০৩. বড়ো আপা

বড়ো আপা আমাকে দেখেই বলল, তোর কথাই ভাবছিলাম।

কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা। কারো সঙ্গে দেখা হলেই সে এ-রকম বলে। তার ধারণা, এ ধরনের কথাবার্তায় খুব আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। তার আন্তরিকতা প্রকাশের আরেকটি কায়দা হচ্ছে ভাত খাওয়ার জন্যে সাধাসান্ধি করা। বিকাল চারটার সময় গেলেও সে গলা সরু করে বলবে, আজরফ মিয়া, টেবিলে ভাত দাও তো। তরকারি গরম কর। লেবু কাট। আর দেখা কাঁচামরিচ আছে কিনা।

আজকে অবশ্যি সে-রকম হল না। সে দেখলাম গম্ভীর হয়ে আছে। চোখ-মুখ ফোলা-ফোলা। বলাই বাহুল্য, দুলাভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। আমি সহজ ভাবে বললাম, ব্যাপার কি?

ব্যাপার-ট্যাপার কিছু না।

ঝগড়া হয়েছে নাকি?

নাহ।

তুমি গম্ভীর হয়ে আছ।

শীলার জ্বর। তোর দুলাভাইকে বললাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। সে নেবে। না। তার ধারণা, একটু গা গরম হলেই ডাক্তারের কাছে দৌড় দেওয়ার কোনো দরকার নেই।

জ্বর কি খুব বেশি?

সকালবেলা ১০২ পয়েন্ট পাঁচ ছিল। এখন ৯৯!

ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিয়েই কি ঝগড়া?

বললাম তো ঝগড়া কিছুই হয় নি। এক কথা বারবার জিজ্ঞেস করিস।

বড়ো আপা কাঁদতে শুরু করল। কান্না তার একটি রোগবিশেষ। যে-কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সে কেঁদে বুক ভাসাতে পারে। আমরা তার কান্নায় কখনো কোনো গুরুত্ব দিই না।

আপা কাঁদছ কেন?

তোর দুলাভাই আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। শহরের অবস্থা নাকি খুব খারাপ।

তোমার কাছে খারাপ মনে হচ্ছে না?

মনে হবে না কেন? তবে তোর আমার জন্যে তো কিছু না। আমরা হিন্দুও না, আমরা আওয়ামী লীগও করি না। আমাদের আবার কিসের অসুবিধা?

আমি চুপ করে রইলাম। বড়ো আপা থেমে থেমে বলতে লাগল, অবস্থা তো অনেক ভালো হয়েছে এখন। পরশু দিন আমি একা এক নিউমার্কেট থেকে বাজার করে আনলাম। আগে কাৰ্য্য ছিল নয়টা থেকে, এখন দশটা থেকে। ঠিক না? তুই বল?

তোর দুলাভাইয়ের ধারণা, গ্রামে গেলে আর কোনো ভয় নেই। এইখানে ভয়টা কিসের? পত্রিকায় দিয়েছে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। অবস্থা খারাপ হলে দিত?

পরীক্ষার ডেট দিয়েছে নাকি?

হুঁ, দৈনিক পাকিস্তানে আছে। দাঁড়া, নিয়ে আসছি, নিজের চোখে দেখ।

থাক আপা, আনতে হবে না।

না, তুই দেখে যা।

সারাটা দিন বড়ো আপার বাসায় কাটাতে হল। দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে আসা ভালো দেখায় না। তিনি ফিরবেন ছাঁটার দিকে। এত দীর্ঘ সময় বড়ো আপার সঙ্গে কাটান একটি ক্লান্তিকর ব্যাপার। এক গল্পই তার কাছে অনেক বার শুনতে হয়। আজরফ কী করে কাপড়-ধোওয়া সাবান দিয়ে ধুয়ে তার একটি বেনারসী শাড়ি নষ্ট করেছে, সে-গল্প আমাকে চতুর্থ বারের মতো শুনতে হল। তারপর শুরু করল দুলাভাইয়ের এক বোনের গল্প। সেই বোনটি বিয়ের পর তার স্বামীর এক বন্ধুর সঙ্গে কী সব নটঘট করতে শুরু করেছে। এই গল্পটিও আগে শোনা।

আমি হাই তুলে বললাম, শীলা কোথায় আপা?

ওর বান্ধবী এসেছে।

যাই, দেখা দিয়ে আসি।

দরজা বন্ধ করে রেখেছে ওরা।

তাই নাকি?

হুঁ।

দরজা বন্ধ করার ব্যাপার নিয়েও বড়ো আপা গজগজ করতে লাগলেন।

দরজা বন্ধ করে কথা বলার দরকারটা কী? এই সব আমি পছন্দ করি না। মেয়েরা দরজা বন্ধ করলেই তাদের মাথায় আজেবাজে সব খেয়াল আসে।

শীলার বয়স এমন কিছু নয়। তের হয়েছে। বড়ো আপা বলেন সাড়ে এগার। অবশ্যি শীলাকে বেশ বড়োসড়ো দেখায়। এই তের বছর বয়সেই সে গোটা চারেক প্ৰেমপত্র পেয়েছে। এর মধ্যে একটি সে আমাকে দেখিয়েছে (আমার সঙ্গে তার বেশ ভাব আছে)। সেই চিঠিটি এতই কুৎসিত যে পড়া শেষ করে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়। আমি যখন বললাম,  এই চিঠি তুই জমা করে রেখেছিস? ছিঁড়ে ফেলে দিস না কেন?

শীলা অবাক হয়ে বলেছে, আমার কাছে লেখা চিঠি আমি ফেলব কেন? জানো, লুনা একুশটা চিঠি পেয়েছে? এর মধ্যে একটা আছে। ষোল পাতার।

কী আছে সেই ষোল পাওয়ার চিঠিতে?

তোমাকে বলা যাবে না।

লুনা মেয়েটিই আজকে এসেছে। বড়ো আপা একে দুচক্ষে দেখতে পারে না। প্রধান কারণ হচ্ছে, মেয়েটি অসামান্য রূপসী। আমার ধারণা, এই মেয়েটির দিকে তাকালে যে-কোনো পুরুষের মনে তীব্র ব্যথাবোধ হয়। বড়ো আপা মুখ লম্বা করে বললেন, লুনার সঙ্গে অল্পবয়েসী মেয়েদের মিশতে দেয়া উচিত না।

আমি বলব না বলব না করেও বললাম, লুনাও তো অল্পবয়েসী।

বড়ো আপা আকাশ থেকে পড়ল, অল্প বয়েস কোথায় দেখলি তুই! দুই বছর আগে থেকে ব্রা পরে এই মেয়ে।

বিকালে চা দিতে এসে আজরফ গম্ভীর মুখে বলল, বড়ো রাস্তার মোড়ে একটা মিলিটারি জীপ।

আপা এটা শুনেই রেগে গেল। মিলিটারি জীপ হয়েছে তো কী হয়েছে? মিলিটারি তোকে খেয়ে ফেলেছে? গরু কোথাকার! যা আমার সামনে থেকে।

আজরফ সামনে থেকে নড়ল না। মুখ আগের চেয়েও গম্ভীর করে চা ঢালতে লাগল। আপা থমথমে গলায় বলল, মিলিটারি জীপ দেখেছিস, দেখেছিস। এর মধ্যে গল্প করার কী আছে? খবরদার, এই সব নিয়ে গল্পগুজব করবি না। আমি পছন্দ করি না।

আম্মা জীপটার লক্ষণ বালা না। এক জায়গার মধ্যে ঘুরাঘুরি করতাছে।

করুক। তারা তাদের কাজ করবে, তুই করবি তোর।

আইচ্ছা।

খবরদার, মিলিটারি নিয়ে আর কোনো কথা বলবি না।

আইচ্ছা।

আপার বক্তৃতা আজরফের মনে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। কারণ খানিকক্ষণ পর শীলা এসে বলল, আজরফ ভাই বলল রাস্তার মোড়ে একটা জীপ ঘোরাঘুরি করছে।

করুক, তাতে তোমার কী?

ওরা অল্পবয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে নেখটা করে একটা ঘরের মধ্যে রেখে দেয়।

বড়ো আপা স্তম্ভিত হয়ে বলল, কে বলেছে এই সব?

লুনা। লুনা বলল।

যাও, নিজের ঘরে যাও। যত আজগুবী কথাবার্তা। বলতে লজ্জাও করে না!

লজ্জা করবে। কী জন্যে? আমাকে তো আর নেংটো করে রাখে নি। শীলা ফিক করে হেসে ফেলল।

যাও, ঘরে যাও। তোমার বন্ধু যাবে কখন?

ও আজ থাকবে আমার সঙ্গে। বাসায় টেলিফোন করে দিয়েছি। মা, তুমি কিন্তু খিচুড়ি করবে রাত্রে। আমরা এখন জ্বর নেই।

ঠিক আছে, তুমি যাও। আজরফকে পাঠিয়ে দিও।

আপা দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলতে পারল না। আজরফ যখন দ্বিতীয় বার চা দিতে এল তখন শুধু গম্ভীর হয়ে বলল, আজরফ, তোমার চাকরি শেষ। কাল সকাল নটায় বেতনটেতন বুঝে নিয়ে বাড়ি যাবে।

জ্বি আচ্ছা, আম্মা।

আজরফকে মোটেই বিচলিত মনে হল না, দিনের মধ্যে কয়েক বার যার চাকরি চলে যায়, তাকে চাকরি নিখে বিচলিত হলে চলে না।

 

দুলাভাই ঠিক ছটার সময় এলেন।

তাঁর সব কাজ ঘড়ি ধরা, সময় নিয়ে খানিকটা বাতিকের মতো আছে। পাঁচটায় কোথায়ও যাওয়ার কথা থাকলে চারটা পঞ্চাশে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন এবং ঠিক পাঁচটায় ঢুকবেন। অফিসের লোকরা তাঁকে ঘড়িবাবু বলে।

দুলাভাই আমাকে দেখেই বললেন, তিন ঠ্যাং-এর শালা বাবু যে? কী হেতু আগমন?

পা নিয়ে ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু দুলাভাইয়ের উপর আমি কখনো রাগ করতে পারি না। এই লোকটিকে আমি খুবই পছন্দ করি।

আছ কেমন শালা বাবু?

আমি হাসিমুখে বললাম, ভালো আছি, দুলাভাই।

তোমার তিন নম্বর ঠ্যাংটা সাবধানে রাখছ তো? খানায় পড়ার সম্ভাবনা। হা-হা-হা।

সাবধানেই রাখছি। আমাকেও হাসির ভান করতে হয়।

শুনেছি নাকি, ওদের নীলগঞ্জে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

শুনেছি।

তোমার আপার ধারণা, সে বনবাসে যাচ্ছে। তবে যে–পরিমাণ কান্নাজাটি করছে, সীতাও তার বনবাসে এত কাঁদে নি।

সীতার সঙ্গে তো রাম ছিল। কিন্তু আপনি তো যাচ্ছেন না।

আমিও যাব। ব্যাক টু দা ফরেস্ট। তবে কিছুদিন পর। তুমিও চল।

না দুলাভাই। এখানে আমার কোনো অসুবিধা নেই।

তা ঠিক। ঢাকা শহরে কানা-খোঁড়া—অন্ধ এরা বর্তমানে খুব নিরাপদ। হা-হা-হা।

আমি চুপ করে রইলাম।

রাগ করলে নাকি শফিক?

জ্বি-না।

ঠাট্টা করে বলি।

ঠিক আছে।

বড়ো আপা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, চা খাবি আরেক বার?

দুলাভাই বললেন, আমি খাব। আমাকে এক কাপ লেবু চা দাও।

বড়ো আপা কথা না বলে চলে গেলেন। দুলাভাই ক্লান্ত স্বরে বললেন, তোমার এক জন ভাড়াটে যে নিখোঁজ হয়েছিল, কী নাম যেন তার?

আব্দুল জলিল।

ও হ্যাঁ, জলিল। কোনো খোঁজ হয়েছে?

এখনো হয় নি। রফিককে নিয়ে চেষ্টা করছি।

তুমি খোঁজাখুঁজির মধ্যে যাবে না। কোনো ক্রমেই না। সময় ভালো না এখন। প্রায়ই লোকজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

করছে কী ওদের?

কিছু দিন রেখে ছেড়ে দিচ্ছে সম্ভবত। মানুষ মারা তো খুব কঠিন ব্যাপোর।

ধরাধরিটাই-বা করছে কি জন্যে?

মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেবার জন্যে। ভয় ধরানর এটা খুব ইফেকটিভ ব্যবস্থা। এক জন নিখোঁজ হলে পাঁচ হাজার লোক সেটা জানে। সবাই খোঁজাখুজি করে।

বড়ো আপা থমথমে মুখে চা নিয়ে ঢুকল। ওর বুদ্ধিসুদ্ধি সত্যি কম। চা এনেছে শুধু আমার জন্যে, দুলাভাইয়ের জন্যে নয়। তিনি একটু হাসলেন এবং হাসিমুখেই বললেন, শীলার জ্বর কমেছে? লুনাকে দেখলাম ওর ঘরে।

আপা জবাব দিল না।

ও কি আজকে থাকবে? এই সময় কেউ মেয়েদের বাইরে পাঠায়? কী আশ্চর্য!

আপা তারও জবাব দিল না।

আমি বললাম, মেয়েটি আজকে থাকবে দুলাভাই। শীলা ওর বাসায় টেলিফোন করে দিয়েছে।

মেয়েটিকে তুমি দেখেছি শফিক?

দেখেছি।

ওর চেয়ে সুন্দর মেয়ে তুমি দেখেছ?

আমি ইতস্তত করে বললাম, না।

আমি কিন্তু দেখেছি। ঢাকা কলেজে তখন পড়ি। বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে করে যাচ্ছি দিনাজপুরে। ময়মনসিংহ স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখি, একটি ষোল-সতের বছরের মেয়ে প্লাটফরমে টিনের একটা ট্র্যাঙ্কে বসে আছে। খুবই গরিব ঘরের মেয়ে। পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল।

আপা রাগী গলায় বলে উঠলেন, লুনার মধ্যে তুমি সুন্দরের কী দেখলে? সমস্ত মুখ ভর্তি নাক।

লুনার কথা তো আমি বলছি না। যার কথা আমি বলছি, তার নামধাম কিছুই জানি না।

আপা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। দুলাভাই হাসতে লাগলেন ঘর ফাটিয়ে।

আমি বললাম, ওদের কবে পাঠাচ্ছেন?

এই মাসেই পাঠাব। আমি নিজেও চলে যেতে পারি। রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় না। আরাম করে ঘুমুতে ইচ্ছা করে।

দুলাভাই গাড়ি করে আমাকে পৌঁছে দিতে রওনা হলেন। সাতটা মাত্র বাজে, এর মধ্যেই দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে লোক-চলাচল নেই। কেমন খী-খী করছে চারদিক। এত বড়ো একটা শহর বিম মেরে গিয়েছে।

দুলাভাই বললেন, সন্ধ্যার পর চলাফেরা করা ঠিক না।

দুলাভাই, আপনার কি ভয় লাগছে?

না, ভয় লাগে না। অন্য রকম লাগে। আমার কাছে টিক্কা খানের সই করা পাশ আছে, আমাকে কেউ ধরবে না।

গাড়ি সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছাকাছি আসতেই দেখি রোড ব্লক দিয়ে তিনচার জন সেপাই দাঁড়িয়ে। ওরা গাড়ি থামিয়ে থামিয়ে কী-সব দেখছে। একটি কালো ভকস ওয়াগনকে দেখলাম রাস্তার পাশে। রোগামতো একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে। একজন সেপাই কী-সব যেন জিজ্ঞেস করছে। দুলাভাই শুকনো গলায় বললেন, তুমি চুপচাপ থাকবে। কথাবার্তা যা বলবার আমি বলব।

ওরা আমাদের গাড়ি থামাল না। হোত ইশারা করে চলে যেতে বলল। তাকিয়ে দেখি দুলাভাইয়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

গেটের সামনে গাড়ি থামতেই জলিল সাহেবের স্ত্রীর কান্না শোনা গেল। আজ

সকাল-সকাল কান্না শুরু হয়েছে। দুলাভাই ভীত স্বরে বললেন, কাঁদে কে?

জলিল সাহেবের বউ।

রোজ এ রকম কাব্দে?

হ্যাঁ।

শফিক—

জ্বি।

তুমি খোঁজখবরের মধ্যে যাবে না। সময়টা খারাপ–দুলাভাই কুলকুল করে ঘামতে ল্যালেন।

আসেন, উপরে যাই। চা খেয়ে যান।

না থাক। দেরি হয়ে যাবে।

দেরি হবে না।

না থাক।

দুলাভাই না বলেও গাড়ি থেকে নেমে আমার সঙ্গে উপরে উঠতে লাগলেন।

শফিক, আমিও নীলগঞ্জে চলে যাব।

ভালোই হবে।

আমার ভালো লাগছে না। বড়োই দুঃসময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *