০৩. বিয়েবাড়ির লোকজন

বিয়েবাড়ির লোকজন ক্রমে ক্রমে জেগে উঠছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হুঁটোপুটি আর কানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টিউবওয়েলে ঘটাং ঘটাং ব-রে ক্রমাগত পানি তোলা হচ্ছে। ডেকোরেটরের দোকান থেকে লোকজন এসে গেটের জন্য মাপজোক শুরু করেছে। জরীর বাবা অকারণে একতলা থেকে দোতলায় ওঠানামা করছেন। মাঝে মাঝে তাঁর উঁচু গলা শোনা যাচ্ছে,  এক ঘণ্টা ধরে বলছি এক কাপ চা দিতে। শুধু এক কাপ চা, এতেই এত দেরি? মেয়ের বিয়ে কি আর কাৰো হয় না?

আভা, হঠাৎ বলল, জরী, তোর ছোটচাচার ছেলে কি আমেরিকা চলে গেছে?

না, সতের তারিখে যাবে।

একাই যাচ্ছে?

না। বড়োচাচা সঙ্গে যাবেন।

কনক বলল, কী জন্যে যাচ্ছেন? কই, আমি তো কিছু জানি না?

জরী অস্বস্তি বোধ করল। থেমে থেমে বলল, চিকিৎসা করাতে যাচ্ছে। মেরুদণ্ডে গুলী লেগেছিল। সেই থেকে পেরাপ্লেজিয়া হয়েছে। কোমরের নিচে থেকে অবশ্য।

আমাকে তো কিছু বলিস নি তুই, গুলী লাগল কী করে?

আমির লেফটেন্যান্ট ছিলেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যখন পাক-আর্মির সাথে যুদ্ধ হয়, তখন গুলী লেগেছে।

লায়লা বলল, জরীর এই ভাইটিকে তো তুই চিনিস, কনক মনে নেই–এক বার আমরা সবাই দল বেঁধে আনন্দমোহন কলেজে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম? তখন যে একটি ছেলে সন্ন্যাসী সেজেছিল, হঠাৎ নাটকের মাঝখানে তার দাড়ি খুলে পড়ে গেল। ঐ তো আনিস। যা মুখচোরা ছিল।

জয়ী একটু হেসে বলল, ছোটবেলায় আনিস ভাই ভীষণ বোকা ছিল। একেক বার এমন হাসির কাও করত! তাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলেই হয়েছে, হয়। সেখানে একটা কাপ ভাঙবে, নয় চেয়ার নিয়ে হঠাৎ গড়িয়ে পড়বে।

রুনু বলল, বাঘের গল্পটা বল জয়ী, ওটা ভীষণ মজার।

না থাক।

বল না, শুনি।

এক বার আমরা সবাই জঙ্গল বয় ছবি দেখে এসেছি। আনিস ভাই ফিরে এসেই বড়চাচার সোয়েটার গায়ে দিয়ে বাঘ সেজেছে। আর আমরা সেজেছি হরিণ। আনিস ভাই হালুম শব্দ করে আমার ঘাড় কামড়ে ধরল। কিছুতেই ছাড়বে না। রক্তটক্ত বেরিয়ে সারা, শেষে বড়োচাচা এসে ছাড়িয়ে দিলেন। দেখ, এখনো দাগ আছে।

জরীর মা দোতলা থেকে ডাকলেন, ও মেয়েরা, চা দেওয়া হয়েছে, এস। শিগগির। সবাই দেখল, তাঁর মুখ খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। একজন সুখী চেহারার মা, যার খোঁপায় গোঁজা ফুলটি এখনো রয়েছে। হয়তো ফেলে দিতে তাঁর মনে নেই, কিংবা ইচ্ছা করেই ফেলেন নি।

আভা বলল, চা খেয়ে আমরা আনিস ভাইয়ের সঙ্গে একটু গল্প করব, কেমন জরী?

বেশ তো, কারবি।

যুদ্ধের গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে!

কনক বলল, কই, আর সানাইয়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তো?

সানাই বাজছিল ঠিকই, কিন্তু বিয়েবাড়ির হৈচৈ এত বেড়েছে যে শোনা যাচ্ছে না!

তারা সবাই দোতলায় উঠে এল। সিঁড়িতে জরীর বাবার সঙ্গে দেখা। তিনি দ্রুত নামছিলেন। জরীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, শুনেছিস কারবার, রশীদ টেলিফোন করেছে।–দৈ নাকি পাওয়া যাবে না। জরী, তুই আমার সোয়েটারটা বের করে দে, আমি নিজেই যাই। তাড়াতাড়ি কর। এমন গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন–বলে তাঁর খেয়াল হলে বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমি নিজেই খুঁজে নেব। জরীর বন্ধুরা হাসতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *