০৩. বাংলা রেস্টুরেন্ট

রেস্টুরেন্টের নাম কিছুদিন আগেও ছিল বাংলা রেস্টুরেন্ট।

এখন নতুন নাম। কায়দে আযম রেস্টুরেন্ট। সাইন বোর্ড ইংরেজি, উর্দু এবং বাংলায় লেখা। সবচে ছোট হরফ বাংলায়। বাঙালিরা এসব দেখছে। কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। ছাবিবশে মার্চের পর সবাই অতিরিক্ত রকমের চুপ। রেস্টুরেন্টে ফ্রেমে বাধাই করা আছে বড় বড় অক্ষরে লেখা রাজনৈতিক আলোচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তার প্রয়োজন ছিল না। রাজনৈতিক আলোচনা কেউ করছে না। মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে এখন কারো কোন আগ্রহ নেই।

অনিল কায়দে আযম রেস্টুরেন্টে নাশতা খেতে এসেছে। ভালোমতো খেয়ে নেবে, তারপর রওনা হবে টাঙ্গাইলের দিকে। বাস আছে নিশ্চয়ই। পত্রিকায় বার বার লেখা হচ্ছে- দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীর খবরও কিছু আছে, তা ভেতরের পাতায়। নিতান্ত অবহেলায় এক কোণে ছাপা। তবু কি করে জানি এই সব খবরের দিকেই চোখ চলে যায়। অনিল চা খেতে খেতে কাগজ পড়ছে।

প্রথম পাতার খবর হল হাজির হওয়ার নির্দেশ। চোখে কালো চশমা, বগলে ব্যাটিনসহ টিক্কা খানের হাসি হাসি মুখের এক ছবির নিচে লেখা-খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক কর্নেল ওসমানীকে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্ৰদান করেন। সরকারি নির্দেশে বলা হয়–

৪০ নম্বর সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে আমি খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খান এম. পি. কে. পি এসসি- আপনি কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীকে (অবসরপ্রাপ্ত) আপনার বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১, ১২৩, ১৩১ ও ১৩২ নম্বর ধারা এবং ১০ ও ১৪ নম্বর সামরিক আইনবিধি অনুযায়ী আনীত অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্যে ১৯৭১ সালের ২০ শে আগস্ট সকাল আটটার সময় ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানীস্থ ১ নম্বর সেক্টরের উপসামরিক আইন প্ৰশাসকের সামনে হাজির হাজির হতে আদেশ দিচ্ছি।

যদি আপনি হাজিরে ব্যর্থ হন তাহলে আপনার অনুপস্থিতিতেই ৪০ নম্বর সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী আপনার বিচার হবে।

বাণিজ্য, শিল্প ও আইন মন্ত্রী আখতার উদ্দিন আহমেদ সাহেবেরও একটি ছবি ছাপা হয়েছে টিক্কা খানের ছবির নিচে। মন্ত্রী জনসভায় বলেছেন

আল্লাহ না করুক, পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে মুসলমানরা তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে এবং হিন্দুদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়বে।

বক্স করে ছাপা হয়েছে- সাবধান, গুজব ছড়াবেন না। আপনার গুজব শক্ৰকেই সাহায্য করে।

দু পৃষ্ঠার খবরের কাগজ এইটুকুতেই শেষ। শেষের পাতায় সামরিক নির্দেশাবলি যা কিছুদিন পর পর ছাপা হচ্ছে। ভেতরের দুপাতার সবটাই বিজ্ঞাপন। এক কোণায় ছোট করে একটা সংবাদ- শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্ৰ উদ্ধার : কয়েকজন গ্রেপ্তার।

গত রোববার রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অন্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই অভিযানগুলো চালানো হয়।

গ্রেফতার করা দুটি ছেলের ছবি ছাপা হয়েছে। ছেলে দুটির বয়স কিছুতেই আঠারো উনিশের বেশি হবে না। দুজনেরই হাত পেছন দিকে বাধা। কিন্তু এদের মুখ হাসি হাসি। ছবি তোলার সময় এরা কি সত্যি হাসছিল না। অনিল কল্পনা করছে, এরা হাসছে? এদের নাম দেয় নি, নাম দেয়া উচিত ছিল।

ভাইজান, খবরের কাগজটা দেখি।

অনিল তার সামনে বসা মানুষটির দিকে কাগজ এগিয়ে দিল। সেও সব খবর ফেলে এই খবরটিই পড়ছে। একটা খবর পড়তে এতক্ষণ লাগে না। নিশ্চয়ই বার বার পড়ছে। মানুষটার চোখে-মুখে আনন্দের আভা। পত্রিকা বন্ধ করার পরেও সে আরেকবার খুলল, তাকিয়ে আছে। ছবিটার দিকে। অনিল বলল, কাগজটা আপনি রেখে দেন।

জ্বি-না, দরকার নেই।

রেখে দেন। অন্যকে দেখবেন।

লোকটা হেসে ফেলে চাপা গলায় বলল, দুই বাঘের বাচ্চা, কি বলেন ভাইজান?

অনিল বলল, বাঘের বাচ্চা তো নিশ্চয়ই।

খাটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। দেখেন চোখ দেখেন। চোখ দেখলেই বোঝা যায়।

অনিল আরেকবার তাকাল। ছেলে দুটির চোখ দেখা যাচ্ছে না। মারের জন্যেই মুখ ফুলে চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে। তবু এর মধ্যেই তেজি চোখ এই মানুষটা দেখতে পাচ্ছে। তাই তো স্বাভাবিক। চায়ের দাম দিয়ে অনিল উঠে পড়ল। সে অফিসে যাবে। বড় সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে রওনা হবে দেশের দিকে। পৌঁছতে পারবে কি-না তা সে জানে না। চেষ্টা করবে।

 

কি সুন্দর দিন! কি চমৎকার রোদ! শ্রাবণ মাসের মেঘশূন্য আকাশের মতো সুন্দর কিছু কি আছে? এই রোদের নাম মেঘভাঙা রোদ। রিকশা নিতে ইচ্ছা করছে না। হাঁটতে ইচ্ছা করছে। রাস্তা এখনো ফাকা। তারচেয়েও বড় কথা রাস্তায় কোন শিশু নেই। এখনকার এই নগরী শিশুশূন্য। বাবা-মারা তাদের সন্তানদের ঘরের ভেতরে আগলে রাখছেন। শহর এখন দানবের হাতে। শিশুদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।

বড় রাস্তার মোড়ে মেশিনগান বসানো একটি ট্রাক। পাশেই জীপ গাড়ি। বিশাল ট্রাকের পাশে জীপটোকে খেলনার মতো লাগছে। একজন অফিসার কথা বলছেন একজন বিদেশির সঙ্গে। বিদেশির কাঁধে কয়েক ধরনের ক্যামেরা। দুজনের মুখই খুব হাসি হাসি। এই বিদেশি কি একজন সাংবাদিক? কয়েকদিন আগে অনিল পত্রিকায় পড়েছিল, বিদেশি সাংবাদিকদের আহবান করা হয়েছে তারা যেন নিজেদের চোখে দেখে যায় কি সুন্দর পরিবেশ পূর্ব পাকিস্তানে।

এই লোকটি তাই দেখতে আসছে? সুন্দর পরিবেশ দেখে মোহিত হচ্ছে? কিছুটা মোহিত হতেও পারে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন। বস্তি নেই। ২৫ শে মার্চেই বস্তি উজাড় হয়েছে। ভিখিরীও নেই। ভিখিরীরা ভিক্ষা চাইতে কেন বেরুচ্ছে না কে জানে? এরা সম্ভবত ভিখিরীদেরও গুলি করে মারছে।

বিদেশি ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অনিলের দিকে। হাত ইশারা করে তিনি অনিলকে ডাকলেন। শুধু অনিল না, আরো কয়েকজনকে তিনি ডেকেছেন। তারা ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছে। অনিল এগিয়ে গেল।

সেনাবাহিনীর অফিসারটি ইংরেজি-বাংলা-উর্দু মিশিয়ে যে কথা বলল, তা হচ্ছে ইনি ইউনাইটেড প্রেসের একজন সাংবাদিক। খবর সংগ্ৰহ করতে এসেছেন। তোমাদের যা বলার ইনাকে বল। ভয়ের কিছু নাই। Whatever you want to say, say it. কোই ফিকির নেই। সাংবাদিক ভদ্রলোক একজন দোভাষী নিয়ে এসেছেন। বিহারী মুসলমান। সে কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছে। নীল হাওয়াই সার্ট পরে একজন মানুষকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করা হল—। প্রশ্নোত্তরের পুরো সময় মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরা থাকল।

আপনার নাম?

আমার নাম মোহাম্মদ জলিল মিয়া।

কি করেন?

আমি একজন ব্যবসায়ী আমার বাসাবোয় ফার্নিচারের দোকান আছে।

দেশের অবস্থা কি?

জনাব অবস্থা খুবই ভালো।

মুক্তিবাহিনী শহরে গেরিলা অপারেশন চালাচ্ছে, এটা কি সত্য?

মোটেই সত্য না।

একটা পেট্রল পাম্প তো উড়িয়ে দিয়েছে।

এগুলো হল আপনার দুষ্কৃতকারী।

আপনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর সন্তুষ্ট?

জ্বি জনাব। এরা দেশ রক্ষা করেছে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনার কি অভিমত?

তিনি আমাদের ভুল পথে পরিচালনা করেছেন। ইহা উচিত হয় নাই।

আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

মাইক্রোফোন এবার অনিলের কাছে এগিয়ে আনা হল।

আপনার নাম?

আমার নাম অনিল। অনিল বাগচী।

আপনি কি করেন?

আমি একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করি। আলফা ইসুরেন্স।

দেশের অবস্থা কি?

দেশের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।

কেন বলছেন দেশের অবস্থা খারাপ?

স্যার, আপনি নিজে বুঝতে পাছেন না? আপনি কি রাস্তায় কোন শিশু দেখেছেন? আপনার কি চোখে পড়েছে হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে কেউ যাচ্ছে? শহরে কিছু সুন্দর সুন্দর পার্ক আছে। গিয়ে দেখেছেন পার্কগুলোতে কেউ আছে কি-না? বিকাল চারটার পর রাস্তায় কোন মানুষ থাকে না। কেন থাকে না? স্যার, আমার বাবা মারা গেছেন মিলিটারীর হাতে।

কি করতেন। আপনার বাবা?

তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

আপনি কি আওয়ামী লীগের কর্মী?

না, আমি আওয়ামী লীগের কর্মী না।

আপনাকে ধন্যবাদ।

সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে অনিলের দিকে। সবচে বেশি অবাক হয়েছে ফানিৰ্চার দোকানের মালিক। অনিল একবারও মিলিটারী অফিসারের দিকে তাকাল না। তাকে চলে যেতে বলা হয়েছে। সে চলে যাচ্ছে। ভুলেও পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে এই বুঝি এক ঝাঁক গুলি এসে পিঠে বিঁধল।

ফানিৰ্চার দোকানের মালিক অনিলের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সে ফিসফিস করে বলল, জানে বাঁচার জন্যে মিথ্যা কথা বলতে হয়। ভাই সাহেব। এতে দোষ নাই। আপনি গলির ভিতর ঢুকে পড়েন। গলির ভিতর ঢুকে দৌড় দিয়া বের হয়ে যান।

অনিল গলির ভিতর ঢুকে পড়ল। ভদ্রলোক রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে লজ্জিত ও বিব্রত মনে হচ্ছে।

অনিল এগুচ্ছে দ্রুত পায়ে। তার মাথায় ঝন ঝন করে বাজছে- বিপদে মিথ্যা বলার নিয়ম আছে। বিপদে মিথ্যার বলার নিয়ম আছে।

সুরেশ বাগচী মিথ্যা বলা বিষয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের একটি গল্প বলেছিলেন। মহাভারতের গল্প। অশোক বনে শৰ্মিষ্ঠা নামের অতি রূপবতী এক রমণী কিছুকালের জন্যে বাস করেছিলেন। একদিন মহারাজ যযাতি বেড়াতে বেড়াতে চলে এলেন অশোক বনে। শৰ্মিষ্ঠা তাকে দেখে ছুটে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আমার স্বামী নেই, আমি যৌবনবতী, আপনি আমার সঙ্গে রাত্রিযাপন করুন। আমার ঋতু রক্ষা করুন। যযাতি বললেন, তা সম্ভব না। তোমার সঙ্গে শয্যায় গেলে আমাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে। মহা পাপ হবে। শৰ্মিষ্ঠা বললেন,

নন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি
ন স্তীষু রাজন ন বিবাহকালে
প্ৰাণাত্যয়ে সর্বধনাপাথরে
পঞ্চান্তান্যাহুর পাতকানি

তার মানে হল, পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না। পরিহাসে, মেয়েমানুষকে খুশি করায়, বিবাহকালে, প্ৰাণ সংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনায়। আপনি আমার সঙ্গে রাত্রিযাপন করলে আমাকে খুশি করবেন। কাজেই আপনার পাপ হবে না। এই কথায় মহারাজ যযাতি শৰ্মিষ্ঠার সঙ্গে রাত্রিযাপনে রাজি হলেন।

সুরেশ বাগচী বললেন, গল্পটা কেমন লাগল?

অনিল, অতসী কেউ কিছু বলল না। মহারাজ যযাতির কাজটা কি ঠিক হয়েছে?

অতসী বলল, ঠিক হয় নাই।

হ্যাঁ, ঠিক হয় নাই। ধর্মগ্রন্থে যাই থাকুক কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলা যায় না। বাবারা, এটা যেন মনে থাকে।

অনিল অসম্ভব ভীতু। কিন্তু বাবার চিঠি বুকে নিয়ে সে মিথ্যা বলতে পারছে না। তাকে সত্যি কথাই বলতে হবে। চিঠিটা কি ফেলে দেয়া ভালো না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *