বসন্তদাসের বাণিজ্য যাত্রার কাহিনী ঐ স্থানে অর্থাৎ দেবীকোটের পরিত্যক্ত ঐ মেলাতেই সমাপ্ত হতে পারতো। কিন্তু হয়নি। তার গৃহের পথ তখনও বহুদূর। আরও বহুবিধ ঘটনা ঘটেছে পরবর্তী পর্যায়ে, যে ঘটনাগুলি বর্তমানের বসন্তদাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেগুলি আমরা পরে জানবো একে একে।
পুনর্ভবার পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতে সে অনুসন্ধান করতে করতে উত্তরে অগ্রসর হচ্ছিলো। তার অনুমান, পূর্বে বা দক্ষিণে প্রাণ ভয়ে ভীত পলায়নকারীরা যাবে না। শুকদেব যদি জীবিত থাকেন, তাহলে তিনি পশ্চিমে অথবা উত্তরেই এসেছেন। ইতোমধ্যে সে সংবাদ নিয়েছে যে মাতুল দীনদাসও গৃহে ফেরেননি। তাঁর এক ভাগিনেয় পশ্চিমতীরের গ্রামগুলিতে সন্ধান করতে এসেছিলো।
মদনপুরের দিকে সে অগ্রসর হচ্ছিলো। জানা ছিলো, শুকদেবের এক বন্ধু থাকেন ঐ গ্রামে–যাঁর কন্যার সঙ্গে মৃত চন্দ্ৰদাসের বিবাহের কথা স্থির হয়েছিলো। শুকদেব সম্ভবত বন্ধুগৃহেই আশ্রয় নিয়েছেন, এই প্রকার অনুমান করেছিলো সে। কিন্তু দেখলো, মদনপুরে শুকদেব আসেননি। বৃদ্ধ প্রফুল্ল দাস জানালেন, বৎস, আমিও তাদের সন্ধান করছি, কিন্তু এখনও সফল হইনি, মঙ্গলময় শিব জানেন, তাঁরা কোথায় আছেন। আমার সন্দেহ, তাঁরা কেউ পশ্চিম তীরে আসেননি। যদি জীবিত থাকেন, তাহলে পূর্বতীরেই কোনো গ্রামে তাঁরা রয়েছেন–তুমি বরং পূর্বতীরেই তাদের সন্ধান করো।
এ অঞ্চলে পথ এখন প্রায়শই নির্জন থাকে। বণিকদের গোশকটগুলিও আর চোখে পড়ে না। হাটগুলি বিষণ্ণ, সন্ত্রস্ত এবং ক্ষণস্থায়ী। মানুষ দিবাভাগেই গৃহে ফেরে। গ্রামে গেলে লোকেরা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। লোকে সন্দেহ করে, সামন্তপতির কোনো গুপ্তচর এসেছে। একদিন একজন তো স্পষ্টতই বললো, মহাশয়, যদি যথোচিত পুরস্কার দান করেন, তাহলে আমি একটি সদ্ধর্মী ভিক্ষু দলের সন্ধান দিতে পারি।
সে লোকটিকে কী বলবে ভেবে পায় না। শেষে ভ্ৰম অপনোদনের জন্য বলে, মহাশয়, আমি গূঢ়-পুরুষ নই যে আপনাকে পুরস্কৃত করবো। তবে একটা কথা বলি, নিশ্চিত না হয়ে অপরিচিত লোকের কাছে এ প্রকার প্রস্তাব করবেন না, সে কোন পক্ষের লোক তার কি কোনো স্থিরতা আছে?
বলাবাহুল্য লোকটি প্রথমে হতাশ, পরে ভীত হয়ে প্রস্থান করে।
প্রফুল্লদাস তাঁকে জামাতা জ্ঞানেই সমাদর করলেন। তাঁর কন্যাটি এখনও সুস্থ হয়নি। তার শোনা ছিলো যে চন্দ্রদাস দস্যুহস্তে নিহত হওয়ার পর কন্যাটি উন্মাদিনীপ্রায় হয়ে রয়েছে। দেখলো, মধুমতী সম্মুখ দিয়ে গমনাগমন করছে কিন্তু তার যেন সম্বিত নেই। নারীসুলভ লজ্জার ভাবটি তার মুখে অনুপস্থিত। বিকার ঐটুকুই, না হলে সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক। উত্তম স্বাস্থ্য, গঠনটিও সুন্দর, তদুপরি মধুমতী রূপসীও। একবার সম্মুখে এসে বললো, আপনি বুঝি মেলায় যাবেন? সেখানে চন্দ্রদাস গেছে, বলবেন তো, যেন বিলম্ব না করে। আর স্মরণ করিয়ে দেবেন, আমার জন্য যেন একখানি মুক্তামালা অবশ্যই নিয়ে আসে।
প্রফুলদাস বললেন, বৎস, এই-ই আমার ললাটলিপি, এই উন্মাদিনীকে কে রক্ষা করবে? দুশ্চিন্তায় আমার নিদ্রা হয় না।
সকলের মনেই অদ্ভুত একটি আতঙ্ক। কখনও শঙ্কা, এই বুঝি যবন সেনাদল এলো–কখনও ভয়, আজ রাত্রে আর নিস্তার নেই, পূর্বতীরে সামন্তপতির লোকদের দেখা গেছে। কখনও আবার হতাশা, যদি যুগপৎ আক্রমণ হয়, তাহলে আমাদের তো পলায়নের পথ নেই।
কেউ কোনো কাজ করে না। গোচারণে রাখাল নেই, গোরুগুলি ইচ্ছামতো ক্ষেত্র নষ্ট করছে–কর্ষিত ভূমিতে বীজ ফেলে না কেউ–নতুন ধান্যক্ষেত্রে প্রচুর আগাছা, কেউ সেগুলি উৎপাটন করতে আসে না। চতুর্দিকে এমন একটি নিরুদ্যম হতাশ ভাব যে অধিকক্ষণ বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মন পীড়িত হয়ে ওঠে।
বসন্তদাস রাত্রিযাপন করে পরদিনই মদনপুর গ্রাম থেকে বিদায় নেয়। এখন ক্রমাগত উত্তরে চলেছে সে। তিন–চারখানি গ্রাম অতিক্রম করে সে এক হট্টকুটিরে তিনজন সদ্ধর্মী ভিক্ষুকে দেখতে পায়। তারা দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অল্পক্ষণ পূর্বে ঐ স্থানে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমত তারা আলাপে একেবারেই অনাগ্রহ প্রকাশ করে। শেষে একজন বললো, মহাশয় আমরা সাধারণ ভিক্ষু, আপনি যা যা জানতে চাইছেন, সে সব সংবাদ আমরা কোথায় পাবো, বলুন?
তবে তারা একত্রে আহারের আয়োজন করে। এবং ঐটুকু অন্তরঙ্গতার সুযোগে বসন্তদাস নানান বিষয়ে কথা বলতে আরম্ভ করে। ফলে রাত্রি গম্ভীর হতে হতে পরস্পরের মধ্যে স্বচ্ছন্দ আলাপ আরম্ভ হয়ে যায়। ভিক্ষুরা নানান সংবাদ জানে। যেমন ভিক্ষু মিত্রানন্দকে এখন নিকটে কোথাও পাওয়া যাবে না, তিনি দূরের এক মহাবিহারে অবস্থান করছেন, তাঁর প্রত্যাবর্তনে বেশ বিলম্ব হবে।
তারা আরও সংবাদ জানায়। যবন সেনাদের একটি দল নাকি দক্ষিণ-পশ্চিমে মহানন্দার অপরপারে অবস্থান করছে। সম্ভবত রাজধানীতে কোনো ঘটনা ঘটবে, এবং সেটি ঘটলে, তারা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে পারে। তাদের কেউই বাধা দিচ্ছে না। রাজপুরুষেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। মন্ত্রী–মহামন্ত্রীরা পরস্পর কলহে লিপ্ত। বহিরাক্রমণ প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। রাজপুরোহিত বিধান দিয়েছেন যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের। অলৌকিক শক্তিবলেই নাকি শত্রু দমন সম্ভব হবে।
পিপ্পলী হাটের সংবাদটিও তারা জানে, কিন্তু উজুবট গ্রামে কী ঘটেছে, তা তাদের জানা নেই। তবে তারা পথিমধ্যে দেখেছে, উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলিতে কিছু সংখ্যক লোক আশ্রয় নিয়ে আছে। এবং আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাহলে কি আরও গ্রাম উপদ্রুত হয়েছে?
ঐ প্রশ্নে একজন হেসে ওঠে। বলে, মহাশয় দেখছি নিজ দেশের কোনো সংবাদই রাখেন না। কোন অঞ্চলটি অনুপদ্রুত বলতে পারেন? পূর্বে যান, দক্ষিণে যান, উত্তরে যান, সর্বত্র একই কাহিনী। সর্বত্রই ধর ধর রব, সর্বত্রই মার মার চিৎকার।
অপর ভিক্ষুটি সহাস্যে মন্তব্য করে, এ স্থানেও ঐ দৃশ্য অচিরেই দেখতে পাবেন চিন্তার কোনো কারণ নেই।
গভীর রাত্রি পর্যন্ত চললো আলাপ। মনে হয়েছিলো তারা সাধারণ ভিক্ষু। কিন্তু জানা গেলো, একজন উচ্চতর সম্মানের অধিকারী। তিনি পশ্চিমে যাচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছা, যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
কেন? বসন্তদাস জানতে চাইলো, আপনারা কি বিশ্বাস করেন যে তাদের সঙ্গে প্রকৃত সম্প্রীতি সম্ভব? এবং তারা এলে এদেশবাসী উপকৃত হবে?
ঐ প্রশ্নে জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু ভ্রূকুঞ্চিত করলেন। ঈষৎ চিন্তা করলেন মনে হলো। শেষে বললেন, না মিত্র, তা নয়–যা আপনি ভাবছেন। লোকে সন্দেহ করে যে আমরা ঘরের শত্রু বিভীষণের মতো যবনদের এদেশে ডেকে আনছি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। আমরা শুধু জানাবো, যে লোক ক্ষয় যেন না হয়। প্রকৃতিপুঞ্জ তো কোনো দোষ করেনি, তারা কেন নিপীড়িত হবে? বিশেষত সাধারণ মানুষ যখন রাজশক্তির সমর্থক নয়, তখন যবন সেনারা কেন তাদের হত্যা করবে?
বসন্তদাস ভিক্ষু তিনটিকে লক্ষ্য করে দেখলো। কেশশ্মশ্রুহীন গোলাকার শান্ত সৌম্য মুখ। কোনো প্রতিক্রিয়াই সে মুখে আভাসিত হয় না। তার দুর্বোধ্য লাগে। আবার কেমন সন্দেহও হয়, তবে কি মিত্রানন্দ আর তার সঙ্গীরা একরূপ চিন্তা করে এবং এরা অন্য চিন্তা করে? মিত্রানন্দের সঙ্গে এরা যে সম্পর্কবিহীন তা–ও নয়। যদি মিত্রানন্দের। সেই কথা সত্য হয় যে, যবনদের সঙ্গে সদ্ধর্মীদের কী সম্পর্ক হবে তা এখনও স্থির হয়নি, তাহলে এই ভিক্ষুরা কীভাবে যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়? সে জানতে চাইলো, সকল সদ্ধর্মীর সম্মতিক্রমে কি আপনি যবন সেনাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন?
এই প্রশ্নে তিনজনই গম্ভীর হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুটি বলেন, এতে সম্মতির কি প্রয়োজন? এতো সংঘের কাজ নয়, একেবারেই দৈনন্দিন ধর্মের কাজ। শুধু বলবো, জীবে দয়া করো এই কাজের জন্য কারও সম্মতি প্রয়োজন নেই।
বসন্তদাসের অনুমান হয় মিত্রানন্দের প্রচেষ্টা কোনো কাজেই আসেনি, তাদের সংঘ এখনও সংগঠিত নয়। কোনো কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নেই, ভিক্ষুরা স্বেচ্ছাচারীর মতো আচরণ করছে। সে কৌতূহল বশত পুনরশি জিজ্ঞাসা করে, মহাশয়, যবন সেনাপতির নিকট না গিয়ে ঐ একই আবেদন কি রাজ পুরুষদের কাছে করা যেতো না?
এবার বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুটি হাসেন। বলেন, না ভ্রাতঃ, তা করা যেতো না–প্রথমত আমাকে রাজার সমীপে যেতে দেওয়া হতো না। এবং দ্বিতীয়ত যদি কোনোক্রমে যেতামও, তাহলেও কেউ আমার আবেদন শুনতো না।
কেন, শুনতো না কেন? বসন্তদাস জানতে চাইলো।
মিত্র, আপনি দেখছি নিতান্তই বালসুলভ প্রশ্ন করছেন। জ্যেষ্ঠ ভিক্ষু বললেন, চিন্তা করে দেখুন, আমার আবেদন ওঁরা কেন শুনবেন? তাতে কারও কোনো লাভ নেই। রাজসভার লোকেরা প্রায় প্রত্যেকেই সামন্ত মহাসামন্ত, নিজ শ্রেণীর বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কথা তারা রাজসভায় উত্থাপিত হতে দেবেন না, এ তো সহজ কথা।
রাজসভায় তো মহারাজও থাকেন, তিনিই তো সর্বেসর্বাবসন্তদাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
হ্যাঁ, মহারাজ অবশ্যই থাকেন। কিন্তু রাজার নিজস্ব শক্তি আর কতোটুকু–অশীতিপর বৃদ্ধ আমাদের রাজা। সামন্তপতিদের শক্তিতেই রাজার শক্তি। কেউ কি স্বেচ্ছায় নিজ হস্ত ছেদন করে, বলুন?
না, তা করে না, বসন্তদাস স্বীকার করে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা কি চিন্তা করে না মানুষ? সে জানতে চাইলো।
অবশ্যই করে, ভিক্ষুটি বললেন, কিন্তু সে তো সুস্থ মানুষ। দেহ মনে সুস্থ মানুষ অবশ্যই ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। কিন্তু তেমন সুস্থ মানুষ রাজসভায় আর কয়জন? রাজসভা অর্থ ও ক্ষমতার পীঠস্থান আর দুই–এরই প্রবণতা হচ্ছে কালক্রমে স্বয়ং–বিকৃত হওয়া। প্রায় দ্বিশতাধিক বর্ষের রাজসভা, মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালই প্রায় অশীতিবর্ষ। এমতাবস্থায় সভার প্রায় সকল লোকই যে বিকারগ্রস্ত হবে এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই। আর সেই বিকারগ্রস্তদের মানসচক্ষু কি স্বচ্ছ, বলুন? যুক্তিযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ কি তাদের পক্ষে সম্ভব? এরা অচিরেই ধ্বংস হবে দেখবেন। কেউ এদের রক্ষা করতে পারবে না।
যেন জটিল একটি বিতর্ক ক্রমেই প্রসারিত ও দীর্ঘ হয়ে চলেছে। বসন্তদাস বললো, শুনুন মহাশয়, আমি অতো কথা জানি না, মহারাজ লক্ষ্মণ সেন, তাঁর রাজসভা, কিংবা তার সামন্তবর্গ, এরা রক্ষা পাবে কি পাবে না, এ বিষয়ে আমার সামান্যতম শিরোবেদনা নেই। জানি, স্বকৃত পাপই এদের ধ্বংস করবে। আমার চিন্তার বিষয় বহিরাগত যবনেরা। এরা একেবারেই বহির্দেশীয় এবং ধর্মে ভিন্ন, আচারে ভিন্ন, ভাষায় ভিন্ন–এরা যে কী করবে, কেউ জানে না।
ভিক্ষুরা বসন্তদাসের কথা শুনে অনেকক্ষণ নীরব রইলো। শেষে জ্যেষ্ঠভিক্ষু বললেন, আপনার কথাটি আমাদের মনে থাকবে–ভিক্ষু মিত্রানন্দের মুখেও আমরা এইরূপ কথা শুনেছি–দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়–তথাগতের কী ইচ্ছা।
রাত্রি শেষে প্রত্যুষকালে ভিক্ষুরা প্রস্থান করলে বসন্তদাসও নদী অতিক্রমের আশায় পূর্বাভিমুখে যাত্রা করে।