বিজ্ঞান কি কুসংস্কারাচ্ছন্ন?
আধুনিক জীবন দু’ভাবে বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। একদিকে আমাদের সকলকে দৈনন্দিন রুটি-রোজগার এবং আরাম-আয়েশের জন্য বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হয়। অন্যদিকে মনের কতেক স্বভাব যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, বিগত তিনশ বছর ধরে কয়েকজন প্রতিভাবানের কাছ থেকে সমাজের বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানের এ দু’রকমের প্রভাব যে পরস্পর অনিষ্ট তা সুদীর্ঘকাল ধরে বিচার বিশ্লেষণ করলে ধরা পড়ে, কিন্তু একটা অন্যটাকে ছাড়া কয়েকশ বছর পর্যন্ত চলে যেতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিক ছাড়া মনের বৈজ্ঞানিক স্বভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি। কারণ তার আগে বিরাট বিরাট আবিষ্কারের ফলে শিল্পোৎপাদন পদ্ধতিতে বিপ্লবের সঞ্চার হয় নি। অন্যদিকে বিজ্ঞান যে ধরণের জীবন পদ্ধতির সৃষ্টি করেছে তা তারাই গ্রহণ করল শুধু বিজ্ঞান সম্বন্ধে যাদের সামান্য বাস্তব জ্ঞান আছে এবং এ সমস্ত লোকেরা যেখানেই আবিষ্কৃত হোক না কেন যন্ত্র তৈরি, ব্যবহার এমনকি অল্পস্বল্প উৎকর্ষ সাধনও করতে পারে। মানবজাতির সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তি যদি লোপও পায় তাহলেও যে কারিগরি এবং দৈনন্দিন জীবনের সৃষ্টি করেছে তা সমগ্র সম্ভাবনাসহ কয়েকপুরুষ ধরে অক্ষয়ভাবে বিরাজ করবে। কিন্তু চিরদিনের মতো স্থায়ী হতে পারবে না, কেননা কোন আকষ্মিক বিপত্তির ফলে ধ্বংস হয়ে গেলে এর পূণর্নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
সুতরাং ভালোর জন্য হোক, মন্দের জন্য হোক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি মানবজাতির একান্তই প্রয়োজন। শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গীর মতো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীও দু’ভাবে বিভক্ত। স্রষ্টা এবং সমালোচক, দু’জনেই আলাদা মানুষ এবং তাদের প্রত্যেকেরই মনের আলাদা স্বভাব। অন্যান্য স্রষ্টার মতো বৈজ্ঞানিক স্রষ্টারাও আবেগে উদ্দীপিত হন, যার ফলে তারা অপ্রকাশিত সত্যের বুদ্ধিগ্রাহ্য বর্ণনা দিতে পারেন। এ না হলে কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারবেন না। সমালোচকের এ ধরনের বিশ্বাস বা প্রত্যয় না থাকলে চলে। তিনি প্রয়োজন মতো আনুপাতিকভাবে জ্ঞাত হয়ে সংরক্ষণ করেন এবং নিজের তুলনায় স্রষ্টাকে একজন কদর্য বর্বরব্যক্তি হিসেবেও ভাবতে পারেন। যখন সভ্যতা অত্যধিক পরিব্যপ্ত এবং ঐতিহ্যাশ্রয়ী হয়ে পড়েছে তখন সমালোচকদের মনে স্রষ্টাদের মন জয় করবার প্রবৃত্তিও দেখা গেছে। এর ফলে সভ্যতার প্রশ্ন বাইজানটাইনের মতো পুরনো এবং বহিদর্শনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানেও অনুরূপ কিছু বোধকরি ঘটতে শুরু করেছে। যে সরল বিশ্বাসের রজ্জু ধরে পুরোধা ব্যক্তিরা অগ্রসর হচ্ছিলেন তার মর্মমূল এখন শুকিয়ে গেছে। বাইরের জাতিগুলো যেমন রাশিয়ান জাপানি এবং তরুন চীনারা এখনও বিজ্ঞানকে সপ্তদশ শতাব্দীর বৈশিষ্ট্যেমণ্ডিত হিসাবে দেখতে চান, তেমনি চান প্রতীচ্যের অনেকগুলো জাতি। কিন্তু ধর্মযাজকেরা এখন তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে নিবেদিত ধর্ম-কর্মে আস্থা স্থাপনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ধার্মিক তরুণ লুথার একজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন পোপকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। তিনি তার রোগমুক্তি কামনা করে রোমের মন্দিরে জুপিটার দেবতার কাছে ষাঁড় বলি দিয়েছিলেন। বর্তমানে সভ্যতা সংস্কৃতির পীঠস্থান থেকে যারা দূরবর্তী তারাও বিজ্ঞানের প্রতি তেমনি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছেন। জার্মান প্রোটেস্টানিজমের মতো বলশেভিকদের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদও হলো পুরনো শ্ৰেয়োবোধকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা, যা বন্ধু এবং শত্রু সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে নতুন মতবাদ হিসাবে। নিউটনের মৌলিক আনুপ্রেরণা পশ্চিমের বুর্জোয়া বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংশয়বাদের জন্ম দিয়েছে। বিজ্ঞানকে ক্রিয়াপদ্ধতি হিসাবে রাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের উৎসাহদাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেনেসি রাজ্যের মতো রাষ্ট্র যেখানে প্রাকবৈজ্ঞানিক স্তর অতিক্রম করতে পারে নি, সেখানে ছাড়া রাজনৈতিকভাবে অন্যান্য রাষ্ট্র রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। পূর্বের অবস্থা রক্ষা করাই আজকের বিজ্ঞানের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলতঃ তারা বিজ্ঞানের যা প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি কিছু দাবি করতে ইচ্ছুক নন। ধর্মের মতো রক্ষণশীল শক্তির চাইতে বিজ্ঞানের দাবি যে বেশি, তা তারা স্বীকার করেন না।
সে যা হোক তারা এক মস্ত বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন। বিজ্ঞানের মানুষেরা এখন মুখ্যতঃ রক্ষণশীল হলেও বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত পৃথিবীর দ্রুত পরিবর্তনের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।
.
এ পরিবর্তনের ফলে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপের শিল্পাঞ্চলের মানুষের মনে যে আবেগের সঞ্চার করেছে তা অনেক সময় রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন মানুষদের অসন্তে ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং বিজ্ঞানের মূল্য সম্বন্ধে এক ধরনের গড়িমসি মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে পুরোত এবং ধর্মযাজকদের মধ্যে সংশয়বাদের উদয় হয়েছে। তা যদি একা হতো তা হলে তত বেশি প্রয়েজনীয় হতো না, কিন্তু প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক অসুবিধাগুলো এর সঙ্গে যুক্ত এবং তা যদি অনতিক্ৰমণীয় হয়ে দেখা দেয়। তাহলে বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার উপর যবনিকাও টেনে দিতে পারে। একথার মানে আমি এ বলতে চাচ্ছি যে খুব শিগগিরই তেমন কিছু ঘটবে। প্রতীচ্য যে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে, এশিয়া এবং রাশিয়া আরো শতবছর হয়ত সে বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকতে পারে। শিগগির হোক অথবা দেরিতে হোক এ বিশ্বাস বর্জন করার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রবল হয়ে দেখা দেবে এবং লোকসাধারণকে যে কোনভাবেই প্রভাবিত করবে; তার ফলে তারা ক্ষণিকের জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়লেও পূর্বের সে আনন্দিত বিশ্বাসে ফিরে আসতে পারবে না। সুতরাং বিজ্ঞানের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিগুলো সযত্ন পরীক্ষার দাবি রাখে।
বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের নামে আমি এ কথা বলছি না যে তা শুধু যুক্তিগতভাবে প্রয়োগক্ষম, শুধু যে অর্থে বিজ্ঞান সত্য; কিন্তু আমি বলছি এমন কিছু যা অধিকতর উৎসাহব্যঞ্জক এবং কম যুক্তিনির্ভর। নাম করে বলতে গেলে সে সমস্ত আবেগ এবং বিশ্বাসের পদ্ধতি যা মানুষকে শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারক হতে অনুপ্রাণিত করে। এখন কথা হলো এ সমস্ত বিশ্বাস এবং আবেগ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে স্থায়ীভাবে বিরাজ করতে পারে কিনা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি ছাড়া কি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অসম্ভব?
এ সমস্যার প্রকৃতি অনুধাবন করতে হলে সাম্প্রতিক দুটো চিত্তাকর্ষক বই আমাদেরকে প্রভূত সাহায্য করবে। বই দুটো হলো বার্ট এর ‘মেটাফিজিক্যাল ফাউণ্ডেশানস অব মডার্ন সায়েন্স’; প্রকাশকাল ১৯২৬ এবং হোয়াইটহেডের সায়েন্স অ্যাণ্ড দ্যা মডার্ন ওয়ার্ল্ড’; প্রকাশকাল ১৯২৬। এ দুটোর প্রত্যেকটাতেই আধুনিক পৃথিবী কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও এবং নিউটনের কাছ থেকে যে ধারণা পদ্ধতি পেয়েছে তার সমালোচনা করেছে। প্রথমটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখা হয়েছে। ড. হোয়াইটহেডের বইটিই অধিকতর দরকারি, কেননা তা শুধু সমালোচনা নয় ওতে গঠনমূলকও অনেক কিছু রয়েছে, ভবিষ্যতের বিজ্ঞানের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিসম্মত ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টাও তাতে করা হয়েছে। অধিকন্তু বইটাতে বিজ্ঞানবাদে মানুষের সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আবেগদীপ্ত অনেক কিছুই রয়েছে। ড. হোয়াইটহেড তার থিয়োরির যে অংশকে আনন্দদায়ক আখ্যা দিয়ে যুক্তির অবতারণা করেছেন, আমি তা সমর্থন করতে পারি না। বৈজ্ঞানিক ধারণাক্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিসঞ্জাত ধারণা গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েও আমি মনে করি যে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কহীন আবেগ বিজ্ঞানের দিকে প্রবল টান ব্যতিরেকে পুরনো ধারণার মতো নতুন ধারণাকেও গ্রহণ করতে পারবে না এর সমর্থনে কি যুক্তি আছে, এখন আমরা তা তলিয়ে দেখছি।
.
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গিয়ে, ড. হোয়াইটহেড নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বস্তুপুঞ্জে সুসমঞ্জস সমাহারের প্রতি প্রবৃত্তিগত ব্যাপক বিশ্বাস ব্যতিরেকে জীবন্ত বিজ্ঞান বলতে কিছুই থাকতে পারে না। বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছেন একমাত্র তারাই যাদের এ বিশ্বাস ছিল। সুতরাং বিশ্বাসের মৌল উৎস প্রাক-বৈজ্ঞানিক। নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞানের আবির্ভাবের জন্য যে মিশ্র মনোভাবের প্রয়োজন ছিল তাতে অন্যন্য উপাদানও মিশ্রিত হয়েছিল। তার মতে জীবন সম্বন্ধে গ্রিকদের ধারণা ছিল নাটকীয়, সূচনার চাইতে সমাপ্তিকেই জোর দেয়া হতো বেশি। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করতে গেলে এটাও একটা বিচ্যুতি। অন্যদিকে গ্রিক বিয়োগান্ত নাটকে নিয়তির ধারণা থেকে প্রত্যেকটা ঘটনার যে প্রাকৃতিক নিয়মের উপর নির্ভরশীল তার উদ্ভব হয়। গ্রিক নাটকের নিয়তির ধারণা আধুনিক চিন্তায় প্রাকৃতিক বিধান বলে রোমান সরকার (অন্ততঃ থিয়োরিগতভাবে হলেও) প্রাচ্যের স্বেচ্ছাচারী শাসকদের মতো খেয়ালখুশী মতো শাসনকার্য পরিচালনা করে নি, বরঞ্চ পূর্বনির্ধারিত আইনকানুন অনুসারেই তারা শাসন-শৃঙ্খলা পরিচালনা করেছে। অনুরূপভাবে খ্রিস্টধর্মও আইনানুসারে ভগবানের ধারণা করেছে যদিও সে আইনগুলো ভগবানেরই স্থিরীকৃত। এসবের ফলে প্রাকৃতিক আইনের সৃষ্টির পথ পরিষ্কার হয় এবং তা বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গীর একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য।
যে সমস্ত অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর অগ্রদূতদের অনুপ্রাণিত করেছিল, ড. বার্ট সেসব খুবই প্রশংসনীয়ভাবে অজ্ঞাত অনেক মৌলিক উৎসের সাহায্যে উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কেপলারের অনুপ্রেরণার মূলে ছিল জরথুস্ত্রীয়দের সূর্য উপাসনা যা তিনি যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বরণ করে নিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে সূর্যকে দেবতা জ্ঞান করে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করার পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। রেনেসাঁর যুগে খ্রিস্টিয় ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বিরোধ প্রাথমিকভাবে প্রাচীন আদিমতার প্রশংসার মধ্যে যার অঙ্কুর নিহিত ছিল, সর্বত্রই পরিলক্ষিত হতো। নিয়মের মাধ্যমে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি খোলাসাভাবে, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদির যে পুণঃপ্রচলন হয়েছে, তার ফলে তা উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। গির্জা শারীরিক নির্যাতন করে তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিল। খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ তার সঙ্গে মিশেছিল কুসংস্কার যেমন বিজ্ঞানে কেপলারের ব্যাপারেও ছিল অঙ্গাঙ্গীভাবে কুসংস্কার বিজড়িত।
কিন্তু তার একটি অসুবিধা আছে, তাহলো অপ্রতিরোধ্য এবং কর্কশ সত্যের প্রতি স্পৃহা, যার প্রয়োজন একইভাবে অপরিহার্য, মধ্যযুগে তা অনুপস্থিত ছিল এবং প্রাচীনকালে তা সাধারণত দৃষ্টিগোচর হতো না। রেনেসাঁর আগে বস্তুর প্রতি অনুসন্ধিৎসা ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে দেখা যেত। উদাহরণস্বরূপ সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক এবং রোজার বেকনের নাম করা যেতে পারে। কিন্তু রেনেসাঁর সময়ে তা বুদ্ধিমান লোকদের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক আইনের প্রতি অনাসক্ত মতের লেখার মধ্যেও তা দেখা যায়; অথচ মতে বিজ্ঞানের মানুষ ছিলেন না। সাধারণ অথবা বিশেষ আকর্ষণের আশ্চর্য রসায়ন ঘটেছিল বিজ্ঞানের ব্যাপারে। বিশেষ বিশেষ বিষয় এই আশায় পড়া হতো যে তার ফলে সাধারণ বিষয়সমূহের উপর আলোকসম্পাত করা যাবে। মধ্যযুগে এটা ভাবা হতো যে সাধারণ নীতি মেনে বিশেষ সিদ্ধান্তে আসা যায়। রেনেসাঁর সময়ে তা প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হলো। ঐতিহাসিক পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে আগ্রহ তাদেরকে বিশেষ বিশেষ ঘটনার প্রতি প্রবল আগ্রহী করে তোলে। মনের এই স্পৃহা যা গ্রিক রোমান এবং ঐতিহ্যাশ্রয়ী জ্ঞানের মাধ্যমে শিক্ষিত এবং সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল, যা গ্যালিলিও কেপলারের অভ্যুত্থানকে সম্ভবপর করে তুলেছিল! স্বভাবতঃই এই আবহাওয়ার কিছুটা তাদের কাজকে বেষ্টন করেছিল এবং তা তাদের আজকের দিনের উত্তরাধিকারীর মধ্যে চলে এসেছে। বিজ্ঞান কখনও পরবর্তী রেনেসাযুগের ঐতিহাসিক বিদ্রোহ যা বিজ্ঞানের উৎসমূল তাতে নাড়া দেয় নি। প্রধানতঃ তা ছিল অবিবেচনাপ্রসূত একটি আন্দোলন এবং যা জনসাধারণের প্রচলিত বিশ্বাসেরই উপর ছিল প্রতিষ্ঠিত এবং যে অনুমানের অভাব ছিল, তাতে আর অভাব মিটান হলো অঙ্কবিদ্যা হতে ধার করে। এ অনুমান ছিল অবরোহপদ্ধতি অনুসারে গ্রিক হেতুবাদের প্রচলিত অপভ্রংশ। বিজ্ঞান দর্শনের সম্পর্ক অস্বীকার করল। অন্য অর্থে বলতে গেলে এর বিশ্বাসকে যাচিয়ে দেখা অথবা অর্থ ব্যাখ্যা করার এত যত্ন নেয় নি, হিউমের দ্বারা বর্জিত হয়েও আড়ালে অগোচরে রয়ে গেল।
শৈশবে যে যে কুসংস্কারের ক্রোড়ে লালিত হয়েছে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে বিজ্ঞান টিকে থাকতে পারবে কিনা? অবশ্য দর্শনের প্রতি বিজ্ঞানের নিস্পৃহতার কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানের অত্যাধিক সাফল্য, তা মানবশক্তির ধারণাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে গোড়া ধর্মমতের সঙ্গে সংঘাত ছাড়া প্রায় সর্বাংশে মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। তাহলেও হালে বিজ্ঞান নিজের সমস্যার গরজেই দর্শনের প্রতি আগ্রহশীল হয়ে পড়েছে, যা থিয়োরি অব রিলেটিভিটির মধ্যে সত্য হিসেবে দেখা দিয়েছে; বিশেষভাবে যার ফলে স্থান এবং কালকে স্থান-কাল একক সত্তা বলে স্বীকার করা হয়েছে। গতির বিচ্ছিন্নতার আপাতঃ প্রয়োজনীয়তার মধ্যে কোয়ান্টামতত্ত্বেও তা সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। অন্যদিকে শারীরবিদ্যা এবং জৈব রসায়নবিদ্যা মনস্তত্ত্বের শিকড় প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দর্শনেরও ভয়ঙ্কর ভীতির কারণ হয়ে পড়েছে। ড. ওয়াটসনের ব্যবহারবাদ হলো তার মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্ণতম, তাতে দর্শনের ঐতিহ্যের প্রতি শুধু অসম্মান দেখান হয় নি। পক্ষান্তরে ব্যবহারবিদ নিজস্ব একটি নতুন দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ সকল কারণে বিজ্ঞান ও দর্শন দীর্ঘকাল ধরে সশস্ত্র নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে না। তাদেরকে পরস্পরের বন্ধু অথবা শত্রু দু’টোর একটা হতেই হবে। বিজ্ঞান যতদিন দর্শনের বক্তব্যের মধ্যে যে-সকল প্রশ্ন তুলে ধরবে, পাশ না করা পর্যন্ত একে অপরের পরিপূরক অথবা বন্ধু হতে না পারলে, একে অপরকে অবশ্যই ধ্বংস করবে; কিন্তু একা একটি যে প্রভুত্ব করবে তারও কোন সম্ভাবনা নেই।
ড. হোয়াইটহেড বিজ্ঞনের দার্শনিক বিচারের জন্য দু’টি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। একদিকে তিনি নতুন ধারণা দিয়েছেন, যার সাহায্যে রিলেটিভ বা আপেক্ষিক পদার্থবিদ্যা এবং কোয়ান্টামকে অতীতের নিরেট পদার্থবাদ দিয়ে গঠন করার চাইতে অধিকতর সন্তোষজনক বুদ্ধিগ্রাহ্য উপায়ে গঠন করবার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তার কীর্তির এ অংশে যা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে উঠে নি, যদিও বিজ্ঞানের ব্যাপক ধারণার মধ্যে ভূণ হিসাবে তা রয়ে গেছে। সাধারণ পদ্ধতি সমূহের সাহায্যে যাচাই করা যায়, যা কিছু বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর সম্বন্ধের থিয়োরিগত বিশ্লেষণের দিকে আমাদের প্রচেষ্টাকে পরিচালিত করে। কারিগরি দিক দিয়ে দেখলে তা খুব জটিল এবং এ সম্পর্কে আর কিছু বলছি না। আমাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ড. হোয়াইটহেডের গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর অতিদার্শনিক অংশ: তিনি শুধু উৎকৃষ্টতর বিজ্ঞানকে দেন নি, এমন একটি দর্শন দিয়েছেন যা বিজ্ঞানকেও যুক্তিসিদ্ধ করতে সক্ষম; কিন্তু তা এই অর্থে যে ঐতিহ্যিক বিজ্ঞান হিউমের পূর্বে কখনো যুক্তিনির্ভর ছিল না। তার দর্শন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বের্গসঁনের দর্শনেরই সমগোত্রীয়। আমি নিজে অসুবিধা বলে যা মনে করছি তা হলো এ পর্যন্ত ড. হোয়াইটহেডের যে ধারণা তাকে ফর্মুলাবদ্ধ করে যে কোন সাধারণ বৈজ্ঞানিক বা যুক্তির পরীক্ষায় ফেলে যাচাই করা যায়, কিন্তু তার দর্শনের মধ্যে তার কোন উল্লেখ নেই। সুতরাং দর্শনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। বিজ্ঞান সত্যকে স্বীকার করে শুধু এ কারণে আমরা তা গ্রহণ করব না, এ কারণেও গ্রহণ করব যে তা বিজ্ঞানকেও যুক্তিসম্মত করে তোলে। প্রত্যক্ষভাবে আমাদের পরীক্ষা করে অবশ্যই জেনে নিতে হবে যা সত্য মনে হয় আদতে তার বাস্তব সমর্থন আছে কিনা এবং এখানেই আমরা পুরনো সকল রকমের হতবুদ্ধির শিকার হয়ে পড়ি।
আমি শুধু একটা বিষয়কে নিচ্ছি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকলেই জানেন, বের্গসঁন মনে করতেন স্মৃতিতে অতীত জীবিত থাকে এবং মনে করতেন আদতে মানুষ কিছুই ভুলতে পারে না। এ সকল দিকে তার সঙ্গে ড. হোয়াইটহেডের মতের মিল রয়েছে। এ হলো কাব্যের জন্য খুবই সুন্দর কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে তার সাহায্যে যথাযথ বাস্তব কিছু নির্দেশ করা যায় না (অন্তত আমার তাই-ই চিন্তা করা উচিত)। আদি যদি অতীত কোন ঘটনাকে স্মরণ করি, উদাহরণস্বরূপ যেমন আবার চীনে আগমন, তাহলে তা শুধু কথার কাঠামো যে আমি আবার চীনে আগমন করছি। যখন আমি স্মরণ করি তখন কিছু সংখ্যক শব্দ বা প্রতাঁকের প্রয়োজন হয়। কার্যকারণ সূত্র এবং যৌক্তিক সমতার চাইতে কিছু বেশি অংশে কী স্মরণ করছি তার সঙ্গে সম্পর্কশীল। স্মৃতিকে যদি আমরা অতীত ঘটনার অনুরণন বলতে চেষ্টা করি, তাহলেও কিন্তু অতীত ঘটনা স্মরণ করবার বৈজ্ঞানিক সম্বন্ধ অটুট থেকে যায়। যদি আমরা তা বলি তা হলেও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হব সময়ের ব্যবধানে ঘটনাটির পরিবর্তন হয়েছে এবং এ পরিবর্তন কেননা হয় তার কারণ আবিষ্কার করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমস্যার সম্মুখীন হব। আমরা স্মৃতিতে নতুন ঘটনা অথবা বহুলাংশে পরিবর্তিত পুরনো ঘটনা বললেও তাতে বৈজ্ঞানিক সমস্যাটির কিছুই হয় না।
হিউমের সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানের দর্শনের প্রধানতম আপবাদ ছিল কার্যকারণ এবং আরোহ পদ্ধতি। আমরা সকলেই দুটোতেই বিশ্বাস করি। কিন্তু হিউম দেখিয়ে দিলেন যে আমাদের বিশ্বাসসমূহে অন্ধতার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। ডঃ হোয়াইটহেড বিশ্বাস করেন তার দর্শন হিউম দর্শনের একটি জবাববিশেষ। কান্টও তাই করেছেন। আমি নিজে কিন্তু এ দু-উত্তরের কোনটাকেই গ্রহণ করতে পারিনে। তা সত্ত্বেও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে মত মিলিয়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে অবশ্যই একটা উত্তর থাকতে হবে। এ জাতীয় ক্রিয়াকলাপ মোটেই সন্তোষজনক নয়, বিজ্ঞানের মতো দর্শনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে একটা জবাব পাওয়া যাবে, কিন্তু সে জবাব পাওয়া গেছে একথা মানতে আমি মোটেই রাজি নই।
বর্তমানের বিজ্ঞানের কিছু অংশ আমাদের প্রিয় এবং কিছু অংশ প্রিয় নয়। পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি দান করে বলে প্রায় বুদ্ধিবৃত্তিক সন্তষ্টি দান করতে পারে বলে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে তা গ্রহণীয় হয়ে থাকে। তা অপ্রিয়, এ কারণে যে, যতই আমরা সত্যকে ঢেকে রাখতে চেষ্টা করি না কেন, থিয়োরি গতভাবে মানুষের কাজকে পূর্বাহ্নে নির্ধারিত করার শক্তিতে বিশ্বাস করে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তা মানুষের শক্তির স্বল্পতা সাধন করেছে। সভাবতঃই মানুষ বিজ্ঞানের অপ্রিয় দিকটিকে বাদ দিয়ে প্রিয় দিকটিকে গ্রহণ করতে চায়। সে জন্যে এ পর্যন্ত যতরকমের চেষ্টা করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিই বিফলমনোরথ হয়েছে। যদি আমরা এ সত্যের উপর জোর দেই যে আরোহ এবং কার্যকারণ পদ্ধতির উপর আমাদের যে বিশ্বাস তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, তাহলে আমাদের অনুমান করতে হয় যে আমরা-বিজ্ঞানকে সত্য বলে মানি না এবং যে কারণে বিজ্ঞান আমাদের কাছে প্রিয় যে কোন মুহূর্তে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি এর পরিবর্তে যে মতবাদ এখন সম্পূর্ণভাবে থিয়োরিগত আধুনিক মানুষ তা এখন বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারে না। পক্ষান্তরে যদি আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দাবিকে মেনে নেই তাহলে আমরা এ উপসংহার কিছুতেই এড়াতে পারব না যে আরোহ এবং কার্যকারণ পদ্ধতিকে অন্যান্য সবকিছুর মতো মানুষের সংকল্পেও প্রয়োগ করা যায়। বিংশশতাব্দীর পদার্থ, শারীরবিদ্যা এবং মনস্তত্ত্ব যা কিছু ঘটেছে সবকিছু একসঙ্গে এই উপসংহারকে বলবৎ করেছে। এর ফলাফল সম্ভবত এ দাঁড়াতে পারে যে, যদিও বিজ্ঞানের যুক্তিসম্মত মূল্যায়নের থিয়োরি অপর্যাপ্ত, তবু বিজ্ঞানে এমন কোন পদ্ধতি নেই যাতে করে বিজ্ঞানের অপ্রিয় দিকটি বাদ দিয়ে প্রিয় দিকটি গ্রহণ করা যায়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে যুক্তি তা দিয়ে হয়ত আমরা তা করতে পারি, কিন্তু তা করলে বিজ্ঞানের উৎসমূলকে আমরা শুকিয়ে ফেলব অথচ তাই হলো পৃথিবীকে বুঝবার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা’ ভবিষ্যতে এ জটিল সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যাবে এটা আশা করা যায়।