০৩. বিরাটনগর হাই স্কুল

বিরাটনগর হাই স্কুলের সামনে আজ চাপা উত্তেজনা।

গুজব শোনা যাচ্ছে আজ জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবকে নেংটো করে স্কুলের মাঠে চক্কর দেওয়ানো হবে। গুজবটা কেউ ঠিক বিশ্বাসও করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। চেয়ারম্যান সাহেব বিচিত্র সব কাণ্ড করেন। তার পক্ষে এই ধরনের শাস্তি দেয়া অসম্ভব না। আবার জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবের মতো মানুষকে নেংটো করে কানে ধরে চক্কর দেওয়ানো হবে এটাও বিশ্বাসযোগ্য না।

স্কুল ঘরের সামনে কয়েকটা চেয়ার এবং দুটা বেঞ্চ রাখা হয়েছে। মাঝখানের চেয়ারে চেয়ারম্যান সাহেব পা তুলে বসেছেন। তার পরনে ধবধবে সাদা সিস্কের লুঙ্গি। গায়ে পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিও ধবধবে সাদা। তবে সিস্কের না। বলে চকচক করছে না। চেয়ারম্যান সাহেবের মুখ ভর্তি পান। পান খেলেই তার মুখ হাসিহাসি হয়ে যায়। তার মুখ হাসিহাসি। চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে আছেন হাই স্কুলের হেডমাস্টার বাবু ঈশ্বরচন্দ্র এম.এ.বি.টি.। হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকও আছেন। শিক্ষকরা সবাই চুপচাপ। তারা গত তিন মাসে কোনো সরকারি ডিএ পাচ্ছেন না। ছাত্র বেতনের আদায় খুবই সামান্য। জহির খাঁ সাহেব প্রতি মাসে স্কুলে বেশ কিছু টাকা দেন। গত দু’মাসে সেই টাকাও দিচ্ছেন না। ঘটনা কী জানা যাচ্ছে না। শিক্ষকরা শংকিত। বিরাটনগরের গণ্যমান্যদের মধ্যে সরকার বাড়ির ইরফান সরকার আছেন। নয়াবাড়ির আজিজ মিয়াও সেজোগুজে উপস্থিত হয়েছেন। আরো কিছু লোকজনের আসার কথা, তারা এখনো এসে উপস্থিত হন নি। আছরের নামাজের পর সবাইকে আসতে বলা হয়েছে। আছরের নামাজের সময় মাত্র হয়েছে। তবে বাজার থেকে বেশ কিছু লোকজন এসেছে। তারা আলাদা বসেছে। বাজারের লোকজনদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। গ্রামের সালিশি। বৈঠকে তারাও থাকে, তবে আলাদা থাকে।

চেয়ারম্যান সাহেব নয়াবাড়ির আজিজ মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, পুকুর কাটাইতেছ শুনলাম।

আজিজ মিয়া বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, একটা ইচ্ছা আছে। ছেলে টাকা পাঠায়েছে–তার ইচ্ছা বড় একটা পুকুর। পাথরের ঘাটলা হইব। পুলাপাইন্যা।

চেয়ারম্যান সাহেব আরো একটা পান মুখে দিতে দিতে বলল, খারাপ কী?

আজিজ মিয়া উত্তেজিত গলায় বলল, ছেলে চিঠিতে লিখেছে—আব্বাজান পুকুরে মাছ ছাড়িবেন কিন্তু মাছ বিক্রয় করিবেন না। মাছ বড় হউক। দেশে ফিরিয়া হুইল বর্শি দিয়া মাছ ধরিব।

জহির খাঁ পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, চিঠি মুখস্থ করে বসে আছ। পুরা চিঠি মুখস্ত, না। এই দুই লাইন মুখস্ত?

আজিজ মিয়া লজ্জিত মুখে বলল, অনেকবার কইরা এক চিঠি পড়ি–ইয়াদ থাকে।

তোমার ছেলে ভালো দেখাইছে।

আপনাদের দেয়া।

জহির খাঁ সামান্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। আজিজ মিয়া বছর সাতেক আগেও হত দরিদ্র ছিল। ফসল তোলার সময় অন্যের ক্ষেতে কমলা দিত। তার ছেলে কীভাবে কীভাবে কুয়েত চলে গেল। তারপর টাকা পাঠাতে শুরু করল। আজিজ মিয়ার বাড়িতে টিনের ঘর উঠল। সেই টিনের ঘরের পাশে উঠল পাকা বাড়ি। আজিজ মিয়া জমি কেনা শুরু করল। বাজারে ঘর নিল। এখন জানা গেল পুকুর কাটা হবে। জহির খাঁর কানে এসেছে যে আজিজ মিয়া বলে বেড়াচ্ছে–এমন পুসকুনি দিব যে চেয়ারম্যান সাহেবের পুসকুনিরে আমার পুসকুনির সামনে মনে হইব ব্যাঙের ছাতা। অতি অপমানসূচক কথা। জহির খাঁ বিশ্বাস করেন না আজিজ মিয়া এ ধরনের কথা বলতে পারে। তবে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করা যায় না। ছোটলোকের যদি হঠাৎ পয়সা হয় তাহলে পয়সার গরমে পাছা গরম হয়ে মায়। মাথা গরম লোক অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে–সেইসব কথার মাপ থাকে। পাছা গরম লোকের কথার কোনো মাপ থাকে না।

আজিজ মিয়া তৃপ্তির সঙ্গে বলল, ছেলেটা লোক মারফত আমারে আর তার মারে মক্কা শরিফ থাইক্যা কাফনের কাপড় কিন্যা পাঠাইছে। বড়ই আনন্দের ব্যাপার! এই কাপড় কাবা শরীফ ছুঁয়াইয়া আনাইছে।

ভালো তো।

আবার চিঠিতে লিখেছে। হজ্জ কইরা যাইতে। সে ব্যবস্থা করবে।

যাও, হজ্জ কইরা আস।

ইচ্ছা আছে কিন্তু নানান ঝামেলায় জড়াইয়া পড়ছি—বাজারে আরেকয়া নয়া ঘর নিছি।

বাজারে ঘর নিয়েছ?

জ্বি, দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে।

ভালো তো।

জহির খাঁ পানের পিক ফেললেন। তার কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল–বিরাটনগরে অনেক কিছুই ঘটছে। যার খোঁজ তিনি রাখেন না। বাজারে ঘর রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে সেই খবরও তিনি পান নি এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। আজিজ মিয়া তলে তলে সুড়ং কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটা অতি বুদ্ধিমান। ছোটলোকের হাতে হঠাৎ পয়সা এলে নানান আলামত দেখা যায়। এরা তখন বড় কার্প মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারে না। আড়ং-এ ষাড়ের লড়াইয়ের জন্যে ষাঁড় কিনে ফেলে। সপ্তাহে দুই দিন যায় নেত্রকোনা ছবি দেখার জন্যে। আজিজ মিয়া তার কিছুই করছে না–জমি কিনছে, বাজারে ঘর রাখছে। তিনি খবর পেয়েছেন আজিজ মিয়া ব্যবসা ভালোই বুঝে। সরিষার ব্যবসা করে এই বৎসর অনেক টাকা কামিয়েছে।

স্কুলের দপ্তরি নাশতা নিয়ে এল। ধামাভর্তি মাখানো মুড়ি। পেঁপে। ঈশ্বর বাবু বিনীত গলায় বললেন, চেয়ারম্যান সাব নাশতা করেন। চা আসতেছে। গুড়ের রং চা করতে বলেছি। গুড়ের চা আপনার পছন্দ।

জহির খাঁ হাই তুলতে তুলতে বললেন, তোমরা খাও। আমার মুখে পান।

ঈশ্বর বাবু নিচু গলায় বললেন–ভালো নাশতার আয়োজন করার ইচ্ছা ছিল। স্কুল ফান্ডের অবস্থা শোচনীয়। ক্লাসটেনে ছাত্র মাত্র সাতজন।

জহির খাঁ গম্ভীর গলায় বললেন, ছাত্র কম কেন? পড়াশোনা ভালো হয় না?

ঈশ্বরচন্দ্ৰ হতাশ গলায় বললেন–যে সব স্কুলে সেন্টার পায় সেখানে ছাত্র হয়। নকলের সুবিধা হয় কি-না সেটা সবেই আগে দেখে। খুবই দুর্দশায় আছি। অঞ্চলের বিশিষ্ট গণ্যমান্যরা যদি না দেখে তাহলে স্কুল উঠায়ে দিতে হবে।

দাও উঠায়ে দাও। সবকিছুর জন্ম মৃত্যু আছে। স্কুলেরও আছে। আফসোস কইরা তো লাভ নাই। আগে রাজা বাদশা ছিল, তারা হাতি পুষত। স্কুল কলেজ এইগুলা হইল হাতি। এখন রাজা বাদশা নাই–হাতিও থাকব না। সোজা হিসাব।

আজিজ মিয়া অতি দ্রুত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল অবশ্যই অবশ্যই। স্কুলের শিক্ষকরা আহত চোখে তাকিয়ে রইল। আজিজ মিয়ার দিকে।

জুম্মাঘরের ইমাম সাহেবকে আসতে দেখা গেল। চেয়ারম্যান সাহেব তার মনযোগ সেই দিকে দিলেন। একসঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে নাই। চিন্তা ভাবনা হলো পুতির মালার মতো। একেকটা চিন্তা একেকটা পুতি। আর সুতাটা হলো চিন্তার লাইন। সব পুতি এক লাইনে বঁধতে হয়। এই কাজ সবাই পারে না। ইমাম সাহেবের কাছে গত রাতে তিনি লোক পাঠিয়েছিলেন। লোক মারফত তিনি একটা প্ৰস্তাব দিয়েছেন। ইমাম যদি অপরাধ স্বীকার করে তাহলে তিনি তাঁকে নেংটা করে ঘুরাবেন না। দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে ইমামের চাকরি বহাল থাকার সম্ভাবনা আছে। দোষ স্বীকার না করলে শাস্তি হবে।

ইমাম সাহেবের চোখ রক্তবর্ণ। তিনি গত কয়েক রাত ধরে ঘুমাচ্ছেন না তা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ঠিকমতো হেঁটে আসতেও পারছেন না। মাতালের মতো হেলে দুলে। এগুচ্ছেন। জুম্মার নামাজের দিন তিনি যে পোশাক পরেন। আজও তাই পরেছেন–কালো আচকান, মাথায় সাদা পাগড়ি। সাদা পাগড়ির সঙ্গে কালো আচকান খুব মানিয়েছে, তাকে সুফি সুফি লাগছে। আজ তিনি চোখে সুরমা ও পরেছেন। অন্য যে-কোনো সালিশির দিনে ইমাম সাহেব আসা মাত্র তাকে চেয়ার দেয়া হয়। আজ দেয়া হলো না। তিনি জহির খাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার চোখে মুখে দিশাহারা ভাব।

ইমাম সাহেবের নাম ইয়াকুব। উলা পাস। বয়স পঞ্চাশের ওপরে। তিনি পাঁচ বছর হলো বিরাটনগরে আছেন। তার বাড়ি মধুপুর। স্ত্রী এবং দুই কন্যা মধুপুরেই থাকে। তিনি মাঝে মধ্যে মধুপুর তাদের দেখতে যান। বছর দুই আগে ইমাম সাহেবের স্ত্রী তার দুই কন্যাকে নিয়ে এখানেও বেড়াতে এসেছিলেন–এক সপ্তাহ ছিলেন। গ্রামের মানুষজন তখন তার দুই কন্যার রূপ দেখে মোহিত হয়েছিল। বড় মেয়েটির নাম সকিনা, ছোটটির নাম জরিনা। গ্রামের মানুষজন এখনো কোনো রূপবতী মেয়ে দেখলে বলে–ইমাম সাহেবের বড় মেয়ে সকিনার মতো সুন্দর।

সকিনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পান-চিনি হয়ে গেছে। কার্তিক মাসের নয় তারিখ বিবাহ। ছেলে সরকারি কলেজে অংকের লেকচারার। ইমাম সাহেব কন্যার বিবাহ উপলক্ষে এক মাসের ছুটি নিয়েছেন। দেশে রওনা হবার আগে এমন বিপত্তি।

চারদিকে গুনগুন হচ্ছিল। ঈশ্বর বাবু উঠে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বললেন–সাইলেন্স। পিনড্রপ সাইলেন্স। গুনগুনানি বন্ধ হলো। জহির খাঁর পাঞ্জাবিতে পানের পিক লেগে গেছে। তিনি খুবই বিরক্ত চোখে পানের পিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইমাম সাহেব ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, চেয়ারম্যান সাব আসসালামু আলায়কুম।

সালাম দিলে নিতে হয়। এটাই নিয়ম। জহির খাঁ নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন। সালাম নিলেন না। শব্দ করে মেঝেতে পানের পিক ফেললেন। গলা খাকারি দিয়ে শুকনো গলায় বললেন–আপনি চিন্তা ভাবনা কিছু করেছেন? অপরাধ স্বীকার করলে ভিন্ন বিবেচনা।

ইমাম সাহেব কাপা কাপা গলায় বললেন, আমি কোনো অপরাধ করি নাই। আল্লা সাক্ষি আমার দুই কান্দের দুই ফেরেশতা সাক্ষি আমি নিরপরাধ।

জহির খাঁ বিরক্ত মুখে বললেন, আপনের দুই কান্দের দুই ফিরিশতা তো সাক্ষি দিবে না। এদের কথা খামাখা বইল্যা তো লাভ নাই। আপনে বিরাট অন্যায় করেছেন। এই অঞ্চলের নাম বিরাটনগর। এইখানে যা হয় সবই বিরাট। মানুষ যখন অন্যায় করে ছোট অন্যায় করতে পারে না। বিরাট অন্যায় করে। আপনি দোষ স্বীকার না করলে যে শাস্তির কথা বলেছিলাম। সেই শাস্তি দিব। আপনে বড় অপমান হবেন।

ঈমাম সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি কোনো দোষ করি নাই, কিন্তু তারপরও দোষ স্বীকার করলাম।

প্যাঁচের কথায় কাজ হবে না ইমাম সাহেব। দোষ করি নাই। কিন্তু দোষ স্বীকার করলাম এটা কেমন কথা? আমি বিবাহ করি নাই। কিন্তু সে আমার বিবাহীত স্ত্রী–এইটা কি হয়?

লোকজন হো হো করে হেসে ফেলল। জহির খাঁ সেই হাসিতে যুক্ত হলেন না। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন–আপনি যে পাপ করেছেন সেই পাপ ব্যাভিচারের চেয়েও খারাপ। আমাদের ধর্মে যে ব্যাভিচার করে তার শাস্তি কী জানেন নিশ্চয়ই। গর্ত খুঁড়ে তাকে ঢুকানো হয়–তারপরে পাথর ছুড়ে মারা হয়। আমি সে রকম কিছু করব না। কাপড় চোপড় খুলে কানে ধরে আপনাকে চক্কর দেওয়াব। শান্তি শেষ। এখন শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করতেছি আপনি কি অপরাধ করেছেন?

জ্বি করেছি।

আপনি কি সবের কাছে ক্ষমা চান?

জ্বি চাই।

তাহলে প্রথম কেন বললেন দোষ করেন নাই?

আমি দোষ করি নাই এইজন্যে বলেছি দোষ করি নাই।

এখন কেন বলতেছেন দোষ করছেন?

অপমানের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বলতেছি।

অর্থাৎ আপনি স্বীকার করেন না যে দোষ করেছেন? শেষ জবাব দেন। আমি আর ছওয়াল জবাব করতে পারব না। হ্যাঁ কিংবা না বলেন। দোষ করেছেন?

জ্বি না।

দোষ তাহলে করেন নাই?

ইমাম সাহেব হড়বড় করে বললেন–দোষ করেছি।

জহির খাঁ কঠিন গলায় বললেন–আপনে তো একেকবার একেক কথা বলতেছেন।

জনাব আমার মাথাটা আওলায়ে গেছে। আমি কী বলতেছি কী বলতেছি। না–কিছুই বুঝতেছি না।

জহির খাঁ শান্ত গলায় বললেন, ঠিক আছে আপনারে বুঝাইবার ব্যবস্থা করতেছি। সবেই চট কইরা বুঝে না। কেউ তাড়াতাড়ি বুঝে আবার কেউ আছে বুইঝাও বুঝে না।

ইমাম সাহেব মাথার পাগড়ি খুলে হাতে নিয়েছেন। গরমে তার মাথার সব চুল ভিজে গেছে। চুল থেকে ঘামের ফোটা কপাল বেয়ে নামছে। তার ঠোঁট নড়ছে। মনে হচ্ছে তিনি দ্রুত কোনো সূরা পাঠ করছেন।

 

রাত আটটার মতো বাজে। আনিস বিছানায় শুয়ে আছে। বিকেল থেকেই তার গা ম্যাজ ম্যাজ করছিল, এখন শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। ডাক্তাররা নিজেদের অসুখ বিসুখের ব্যাপারে উদাসীন হয়। আনিস তার ব্যতিক্রম না। থার্মোমিটারে সে জ্বর দেখে নি। দুটা এনালজেসিক ট্যাবলেট খেয়ে জ্বর কমানোর চেষ্টাও করে নি। হাত পা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার সামান্য দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে রাতের খাবার নিয়ে। তার রান্না বান্না করে দেয়। সুজাত মিয়া। বয়স দশ এগারো। তার পায়ে সমস্যা আছে। একটা পা বড়, একটা ছোট। হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পরশু সকাল থেকে সুজাত নিখোঁজ। কোথায় গেছে কাউকে কিছু বলে যায় নি। ছেলেটি অতি ভদ্র, অতি বিনয়ী, কাজ কর্মে দক্ষ। তার একটাই সমস্যা–মাঝে মাঝে কাউকে কিছু না বলে নিখোঁজ হয়ে যায়। আবার ফিরে এসে কাজকর্ম শুরু করে দেয়। ভাবটা এ রকম যেন কিছুই হয় নি। সে কোথাও যায় নি। এখানেই ছিল।

আনিসের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। বিরাটনগরে পল্লী বিদ্যুৎ এসেছে। ডাক্তারের কোয়ার্টারে পল্লী বিদ্যুতের লাইন আছে। ইলেকট্রিকের তারে কী সমস্যা হয়েছে–বাতি জ্বলছে না। তার ঠিক করার জন্যে ইলেকট্রিশিয়ান আনার জন্যে খবর পাঠাতে হবে নেত্রকোনায়। আলসেমির জন্যে খবর পাঠানো হচ্ছে না। আনিস রোজ রাতে ভাবে কালই লোক পাঠাবে। সকালে মনে থাকে না। কাল অবশ্যই লোক পাঠাতে হবে। নবনী চিঠি লিখেছে সে আসবে। নবনী শীতের দিনেও এসি ছাড়া ঘুমুতে পারে না। ফ্যান তো লাগবেই। আশ্বিন মাসে দিনে রোদের তাপ বেশি। রাতটা অবশ্যি ঠাণ্ডা–তারপরেও ফ্যান লাগবে।

নবনীর এবারের চিঠিটা নিয়েও আনিস সামান্য চিন্তিত। চিঠির কথা কেমন যেন এলোমেলো! তার কি কোনো সমস্যা যাচ্ছে? সমস্যার ব্যাপারটা লেখা নেই। লেখা থাকলে ভালো হতো–আনিস চিন্তা করতে পারত। প্ৰায় রাতেই তার কোনো কাজ থাকে না। তখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে।

আনিস বালিশের নিচ থেকে নবনীর চিঠি বের করল। এই চিঠি এর মধ্যেই কয়েকবার পড়া হয়েছে। আরো একবার পড়লে ক্ষতি কিছু নেই।

ডাক্তার সাহেব,

কেমন আছ তুমি? জঙ্গলে দিনকাল কেমন কাটছে? অসহ্য বোধ হওয়া শুরু হয় নি? আমি যখন ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতম প্রথম দিন খুব ভালো লাগত। দ্বিতীয় দিনে ভালো লাগাটা কমে যেত। তৃতীয় দিন থেকে অসহ্য লাগা শুরু হতো। তুমি কীভাবে বৎসর পার করে দিচ্ছে ভাবতে অবাক লাগছে।

আমি ভেবে দেখলাম-তুমি তেল আমি জল। তোমার পছন্দ এক রকম। আমার অন্য রকম। বিবাহ নামক ঝাকুনি যন্ত্রের মাধ্যমে তেল জল মিশে যাচ্ছে। আবার ঝাকুনি বন্ধ হলেই তেল আলাদা, জল আলাদা। আমাদের সার্বক্ষণিক সুখে থাকার জন্যে প্রবল ঝাঁকুনি যন্ত্র দরকার। সে রকম যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় নি বলে আমি ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় আছি।

তোমার এখানে তিন দিনের জন্যে আসব। প্ৰথম দিন আমার খুবই ভালো লাগবে। দ্বিতীয় দিন ভালো লাগাটা একটু কমবে। তৃতীয় দিনে অসহ্য বােধ হতে থাকলে তখন চলে আসব। কিছু মানুষ আছে অসহনীয় অবস্থা সহনীয় করার জন্যে চেষ্টা চালায়। আমার এবং তোমার, আমাদের দু’জনেরই দুৰ্ভাগ্য আমি সে রকম না। আমি কেন এ রকম হয়েছি সেটা নিয়ে ভেবেছি। উত্তর পাই নি।

তোমাকে জানানো হয় নি ইদানিং আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া-আসা করছি। ভদ্রলোক আমাদের আত্মীয় এবং আমাকে ছোটবেলা থেকেই খুব স্নেহ করেন। সাইকিয়াট্রিক্টের কাছে যাবার উদ্দেশ্য হলো–তিনি যেন রাতে ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখার হাত থেকে আমাকে বঁচোন। একবারতো। আমি তোমাকে লিখেছিলাম যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। সেই দুঃস্বপ্নগুলো কত ভয়ঙ্কর তা লেখা হয়। নি। রাতে দেখা ভয়ের স্বপ্নগুলো যখন দিনে মনে করি বা কাউকে বলতে যাই তখন খুবই হাস্যকর মনে হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে কী স্বপ্নে দেখেছি শোন–দেখলাম আমি পুরনো ধরনের রেলিং দেয়া খাটে শুয়ে আছি। খাটের চারদিকে রেলিং ধরে আট ন’জন বোরকাপরা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। এবং সবাই হাত বাড়িয়ে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন। আমি নিশ্চিত যে তোমার কাছে স্বপ্নটা মোটেই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। এখন আমার কাছেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু স্বপ্নটা দেখার সময় কী যে ভয় পেয়েছিলাম! আমি সাইকিয়াট্রিস্ট চাচার পরামর্শ মতো একটা খাতা বানিয়েছি। সেই খাতার নাম দিয়েছি। স্বপ্ন-খাতা। আমি এই খাতায় স্বপ্নগুলো লিখে রাখছি। তোমার এখানে আসার সময় খাতাটা নিয়ে আসব। তুমি পড়ে দেখ। আমি নিশ্চিত তুমি মজা পাবে।

সাইকিয়াট্রিস্ট চাচা আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কী সিদ্ধান্তে এসেছেন শুনতে চাও? তার সিদ্ধান্ত হলো—আমি নাকি মানসিকভাবে বিয়েটা মেনে নিতে পারছি না। তোমার সঙ্গে বিয়ে আমার মনের ওপর প্রবল চাপ ফেলেছে। এই মানসিক চাপই স্বপ্ন হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এটা সাইকিয়াট্রিস্টেরর সিদ্ধান্ত। তোমার সিদ্ধান্ত কী? ভালো থেকো।

নবনী

 

আনিসের শরীর কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। জ্বর কি বেড়েছে? ঘরে থাৰ্মেমিটার নেই। ক্ষিধে লেগেছে, কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। দুটা বিপরীতমুখী ব্যাপার একসঙ্গে কী করে ঘটে? শরীর যন্ত্র নষ্ট হলে এরকম হয়। জলাতংকের রোগীর তৃষ্ণায় বুক ফাটে কিন্তু পানি খেতে পারে না। না উদাহরণটা ঠিক হলো না। জলাতংকের রোগীর তৃষ্ণা হয়, পানিও খেতে চায়–খিঁচুনির জন্যে খেতে পারে না।

মন যন্ত্র নষ্ট হলেও বিপরীতমুখী ব্যাপারগুলো দেখা যায়। পাশাপাশি দুটি নদী। একটি অন্যটির গায়ের ওপর দিয়ে বইছে। একটির পানি যাচ্ছে সাগরের দিকে। অন্যটির পানি সাগর থেকে উঠে রওনা হয়েছে পর্বতমালার দিকে।

নবনীর মনে কি এরকম দু’টি ধারা বইছে? সে দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কেন? আনিস কি তার জীবনে বড় ধরনের কোনো আশা ভঙ্গের’ ব্যাপার ঘটিয়েছে?

নবনীর ব্যাপারে আনিসের মনে আশা ভঙ্গের কিছু ঘটে নি। সে জানে নবনী চমৎকার একটি মেয়ে। তার একটাই সমস্যা – সে ভয়াবহ নিঃসঙ্গ। আনিস সেই নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারে নি। বিরাটনগর ছেড়ে সে যদি ঢাকায় গিয়ে নবনীর সঙ্গে বাস করতেও থাকে তাতেও নবনীর নিঃসঙ্গতা দূর হবে না। কিছু কিছু মানুষ বিচিত্র ধরনের নিঃসঙ্গতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কারোর সাধ্য নেই সেই নিঃসঙ্গতা দূর করে। সেই সব মানুষরা তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টা নিজেরাই করে। তা করতে গিয়ে কেউ বড় লেখক হয়, কেউ হয় চিত্রকর, বিজ্ঞানী। আবার কেউ কেউ হয়তো তার মতো ডাক্তার হয়। চারপাশের মানুষদের নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থেকে নিজের নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকতে চায়।

আনিস নবনীর নিঃসঙ্গতা জানে। নবনী কি আনিসের নিঃসঙ্গতা জানে?

দরজায় শব্দ হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে কেউ একজন কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার শব্দ থেকে মনে হয়। সুজাত ফিরে এসেছে। আনিস উঠে দরজা খুলল।

সুজাত মিয়া না, মতি দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে নতুন শার্ট, নতুন লুঙ্গি। পায়ে নতুন রাবারের জুতা। যে ছাতা হাতে সে দাঁড়িয়ে আছে ছাতাটাও নতুন। আনিসের সাইকেল বিক্রি করে সে ভালো দাম পেয়েছে। আট শ’ টাকা। আট শ’র মধ্যে ছয় শ’ নগদ পেয়েছে। দুশ’ টাকা এখনো বাকি আছে। বাকি দু’শ’ টাকা আদায় করতে কষ্ট হবে। শেষ পর্যন্ত আদায় হয় কি-না সেই বিষয়েও তার ক্ষীণ সন্দেহ আছে। মতির খরচের হাত ভালো। ছয় শ’ টাকার প্রায় সবটাই একদিনে শেষ হয়েছে। নিজের জামা-কাপড় ছাড়াও সে দুটা টাঙ্গাইলের তীতের শাড়ি কিনেছে। একটা মর্জিনার জন্যে, আরেকটা বাতাসীর জন্যে।

বাতাসী মেয়েটা বাজারে নতুন এসেছে। বাতাসীর গলার স্বর অতি মধুর। এমন মধুর স্বরে সে এর আগে কোনো মেয়েকে কথা বলতে শোনে নি। বাতাসীর আরো একটি ব্যাপারে সে মুগ্ধ। সেটা হলো বাতাসীর গায়ের গন্ধ। অবিকল তেজপাতার গন্ধ। মানুষের গায়ে নানা রকম গন্ধ থাকে। তেজপাতার গন্ধও যে থাকে। এটা সে কল্পনাও করে নি। মর্জিনার গায়ের গন্ধ টিকটক। খারাপ না। টক গন্ধও ভালো লাগে। তবে তেজপাতার গন্ধ অন্য জিনিস।

মতি বাতাসীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছে বিরাটনগর হাই স্কুলের শিক্ষক। এতে কয়েকটা উপকার হয়েছে। বাতাসী তাকে আলাদা খাতির করছে। ‘স্যার’ ডাকছে। মতির দিক দিয়ে সামান্য সমস্যা হচ্ছে–কথাবার্তা শিক্ষকদের মতো বলতে হচ্ছে। শুদ্ধ ভাষা বলতে হচ্ছে। মতি এখন সরাসরি বাতাসীর কাছ থেকে এসেছে। শাড়ি দিতে গিয়েছিল। ইচ্ছা ছিল রাতটা থেকে যাবে। বাতাসী অন্য মানুষ ঘরে নিয়ে নিয়েছে বলে সেটা সম্ভব হয় নি। তবে খুব আফসোস করেছে। দুঃখ দুঃখ গলায় বলেছে–আপনে আইজ আসবেন আগে কইবেন না? মতি বলেছে–আগে থেকে কিছু বলা যায় না। মন উদাস হইলেই শুধু তোমার কাছে আসি। মানুষের মন কখন উদাস হইব কখন হইব। না এইটা বলা বেজায় কঠিন। মানুষের মন তো কঁঠাল না যে জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকব। মানুষের মন যে-কোনো সময় পাকতে পারে।

বাতাসী মুগ্ধ গলায় বলেছে–ইস্! আপনি এত সুন্দর কইরা ক্যামনে কথা কন?

মতি বলেছে, আমরা শিক্ষক মানুষ, আমরার কথার এইটাই ধারা। এই নাও শাড়ি। রঙ পছন্দ হইছে?

বাতাসী হতভম্ব গলায় বলেছে–আমার জন্যে শাড়ি আনছেন? কী আচানক কথা! আফনে মানুষটা অত ভালা কেন হইছেন?

বাতাসীর আনন্দ এবং বিস্ময় দেখে মতির বড় ভালো লেগেছে। মর্জিনার ভেতর এই জিনিস নেই। সে আনন্দিতও হয় না, বিক্ষিত্রতও হয় না। শুধু খাবার দেখলে তার চোখ চকচক করে। একটা শাড়ি পেলে সে যত খুশি হয় তারচে’ অনেক বেশি খুশি হয় আধা কেজি গরম জিলাপি পেলে।

আনিস বলল, মতি কী খবর?

মতি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, খবর মাশাল্লাহ ভালো। কয়েক দিন বাইরে কাজকর্মে ছিলাম। গৌরীপুর গিয়েছিলাম। আইজ সন্ধ্যায় ফিরছি। ইষ্টিশনে নাইমা শুনলাম। আপনার সাইকেল চুরি গেছে। মনটা এমন খারাপ হইছে! ভাবলাম দেখা কইরা যাই।

আনিস ক্লান্ত গলায় বলল, আমার সাইকেল চুরির খবর কি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে?

কী বলেন–এইটা একটা ঘটনা না? তবে চিন্তা কইরেন না–গৌরীপুরের এক পীর সাহেব আছেন, চাউল পড়া দেন। সেই চাউল পড়া খাওয়াইয়া দিয়া সাইকেল চোর বাইর করা এক ঘণ্টার মামলা।

চাল পড়া দিয়ে সাইকেল চোর ধরা যায়?

অবশ্যই। পীর সাহেবের চাউল পড়া খাইয়া যদি কেউ মিথ্যা কথা বলে–সাথে সাথে রক্তবমি। আমার নিজের চউক্ষে দেখা।

আনিস বলল, তুমি কি বসবে না চলে যাবে? আমার শরীরটা ভালো না। আমি শুয়ে পড়ব।

আপনার যদি অসুবিধা না হয় দুই চাইর মিনিট বসি। আপনার এইখান থাইকা যাব ইমাম সাহেবের কাছে। উনি চাইলা যাবেন–দেখা কইরা আসি। যত খারাপ লোকই হউক এতদিন মানুষটা গ্রামে ছিল। তার পেছনে কয়েকবার নামাজও পড়েছি। ডাক্তার সাহেবের কি শরীর বেশি খারাপ?

মনে হয় বেশিই খারাপ। কেঁপে জ্বর আসছে।

মতি হাই তুলতে তুলতে বলল, আমরার ইমাম সাহেবেরও শুনেছি বেজায় জ্বর। জ্বরের মধ্যে উল্টা পাল্টা কথা বলতেছে। আপনার কাছে কেউ খবর নিয়া আসে নাই?

না তো।

একটা চক্করের পরেই ঠাশ কইরা মাথা ঘুইরা পইড়া গেল।

আনিস অবাক হয়ে বলল, তোমার কথা বুঝলাম না–কীসের চক্কর?

মতি তার চেয়েও অবাক হয়ে বলল, ইমাম সাবরে যে আইজ লেংটা কইরা চক্কর দেয়া হইছে আপনে জানেন না?

না, জানি না।

বাদ আছর চক্কর দেয়ানি হইল। বিরাট জনতা। মনে হইতেছিল ষাঁড়ের আড়ং।

আনিস হতাশ গলায় বলল, চেয়ারম্যান সাহেব শেষ পর্যন্ত এই কাজটা করলেন?

মতি বলল, করব না। আপনে কী কন? আমরার চেয়ারম্যান সাব এক কথার মানুষ। বাক্কা বেডার চাক্কা। হে যদি বলে আমি বাঘের দুধ খামু তাইলে আপনে নিশ্চিন্ত থাকবেন বাঘের দুধ আসতাছে। সুন্দরবন থাইক্যা বাঘ আইব, হেই বাঘ পানানি হইব–হেই দুধ জামবাটির এক বাটি চেয়ারম্যান সাব নিয়া খাইব।

মতি তুমি বুঝতে পারিছ না। কাজটা খুবই অন্যায় হয়েছে।

আপনের কাছে অন্যায়, কিন্তুক গ্রামের আর দশটা লোকের কাছে ন্যায়। যেমন ধরেন–আপনের সাইকেল চুরি হইছে। আপনার কাছে মনে হইছে কাজটা অন্যায়। কিন্তু যে চুরি করছে তার কাছে কাজটা ন্যায়।

আনিস শার্ট গায়ে দিল। লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরতে শুরু করল। মতি অবাক হয়ে বলল, শইল খারাপ নিয়া যান কই?

ইমাম সাহেবকে দেখে আসি।

চলেন যাই। ওষুধের বাক্স সাথে নেন। শুনছি ইমাম সাহেবের অবস্থা ভালো না। ক্ষণে ক্ষণে বমি হইতেছে।

আনিসের খুব খারাপ লাগছে। শুধু খারাপ না রাগও লাগছে। বিরাটনগরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে এইসব নিয়ে তার কখনো মাথাব্যথা ছিল না। যা ইচ্ছা হোক। সে ডাক্তার মানুষ, সে রোগের নিদান দেবে। এর বেশি কিছু না। সে রোগ চিনবে, যে মানুষটাকে রোগে ধরেছে তাকে তার চেনার দরকার নেই। বেচারা ইমাম সাহেবের জন্যে তার এই মুহূর্তে যে মায়াটা হচ্ছে তার কারণটা আনিসের কাছে স্পষ্ট না। ইমাম সাহেব তার খুব যে পরিচিত কেউ তা না। ভাসা ভাসা পরিচয়। হঠাৎ দেখা হলে অল্প কিছু কথা। এই মানুষটা মসজিদ এবং মসজিদের পাশে ছোট্ট চালাঘর নিয়ে একা থাকেন। ভদ্রলোকের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে। সারাক্ষণই তাকে দেখা যায় হয় মসজিদ পরিষ্কার করছেন নয়তো নিজের বাড়ি পরিষ্কার করছেন। উঠান ঝাঁট দিচ্ছেন, বাড়ির সামনের আগাছা তুলছেন। তিনি মসজিদের চার কোণায় চারটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ লাগিয়েছেন। এই

গাছ চারটার প্রতি তার মমতা অসীম। কারো সঙ্গে কথা হলেই, কৃষ্ণচূড়া গাছের প্ৰসঙ্গ চলে আসে।

নবনী যখন বিরাটনগরে এসেছিল তখন ইমাম সাহেব বেশ কিছু পাকা তেতুল নিয়ে নবনীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তার বাড়ির দক্ষিণদিকে তেতুলগাছে খুব তেতুল হয়। ইমাম সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে নবনীকে বলেছিলেন–আপনার স্বামীর এই অঞ্চলে ভালো চিকিৎসক হিসেবে খুবই সুনাম। উনাকে কিছু উপহার দিব এই সামর্থ আমার নাই। আপনার জন্যে কিছু পাকা তেতুল আনলাম। আমার গাছে হয়েছে। নবনী বলেছিল–গাছ থেকে পেড়ে এনেছেন?

জ্বি।

গাছে কি এখনো তেতুল ঝুলছে?

জ্বি।

এইগুলো আপনি নিয়ে যান। আমি গাছে উঠে নিজের হাতে পাকা তেতুল পাড়ব।

ইমাম সাহেব খুবই লজ্জিত গলায় বলেছেন–এটা সম্ভব না। মসজিদের কাছে গাছ। সেই গাছে মেয়েছেলে উঠে তেতুল পাড়বে–এটা ঠিক না।

নবনী তেজি গলায় বলেছিল, ঠিক না কেন? আল্লাহ রাগ করবেন?

তার উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছেন, আল্লাহপাক এত সহজে রাগ করেন। না। কিন্তু মানুষ রাগ করে। আমরা এমন যে মানুষের রাগটাকেই বেশি ভয় পাই।

 

ইমাম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। তিনি মেঝেতে পাটির ওপর কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছেন। শীতল পাটি বমিতে মাখামাখি। তিনি বমির মধ্যেই শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছেন। তার মনে হয়৷ এজমা আছে। যতবারই নিঃশ্বাস নিচ্ছেন বুকের ভেতর থেকে শো শো শব্দ আসছে। ঘরে কটু গন্ধ।

মতি বলল, ইমাম সাব জাগনা আছেন? ডাক্তার সাব আসছেন।

ইমাম সাহেব মাথা তুলে তাকালেন। আবার মাথা নামিয়ে ফেললেন। তাকে দেখে মনে হলো না। তিনি কাউকে চিনতে পেরেছেন।

আনিস বলল, মতি উনাকে গোসল দেয়া দরকার। গোসল করাতে পারবে?

মতি বলল, আপনে বললে পারব।

আনিস বলল, বালতিতে করে পানি আন। সাবান আন। দুজনে মিলে গোসল দিয়ে দেই।

মতি বলল, আপনার এত ঠেকা কী ডাক্তার সাব!

ডাক্তার বিরক্ত গলায় বলল, সে একজন রোগী। এই জন্যেই আমার ঠেকা।

মতি ডাক্তারকে হাত দিতে দিল না। নিজেই সাবান দিয়ে ডলে গোসল দিল। শরীর মুছে শুকনো কাপড় পরিয়ে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিল। ইমাম সাহেবের গায়ে জ্বর নেই। জ্বর ছাড়াই তিনি কাঁপছেন। আনিস বলল, আপনি রাতে কিছু খেয়েছেন?

ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, জ্বি না।

আপনার খাবার কে রোধে দেয়?

আমি নিজে রান্ধি ডাক্তার সাব।

আমি আপনার জন্যে এক গ্লাস দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে শুয়ে থাকুন। দুটা ট্যাবলেট পাঠাব। দুধ খাওয়ার পরে খাবেন। ঘুমের ওষুধ। ভালো ঘুম হবে।

ইমাম সাহেব কিছু বললেন না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। ডাক্তার দ্রুত চিন্তা করছে–ঘুমের ওষুধ ছাড়াও কি আরো কিছু দেয়া দরকার। মানুষটার স্নায়ুর ওপর দিয়ে একটা ঝড়ের মতে গিয়েছে। উত্তেজিত স্নায়ু ঠিক করতে হলে কী সিডেটিভ দিতে হবে? মানুষটা একা থাকে। একজন কেউ সঙ্গে থাকলে ভালো হতো। কথাবার্তা বলতে পারত। মানুষের সঙ্গ মাঝে মাঝে ওষুধের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর হয়।

ডাক্তার সাব আপনার অনেক মেহেরবাণী।

মেহেরবানির কিছু না। আপনি বিশ্রাম করুন।

ইমাম সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যে অপরাধের জন্যে আমার শাস্তি হয়েছে সেই অপরাধ আমি করি নাই। তবে নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ করেছি। যে কারণে আল্লাহপাকের নির্দেশে আমার শাস্তি হয়েছে। উনার অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না।

ডাক্তার বলল, আপনি কথা বলবেন না। বিশ্রাম করুন। আমি ওষুধ পাঠাচ্ছি।

ইমাম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বিড়বিড় করে নিজের মনেই বললেন, ডাক্তার সােব আপনার মেহেরবানি।

ফেরার পথে মতি তিক্ত গলায় বলল, কেমন মানুষ দেখছেন ডাক্তার সাব? মুখে একবার বলল না–ধন্যবাদ। বমি সাফ করা আর গু সাফ করা একই। বমি পেটে আর কিছুক্ষণ থাকলেই গু হইয়া যায়–কথা সত্য কিনা বলেন ডাক্তার সাব।

আনিসা জবাব দিল না। ইমাম সাহেবের বাড়ি গ্রামের শেষ মাথায়। আনিসকে শরীরে জ্বর নিয়ে অনেকখানি হাঁটতে হয়েছে। বেশ খারাপ লাগছে। অসহ্য লাগছে মতির বকবকানি। আনিস মতিকে চলে যেতে বলতে পারছে না। কারণ মতিকে দিয়ে ওষুধ পাঠাতে হবে।

গরম কেমন পড়ছে দেখছেন ডাক্তার সাব?

হুঁ।

এখন আশ্বিন মাস–কেঁথা-শীত পড়নের কথা। পড়ছে। গরম। দুনিয়া উলট পালট হওয়া শুরু হইতেছে। কেয়ামত মনে হয় কাছাইয়া পড়ছে। কী কন?

হতে পারে।

মতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, কেয়ামতের আগে আগে মাটির তল থাইক্যা এক জন্তু ৰাইর হইব। হে মানুষের মতো কথা বলব। এই জন্তুটা দেখার বড় শখ ছিল। দশ পনরো বছরের মধ্যে কিয়ামত হইলে জম্বুটা দেখতে পারতাম। জন্তুর সাথে দুই চাইরটা কথা বলতে পারতাম। ডাক্তার সােব আপনের কি মনে হয় দশ বছরের মধ্যে কিয়ামত হইতে পারে?

জানি না মতি।

জন্তুটা কোন ভাষায় কথা বলব কে জানে! চাইনীজ ভাষায় কথা বললে আমরা বাঙালিরা কিছুই বুঝব না।

মতি, কথা বলা একটু বন্ধ রাখ। মাথা ধরেছে।

আমার নিজেরো মাথা ধরছে ডাক্তার সাব এই জন্যেই কথা বেশি বলতেছি। আমি একটা জিনিস পরীক্ষা কইরা বাইর করছি–মাথায় যদি খুব যন্ত্রণা হয় তাইলে কথা বললে যন্ত্রণা কমে। আর কথা না বইল্যা ঘরের চিপাত বইস্যা থাকলে মাথা ধরা বেজায় বাড়ে।

এক গ্লাস দুধ, দুটা বিসকিট আর ওষুধ নিয়ে মতি রওনা হলো ইমাম সাহেবের বাড়ির দিকে। পথে কিছুক্ষণ দেরি হলো–ইষ্টিশনের চায়ের দোকানটা খোলা, মতি এক কাপ চা খেল। চা খাওয়া মানেই গল্পগুজব। গল্পগুজবেও কিছু সময় গেল। সেখান থেকে গেল বাতাসীর ঘরে। জেনে যাওয়া–ঐ লোকটা এখনো তার ঘরে আছে কি-না। থাকলেও কিছু যায় আসে না–না থাকলেও না। লোকটা তো আর বিনা পয়সায় থাকছে না। পয়সা দিয়ে থাকছে। লোকটা যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে বাতাসীর সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়া যাবে। এই ভেবে সে পুরনো কোকের বোতল ভর্তি করে এক বোতল চা সঙ্গে নিয়ে নিল। বাতাসীর ঘরে লোক থাকলে কোকের বোতল নিয়ে ইমাম সাহেবের কাছে যাবে। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তাতে অসুবিধা নাই। ঠাণ্ড চা খেতে মতির খারাপ লাগে না। বরং ঠাণ্ডা। চা খেতেই তার বেশি ভালো লাগে।

এত সব করতে মতির অনেক দেরি হয়ে গেল। সে ইমাম সাহেবের বাড়ি পৌছাল রাত একটায়। আকাশে তখন কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। আবছা আবছা সব কিছু দেখা যায়। মতি হতভম্ব হয়ে দেখল। ইমাম সাহেবের বাড়ির ডান দিকের তেতুল গাছের নিচে কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। মতি বলল–কেডা গো?

কেউ জবাব দিল না।

মতি বলল–কেডা? আপনে কে?

এই প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া গেল না।

মতি এগিয়ে গেল। তার জন্যে বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। তেতুল গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না। তেতুল গাছের ডাল থেকে ঝুলছিলেন ইমাম সাহেব। মতি অতি দ্রুত দা দিয়ে দড়ি কেটে তাকে নামাল। ইমাম সাহেব বিড় বিড় করে কী যেন বললেন, ঠিক বুঝা গেল না। মনে হলো–পানি খেতে চাইছেন। মতি ছুটে গেল পানি আনতে–তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইমাম সাহেব মারা গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *