০৩. বাংলা কবিতার তিন ছন্দ

বাংলা কবিতার তিন ছন্দ

রবিবার সকাল। আপিসের তাড়া নেই। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে, চোখ বুজে, তাই ছন্দ-ভাবনায় মগ্ন হয়ে ছিলুম। ভাবছিলুম যে, বাংলা কবিতা মোটামুটি তিন রকমের ছন্দে লেখা হয় :

১) অক্ষরবৃত্ত ২) মাত্রাবৃত্ত ৩) স্বরবৃত্ত।

বাংলা ছন্দের এই নাম নিয়ে অবশ্য আপত্তি উঠেছে। আপত্তির যে কারণ নেই, তা-ও নয়। কিন্তু…

চিন্তায় বাধা পড়ল। অন্নচিন্তা চমৎকারা। সুতরাং চক্ষু বুজে কাব্যচিন্তায় মগ্ন হওয়া অসম্ভব। (আমি আগেই আভাস দিয়েছি যে, আমাদের বাড়িতে প্রত্যেকেই কবি। ইস্তক আমার ভৃত্যটিও, কাজ না করুক, চমৎকার ছড়া মেলায়।) কনের কাছে হঠাৎ ঝংকার উঠল :

কর্মের বেলায় ঢুঢু, শুধু নিদ্রা দাও!
ওঠো বাবু কুম্ভকৰ্ণ, বাজারেতে যাও।

গৃহিণীর কণ্ঠ! আমি যে ছন্দ নিয়ে চিন্তা করছি, তা তিনি বুঝতে পারেননি। ভেবেছেন, স্রেফ ফাঁকি দেবার জন্য মটকা মেরে শুয়ে আছি। বলা বাহুল্য, তাঁর বাক্যের মধ্যে যে একটা গঞ্জনার ব্যঞ্জনা ছিল, সেটা আমার আদপেই ভালো লাগেনি; কুম্ভকৰ্ণ সম্বোধনটা তো রীতিমতো আপত্তিকর মনে হল। তবু গুণগ্রাহী মানুষ বললেই তাঁর সহজাত কাব্যপ্রতিভায় আমি মুগ্ধ হলুম।

বিছানা ছেড়ে তক্ষুনি অবশ্য উঠলুম না। কিন্তু শুয়ে থাকবারই-বা উপায় কী। খানিক বাদেই আমার আট বছরের নাতিটি এসে চেঁচাতে লাগল। :

সকলে ডেকে ডেকে হদ হল যে,
এক্ষুনি ওঠে, যাও খাদ্যের খোঁজে।

এর পরে আর শূয়ে থাকা চলে না। থলি নিয়ে বাজারের পথে রওনা হতে হল। ফিরতি পথে একবার মুদির দোকানে যাবার দরকার ছিল। কিন্তু যাওয়া হল না। না-যাবার হেতুটা অতিশয় প্রাঞ্জল। গত মাসের বিল অদ্যাবধি শোধ করা হয়নি, এবং আমি শ্ৰীকবিকঙ্কণ সরখেল যে একজন পুরোদস্তুর কবি, এই কথাটি বিলক্ষণ জানা সত্ত্বেও গতকাল মুদি আমাকে ধারে এক কিলো বাদামতেল দিতে আপত্তি করেছিল। শুধু তা-ই নয়, তার বিল আপাতত মেটানো হবে না। শুনেই সর্বসমক্ষে সে আমার তেলের বোয়মটা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “যান যান মশাই, কবিকে তেল দেওয়া আমার কৰ্ম্ম নয়।”

কথাটা মনে পড়ে যেতেই মুদির দোকানের সান্নিধ্য বর্জন করে আমি অন্য পথে বাড়ি ফিরলুম। ফিরেই বুঝলুম, বাড়িতে তেল না থাক, ঘি আছে, এবং প্রাতরাশের জন্যে লুচি ভাজবার আয়োজন হচ্ছে। রাঁধুনি বামনিকে তো আমার কন্যার উদ্দেশে স্পষ্টই বলতে শোনা গেল :

দিদি আসুন, ময়দা ঠাসুন,
আজকে রবিবার।
মোহনভোগের সঙ্গে লুচি,
জমবে চমৎকার!

শুনে আমি যৎপরোনাস্তি প্রীত হলুম। তার কারণ নেহাত এই নয় যে, বাড়িতে লুচি হলে আমিও তার ভাগ পাব। বলা বাহুল্য, সেটাও একটা কারণ বটে, তবে আমার আনন্দের প্রধান কারণটা এই যে, আজ সকালে ঘুম ভাঙবার পর, মাত্ৰ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই, বাংলা কবিতার প্রধান তিনটি ছন্দের নমুনা আমি পেয়ে গিয়েছি। এখন দেখা যাক, একই কথাকে নানান রকমের ছন্দে আমরা বাঁধতে পারি। কিনা। না না, আর ওই হাট-বাজার-তেল-ঘি-কয়লা-কেরোসিন নয়; আসুন, কবিদের যা কিনা খুবই প্রিয় প্রসঙ্গ, সেই পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে কিছু লিখি। ধরা যাক, আমাদের বলবার কথাটা এই যে, শ্রাবণ মাসের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, আর সেই গোল চাদকে একটা সোনার থালার মতো দেখাচ্ছে। এখন এই কথাগুলিকে যদি ছন্দে বেঁধে বলতে হয়, তো আমরা কীভাবে বলব? প্রথমত এইভাবে বলতে পারি :

দ্যাখো ওই পূৰ্ণচন্দ্র শ্রাবণ-আকাশে,
স্বর্ণের পত্রটি যেন শূন্য পরে ভাসে।

এ হল অক্ষরবৃত্ত ছন্দ (পরবর্তীকালে শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্র সেন মহাশয় এর নাম দিয়েছেন মিশ্রকলাবৃত্ত’। আর শ্ৰীঅমূল্যধন মুখোপাধ্যায় মহাশয় এই ছন্দকে বলেন ‘তানপ্রধান’) শ্রাবণ মাসের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে পূৰ্ণচন্দ্ৰ আদৌ দেখা সম্ভব কি না, এক্ষুনি সেই কুটকচালে তর্ক তুলে লাভ নেই; তার চাইতে বরং ভাবা যাক, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মধ্যে আমাদের বক্তব্যের সুর কি ঠিকমতো বেজে উঠল? যদি মনে হয়, বাজেনি, তো এই একই বস্তুব্যকে আমরা অন্য ছাদেও বাঁধতে পারি। ছন্দ পালটে লিখতে পারি। :

আকাশে ছড়ায় পূর্ণচাঁদের বাণী
শ্রাবণ-রাত্রি হাসে;
দেখে মনে হয়, স্বৰ্ণপাত্ৰখানি
নীল সমুদ্রে ভাসে।

এ হল মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। (শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্র সেন এর নতুন নাম দিয়েছেন ‘কলাবৃত্ত’। আর শ্ৰীঅমূল্যধন মুখোপাধ্যায় একেই বলেন ‘ধ্বনিপ্রধান’ ছন্দ।) লাইনগুলি আরএক বার পড়ে দেখুন; ঠিক বুঝতে পারবেন যে, এর দোলাটা একেবারে অন্য রকমের। এতক্ষণ যেন শান্ত জলে নৌকো চলছিল, এবার ঢেউয়ের দোলায় উঠছেনামছে। এই দোলাটা কি ভালো লাগছে। আপনাদের? নাকি মনে হচ্ছে যে, এ-ও যেন ঠিক মনের মতো হল না? বেশ তো, তাহলে আসুন, আমাদের কথাগুলিকে এবারে আর-এক রকমের ছন্দে দুলিয়ে দেওয়া যাক। লেখা যাক :

দ্যাখো দ্যাখে আজকে যেন
শ্রাবণ-পূর্ণিমায়
সোনার থালা আটকে আছে
নীল আকাশের গায়।

এ হল স্বরবৃত্ত ছন্দ। (শ্ৰীপ্ৰবোধচন্দ্র সেন এই ছন্দকে এখন দলবৃত্ত’ বলেন। শ্ৰীঅমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বলেন ‘শ্বাসাঘাতপ্রধান’ ছন্দ।)

দেখা যাচ্ছে, একই কথাকে আমরা তিন রকমের ছন্দে বাঁধিলুম। নমুনা তিনটিকে এবারে পাশাপাশি মিলিয়ে নিন, তাহলেই এদের পার্থক্যটা বেশ স্পষ্ট করে ধরা পড়বে। পার্থক্য এদের মাত্রায়, পার্থক্য এদের ঝোকে, পার্থক্য এদের পর্ব-বিন্যাসে। মাত্রা, ঝোক, পর্ব-এসব কথা নতুন ঠেকছে তো? ভয় নেই, ছন্দের আলোচনা আর-একটু এগোলেই এসব জল হয়ে যাবে।

1 Comment
Collapse Comments
মোশাররফ শরিফ January 14, 2022 at 12:24 pm

উপযোগী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *