বৈদিক সমাজে নারীর স্থান
এক
মাঝে মাঝেই বক্তৃতায় বা বেতারে শুনি, প্রবন্ধে বা বইয়ে পড়ি প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীর স্থান খুব উঁচুতে ছিল। মুসলিম আক্রমণের পরই নাকি নারীর স্থান সমাজে নেমে যায়। এ সব মন্তব্যের সত্যতা পরীক্ষা করার জন্যে আমাদের হাতে তথ্য আছে, বিশেষত বৈদিক সাহিত্যে। একেবারে প্রাচীন অর্থাৎ বৈদিক যুগেই নাকি নারীর স্থান খুব উঁচুতে ছিল। বৈদিক সাহিত্য ছাড়া তো সে যুগের কোনও ইতিহাস পৌঁছয়নি আমাদের কাছে, কাজেই সেই সাহিত্যের থেকেই খোঁজ করতে হবে সত্যি সত্যি নারীর স্থান কতটা উঁচুতে ছিল, এ প্রবন্ধে সেই অনুসন্ধানের চেষ্টা।
বৈদিক যুগ বলতে যে যুগে বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল তাই বুঝতে হবে। এ সাহিত্য প্রধানত সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ ও সূত্রসাহিত্য, অর্থাৎ, প্রধানত শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্মসূত্রই। আধুনিক সমস্ত পণ্ডিতই প্রাচীনতম বেদ অর্থাৎ ঋগ্বেদ-কে খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে দশমের শেষ বা নবমের শুরুর রচনা বলে মনে করেন। যজুর্বেদ ও সামবেদ এবং প্রাচীন ব্রাহ্মণগুলি খ্রিস্টপূর্ব নবম থেকে সপ্তম শতকের। অথর্ববেদ-এর প্রাচীনতম অংশও এই সময়ের; বাকি অংশ ও পরবর্তী ব্রাহ্মণ ও উপনিষদগুলি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতকের রচনা। সূত্রসাহিত্য সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের মধ্যে রচিত। তাহলে খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে খ্রিস্ট্রিয় চতুর্থ শতক এই দেড় হাজারের কিছু বেশি সময়ের সাহিত্যে সমাজের যে চিত্র সংগ্রহ করতে পারি তারই মধ্যে খুঁজব নারীর স্থান। এটাও উল্লেখ করা যায় যে, এর শেষ হাজারখানেক বছরের ইতিহাসে সাহিত্য ছাড়াও অন্য উৎস আছে, যেমন প্রত্নতত্ত্ব, শিলালিপি, তাম্রশাসন, দুটি মহাকাব্য, প্রথম যুগের পুরাণ, বৌদ্ধ সাহিত্য, ইত্যাদি।
যাযাবর পশুচারী আর্যরা এল উত্তরভারতে— যেখানে সিন্ধুসভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সিন্ধু সভ্যতার লোকরা কৃষিজীবী এবং নগরসভ্যতার যুগে বাস করত, ধাতুর দিকে যুগটা ছিল ব্রোঞ্জ যুগ। ইতিহাসের সাক্ষ্য হল বৈদিক আর্যদের সঙ্গে লোহা ঢোকে ভারতবর্ষে। সম্ভবত ইন্দ্রের বজ্র, যার জোরে আর্যদলের সেনাপতি ইন্দ্র প্রাগার্যদের হারালেন, সেটা ছিল লোহার ফলকযুক্ত কোনও অস্ত্র, যার সামনে প্রাগার্যদের নরম ধাতু অস্ত্র দাঁড়াতে পারেনি। এছাড়াও আর্যদের ছিল ঘোড়ায় টানা রথ, প্রাগার্যদের হাতি তার মত দ্রুতগামী নয়। প্রাগার্য সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের যে বহির্বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল আর্যরা আসবার পরেই তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার শুরু হয় দু তিনশো বছর পরে।
যাযাবর পশুচারী আর্যরা এদেশে এসে ধীরে ধীরে এদের পরাজিত করে প্রায় সমস্ত আর্যাবর্ত অধিকার করে। প্রাগার্যদের সঙ্গে বিয়ে ও প্রতিবেশিত্বের মধ্যে দিয়ে আর্যরা ক্রমে চাষ করতে শেখে ও যাযাবর থেকে গ্রামীণ মানুষ হয়ে ওঠে। পোড়া ইটের বাড়ি তৈরি করতে শেখে ও থিতু হয়ে এক জায়গায় বসবাস করতে থাকে। যাযাবরদের সমাজসংস্থা ছিল গোষ্ঠী (tribe) ও কৌম (clan)-তে বিভক্ত। কৃষি শিখে কৃষিজীবী হওয়ার পর এ সমাজগঠন ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে। ক্রমে ক্রমে ‘কুল’-এর প্রবর্তন হয়, অর্থাৎ একটা বাড়িতে তিন চার পুরুষের পল্লবিত বৃহৎ পরিবার। তারপর আসে যৌথ পরিবার, পুরুষের সম্পর্ক ধরে দু-তিন পুরুষের পরিবার। সবশেষে একক পরিবার, এক পুরুষের সংসার। এসবের সঙ্গেই উৎপাদন ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, কিন্তু একটি ব্যাপার ক্রমশ পরিণতির দিকে এগোচ্ছিল: সমাজে শূদ্র ও নারীর স্থানের অনিবার্য অবনমন, অর্থাৎ ক্রমেই নারীর স্থান সমাজে ও পরিবারে নেমে যাচ্ছিল। উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশ ক্রমেই কমে যাচ্ছিল। যদিও গৃহকর্মে তার পরিশ্রম ও দায়িত্ব যথেষ্টই ছিল তবু তাকে ‘ভার্যা’ অর্থাৎ অন্যের দ্বারা ভরণীয়া, স্বামীর অন্নে প্রতিপালিত এই সংজ্ঞা দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে ‘ভৃত্য’ আর ‘ভার্যা’ শব্দ দুটোর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একই: যাকে ভরণ করতে হয়। স্ত্রী স্বয়ং অন্ন উৎপাদন করে না, তাই সে ভরণীয়া। (ইংরেজিতে মধ্যযুগ পর্যন্ত স্বামীকে লর্ড বলা হত; এই শব্দও স্ত্রী ও ভূতে— উভয়ের পক্ষে একই। এবং এরও ব্যুৎপত্তি hlaf ward থেকে, অর্থাৎ অন্ন (hlaf loaf/রুটি)-র জন্য যার কাছে আশ্রিত (ward))।
বৈদিক যুগের শেষ দিকে অনেক বৈদেশিক আক্রমণ হয় তার ফলে নারীহরণের ও বর্ণসংকরের আশঙ্কায় নারীকে অন্তঃপুরে ঠেলে দেওয়া হয় ও তখন থেকে নারী অনেক বেশি অসূর্যম্পশ্যা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ঘরে-বাইরে যখন যেখানে কোনও বিপত্তি দেখা দিয়েছে তার দামটা দিতে হয়েছে শূদ্র এবং অথবা, নারীকে। নারীর ক্ষেত্রে সেটা কেন এবং কেমন করে ঘটল তাই দেখব এ প্রবন্ধে।
দুই
ঋগ্বেদ হল বৈদিক সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ। এখানে সরাসরি নারীর স্থান সম্বন্ধে বিশেষ কোনও উক্তি নেই। কিন্তু নানা বর্ণনা উপমান থেকে নারীর স্থান সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। ঋগ্বেদ-এর রচনায় কয়েকটি স্তর আছে, তার প্রথম স্তরের মন্ত্রগুলিতে নারী অপেক্ষাকৃত স্বাধীনচারিণী। দেবী ঊষা কোনও মন্ত্রে সূর্যের বধূ, কোথাও মাতা, কোথাও কন্যা; বিশ্বজনের দৃষ্টির সামনে আপন দেহশ্ৰী উদ্ঘাটন করছেন। (১:৪৬:৪) কখনও বা শুনি ঊষা স্মিতহাসিনী; নববধূ যেমন করে স্বামীর সামনে নিজেকে প্রকাশ করে, ঊষা তেমনই করেই নিজের আবরণ উন্মোচন করছেন। (১:১২৪:৭) সুন্দরী সুসজ্জিতা ঊষার দেহটি যেন মায়ের নিজের হাতে স্নান করিয়ে দেওয়া ও সাজিয়ে দেওয়া কন্যার দেহটি। (১:১২৩:১২) শুনতে পাই, অগ্নি তেমনই করে স্তোতার স্তবে খুশি হন যেমন করে প্রেমিক স্বামী তার বধূর সান্নিধ্যে আনন্দ পায়। (৩:৬২:৮) অগ্নি তেমনই পবিত্র যেমন পবিত্র স্বামীর দ্বারা সম্মানিত বধূ। (১:৭৩:৩) দেখা যাচ্ছে, দেবতার আনন্দ দেবতার পবিত্রতার উপমান, মানবের প্রেম, মানবীর শুচিতা। এই যুগেই শুনি নারী নিজেই তার জীবনসঙ্গী বেছে নেয়— স্বয়ং সা মিত্রং বনুতে জনে চিৎ। (১০:২৭:১২) আবার একটু পরের যুগে শুনি, প্রিয়া স্ত্রী যেমন প্রিয় স্বামীতে আনন্দ পায়, হে ভগদেব, তুমি যেন আমাতে তেমনই সুখী হও। (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২:৪:৬:৫৬) বহুবার একটি উপমা পাই, উপাসক তাঁর দেবতার কাছে আসছেন যেমন করে কোনও পুরুষ তার কাম্য নারীর কাছে আসে বা তার পেছনে পেছনে যায়— মর্যো ন যোষামভ্যেতি পশ্চাৎ। (ঋগ্বেদ ৭:৮০:২) আরও অনেক জায়গায় এই ধরনের কথা আছে। ঘৃতধারা সোমের দিকে ধাবিত হচ্ছে যেমন করে অলংকৃতা সুন্দরী তরুণী স্বামীর কাছে যায়। (ঋগ্বেদ ৪:৫৮:৯)
যাকে বলা হয় অবৈধ প্রণয়, তা নিয়ে ঋগ্বেদের ঋষির কোনও কুণ্ঠা নেই। অনাদিকাল থেকেই তা সকল সমাজেই আছে, তাই তা যেন সর্বজনস্বীকৃত একটি সামাজিক তথ্য। সেই জন্যে, ‘জারো ন’, উপপতির মত, এই উপমাটি বারেবারেই পাই। যমযমী সূক্ত (১০:১০)-তে ভাইবোনের ও নাভানেদিষ্ঠ সূক্ত (২০:৬১:৫-৭)-তে পিতাপুত্রীর আসক্তির কথা আছে, নাভানেদিষ্ঠে মিলনের উল্লেখও আছে। অর্থাৎ এটা প্রচলিত সমাজনীতির ব্যতিক্রম। মাঝে মাঝে সমাজে নিষিদ্ধ সম্পর্কের মিলন দেখা যায় বলেই ঋগ্বেদ-এর ঋষিও অকুণ্ঠ ভাবে এর উল্লেখ করেছেন। সোম যজ্ঞপাত্রের দিকে যাচ্ছে যেমন কামুক তার বন্ধুপত্নীর দিকে যায়। (৯:৯৬:২২, ২৩; ১০১:১৪) নদীরা বিশ্বামিত্রের দিকে যাচ্ছে যেমন করে চুম্বনে উদ্যত পুরুষের কাছে নারী আনত হয়। (৩:৪৫:১) সোমরস বসতীবরীর জলে আনন্দিত হয় যেমন উত্তম নারীর সান্নিধ্যে পুরুষ আনন্দিত হয়। এমনই অসংখ্য দৃষ্টান্তে নারীপুরুষের প্রেম ও মিলনের অসংকোচ উল্লেখ উপমানে।
নারীর ইচ্ছাক্রমে বা অনিচ্ছাক্রমে নারীহরণের কথাও ঋগ্বেদ-এ মধ্যেমধ্যে আছে। পুরুমিত্রের কন্যাকে বিমদ হরণ করছেন। (১:১১২:৭; ১১৬:১) কোনও পুরুষ রাত্রে একটি নারীকে হরণ করতে যাবেন তাই প্রার্থনা করছেন, মেয়েটির ভাইয়েরা যেন জেগে না যায়, কুকুরগুলো যেন ডেকে না ওঠে। (৭:৫৫:৫-৮)
বিবাহের কন্যাপণের কথা পাওয়া যায়। ইন্দ্র আর অগ্নি ভক্তকে ধন দেন, অবাঞ্চিত জামাতা যেমন প্রচুর ধন দিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকদের অনুকূল করে তাদের প্রীতিভাজন হয়। (১:১০৯:২) পুরুষের বহুপত্নীত্বের কথা কখনও স্পষ্টত (৭:২৬:৩) কখনও বা গৌণভাবে, সপত্নীনাশনের মন্ত্রগুলির দ্বারা প্রতিপন্ন হয়। কন্যার শরীরে ত্রুটি থাকলে একাধিকবার বরপণের কথা আছে। (৬:২৮:৫, ২০:২৭:১২) কুমারী কন্যার কথাও বেশ কয়েকবার আছে। এদের বলা হত অমাজু বা অমাজুরা, অর্থাৎ যারা বাপের বাড়িতেই বুড়ো হয়ে যায়। কিংবা কুলপা বা বৃদ্ধকুমারী বা জরৎকুমারী (১:১১৭:৭; ১০:৩৯:৩; ১০:৪০:৫) পরবর্তী কালে বিবাহ যেমন নারীর পক্ষে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছিল, ঋগ্বেদ-এর যুগে দেখছি তা ছিল না। ঋগ্বেদ-এ সহমরণ, পরবর্তী কালে যাকে সতীদাহ বলা হয়েছে, তার কোনও উল্লেখ নেই; বিধবা বেঁচেই থাকত, কখনও বা দেওরের সঙ্গে তার বিয়ে হত, আর কখনও-বা আর বিয়ে হতই না। সে যাই হোক তার বেঁচে থাকার অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া হয়নি, ধর্ম বা সমাজের দোহাই পেড়ে পুড়িয়ে মারাও শুরু হয়নি। দ্বিতীয়বার বিয়ের— দেওর ছাড়া অন্যকেও— অধিকারও স্বীকার করা হয়েছিল, কিছু পরেই তার প্রমাণ দেখতে পাব। বেদ রচনার উত্তরপর্বে অর্থাৎ ঋগ্বেদ-এর প্রথমাংশ রচনার পরে, প্রাগার্য প্রভাবেই হোক বা অন্য কোনও কারণে সামাজিক বিবর্তনের ফলেই হোক, প্রথম সহমরণের কথা শুনি অথর্ববেদ-এ। সেখানে এক জায়গায় শুনি, ‘দেখলাম জীবিত নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতের বধূ হতে।’ (১৮:৩:৩২) কিংবা অন্যত্র ‘এই নারী পতিলোকে যাচ্ছে, এ প্রাচীন রীতি অনুসরণ করছে।’ (১৮:৩:১) প্রশ্ন থেকেই যায়, এ প্রাচীন রীতি আর্য না প্রাগার্য; কারণ ইন্দো-ইয়োরোপীয় অন্য সভ্যতাগুলিতে সহেমরণের কথা পাই না। এ প্রথা কত প্রাচীন? প্রাগার্য সিন্ধুসভ্যতার? বিধবা বেঁচে থাকলেই সব সময়ে তার জীবন সুখের হত না, তাই প্রার্থনা শুনি, ‘যেন ইন্দ্রাণীর মত অবিধবা হই।’ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ৩:৭:৫:৫১) এটা তো জানাই আছে, সমস্ত ভারতীয় সাহিত্যে ‘যেন বিপত্নীক না হই’ এমন প্রার্থনা কোথাও নেই। বরং এখন এর উল্টো কথাই শোনা যায়, ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গরু।’ সম্পত্তি হিসেবেও স্ত্রীর স্থান গরুর নিচে, কারণ নতুন গরু কিনতে টাকা লাগে, আর নতুন বৌ আনলে টাকা পাওয়া যায়। এই উত্তর-বৈদিক যুগে নারীর বহু বিবাহের কথাও শোনা যায়। অথর্ববেদ-এ শুনি, ‘যে নারীর পূর্বে একজন পতি ছিল সে যখন দ্বিতীয় পুরুষকে লাভ করে তখন পঞ্চৌদন অজ দান করলে তার কোনো ক্ষতি হয় না।’ (৯:৫:২৭) অন্যত্র শুনি, ‘কোনো নারীর দশটি পতি থাকলেও সে যখন ব্রাহ্মণের পত্নী হয় তখন সেই ব্রাহ্মণই তার পতি, রাজন্য বা বৈশ্য পতিরা পতি নয়।’ (৫:১৭:৮, ৯) এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য অবশ্য ব্রাহ্মণ পুরুষের মাহাত্ম্য ঘোষণা করে অন্য বর্ণের হীনত্ব প্রতিপাদন করা। কিন্তু প্রসঙ্গত কোনও নারীর পক্ষে দশটি স্বামী গ্রহণের স্বীকৃতিও এতে আছে।
তিন
যজুর্বেদ-এর যুগেই সাহিত্যে আর্য প্রাগার্য সংমিশ্রণের স্পষ্ট চিহ্ন পড়েছে। অবশ্য ঋগ্বেদ-এর প্রথম মণ্ডলের প্রথমার্ধ ও দশমমণ্ডলেই এর সূত্রপাত। ততদিনে আর্যরা গ্রামীণ ও কৃষিজীবী,; পোড়া ইঁটের ঘরবাড়ি তৈরি করছে; জনপদে, গ্রামে ও পুর বা শহরে বাস করছে। নানা বৃত্তি অবলম্বন করছে। সমাজে জটিলতা বেড়েছে, গোষ্ঠী ও কৌম ভাঙছে; ধীরে ধীরে যৌথ ও বৃহৎ পরিবারেই সমাজের ন্যূনতম সংগঠন দেখা দিচ্ছে। বহির্বাণিজ্য শুরু হয়েছে। ধনসম্পত্তি বাড়ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞের সংখ্যা ও জটিলতা, পুরোহিতের সংখ্যা ও দক্ষিণার পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। এই সময়ে শুনি, ‘দীক্ষার দিনে যজমান গণিকাসাহচর্য বর্জন করবেন, তার পরদিন পরস্ত্রীর এবং তৃতীয় দিনে নিজের স্ত্রীর।’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৬:৮:৫) অর্থাৎ দীক্ষার দিনেও পরস্ত্রীর সাহচর্য নিষিদ্ধ ছিল না এবং গণিকাগমনের জন্যে দীক্ষার দিনে কোনও প্রায়শ্চিত্ত ছিল না।
যজ্ঞে যজমানের পত্নী পাশে থাকতেন, কিন্তু নিষ্ক্রিয় ভাবে। তাঁর উপনয়ন নেই, অতএব, ‘ন স্ত্রী জুহুয়াৎ— নারী হোম করতে পারবে না।’ (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:৭:১৫:১৭) অথচ অন্যত্র বারেবারে শুনি, ‘পূর্বার্ধো বৈ যজ্ঞস্যাধ্বজঘনার্ধং পত্নী।’ (শতপথব্রাহ্মণ ১:৯:২:২; ৩:৪:২২; ৫:২:১-১০) অর্থাৎ যজ্ঞের পূর্বার্ধ যজমান, উত্তরার্ধ যজমানপত্নী। কিন্তু এই অপরাটি যজ্ঞে কোনও অংশগ্রহণ করত না; শুধু পাশে বসে থাকত। এতটাই নিষ্ক্রিয় তার ভূমিকা যে, রাম সোনার সীতা গড়িয়ে নিয়ে যজ্ঞ নিষ্পাদন করতে পেয়েছিলেন। গৌতমধর্মসূত্ৰ-তে শুনি, ‘অস্বতন্ত্রা ধর্মে স্ত্রী।— ধর্মাচরণে নারীর কোনও স্বাতন্ত্র্য নেই।’ (১৮:১)
গৃহকর্ম ভিন্ন কোনও বৃত্তি কুলনারীর ছিল না। যে দু’ একটি কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় তার মধ্যে আছে পশম পাকানো ও বোনা, (শতপথব্রাহ্মণ ১২:৭:২:১১) অন্যান্য কাজের সঙ্গেই তারা এটি করত। মেয়েদের শিক্ষার প্রসঙ্গে দেখি ব্রহ্মচর্য— যা বেদ অধ্যয়নের প্রবেশদ্বার— তা বহু প্রাচীন যুগেই নারীর পক্ষে নিষিদ্ধ। অতএব শিক্ষালাভের পথ তার রুদ্ধ। অথর্ববেদ বলে, ব্রহ্মচর্যের দ্বারা নারী স্বামী লাভ করে। (১১:৫:১৮)। মনে হয়, এ ব্রহ্মচর্য কোনও ব্রত, বা শিবপুজোর মতোই কিছু, স্বামীলাভই যার উদ্দেশ্য। ঋগ্বেদ-এ কিছু ঋষিকার নাম পাই, হয়তো তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষালাভের সুযোগ পেতেন; যেমন বিশ্ববারা, ঘোষা, অপালা, ও গোধা। পাণিনিতে আচার্যা ও উপাধ্যায়া শব্দের ব্যুৎপত্তিতে অধ্যাপনা রত নারীর উল্লেখ আছে; কাশিকাভাষ্যে কাশকৃৎস্না ও অপিলার নাম পাই— মীমাংসা ও ব্যাকরণের পণ্ডিত হিসাবে; অস্তূণ ঋষির কন্যা বাক্, গার্গী, মৈত্রেয়ী, শাশ্বতী— এঁদের কথাও পাই। অর্থাৎ মধ্যে মধ্যে ব্যতিক্রমের মতো কোনও কোনও নারী শিক্ষার সুযোগ পেতেন। কিন্তু শাস্ত্রের নজির দেখলে বোঝা যায় নারীর শিক্ষার অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছিল। তাই শিক্ষিতা নারীর প্রসঙ্গে বলা আছে, ‘স্ত্রিয়ঃ সতীঃ ত উ যে পুংসঃ আহুঃ।’ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১:১১:৪) অর্থাৎ নারী হয়েও তারা পুরুষ। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের যুগ থেকে শিক্ষিতা নারীর সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়, ক্রমে যে অবস্থা দাঁড়াল তাতে গণিকা ছাড়া শিক্ষাতে আর কোনও নারীর অধিকার ছিল না। অনুমান করা যায়, সঙ্গীত নৃত্য ও চিত্রশিল্পে কিছু কিছু কুমারীর অধিকার ছিল, কিন্তু অন্যান্য বিদ্যা থেকে সাধারণ ভাবে সে বঞ্চিতই ছিল। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল; বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ পণ্ডিত কন্যা পাওয়ার জন্যে পিতামাতার আচরণীয় অনুষ্ঠানের কথাও আছে (৬:৪:১৩); কিন্তু সে ব্যতিক্রমই।
সোমযাগের একটা পর্বে যজ্ঞের কয়েকটি পাত্রকে মাটিতে রাখা হয়, বাকি কয়েকটিকে ওপরে তুলে ধরা হয়; এ প্রসঙ্গে শুনি, ‘সেইজন্যে সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে মাটিতে রাখা হয়, শিশুপুত্রকে তুলে ধরা হয়।’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:১০:৩) সমাজে নারী জন্মাবধি এই স্থানই পায়— পুরুষের নিচে।
পুরুষের বহুবিবাহ ঋগ্বেদ-এর যুগ থেকেই চলে আসছে। তবে সে সময়ে নারীরও বহুপতিত্বে অধিকার ছিল, যদিও এ অধিকার সে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হারায়। তৈত্তিরীয় সংহিতা ও ব্রাহ্মণ-এ পড়ি, ‘যজ্ঞে একটি দণ্ডকে বেষ্টন করে থাকে দুটি বস্ত্রখণ্ড; তাই পুরুষ দুটি স্ত্রী গ্রহণে অধিকারী; একটি বস্ত্রখণ্ডকে দুটি দণ্ড বেষ্টন করে না, তাই নারীর দ্বিপতিত্ব নিষিদ্ধ।’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৬:৪:৩; তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১:৩:১০:৫৮) অন্যত্রও শুনি, ‘একস্য পুংসো বহেব্যা জায়া ভবন্তি। এক পুরুষের বহু পত্নী হয়।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৯:৪:১৬) বলা বাহুল্য এই ধরনের শাস্ত্র হেতুনির্ণয়ের ছলে যজ্ঞের বিধিবিধানের দোহাই পাড়লেও আসলে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজের প্রচলিত কিছু আচরণের শাস্ত্রীয় সমর্থন জোগানো। এবং, এ ধরনের ব্যাখ্যায় শুধু পুরুষের পক্ষে সুবিধাজনক আচরণেরই সমর্থন পাওয়া যায়। সম্ভবত পূর্ববর্তী কালে প্রচলিত নারীর বহুপতিত্ব এ সময়েই নিষিদ্ধ হতে শুরু হয়। তাই আপাত-যুক্তির মতো এক যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানের অনুপুঙ্খকে হেতুরূপে উপস্থাপিত করা হল। এখানে পুরুষের দুটি স্ত্রী গ্রহণের কথা বলা থাকলেও কার্যত পুরুষের বহুবিবাহের অনেক নিদর্শন দেখতে পাই। (ঋগ্বেদ ৭:২৬:৩) রাজাদের তো বৈধ পত্নীই থাকত চারটি যজুর্বেদ-এর আমল থেকেই— মহিষী, বাবাতা, পরিবৃত্তি (বা পরিবৃত্তী) ও পালাগলী। এ ছাড়াও বহু উপপত্নীও থাকত রাজ-অন্তঃপুরে। মৈত্রায়ণী সংহিতা-য় দেখি মনুর দশটি ও চন্দ্রের সাতাশটি স্ত্রী-র উল্লেখ আছে। বহু স্ত্রী থাকলেও তাদের প্রতি সমদর্শিতা নাকি প্রত্যাশিত ছিল, তাই চন্দ্র রোহিণীর প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিলেন বলে তাঁর যক্ষ্মা হয়। সেইজন্যে যক্ষ্মার অন্য নাম ‘জায়েন্য’। (তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৩:৫:১-৩) বিবাহে কন্যাকে দান করা হত। স্বামীকে নয়, স্বামীর পরিবারকে— ‘কুলায় হি স্ত্রী প্রদীয়তে।’ (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:১০:২৭:৩) এর কুফল আজও প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখা যায়—শ্বশুর শাশুড়ি ননদ ভাসুর দেওর সকলে মিলেই বধূকে যে নির্যাতন করে সে তো এই অধিকারেই।
চার
‘নারী পুরুষের অপরাধ’ শুনলে মনটা উল্লসিত হয়ে ওঠে, কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। কারণ পরের অংশটা হল, ‘সেজন্যে যতক্ষণ সে বধূলাভ না করে ও সন্তান না আসে ততক্ষণ পুরুষ অসম্পূর্ণ।’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:১:৮:৫) অর্থাৎ, সন্তানজন্মের জরুরি প্রয়োজনেই নারী পুরুষের অপরাধ, মানসিক বা সামাজিক কোনও সংজ্ঞায় নয়। ঋগ্বেদ-এ সদ্যোবধূকে আশীর্বাদ করা হচ্ছে, শ্বশুর শ্বাশুড়ি দেবর ননদ সকলের সম্রাজ্ঞী (বা অধীশ্বরী) হ’য়ো।’(১০:৮৫:৪৬) প্রথমত, বধূটির বাস্তবজীবনে সম্রাজ্ঞীত্ব দুর্লভ ছিল বলেই এ আশীর্বাদ। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী অসংখ্য শাস্ত্রবচনে এর খণ্ডন আছে। তাই অথর্ববেদ-এ পড়ি, ‘সূর্যোদয় হলে প্রেত তেমন করে ছুটে পালায় যেমন করে পুত্রবধূ শ্বশুরের সামনে থেকে ছুটে পালায়।’ (৮:৬:২৪) কোনও সম্রাজ্ঞী প্রজার সামনে থেকে কবে এমন করে ছুটে পালিয়েছে? উত্তম নারীর সংজ্ঞা হল, ‘যে স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর কথার ওপরে কথা না বলে।’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৩:২৪:২৭) পরবর্তীকালে এমনই কথা দেখি আপস্তম্বধর্মসূত্র-তে (১:১০:৫১-৫৩) এ ছবি আর যাই হোক, কোনও কালে কোনও সম্রাজ্ঞী বা অধীশ্বরীর নয়; বরং দীনতম প্রজার বা দাসীর, যে পুরুষ প্রভুর ভয়ে সংকোচে নেপথ্যচারিণী।
বিবাহের সব ক’টি মন্ত্রেই উচ্চারণ করে বলা হয় স্ত্রী যেন চিন্তায় ও কাজে স্বামীর অনুবর্তিনী হয়, স্বামীর চিত্তের অনুগামিনী হয়; কোথাও বলা নেই, স্ত্রীরও চিত্ত বলে একটা কিছু আছে এবং স্বামীকে তার প্রতি অনুকূল হতে হবে। মধ্যে মধ্যে শোনা যায়, সুন্দরী বধূ স্বামীর প্রেম লাভ করে। (শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩:১:৯:৬) এতে বধূকে দেহমাত্রসার করে দেখা হয় এবং তার যে অন্য কোনও আকর্ষণ থাকতে পারে সে কথা শাস্ত্রে কোথাও স্বীকৃতি পায়নি। সহজেই বোঝা যায়, সুন্দরী বধূরও রূপযৌবনে একদিন ভাঁটা পড়ে, তখন স্বামীর প্রেমে সে অধিকার হারায়। তাছাড়া ভাঁটা পড়বার আগেও সুন্দরীতরা নারী স্বামীর চোখে পড়লে তাকে এনে স্বামী পূর্ববর্তিনীর মর্যাদা খর্ব করে। তাই সপত্নীবিনাশের জন্যে, স্বামীর একনিষ্ঠ প্রেম পাওয়ার জন্যে বা স্বামীকে বশীভূত করার জন্যে বহুতর অভিচারক্রিয়ার মন্ত্র দেখতে পাই ঋগ্বেদ-এ ও অথর্ববেদ-এ। এ বিপদ সে দিনের নারীর কাছে কত ভয়াবহ রকমে বাস্তব ও সর্বনাশা হয়ে দেখা দিত তা আজ কল্পনা করাও কঠিন।
নারীর স্থান ক্রমেই অন্তঃপুরের গহনে সরে গেছে। ঋগ্বেদ-এ যোদ্ধা নারী মুদ্গলিনী, বিপলা, বধ্রিমতী, শশীয়সীর কথা পড়ি, যাঁদের কেউ যুদ্ধে আহত কেউবা যুদ্ধে বিজয়িনী। তবুও ঋগ্বেদের প্রথম যুগের পরে প্রকাশ্য সমাজ-জীবনে নারীর আর কোনও ভূমিকা রইল না (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালেও মেসেগা অবরোধকালে ভারতীয় নারী যোদ্ধার কথা কার্টিয়াস উল্লেখ করেছেন। কিন্তু, ততদিনে এ ভূমিকা ব্যতিক্রম, আপদ্ধর্মে পর্যবসিত)। ব্রাহ্মণের যুগেই নারীকে অবরোধে রাখার কথা শুনি, ‘নইলে তার শক্তিক্ষয় হবে!’ (শতপথ ব্ৰাহ্মণ ১৪:১:১:৩১) এ কোন্ শক্তি যা শুধু অবরোধে থাকলেই অক্ষুণ্ণ থাকে? অথর্ববেদে অনেকগুলি ‘প্রতিষ্ঠাপন’ সূক্ত আছে, এগুলি পলাতকা বা পলায়নে উদ্যতা স্ত্রীকে অন্তঃপুরে ধরে রাখবার জন্যে প্রয়োগ করা হত। কাজেই অন্তঃপুরবাসিনী ক্রমেই বন্দিনী হয়ে উঠছিল।
পাঁচ
গোষ্ঠীবদ্ধ, কৌমবদ্ধ সমাজ ভেঙে ধীরে ধীরে পরিবার-আশ্রিত বা ‘কুল’-বদ্ধ সমাজ প্রবর্তিত হচ্ছিল। একটি বৃহৎ পরিবারের বাসগৃহের নাম ‘কুল’, এখানে তিন-চার পুরুষের সংসার। এ সংসারের ছোট ছোট বিভাগে একটি পুরুষকে ঘিরে তার নিজস্ব যে পরিবার সেখানে স্বামীই সর্বময় কর্তা। এবং ওই বৃহৎ যৌথ পরিবারের পরিবেশের মধ্যেই, গুরুজন এবং ছেলেমেয়েদের সামনেই, সে পুরুষ একে একে বহু নারীকে নিয়ে আসছে পত্নীরূপে। এই স্বাধীনতা কিন্তু তার স্ত্রীর নেই, কারণ, ‘এক স্বামীর বহু স্ত্রী থাকলেও একটি স্বামীই তাদের পক্ষে যথেষ্ট।’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩:৫:৩:৪৭) তেমনই খেয়ালখুশি মতো পুরুষ গণিকালয়ে যেতে পারত, তার উপপত্নী ও গণিকাসম্ভোগে সমাজ কোনও বাধা দেয়নি; কিন্তু স্বামীর হাজার দোষ থাকলেও নারী উপপতি গ্রহণ করলে সমাজে সেটা মহাপাতক বলে গণ্য করা হত। আর গণিকালয়ের মতো কোনও বিকল্প ব্যবস্থা তো নারীর জন্যে কখনওই কোথাও ছিল না।
বিবাহকালে বর বলে, ‘এস আমরা মিলিত হই, যেন পুত্রসন্তান উৎপন্ন হয়, যে সন্তান দ্বারা সম্পত্তিবৃদ্ধি হবে।’ এরই শেষাংশে প্রার্থনা আছে, পুত্র, পৌত্র, দাস, শিষ্য, বস্ত্র, কম্বল, ধাতু, বহু ভার্যা, রাজা, অন্ন ও নিরাপত্তার জন্যে। (হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ১:৬:১২:১৪) লক্ষ্য করতে হবে যে প্রথমত, বিবাহের সময়েই, নব-বিবাহিত বধূর সঙ্গে এবং তার সামনেই ‘বহু ভার্যা’র জন্যে প্রার্থনা করা হচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত, কতকগুলি ভোগ্য বস্তুর সঙ্গে ‘বহু ভার্যা’র উল্লেখ। ব্যতিক্রম পুত্র-পৌত্র, শিষ্য ও রাজা; এর মধ্যে পুত্র-পৌত্র নিজের ব্যক্তিসত্তারই সম্প্রসারণ,— কালে, অর্থাৎ মৃত্যুর পরও যাতে বংশধারার বিলোপ না হয়; শিষ্য জীবিকার পক্ষে অত্যাবশ্যক, আর রাজা নিরাপত্তার পক্ষে। নইলে বস্ত্র, কম্বল, ধাতু, দাস ও ‘বহু ভার্যা’ সবই ভোগ্য বস্তু। কন্যা সম্প্রদানের সময়ে মাতামহ পিতামহের উল্লেখ আছে, মাতামহী পিতামহীর নেই, অথচ পিতামাতা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন এঁদের অবলম্বন করেই। বিবাহে কন্যা সম্বন্ধে পুরুষের পাঁচটি কাম্যবস্তু, ধন, রূপ, বিদ্যা, বুদ্ধি ও বংশ। এর মধ্যে বিদ্যা ও বুদ্ধির সত্যি কোনও উপযোগিতা আছে কিনা তা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। (মানবগৃহ্যসূত্র ১:৭৬; অন্যত্রও আছে।)
স্ত্রীর প্রধান প্রয়োজন হল সে সন্তানের জননী এবং তার প্রধান কর্তব্য হল, পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়া। (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:১০-৫১-৫৩) নিঃসন্তান বধূকে বিবাহের দশ বছর পরে ত্যাগ করা যায়, যে স্ত্রী শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় তাকে বারো বছর পরে, মৃতবৎসকে পনেরো বছর পরে এবং কলহপরায়ণাকে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করা যায়। (বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২:৪:৬; আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:৫:১১-১৪, মনুসংহিতা ৯:৪) পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে না পারলে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার বিধান বহু প্রাচীন; শতপথ ব্রাহ্মণ-এই পড়ি, ‘যা বা অপুত্রা পত্নী সা পরিবৃত্তী— যে অপুত্রা পত্নী সে পরিত্যক্তা’; (৫:২:৩:১৩) এবং পুত্রসন্তান না জন্মালে স্বামী আবার বিয়ে করতে পারবে। (বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২৮:২-৩) অপরপক্ষে মানবিকতার বোধে অনুপ্রাণিত শাস্ত্রবাক্যও আছে, যেমন ‘কলহপ্রিয়া, অশুচি, গৃহত্যাগিনী, বলাৎকৃতা, চৌরগৃহীতা হলেও স্ত্রী ত্যাগ করা চলে না; ভ্রষ্টা স্ত্রীও প্রায়শ্চিত্তে শুচি হয়।’ (বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২১:৮-১০) আপস্তম্ব বলেন স্ত্রীপরিত্যাগী স্বামীর কঠোর দণ্ডবিধান করা উচিত। (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:১০-১৯, ২৮) স্ত্রীকে কটুকথা বললেও একদিন উপবাসের প্রায়শ্চিত্ত বিধান আছে। (বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২:২:৬৩, ৬৪) কিন্তু সমাজ এ-বিষয়ে কী ভাবত তার জন্যে উদাহরণ দেখা যেতে পারে। কোনও কোনও ধর্মশাস্ত্রে আছে বলাৎকৃতা নারীকে পরের মাস থেকে স্বামী শুচি জ্ঞান করবেন; বশিষ্ঠ বলছেন বলাৎকৃতা নারী প্রায়শ্চিত্তে শুচি হন। আপস্তম্ব বলছেন স্ত্রীকে কটুকথা বললেও প্রায়শ্চিত্তের জন্যে একদিন উপবাস করতে হবে। অবশ্য স্বামীকে কটুকথা বললে স্ত্রী তৎক্ষণাৎ পরিত্যাক্তা হতেন।
সে যাই হোক, রামচন্দ্র তো নিশ্চয়ই এসব জানতেন, বিশেষত যখন শাস্ত্রকাররা তাঁকে আদর্শ চরিত্র বলেছেন। (রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং ন রাবণাদিবৎ—রামের মতো আচরণ করা উচিত, রাবণের মতো নয়)। সেই রামচন্দ্র যদি সত্যি বিশ্বাসও করে থাকেন যে সীতা অশুচি, তাহলেও তো শাস্ত্রানুসারে একমাস পরে তাঁকে শুচি জ্ঞান করতে পারতেন। প্রায়শ্চিত্তে শুদ্ধত্ব সম্পাদন করতে পারতেন, এবং নিজে যে সব অন্যায় ও মিথ্যা কটুকথা সীতাকে বলেছিলেন তার জন্যে তাঁর উপবাস করা উচিত ছিল, এবং স্ত্রীপরিত্যাগী স্বামীর দণ্ডও তাঁর পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ সবের কিছুই তিনি করেননি, আশ্চর্য চরিত্র হয়েও কোনও দণ্ড বা প্রায়শ্চিত্তও তাঁর হয়নি, কাজেই, অন্যে পরে কা কথা। অর্থাৎ ওইসব মানবিক নির্দেশ ছিল শুধু শাস্ত্রকারদের ‘সমদর্শিতা’ প্রতিপাদনের জন্যে, কার্যক্ষেত্রে পুরুষশাসিত সমাজে ওসব বইয়ের পাতাতেই থাকত। এই ধরনের শুনতে ভাল বিধান আরও আছে, ‘ধর্ষিতা নারীকে ধর্ষণকারী বিয়ে না করলে বিধিমতে বিনা পণেই তার বিয়ে হতে পারে।’ (বৌধায়ন ধর্মসূত্র ৪:১:১৫-১৬) কিন্তু সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যে ভ্রষ্টা স্ত্রী সমাজের কাছে দণ্ডবিধান ছাড়া কোনও কিছুই পায়নি। তেমনই একাধিক ধর্মশাস্ত্রকার বলছেন ভ্রষ্টা স্ত্রীকে স্বামী পরিত্যাগ করলে (তাহলে ওইসব উদার শাস্ত্রবাক্য সত্ত্বেও স্বামী তাকে পরিত্যাগ করত!) পুত্র তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে। স্পষ্টই বোঝা যায়, তথাকথিত যৌন দুর্নীতি সম্বন্ধে সমাজে পরিষ্কার দু’ধরনের বিধান ছিল, একটি পুরুষের জন্যে একটি নারীর জন্যে। নারীর ক্ষেত্রেই যৌন অপরাধ অপরাধ, পুরুষের ক্ষেত্রে সমাজ অনেক প্রশ্রয়শীল ছিল। যে দেশে ‘সতী’ শব্দের ওই অর্থে কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দই নেই, সে দেশের সমাজে অন্য রকম কিছু আশা করাও যায় না।
‘কুমারী কন্যার পিতা যথাকালে বিবাহ দিতে না পারলে সে তিন বছর (বা তিন মাস) পরে যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু বিয়ে তাকে কোনও রকম অধিকার দেবে না, সব অবস্থাতেই সে পুরুষের অধীন।’ বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র-তে পড়ি, ‘পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষিত যৌবনে/রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বতন্ত্র্যমহতি।।’ (৫:১-২, ২:২, ৩, ৪৪, ৪৫) অর্থাৎ, নারীকে কুমারী অবস্থায় রক্ষা করবেন পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা; নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। কত আগে শতপথ ব্রাহ্মণ-এ দেখি, ‘স্ত্রিয়ঃ পুংসো নুবত্মানো ভাবুকাঃ।’ (১৩:২:২৪) অর্থাৎ, নারীর পুরুষের অনুপথগামিনী হওয়া উচিত। বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ পড়ি, ‘পতিং বা অনু জায়া।’ (১:৯:২:১৪) অর্থাৎ, স্ত্রী স্বামীর পশ্চাতে। মনে পড়ে যায়, ঋগ্বেদ-এ ঊষার বর্ণনা, ‘ঊষো যাতি স্বসরস্য পত্নী— সূর্যের পত্নী ঊষা চলেছে।’ (১:১১৫:২) কোথায়? সূর্যের বা স্বামীর আগে আগে। তার পরে নদীতে অনেক জল বয়ে গেছে, তখন ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের যুগে স্ত্রী স্বামীর অনুগামিনী, অধীন। একদিকে বলা হচ্ছে, ‘শিয়া বা এতদ্রুপং যৎ পত্ন্যঃ’ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩:৯:৪:১৯), অর্থাৎ পত্নীই হল সমৃদ্ধির রূপ; অন্যদিকে শুনি, ‘তদ্বৈ সমৃদ্ধং যস্য কনীয়াংসো ভার্যা আসন্ ভূয়াংসঃ পশবঃ— তারই হল সমৃদ্ধি, যার পশুপালের চেয়ে স্ত্রীরা সংখ্যায় কম। (শতপথ ব্রাহ্মণ ২:৩:২:৮) এক তো পশুপালের সঙ্গে একনিঃশ্বাসে উচ্চারিত হল স্ত্রী; দ্বিতীয়ত, কত সংখ্যায় স্ত্রী থাকার সম্ভাবনা থাকলে সে সংখ্যা পশুপালের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।
ছয়
নারীকে যথেচ্ছ শাসন ও ভোগ করবার অধিকার শাস্ত্র পুরুষকে দিয়েছে, কিন্তু তার জন্যে দায়িত্ব যা দিয়েছে তা নেহাৎই নগণ্য। বৌধায়নধর্মসূত্র-তে অবশ্য পড়ি, ‘সর্বেষাং বর্ণনাং বধূ রক্ষ্যতমা ধনাৎ’, অর্থাৎ সমস্ত বর্ণেরই উচিত ধনের চেয়ে স্ত্রীকে রক্ষা করা। (২:৪২) কিন্তু কার্যত যে নীতি অনুসৃত হত তা হল চাণক্যের সেই চূড়ান্ত সুবিধাবাদী নীতিটি: ‘আত্মানং সততং রক্ষেদ্দারৈরপি ধনৈরপি।— নিজেকে সর্বদাই রক্ষা করবে, প্রয়োজন হলে ধন বা স্ত্রীর বিনিময়েও।’ বৈদিক বা পরবর্তী সাহিত্যে ধনের বিনিময়ে স্ত্রীকে রক্ষা করার কোনও নজিরই মেলে না। বৈদিক যুগের একেবারে প্রথম পর্বের পরে শিক্ষাতেও নারীর আর অধিকার নেই; কারণ দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া উপনয়নে তার অধিকার নেই। জন্মাবধি তার সম্বন্ধে সমস্ত সংস্কারই অমন্ত্রক; সে নিজে মন্ত্র উচ্চারণে বা হব্যদানে অনধিকারিণী; এবং সে যুগে বিদ্যা তো মন্ত্র দিয়েই হত, কাজেই বিদ্যা অর্জনে তার আর অধিকার রইল না। অমন্ত্ৰক বিদ্যা অর্থাৎ সামান্য কিছু গানবাজনা, সেলাইবোনা, হাতের কাজ আর যাবতীয় গৃহকর্ম, স্বামী সন্তান ও শ্বশুরকুলের উদয়াস্ত সেবাই ছিল তার কাজ। সন্তানের, মুখ্যত পুরুষসন্তানের জননী হওয়াতেই তার চূড়ান্ত চরিতার্থতা। অথচ অন্য সব দেশের মতো এখানেও কিছু পুরুষের শিক্ষিতা নারীর সান্নিধ্য পাওয়ার স্বাভাবিক সুস্থ আকাঙ্ক্ষা ছিল। সে আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হতে পারত একমাত্র গণিকালয়ে; কারণ একমাত্র গণিকাই ছিল শিক্ষিতা; এবং প্রাচীন ভারতে সে-ই একমাত্র স্বাধীন নারী ছিল। কুলবধূকে শিক্ষা থেকে সর্বতো ভাবে বঞ্চিত করে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে, গণিকাকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী করে সমাজ কুলনারীর প্রতি চূড়ান্ত অপমানের ব্যবস্থা করেছিল। সন্তানধারণে এবং লালনে, গৃহকর্মে এবং পরিচর্যায় হতশ্রী ও বিগতযৌবনা অশিক্ষিতা স্ত্রী যখন স্বামীর মনোরঞ্জনে অক্ষম, তখন স্বাধীনযৌবনা শিক্ষিত গণিকার দিকে খিড়কির দরজা খুলে রেখে সমাজ কুলনারীকে অসম্মানের পাত্রী করে তুলতে দ্বিধা করেনি।
সোমযাগের একটি প্রকরণ হল অগ্নি পত্নীবৎ। সেখানে আছে, ‘বজ্র বা লাঠি দিয়ে নারীকে মেরে দুর্বল করা উচিত, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির ওপরে তার কোনও অধিকার না থাকে।’ (শতপথ ব্রাহ্মণ ৪:৪:২:১৩) এখানে যজ্ঞের প্রসঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে যজ্ঞীয় হবি-কে কেন লাঠি দিয়ে মারতে হবে তারই ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এ কথা এসেছে; কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায় শাস্ত্র ওই ব্যাখ্যার ছলে স্ত্রীকে লাঠি দিয়ে মারবার অবাধ অধিকার পুরুষকে দিচ্ছে। আর দিচ্ছে সমস্ত সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করবার অধিকার; এবং তার চেয়েও বড় কথা, তার নিজের দেহের ওপরেও তার কোনও অধিকার যেন না থাকে সে ব্যবস্থাও পাকা করছে। এতে প্রচলিত সামাজিক আচরণেরই শাস্ত্রীয় সমর্থন মেলে। সবচেয়ে বিখ্যাত এবং দীর্ঘ যে বৃহদারণ্যকোপনিষদ, তাতে স্বয়ং ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য বলছেন: ‘স্ত্রী স্বামীর সম্ভোগকামনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হলে প্রথমে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে ‘কেনবার’ চেষ্টা করবে (যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হল ‘অবক্রীণীয়াৎ, যেন স্ত্রী পণ্যদ্রব্য), তাতেও অসম্মত হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে।’ (৬:৪:৭) কাজেই স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে নারীর মন বলে কিছু আছে, এ কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে, তার দেহে তার কোনও অধিকার নেই এবং তাকে অসম্মান শুধু নয়, মারধর করারও পূর্ণ অধিকার স্বামীকে দেওয়া হল, যে-স্বামী বহু পত্নীকে ইচ্ছেমত আনলে, জারিণী বা উপপত্নী সান্নিধ্যে গেলে এমনকী গণিকালয়ে গেলেও স্ত্রী কোনও ভাবে উচ্চবাচ্য করতে পারবেন না। করলেই তাঁকে ত্যাগ করবার অধিকার স্বামীর আছে। মনে রাখতে হবে সমাজে এ ত্যাগের অর্থ ছিল কী— গণিকাবৃত্তি বা দাসীবৃত্তি ছাড়া পরিত্যক্তা নারীর কোনও গতি ছিল না। তার নিজের সম্পত্তি থাকত না এবং পিতা বা স্বামীর ধনে তার কোনও অধিকারও স্বীকৃত ছিল না। (মৈত্রায়ণী সংহিতা ১:১০:১১; ৩:৬:৩; তৈত্তিরীয় সংহিতা ৪:৫:৮:৭) এবং, জীবনধারণের উপযোগী কোনও বৃত্তির শিক্ষা তাকে দেওয়া হত না। ফলে শুধু বেঁচে থাকার জন্যে তাকে সর্বতো ভাবে স্বামীর অধীনে থাকতে হত।
বারবার বলা হয়েছে যে নারীর সভায় যাওয়ার অধিকার নেই। (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৪:৭:৪) কোনও শিক্ষা পাওয়ার, ধন অর্জন বা স্বাধীন ভাবে ভোগ করবার, এমনকী নিজের দেহটিকে ও অবাঞ্ছিত সম্ভোগ থেকে রক্ষা করবারও অধিকার তার নেই। (মৈত্রায়ণী সংহিতা ৩:৬:৩; ৪:৬:৭; ৪:৭:৪; ১০:১০:১১; তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:৮:২) তার ছেলেমেয়েদের সামনেই তার স্বামী একাধিক পত্নী, উপপত্নী এনে অথবা গণিকাগমন করে তাকে অসম্মান করলে নিষ্প্রতিবাদে তাকে তা সহ্য করতে হবে, অথচ স্ত্রীর সামান্যতম পদস্খলনে সমাজ কঠোর ভাবে দণ্ড দেবে। আপস্তম্ব ধর্মসূত্র(২৩:৪) ও হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র(১:৪:১৪:২) ব্যভিচারিণী নারীর যে দণ্ডের বিধান দিয়েছে তা যেমন নিষ্ঠুর তেমনই ঘৃণ্য; উচ্চারণ করতেও জুগুপ্সা বোধ হয়। স্ত্রীর প্রেমিকাকে হত্যা করবার জন্যে শাস্ত্রে ধর্মীয় অভিচারক্রিয়ার বিধান ও নির্দেশ দেওয়া আছে। (বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৪:৪:১২, ১৩; হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ১:৪:১৪:৭) অথচ অনুরূপ ক্ষেত্রে পুরুষের কোনও দণ্ড নেই। সে তার বহু পত্নী, উপপত্নী এবং যথেচ্ছ গণিকালয় গমনের অবাধ অধিকার সযত্নে রক্ষা করেছিল। ‘প্রাজাপত্য’ নামে লঘু একদিনের নামমাত্র প্রায়শ্চিত্তের বিধান কোথাও কোথাও আছে বটে, কিন্তু সুবৃহৎ সংস্কৃত সাহিত্যে কোনও গণিকাগামী কখনও কোনও প্রায়শ্চিত্ত করেনি।
সাত
তাহলে বৈদিক ভারত নারীকে কি চোখে দেখেছিল? নারী অশুচি, স্বভাবত পাপিষ্ঠা ও অমঙ্গলের হেতু। চাতুর্মাস্যের অন্তর্গত বরুণপ্রঘাস যজ্ঞে প্রকাশ্য জনবহুল যজ্ঞসভায় প্রতিপ্রস্থাতা পুরোহিত যজমানপত্নীকে (যজমানকে নয় কিন্তু) প্রশ্ন করতেন, ‘কেন সহ চরসি’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৫:২:২০), অর্থাৎ কার সঙ্গে ব্যভিচারিণী হয়েছ? এ প্রকাশ্য অপমান সহ্য করে তাকে উত্তর দিতে হত। নইলে যজ্ঞ নষ্ট হবে যে! মৈত্রায়ণী সংহিতা উচ্চারণ করেই বলেছে, ‘নারী অশুভ’। (৩:৮:৩, তৈত্তিরীয় সংহিতা-তেও একই কথা বলা হয়েছে ৬:৫:৮:২।) যজ্ঞকালে কুকুর, শূদ্র ও নারীর দিকে তাকাবে না। (শতপথব্রাহ্মণ ৩:২:৪:৬) এ সব উক্তি এমনই স্পষ্ট যে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার কোনও অবকাশই নেই।
নারীর সর্বপ্রধান সংজ্ঞা দুটি, তার স্থানও ওই দুটিতেই সীমাবদ্ধ: সে পুত্রের জননী এবং সে ভোগ্যবস্তু। তৈত্তিরীয় সংহিতা-তেই শুনি, ‘তস্মাদু হ স্ত্রিয়ো ভোগমেব হারয়ন্তে— নারী সম্ভোগ আনে।’ (২:৩:১০:৭) এটির রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক, তার মানে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষ নারীকে ভোগ্যবস্তু-রূপে দেখছে। পরবর্তীকালের গৌতমধর্মসূত্র-তে পড়ি, ‘পশুভূমিস্ত্রীণামনতিভোগঃ,— পশু, ভূমি ও নারীর অধিক ভোগ নয়।’(১২:৩৯) শাস্ত্রকাররা বারবার নারীর ভোগ্যরূপ উল্লেখ করেছেন অকুণ্ঠ, নির্লজ্জ ভাবে। তাই নারী দক্ষিণার তালিকায় স্থান পায়। ‘সারস্বতানাময়ন’ যাগের দক্ষিণা হল একটি ঘোটকী এবং একটি সন্তানবতী দাসী। (শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ১২:২৯:২১) ঘোড়া ব্যবহারে লাগবে, দাসীর পুত্র বড় হয়ে ভৃত্য হবে, দাসী স্বয়ং ভোগ্যবস্তু হবে অর্থাৎ দক্ষিণা বাবদে এগুলো বিনামূল্যে পাওয়া গেল। পেলেন কে? যজ্ঞের ব্রাহ্মণ পুরোহিত! অন্যান্য বহু যজ্ঞে নানা স্তরের নারী দক্ষিণা— সন্তানবতী, অপ্রসূতা ও অনুঢ়া— শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে। রামায়ণ মহাভারত-এর কাহিনিগুলি বৈদিক যুগের অল্প পরের সমাজেরই চিত্র বহন করে; সেখানে এবং পরবর্তী পুরাণগুলিতে অসংখ্যবার পড়ি অতিথিসৎকারে, উৎসবে, যুদ্ধে, যজ্ঞে, যৌতুকে, দানে ও দক্ষিণায় গাভী-স্বর্ণ-শস্য-রথ-গজ-অশ্বের সঙ্গেই অগণ্য নারী দান করা হচ্ছে। এমন দান সম্ভবই হত না যদি নারীকে বস্তু এবং মুখ্যত ভোগ্যবস্তু বলে না দেখা হত। নারী সম্পত্তি, তাই নারীকে জুয়াখেলায় পণ রাখা যাচ্ছে। সেই ঋগ্বেদ-এর সময় থেকে (অক্ষসূক্ত ১০:৩৪:৪) মহাভারত পর্যন্ত।
‘কন্যা অভিশাপ’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৬:৩:৭:১৩); তাই সন্তানসম্ভবা নারীর একটি আবশ্যিক অনুষ্ঠান হল ‘পুংসবন’, যার উদ্দেশ্য হল যাতে গর্ভস্থ সন্তানটি পুরুষ হয়। আপস্তম্ব ধর্মসূত্র-তে পড়ি, ‘নারীং ন হৃদয়েন প্রার্থয়েৎ।’ (১:২৭৭:১-১০) অর্থাৎ, হৃদয় দিয়ে নারীকে প্রার্থনা করা উচিত নয়; কিন্তু যথেচ্ছ ভোগ করার কোনও বাধা নেই। ‘নারী মিথ্যাচারিণী, দুর্ভাগ্যস্বরূপিণী, সুরা বা দ্যুতক্রীড়ার মত একটি ব্যসনমাত্র।’ (মৈত্রায়ণী সংহিতা ১:১০:১১; ৩:৬:৩) খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের কাছাকাছি রচনা এই সংহিতা; এবং অত আগেই নারী ব্যসনে পর্যবসিত হয়ে গেছে। ‘নারী রাত্রে স্বামীকে মুগ্ধ করে নিজের ইষ্টসিদ্ধি করে নেয়’ (কাঠকসংহিতা ৩১:১: ওই সময়েরই রচনা।) অর্থাৎ, নারী ছলনাময়ী, স্বার্থপর; যেন পুরুষ উৎকৃষ্টতর জীব, এ সব দোষ তার নেই। ‘সর্বগুণান্বিতা শ্রেষ্ঠ নারীও তাই অধমতম পুরুষের থেকে হীন।’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:৮:২) অনৃত অর্থাৎ মিথ্যা কী? ‘স্ত্রী, শূদ্র, কুকুর, কাল পাখি— এদের দেখো না; নইলে শ্রী ও পাপ, জ্যোতি ও অন্ধকার, সত্য ও মিথ্যা মিশে যাবে।’ (শতপথব্রাহ্মণ ১৪:১:১:৩১১) স্ত্রী স্বামীর পরে খাবে— ‘ভক্তোচ্ছিষ্টং বধ্বৈ দদাৎ,–খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে। (খাদির গৃহ্যসূত্র ১:৪:১১) এর থেকে স্পষ্ট করে নারীর স্থান নির্ণয় করা কঠিন। যেখানে দাস সম্বন্ধে বলা হয়েছে জীর্ণ জুতো কাপড় দাসকে দেবে এবং স্ত্রী সম্বন্ধে বলা হয়েছে খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে খেতে দেবে— সেখানে স্ত্রীকে কোন্ পর্যায়ে দেখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে কোনও সংশয়েরও অবকাশ আর রইল না। এ কথা সবচেয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে আপস্তম্ব ধর্মসূত্ৰ-তে: ‘কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো ও কুকুর হত্যা করলে যে প্রায়শ্চিত্ত, নারীহত্যা ও শূদ্র হত্যাতেও সেই একই প্রায়শ্চিত্ত’, অর্থাৎ মাত্র একদিন কৃচ্ছসাধন। (১:৯:২৩, ৪৫)
পরবর্তী সাহিত্য যে নারীকে ভোগ্যবস্তু ও পণ্যদ্রব্য বলতে সাহস করেছে তার জোরটা জুগিয়েছে বৈদিক সাহিত্যই। ক্রমেই অবশ্য ওই ভোগ্যত্ব ও পণ্যত্বেই জোর দেওয়া বেড়েছে। রামচন্দ্র সীতাকে প্রত্যাখ্যান করবার সময়েও বলেছেন পরহস্তগতা নারীকে তিনি ‘ভোগ’ করতে পারবেন না; এই হল প্রাচীন ভারতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল কথা। ক্রমেই অবরোধের দুর্ভেদ্য অন্তরালে নারীকে সরে যেতে হয়েছে। কেন এমন হল? কেন ধীরে ধীরে নারীর ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে সে বস্তুতে পরিণত হল? এর বিস্তৃত বিশ্লেষণ এখানে করব না, শুধু একটা দিকের কথাই বলব। সম্পত্তিতে গোষ্ঠীগত সত্ত্বাধিকার থেকে যখন ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল অর্থাৎ গোষ্ঠী ও কৌম ভেঙে ‘কুল’ বা যৌথ পরিবারই সমাজের ন্যূনতম সংগঠন হল ততদিনে সমাজে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে। উৎপাদনে কিছু উদ্বৃত্ত ধনের সৃষ্টি হয়েছে এবং সে উদ্বৃত্ত ধন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মধ্যে বিভক্ত হচ্ছে। এই ধন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্ষরিক অর্থে স্বোপার্জিত নয়— নিচের দিকের মানুষের শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করে, শোষণ করে পাওয়া গেছে— তা যেহেতু কোনও ব্যক্তিগত গুণ বা যোগ্যতার দ্বারা লব্ধ নয়, তাই সে সম্বন্ধে ধনাধিকারীর যেন একটি অতিরিক্ত স্বত্ত্বাধিকারবোধ জন্মায়। এবং, তারই সঙ্গে একটা আতঙ্কও আসে, পাছে সেটা তার নিজের এবং নিজের সন্তান বা বংশধারার দখলের বাইরে চলে যায়। ব্যক্তির পরমায়ুর তো সীমা আছে, তারপরে? তার পরেও যাতে সে-ধন তারই বংশধররা ভোগ করতে পারে সে সম্বন্ধে ভীষণ একটা আকাঙ্ক্ষা ও উদ্বেগ জন্মায়। এ ধন কার হাতে দিয়ে যাওয়া যায়, নিশ্চিত ভাবে নিজেরই সন্ততি ছাড়া? কেমন করে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় সন্তানটি ঠিক তারই কিনা? স্ত্রীকে চোখে চোখে রেখে। যথাসম্ভব পর পুরুষের সম্পর্ক থেকে দূরে রেখে। এই কারণেই নারীর বহুপতিত্ব সমাজে নিষিদ্ধ হয়ে গেল, কারণ তাতে সন্তানের পিতৃপরিচয় সংশয়িত থেকে যায়।
ভুলে গেলে চলবে না, এ যুগের পূর্বযুগে যখন সমাজ গোষ্ঠী ও কৌমবদ্ধ ছিল তখন সকল সন্তানই কৌম বা গোষ্ঠীর সন্তান বলে পরিচিত ছিল; তখন পিতৃত্ব বা পতিত্বের সীমা এমন সুস্পষ্ট মোটা দাগে আঁকা ছিল না। এ ব্যাপারটা তখনও জীবিত স্মৃতির মধ্যেই ছিল তাই আরও আতঙ্ক। গোষ্ঠীযুগে সব নারীই গোষ্ঠীর বা কৌমের সব পুরুষের ভোগ্যা ছিল, সব পুরুষও সব নারীর। নারীর সে ধরনের স্বাধীনতার যুগে স্ত্রীর বা সন্তানের পরিচয় একটি পুরুষের সঙ্গে এমন একান্ত ও অচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত ছিল না। সে যুগ সদ্য পেরিয়ে এসে ব্যক্তিগত মালিকানার দিনে সম্পত্তি যখন একান্ত ও নিশ্চিত ভাবে নিজেরই সন্তানের জন্যে রেখে যাওয়ার উগ্র বাসনা জাগল, তখন যাতে ঔরসজাত সন্তানটিকে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করতে পারা যায় তাই স্ত্রীকে অন্য সব পুরুষ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখার এমন প্রয়োজন বোধ হল। তাছাড়া স্ত্রীও তো তখন সম্পত্তি, অতএব সে যাতে অন্যের ভোগ্যা না হয়, তার ওপরে ব্যক্তিগত মালিকানা তাই ষোল আনা জাহির করা চাই। আরও একটা কারণ ছিল; পুরুষের যথেচ্ছ পরনারী সম্ভোগের অধিকার তখন সমাজ মেনে নিয়েছে; সে তখন বৈধ বিবাহে— অনুলোম ও প্রতিলোমে— বহু পত্নীর স্বামী, আরও বহু উপপত্নীর উপপতি, এবং এ ছাড়াও তার খিড়কির দুয়ার খোলা গণিকালয়ের দিকে। এই জীবনে অভ্যস্ত পুরুষ স্বভাবতই তার একান্ত-ভোগ্য পত্নীটিকেও সেই রকম সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখবে, কারণ ‘আত্মবন্মন্যতে জগৎ’। তাই তার স্ত্রীর সম্বন্ধে তার পাহারা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গেল যখন নারী হল কয়েদি এবং স্বামী তার প্রহরী। এই হল উত্তর-বৈদিক যুগের সমাজচিত্র। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু সে ব্যতিক্রমই। পরবর্তী দুটি সহস্রাব্দে শেকলগুলো দৃঢ়তর হয়ে নারীকে পাকে পাকে ফেরে ফেরে বেঁধেছে, তালা আরও মজবুত হয়েছে। এর মধ্যে কখন যে প্রহরী নিজেই বন্দি হয়েছে তার স্বৈরাচারজনিত সংশয়ের ক্রুর বন্ধনে, কখন যে সে তার বন্ধু ও সহচারিণীকে হারিয়ে ফেলে তার বদলে পেয়েছে নিরক্ষর নিষ্প্রাণ এক যত্নতুল্য দাসীকে, তা সে নিজেই জানে না। নিরঙ্কুশ শাসন ও শোষণ মানুষ কখনও চিরদিন মানে না। যে-বঞ্চনা করতে পুরুষ এত আটঘাট বেঁধেছিল সে-বঞ্চনা শেষ পর্যন্ত তাকেও বঞ্চিত করেছে। আর, যে পরিমাণে নারী সে-বঞ্চনাকে নিজের মধ্যে নিষ্প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে সে পরিমাণে সেও তার স্বরচিত শৃঙ্খলে বন্দিনী। বৈদিক ভারতবর্ষে নারীর মর্যাদা ছিল না, মানুষ বলে তার কোনও স্বীকৃতিই ছিল না। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাতেও ছিল না, তবে তাদের উত্তরপুরুষেরা এখন সে-কথা স্বীকার করে— বলে, নারী এই শতাব্দীতেই প্রথম অধিকারসচেতন হয়েছে, আগে সে অত্যাচারিতা বন্দিনীই ছিল। শুধু আমাদের এখানেই জোর করে বলবার চেষ্টা হয়, বৈদিক যুগে নারী নাকি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। এতে শুধু যে সত্যের অপলাপ হয় তা নয়, অতীতকে যথার্থ ভাবে না দেখতে পাওয়ার জন্যে অতীতের যে বিষ বর্তমান সমাজদেহে সঞ্চারিত, তাকে চিনতে, তার প্রতিষেধ করতে এবং সুস্থ এক ভবিষ্যতের প্রস্তুতি বিধান করতে অনাবশ্যক দেরি হয়ে যায়।
খুব সুন্দর
যাযাবর পশুচারী আর্যরা এদেশে এসে ধীরে ধীরে এদের পরাজিত করে প্রায় সমস্ত আর্যবর্ত অধিকার করে-তারপরেই অলৌকিক ভাবে ভদ্র হয়ে বেদ রচনা করে ফেলল – ঘোষ, অপালা, বিশ্ববারার মতো নারীরা বৈদিক শ্লোক রচনা করেছিলেন । উপনিষদের যুগে গার্গীর মতো দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল । তিনি যাজ্ঞবল্ক্যের মতো পণ্ডিতের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন । উচ্চবর্ণের মহিলারা তাঁদের স্বামীর সঙ্গে যাগযজ্ঞে অংশ নিতেন । লীলাবতী ও খনার নাম তো আশা করি লেখক জানেন না -মনুস্মৃতি তে ৬৬ নং শ্লোকে নারীর উপনয়নের নির্দেশ আছে বা বিবাহের সময় উপনয়ন গ্রহন করতে বলা আছে