০৩. বৃহস্পতিবার দুপুরে স্কুল ছুটি

বৃহস্পতিবার দুপুরে স্কুল ছুটি হয়ে গেলে আমি রাশেদকে বললাম, আমাদের পাড়ায় যাবি?

কি আছে তোদের পাড়ায়?

আমরা আছি।

আমরা কারা?

আমি, ফজলু, দীলিপি। আশরাফও আছে।

ফজলু মনে করিয়ে দিল, কাদেরও আছে।

আমি হি হি কবে হেসে বললাম, কাদের আর কোন দিন তোর ধারে-কাছে আসবে না!

রাশেদ মাথা নেড়ে বলল, তা ঠিক।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, যাবি আমাদের সাথে?

তোরা কি করিস?

খেলি।

কি খেলিস?

ডাকাতি ডাকাতি খেলি। একটা কারখানা আছে, সেটাতেও খেলি।।

কারখানা? কিসের কারখানা?

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, এখনো ঠিক করি নাই গাড়ির কারখানা না হয় ওষুধের কারখানা। এখন অবিশ্যি খালি বিস্কুটের।

রাশেদ চোখ বড় বড় করে বলল, তোরা বিস্ত্ৰকূট বানাতে পারিস? কি দিয়ে বানাস? মিছিমিছ বিস্ত্ৰকূট?

না না, সত্যি বিস্কুট।।

দিলীপ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, বিস্ত্ৰকূট না কচু! আটার মাঝে চিনি মিশিয়ে চুলার মাঝে গরম করলেই যেন বিস্কৃঢ় হয়।

আমি বললাম, একবারেই সব হবে নাকি? আস্তে আস্তে হবে।

দিলীপ আবার মুখ বাকী করে বলল, মিষ্টি রুটির মত খেতে, হ্যাক থুঃ!

ফজলু একাই সবগুলি বিস্ত্ৰকূট খেয়ে ফেলেছিল, দিলীপের কথা শুনে গরম হয়ে বলল, হ্যাক থুঃ মানে? খেয়ে দেখেছিস?

রুটির মত নরমা লুতা লুতা। ময়লা কাল—

আমি বাধা দিয়ে বললাম, খাবার সোড়া দিতে হবে পরের বার। খাবার সোডা দিলে মুচমুচে হয়।

ফজলু বলল, আটা না দিয়ে ময়দা দিতে হবে। তাহলে দেখতে ভাল হবে।

দিলীপ তখনো মুখ কুঁচকে রেখেছে, মাথা ঝাকিয়ে বলল, কেরোসিনের গন্ধ —

ফজলু মহা বিরক্ত হয়ে বলল, তুই চুপ কর দেখি। সব কাজে শুধু সমালোচনা।

দিলীপের এত সমালোচনার পরও রাশেদকে বিস্কুটের কারখানায় খুব উৎসাহী দেখা গেল। বলল, ভাল করে যদি সত্যি সত্যি বিস্ত্ৰকূট বানাতে পারিস অনেক কাজ দেবে। তাই না?

কি কাজ দেবে?

দেশের সব গরিব বাচ্চাদের সকালে নাস্তা খাওয়ানোর জন্যে দেয়া যাবে।

আমাদের তখন মনে পড়ল, রাশেদ রাজনৈতিক মানুষ। সে সব সময়ই দেশের সব মানুষের কথা ভাবে। আমরাও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লাম, তা ঠিক।

ফজলু পর্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের গম্ভীর হয়ে বলল, তাহলে আগে ওষুধের কারখানা তৈরি করতে হবে। দেশের মানুষের দরকার ওষুধ। বিস্কট না খেলে কি হয়? কিন্তু অসুখ হলে ওষুধ খেতেই হয়।

দিলীপ আবার ঠোঁট উল্টে বলল, তোরা ওষুধ বানাবি? তোরা?

কেন, অসুবিধা কি?

কিসের ওষুধ?

জ্বর, সর্দি আর কাশি। সাথে মাথাব্যথা।

ফজলু যোগ করল, এবং পেটের অসুখ।

কেমন করে বানাবি?

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, কেন, শফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করব। শফিক ভাই বলে দেবে।

দিলীপ চুপ করে গেল। শফিক ভাই পারেন না। এমন কোন কাজ নেই। চুপ না করে উপায় কি? শফিক ভাই আমাদের পাড়ায় থাকেন। কলেজে পড়েন, আই. এস. সি, না যেন বি. এস. সি ঠিক মনে থাকে না। যখনই আমাদের কিছু দরকার হয় আমরা শফিক ভাইয়ের কাছে যাই। শফিক ভাই সব কিছুর একটা ব্যবস্থা করে দেন। আমাদের পাড়ায় আমরা যখন নাটক করলাম, শফিক ভাই আমাদের মুখোশ তৈরি করে দিয়েছিলেন (ইশঃ সে যে কি দারুণ একটা নাটক হয়েছিল!)। যখন আমরা সাকাসের দল খুলেছিলাম তখন শফিক ভাই আমাদের বিড়ালটাকে রং করে বাঘ তৈরি করে দিয়েছিলেন (একেবারে খাটি বাঘ, শুধু যদি মিয়াও করে না ডাকত!)। আমরা যখন ল্যাবরেটরী তৈরি করেছিলাম তখন শফিক ভাই লিটমাস পেপার আর চুম্বক এনে দিয়েছিলেন (কত যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আমরা করেছিলাম!)।

দিলীপ বলল, চল যাই শফিক ভাইয়ের কাছে।

চল।

আমার হেঁটে হেঁটে শফিক ভাইয়ের বাসার দিকে রওনা দিলাম।

 

শফিক ভাই তাদের বাসার দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে অরু আপার সাথে গলপি করছিলেন। অরু আপা এখানকার মেয়েদের কলেজে পড়েন, আই এ, না কি বি. এ. আমার মনে থাকে না। অরু, আপা শফিক ভাইদের পাশের বাসায় থাকেন। আগেও দেখেছি দুজনে খুব গল্প করতে পছন্দ করেন। আমাদের দেখে অরু অপি চোখ বড় বড় করে বললেন, ও মা! আমাদের হারু পার্টি দেখি এখানে।

আমরা না শোনার ভান করে হেঁটে গেলাম। গতবার আমরা যখন ফুটবলের টিম খুলেছিলাম, অরু আপা রাত জেগে আমাদের টিমের জন্যে জার্সি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সব জায়গায় গোল খেয়ে আমাদের হারু পার্টি নাম হয়ে গিয়েছিল বলে আজকাল আর ফুটবল খেলি না। অরু আপা আমাদের দেখলেই সেটা মনে করিয়ে দেন। আবার ডাকলেন পিছন থেকে, গোল খাওয়ায় ওয়ালৰ্ড রেকর্ড হতে আর কত দেরি?

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ইয়ারকি মেরো না। অরু, আপা।

ইয়ারকি মারলাম। কখন? এত কষ্ট করে জার্সি তৈরি করে দিলাম, সেটা পরে খেলতে গিয়ে শুধু গোল খেয়ে এসেছিস। কোনদিন কি একটা গোল দিয়েছিস কোথাও? দিয়েছিস?

শফিক ভাই আমাদের বাচালেন, বললেন, কেন জ্বালােচ্ছ ওদের অরু? গোল দেয় নাই তো দেবে, পরের খেলায় দেবে। অন্য টিম যদি এত ফাউল করে খেলে এদের দোষ কি?

আমরা জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। শফিক ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি খবর তোমাদের? কই যাও?

আপনার কাছে এসেছিলাম।

ফজলু যোগ করল, একটা বিশেষ কাজে।

দিলীপ অরু, আপার দিকে আড়াচোখে তাকিয়ে বলল, একটা বিশেষ গোপন কাজে।

অরু, আপা চোখ পাকিয়ে বললেন, তার মানে তোরা আমার সামনে কলবি না?

আমরা মাথা নাড়লাম, না।

শফিক ভাই বললেন, আস তাহলে আমার ঘরে।

আমরা শফিক ভাইয়ের পিছু পিছু তাদের বাসায় যাচ্ছিলাম। অরু আপা পিছন থেকে বললেন, এর পরের বার যদি হারু পার্টির জার্সির জন্যে আমার কাছে আসিস, মাথা ভেঙে দেব।

কাজটা ভাল হল না। কিন্তু কি আর করা যাবে!

 

শফিক ভাই তার চাচার বাসায় থাকেন। ঠিক আপনি চাচা নয়, দূর সম্পর্কের চাচা। বাসার বাইরের দিকে একটা ছোট ঘর শফিক ভাই ঠিকঠাক করে নিয়েছেন। আমরা তার ঘরে গিয়ে দেশের উন্নতির জন্যে একটা ওষুধের কারখানা খোলার কথাটা খুলে বললাম। শফিক ভাই খুব গম্ভীর হয়ে শুনলেন। আমি বাজি ধরে বলতে পারি অরু আপা থাকলে এতক্ষণে এটা নিয়ে হাসি—তামাশা করে একটা কাণ্ড করতেন।

ফজলু বলল, শফিক ভাই ওষুধ কেমন করে বানাতে হয় আপনাকে বলে দিতে হবে।

একশ বার। শফিক ভাই মাথা নেড়ে বললেন, কিন্তু আমি তো আগে কখনো ওষুধ তৈরি করিনি। আগে কিছু বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।

তাহলে করেন।

করব। করে যখন বের করব তখন তোমাদের বলব। কি রকম ওষুধ বানাতে চাও? হোমিওপ্যাথিক না এলোপ্যাথিক?

আমি মাথা চুলকালাম, কোনটা ভাল?

ফজলু বলল, হোমিওপ্যাথিকটা খেতে ভাল।

দিলীপ বলল, কিন্তু এলোপ্যাথিক বেশি কাজের।

তাহলে এলোপ্যাথিকই হোক।

শফিক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, টেবলেট না ক্যাপসুল?

আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। দিলীপ জিজ্ঞেস করল, কোনটা সোজা?

মনে হয় টেবলেট।

তাহলে টেবলেট দিয়েই শুরু করি।

ঠিক আছে।

শফিক ভাইয়ের সাথে খুটিনাটি জিনিস নিয়ে আরো খানিকক্ষণ কথা বলে আমরা যখন চলে আসছিলাম, হঠাৎ শফিক ভাই বললেন, দেশের অবস্থা খুব খারাপ সেটা জান?

আমরা কিছু বলার আগেই রাশেদ বলল, জানি।

কি জান?

ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালীদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না।

শফিক ভাই একটু অবাক হয়ে রাশেদের দিকে তাকালেন, আমরাও তোকালাম। রাশেদ একেবারে বড় মানুষের মত কথা বলছে। শফিক ভাই বললেন, তুমি কেমন করে জানি বাঙালীদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না?

পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের শোষণ করে বেঁচে থাকে। আমরা ক্ষমতায় গেলে আর শোষণ করতে পারবে না।

শফিক ভাই এবারে মনে হল আরো অবাক হলেন। বললেন, তোমাকে তো আগে দেখিনি।

আমি বললাম, নতুন এসেছে আমাদের ক্লাসে।

কি নাম তোমার?

রাশেদ হাসান।

আমি বললাম, তার আগের নাম ছিল লাড্ডু।

লাড্ডু।

রাশেদ একটু হেসে বলল, এখন আমার নাম রাশেদ।

রাশেদ, তুমি তো কেশ খবরাখবর রাখ দেখি।

আমি বললাম, হ্যাঁ, রাশেদ সব সময় তার বাবার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করে।

শফিক ভাই আবার জিজ্ঞেস করলেন, শেখ মুজিবকে যদি ক্ষমতা না দেয় তাহলে কি হবে বলে তোমার মনে হয়?

ফজলু হি হি করে হেসে বলল, গৃহযুদ্ধ আবার কি? ঘরের মাঝে যুদ্ধ? বাবার সাথে মায়ের?

দূর বোকা— শফিক ভাই বললেন, একটা দেশের নিজেদের ভিতরে যখন যুদ্ধ হয় তাকে বলে গৃহযুদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তান যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে সেটা হবে গৃহযুদ্ধ।

দিলীপ ভয়ে ভয়ে বলল, সত্যি হবে গৃহযুদ্ধ?

শফিক ভাই আস্তে আস্তে বললেন, আমার মনে হয় হবে। আমার মনে হয়, পশ্চিম পাকিস্তান কখনো শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেবে না— যদিও শেখ মুজিব বেশি সিটি পেয়েছেন তবু তাকে ক্ষমতা দেবে না— কারণ তাহলে আর ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে না। কিন্তু বাঙালীরা আর কখনো সেটা চুপ করে মেনে নেবে না। কিছুতেই নেবে। না।

কি করবে?

আন্দোলন করবে। আসলে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। অসহযোগ আন্দোলন। দোয়া করা যেন আন্দোলনে কাজ হয়। যেন এমনিতেই ক্ষমতা দিয়ে দেয়।

রাশেদ মাথা নাড়ল, বলল, দেবে না। কিছুতেই দেবে না।

আমরা শফিক ভাইয়ের ঘর থেকে বের হয়ে এলাম খুব গম্ভীর হয়ে। দেশের সামনে এত বড় একটা বিপদ, তার মাঝে তো আর হাসােহাসি করতে পারি না। আমরা হেঁটে হেঁটে আমাদের বাসার কাছে চলে এলাম। বাসার সামনে দেয়ালে চুন বালি খসে পড়েছে। দেয়ালের ফোকড়ে পা দিয়ে উপরে উঠে পা বুলিয়ে বসে থাকলাম গম্ভীর হয়ে। বসে বসে আমরা দেশের কথা ভাবছিলাম, তখন দেখি আশরাফ তার ক্রিকেট বল আর ব্যাট নিয়ে এসেছে। আশে-পাশের বাসা থেকে আরো ছেলেপিলেরা বের হয়ে এল। আমরা তখন মাঠে ক্রিকেট খেলতে শুরু করলাম, দেশের বিপদের কথা ভুলে গেলাম একটু পরেই।

বিকেল পড়ে এলে রাশেদ বলল সে এখন যাবে। ক্রিকেট খেলায় রাশেদ একেবারে যাচ্ছেতাই। না পাৱে বোলিং, না পারে ব্যাটিং। শুধু তাই না, ফিল্ডিংয়ের সময়ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবে সেই জানে, হাতের কাছ দিয়ে বল গড়িয়ে যায়, ধরতে মনে থাকে না।

আমি রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর বাসা কোথায়?

অনেক দূর। ব্রীজের কাছে।

তাহলে চলে যা। বাসায় যেতে যেতে অন্ধকার হয়ে যাবে।

বাসায় যেতে দেরি আছে আমার।

কোথায় যাবি?

মশাল মিছিল আছে রাত্ৰিবোলা।

তুই মশাল মিছিলে যাবি?

হ্যাঁ। ছোট বলে হাতে মশাল দিতে চায় না। আগে গিয়ে অনেক সাধাসাধি করতে হবে।

ফজলু চোখ ছোট ছোট করে বলল, ইশ! আমি যদি তোর সাথে যেতে পারতাম!

রাশেদ বলল, চল যদি যেতে চাস।

ফজলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দিলীপ বলল, ফজলু যাবে মশাল মিছিলে? তাহলেই হয়েছে! কাকা তোকে পিটিয়ে লম্বা করে দেবে না?

ফজলু বিষগ্ন মুখে মাথা নাড়ল। আশরাফ গম্ভীর গলায় বলল, বড় না হওয়া পর্যন্ত মিছিলে যোগ দেয়া ঠিক না। রাজনৈতিক দল ভুলপথে নিয়ে যাবে।

রাশেদ আবার বড় মানুষের মত বলল, পথে তো নামতে হবে। আগে, না হলে জানবি কেমন করে কোনটা ভুলপথ কোনটা ঠিক পথ?

 

রাশেদ যাবার আগে তার স্কুলের বই-খাতা আমাকে দিয়ে গেল কালকে স্কুলে নিয়ে যাবার জন্যে। আশরাফ তার ব্যাট আর বল নিয়ে বাসায় গেল, দিলীপ আর ফজলুও চলে গেল তাদের বাসায়, অন্যেরা আগেই চলে গিয়েছে। আমি খানিকক্ষণ একা একা মাঠে বসে থেকে বাসার দিকে রওনা দিলাম। শফিক ভাইয়ের ঘর অন্ধকার, তার মানে বাসায় নেই। কে জানে রাশেদের মত মশাল মিছিলে গিয়েছে কি না। অরু, আপাদের বাসায় দেখি বারান্দায় অরু, আপা আর তার আম্মা দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। আমাকে দেখে অরু আপা গলা উচিয়ে বললেন, এই ইবু, এখন বই-খাতা নিয়ে কোথায় যাস?

আমার বই-খাতা না।

কারা?

রাশেদের। মশাল মিছিলে গেল, তাই আমাকে দিয়েছে।

এইটুকুন পিচ্চি মশাল মিছিলে গেল? হ্যাঁ, বলে কি?

হ্যাঁ।

বাসায় গেলে তার বাবা বানাবে না?

না। রাশেদ আর তার বাবা খুব বন্ধু!

মজা তো দেখি! এরকম বাধা হলে খারাপ হয় না, কি বলিস?

রাশেদ বলেছে, তার বাবা নাকি একটু পাগল কিসিমের।

একটু কি বলছিস? মনে তো হয় পুরোটাই, না হলে এইটুকু পিচ্চিকে রাত্রিবেলা মশাল মিছিলে পাঠায়?

আমি চলে যাচ্ছিলাম, অরু আপা আবার ডাকলেন, এই ইবু, আয়, লজেন্স খাবি?

লজেন্সের কথা শুনে আমি একটু নরম হয়ে গেলাম। অরু আপা মানুষটা খারাপ না। কিন্তু মাথায় মনে হয় একটু ছিট আছে। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমার হাতে কয়েকটা লজেন্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন, খেয়ে দ্যাখ, অনেক মজা।

অরু আপার আম্মা বললেন, তোমার আম্মা ভাল আছেন, ইবু?

জ্বী খালাম্মা।

আসতে বল একদিন। আমি ঘর থেকে বের হবার সময় পাই না।

বলব খালাম্মা।

অরু আপা বললেন, এই ইবু তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি, ঠিক জবাব দিবি?

আমি ঘামতে শুরু করলাম, এই বুঝি আবার অরু আপার পাগলামি শুরু হল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি?

আমাকে তোর পছন্দ হয়?

আমি ঢোক গিলে বললাম, হয়।

আমাকে বিয়ে করবি?

যাও। খালি ঠাট্টা।

ঠাট্টা কখন করলাম, সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করছি। কারবি? আমি তোর জন্যে ভাত রান্না করে দেব। তুই যখন বুড়ো হবি তোর মাথা থেকে পাকা চুল তুলে দেব। করবি?

যাও!

অরু আপার আম্মা বললেন, কেন জ্বালাচ্ছিস ছেলেটাকে?

কে বলল জ্বালাচ্ছি! তোমার জামাই, মা দেখা পছন্দ হয় কি না। তুমি মাছের মাথা

রান্না করে খাওয়াবে। ইবু, তুই মাছের মাথা খাস তো?

যাও অরু আপা, তোমার খালি ঠাট্টা।

দেখিম, আমি তোৰ অনেক যত্ন করব। প্রত্যেকদিন লজেন্দ নিয়ে আসব। করবি বিয়ে?

অরু আপার আম্মা হাসি চেপে বললেন, কেন জ্বালাচ্ছিস ইবুকে! ছেড়ে দে, এখন সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।

খালাম্মা ভিতরে চলে যাবার পর অরু, আপা মনে হল আরো মজা পেয়ে গেলেন। আমার মুখের কাছে মাথা নামিয়ে বললেন, দেখ না— আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখ। আমার চেহারা কি খারাপ?

খারাপ কেন হবে?

তাহলে রাজি হচ্ছিস না কেন?

তুমি আমাকে বিয়ে করবে না। কচু!

কেন করব না?

তুমি কত বড় আমি কত ছোট! তাছাড়া–

তাছাড়া কি?

তাছাড়া তুমি কাকে বিয়ে করবে সেটা আমি জানি।

কাকে?

শফিক ভাইকে।

অরু আপা চমকে উঠে এদিকে সেদিকে তাকালেন তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে বললেন, কাউকে যদি বলেছিস একেবারে মাথা ভেঙে ফেলব।

ঠিক আছে বলব না। কিন্তু ঠিক বলেছি কি না?

চুপ! চুপ দুষ্ট পাজী ছেলে।

আমি দাঁত বের করে হাসলাম। এতদিনে অরু, আপাকে শায়েস্তা করার মত একটা জিনিস পাওয়া গেছে।

 

রাত্রিবেলা আমাদের বাসার খুব কাছে দিয়ে মশাল মিছিল গেল। হাজার হাজার মানুষ, মশাল হাতে তাদের কেমন জানি রহস্যময় দেখায়। আমি রাশেদকে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না, এত ভিড়ের মাঝে পাওয়ার কথাও না।

মিছিলটি চলে যাবার পরও শ্লোগানগুলি আমার কানো বাজতে লাগল। অনেকগুলি শ্লোগান দিয়েছে, তার মাঝে একটা খুব সুন্দর ছিল, ‘আমার দেশ তোমার দেশংলাদেশ বাংলাদেশ!’ খারাপ হয় না ব্যাপারটা। পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যদি আমাদের দেশটার নাম বাংলাদেশ হয়ে যায়! কি সুন্দর নাম, বাংলাদেশ! একেবারে নিজের একটা দেশ।

রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম, বাংলাদেশ হয়ে গেছে, আর আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছি।— চিৎকার করতে করতে যাচ্ছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *