০৩. বড় হওয়া

এক পবিত্র দিনে জন্ম আমার, বারোই রবিউল আওয়াল, সোমবার, ভোর রাত। এমন মেয়ের জন্মেই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা মহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলার কথা, আল্লাহর ওলিরা নাকি জন্মেই তা বলেন। ফজলিখালা বলেছিলেন, আহা কি নুরানি মুখ মেয়ের, হবে না কেন, কী পবিত্র দিনে জন্মেছে!

কিন্তু মেয়ের মুখের নূর রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যায়। শরাফ মামা, ফেলু মামা আর টুটু মামার পেছনে দৌড়োতে দৌড়োতে। কড়ই গাছকে পাক্কা করে চোর চোর খেলার ধুম পড়ে বিকেল হলেই। চোর দৌড়ে যাকে ছোঁবে, সে হবে চোর, গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে চোরকে বলতে হবে এক দুই তিন চার পাঁচ, তারপরই ভোঁ দৌড়, যাকে কাছে পায়, তার পেছনে। মামারা আমার থেকে বড়, দৌড়োতে পারেন আমার চেয়ে দ্রুত। আমাকেই বেশির ভাগ সময় চোর হয়ে থাকতে হয়। টুটু মামা কেড়ি কেটে দৌড়োন, চোর আমি ধন্দো পড়ি। খরগোসের মত দৌড়োন ফেলুমামা, সারাদিন তাঁর পেছনে দৌড়োলেও তিনি আমার নাগালের বাইরে থাকেন।

ডাংগুটি খেলতে গেলেও আমাকে খাটতে হয়। আমি গুটি ছুঁড়ি, শরাফ মামা নয়ত ফেলু মামা ডাং পিটিয়ে সে গুটি মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন। আমার ইচ্ছে করে আমি ডাং হাতে খেলি, কেউ খাটুক, গুটি ছুঁড়ুক আমার ডাংএর দিকে। তা হঠাৎ খানিকক্ষণের জন্য ঘটে বটে, আবার ডাংএর গায়ে গুটি না লাগায় ডাং ফেরত দিতে হয়।

মার্বেল খেলতে গেলেও জিতে আমার সব মার্বেল মামারা নিয়ে নেন। শরাফ মামা কাচের বয়ামে মার্বেল রাখেন। প্রায়ই বিছানায় বয়াম উপুড় করে ফেলে মার্বেল গোণেন তিনি। আমি মুগ্ধ চোখে দেখি চকচক করা মার্বেলগুলো। আমার কেবল তাকিয়ে থাকার অধিকার আছে, ছোঁবার নেই। একবার হাত বাড়িয়েছিলাম বলে শরাফ মামা ধাম করে পিঠে কিল বসিয়েছিলেন।

সিগারেটের প্যাকেটগুলোও আমার হাতছাড়া হয়ে যায়। বগা, সিজার, ব্রিস্টল আর ক্যাপস্টেনের প্যাকেট রাস্তা থেকে কুড়িয়ে চ্যাড়া খেলতাম। উঠোনের মাটিতে চারকোণা ঘর কেটে ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে চ্যাড়া ছুঁড়তে হয়, এরপর যত ইচ্ছে প্যাকেট হাতের মুঠোয় নিয়ে দু’উরুর তলে লুকিয়ে অন্যপক্ষকে বলতে হয় পুটকির তল। মানে বাজি, তোমার চ্যাড়া আমার চ্যাড়ার চারআঙুলের সীমানায় এলে আমি পুটকির তলে যা আছে দিয়ে দেব, না হলে তুমি দেবে গুনে গুনে। আমাকেই দিতে হত।

চোর চোর, ডাংগুটি, মার্বেল, চ্যাড়া খেলে খেলে রং তামাটে হয়ে গেছে, মুখের নূরানি গেছে, ফজলি খালা তবু আশা ছাড়েননি, তাঁর তখনও ধারণা আমি বড় হয়ে আল্লাহর পথে যাব।

নন্দিবাড়ি থেকে আমার ঘুরে আসার পর ফজলিখালার ধারণা আরও পোক্ত হয়। রুনুখালার বান্ধবী শর্মিলার বাড়ি নন্দিবাড়ি নামে এক এলাকায়, হাজিবাড়ি জঙ্গলে যেতে গেলে হাতের বাঁদিকে। ও বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন রুনু খালা আমাকে নিয়ে। শর্মিলার বাড়িটি, চুন সুরকি খসা পুরোনো দালান। পোড়ো বাড়ির মত, যেন দেয়ালের ভেতরে সাপ বসে আছে মোহরের কলসি নিয়ে। যেন বটগাছ গজাচ্ছে বাড়িটির ফোকরে। বাড়িটি দেখলেই মনে হয় বাড়ির ছাদে গভীর রাতে কোনও রূপবতী মেয়ে পায়ে নূপুর পরে নাচে আর বাতি জ্বাললেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বাড়িটি ঘিরে লিচু গাছ, লিচু পেকে ঝুলে আছে গাছের সবগুলো ডাল। নন্দিবাড়ির লিচুর বেশ নাম, কিন্তু লিচুর দিকে হাত বাড়াতে আমার ভয়, যদি পোড়োবাড়ির দালান থেকে উঁকি দেয় কোনও পদ্ম গোখরা। সিঁড়ির সামনে অদ্ভুত সুন্দর এক পুকুর, জলে তাকালে তলের মাটি দেখা যায়, আর জলের আয়নায় ভেসে ওঠে মুখ, জল নড়ে, মুখও নড়ে এলোমেলো হয়ে। আমি হাসি না, অথচ জলের মুখ হাসে আমাকে দেখে।

সন্ধেয় নিবু নিবু হারিকেন জ্বেলে শর্মিলা আমাদের মিস্টান্ন খেতে দিয়েছিলেন, আমি মাথা নেড়ে বলেছি খাবো না। খাবো না তো খাবোই না।

— কেন খাবে না? শর্মিলা জিজ্ঞেস করল।

ঠোঁট চেপে বসে থাকি। সাপের, জিনের, ভূতের ভয়ে গলার স্বর বেরোয় না।

শর্মিলা অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে, যে মেয়ে ছাদে গভীর রাতে নাচে বলে মনে হয়, ও ঠিক শর্মিলার মত দেখতে। শর্মিলার কোনও যমজ বোন নয়ত আগের জন্মে ও শর্মিলাই ছিল। শর্মিলার কালো চুল সাপের মত নেমে এসেছে হাঁটু অবদি। বাড়িতে তখন একা সে, পরনে শাদা শাড়ি, বেতের চেয়ারে বসেছেন গা এলিয়ে চুল এলিয়ে, হু হু করে সন্ধের বাতাস জানলা গলে এসে আরও এলো করে দেয় চুল, আবছা আলোয় দেখি তাঁর কাজল না পরা চোখও কালো, উদাস।

শর্মিলা ঠোঁট খুললে মনে হয় আকাশ থেকে ডানা করে এক শাদা পাখি বয়ে আনছে শব্দমালা–খুব মিষ্টি মেয়ে তো, নাম কি তোমার?

কান পেতে থাকলে শর্মিলার কথার সঙ্গে নূপুরের শব্দ শোনা যায়। আমি শুনি, অন্তত। রুনু খালা বলেন–ওর নাম শোভা।

–মিষ্টি খাও শোভা। শর্মিলা হেসে বলেন।

আমার নাম শোভা নয় কথাটি বলতে চেয়েও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শোভা নামটি আমার সত্যিকার নামের চেয়ে ভাল তা সত্যি কিন্তু নামটি আমার নয়। নামটি বলে আমাকে কেউ ডাকলে কেমন অস্বস্তি হয় আমার, ওই নামের ডাকে সাড়া দিলে নিজেকে মিথ্যুক মনে হয়, মনে হয় চোর, অন্যের নাম চুরি করে নিজের গায়ে সেঁটেছি। শর্মিলাকে হঠাৎ, হঠাৎই, আমার শর্মিলা বলে মনে হয় না, বসে আছে চুল খুলে শাদা শাড়িতে, যেন ও শর্মিলা নয়, ওর মরে যাওয়া যমজ বোন নয়ত আগের জন্মের ও বলছে। শব্দগুলো আসছে পাখির ডানায় করে। ও যখন কথা বলে নূপুরের শব্দ ভেসে আসে। মিষ্টি এক গন্ধ ঘরে, বেলি ফুলের। ঘরে কোথাও বেলি ফুল নেই, বাগানে বেলি ফুলের গাছ নেই, গন্ধ কোত্থেকে আসে আমি বুঝি না। ফুলের গন্ধ কি শর্মিলার গা থেকে আসছে! বোধহয়। রুনু খালার হাত চেপে বলি–চল, বাড়ি যাই।

হারিকেনের আলো ম্লান হতে হতে দপ করে নিবে যায়। শর্মিলার গায়ের আলো সারাঘর আলো করে দেয়।

সারাঘরে আলো ছড়িয়ে বেলি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে শর্মিলা বলেন–এখনই চাঁদ উঠবে। ফুটফটে জোৎস্না হবে। জোৎস্নায় বসে আমরা গান গাইব আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। তুমিও গাইবে।

বলে রিনরিন করে হেসে ওঠেন। আমি রুনু খালার গা ঘেঁসে ভাঙা গলায় বলি –রুনুখালা, চল। বাড়ি চল।

সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি, চাঁদ ছিল শর্মিলাদের বাড়ির ওপর, উড়ে উড়ে আমাদের বাড়ির আকাশ অবদি এল। রুনুখালাকে পথে বলেছি দেখ দেখ চানটা আমগোর সাথে সাথে আইতাছে। রুনুখালা মোটে অবাক হলেন না দেখে। মা’কে বাড়ি ফিরেই বলেছি–জানো মা, চান আমরা যেইদিকে গেছি সেইদিকে গেছে। নন্দিবাড়ি থেইকা চানটা আমগোর সাথে আকুয়ায় আইছে।

মাও আমার কথায় অবাক হন না, জিজ্ঞেস করেন–কি খাওয়াইল শর্মিলাগোর বাড়িত?

গর্বে ফুলে রুনুখালা বললেন–কিচ্ছু মুহে দেয় নাই। হিন্দু বাড়ি ত, এইল্লিগা।

হিন্দু বাড়িতে আমি কিছু মুখে দিই না। কপালে কমুকুমের টিপ পরাতে চাইলে মুখ ফিরিয়ে নিই–মা’র ধারণা পবিত্র দিনে জন্মেছি বলেই আমি এমন করি। শর্মিলাদের বাড়ি থেকে ফেরার দু’চারদিন পর ফজলিখালার কাছে প্রথম কথাটি পাড়েন মা–দেখ ফজলি, অমন দিনে জন্মাইছে বইলাই তো মেয়ে আমার হিন্দু বাড়িতে খায় না, কপালে ফুটা দিতে চাই, দেয় না।

ফজলিখালা প্রায়ই হাজি বাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে চলে আসেন নানির বাড়ি। এসেই আপাদমস্তক ঢেকে রাখা বোরখাটি গা থেকে খুলে বেরিয়ে পড়েন উঠোনে, পাকঘরে ঢুকে পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখেন কি রান্না হচ্ছে বা হয়েছে, যে রান্নাই হোক, ইলিশ মাছ ভাজা বা চিতল মাছের কোপ্তা, নাক কুঁচকে ফেলেন। দেখে ধারণা হয় তিনি বিশ্রি গন্ধ পাচ্ছেন ওসব থেকে, অথবা আদৌ এসব খাবার তিনি পছন্দ করেন না। খেতে বসলে ফজলিখালার পাতে নানি দেখে শুনে ভাল পেটিটি, তলের না ওপরের না, মাঝের ভাত দেন, না পোড়া না থ্যাবড়ানো বেগুনের বড়াটি দেন। বড়ার ওপর ভাজা পেঁয়াজও দিয়ে দেন এক মুঠো। তিনি যতক্ষণ খান নাক কুঁচকেই রাখেন, যেন এ বাড়িতে এসে শ্বশুরবাড়ির চমৎকার খাবার থেকে ভীষণ বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি আর নিতান্তই ভদ্রতা করে যা তা কোনওরকম গিলছেন এখানে যেহেতু এসেই পড়েছেন আর দুপুরও গড়িয়েছে। খেতে বসে কেবল নাক কুঁচকে থাকা নয়, ফজলিখালা বলেন শাকটা কে রেঁধেছে, বালু বালু লাগে। মাংসটায় গরম মশলা দেওয়া হয়নি নাকি! মাছ ভাজায় মনে হয় তেল কম হয়েছে। এসব।

সেদিনও, যেদিন মা আমার কপালে টিপ না পরা আর হিন্দু বাড়িতে না খাওয়ার খবর শোনালেন, তিনি খেয়ে দেয়ে মুখে পান পুরে শুয়ে শুয়ে চিবোচ্ছেলেন, সেদিন ফজলিখালার আপত্তি ছিল রসুন নিয়ে, কবুতরের মাংসে নাকি রসুন কম হয়েছে। কাঁচা চারটে রসুন ফজলিখালার পাতে দিয়ে বলেছিলেন নানি দেখ তো ফজলি এহন স্বাদ লাগে কি না। –আবার পাতে রসুন দিতে গেলেন কেন মা!
ফজলিখালা শুকনো হেসে বলেন, কাঁচা রঁসুন কি আর মাংসের ঝোলে মিশবে! মাংস সিদ্ধ হয়েছে তাই তো যথেষ্ট। ক্ষুধা মেটাতে আল্লাহ বলেছেন কোনওরকম সামান্য কিছু খেলেই চলে, খাবার নিয়ে বিলাসিতা আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। নবীজিও অল্প খেতেন।

ফজলিখালার ফর্সা কপালে কোঁকড়া ক’টি চুল ঝুলে থাকে। দুর্গা প্রতিমার মত তাঁকে দেখায়। শুয়ে থাকা পান চিবোনো ফজলিখালা ঘটনাটি ফাঁস করেন ভরা ঘরে, দুপুরের পর বিছানায় শুয়ে বা বসে যারাই জিরোচ্ছিল, শোনে–বলছিলাম না, এই মেয়ে ঈমানদার হবে। দেখ, হিন্দুর বাড়িতে ও কিছু খেলো না। কপালে টিপও পরাতে দেয় না, কারণ হিন্দুরা কপালে টিপ পরে। ওকে তো কেউ শেখায়নি এসব, ও জানল কি করে! আসলে আল্লাহ ওকে জানাচ্ছেন। ছোটবেলায় ঘুমের মধ্যে ও কি যে মিষ্টি করে হাসত, ফেরেসতাদের সঙ্গে ও খেলত কি না। বড়বুর কপাল ভাল।

যে যত বলুক বড়বুর কপাল ভাল, মা ভাবেন তাঁর কপাল খারাপ। তাঁর পড়ালেখা করার শখ ছিল খুব, সম্ভব হয়নি। ভাল ছাত্রী বলে ইস্কুলে নাম ছিল। নানা চাইতেন মেয়ে বোরখা পরে ইস্কুলে যাক। মা বোরখা পরেই যেতেন, দেখে ইস্কুলের মেয়েরা মুখ টিপে হাসত। বিয়ে হয়ে গেল বলে ইস্কুল ছাড়তে হল। ইস্কুল থেকে শেষদিন বিদায় নেওয়ার দিন মাস্টাররা চুক চুক করে দুঃখ করে মা’কে বলেছিলেন তর মাথাডা ভালা আছিল, বিএ এমএ পাশ করতে পারতি। বিয়ার পর দেহিস পড়ালেখা যদি চালাইয়া যাইতে পারস। বিয়ের পর বাবার কাছে মা একটি আবদারই করলেন আমি লেখাপড়া করাম। দাদাকে ইস্কুলে পাঠিয়ে নিজেও তিনি যেতে শুরু করেছিলেন, বাবার আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল নানার। মা’র তবু লেখাপড়ার শখ যায়নি। বাবা রাজশাহী পড়তে গেলে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে মা নিজে ইস্কুলে ভর্তি হলেন। তখন দাদা পড়েন সেভেনে, জিলা ইস্কুলে। মহাকালি ইস্কুলে মাও সেভেনে। ইস্কুলে মাস্টাররা জানতেন মা’র বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে। খবরটি গোপন রাখা হল ছাত্রীদের কাছে যেন মা কোনওরকম কুণ্ঠা ছাড়াই বয়সে ছোট মেয়েদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন, এক কাতারে বসে লেখাপড়া করতে পারেন। ক্লাস সেভেনের ষৈনমাসিক পরীক্ষায় সবচেয়ে ভাল ফল করলেন তিনি। গোপন ব্যাপারটি শেষ অবদি বাড়িতে গোপন থাকেনি। খবর জেনে বার্ষিক পরীক্ষার আগে মা’কে সাফসাফ বলে দিলেন নানা, সেই আগের মতই, মাইয়া মানষের অত নেকাপড়ার দরকার নাই। ঘরে বইসা পুলাপান মানুষ কর। বাবাও রাজশাহী থেকে চিঠি লিখে ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে মা’কে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পরামর্শ দিলেন। পায়ে অদৃশ্য এক শেকল পরিয়ে দিল কেউ। মা’র স্বপ্নসাধ ভেঙে চুরমার হল আরও একবার।

মা’র বিশ্বাস হয় না তাঁর কপাল ভাল।

কপাল ভাল হলে নানাকে বেড়ালের মত পা টিপে টিপে মা’র ঘরে ঢুকে আশে পাশে কেউ আছে কি না পরখ করে পকেট থেকে বের করতে হয়েছিল কেন কাগজে মোড়ানো কৌটো! মা’র ডান হাতে কৌটোটি রেখে আঙুলগুলো বুজে দিয়েছিলেন তিনি যেন কাকপক্ষীও না দেখে! বলেছিলেন কেন জিনিসটা লুকাইয়া রাখিস, যেহেতু দেয়ালেরও কান আছে, ফিসফিস করে–আর রাইতে রাইতে মুখে মাখিস।

মা’র কালো মুখ ফর্সা করার ওষুধ দিয়ে দিয়েছিলেন নানা যেন বাবার চোখে মা অসুন্দরী না ঠেকেন যেন বাবা বউছেলেমেয়ে ফেলে আবার না কোথাও চলে যান। সেই কৌটোর ওষুধ মা রাতে রাতে মুখে মাখতেন, মুখের রং কিন্তু পাল্টাত না। চোখ আরও কোটরের ভেতরে যেতে থাকে, চোখের নিচে পড়তে থাকে কালি, নাক যেমন ভোঁতা, তেমন ভোঁতাই থেকে যায়। রূপ না থাক, গুণ তো আছে তাঁর, সেলাই জানেন, রান্না জানেন, মা নিজেকে স্বান্ত্বনা দেন। কিন্তু আদৌ কি গুণবতী তিনি! মা’র বিশ্বাস তাঁর চেয়ে নিখুঁত রান্না সেলাই অন্য অনেক মেয়েই জানে। রূপ গুণ না থাক, মা আবার নিজের কাঁধে মনে মনে চাপড় দিয়ে নিজেকেই বোঝান তিনি তো আস্ত একটি মানুষ, খোঁড়া নন, অন্ধ নন, পাগল নন। সোহেলির মা’র এক মেয়ে বদ্ধ পাগল, সত্য গোপন করে এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মেয়েকে। সে পাগল মেয়ের চেয়ে সংসারে নিশ্চয় এক ধাপ ওপরে মা, যে যত নিন্দা করুক মা’কে। মা পাগল না হলেও মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে মা’র। বাবা যখন রাজশাহী চাকরি করছিলেন, তিনি দাদাদের নানির কাছে রেখে রওনা হয়েছিলেন একা। মা’র ভয়, বাবা তাঁকে ভালবাসেন না। নানা রং ফর্সা করার ওষুধ দিলে মা’র আরও ভয় ধরে। লাল রঙের ফ্রক মা’কে আর নীল রঙের ফজলিখালাকে যখন কিনে দিতেন নানা, মা খেজুর গাছের তলে দাঁড়িয়ে কাঁদতেন একা একা, সেই ছোটবেলায়। বিয়ের পর বাবা তাঁর জন্য শাড়ি কিনতে গেলে দোকানিকে বলতেন কালো রঙের মেয়েকে মানাবে এমন শাড়ি দিতে। শাড়ি পেয়ে মা কাঁদতেন না, ভয় পেতেন। সেই ভয় মা’র কখনও যায়নি। রাজশাহির পথে যেতে যেতে বুক ফুঁড়ে সে ভয় বেরিয়ে আসে, মা সামাল দেন। কখনও এর আগে একা একা ময়মনসিংহ ছেড়ে কোথাও যাননি মা, তা যাননি, তাই বলে কেন যাবেন না আজ, তিনি স্বামীর কাছে যাচ্ছেন, তাঁর দু’ছেলের বাবার কাছে, কোনও অবৈধ পুরুষের কাছে যাচ্ছেন না, কলমা পড়ে যে লোক তাঁকে কবূল করেছেন, তাঁর কাছে, ন্যায্য দাবিতে যাচ্ছেন। বাবা বলেননি যেতে, কিন্তু তাঁর সমস্ত শরীরে মনে তিনি বাবার কাছে যাওয়ার তীব্র আকাংখা অনুভব করছেন। বাবা ড্রাম ভরে চাল আর হাতে টাকা পয়সা দিয়ে গেছেন সংসার খরচ। কিন্তু সংসারে মন বসে না মা’র। সংসারে চাল ডালই তো সব নয়! টিঙটিঙে বোকাসোকা মেয়েরও যে মন থাকে, মন উথালপাথাল করে, কে বোঝে! বাড়ির কাউকে বোঝানো যায় না এ কথা। বাবার বদলির চাকরি, সারাদেশ ঘুরে ঘুরে চাকরি করতে হয়। রাজশাহি এসে অবদি চেষ্টা করছেন আবার বদলি হয়ে যেতে ময়মনসিংহ। কিন্তু আপিসের বাবুরা তা মানেন না। এমন সময় হঠাৎ দেখেন বউ এসে হাজির। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক, মুখ শাদা হয়ে আছে পাউডারে। হাতে চামড়ার সুটকেস, সুটকেসে রঙিন শাড়ি, নানার দেওয়া রং ফর্সা হওয়ার কৌটো, আর একখানা তিব্বত পাউডারের ডিব্বা।

বাবা ভূত দেখার মত চমকে বলেছিলেন–তুমি এইখানে কেন? কেমনে আসছ? কে নিয়া আসছে?

–আসছি একলাই। মা শুকনো হেসে বলেন।

–একলা? এতদূর? কি ভাবে সম্ভব? বাচ্চারা কেমন আছে? বাবা একদমে জিজ্ঞেস করেন।

–ভালা আছে। তুমি কেমন আছ? চিঠি পত্তর দেও না। তুমি কি আমারে ভুইলা গেছ? মা’র স্বর বুজে আসে। চোখ ছলছল করে।

বাবা অস্থির পায়চারি করে ডক্টরস কোয়ার্টারের পুরোনো লোহার চেয়ারে বসে বলেন –তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হইয়া গেছে? কোলের বাচ্চা ফালাইয়া আইছ?

–বাচ্চাগোর অসুবিধা নাই। দেখার মানুষ আছে।

বলে মা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসেন বাবার দিকে।

–টাকা যা দিয়া আইছি, আছে তো! বাবা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।

–ফুরাইয়া গেছে। বাচ্চাগোর দুধ কিইনা দেন বাজান আর মিয়াভাই।

কাছে এসে বাবার চেয়ারের হাতলে হাত রেখে মা বলেন। গা থেকে তাঁর মিষ্টি সুবাস ছড়ায়।

–আমারে জানাইলে তো আমি টাকাপয়সা যা লাগে নিয়া যাইতাম! আগামীকালই টাকা নিয়া ময়মনসিং ফিরো। বাবা চেয়ার ছেড়ে ঝট করে উঠে প্যান্টের দু’পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে বলেন।

–তুমার রান্ধাবাড়া কেডা কইরা দেয়? কি খাও? শইলডা তো শুগাইয়া গেছে। বাবার পিঠে কোমল একটি হাত রাখেন মা। ভারি নরম হাত। হাতেও মিষ্টি গন্ধ। বাবার মুখে উত্তর নেই, কালো ঘন ভুরু দুটো কুঁচকে থাকে। ক্লান্ত বিরক্ত।

দু’বছরের কনডেন্সড করতে যখন বাবা আবার যান রাজশাহি, মা’কে বলেন দেইখো তুমি আবার বাচ্চাকাচ্চা ফালাইয়া কুথাও রওনা দিও না। মা কেঁদে বুক ভাসান। বাবা কেশে সাফ গলা সাফ করে বলেন–টাকা পয়সা যা লাগবে রাইখা গেলাম, চারছয়মাস পরে আইসা দিয়া যাব আরও।

যে দু’একটি চিঠিপত্র লিখতেন বাবা, তা এরকম–নোমান কামাল নাসরিন কেমন আছে? চাল ফুরাইয়া গেলে নতুন বাজারের চালের আড়ত থেকে তোমার বাবাকে পাঠাইয়া চাল কিনিয়া লইও। সদাই পাতি যা লাগে মনু মিয়ার দোকান থেকে আনাইয়া লইও। নোমান কামালের লেখাপড়ার খোঁজ খবর লইও। মন দিয়া পড়ালেখা করতে বলিও। সুলেখার মা’র কাছে যে টাকা ধার লইয়াছ তাহা আগামি মাসে পাঠাব। টাকা পয়সা বাজে খরচ করিও না। অদরকারি কোনও জিনিস কিনিও না। সাবধানে থাকিও। ইতি রজব আলী।

মা’র চিঠির ভাষা অন্যরকম। শহুরে মেয়ে, বাবার সঙ্গে বিয়ের পর পর দু’তিনটে দিলীপ কুমার মধুবালার সিনেমা দেখা মেয়ে গোটা গোটা অক্ষরে পাতা ভরে চিঠি লেখেন–প্রিয়তম, কেমন আছ? কবে আসবে তুমি? তোমাকে ছাড়া আমার ভাল লাগে না। আমি তীর বেঁধা পাখির মত ছটফট করি। তুমি আমাকে নিয়ে যাও। আমরা এক সঙ্গে আমাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে থাকব। তুমি রাজশাহি থেকে বড় ডাক্তার হয়ে ফিরবে। আমি কত মানুষকে যে বলি, গর্বে আমার বুক ভরে যায়। আমি তোমার যোগ্য নই জানি। তোমার মত জ্ঞান, বুদ্ধি আমার নেই। আমার কিছু না থাক, আমার তো তুমি আছ। তুমিই আমার সুখ। আমার শান্তি। এই পৃথিবীতে আমি আর অন্য কিছু চাই না।

উত্তরে বাবা লেখেন–প্রতিদিন দুই আড়াই টাকার বেশী বাজার করিও না। টাকা শেষ হইয়া গেলে মনু মিয়ার দোকান হতে বাকিতে জিনিস কিনিও। ছেলে মেয়ের যত্ন লইও। যাহা যাহা সদাই করিবে, জমা খরচের খাতায় লিখিয়া রাখিবে।

মা খাতায় লিখে রাখেন না, ইচ্ছে হয় না। আঁচলের খুঁটে পয়সা বেঁধে রাখেন, ছেলেমেয়েরা চানাচুর খেতে চায়, মালাই আইসক্রিম খেতে চায়, খুঁট থেকে পয়সা খুলে ওদের দেন। সকালে দাদাকে পাঠিয়ে ঠান্ডার বাপের দোকান থেকে গরম ডালপুরি কিনে আনেন, তা দিয়ে নাস্তা হয়। কোনওদিন সর্ষের তেল থাকে তো নুন থাকে না, নানির কাছ থেকে ধার করে রান্না চলে। কোনওদিন হারিকেনে সলতে থাকে তো কেরোসিন ফুরিয়ে যায়। সুলেখার মা’র কাছ থেকে ধার করে সে রাত চালিয়ে দেন। কোনওদিন ছোটদা টাকা হাতে বাজারে বেরোন, ফেরেন না ফেরেন না, চুলোয় আগুন ধরানো হয় না। হাশেম মামা তিন রাস্তার মোড় থেকে ধরে আনেন ছোটদাকে, কি, রাস্তায় বসেছিল, কেন, বাজারের টাকা নেই, কেন নেই, ফালতু কাগজ মনে করে পকেটের টাকা ফেলে দিয়েছে। দু’বছর পর রাজশাহি থেকে বড় পাশ দিয়ে বাবা ময়মনসিংহে ফিরে আসার পর বাড়ির সবার সঙ্গে বাবার দূরত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। আমার বয়স তখন দুয়ে দুয়ে চার। আমি তাঁর কাছ ঘেঁসি না আগের মত আর। মা’র সঙ্গে বাবার সম্পর্ক গড়ে ওঠে চাল ডালের, আনাজপাতির। মাও ধীরে ধীরে মুখে স্নো পাউডার মাখা কমিয়ে দিয়ে বাবার হাতে লিস্টি দিতে শুরু করেন সরিষার তেল তিন ছটাক, পিঁয়াজ এক সের, লবণ দেড় পোয়া, মশুরির ডাল আধা সের। বাবা লিস্টি পড়ে থলে ভরে সদাই কিনে বাড়ি নিয়ে আসেন। মা রান্না করে বাবাকে খাবার বেড়ে দেন দুপুরে, রাতের খাবার থালা উপুড় করে ঢেকে রাখেন। রাতে ঘরে ফিরে কুয়োর তোলা জলে হাত মুখ ধুয়ে, খেয়ে ঢেকুর তুলে বিছানায় শুয়ে পড়েন বাবা। বাবা ক্লান্ত বিরক্ত। তাঁর কাঁধে কেবল বউবাচ্চার দায়িত্ব নয়, মাদারিনগর বলে এক গ্রামের গরিব কৃষকের ছেলে তিনি, তা তিনি ভোলেন না। জাফর আলী সরকার মরে যাওয়ার পর বাবার ছোট দু’ভাই রিয়াজউদ্দিন আর ঈমান আলীকে পাঠশালায় পাঠানোর উৎসাহ কেউ দেখাননি। বড়দাদা ওঁদের ঢুকিয়ে দিয়েছেন হালচাষের কাজে। বাবার ইচ্ছে অন্তত বাকি ভাইদের লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব তিনিই নেবেন, তিনিই হবেন সংসারের জাফর আলী সরকার। আমানুদ্দৌলা আর মতিন মিয়াকে শহরে এনে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন খেলা করে বাবার মনে। মাদারিনগরের জন্যও তাঁর স্বপ্ন অনেক, অন্তত সে স্বপ্ন তৈরি করেন সবুজ লুঙ্গি আর রাবারের জুতো পরে প্রায়ই শহুরে ভাইএর কাছে চলে আসা রিয়াজুদ্দিন, ঈমান আলী।

পুস্কুনির উত্তরের জমিডা কিইনা লইলে ভালা হয় ভাইসাব, খুশির বাপে জমি বেচতাছে। এইডা এহন না কিনলে জমির মুন্সি ঠিহই কিইনা লইব।

বাজান কইছে বলদ আরও দুইজোড়া কিইনা লইলে চাষের সুবিধা।

গরু চড়াতে গিয়ে দিগন্ত অবদি যে জমি দেখতেন, তিনি এ বয়সে মনে মনে বালক হয়ে সবুজ সেসব ধানক্ষেতে ছুটে বেড়ান। রিয়াজউদ্দিনের হাতে কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে বলেন–ঠিক আছে, কিইনা ল।

মা’র চোখ এড়ায় না বাবার উদার হস্ত।

জমি কিনতে টাকা দেওয়ার পরই তিনি লম্বা লিস্টি তৈরি করে বাবাকে দেন

১.দুইটা ঘরে পরার শাড়ি, ২.শায়া (শাদা) ৩. ব্লাউজ (লাল) ৪. এক জোড়া সেন্ডেল (বাটা) ৫.কানের দুল(ঝুমকা) ৬.কাচের চুড়ি(রেশমি) ৭.গায়ের সাবান। ৮.জবা কুসুম তেল। ৯.কাপড় ধোয়ার ৫৭০ সাবান। ১০. সোডা।

লিস্টি পেয়ে কী ব্যাপার, দুইমাস আগে না শাড়ি কিইনা দিলাম! চোখ কপালে তুলে বলেন বাবা।

মা ঠান্ডা গলায় বলেন–ছিঁইড়া গেছে। এক কাপড় পইরা রান্ধাবাড়া, ধোয়া পাকলা, বাড়ির বেবাক কাম, আর কত! শাড়ি তো আর চটে বানানি না।

–কই দেখি, কই ছিঁড়ছে! বাবা ভুরু কুঁচকে বলেন।

মা দু’আঙুল ছেঁড়া শাড়িকে এক টানে দু’হাত লম্বা করে ছিঁড়ে এনে বাবাকে দেখিয়েছিলেন। মা’র চোখ পাথরের মত স্থির। এক থোকা কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার ভেতর আটকে ছিল।

–সেইদিন না নারিকেল তেল কিনলাম, শেষ হইয়া গেল? বাবা জেরা করেন।

–সেইডা ত কবেই শেষ। মা বলেন।

চোখের চশমা একটানে খুলে বাবা বলেন–কই শিশি কই, শিশিডা আনো।

–শিশি ফালাইয়া দিছি। মা’র উদাসীন স্বর।

বাবা চোখে আবার চশমা লাগিয়ে লিস্টির দিকে তাকিয়ে বলেন–কাপড় ধোয়ার সাবান কিননের লাইগা এই নেও এক টেকা রাখো। বাকি জিনিসের দরকার নাই। বাবা একটি টাকা রেখে গিয়েছিলেন টেবিলে। মা সেই টাকা ছোঁননি। টেবিলে পড়েই ছিল। টাকাটির দিকে তাকালে সংসারে নিজেকে বড় অপাংতেয় মনে হত মা’র।

মা’র তাই বিশ্বাস হয় না তাঁর কপাল ভাল। বারোই রবিউল আওয়াল তারিখে মেয়ে জন্মে তাঁর কপাল আর কতটুকু ফিরিয়েছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন–আমার কপালের কথা কইস না ফজলি। কপালে আমার সুখ নাই।

ফজলিখালা মা’র হাতের পিঠে হাত রেখে বলেন–আল্লাহর নাম লও। দেখবে মনে শান্তি আসছে। দুলাভাইরে বল নামাজ পড়তে।

ফজলিখালার ফর্সা হাতের দিকে তাকিয়ে মা বলেন–তর দুলাভাই উঠতে বইতে আমারে কালা পেঁচি কয়। হে আল্লাহর নাম লইলে কি আমার কালা রঙ শাদা হইব!

–বড়বু, ফজলিখালা দ্রুত তাঁর ভারি শরীরখানাকে তুলে যেন শাসন করছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন–রঙ আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ যা দিয়েছেন আমাদের তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

খরনদীতে মা খড়কুটো পেলেন একটি ধরার। রঙ আল্লাহর দান। কালো রঙকে নাক সিঁটকেলে আল্লাহকেই নাক সিঁটকোনো হয়।

আমার দুয়ে দুয়ে চার চলছে তখনও, পর পর দুটো ভ্রুণ ঝরে পড়ার পর মা আবার পোঁয়াতি হন। বাবা বদলি হন ঈশ্বরগঞ্জ। বাক্সপেটরা গুছিয়ে বাবার সঙ্গে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঈশ্বরগঞ্জ রওনা হলেন মা। নানি তখন সবে ছটকুর জন্ম দিয়েছেন। মা মেয়ে এ বাড়িতে প্রায় একই সময় পোয়াতি হন।

ঈশ্বরগঞ্জে বাবাকে একটি জিপ দেওয়া হল হাসপাতাল থেকে। জিপে করে দাদাদের ইস্কুলে দিয়ে বাবা কাজে যান। আমার তখনও ইস্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। বাড়িতে বসে মা’র কাছে যুক্তাক্ষর শিখি।

মা’র প্রসবের আগে আগে বাবা জিপে করে ময়মনসিংহ গিয়ে ঝুনু খালাকে নিয়ে এলেন ঈশ্বরগঞ্জ। ইস্ত্রি করা পাজামা জামা আর ওড়না পরে একখানা সুটকেস নিয়ে বাড়িতে নামলেন ঝুনু খালা। কী আনন্দ সেদিন তাঁর! দাদাদের নিয়ে তিনি গপ্পে বসে গেলেন, যেন ছ’মাসে এত কিছু ঘটে গেছে ছ’বছরেও গপ্প ফুরোবে না। ঝুনুখালাকে পড়াতে এক নতুন মাস্টার আসেন, সেই মাস্টার কি করে বোয়াল মাছের মত হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন ঝুনুখালার দিকে, তারই বর্ণনা করেন তিনি অর্ধেক রাত অবদি। নতুন মাস্টারের নাম রাসু। ঈশ্বরগঞ্জে আমাদের বড় দালানবাড়িটি ঝুনুখালা এসে সাজিয়ে গুজিয়ে চমৎকার বানিয়ে ফেললেন। বাবা দেখে বললেন–তুমার বইনরে শিখাইয়া দিয়া যাইও ঘরদোর কি কইরা গুছাইতে হয়। শুনে মা তেতো হেসে বলেন–আমার কোনও কামই তার পছন্দ হয় না। কয়না যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।

বাবা ঝুনুখালাকে টেনে কোলে বসিয়ে পেটে কাতুকুতু দিয়ে বলেন–এই তুই ত দিনে দিনে সুন্দর হইতাছস। তরে যে বেটা বিয়া করব কপাল ভাল তার।

ঝুনুখালা ওড়নায় মুখ ঢেকে বাবার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ান। কান নাক লাল হয়ে থাকে তাঁর শরমে। বাবা ফজলিখালার সঙ্গে আরও সরস হতেন, তাঁকে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলতেন– এই যে সুন্দরী, আমার কাছে এট্টু আয় ত, প্রাণডা জুড়াক। জানডা কোরবান কইরা দিতে ইচ্ছা করে তর লাইগা।

ফজলিখালা হাসতে হাসতে বলতেন—খালি ফাজলামি করেন দুলাভাই। শালিদের সঙ্গে এমন ঠাট্টা, বুক টিপে দেওয়া পেটে কাতুকুতু এসব, দুলাভাইদের জন্য হালাল। কথাও যৌনরসে ভিজিয়ে তোলা, কেউ আপত্তি করে না। মা’র তবু মনে হয় বাবা সীমা ছাড়িয়ে যান। রং ফর্সা দেখলে বাবা শালি কি চাকলাদারের বউ কারও গা ছাড়েন না।

ঝুনুখালা আসার ছ’দিন পর মা’র ব্যথা উঠল। খবর পেয়ে দুপুরে হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি ব্যাগ আর একজন নার্স সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে বাবা বললেন এইবার একটা ছেলে চাই আমি। মা’র চিৎকারে আর ডেটলের গন্ধে তখন সারা বাড়ি সয়লাব। মা’র ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট এক ছিদ্রে চোখ রেখে ঝুনুখালা মুখে কাপড় গুঁজে হাসছিলেন আর আর পেছনে দাঁড়িয়ে আমি ও ঝুনুখালা বাচ্চা কেমনে হয়! জিজ্ঞেস করছিলাম। উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করছিল আমার। ঝুনুখালা ছিদ্র থেকে চোখ সরিয়ে বারবারই হাসতে হাসতে লাল হয়ে যাচ্ছিলেন আর আমাকে বলছিলেন বাচ্চা কেমনে হয়, এইডা তরে কওন যাইব না।

ঝুনুখালার হাসি তখনও কমেনি, বাচ্চার কান্নার শব্দ এল। দরজার ছিদ্র আমি নাগাল পাই না বলে ঝুনুখালা আমাকে দু’হাতে উঁচু করে ধরলেন দেখতে। ছিদ্রে চোখ রেখে দেখলাম বাবার হাতে গ্লাবস পরা, গ্লাবসে রক্ত, নার্স বাচ্চাকে গামলার জলে ডুবিয়ে ধুচ্ছেন। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। দেখে আমার গা কেঁপে ওঠে ভয়ে। এত ছুরি কাঁচি নিয়ে বাবা কি মা’র পেট কেটে ফেলেছেন! রক্ত বেরোচ্ছে মা’র কাটা পেট থেকে!মা ব্যথায় কঁকাচ্ছেন! ঝুনুখালা নানির পাঠানো ছোট ছোট কাঁথা হাতে অপেক্ষা করছিলেন বাচ্চা কোলে নিতে। বাবা দরজা খুলে বেরোতেই ঝুনুখালা লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলেন–কি হইছে দুলাভাই? ছেলে না মেয়ে?

বাবা বললেন–যেইটা চাইছিলাম হইল না। মেয়ে হইছে।

–ফর্সা না কালা? ঝুনুখালা জিজ্ঞেস করেন।

–কি আবার, বাবা মুখ ঝামটে বললেন–কালা মায়ের মেয়ে কালা হইব না তো শাদা হইব!

–হাসপাতালে কাজ ফালাইয়া আইছি, আমি গেলাম। বলে বাবা চলে গেলেন। বাবা চলে গেলে আমরা বাচ্চাকে কাঁথা দিয়ে মুড়ে কোলে নিই। গায়ে সর্ষের তেল মেখে শুইয়ে রাখি বিছানায়। ছোট বালিশে মাথা, ছোট কাঁথায় শরীর, ছোট মশারি খেটে মাথার কাছে রেখে নৌকোর মত দেখতে দুধের ফিডার, বসে থাকি। ঝুনুখালাও। মা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন। দাদা আর ছোটদা ইস্কুল থেকে ফিরে বাচ্চাকে চোখ গোল করে দেখেন।

রাতে বাবা ফিরে এলে ঝুনুখালা ভাত তরকারি বেড়ে দেন, খেয়ে শুয়ে পড়েন। বাচ্চা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কেঁদে উঠলে চেঁচিয়ে বলেন–এই চুপ থাকো ত সবাই। আমারে ঘুমাইতে দেও! ঝুনুখালা শুনতে না পায় কেউ, এমন গলায় না না কাঁদে না বলে বলে বাচ্চার কাঁথা বদলে দেন, মুখে পানি নয়ত দুধ দেন। আমি শুয়ে শুয়ে বিমর্ষ বাড়িটির শব্দ শুনি। বাবার জন্য, মা’র জন্য, বাচ্চার জন্য, ঝুনুখালার জন্য আমার মায়া হতে থাকে। ঈশ্বরগঞ্জ থেকে আবার বদলি হয়ে ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ থেকে ঠাকুরগাঁ। ঠাকুরগাঁ থেকে আবার ময়মনসিংহ। দেড় বছরের মধ্যে বদলির ঘোরাঘুরি শেষে আবার সেই পুরোনো বাড়িতে থিতু হই। জন্মের চেনা বাড়ি। বাবা বলে দেন দাদাদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে, এরপর থেকে বদলি হলে বাবা একাই যাবেন, আর বউছেলেমেয়ে নিয়ে নয়। আমি অনেকটা লম্বা হয়ে গেছি। বাড়িতে বলাবলি হচ্ছে আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করাতে হবে। মা ইয়াসমিনকে, আমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাবা নাম রেখেছেন ইয়াসমিন, দুধ খাওয়ান, গোসল করান, গায়ে সর্ষের তেল মেখে শুইয়ে রাখেন রোদে। সন্ধে হলে আমাকে টেবিল চেয়ারে বসে হারিকেনের আলোয় পড়াতে বসান দাদা। আমি ততদিনে অনর্গল পড়ে যেতে পারি ছড়া কবিতা। ছোট ছোট গল্প। ছোটদের রবীন্দ্রনাথ। দাদা মাস্টারি করলে আমার সব গোল বেঁধে যায়।

ক রবীন্দ্রনাথের কত সনে জন্ম?

বানান কর–মুহূর্ত।

কাজলা দিদি কবিতা কার লেখা?

দাদার প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় হয় আমার। কখন আবার কি ভুল বলি, চটাশ করে চড় দেবেন গালে নয়ত সারা বাড়ির লোক ডেকে আমার পড়া শুনিয়ে হাসবেন। ঈশ্বরগঞ্জ যাওয়ার আগে, একদিন শখের মাস্টারি করতে বসে দাদা বলেছিলেন বানান কইরা কইরা পড়। তখন স্বরে অ স্বরে আ ছেড়ে যুক্তাক্তর ধরেছি। অক্ষরের চেয়ে বেশি দেখি ছবি। দাদার আদেশে কত ছবি কত কথা বইটি নিয়ে অক্ষরে আঙুল রেখে বলেছিলাম হ, লয় হ্রস্য উকার দ।

দাদা বললেন–কি হইল, ক।

ছবির দিকে তাকিয়ে দেখি, আদার ছবি। বলি আদা।

–কয় ওইকার, ছবি দেখে নিশ্চিন্তে বলেছিলাম–মাছ।

আমার তের বছর বয়সের শিক্ষক মা’কে ডাকেন, রুনু খালা, ঝুনু খালা, নানি, হাশেমমামা, টুটমামা সবাইকে ডেকে শীতলপাটির চারদিকে বসালেন। বললেন–শুন সবাই, ও কেমনে পড়ে। পড় দেখি এইবার।

আমি বুঝে পাচ্ছিলাম না আমার সামান্য পড়া দেখাতে এত সবাইকে ডাকার মানে কি! বোধ হতে থাকে খুব ভাল পড়েছি বলে আমাকে বাহবা দিতে এসেছেন ওঁরা। চমৎকার পড়তে পারলে আমাকে কোলে নিয়ে নাচবেন রুনু খালা, টুটুমামা লজেন্স দেবেন খেতে, নানি গাছের বড় পেয়ারাটি পেড়ে হাতে দেবেন। শুদ্ধ উচ্চারণে পড়ি, অক্ষরে আঙুল রেখে–হ, লয় হ্রস্যউকার,দ; এবার ছবির দিকে তাকিয়ে, আদা। ঘরে হুল্লোড় পড়ে হাসির। ঝুনু খালা হাসতে হাসতে মেঝেয় বসে পড়েন, তাঁর ওড়না খসে পড়ে গা থেকে। রুনু খালা হি হি হি হি। দাদা আর টুটুমামা হা হা হা। নানি আর মাও সশব্দে হেসে ওঠেন। আমি সকলের মুখের দিকে তাকাই, আমার মুখেও হাসি ফোটে, হাসি সংক্রামক কি না। সংসারের ছোটখাট এক রঙ্গমঞ্চে আমি একাই অভিনেষনী, আর সবাই দর্শক শ্রোতা। নানি হাসতে হাসতে আমাকে বলেন–হ লয়হ্রস্রউকার দ, হলুদ। হলুদের আর আদার ছবি দেখতে এক রকম বইলা তর কি হলুদরে আদা পড়তে হইব! ছবি আমার মনে গাঁথা, শব্দ নিয়ে আদৌ মাথা ব্যথা নেই। আসলে আমি ছবি পড়ি, শব্দ নয়। অক্ষর আঁকার আগে এঁকেছি গাছ, ফুল, নদী, নৌকো।

ঠাকুরগাঁয়ের পিটি আই ইস্কুল আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন ছোটদা, কোলে করে নিয়ে ঠেসে বসিয়ে এসেছিলেন ক্লাসঘরে। সে কী চিৎকার আমার! মাস্টার তাঁর কোলে বসিয়ে আমার কান্না থামাতে গান গেয়েছিলেন সেদিন, খৈয়া খৈয়া চাঁদ খুলা আসমান। কান্না থামলে আমাকে আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বসিয়ে দিয়ে মাস্টার বলেছিলেন– খোকা, খুকি, একটা কলস এঁকে দেখাও তো।

দিব্যি দু’তিন টানে কলস একেঁ ফেলি। কলসের গলায় মালা পরিয়ে দিই ফুলপাতার। ছেলে মেয়েরা নিজেদের আঁকা থামিয়ে আমার কলসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। পিটিআই ইস্কুলে সেই প্রথম দিনই নাম হয়ে যায় আমার। মাস্টার দু’হাতে আমার কোমর ধরে উঁচু করে তুলে বলেছিলেন–এই খুকিকে দেখ, এ খুব বড় শিল্পী হবে একদিন।

পড়াতে বসে দাদা বললেন চল চল কবিতাটা মুখস্ত ক।

–চল চল চল
উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,
নিম্নে উতলা ধরণী তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চলরে চলরে চল।

এটুকু অবদি বলতেই প্রশ্ন অরুণ অর্থ কি?

আমি মুখ বুজে থাকি। দাদা কাঠের পেনসিল দিয়ে আমার আঙুলে জোরে টোকা মেরে মেরে বলতে লাগলেন–বান্দরের মত খালি মুখস্ত করলেই হইব? অর্থ না জাইনা! দাদার মাস্টারির শখ যেদিন হয়, সেদিন পেনসিলের ঠোকর, গালে চড়, পিঠে ঘুসি এসবেই আমার সন্ধে পার হয় যতক্ষণ না মা রাতের খাবার খেতে ডাকেন। বাকি সন্ধেগুলো নানির ঘরের উঠোনে পাটি বিছিয়ে টুটু মামা, শরাফ মামা, ফেলু মামার সঙ্গে এক সারিতে বসে পাঠশালার ছাত্রদের মত শব্দ করে পড়তে হয়। শব্দ করে, যেন ঘর থেকে বড়রা শুনতে পান পড়ছি। এক হারিকেনের আলোয় দু’জন করে, দুলে দুলে। শরাফ মামা আর আমি শব্দ করে ছড়া পড়তে থাকি, ফেলু মামা তখনও মা কলম কলায়। তুফান আসিল প্রচন্ড বেগে। টিনের চাল উড়িয়া যাইতে লাগিল বাতাসে। গাছপালা গুড়িসুদ্ধ উপুড় হইয়া পড়িল। মানুষ আছাড় খাইয়া পড়িতে লাগিল পড়ে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবদি হাসে টুটু মামার। ফেলু মামা আর শরাফ মামাও হেসে কুটি কুটি। তুফান এলে টিনের চাল উড়ে গেলে, মানুষ আছাড় খেয়ে পড়তে থাকলে দুঃখের বদলে ওঁদের হাসি কেন আসে আমি ঠিক বুঝে পাই না। হাসি শুনে নানি ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলেন–পড়তে বইয়া হাসি কিয়ের! টুটু মামার এই নিয়ম, প্রতিরাতে একবার করে তুফানের গল্পটি না পড়লে তাঁর চলে না। রাত আটটায় পাকঘরে ডাক পড়ে আমাদের। পিঁড়িতে বসে মাছ ডাল যা দিয়েই ভাত খাওয়া হোক, শেষে কবজি ডুবিয়ে দুধ নিতে হয় পাতে। মা বাবার সঙ্গে এক খাটে ইয়াসমিন ঘুমোয় বলে জায়গার অভাবে নানির চৌচালা ঘরে পাশাপাশি তিনটে খাটে পাতা লম্বা বিছানায় শরাফ মামা ফেলু মামা, নানা, নানির সঙ্গে ঘুমোতে হয় আমাকে।

ঠাকুরগাঁ থেকে ফেরার দু’মাস পর নানা আমাদের, শরাফ মামা, আমাকে আর ফেলুমামাকে ভর্তি করে দেন রাজবাড়ি ইস্কুলে। আমি আর শরাফ মামা টুতে, ফেলুমামা ওয়ানে। ইস্কুলে যাওয়ার জন্য কালো তিনটে ছাতাও কিনে দেন নানা। শাদা কালিতে যার যার নাম লিখিয়ে আনেন ছাতায়। সকালে ঘি চিনি মাখা ভাত খেয়ে রওনা হই, হেঁটে, ছাতা মাথায়। দুপুরে ইস্কুলে টিফিন খেতে দেয়। বিকেলে ফিরে এসে ভাত খেয়ে খেলতে যেতে হয় বাড়ির লাগোয়া মাঠে। খেলে সন্ধের মুখে গায়ের ধুলোবালি ঝেড়ে কলপাড়ে হাত মুখ ধুয়ে হারিকেন জ্বেলে পড়তে বসতে হয়। আমার জীবন দু’আঙিনায় কাটে, নানির বাড়ির আর আমাদের বাড়ির। দু’ঘরে আমার বই পত্তর, জামাজুতো, কোনওদিন এ ঘরে খাওয়া, কোনওদিন ও ঘরে। সুখ দুঃখ দুইই তখন ঘন ঘন আসে আর যায়, যেন এরা পাশের বাড়ি থাকে। ইস্কুলে যাওয়া শুরু করা অবদি আমি লক্ষ করি টিফিনে টিনের রঙিন থালা পেলে মনে আমার সারাদিন সুখ থাকে। ফুল ফল আঁকা কিছু থালা আছে, আছে কিছু শাদা থালাও। টিফিনের ঘন্টা পড়লে ক্লাসের একজন সবার সামনে থালা রেখে যায়, পরে দপ্তরি এসে থালার ওপর এক এক করে টিফিন দিয়ে যায় কখনও কলা ডিম রুটি, কখনও খিচুড়ি। পপি, ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসা ভাল ছাত্রী, দিব্যি ছবিআঁকা থালা বেছে নেয় নিজের জন্য। পপির মা খালা আবার ইস্কুলের মাস্টার। সে যতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করে, তা পেছনের বেঞ্চে মাথা নুয়ে বসে থাকা ক্যাবলাকান্ত আমার সাধ্য নেই করি। কখনও কখনও কারও হাত ফসকে আমার ভাগে ছবির থালা পড়ে। চোখ পড়ে থাকে থালার ছবিতে, খাবারে নয়।

রাজবাড়ি ইস্কুল ছিল একসময় শশিকান্ত রাজার বাড়ি। সে বাড়ি থেকে রাজা গেল, রাণী গেল, রাজপুত্র রাজকন্যা সব গেল, টেবিল চেয়ার বসিয়ে বিশাল খালি বাড়িটিতে বেঞ্চ আর টুল পেতে খোলা হল ইস্কুল। পুরোনো বটগাছে ঘেরা বাড়ি, বাড়ির সামনে মীরাবাঈএর নগ্ন শাদা মূর্তি। ভেতরে হাঁসের চোখের মত কালো জলের এক পুকুর, পুকুরে শ্বেত পাথরে বাঁধানো ঘাট। বাড়িটির সিঁড়ি নেমে গেছে বাগানে অনেকদূর অবদি। লম্বা দারোয়ানও তাঁর লাঠিখানা ছোঁয়াতে পারে না এমন উঁচু দরজার মাথা, সিলিং তো সিলিং নয়, যেন আকাশ, জানালায় রঙবেরঙের কাচ, ছবি আঁকা। ইস্কুলে ঢুকলে নিজেকে আমার রাজা রাজা মনে হত। ও পর্যন্তই। ক্লাসঘরে গিয়ে দাঁড়ালে একঘর ছেলেমেয়ের মধ্যে আমি একা, বোকা। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে শুনিয়ে গলা ছেড়ে ছড়া বলতে পারি না, ভয়ে শরমে আমার মাথা মাটির দিকে ঝুঁকে থাকে, গলা দিয়ে মিনমিন শব্দ বেরোয় অর্থহীন। মাথায় ডাস্টার মেরে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পেছনের বেঞ্চে। ইস্কুলে আমার নাম হয় না, নাম হয় পরীর মত সুন্দর দেখতে মেয়ে পপির। ড্রইং ক্লাসে হাতির ছবি, ঘোড়ার ছবি, নদী নৌকোর ছবি আঁকতে গেলে হাত কাঁপে আমার। পপি যা আঁকে, তাতেই নম্বর পায় একশয় একশ। আমি ইস্কুলের দুষ্টু ছেলে শরাফের ভাগ্নে। শরাফ আর নাসিমের দু’হাত পেছনে বেঁধে, দু’চোখে কালো পট্টি বেঁধে পেটানো হয়েছিল এক বিকেলে ইস্কুল ছুটির পর। ঘটনা এরকম, নাসিম তার বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে শরাফকে দিয়েছে, আর শরাফ নাসিমকে দিয়েছে চুম্বক। সিঁড়িতে ওদের দাঁড় করিয়ে যেদিন সন্ধিবেত দিয়ে সপাং সপাং পেটানো হল, আমি আর ফেলু মামা ইস্কুলের আর সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে বাগানে দাঁড়িয়ে মুখ চুন করে দেখেছি। দু’জন একা বাড়ি ফিরেছি সেদিন। শরাফ মামাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল ইস্কুলে। সন্ধেয় বেদম মার খেয়ে পড়ে থাকা শরাফ মামাকে বাড়ি ফেরত এনে ঘরের থামের সঙ্গে বেঁধে আরেক দফা পিটিয়েছিলেন নানা।

ইস্কুলের মেয়েরা বইএর ভেতর ফার্ন পাতা ভরে রাখে। ফার্ন পাতাকে ওরা বলে বিদ্যা পাতা। বিদ্যা পাতা বইয়ে রাখলে নাকি ভাল বিদ্যা হয়। আমিও বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যা পাতা ভরে রাখি তবু বোর্ডে অঙ্ক কষার ডাক পড়লে বা ছড়া বলতে গেলে, মাথা মাটির দিকে ঝুঁকে যায়, ছড়া ঝরে পড়ে মাথা থেকে মাটিতে, ধুলোয়।

আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
চিকচিক করে বালি কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।

এত জানা ছড়াটির একটি শব্দও আমার মনে থাকে না, মনে কেবল ছবি, নদীর ছবি, নদী পার হচ্ছে এক ঝাঁক রাখাল। মনে মনে বলি আহা আমাকে যদি ছড়াটির ছবি আঁকতে দিত! পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে ওঠে মাস্টারের কানমলা খেয়ে শব্দহীন দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখে। খেলার ঘন্টা বাজলে ওরা দৌড়ে যায় দলবেঁধে মাঠে, খেলে। আমাকে কেউ খেলায় নেয় না। রাজবাড়ির সিঁড়ির এককোণে আমি বসে থাকি, জড়সড়, একা। ইস্কুলের সবার সঙ্গে যেন আমার আড়ি। কেউ তাই কথা বলে না, কেউ ফিরে তাকায় না।

আমি নিজেকেই নিজে আড়ি দিই

আড়ি আড়ি আড়ি,
কাল যাব বাড়ি
পরশু যাব ঘর
কি করবি কর।

একা আমি বাড়ি ভর্তি লোকের মধ্যেও। শরাফ মামারা আমাকে খেলায় নেন তখনই, যখন ভাল খেলে এমন কাউকে হাতের কাছে না পান। ওঁদের সঙ্গে দৌড়ে মার্বেল খেলায় লাটিম খেলায় চ্যাড়া খেলায় আমি কিছুতে পেরে উঠি না। ওঁরা গাছে ওঠেন, সাঁতার কাটেন, আমি খেজুর গাছের তলে দাঁড়িয়ে ওঁদের হৈ হৈ আনন্দ দেখি। দাদা এখন আর ক্রিকেট খেলেন না মাঠে, তাঁর নতুন এক বাতিক হয়েছে ছবি তোলা। এক বন্ধুর কাছ থেকে ক্যামেরা ধার করে নদীর ধারে, পার্কে, টেডি প্যান্ট, টেডি জুতো পরে নানা কায়দার ছবি তোলেন আর নিজে হাতে কাগজ কেটে অ্যালবাম বানিয়ে সে সব ছবি সাঁটেন অ্যালবামে। অ্যালবাম দাদা দেখতে দেন দূর থেকে, ছুঁতে দেন না। সকলে ব্যস্ত যার যার খেলায়। সন্ধেবেলা ত্যানায় বালু মেখে হারিকেনের চিমনি মুছে, সলতেয় আগুন ধরিয়ে ঘরে ঘরে রেখে আসার কাজ জোটে আমার, আসলে কাজটি আমি শখ করেই নিই। হারিকেন বাহুতে ঝুলিয়ে, যেন আইসক্রিমঅলা আমি, ঘর থেকে ঘরে যেতে যেতে ডাক ছাড়ি হেই মালাইআইসক্রিম!

রুনু খালা থামান আমাকে প্রথম, এই আইসক্রিম এদিকে আয়। এই নে পয়সা, দুইপয়সা দামের একটা আইসক্রিম দে।

আমার কী যে আনন্দ হয় কেউ ডাকলে! আমি মিছিমিছি পয়সা নিয়ে হারিকেনের মাথা মিছিমিছি খুলে আইসক্রিম বার করে দিই। এ আমার একার খেলা, হার নেই, জিৎ নেই। আমার এই খেলায় ফেলু মামা শরাফ মামা কেউই মজা পান না। বরং টিপ্পনি কেটে বলেন, তুই বরং ছটকুর সাথে খেল। ছটকুর তখন আড়াই বছর বয়স।

আমি বড় হতে থাকি মিছিমিছি। আমার বুদ্ধি হয় না, জ্ঞান হয় না। অন্যের সামনে ছড়া বলতে গেলে ছড়া ঝরে যায় মাথা থেকে মাটিতে। শরাফ মামা ফেলু মামা চোর চোর খেলা ছেড়ে ফুটবল খেলেন, ক্রিকেট খেলেন, আমি তখনও কড়ই গাছের তলায় ছটকুদের সঙ্গে চোর চোরে। আমি তখনও হারিকেনের ওপর গোল করে কাগজ ছিঁড়ে রুটি ভাজার মত কাগজ ভাজি। নামতা রেখার বদলে কাগজ ভরে রঙ পেনসিলে ছবি আঁকি। শনের ঘর, ঘরের পেছনে কলা গাছ, কলা গাছের পেছনে আকাশ, আকাশে পাখি উড়ছে, পাখির পেছনে লাল সূর্য, ঘরের কিনার ঘেঁসে চলে গেছে নদী, নদীতে নৌকো, নৌকোর গলুইয়ে বসা মাঝি, কলস কাঁখে নদীতে জল আনতে যাচ্ছে লাল টুকটুক শাড়ি পরা এক বউ।

বারোই রবিউল আওয়ালে জন্ম হওয়া মেয়ের এত ছবি আঁকায় মন কেন বুঝে পান না ফজলি খালা। আমাকে মানুষের ছবি আঁকতে দেখে তিনি বলেন এত পবিত্র দিনে জন্ম হয়েছে, মানুষের ছবি আঁকিস কেন! মানুষের কি প্রাণ দিতে পারবি! মানুষের ছবি আঁকলে আবার প্রাণ দেওয়ার দরকার কি আমি বুঝে পাই না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি ফজলিখালার অপ্রসন্ন মুখে।

নিষিদ্ধ কাজে কেবল আমি নই, মা’ও মাতেন। বাবার শার্টের বুক পকেটে আবার রাজিয়া বেগমের চিঠি পাওয়ার পর মা’র পাগল পাগল লাগে। খাওয়া দাওয়া গোসল সব ভুলে গেলেন, চুলে তেল দেন না, বাঁধেন না, শাড়ির আঁচল খুলে মাটিতে গড়ায়। সংসার চুলোয় ফেলে মা দুয়োর বন্ধ করেন ঘরের। মা’র এমন দুঃসময়ে সোহেলির মা এসে একদিন সারাদিন ঘরে বইসা স্বামীর লাইগা কানলে তুমি মরবা। চল, মনডা অন্যদিকে ফিরাও বলে মা’কে শাড়ি পরিয়ে, মা’র চুল আঁচড়ে নিয়ে গেলেন অলকা হলে সিনেমা দেখাতে। প্রথম প্রথম সোহিলির মা, এরপর আর কারও জন্য অপেক্ষা নয়, মা নিজেই রিক্সা করে অলকা হলে চলে যান। ভিড়ে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটেন। হলের ভেতরে বসে বাদাম চিবোতে চিবোতে ছবি দেখেন। কালো কুৎসিত মা, এলোমেলো, আলুথালু শাড়ি পরা, সস্তা সেন্ডেল পায়ে মা। মা’র আর শাড়ি গয়নায় মন নেই। সোনার গয়না গড়িয়ে দিয়েছেন বাবা বউ আর দু’কন্যার জন্য, মা ওসব ফেলে রাখেন গোসলখানায়, চুলোর কিনারে, বালিশের নিচে। মন নেই। যে মা বারো বছর বয়স থেকে বোরখা পরেন, সে মা বোরখা ছাড়াই দৌড়োন সিনেমায়। দু’পায়ে দু’রঙের চটি পরে। মন নেই। মা’র মন উত্তম কুমারে। রাতে রাতে স্বপ্ন দেখেন, উত্তম কুমার এসে গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছেন মা’র, আবেগে চোখ বুজে আছেন মা।

আমি কখনও সিনেমায় যাইনি। আমার প্রথম ছবি, শীতের দুপুরে মাঠে বায়োস্কোপ অলা এসেছিল, কাঠের বাক্সের ফুটোয় চোখ রেখে বায়োস্কোপ দেখা, ছবি আসে আর যায়। আর বায়োস্কোপ অলা সুর করে ছবির গল্প বলেন। বায়োস্কোপের ছবি মন থেকে মুছতে না মুছতেই একদিন সারা পাড়ায় হৈ হৈ, সাহাবউদ্দিনের বাড়ির মাঠে পাবলিসিটির বোবা ছবি দেখাবে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা সন্ধে হতেই ইট বিছিয়ে বসে গেল মাঠে, বড় পর্দায় ছবি দেখানো হল, ছবি বলতে মানুষ হাঁটল, দৌড়োলো, ঠোঁট নাড়ল। আমি ইটে বসে হাঁ করে ছবি গিলে ছবির মাথা লেজ কিছুই না বুঝে বাড়ি ফিরেছি। মামারা বলেছেন–ঢেঙ্গি ছেড়ির মাথায় খালি গুবর।

তা ঠিক, মাথায় আমার গোবর। তা নইলে সে কথা তো বাড়িতে আমি জানিয়ে দিতে পারতাম। পারিনি। মুখ বুজে ছিলাম। কখনও কেউ জানেনি বাড়ি ভর্তি লোকের মধ্যে কী ঘটে গেছে অলক্ষে। সেদিন ষোলই আগস্ট, উনিশশ সাতষট্টি সন, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পার হয়েছে দুদিন হল, ইস্কুল থেকে ফিরে মা’র জন্য অপেক্ষা করছি। বাড়ি ফিরে মা আমাকে খেতে দেবেন। নানির চৌচালা ঘরে প্রায় বিকেলে যেমন বই পড়ার আসর বসে, তেমন বসেছে। কানা মামু থামে হেলান দিয়ে জলচৌকিতে বসা, নানি পান চিবোচ্ছেন শুয়ে, ঝুনুখালা আধশোয়া, হাশেম মামা এক চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারে পা তুলে হাতপাখায় বাতাস করছেন, আর রুনুখালা বালিশে বুকের ভর দিয়ে পড়ছেন দস্যু বাহরাম। এরকম দৃশ্য নানির চৌচালা ঘরে গরমের দীর্ঘ লম্বা দিনগুলোয়, দুপুরের খাবারের পর ছোট এক ঘুমের পর, বিকেলে, বাঁধা। রুনুখালা পড়েন, সবাই শোনেন। শুনতে শুনতে কেউ খিক খিক হাসেন, কেউ আহা আহা বলেন, কেউ বলেন ধুর। ঘরে ঢুকে পড়ার মধ্যে ছোটদের গোল করা নিষেধ। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, মা নেই, একা। হাশেম মামা বললেন–যা যা মাঠে খেল গিয়া।

মাঠে খেলার ইচ্ছে করে না আমার, ক্ষিধে পেটে, মা মিটসেফে তালা দিয়ে গেছেন। নানির উঠোন থেকে কুয়োর পাড় ঘেঁসে নারকেল গাছের তল দিয়ে আমাদের খাঁ খাঁ আঙিনায় ঢুকে একা বসে ছিলাম সিঁড়িতে, গালে হাত, পা ছড়ানো, তখন শরাফ মামা আসেন। ডাংএর গুটি উড়ে নাকি ক্রিকেটের বল এসে আমাদের উঠোনে পড়ল যে শরাফ মামা নিতে এসেছেন নাকি মার্বেল ফেলে গেছেন এ উঠোনে কে জানে! এক হাত লম্বা আমার চেয়ে শরাফ মামা, শরাফ মামার বাদামি চোখের তারা একবার গাছের পাতায়, একবার ঘরের দরজায়, একবার উঠোনের কালো বেড়ালে, একবার বৈঠকঘরের খালি চেয়ারে। পরনে তাঁর হাত কাটা গেঞ্জি আর শাদা হাফপ্যান্ট। জিজ্ঞেস করেন–বড়বু কই?

গালে হাত রেখেই মাথা নেড়ে বলি–নাই।

–কই গেছে? যেন তাঁর বিষম দরকার এখন মা’কে, এমন স্বরে প্রশ্ন করেন।

শরাফ মামা সিঁড়িতে আমার পাশে এসে বসে পিঠে দুটো চাপড় মেড়ে বললেন –তুই এহানে একলা বইয়া কি করস?

–কিচ্ছু না। শুকনো মুখে বলি।

শরাফ মামা বড়বু কহন আইবরে? বলে আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে নরম গলায় বলেন–গালে হাত রাহিস না। অমঙ্গল হইব।

আমার ইচ্ছে করে বলতে আমার খুব ক্ষিদা লাগছে, খাই কি? মা মিটসেফ তালা দিয়া গেছে। বলি না বরং বলি মা কই গেছে জানো? আরও কাছে সরে বসে, কও কাউরে কইবা না?

কইতাম না ক। শরাফ মামা বলেন।

–সত্যি?

–সত্যি।

–বিদ্যা?

–বিদ্যা।

–আল্লাহর কসম?

–আরে ক না, কারও কাছে কইতাম না ত। শরাফ মামা অস্থির হয়ে বলেন।

–আগে আল্লাহর কসম কও।

আল্লাহর কসম বললে কথার নড়ন চড়ন করার সাহস কারও নেই, এমনই বিশ্বাস আমার।

শরাফ মামা মুখ গম্ভীর করে বলেন–ঠিক আছে, আল্লাহর কসম।

ফিসফিসিয়ে বলি–মা সিনেমা দেখতে গেছে।

শরাফ মামা শুনে এতটুকু চমকালেন না। বললেন ও। যেন ব্যাপারটি এমন কোনও মারাত্মক নয়, মা পেশাবখানায় গেছেন বা সুলেখার মা’র বাড়ি গেছেন এমন। সিনেমা দেখা মা’র জন্য কড়া নিষেধ। ওসব দেখলে গুনাহ হয় এ কথা বলে নানা মা’কে হুমকি দিয়েছেন আবার যদি মাইয়া তুমি বাড়ির বাইরে যাও তাইলে তুমার রক্ষা নাই। তারপরও যে মা নানার নিষেধ অমান্য করে দিব্যি চলে গেলেন এরকম একটি রোমহর্ষক ঘটনা জেনেও শরাফ মামা মোটে কিছু আশংকা না করে বললেন–আমিও একটা সিনেমা দেখছি কাইলকা!

আমি অবাক হয়ে বলি–তুমি একলা গেছ সিনেমাত?

শরাফ মামা চোখ নাচিয়ে বলেন–হ।

–নানা যদি জানে তাইলে কি হইব? আমি ভয়ে ভয়ে বলি।

–আয় একটা মজার জিনিস দেইখা যা। বলে হঠাৎ শরাফ মামা উঠে হাঁটতে থাকেন পুবের উঠোনে দাদাদের ঘরের দক্ষিণে এ বাড়ির শেষ সীমানায় কালো টিনের ঘরের দিকে। পেছনে আমি। ঘরটির সামনের দরজা বন্ধ। পেছনের দরজা কায়দা জানলে খোলা যায়। বাড়িটির এ দিকটায় কোনও কোলাহল নেই। ভূতুড়ে স্তব্ধতা। ঘরের পেছন দিকটা ছেয়ে আছে বুড়ো সিম গাছে, গুল্ম লতায়, মরা পাতায়। এদিকটায় আমি কখনও আসি না সাপের ভয়ে, ছোটদা একবার ঢ়োঁড়া সাপ দেখেছিলেন এই ঝোপে। শরাফ মামার পেছন পেছন হেঁটে ঝোপে পা ফেলার আগে বলি শরাফ মামা এই জঙ্গলে সাপ আছে।

— ধুর ডরাইস না। তুই আসলেই একটা বুদ্ধু, একটা বিলাই। আয়, তরে একটা মজার জিনিস দেখাইয়াম, কেউ জানে না। শরাফ মামা এমন নিশ্চিন্তে ঝোপে গা ডুবিয়ে দেন যেন তিনি জানেন সাপ খোপ সব ঘুমিয়ে আছে গর্তে।

–কি জিনিস, আগে কও। যেতে ইতস্তত করে বলি।

–আগে কইলে মজাই ফুরাইয়া যাইব। শরাফ মামা বলেন।

বাইরে থেকে আঙুল ঢুকিয়ে দরজা খুলে শরাফ মামা ভেতরে ঢোকেন, এক দৌড়ে ঝোপ পার হয়ে আমিও পেছন পেছন। মজার জিনিসটি দেখতে আত্মা হাতে নিয়ে সাপের ঝোপ পার হয়ে এসেছি, এমনই লোভ আমার শরাফ মামার গোপন জিনিসে। ঘরে ঢুকতেই মরা ইঁদুরের গন্ধ নাকে লাগে। শব্দও শুনি ইঁদর দৌড়োনোর। ঘরের একপাশে খড়ি ঠাসা, আরেকপাশে ছোট একটি চৌকি পাতা কেবল। আমি ভয় পাচ্ছি বলে শরাফ মামা যদি বলেন, তুই একটা বুদ্ধু, একটা বিলাই, এই ভয়ে ভয় পেয়েও বলি না ভয় পাচ্ছি। শরাফ মামার বড় সাহস, একা একা সারা শহর ঘুরে বেড়ান, নদীর পারেও চলে যান। তাঁর সাহসের দিকে মুগ্ধতায় আর ভেতরের ভয় ভেতরে লুকিয়ে বিষম কৌতূহলে শরাফ মামাকে জিজ্ঞেস করি –নদীর পারে কি ফটিং টিং আছে মামা?

চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে বলেন তিনি–না।

–আমারে নিয়া যাইবা একদিন? কাতর কণ্ঠ আমার।

–তুই ডরাইবি না? আমার পেটে খোঁচা মেরে আঙুলের, বলেন।

–না। ভয় লুকিয়ে বলি।

–তুই ডউর‌্যা। ডরাইবি। মাথায় আমার চাটি মেরে বলেন তিনি।

–বিশ্বাস কর আমি ডরাইতাম না। আমি তো বড় হইছি এহন, এহন আমি ডরাই না। ঝোপ পার হতে পেরেছি আমি , আমি কেন ভয় পাব, এরকম একটি বিশ্বাস উঁকি দেয় বলে বলি।

–না তুই ডরাইবি। শরাফ মামা খোলা দরজাখানা পা দিয়ে ঠেলে বন্ধ করে বলেন। শরাফ মামার হাত ছুঁয়ে বলি–সত্যি বিদ্যা আল্লাহরকসম, আমি ডরাইতাম না।

— জায়গাটা ভালা। কেউ নাই। কেউ বুঝব না আমরা কই। শরাফ মামা বলেন।

তাঁর এরকম অভ্যেস, হঠাৎ হঠাৎ আড়াল হয়ে যান সবার। একবার রান্নাঘরের পেছনে আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন একটা মজার জিনিস খাইবি?

পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটি চিকন পাটশুলার মাথায় আগুন ধরালেন। আগুনে পাটশুলার মুখ জ্বলল আর শরাফ মামা সিগারেট টানার মত টান দিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে জ্বলন্ত পাটশুলাটি আমার হাতে দিয়ে বললেন–খা।

আমিও ধোঁয়া টেনে মুখে নিয়ে ফুঁ করে ছেড়ে দিই বাতাসে।

বলেন–কাউরে কইবি না তো!

কেশে মাথা নাড়তে নাড়তে–না বলি।

শরাফ মামা এরকম, বাড়ির কাউকে তোয়াক্কা করেন না। যা করার ইচ্ছে লুকিয়ে চুকিয়ে করে যান।

–নাসিমের টাকা দিয়া কি করছ মামা? অনেকদিনের ইচ্ছে আমার জানার.

–মাটির তলে পুঁইতা রাখছি। আমাকে প্রতিজ্ঞা না করিয়েই ফট করে বলে ফেলেন তিনি।

আমি এই সুনসান জায়গায়, বাড়ির কেউ জানে না শরাফ মামা আমাকে কথা দিচ্ছেন নদী দেখাতে নেবেন, বলছেন মাটির তলে পুঁতে রাখা টাকার গল্প, যা কেবল আমাকেই বলছেন তিনি, আর কাউকে নয়, নিজেকে আর মাথায় গোবর অলা ঢেঙ্গি ছেড়ি বলে মনে হয় না।

–কুন মাটির তলে? এই বাড়ির?

ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি।

–হ। যহন বড় হইবাম, এই টাকা দিয়া একটা জাহাজ কিনবাম। মামা বলেন।

–জাহাজ? আমারে চড়াইবা? মন খুশিতে লাফায়। আমার চোখের সামনে তখন বিশাল এক জাহাজ, নদী পার হয়ে সাগরের দিকে যাচ্ছে। আমি জাহাজে ভেসে জলের খেলা দেখছি, রোদে চিক চিক করছে রূপোলি জল। এরকম একটি ছবি দেখেছিলাম ওষুধ কোম্পানির এক ক্যালেন্ডারের পাতায়।

শরাফ মামার চোখের তারা আবার নাচে। হাতে তাঁর পাটশুলাও নেই, দেশলাইও নেই। পকেটে কোনও চুম্বক আছে কি না কে জানে। আমাদের চুম্বকের খেলা দেখাতেন মামা। তখনও চুম্বক কি জিনিস আমি জানি না। যাদু দেখবি আয়, বলে হাতে লোহার একটি শাদামাটা পাত ছুঃ মন্তর ছুঃ বলে তিনি দরজার কড়ায়, টিউবয়েলের ডান্ডায়, বালতিতে, জানালার শিকে ছোঁয়াচ্ছেন আর বসে যাচ্ছে। আমি হাঁ হয়ে মুগ্ধ চোখে যাদু দেখছিলাম। আমিও শরাফ মামার মত ছুঃ মন্তর ছুঃ বলে কুড়িয়ে পাওয়া একটি লোহা দরজায় কড়ায় লাগাতে চেয়েছিলাম, লাগেনি। শরাফ মামা আমার কান্ড দেখে হাসতেন। চোখের বাদামি তারা নাচছে শরাফ মামার আর ঠোঁটের কিনারে একরকম হাসি, যার আমি ঠিক অনুবাদ জানি না। মজার জিনিসটা এই বার তরে দেখাই বলে একটানে আমাকে চৌকির ওপর শুইয়ে দেন মামা। আমার পরনে একটি কুঁচিঅলা রঙিন হাফপ্যান্ট শুধু। শরাফ মামা সেটিকে টেনে নিচে নামিয়ে দেন।

আমি তাজ্জব। হাফপ্যান্ট দু’হাতে ওপরে টেনে বলি–কি মজার জিনিস দেখাইবা, দেখাও। আমারে ল্যাংটা কর ক্যা?

শরাফ মামা তাঁর শরীরকে হাসতে হাসতে আমার ওপরে ধপাশ করে ফেলে আবার টেনে নামান আমার হাফপ্যান্ট আর নিজের হাফপ্যান্ট খুলে তাঁর নুনু ঠেসে ধরেন আমার গায়ে। বুকে চাপ রেগে আমার শ্বাস আটকে থাকে। ঠেলে তাঁকে সরাতে চেষ্টা করি আর চেঁচিয়ে বলি–এইটা কি কর, সর শরাফ মামা, সর।

গায়ের সব শক্তি দিয়ে ঠেলে তাঁকে একচুল সরাতে পারি না।

–মজার জিনিস দেহাইতে চাইছিলাম, এইডাই মজার জিনিস।

শরাফ মামা হাসেন আর সামনের পাটির দাঁতে কামড়ে রাখেন তাঁর নিচের ঠোঁট। –এইটারে কি কয় জানস, চোদাচুদি। দুনিয়ার সবাই চোদাচুদি করে। তর মা বাপ করে, আমার মা বাপ করে।

শরাফ মামা তাঁর নুনু ঠেলতে থাকেন বিষম জোরে। আমার বিচ্ছিরি লাগে। শরমে চোখ ঢেকে রাখি দু’হাতে।

হঠাৎ ইঁদুর দৌড়োয় ঘরে। শব্দে শরাফ মামা লাফিয়ে নামেন। আমি এক দৌড়ে হাফপ্যান্ট ওপরে টেনে দৌড়ে বের হয়ে যাই ঘর থেকে। ঝোপ পার হতে আমি আর সাপের ভয়ে ইতস্তত করি না। আমার বুকের মধ্যে সড়াত সড়াত শব্দ হয়, যেন একশ ইঁদুর দৌড়োচ্ছে। শরাফ মামা পেছন থেকে অদ্ভুত গলায় বলেন–কাউরে কইবি না। কইলে কিন্তু সব্বনাশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *