০৩. বাসায় ফিরলাম রাত বারোটার দিকে

বাসায় ফিরলাম রাত বারোটার দিকে। বাবা নিউ বিরানি হাউজ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। গলা নিচু করে বললেন, My son, বাকি রাস্তা একা একা যেতে পারবি না? আমি বললাম, পারব।

বাবা বললেন, Thats good. এই মুহূর্তে ওদের সামনে পড়তে চাই না। বিসমিল্লাহ বলে চলে যা। আল্লাহু শাফি। আল্লাহু কাফি।

বাসায় এসে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড। দি ইমেজ-এর সামনে অনেক লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। পুলিশও আছে। আমাদের বাসার সব লাইটও জ্বলছে। বারান্দায় ভাইয়া এবং মা হাঁটাহাঁটি করছেন। আমি গেটে হাত রাখতেই ভাইয়া ছুটে এসে আমার হাত ধরল।

কই ছিলি এত রাত পর্যন্ত? বাসা খুঁজে পেয়েছিলি?

না।

খুঁজে না পেলে চলে আসবি। গাধা না-কি? এত রাত পর্যন্ত কেউ বাইরে থাকে? দিনকাল খারাপ। এদিকে বিরাট গণ্ডগোল।

কী গণ্ডগোল?

ঘরে আয় সব শুনবি। বারান্দার লাইট সব নিভিয়ে দে। গেটে তালা লাগাতে হবে।

ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে তালা লাগাতে গেল। মা আমাকে টেনে বাড়িতে ঢুকালেন। খাবার টেবিলে বসিয়ে বললেন, বাবলু, আয় আগে ভাত খা।

আমি বললাম, ভাত খেয়ে এসেছি মা।

ভাত কোথায় খেয়ে এসেছিস?

ভাত খাই নি। ভুল বলছি। শরীর খারাপ লাগছে। বাসা খুঁজতে গিয়ে অনেক হাঁটাহাঁটি। বৃষ্টিতে ভিজেছি, এই জন্যে বোধহয় শরীর খারাপ করেছে। বমি আসছে।

বাসা খোঁজাখুঁজির কোনো দরকার নাই। আমরা পাকা খবর পেয়েছি। যে অ্যাডভোকেট সাহেবের বাসায় সে থাকে, উনিই খবর দিয়েছেন।

আমি বললাম, ভাইয়া বলছিল, এদিকে গণ্ডগোল। কী গণ্ডগোল?

সকালে শুনিস। রাতে শোনার দরকার নেই।

এখনি বলো।

ভিডিওর দোকানে গণ্ডগোল হয়েছে। গোলাগুলি। খুনাখুনি।

কে করেছে গোলাগুলি?

ভিডিওর দোকানের ম্যানেজার। কাদের নাম। মালিককে গুলি করেছে–মালিকের সঙ্গে তার জানি দোস্ত আমাদের ছাগলটা ছিল সে-ও গুলি খেয়েছে।

জহির ভাই গুলি খেয়েছে?

হুঁ।

কেউ মারা গেছে নাকি?

দুজনই বোধহয় মারা গেছে। লোকজন তাই বলছে। অ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে গেছে। পুলিশ এই বাড়িতেও এসেছিল। খোকনের সঙ্গে কথাবার্তা বলল।

কী কথা বলল?

জানি না। জিজ্ঞেস করি নি।

আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পান খাচ্ছেন। ঠোঁটে চুন লেগে আছে। তার চেহারায় চোখে-মুখে শান্তি শান্তি ভাব। জহির ভাই অনেকদিন এ বাড়িতে আছেন। তিনি পালক পুত্র হন যাই হন তিনি তো আমাদেরই একজন। তিনি গুলি খেয়েছেন। লোকজন বলছে সম্ভবত মারা গেছেন। এ নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই।

সত্যি ভাত খাবি না?

না।

দুধ খাবি? এক কাপ দুধ দেই, খা।

না।

তাহলে যা হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়।

জহির ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেব না?

এই নাম এখন কিছুদিন মুখেও আনবি না। পুলিশের তদন্ত-টদন্ত শেষ হোক। তারপর।

যদি মারা গিয়ে থাকেন?

মারা গেলে পুলিশ খবর দিবে। শহরের মাঝখানে জোড়াখুন বিরাট ঘটনা। চ্যানেল আই-এর নিউজে দেখিয়েছে। জহিরকেও দেখিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, চেহারা বোঝা যায় নাই। তুই এইসব নিয়ে চিন্তা করিস না। ঘুমোতে যা। সকালে পুলিশের এসবির লোক আসবে। খোকনকে বলে গেছে। তোর সঙ্গে হয়তো কথাবার্তা বলবে। জহির তোর ঘরে ঘুমাত এই জন্যে। কী বলবি না বলবি খোকন তোকে শিখিয়ে দেবে।

শিখিয়ে দিতে হবে কেন?

কোনটা বলতে গিয়ে কী বলে কোন ঝামেলায় পড়বি! পুলিশের চেষ্টাই থাকে ঝামেলা তৈরি করা। ঝামেলা হলে তারা দুটা পয়সা পায়। সবার পয়সার দরকার। পুলিশের দরকার সবচে বেশি। তুই এক কাজ কর, ঘুমুতে যাবার আগে খোকনের কাছ থেকে সব জেনে যা। সে যা শিখিয়ে দেবে তার বাইরে একটা কথা বলবি না।

ভাইয়া যা শিখিয়ে দিল তা হচ্ছে— জহির ভাই আমাদের পরিবারের কেউ। আমার বড়খালু দয়াপরবশ হয়ে তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেন। সেই থেকেই সে আমাদের সঙ্গে আছে। তবে সে এখন আর আমাদের সঙ্গে থাকে না। দি ইমেজে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ আসে। রাত বেশি হলে আমার ঘরে থেকে যায়। এর বেশি আমরা কিছু জানি না। ভাইয়া বিশেষ করে বলে দিল যেন ভুলেও না বলি বড়খালু জহির ভাইকে পালক এনেছিলেন।

ভাইয়ার সঙ্গে কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমি মিনমিন করে বললাম, ভাইয়া, চল না জহির ভাইয়ের অবস্থা কী একটু খোঁজ নিয়ে আসি?

ভাইয়া শান্ত গলায় বলল, অনেকগুলি কারণে এই কাজটা করা যাবে না। প্রথম কারণ, পুলিশ তাকে কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে আমরা জানি না। রাতদুপুরে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘোরা সম্ভব না। দ্বিতীয় কারণ, খুনখারাবি যখন ঘটে তখন পুলিশের সন্দেহভাজনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখানো যায় না। তৃতীয় কারণ, জহির ভাই আমাদের এমন কেউ না যে তার খোজে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হবে। চতুর্থ কারণ,…

ভাইয়া এমনভাবে কথা বলছে যেন পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। পয়েন্ট বাই পয়েন্ট উত্তর। কোনো পয়েন্ট যেন বাদ না পড়ে। পরীক্ষায় যে প্রশ্ন এসেছে সেটা হলো— জহিরের খোঁজে না যাওয়ার পেছনে তোমার যুক্তিগুলি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।

বাবলু?

জি ভাইয়া।

জহিরের ব্যাপারটা মাথা থেকে দূরে রাখবি। তোর স্বভাব হচ্ছে, তুই যার কাছেই যাস তার ছায়া হয়ে যাস। এটা ঠিক না। সবাইকে আলাদা আইডেনটিটি নিয়ে বড় হতে হবে। তুই ছায়া মানব না। You are not a shadow man. যা ঘুমুতে যা।

আমি ঘুমুতে গেলাম। পাশের ঘরে বড়খালা জেগে আছেন। কোনো হিন্দি মুভি দেখছেন। মারপিটের দৃশ্য হচ্ছে। ঢিসুম ঢিসুম শব্দ হচ্ছে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকার পরেও হিন্দি মুভিতে প্রথম বেশ কিছুক্ষণ কিলঘুসির দৃশ্য থাকে। ঘুসি খেয়ে কেউ না কেউ তরকারিভর্তি ভ্যানগাড়িতে পড়ে। ভ্যান ভেঙে সে তরকারি সুদ্ধ নিচে পড়ে। মারামারির সঙ্গে তরিতরকারির সম্পর্ক আমি এখনো ধরতে পারি নি।

শোবার আগে বড়খালা দি ইমেজ-এর ঘটনা কীভাবে নিচ্ছেন জানার জন্যে তার ঘরে ঢুকলাম। বড়খালা টিভি থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বললেন, সবুজ শাড়ি পরা যে মেয়েটা দেখছিস সে-ই আসল খুনি। তবে সে নিজেও জানে না সে খুনি।

আমি বললাম, তাই নাকি?

মেয়েটা খুন করে ঘোরের মধ্যে।

আমি বললাম, জহির ভাই যে খুন হয়েছে শুনেছ?

বড়খালা বললেন, দুটা মিনিট পরে কথা বল তো! ছবি এখনই শেষ হয়ে যাবে। তুইও দেখ। শেষটা এরা ইন্টারেস্টিং বানিয়েছে।

আমি চোখ বড় বড় করে সবুজ শাড়িওয়ালির অভিনয় দেখে শেষ করলাম। বড়খালা হাই তুলতে তুলতে বললেন, বাবলু, তুই একজন এসির মিস্ত্রি নিয়ে আসিস। এসিতে কোনো গণ্ডগোল আছে, ঘর আগের মতো ঠাণ্ডা হচ্ছে না। মনে হয় গ্যাস চলে গেছে।

আচ্ছা নিয়ে আসব।

তুই কি আম চিনিস? খিরসাপাতি আম কিনে আনতে পারবি? এক কেজি খিরসাপাতি আম আনিস তো। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাস। আম কিনে আমার হাতে দিবি।

তোমার আঙুলে কী হয়েছে?

খালা বিরক্তচোখে নিজের বাঁ হাতের আঙুল মেলে ধরলেন। দুটা আঙুল ব্যান্ডেজ করা। গজ-তুলা দিয়ে ব্যান্ডেজ। একটা আঙুল থেকে রক্ত চুইয়ে ব্যান্ডেজের বাইরে চলে এসেছে। আঘাত নিশ্চয়ই গুরুতর।

আঙুলে ব্যথা পেয়েছ কীভাবে?

ব্যথা পাই নি। কামড় দিয়েছে।

কে কামড় দিয়েছে?

একটা দুষ্টু ভূতের বাচ্চা আমার খাটের নিচে থাকে, বলেছি না! সেটাকে ঝাড় দিয়ে মারতে গেছি, ফট করে সে আঙুল কামড়ে ধরেছে। এমন বদ!

ভূতের বাচ্চাটাকে বিদায় করতে পেরেছ, না-কি এখনো সে খাটের নিচে ঘাপটি মেরে বসে আছে?

আমি জানি না। তুই উঁকি দিয়ে দেখ। তবে আমি ঠিক করেছি, ঐটাকে আর ঘটাব না। সে তার মতো থাকুক। বুড়া বয়সে আর কামড় খাব না। কামড় দিয়ে যখন রক্তারক্তি করে ফেলল তখন খোকন ডাক্তার নিয়ে এলো। চেংড়া ডাক্তার। পড়াশোনা করে পাস করেছে, না নকল করে পাস করেছে কে জানে! ডাক্তার বলল, কিসে কামড় দিয়েছে? আমি বললাম, ভূতে কামড় দিয়েছে। ডাক্তার এমনভাবে তাকাল যেন আমার মাথা খারাপ। তোর কি ধারণা আমার মাথা খারাপ?

আমি বললাম, না।

ভূতগুলা এত জায়গা থাকতে আমার খাটের নিচে বসে থাকে কেন বল দেখি?

তুমি দিনরাত এসি চালিয়ে রাখ। ঘর থাকে ঠাণ্ডা। ভূতরা মনে হয় ঠাণ্ডা পছন্দ করে।

হতে পারে। তোর বুদ্ধি খারাপ না। আমি এই লাইনে চিন্তাই করি নি। আরেকটা ছবি চালা তো। টেবিলের উপরে আছে। উপর থেকে তিন নম্বর সিডিটা দে— ম্যায় হুঁ না। শাহরুখ খানের ছবি। নায়িকা সুস্মিতা সেন। চিনিস না সুস্মিতাকে?

না।

মিস ইন্ডিয়া হয়েছিল। পরে মিস ইউনিভার্স হয়েছে। ফিগার খুব সুন্দর। তবে তাকে নিয়ে নানান গুজব আছে। আয় আমার সঙ্গে ছবি দেখ।

ঘুম পাচ্ছে খালা। ঘুমাব।

যা ঘুমা।

মন বিক্ষিপ্ত থাকলে ঘুম ভালো হয় না, এমন কথা প্রচলিত আছে। আমার বেলায় কথাটা একেবারেই খাটে না। আমার ঘুম তখন অনেক ভালো হয়। এক ঘুমে রাত পার করে দিলাম। ছোট ছোট কয়েকটা স্বপ্ন দেখলাম। এর মধ্যে একটা স্বপ্নে জহির ভাই স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। বড়খালা সেই স্ট্রেচার ঠেলছেন। জহির ভাই বলছেন, আস্তে ঠেল মা। আস্তে। আমার শরীরে বিরাট জখম। জহির ভাই যে কথাগুলি বলছেন সেই কথাগুলি আবার একবার নার্স রিপিট করছে। জহির ভাই বললেন, আমার শরীরে বিরাট জখম। নার্স বলল, আমার শরীরে বিরাট জখম। জহির ভাই বললেন, মা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? নার্স বলল, মা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? এই কথায় বড়খালা রেগে গিয়ে বললেন, তুমি আমাকে মা ডাকছ কেন? তুমি কে? খালার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নার্সটা একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে হয়ে গেল। স্বপ্নে এই বিষয়টা মোটেই অবাস্তব মনে হলো না। মনে হলো এটাই স্বাভাবিক। বাচ্চা মেয়েটা বলল, আমার নাম যূথী। আমার জ্বর। কপালে হাত দিয়ে দেখ। এই বলে সে বড়খালার দিকে মাথা এগিয়ে দিল। স্বপ্ন এখানেই শেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *