ্রমূর্তি ধরবে যে তখন বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন পথ থাকবে না। আজই এসে আবার আজই ঝগড়া ক’রে বেরিয়ে যাওয়া– সেটা, এমন কি ঐন্দ্রিলার পক্ষেও, বড় লজ্জার কথা। দাদার ব্যাপার সব সময় বুঝতেও পারে না সে– এক সময় যতই ওদের রাগারাগি চেঁচামেচি হোক, নির্বিকারভাবে বসে থাকে সে পাথরের মতো, আবার এক এক সময় একটুতেই ক্ষেপে ওঠে। এই সব ভেবেই তাড়াতাড়ি চুপ করে ঐন্দ্রিলা।

হেম অত লক্ষ করে নি। কিছুক্ষণ পূর্বে যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছিল এখানে তার কোন আভাসও পায় নি। সেক্রাদের বাড়ির কাছ থেকেই ঐন্দ্রিলার গলার আওয়াজ পেয়েছিল সে, কিন্তু ঝগড়া ক’রে ক’রে ওর স্বাভাবিক গলাও চড়া হয়ে গেছে, দূর থেকে পাওয়া কিছু বিচিত্র নয়। সামনে ঐন্দ্রিলাকে দেখেও কিছু বলল না তাই। কখন এল কেন এল– মেয়ে কোথায়, এসব প্রশ্নও করল না। যথানিয়মে কাপড়-জামা ছেড়ে ঘাট থেকে মুখ হাত ধুয়ে এসে একেবারে শুয়ে পড়ল।

চা বা জলখাবারের পাট নেই এ বাড়িতে। হেমও কোনদিন কিছু খায় না। শনিবার সকাল ক’রে ফিরলেও কিছু খেতে চায় না। একেবারে রাত্রে ভাত খায়– এই তার চিরদিনের অভ্যাস।

সুতরাং তার আচরণে বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ করলেন না শ্যামা। করল কনকই।

প্রথমত অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে আসা, এইটেই যথেষ্ট অস্বাভাবিক। মন খারাপ বলেই আরও, বেরিয়ে কোথাও আড্ডা দিতে যাবার কথা। মন-মেজাজ খারাপ থাকলে সাধারণত সে সিমলেয় যায় বড় মাসিমার বাড়ি– সেদিনগুলো টের পায় কনক। প্রথমত ফিরতে অতিরিক্ত রাত হয়, এখানে খায় কম, ভাত নিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করে তাছাড়া মেজাজও প্রসন্ন থাকে। সুতরাং আজ ছুটির পরই বাড়ি চলে আসা প্রচণ্ড ব্যতিক্রম। তার ওপর মুখের ভাবটা সন্ধ্যার ঝাপসা আলোতে শ্যামা লক্ষ না করলেও বাগানে ঢোকবার মুখে কনক লক্ষ করেছিল। অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটেছে নিশ্চয়, হয়ত আরও কোন দুঃসংবাদ আছে কোন দিকে।

তখনই কিছু বলল না সে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দোরে চৌকাঠে জল দিয়ে তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় এসে বসল। শাশুড়ী ঘাটে গেছেন স্নান করতে– তিনি এসে একটি ডিবে জ্বেলে ভাত চড়াবেন। পাতার জ্বালটা এবেলা আর বৌকে লাগাতে দেন না। তরকারি রাঁধাই থাকে, শুধু দুটি ভাত ফুটিয়ে দেওয়া। তাঁর বা ঐন্দ্রিলার জন্যে খাবার করার পাট নেই– চাটটি ক্ষুদভাজা বা চালভাজা তেলহাত বুলিয়ে নিয়ে খাবেন যখন হয়– অন্ধকারে বসেই।

শ্যামা কাপড় কেচে ঝাপসা আলোতেই ঘাট থেকে চাল ধুয়ে এনে রাখলেন। কাপড় ছাড়লেন অন্ধকারেই। এইবার তুলসীতলার প্রদীপ থেকে ‘লম্প’ বা ডিবেটা জ্বেলে এনে বসবেন উনুনের কাছে। ঐ থেকেই পাতা জ্বেলে উনুন ধরাবেন। দেশলাইর কাঠির অনর্থক খরচা শ্যামা পছন্দ করেন না। একটা দেশলাই প্রায় এব পয়সা পড়ে, কটাই বা কাঠি থাকে একমাসও যেতে চায় না একটা দেশলাই। হ্যারিকেন একটা আছে বাড়িতে, সেটা কদাচিৎ জ্বালা হয়। বর্ষাকাল বা ঝড়জল না হ’লে সেটা তোলাই থাকে। এই ‘লম্প’টিই জ্বলে, বাড়ির মধ্যে একমাত্র আলো হিসেবে। যেদিন হেমের আসতে অনেক রাত হয় সাতটার গাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ হয় জগাছার পূলের ওপর সেদিন আবার এরই আলোতে নতুন করে পাতা চাঁচতে বসেন শ্যামা কিংবা তেঁতুলের বিচি ছাড়াতে কিম্বা এই ধরনের কিছু। অর্থাৎ আলোটা বাজে খরচা না হয়। কনক নিদ্রালু চোখে বসে বসে শুধু দেখে, হয়ত একটু-আধটু গল্প করে। এ সময়টায় তার কোন কাজ থাকে না। সকাল করে খাওয়ার পাট চুকলে ঘাট থেকে বাসন মেজে এনে রাখে রাত্রেই। তখনও ঐ লম্পই নিয়ে যেতে হয়। নইলে বসেই থাকা। কাজের সময় গল্প করাটা শ্যামা ভালবাসেন না, কাজ খারাপ হয়, হাতকাটার ভয় থাকে। তাই গল্পও তেমন জমে না। খুব কষ্ট হচ্ছে দেখলে এবং শ্যামার মেজাজ ভাল থাকলে বলেন, তুমি শুয়ে পড়োগে বৌমা, হেম এলে আমি ডেকে দেব তখন।’

ঐন্দ্রিলা যখন এখানে থাকে তখন সীতাকে বসিয়ে ঐ আলোতেই অল্পস্বল্প পড়াবার চেষ্টা করে কনক। তার লেখাপড়ার পুঁজিও অবশ্য সামান্য– তবু যা পারে একটু পড়ায়। আসলে একটা কাজ নিয়ে থাকা। নইলে শুধু শুধু বসে থাকলেই রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় ঢোকে– বাজে চিন্তা। নিজের দুর্ভাগ্যের চিন্তাকেই বেশি ভয় ওর, তাই সবরকম চিন্তাকে এড়াতে চায় সে।

সুতরাং শ্যামার পর পর কার্যপদ্ধতি ওর জানা আছে। ওর ছোট দেওর বলে ‘রুটিন বাঁধা কাজ’। সে থাকলে কনকের একটু সুবিধা হয়। কিন্তু এবার অনেক চেষ্টা করে তাকে কলকাতাতে ছোট মাস-শাশুড়ীর কাছে পাঠিয়েছে হেম, এখানে থাকলে নাকি তার পড়াশুনো কিছুই হবে না। মাসিমার শরীর খারাপ, একটা-আধটু বাজারহাট করে দেয়, ইস্কুলে পড়ে। হেম গোপনে পাঁচ টাকা কর দেয় সেখানে– সেটা শ্যামা জানেন না, জানলে প্রলয় কাণ্ড হবে। নগদ টাকা দিয়ে ছেলে পড়ানোর পক্ষপাতী তিনি নন।

শ্যামা লম্পটা নিয়ে তুলসীতলায় আসতেই কনক কাছে এগিয়ে গেল। আস্তে ডাকল, ‘মা।’

‘কেন গা বৌমা?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করেন শ্যামা। প্রদীপের সেই সামান্য আলোতেই ওর মুখখানা ঠাওর করার চেষ্টা করেন। ডাকবার ধরনেই বুঝতে পারেন যে কোন জরুরি বক্তব্য আছে তার।

‘না, তেমন কিছু নয়।’ তাড়াতাড়ি তাঁকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে সে, ‘বলছিলুম যে– আপ–মানে ওর মুখের চেহারাটা আমার তত ভাল লাগছে না। কিছু একটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। একবার জিজ্ঞাসা করুন না। ঠাকুরজামাইদের কোন খবরটবর আছে কিনা-

শ্যামা চুপ করে যান। তাঁর ছেলের খবর বৌয়ের কাছ থেকে শোনাটা খুব রুচিকর নয়। হয়ত ‘ঠাকুরজামাই’ সংক্রান্ত প্রশ্নটা মধ্যে থাকাতেই সামলে নিলেন। একটু খানি চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘তা তুমিই জিজ্ঞেস করো না বৌমা।’

‘না না–। তা ছাড়া আমাকে উনি বলবেনও না তেমন কোন কথা হ’লে।’ এবার একটু খুশি হন শ্যামা। আশ্বস্তও হন। তাড়াতাড়ি লম্পটা জ্বালিয়ে এনে ঘরে ঢোকেন, ‘হ্যাঁরে, অমন করে এসে শুয়ে পড়লি কেন রে? শরীরটা খারাপ করছে নাকি?’

‘না।’ সংক্ষেপে জবাব দিল হেম। দেওয়ালের দিকে মুখ ক’রে শুয়েছিল, তেমনিই রইল। এপাশও ফিরল না।

এরপর আর কথা বাড়ানো উচিত নয়। ছেলের আজকাল বড় মেজাজ হয়েছে। কী বলতে কী বলে বসবে হয়ত।

তবুও ইতস্তত করেন শ্যামা। এবার তিনিও বুঝতে পারেন যে ছেলের মন খারাপ হবার কোন বিশেষ কারণ ঘটেছে।

অনেকক্ষণ চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থেকে সামান্য একটু কেশে গলার আওয়াজ ক’রে বলেন, ‘তা হ্যাঁ রে–ওদের কোন খবরটবর পাস নি, মানে নিবড়ের

ছিলেকাটা ধনুকের মতো লাফিয়ে সোজা হয়ে বসে হেম, ‘খবরদার বলছি, এ বাড়ির কেউ যেন সে ছোটলোকদের নাম না নেয়। ওদের নাম যে করবে তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না বলে দিলুম।’

এখনই আর কোন কথা বলা সম্ভব নয়। শ্যামাও চুপ ক’রে থাকেন। হঠাৎ যেন তাঁর মনে হয় নরেনকে দেখছেন–বা, তার কথাগুলো শুনছেন। এই দুশ্চিন্তার মধ্যেও কেমন ভয় হয় তাঁর–ছেলে কালক্রমে বাপের স্বভাবই প্রাপ্ত হবে না তো।…

চুপ ক’রে থাকে সকলেই। শ্যামার পিছু পিছু কনকও এসে দাঁড়িয়েছিল চৌ-কাঠের বাইরে, সে যেন নিঃশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ ক’রে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

নিথর নিস্পন্দ হয়ে যায় যেন আবহাওয়াটাও। শুধু শ্যামার হাতে ধরা ‘লম্প’র শিখাটা অল্প অল্প কাঁপতে থাকে তাঁর নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে, আর তাতেই হেমের ছায়াটাও একটু একটু কাঁপে পিছনের দেওয়ালে।

কিন্তু হেমই চুপ ক’রে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ। সে নিজেই ওদের প্রসঙ্গ তোলে এবার, ‘ছোটলোকটা কি করেছে জানো? এখান থেকে গিয়ে সোজা সেই প্রথম পক্ষের শ্বশুরবাড়ি উঠেছে। তাদের হাতে-পায়ে ধরে সেই বৌকে নিয়ে এসেছে আবার।’

‘কী সর্বনাশ!’ শ্যামা ও কনক দুজনের কণ্ঠ থেকেই একসঙ্গেই বেরিয়ে আসে কথাটা–চাপা, অস্ফুট–একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের মতো।

‘হ্যাঁ। সকালে উঠে ওর ঠাকুমা নাকি খুব চেঁচামেচি করেছিল, আমি আবার হারানের বিয়ে দেব, সাত দিনের মধ্যে যদি আর একটা বৌ না আনতে পারি তো আমার নাম নেই–এইসব। তাতে নাকি ওর পাড়ার কেউ কেউ এসে ছোটলোকটাকে ডেকে বলেছে যে ওসব মতলব করলে আমরাই এবার পুলিশে গিয়ে খবর দেব যে তোমাদের এই ব্যবসা দুজনে মিলে বৌ খুন ক’রে নতুন নতুন বৌ আনো তার গয়নাগাঁটি মারবে বলে! তাতেই নাকি ভয় পেয়ে ও এখানে এসেছিল। দিদি নাতিতে কিছু মতলব এঁটেই এসেছিল বোধ হয়–এখান থেকে তাড়া খেয়ে সটান সেখানে চলে গেছে।

‘তা তারা আবার পাঠালে?’ আড়ষ্ট কণ্ঠে কোনমতে প্রশ্ন ফোটে।

‘পাঠাবে না কেন! তারা কড়ার করিয়ে হারানকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে যে ওর সঙ্গে দিদিশাশুড়ীর কোন সম্পর্ক থাকবে না, –রান্না-খাওয়া পর্যন্ত আলাদা করতে হবে। জেদ্ বই তো নয়–জেদ বজায় রাখতে সবেতেই রাজি হয়েছে। তাদেরই তো ভাল হ’ল!’

‘তা তোকে কে বললে?’

এখনও যেন আড়ষ্টতা কাটে নি শ্যামার! বিহ্বলভাবে কতকটা কাঠের পুতুলের মতোই প্রশ্ন ক’রে যাচ্ছেন শুধু।

‘ওদের পাড়ার নাড়ু চক্কোত্তি আছে না, ওরেদই কী রকম হয় সম্পর্কে, তার ছেলে আমাদের অফিসে ঢুকেছে আজ মাস কতক হল। তার মুখেই শুনলুম। আবার বলেছে কিনা–

কথাটা শেষ হ’ল না। তার আগেই কী একটা ভারী জিনিস পড়ার আওয়াজ হ’ল বাইরে! কে যেন পড়ে গেল।

তরু কখন নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল তা কনকও টের পায় নি।

এখন চমকে পিছন ফিরে অন্ধকারেই বুঝতে পারল।

‘মা, শিগগির একবার আলোটা আনুন তো। ঠাকুরঝির ফিট হয়েছে বোধ হয়! চেঁচিয়ে উঠল কনক।

ওধার থেকে অন্ধকারেই ঐন্দ্রিলার কণ্ঠ ভেসে এল। সে অর্ধ-স্বগতোক্তি করছে, ‘এখনই মুচ্ছো গেলি– এর পর কী করবি? এই তো কলির সন্ধ্যে লো। কত মুচ্ছো যাবি এর পর?… কত কল্লাই জানে বাবা আজকালকার মেয়েরা।’

।।৩।।

এই ঘটনার পর থেকে তরু যেন কেমন হয়ে গেল। কথা সে চিরদিনই কম বলে, সেদিক দিয়ে তার স্বভাব মহাশ্বেতা ও ঐন্দ্রিলার বিপরীতই বলা যায়– কিন্তু এখন যেন একেবারেই কথা ছেড়ে দিল সে! কেউ কথা কইলে উত্তর দেয় না, দু’তিনবার পর পর কোন প্রশ্ন করলে কিম্বা বকাবকি করলে অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়।’হ্যাঁ’ কিম্বা ‘না’– এর বেশি নয়। তাও ঘাড় নেড়ে কাজ সারা সম্ভব হলে তাই নাড়ে। চুপচাপ বসে থাকে অধিকাংশ সময় ঘরের জানলায়। বাইরের দিকে বা বাগানের দিকের জানলায় নয়– উঠোনের দিকের জানলায় বসে একদৃষ্টে কাঁঠাল চারাটার দিকে চেয়ে থাকে। দিনে রাতে, সব সময়। কেউ এসে জোর করে টেনে নিয়ে গেলে স্নান করে খায়– তা নাহলে তাও করতে চায় না। সারাদিন খেতে না দিলেও কোন কথা বলে না বা খেতে চায় না।

কনকই এসবগুলো করে। সে-ই জোর ক’রে নিজের সঙ্গে ঘাটে নিয়ে যায়, জোর ক’রে গিয়ে ভাতের সামনে বসিয়ে দেয়। তাও প্রথম প্রথম ঠিক গোনা দু’গ্রাস খেয়েই উঠে পড়ত, কনক ছেলেটার কথা স্মরণ করাতো, ‘পেটে যেটা আছে তার কথাটা একটু ভাবো ঠাকুরঝি। ওটাকে বাঁচাতে হবে তো। ওটা তো তোমার নিজস্ব– তাতে তো কেউ ভাগ বসাতে পারবে না। তার কথাটা ভাবছ না কেন?’– বলাতে এখন খায় কিছু। তাও যা প্রথম দেওয়া হয় তা-ই খায়, আর চায়ও না, দিতে এলেও নেয় না। হাসিখুশি তো দূরের কথা– যদি একটু কাঁদত, তা’হলেও শ্যামা কতকটা স্বস্তি পেতেন।

পোড়ামেয়ের চোখে কি জলও থাকতে নেই একফোঁটা?… কী হবে বৌমা, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাবে নাকি? কোন মতে ওকে একটু কাঁদাতে পারো না মা?’

সে চেষ্টা অনেক করেছে কনক; কোন ফল হয় নি। ওর ভেতর-বার সবটা স্তম্ভিত হয়ে গেছে বোধ হয়– কোন কিছুরই বোধশক্তি আর নেই। চোখের জলের উৎসও বুঝি গেছে শুকিয়ে। দুঃখের বহিপ্রকাশের মধ্যে আছে শুধু মূর্ছা রোগটা। সেদিনের পর থেকে ওটা থেকেই গেছে। দুদিন তিনদিন অন্তরই মধ্যে মধ্যে ফিট হয়।

মহাশ্বেতা বলে, ‘ওর ওপর বাপু, আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি, কোন অন্যিদেবতার ভর হয়েছে। এ একেবারে পষ্ট লক্ষণ। এ আমি ভাল বুঝছি না। ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা করাও তোমরা। বল তো মাকড়দায় একজন ভাল গুণীন্ আছে শুনেছি, তার খবর করি। খুব বেশি নেয়ও না শুনেছি। সেবার আমার বড় ননদের ভাসুরঝির অমনি হয়েছিল-

বিরক্ত হয়ে শ্যামা থামিয়ে দেন ওকে ‘তুই চুপ কর তো। তোর সব তাইতে বক্তিমে আমার ভাল লাগে না। অন্যিদেবতার ভর হয়েছে! সে হয়ে থাকলে তোরই মাথাতে হয়েছে। গুণীন্ তুই দেখাগে যা!’

মহাশ্বেতা ঐন্দ্রিলা নয়। সে ঝগড়া করতে পারে না, ম্লানমুখে চুপ করে থাকে। তবে সে তখনকার মতোই। একটু পরেই হয়ত কনকের কাছে গিয়ে ফ্যাশ ফ্যাশ করে বলে, ‘আমি বলছি বৌদি, তুমি দাদাকে বলে একটা ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা করাও। যে রোগের যা। এ মন্তর-তন্তর ছাড়া ভাল হবে না। মা তো এদান্তের কথা জানে না, এখন খুব ভর হচ্ছে অন্যিদেবতাদের।

কনক অবশ্যই চুপ করে থাকে। ইদানীং ‘অন্যিদেবতাদের খুব বেশি ভর হচ্ছে এ কথা শোনবার পর হাসি চাপা কঠিন। সেইজন্যে আরও প্রাণপণে চুপ করে থাকতে হয়। তার বড় ননদীকে সে চিনেও নিয়েছে এর মধ্যেই– জানে যে ওকে এসব কথা বোঝাতে যাওয়া বৃথা।

তার উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করে না মহাশ্বেতা। হয়ত তখনই আবার তরুর সামনে গিয়ে বলে, ‘কী লো, কী খেতে টেতে ইচ্ছে হয় খুলে বল্। যা মন চায় বল্‌, আমি পাঠিয়ে দেব। এখানে তো ভাল-মন্দ কিছু হবার যো নেই। ভাত-হাঁড়ির ভাত খাও, তাতে মা গররাজী নয়, তার ওপর কিছু চেয়ো না বাপু। হি হি।… তা আমাকেই বলিস– যখন যা ইচ্ছে হবে। পেটে-পোয়ে খাবার সাধ চেপে রাখতে নেই। ছেলের মুখ দিয়ে নাল পড়ে। কচুরি খাবি দু’খানা? হিংয়ের কচুরি? বল্ তোর দাদাবাবুকে বলে দিই, বড়বাজার থেকে এনে দেবে। আ-মর, মুখপোড়া মেয়ে হাঁ-ও করে না হুঁ-ও করে না। বাক্যি হরে গেছে যেন।’

তারপরই আবার হয়ত– কিছুক্ষণ পূর্বের ধমকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে– মা’র কাছে গিয়েই উপদেশ দেয়, ‘তুমি ওকে দিয়ে খুব কাজকম্ম করাও। অমন ক’রে বসিয়ে রেখো নি। পোয়াতী মেয়ে, শেষে যে গুম পাগল হয়ে যাবে। খাটলে-খুটলে অত ভাবার সময় পাবে না, মনটাও ভাল থাকবে তখন!’

এ যে সৎ-পরামর্শ তা শ্যামাও জানেন। কথাটা তাঁর মাথাতেও গিয়েছিল বহু-পূর্বেই। কিন্তু কাজটা করাবে কাকে দিয়ে? একশবার কি টেনে টেনে নিয়ে জোর করে কাজ করানো যায়? কীই বা কাজ তাঁর সংসারে? তাঁর যা নিজস্ব কাজ–পাতা কুড়োনো, পাতা চাঁচা, তা ও পারবে না। বাগানের তদারক ও কখনও করে নি– কিছু জানে না। এক যেটা পারে, কনকের কাজ কিছু কিছু ভাগ করে নিতে। তা-ও এখন ঐন্দ্রিলা রয়েছে– সে যেন আরও, তরু এসেছে বলেই, বেশি করে করে কাজ করছে। রান্না বাসন মাজা, ঘর-দোরের পাট– কনকের কাছ থেকে টেনে নিয়ে করছে।

সবচেয়ে বড় কথা– অনিচ্ছায় কোন কাজই করানো যায় না। জোর করে বসিয়ে দিয়েও দেখেছেন, টেনে নিয়ে গিয়ে উনুনের ধারে বসিয়ে পাতার জ্বাল দেওয়াতে শুরু করে চলে এসেছেন– খানিক পরে গিয়ে দেখেছেন সে তেমনি চুপ করে বসে আছে। উনুন নিভে ধুস। ভাতও খানিকটা কাঁচা, খানিকটা সেদ্ধ– ঢিকচেলো হয়ে আছে। দুপুরে বাসন দিয়ে ঘাটে বসিয়ে রেখে এসেছেন, বেশ খানিকটা গড়িয়ে উঠে গিয়ে দেখেছেন যে, সে তেমনি বসে আছে, বাসন একখানাও মাজা হয় নি।

আবার কনক অনুযোগ করে, ‘অমন করে ঘাটে-টাটে একা বসিয়ে রেখে আসবেন না মা, ফিটের ব্যারাম হয়েছে, যদি হঠাৎ জলের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়? আমরা তো জানতেও পারবো না!’

কথাটা ঠিকই, শ্যামাও তা বোঝেন। সুতরাং সে চেষ্টা ছেড়ে দেন।

অর্থাৎ কিছুই করা যায় না– সমস্যা শুধু দিন-দিন উগ্রতর হয়ে ওঠে।

আরও বেশি সমস্যা হয়েছে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে।

তার বাক্যবাণ অহরহ বর্ষিত হয়ে চলেছে তরুকে উপলক্ষ করে। অথচ এমন কিছু ঝগড়া-ঝাঁটিও করে না যে বাড়াবাড়ি হয়ে চলে যাবে আবার। এবার যেন সে একটু বেশি সতর্ক হয়েছে। যাকে অন্তর-টিপুনী বলে, শুধু সেইটুকু দিয়েই সরে যায় অন্যত্র, ঝগড়া পেকে ওঠবার অবকাশ দেয় না।

হয়ত তরুর কাছে গিয়েই হাত-পা নেড়ে চাপা গলায় মুখের বিকৃত ভঙ্গি করে বলে, ‘রাখালি লো রাখালি– কত খেলাই দেখালি….. মাইরি, আদর নিতে তুই জানিস বটে। তোকে সবাই ভালমানুষ বলত। আমি জানি– চিরকাল মিচকে পোড়া শয়তান তুমি! কেমন কল্লা করলে– কোন কাজকম্ম কিছু করতে হচ্ছে না, অথচ সকলে হা-হুঁতাশ করছে, কী হ’ল কী হ’ল মেয়েটার কী হ’ল!’

আবার হয়ত জানলার বাইরে উঠোন থেকে কিছুক্ষণ ওর দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে, ‘নমস্কার। নমস্কার। তোমার ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার। একবছর ধরে নিত্যি তোমার পাদোকজল খেলে তবে যদি তোমার বুদ্ধির ধার দিয়ে যেতে পারি!’

এক এক সময় অন্তরের বিষও চাপতে পারে না। হিংস্র গলায় তর্জন করে ওঠে, ‘হবে না! এত দেমাক ভাল নয়। বড্ড অহঙ্কার হয়েছিল তোর, ভেবেছিলি বর একে-বারে হাতের মুঠোয় এসে গেছে,–তুই রাগ দেখিয়ে এখানে চলে এলেই চোখে শর্ষে ফুল দেখে ছুটে এসে হত্যে দিয়ে পড়বে। ওরে, হাজার হোক ওরা পুরুষ জাত, ওদের চার দোর খোলা।…. আমার বর সত্যি-সত্যিই আমার হাতধরা ছিল, আমার কথায় উঠত বসত, তবু কখনও এরকম ঘাঁটাতে যাই নি আমি। তুই ভাবিস্ তোর খুব বুদ্ধি! ঐ বুদ্ধিই তোর কাল হ’ল!’ ইত্যাদি–।

এ ছাড়া ওকে উপলক্ষ করে এবং শুনিয়ে মাকে বৌদিকে বলা তো আছেই।

মাঝে মাঝে উদ্বেগে কনকের চোখে জল এসে যায়।

কী হবে মা! মেজ ঠাকুরঝি দেখছি মেয়েটার একটা ভালমন্দ কিছু না ঘটিয়ে ছাড়বে না। নিত্যি শুনতে শুনতে শেষে যদি মনের ঘেন্নায় একটা কিছু করে বসে?

‘সবই তো বুঝি মা। কী করব সেইটেই যে শুধু বুঝতে পারি না। দুই-ই যে আমার পেটের কাঁটা। কোনটাই যে ফেলবার নয়। কাকে কি বলি বলো! ওকে তো দুবেলা টাইস করছি– দেখছই তো। কিন্তু ও কি কথা শোনবার পাত্তর! ওকে তো চেনো। এর পর কিছু করতে গেলে গলা-ধাক্কা দিয়ে বার ক’রে দিতে হয়। মা হয়ে সেটাই বা করি কী করে বলো?’

এক এক সময় আর থাকতে না পেরে চরম সাহসে ভর করে হেমের কাছে গিয়েই বলে কনক, ‘কী করলে বলো তো মেয়েটার? সত্যি-সত্যিই পাগল হয়ে গেলে কী করবে?’

হেম গোড়ার দিকে অত গ্রাহ্য করে নি। শ্যামা কি কনক উদ্বিগ্ন হয়ে কিছু বলতে গেলে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘প্রথম প্রথম শটা পেলে অমন হয়ই। দুটো চারটে দিন যেতে দাও না,–একটু সামলে নিক, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ দুঃখে হাউ-হাউ ক’রে কাঁদে, কেউ গুম হয়ে থাকে– দ্যাখো না? সব দুঃখই জুড়িয়ে যায়, ওরও যাবে!

হেম বাড়িতে থাকেই কম, রবিবারেও পুরো দিনটা বাড়ি থাকে না–খাওয়া দাওয়ার পরই বারোটা নাগাদ বেরিয়ে যায়। শনিবার সকাল করে ফিরে কাপড়-জামায় সাবান দিয়ে– হয় বিকেলেই আবার বেরিয়ে পড়ে, নয়ত বাগানে মন দেয়। তরুর অবস্থাটা তত চোখে পড়ে না ওর। কাজেই প্রথম প্রথম অতটা উদ্বেগের কারণও বুঝতে পারে নি |

কিন্তু ক্রমশ সেও চিন্তিত হয়ে উঠল।

অথচ এখন যে কী করা উচিত তাও ভেবে পায় না সে।

কনকের অনুযোগে এক সময় চটে ওঠে, ‘তা কী করতে হবে কি? এখন আবার পায়ে ধরে সতীনের ওপর গিয়ে দিয়ে আসতে হবে? সে আমি অন্তত পারব না। দিতে হয় তোমরা দাওগে।….. আর দিলেই বা সে সতীন ঢুকতে দেবে কেন?’

আবার কখনও ঠাণ্ডা মেজাজেই জবাব দেয়, ‘তা আমিই বা কি করছি বলো। তখন ঐ অবস্থায় মেয়েটাকে খুন হতে পাঠানোই কি ঠিক হত? দেখলে তো কি মেজাজ। ও রকম কথা শুনলে মরা মানুষের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, তা আমি তো জ্যান্তমানুষ। এ ওর বরাত। বরাত ছাড়া কিছু নয়।

এ কথার পর চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কনক বা শ্যামা কারুরই কোন উত্তর যোগাত না।

হঠাৎ একদিন কথাটা উঠল।

।।৪।।

সেটা শনিবার না হলেও কী কারণে সকাল করে ছুটি হয়েছিল– সিমলেয় বড় মাসিমার কাছে হয়ে আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছে হেম। শ্যামা যথারীতি বসে তেঁতুল কাটছেন, সীতা বই খুলে বসে ঢুলছে এবং মধ্যে মধ্যে শ্যামা বা কনকের কাছে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করছে। ঐন্দ্রিলার জ্বর-সে শুয়ে পড়েছে। কনক বাইরের অন্ধকার বাগানটার দিকে চেয়ে বসে আছে স্থির হয়ে। অন্ধকারে জোনাকিগুলো জ্বলছে আর নিভছে। অসংখ্য জোনাকি। এক এক সময় ভয় হয় ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে–কত, বোধ হয় হাজার হাজার হবে। এরা দিনের বেলা থাকে কোথায়, কই তখন তো মোটে দেখা যায় না!

সন্ধ্যেটা এমনি এলোমেলো চিন্তাতেই কাটাতে হয়। কনকের লেখাপড়া খুব বেশি জানা নেই, তবু হয়তো চেষ্টা করলে একটু-আধটু পড়তে পারত, কিন্তু বইয়ের পাটই নেই বাড়িতে। শ্যামা নাকি সেকালের মতে লেখাপড়া ভালই জানতেন, এখনও তাঁর হাতের লেখা মুক্তোর মতো– অনভ্যাসে সব ভুলে গেছেন। সীতারই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ধাঁধায় পড়েন, দ্বিতীয় ভাগের বানান বলতে পারেন না সব শব্দের। ছোট দেওর এখানে এলে তার পড়ার বইগুলো নিয়ে মধ্যে মধ্যে পাতা ওল্টায় কনক, তাও শ্যামার সামনে নয়, মেয়েদের ‘আয়না মুখে করে বসা’ তাঁর ভাল লাগে না। ওতে সংসার বয়ে যায়, সাত হাল হয় মানুষের। মেয়েরা সংসারের কাজ নিয়ে না থাকলে লক্ষ্মীশ্ৰী থাকে না।

সুতরাং–আরও অন্তত দুটো ঘণ্টা কী করে কাটবে এই ভেবে যখন অস্থির হচ্ছে মনে মনে, তখন হঠাৎ সদরে পরিচিত জুতোর আওয়াজ উঠতে যেন বেঁচে গেল সে। প্রথমটা একটু চিন্তাও হয়েছিল– আবার কোন দুঃসংবাদ নয় তো? কিন্তু ‘লম্পর কাছাকাছি আসতে দেখল যে মুখের ভাব প্রসন্ন, চোখের কোণে তখনও একটা কৌতুক-হাস্যের আভাস লেগে আছে– উচ্ছল হাস্য-পরিহাসের স্মৃতি সেটা।

ঘাট থেকে মুখহাত ধুয়ে আসতে কনক মৃদুস্বরে প্রশ্ন করল, ‘ভাত দেব এখন?’

‘ভাত?’ উদার প্রসন্নতার সঙ্গে বলল হেম, ‘তা দাও। কতক্ষণ আর বসে থাকবে। আটটা বেজে গেছে। আজ বড়মাসিমার ওখানে গেছলুম মা (শ্যামা মনে মনে বললেন, তা জানি, সে তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি!’) হঠাৎ সকাল করে ছুটি হয়ে গেল আজ– কে এক সাহেব মরেছে, তাই চলে গেলুম। বৌদির আবার ছেলে হবে!

‘তাই নাকি?’ এবার শ্যামা আর চুপ করে থাকতে পারেন না।

‘যাক, এবার একটা ছেলে হলে দিদির একটু শান্তি হয়।’ তিনি একটু থেমে বলেন। ছোটমাসিও আজ এসে পড়েছিল। দুবাড়িতে বুঝি মেয়েরা পড়ে নি– তাই একটু সময় পেয়ে এসেছিল। মেসোমশাইয়ের শরীর খুব খারাপ, হাঁপানির টানে সারারাত ঘুমোতে পারেন না, মাসিকেও বসে তেলমালিস করতে হয় বুকে অর্ধেক দিন।’

‘তা হাঁরে– খোকা কেমন আছে?’

‘ভাল আছে। বলছিল যে দেখে যাবি। কিন্তু তখন গেলে বড্ড রাত হত।

‘উমা কি আর ওকে একটু দেখছে-শুনছে? কে জানে। পয়সা নিয়ে পরের বাড়ি পড়িয়ে পড়িয়ে ঘরে এসে আর কি ওর গাধার খাটুনি খাটতে ইচ্ছে করে।…ত হাঁরে, শরৎ জামাই তো কিছু কিছু পান ছাপাখানা থেকে, উমা তো এবার একটু বিশ্রাম নিলে পারে।’

স্বামী-পরিত্যক্তা উমা একদা অবলম্বন হিসেবে এই মেয়েপড়ানোর কাজ নিয়েছিল– নিজের স্বল্পবিদ্যা সম্বল করেই। দুটাকা একটাকা মাইনের টিউশ্যানিই বেশি, তাই দুপুর থেকে রাত নটা পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি পড়িয়ে বেড়াতে হয়, নইলে ঘরভাড়া খাওয়াপরা একটা লোকের খরচ ওঠে না। শ্যামার মনে হয়– ঘরে থাকলে তার কোলের ছেলেটাকে একটু দেখতে পারত। একটা ছেলে পড়ে আছে মহার মামাতো ননদের বাড়ি–জায়গাটা ভাল নয়–তবু আদরযত্নেই আছে। যখন আসে তার বেশভুষার মহার্ঘ তাতেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়। লেখাপড়াতেও ভাল সে। তার জন্যে চিন্তা নেই। চিন্তা এই ছেলেটার জন্যেই।

ভাবতে ভাবতে একনিমেষে বহুদূর চলে গিয়েছিলেন শ্যামা। হঠাৎ কানে গেল হেম বলছে, ‘সে তো মেসোমশাই নিজে কতবার বলেন। তা কে শোনে বলো! মাসি বলে যে, না, যতদিন পারব নিজের রোজগারে খাব। যে স্বামী কখনও ফিরে চাইলে না তার পয়সায় বসে খাব কিসের জন্যে।… আর খোকার পড়ার কথা বলছিলে। খোকা এখন সিক্সথ্ ক্লাসে পড়ছে– ইংরিজি বই সব তার, সে কি মাসি পড়াতে পারে?’

কেন– উমা তো ইংরিজি শিখেছিল গোবিন্দর কাছে।

হ্যাঁ সে কী শিখেছিল– ফার্স্টবুক পর্যন্ত। নেহাত আজকালকার দিনে কোন মেয়েই শুধু বাংলা শিখতে চায় না– কাজচলা গোছের একটু শেখাতে হয়– তাই!’

ইতিমধ্যে কনক ঠাঁই করে ভাত বেড়ে দিয়েছে। হেম গিয়ে খেতে বসে। শ্যামাও কাছে এসে বসেন।’লম্প’ এখানে, সুতরাং তাঁর কাজ বন্ধ। তাছাড়া জেগে থাকলে ছেলের খাওয়ার সময় এসে বসেন প্রত্যহই। ভাতটা আর বেড়ে দিতে পারেন না– একশবার ওঠা- বসা করতে কোমর-ব্যথা করে তাঁর।

দু-এক গ্রাস খাবার পর হেম বলল, ‘বড় বৌদি কী বলছিল জান মা খুকীর কথায়?

গলাটা অকারণেই একটু বড় করে হেম। খাওয়ার ব্যবস্থাটা রান্নাঘরের দাওয়ায়। ভাত বেড়ে দিয়ে কনক ঘরের মধ্যে চৌকাঠের অপর পারে দাঁড়িয়ে থাকে। শাশুড়ী যখন সামনে বসে থাকনে তখন এখানে থাকার প্রয়োজন নেই, শোভনও নয় সেটা। যা দরকার শ্যামাই বলতে পারবেন, ও শুধু এসে দিয়ে যাবে।

সেই অন্তরালবর্তিনীও যাতে শুনতে পায় সেই উদ্দেশ্যেই গলাটা চড়ানো। খুশি হবারই কথা কনকের কিন্তু বড়বৌদির নামটা সেই উথলে-ওঠা খুশির ফেনায় যেন জল ঢেলে দেয়। তার প্রসঙ্গ শোনামাত্র মনের ধনুকে কে যেন টং করে টঙ্কার দিয়ে ওঠে। বিদ্বেষের আগুনে কান-মাথা গরম হয়ে ওঠে, কঠিন হয়ে ওঠে দেহ, মনও জুগুপ্সু হয়ে ওঠে। সমস্ত ইন্দ্রিয় টান টান হয়ে যেন নামটাকে সরিয়ে দিতে চায় স্মৃতি ও শ্রুতি থেকে।

বড়বৌদি কী বলছে তা শোনার জন্য শ্যামাও খুব উৎসুক নন। ছেলের এই অত্যধিক বড়বৌদি প্রীতি তিনি আদৌ পছন্দ করেন না। তবে এ বীতরাগ কনকের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে নয়; ছেলের এই অত্যধিক আকর্ষণের পিছনে কিছু অর্থব্যয়ও হয়–এই তাঁর আশঙ্কা।

‘যেখানে এত সোহাগ পীরিত, সেখানে কি আর এমনি হাত মুখে ওঠে, মন পাবার জন্যে কি আর চাট্‌টি সেই শ্রীপাদপদ্মে ঢেলে দিতে হয় না মনে করো?’ প্রায়ই বলেন ছেলের আড়ালে।

সুতরাং কোন উত্তর দেন না শ্যামা, কথাটা শোনবার জন্যে কোন আগ্রহও দেখান না।

তবে তাতে যে হেমের উৎসাহ কমে তা নয়, সে আগের মতোই ঈষৎ গলাটা চড়িয়ে বলে, ‘বলছিল যে ওর বৌদি যদি একটা শনিবারে আসবার জন্যে নেমন্তন্ন করে চিঠি লিখে পাঠায় তো কেমন হয়? আমাকেই বলছিল খুকীর বৌদির জবানিতে একখানা লিখতে– তা আমার হাতের লেখা তো সে জানে। সেটা দেওয়া ঠিক হবে না!’

‘এই ছিরির কথা! তাই আবার তুমি সবিস্তারে ব্যাখ্যা না করে বলতে এসেছ!’ মনের অপ্রীতি কণ্ঠে চাপা থাকে না শ্যামার, ‘আহা কী বুদ্ধি!’ যেন সে সেই নেমতন্নর জন্যই হাত ধুয়ে বসে আছে। অমনি তু করলেই চলে আসবে! বলে সে এখন এতদিন পরে তার প্রথম বৌকে এনেছে, সে তো বলতে গেলে এখন নতুন তার কাছে। তাকে ছেড়ে তাকে চটিয়ে এক কথায় অমনি ছুটে আসছে! রেখে বসো দিকি! একে বলে চ্যাংড়ার বুদ্ধি।’

হেম বেশ একটু ক্ষুণ্ণ হয়। উৎসাহের আধিক্যেই সে অমন জমাট-বাঁধা আড্ডাটা ছেড়ে ছুটে এসেছে। এই প্রস্তাবের যে এই পরিণাম হবে তা ভাবে নি।

সে একটু চুপ করে থেকে বেশ মুষড়ে পড়া গলাতেই বলে, ‘সে তো আমি বললুম। তা বৌদি বললে, ঠাকুরঝির পেটে তার ছেলে, প্রথম সন্তান, সে টান তো একটা আছে। তুমি লিখে দ্যাখোই না– অফিসের ঠিকানায় দিও বরং।’

‘দূর! দূর! যত সব বাজে কথা।’

কথাটা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেন শ্যামা।

হেম আর কিছু বলে না, গম্ভীর ভাবে খেয়ে উঠে যায়। সেদিন রাত্রে আর কনকের সঙ্গেও কোন কথা বলে না। একেবারে দেওয়ালের দিকে ফিরে শোয় গোড়া থেকেই।

কিন্তু কনকের মনে যতই বিদ্বেষ থাক বড়বৌ সম্বন্ধে কথাটা তার মন্দ লাগে না। কোন উপায়ই তো হচ্ছে না– একটু বেয়ে-চেয়ে দেখতে দোষ কি! সত্যিই তো, প্ৰথম সন্তান এসেছে পেটে–তার ওপর একটা টান তো থাকবেই। যতই বলো বাপু, বড়দির মাথায় খেলেও খুব!

সেদিন বহু রাত্রি পর্যন্ত জেগে জেগে ভাবল কনক। দিনের বেলাও কাজকর্মের ফাঁকে তোলাপাড়া করল অনেক, তারপর চিঠি একটা লেখাই সাব্যস্ত করল। কী আর হবে, না হয় উত্তর দেবে না– এই তো।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সীতার কাছ থেকে খানদুই খাতার পাতা আর দোয়াত কলম চেয়ে নিয়ে চিঠির মুসাবিদা করতে বসল। বার বার কাটাকুটি হয়, কোনটাই পছন্দ হয় না। এককালে ও পাড়ার অনেক বিবাহিতা মেয়ের প্রেমপত্র লিখেছে, কিন্তু অনভ্যাসে এখন যেন কোন কথাই মনে পড়ে না। হাতের লেখা ভাল নয় কোনকালেই– এখন আরও কদর্য হয়ে গেছে।

তবু তিন-চারবার চেষ্টার পর একটা চিঠি খাড়া করল শেষ পর্যন্ত

লিখল–

‘ঠাকুরজামাই,

ছোটঠাকুরঝি আপনার জন্য দিনরাত কাঁদিতেছে এবং পাগলের মতো হইয়া গিয়াছে। খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ছাড়িয়া দিয়াছে। এমন অবস্থায় সে বেশিদিন বাঁচিবে বলিয়া মনে হয় না। একবার আসিয়া অন্তত শেষ দেখা দিয়া যান। তাহার গর্ভে আপনার প্রথম সন্তান, সে গেলে সন্তানও যাইবে। দয়া করিয়া সামনের শনিবার একবার আসুন, মিনতি করিতেছি। আপনি আমার আশীর্বাদ লইবেন। গুরুজনদের প্রণাম দিবেন। ইতি–

আপনার বৌদি।’

বানান ভুল যে অনেক হল তা কনকও জানে। তবু এইটে লিখে ওর মনে হল মন্দ দাঁড়ায় নি। হাতের লেখাও, চেষ্টা করলে পড়া যাবে। তবে খামে কি আর দিতে দেবে হেম, মিছিমিছি দুটো পয়সা যে খরচ করবে তা মনে হয় না। আবার হয়ত পোস্টকার্ড এনে দেবে আবার নকল করতে হবে। সেটা কেমন দাঁড়াবে কে জানে।

শ্যামা গড়িয়ে ওঠবার আগেই দোয়াত-কলম যথাস্থানে রেখে এল সে। আঙুলে একটু কালি লেগেছিল, ঘষে ঘষে তুলে এল ঘাট থেকে।

হেমকে জিজ্ঞাসা না করে এ চিঠির কথা সে কাউকে বলবে না।….

হেম প্রথমটা একটু অবাক হয়ে গেল, খুশিও হল।

বড়বৌদির কথাটা উড়িয়ে দেয় নি কনক বরং সেই মতো কাজ করেছে, খুশিটা এই জন্যই বেশি।

তারপর প্রদীপের আলোতে (হঠাৎ কোন দরকার পড়তে পারে বলে সব ঘরে একটা করে প্রদীপ দিয়াশলাই রেখে দিতেন শ্যামা– রান্নাঘরেও) চিঠিটা পড়ে বলল, ‘বাঃ এই তো বেশ হয়েছে। দিব্যি গুছিয়ে লিখেছ তো। বাবা, তোমার পেটে পেটে এত। আমি সাত জন্মে বসে ভাবলেও এর একটা লাইন আমার মাথাতে যেত না। খুব লোককে লিখতে বলেছিল বড়বৌদি!’

বড়বৌদির নামেতে আজও মনের মধ্যে তেমনি একটা টং করে শব্দ উঠলেও খুশিও হল কনক। স্বামীর মুখে তার এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এই প্রথম শুনল সে। খুশির জোয়ার মনের কানায় কানায় উপচে উঠে অপ্রীতিকর নামটাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তার গৌরাভ মুখবর্ণে ক্ষণে ক্ষণে রক্তোচ্ছ্বাস হতে লাগল। আর সেইদিকে চেয়ে ক্ষীণ আলোতেই মনে হ’ল হেমের যে অনেকদিন পরে সে নতুন করে দেখল কনককে। রানীবৌদির দীপ্তি নেই বটে– সে কটা মেয়েরই বা আছে বাংলাদেশে?– তবু কনকেরও যে কিছু নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য আছে সেটা আজ লক্ষ করল সে। প্রদীপের খেলে-যাওয়া আবীর গোলার মতো রক্তোচ্ছ্বাসটাও তার চোখ এড়াল না। লজ্জারও যে–এটাকে লজ্জার লালিমা বলেই ধরে নিল হেম– একটা শোভা আছে, তা মানতেই হবে। এটা কিন্তু সকলের থাকে না। অতি সপ্রতিভ রানীবৌদির এই শোভাটি তেমন চোখে পড়ে না। নলিনীরও এমন মধুর লজ্জা দেখার অবকাশ হয় নি তার।…. সুতরাং সে তাকিয়েই রইল সেদিকে– কয়েক মুহূর্ত। সুশ্রী মসৃণ ললাটে পটে আঁকার মতো সুন্দর ভূ-তারই মধ্যে কালো টিপ একটি; বার বার ঘোমটা টানবার ফলে ঈষৎ বিপর্যস্ত কেশের কোলে কোলে সূক্ষ্ম একটি স্বেদরেখা বরাবরই ছিল, এখন সম্ভবত প্রদীপের তাপেই তার বিন্দুগুলি বৃহত্তর হয়ে ঐ টিপটির চারপাশে নামছে, ভ্রূর উপরে উপরে জমা হচ্ছে– সবটা জড়িয়ে ভালই লাগল হেমের।

ওর হঠাৎ চুপ করে যাওয়াটা লক্ষ করতে কনকেরও একটু সময় লাগল। সেও তন্ময় হয়ে উপভোগ করছিল এই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতাটা। যখন খেয়াল হল, তখন বিস্মিত হয়ে চোখ তুলে তাকাতেই চোখে পড়ল স্বামীর সেই ঈষৎ মুগ্ধ দৃষ্টি, ফলে সে আরও সুখী, আরও লজ্জিত, আরও বিব্রত হয়ে পড়ল। এই-ই প্রথম, তবু এ দৃষ্টি বুঝতে বোধ করি কোন মেয়েরই ভুল হয় না।

আবারও প্রবল খুশির জোয়ার বিচিত্র বর্ণাভার সৃষ্টি করল তার মুখে– তবু কনক সেটা উপভোগ করার জন্য অপেক্ষা করল না। সে যেন বড় বেশি দৈন্য প্রকাশ করা হয়, ছি!

সে বরং এই মোহটা ভাঙ্গবার জন্যেই জোর করে বাস্তবে নেমে এল, ‘তা এটা তো আবার পোস্টকার্ডে নকল করে দিতে হবে? পোস্টকার্ড আছে তোমার কাছে?’

‘দূর পাগল! পোস্টকার্ড কি? অফিসে চিঠি দিতে হবে– এসব চিঠি কখনও পোস্টকার্ডে দেওয়া চলে। তুমি এমনি আমার জামার পকেটে রেখে দাও, কাল আমি খাম কিনে ঠিকানা লিখে ফেলে দেব।…মাকে বল নি তো? এখন বলো না–দেখাই যাক না কী ফল হয়।’

পাগল শব্দটাও স্নেহ ও প্রশ্রয়-সূচক।

এই ধরনের সাদর সম্ভাষণের জন্যই তো কতকাল অপেক্ষা করেছে সে!

আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা; কিন্তু তখনই ঘুম এল না।

তরুর যা হয় হবে কিন্তু এ উপলক্ষে কনক তার পথ দেখতে পেয়েছে।

রানীদিকে বৈরীভাবে দুরে রেখে কোন লাভ নেই। এ প্রসঙ্গ ধরেই, এই পথ দিয়েই স্বামীর অন্তরঙ্গ হ’তে হবে। অন্তরঙ্গতা না জন্মালে কোন দিনই সে তার মনোরাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। বরং এই পথটাই সোজা– এতদিন বোকার মতো এড়িয়ে যেত সে। বড়ই বোকামি করেছে, আর না।

সে হেমের পা টিপতে টিপতে যেন কতকটা আপন মনেই বলল, ‘রানীদির খুব বুদ্ধি, না?

একেবারে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল হেম।

‘বুদ্ধি ব’লে বুদ্ধি– আমি কোন ব্যাটাছেলের অমন বুদ্ধি দেখি নি। আঁচে বুঝে নেয় কথা। এই তো আমাদের সব অফিসের সায়েবদেরও দেখি– একটা কথা বোঝাতে ঝিক্কুড় নড়ে যায়। অথচ দ্যাখো হাজার হাজার টাকা মাইনে পাচ্ছে। তাই তো বলি তা হাসে, বলে ভাগ্যিস শিখি নি তাহলে তো এমন করে আমার দেখা পেতে না, দারোয়ানকে কার্ড দিয়ে সেলাম করে ঢুকতে হত!’

এমনিই চলে দীর্ঘক্ষণ। শেষে এক সময় রাতই শেষ হয়ে আসে। ফরসা না হোক– ভোরাই বাতাসে তা টের পায় কনক। তবু সে-ই প্রসঙ্গটা থামতে দেয় না। হেমের উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে এলেই সে নতুন প্রশ্নের ইন্ধন যোগায়– নতুন প্রসঙ্গ তোলে রানীদি সম্পর্কে নতুন করে আবার উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে হেম।

এ খেলা সুখের নয়। এক নারীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সর্বক্ষেত্রেই অপর নারীর অন্তরে বিষদাহের সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে সে দাহের তো কারণই আছে যথেষ্ট। তবু সে থামতে দেয় না। স্বামীর সঙ্গে এত দীর্ঘক্ষণ ধরে এমনভাবে প্রাণখোলাগল্প করতে পারবে সে– এও যে তার কাছে কল্পনাতীত। তাই তিক্ততায় যতই অন্তরের পাত্র পূর্ণ হয়ে যাক, বেদনার ভারে মনটা যতই পিষে গুঁড়ো হয়ে যাক– সে যেন আর নিজেও থামতে পারে না। শুনেছে নিম- উচ্ছে ফুলেও মধু থাকে, মৌমাছি তাতে গিয়েও বসে, লেবুর তেতো খোসা দিয়েও নাকি মোরব্বা হয়– তেমনি সেও এই তিক্ততার মধ্যে থেকে স্বামীর অন্তরঙ্গ সাহচর্যের যে মধুটুকু আস্বাদ করতে পায়– সেইটেই পরম লাভ বলে মনে হয় তার।

এই প্রথম তাদের বিবাহিত জীবনে গল্প করতে করতে সারা রাত কেটে গেল। ওঘরে শ্যামার দোরখোলার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি কনক বেরিয়ে এসে যখন অবসন্নভাবে দাওয়ায় বসে পড়ল– তখন তার সমস্ত শরীর যেন অল্প অল্প কাঁপছে। সে কম্পন সুখের কি বিষাদের, আনন্দের কি ঈর্ষার তা সে নিজেও বুঝতে পারল না।

॥ ৫॥

মনে মনে এবং প্রকাশ্যে যতই রানীদির বুদ্ধির তারিফ করুক কনক–সত্যি সত্যিই যে ও চিঠিতে কোন কাজ হবে তা সে আশা করে নি। অন্তত এ শনিবার আসবে না, এটা ঠিক। আরও দু-তিন বার লিখলে হয়ত আসতে পারে সে। অর্থাৎ আরও দু-তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।

তবু সে হেমকে শনিবার দিন বিকেলে বেরোতে বারণ করল।

হেম কপালটা কুঁচকে বলল, ‘কেন, তোমাদের জামাই আসবে, তোমরাই আদরযত্ন ক’রো। আমি না থাকাই তো ভাল!’

‘তা তো ভাল বুঝলুম। আশা নেই–তবু যদিই এসে পড়ে–জামাই মানুষ, কিছু তো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে! তোমাদের ঘরে তো কিছুই নেই!

হ্যাঁ! ঐ যা ডাল-ভাত হয় তাই খাবে।’

‘না না–তা হয়না। একটু একটু মাছ ওর মতো, কি দুটো আলুও অন্তত না হ’লে কী ক’রে চলে!’

এ বাড়িতে আলু কেনার পাট নেই। নতুন আলু যখন খুব সস্তা হয় তখন এক আধদিন হেম নিয়ে আসে পোস্তা থেকে একেবারে পাঁচ সের। কৃপণের ধনের মতো সে-ই রেখে রেখে দীর্ঘকাল ধরে খাওয়া হয়। একটু দাম বাড়লেই সেটুকু কেনাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন চলে উঠোন কুড়িয়ে যা বাজার পাওয়া যায় তাই দিয়ে। তা শ্যামার বাড়িতে হয়ও অবশ্য অনেক রকম–থোড় মোচা কাঁচকলা ডুমুর, সজনে ও নাজনে ডাঁটা, সজনে শাক, আমড়া। এ-ছাড়া পুকুরের ধারে ধারে সুষুনি ও কলমি শাক তো অজস্র। এরা তো খায়ই, পাড়ার লোকও অনেকে তুলে নিয়ে যায়। পুঁই কুমড়ো লাউ-ডগা, এগুলো মধ্যে মধ্যে। কুমড়ো লাউ খুব ফলে না–অল্প জায়গায় এত গাছ, কোনটাই জুত হয় না তাই–তবু মাঝে মাঝে দু একটা মেলে বৈকি। সুতরাং অভাব খুব হয় না আনাজের, আর-একটু তেল কি মশলা পেলে এসব দিয়েও মুখরোচক তরকারি হয়। সেটারও যে কান্ত অভাব। সপ্তাহে পাঁচ- ছটাকের বেশি তেল আসে না। আগে হাসি পেত কনকের, এখন সেও অভ্যস্ত হয়ে গেছে– সে নিজেও তাই রান্না করে। শুধু ফোড়ন চোঁয়ানোর মতো তেল দেওয়া হয়। শ্যামা নিজেও বলেন, ‘তেলের কি স্বাদ আছে গা? একটু কাঁচা তেল মুখে দিয়ে দ্যাখো দিকি! সুসিদ্ধ এবং পরিমাণ-মতো নুন–এই তো ব্যাঞ্জনের স্বাদ। বড়জোর একটু ঝাল দাও। গন্ধ করবার জন্যে ফোড়ন–ফোড়ন চোঁয়ানোর মতো তেল–এইটুকু দরকার! বেশি ঢেলেই বা লাভ কি?’

সয়ে গেছে সবই, মাছও চায় না সে, তবু মধ্যে মধ্যে একটু আলুর জন্যে মনটা বড় ছট্‌ফট্ করে; অথচ আলুই একেবারে দুর্লভ এ বাড়িতে। মেজাজ ভাল থাকলে তবু রবিবার সকালে এক-আধদিন হাতছিপে এক-আধটা মাছ ধরে হেম–কিন্তু আলু কেনার ইচ্ছা বা সাহস তারও নেই।…

হেম কথাটা শুনে চুপ ক’রে রইল। খুব মনঃপূত যে হ’ল না, তা কনক বুঝতে পারল মুখ দেখেই।

সে একটু চুপ ক’রে থেকে বলল, ‘না হয় আধপো একপো আলু এনে রেখে তুমি চলে যাও, তারপর যা হয় ক’রে চালিয়ে নেবো ‘খন!’

‘না, সে আবার মার কাছে কী বলবে? সতেরো রকম কৈফিয়ৎ। দ্যাখো আসে কিনা– এলেও খায় কি না, শুধু শুধু কতকগুলো খরচান্তর ক’রেই বা লাভ কি!’ …দেখি একটু–’

হেম বাইরে যাবার জন্য কাপড় কোঁচাচ্ছিল–এ বিলাসটুকু তার আজও আছে, শনিবার দেশি কাপড় পরে বিকেলে কলকাতায় যাওয়া–কোঁচানো শেষ ক’রে সেটা আবার সযত্নে তুলে রেখে টান হয়ে শুয়েই পড়ল বিছানাতে।

এত অল্পে যে সে রাজি হবে তা কনক ভাবে নি। সাধারণ দিনে তো নয়ই, সামান্য জল-ঝড়েও তার এই বেরনো আটকানো যায় না। এও এক রকমের জয় তার।

সে একটু মুখ টিপে হেসে বলল, ‘মা যদি কিছু জিজ্ঞাসা করেন আবার, যদি বলেন আজও বেরোল না যে বড়? তা’হলে কী উত্তর দেব? কোনদিনই তো থাকো না, মানে কোন শনিবার–জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’

‘যা হয় ব’লো। ব’লো যে মাথা ধরেছে একটু। হয়ত পরে যাবে। কিংবা কিছুই বলে কাজ নেই। ব’লো যে আমি কি জানি!’

এই বলে সেও হাসল একটু। হয়ত অকারণেই।

আসলে তারও এ কদিনে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সে যেন নতুন ক’রে আবিষ্কার করেছে কনককে। ওর সঙ্গেও যে গল্প ক’রে সুখ হয়, অনেক রাত পর্যন্ত জেগেও গল্প করা চলে–এটাই যেন একটা আবিষ্কার

আর তার এই সামান্য পরিবর্তনের ফাঁকেই কখন যে কনক তাদের গল্প করাটাকে সুকৌশলে রানী বৌদি থেকে প্রসঙ্গান্তরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েও তাকে জাগিয়ে রাখছে গত দুদিন, তাও লক্ষ করে নি। অত জানতও না সে, কনকের মনেও যে এত কথা উঠতে পারে, তারও যে এত কৌশল জানা, এত বুদ্ধি থাকা সম্ভব এ তাকে কেউ বলে দিলেও বোধ করি সে বিশ্বাস করত না।

এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা এবং বেশ ভাল লাগছে– এইটুকুই শুধু জানত

তাই অন্য শনিবারে বেরোতে না পারলে যতটা অসহ্য মনে হ’ত আজ আর ততটা হল না। বরং আজ একটু আলস্য করতে ভালই লাগল যেন। কদিনই রাত্রে যথেষ্ট ঘুম হচ্ছে না– শোবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটোও বুজে এল সহজেই।

নিশ্চিন্ত হল কনক। তৃপ্তও হল। ঘরে যদি বাঁধতে পারে একবার, মনেও পারবে। আর ঘরের লোক কোনদিনই ঘরে না থাকলে যেন খাঁ-খাঁ করে– সে যদি ঘরে শুয়ে ঘুমোয় তাও ভাল।

সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল।

ঠিক সেই সময় বাগান থেকে একরাশ শুকনো আমড়া পাতা ও বাঁশ পাতা নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন শ্যামা। ওকে দেখেই– কনক যা আশঙ্কা করেছিল– উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁগা বৌমা, হেম যে আজ এখনও বেরোল না বড়? সাড়ে চারটের গাড়ি তো যাবার সময় হয়ে এল প্রায়! এতক্ষণ তো কোন শনিবার থাকে না। শরীর টরীর খারাপ হয় নি তো?’

গুছিয়ে কি উত্তর দেবে ভাবছে কনক–এমন সময় বাইরে থেকে পরিচিত-কণ্ঠের ডাক শোনা গেল–’সীতা আছিস নাকি রে, সীতা?’

‘ওমা, জামাই!’

এতখানি জিভ কেটে দুড়দুড় করে পালিয়ে গেলেন শ্যামা খিড়কির বাগানের দিকে। কারণ এই পাতা কুড়নোর সময়টা তিনি যে বেশ ধারণ করেন, তাতে কোনমতেই জামাই বা কুটুমসাক্ষাতের সামনে বেরনো যায় না। একটা গামছা বা হেমের অফিস থেকে আনা দুসুতির টুকরো পরেন এবং একটু ছেঁড়া ন্যাকড়া-গোছের গায়ে দেন। অনেকে এ নিয়ে অনেক অনুযোগ করেছে কিন্তু তিনি গায়ে মাখেন না। বলেন, ‘হ্যাঁ, বুড়ো হ’তে চললুম– বিধবা মানুষ– আমাদের আবার অত বেশভূষা কি গা? কী থাকে না পাতায়, কুকুর বেড়ালের গু থেকে সত্তিক জাতের এঁটো– মাছের কাঁটা পাঁঠার হাড়– চান তো করতেই হবে, মিছিমিছি একটা কাপড় ভেজাই কেন?’

আবার ঈষৎ অসহিষ্ণুভাবে ডাকে হারান, ‘কৈরে সীতি, কোথায় গেলি!’

অর্থাৎ, দাদাকে ডাকবে না। এত লোক থাকতে বৌদিকে ডাকাও ভাল দেখায় না।

কনক শাশুড়ীর সরে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল। এইবার সে বেরিয়ে এল ‘আসুন আসুন, ঠাকুরজামাই। আসুন।’

‘হ্যাঁ এই তাই আপনার জোর তলবেই ছুটে আসা। তা যা বলব, আদরযত্ন আর কি, খাওয়া তো আজ খেলে কাল ময়লা, মুখের মিষ্টি কথাই লোকে মনে রাখে। তা সেটা আপনার আছে খুব। বড় বংশের মেয়ে আপনি, আপনার কথাই আলাদা।’

কথা বলতে বলতেই ভেতরে এসে দাঁড়াল। কনক ছুটে গিয়ে ঘর থেকে একটা আসন এনে দাওয়ায় পেতে দিল, ‘বসুন ভাই। তা মিষ্টি কথায় কি আর আপনার সঙ্গে তা বলে পারব? মুখ্যু সুখ্যু মানুষ। আপনারা নাটক নভেল পড়া লোক, যা গুছিয়ে বলতে পারেন–’

এ কামড়ের দিক দিয়েও যায় না হারান। উদ্দীপ্ত হয়ে বলে, ‘না না বৌদি ওসব নাটক নভেল টভেল আমি বুঝি না, আমিও থার্ড ক্লাস পড়া লোক, কোন মতে আপনাদের আশীর্বাদে করে খাচ্ছি। আমার স্বভাব একেবারে অন্য রকম, পেটে এক মুখে এক নই–যা মনে আসে বলে দিই, ব্যস খালাস!’

কনক ভাবছে অন্য কথা। মা ওদিক দিয়ে পুকুরে গেছেন–কিন্তু আসবার এই পথ হয় জামাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরে বসিয়ে এদিকের দোর জানলা বন্ধ করে দিতে হয়– নয় তো একখানা কাঁচা ভাল কাপড় ঘাটে দিয়ে আসতে হয়। অথচ জামাইকে ফেলে যাওয়া– এখনই একটা দুটো কথা না বলে–সেটাও ভাল দেখায় না।

তরু যথারীতি জানলাতেই ছিল। প্রথম ডাকটা কানে যেতেও বিশ্বাস করে নি ভেতরে ঢুকতে দেখে ছুটে গিয়ে ঘরে দাঁড়িয়েছে– কনক যখন আসন আনতে গিয়েছিল তখন দেখে এসেছে ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে সে দাঁড়িয়ে। তার দ্বারা কোন কাজ হবে না। সীতাও ঘুমুচ্ছে, ঐন্দ্রিলাও ঘরে নেই।

হারান কিন্তু বলেই চলেছে, ‘অনেক ভাবলুম চিঠি পড়ে, বুঝলেন বৌদি, কী কর্তব্য। ভাবলুম হাত যখন একবার ধরেছি শালগ্রামশিলা সাক্ষী করে, ওর নাম কি ওর গর্ভে যখন আমারই বংশধর– তখন আমার উচিত ওকে দেখা।’

কী একটা আওয়াজ হল না? কনক কান খাড়া করে থাকে। কিন্তু হারানের কথার মধ্যে চলে যাবার মতো ফাঁকও যে পাওয়া যাচ্ছে না।

হারান বলছে, ‘ও ছেলেমানুষ, বোকার মতো একটা কাজ করেছে– তাই বলে আমিও ছেলেমানুষী করব? তা হ’তে পারে না। বাড়িতে ফিরে এসে বললুম, আমি ওখানে যাচ্ছি- তা তিনি তো একবারে দশবাই চণ্ডী বুঝলেন না? মরুক গে, মেয়েমানুষ চেঁচায়ই, তা আমি কি আর সে জন্যে কর্তব্যভ্রষ্ট হব! চলে এলুম সটান– সামনে দিয়েই–।…. মোদ্দা সকাল করে ফিরতে হবে বৌদি– জরুরি রিয়েসাল আছে ক্লাবে, না গেলেই নয়!

‘ও মা, তাই কখনও হয়! কনক আরও কি বলতে যাচ্ছিল, ভেতর থেকে সীতার নিদ্ৰা- জড়িত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ও মামী শিগির এসো, ছোট মাসীর আবার ফিট হয়েছে!

‘ঐ, চলুন চলুন– একেবারে ভেতরেই চলুন।’ তারপর ঘরে ঢুকে পাখা খোঁজবার ছল করে সীতাকে চুপি চুপি বলে, ‘শিগগির তোর দিদিমার কাপড়টা ঘাটে পৌঁছে দিয়ে আয় মা!

অত বেলা অবধি ঘুমোনোর ফলে সীতার তখনও আচ্ছন্ন বিহ্বল ভাবটা রয়েছে, সেটা বিকেল কি সকাল–ভাববার চেষ্টা করছে প্রাণপণে–সে বেশ কলরব ক’রেই প্রশ্ন করল, ‘কোন্‌টা মামীমা–পাঁচিধুতিটা? ঐটেই তো পরে সকালে!’

‘না রে, কাঁচা থানটা!’ থানটা আলনা থেকে পেড়ে ওর হাতে গুঁজে দিয়ে একরকম ঘর থেকে ঠেলেই দেয়।

ততক্ষণে হারান নিজেই কলসি থেকে খানিকটা জল হাতে করে নিয়ে মুখে ছিটোচ্ছে তরুর, ‘ইস, এমন হাল হয়ে গেছে! এ যে চেনাই যায় না। খেত না মোটে–নাকি? দেখুন দিকি; একে বলে ছেলেমানুষি! ছি ছি! পেটে একটা আছে, তার কথাও তো ভাবতে হয়। কি দরকার ছিল এত কাণ্ডর বলুন তো। আসবারই বা কি দরকার, এলেও, তখন চলে গেলেই হত। আমি দেখছি আপনার– এক আপনারই এর মধ্যে স্থির বুদ্ধি, ভাল বুদ্ধি! ঐ তো– ঠাকমার তো বিষ-দাঁত ভেঙ্গে গেছে, গেল হপ্তা থেকে পক্ষাঘাত হয়ে বাঁ দিকটা পড়ে গেছে একদম, বিছানায় শুয়ে যা কিছু। আমার তিনি তো দুবেলা গঞ্জনা দিয়ে তবে কন্না করছেন। এখন চুপ একদম, শুধু পড়ে পড়ে কাঁদছে। সামনে গাল দেবার সাহস আর নেই, দিলেও আড়ালে– বুঝলেন না!’

ততক্ষণে তরুর জ্ঞান ফিরে এসেছে। সে ধড়মড় করে উঠে বসে মাথায় ভিজে কাপড়টাই টেনে দিলে 1

‘উঁহু-উঁহু উঠো না। উঠো না। আর ভিজে আচলটাই বা মাথায় দেবার দরকার কি? অসুখ করবে যে! ঘরে কে আর আছে–বুঝলে না– বৌদি তো ঘরের লোক। সত্যি, অনেক পুণ্যি করে বৌদি পেয়েছিলে– বুঝলে –না–’

কনক মুখ টিপে হেসে সেইখানেই একখানা আসন পেতে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

‘আসল ঘরের লোকটিকে নিয়ে এখন থাকুন ভাই, নকল ঘরের লোক এখন কাজে যাচ্ছে!’

বাইরে তখন শ্যামা অনেকটা সাব্যস্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন বটে, কিন্তু মুখ তাঁর আষাঢ়ের মেঘের মতো অন্ধকার!

কনক উঠোনে নেমে কাছে যেতেই চাপা অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘সে-ই চিঠি পাঠানো হয়েছিল বুঝি– আমার কথাটা অগেরাহ্যি করে?’

সে কণ্ঠস্বরে কনকের বুক শুকিয়ে উঠল। আসল কথাটা বলতে সাহস হল না– একেবারে মিথ্যাও বলতে পারলে না, ঢোক গিলে লেখার কথাটা পাশ কাটিয়ে গিয়ে অর্ধস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘উনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।’

‘হুঁ। তা তো দেবেনই। বড় বৌদি বলেছেন, সে যে বেদবাক্যি– গুরুমন্তর একেবারে। আমি বেটি কে, ঘুঁটে-কুডুনি কানিপরা দাসি বৈ তো আর নই!’

তাঁর এই অযৌক্তিক বিষোদ্গার দেখে অবাক হয়ে যায় কনক। এবাড়িতে এসে পর্যন্ত মানবচরিত্রে তার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে কিন্তু আজকের এটা একেবারে নতুন। মা সন্তানের সুখে সুখী নন, তার জীবন, তার ভবিষ্যতের চেয়ে তাঁর কাছে তাঁর অত্যন্ত তুচ্ছ একটা কর্তৃত্বের প্রশ্নই বড়– এরকম এখনও ভাবতে অভ্যস্ত নয় সে, তাই তার অবাক লাগল। কিম্বা ঠিক কর্তৃত্বর প্রশ্নও নয়– বুদ্ধির অহঙ্কারে আঘাত লাগলে বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেই এমনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, কে জানে।

সে কোনমতে ওঁকে এড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল।

হেম উঠে তখনও বিছানাতেই বসে আছে চুপ করে। তার মুখ প্রসন্ন। তরুর ভবিষ্যতের চেয়েও তার বর্তমানের চিন্তাটাই পাষাণ-ভার হয়ে চেপে বসেছিল মনে, সেই ভারটাই নেমে গেছে। রানী বৌদির কথাটা ফলেছে, তৃপ্তি সে জন্যেও

ওকে ঢুকতে দেখে বলে, ‘তাহলে ছটাকখানেক কাটা মাছ নিয়ে আসি, আর দুটো মিষ্টি– কি বলো?’

‘তাই আন। কিন্তু দোহাই তোমার– চিঠিটা যে আমি লিখেছিলুম, মাকে যেন বলো না!

‘জানি।’ বলে মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে যায় হেম।

হারানের যে জরুরি রিহার্সাল আছে ক্লাবে, তখনই যাওয়া দরকার– সে কথাটা আর তার মনে রইল না। বলা বাহুল্য, এরাও কেউ মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করল না।

শাশুড়ী সামনে এসে দাঁড়াতে খুব সহজভাবেই তাঁকে প্রণাম করে কুশল প্রশ্ন করল। তরুর ছেলেমানুষী প্রসঙ্গে তাকে মৃদু তিরস্কার এবং সাধারণভাবে অনুযোগ করল। অর্থাৎ লজ্জা পাবার মতো কোথাও কিছু ঘটেছে, তা তার আচরণে আদৌ প্রকাশ পেল না।

শ্যামা অবশ্য বেশিক্ষণ বসলেন না, রান্না করার অছিলায় বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে কিন্তু তাতে হারানের উৎসাহ কমল না। ততক্ষণে ঐন্দ্রিলা এসে পড়েছে পাড়া বেড়িয়ে। সে তাকে নিয়েই পড়ল। তা ছাড়া সীতা কনক– এবং নীরব নত-মুখী তরু তো আছেই– গল্প করার লোকের তার অভাব ঘটল না।

হেম একবার মাত্র এসে দাঁড়িয়েছিল। হারান শশব্যস্তে উঠে গিয়ে প্রণাম করল। তারপর ঘাড় হেঁট করে মাথাটা চুলকে বলল, ‘দাদা অভাগা ছোট ভাইকে মাপ করেছেন তো? রাগের মাথায়– আর তখনও খাওয়া হয় নি বুঝলেন কিনা– এতটা পথ ঠেকো রোদ্দুরে এসে আর লঘু-গুরু জ্ঞান ছিল না!’

এত সহজে এসব কথা যোগায় না হেমের মুখে। সে একটু মৃদু হেসে আশ্বস্ত করে, ‘সব ভালো তো?’– কুশল প্রশ্ন মাত্র করে সরে পড়ল। তখন আর কলকাতা যাওয়া সম্ভব নয়, সে হাত-ছিপটা পেড়ে নিয়ে কেঁচোর সন্ধানে চলল। যদি দু-একটা মাছ ওঠে।

যথা নিয়মে চা জলখাবার এবং যথা সময়ে ভাতও খাওয়া হয়ে গেল। কনক আগেই বাইরের ঘরে ওদের বিছানা করে দিয়েছিল, মুচকি হেসে বলল, ‘যান সটান একেবারে ওঘরে চলে যান। আপনাদের ঐসব ছাই-ভস্ম কি ধোঁয়া-টোয়া খাওয়া আছে সারুন গে, ঠাকুরঝি খেয়ে-দেয়ে যাচ্ছে।’

সবকটা দাঁত বার করে হে হে করে হাসে হারান।

‘এই তো সব মাটি করলেন বৌদি। মা দাদা সব রয়েছেন– ধোঁয়া খাবার কথাটা চেঁচিয়ে বলে দিলেন!’

‘না, তাঁরা তো আর টের পাবেন না। একটু পরেই যে বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোবে– তখন!’

‘আরে সে অন্য কথা।’

হাসতে হাসতেই গিয়ে ঘরে ঢোকে।

তার পরের দিনও থাকল সে। একেবারে সোমবার এখান থেকেই খেয়ে-দেয়ে অফিস রওনা হল।

যাবার সময় কনকই প্রশ্ন করল, ‘তার পর? আবার মশাইয়ের দেখা পাচ্ছি কবে? শনিবার অন্ততঃ আসছেন তো?’

এ শনিবার নয় বৌদি।’ হারান বেশ সপ্রতিভভাবে বলে, ‘আপনিই বুঝে দেখুন, তারও তো একটা ক্লেম হয়ে গেল কিনা– নতুন করে। ফি শনিবার এলে কুরুক্ষেত্তর করবে হয়ত আপিং খাবে কি জলে ঝাঁপ দেবে।… সে আবার বাপের আদুরে মেয়ে– বুঝলেন না! আর আমার কাছে- সর্বদা ন্যায্য বিচার। এক শনিবার তার এক শনিবার এর। বলে কয়েই আসব, নুকোছাপা কিছু নেই তো! হাত যখন ধরেছি– বুঝলেন না?’

‘তা–তাঁর তো এই হপ্তার দিনগুলো রইলই!’ মৃদুস্বরে তবু কনক বলতে যায়।

উঁহু তার নয়–তার নয়। এ দিনগুলো ধরুন ঠাকুমা-মাগীর! সে তো শুষছে। তার কন্না করছে তো–ও। গু-মুত থেকে নাওয়ানো-খাওয়ানো সবই তো করতে হচ্ছে–তবে? তার দরুন একটা বাড়তি ক্লেম তার আছে–বুঝলেন না?’

হে হে করে হাসতে হাসতে চলে গেল হারান।

কনক ফিরে দেখল তরু নিজে থেকেই ও ঘরের বিছানা তুলছে। সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।

শুধু শ্যামা কটু কণ্ঠে মৃদু মন্তব্য করলেন, ‘খুব হল আর কি! মেয়ে তো বসে রইলই বুকের ওপর বারোমাস– তার ওপর এখন ঘর-জামাই পোষো। একগাদা খরচান্ত শুধু!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *