ফ্লোরে ফিরে রেশমা হতভম্ব হয়ে গেল
ফ্লোরে ফিরে রেশমা হতভম্ব হয়ে গেল। শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেছে। আজমল তরফদার শুকনো মুখে বসে আছেন। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে বলে ফ্যান ঘুরছে না। একজন ফ্লোর-বয় তাকে প্রবল বেগে তালের পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। তারপরেও আজমল তরফদার ঘামছেন। ইউনিটের সব লোকজন কেমন যেন গম্ভীর। তারা আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। শুটিং প্যাকআপ হওয়ার মূল কারণ হলো নায়ক ফরহাদের সঙ্গে ডাইরেক্টর সাহেবের খিটিমিটি হয়েছে। নায়ক এক পর্যায়ে বলেছেন, এই ছবির কাজ করব না। বলেই ফ্লোর থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠেছেন।
আজমল তরফদার ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ হোক কাল হোক, এই নখড়ামি যে সে আমাদের সঙ্গে করবে। এটা জানতাম। আমার সঙ্গে তার কোনো খিটিমিটি হয় নি, সে যা বলেছে আমি শুনেছি। তার অন্যায় কথা শুনেও আমি বলেছি, ঠিক আছে–তারপরেও সে ফ্লোর থেকে চলে গেল। ঘটনাটা কী? ঘটনা তোমরা কেউ জান না, জানি আমি। ঘটনা বলি শোন–তার সাথে আমাদের ছবির কনট্রাক্ট হয় দু’বছর আগে। এক লাখ টাকায় কনট্রাক্ট। এক লাখ টাকা পেয়েই সে তখন হাতে আসমানের চাঁদ পেয়েছে। খুশিতে গুলগুলা। এর মধ্যে ঘটনা ঘটল–তার তিনটা ছবি হয়ে গেল সুপারহিট। এক লাখ টাকা থেকে বেড়ে তার রেমুনারেশন এক লাফে হয়ে গেল চার লাখ। আমাদের সঙ্গে আগের চুক্তি–এক লাখের চুক্তি। ব্যাটা গেছে ফেঁসে। এখন চাচ্ছে মোচড় দিয়ে আরো কিছু বের করে নিতে–এই হচ্ছে ব্যাপার। শুভঙ্করের অঙ্ক।
মিজান বলল, আমরা এখন স্যার করব কী? টাকা বাড়াব?
দেখি।
যদি বলেন সন্ধ্যার পর ফরহাদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে…।
করা যা ইচ্ছা।
আপনি সঙ্গে গেলে ভালো হয়–স্যার যাবেন?
আজমল তরফদার জবাব দিলেন না। ভুরু কঁচকে বসে রইলেন। শুটিং প্যাকআপ হবার পরেও কেউ যাচ্ছে না। বসে আছে। বিকেল চারটা পর্যন্ত শিফট। এখন বাজছে মাত্র বারটা। সারাদিনের কাজ মাটি হবে–তা তো হয় না। নায়ক ছাড়াও তো অনেক কাজ আছে। সেগুলো করা যায়।
ডাইরেক্টর সাহেব রাগের মাথায় প্যাকআপ বলার পরেও মিজান চোখের ইশারায় বলেছে–প্যাকআপ না, সাময়িক বিরতি। অবস্থা ঠাণ্ডা হলে কাজ আবার শুরু হবে। অবস্থা ঠাণ্ডা হলো না। মিজান যখন ডাইরেক্টর সাহেবের কানে কানে বলল, লাঞ্চ ব্রেকের পর কি স্যার ছোটখাটো দু’একটা কাজ করে ফেলব –তখন আজমল তফাদার প্রচণ্ড ধমক দিলেন, গাধার বাচ্চা, প্যাকআপ হয়ে গেছে তুই দেখছিস না? খালি বেশি কথা–সামনে থেকে যা। আমাকে কাজ শিখায়।
মিজান কুৎসিত ধমকে কিছু মনে করল না। কুৎসিত গালি, তুই তুকারি শুটিং ফ্লোরে চলবে না তো কোথায় চলবে? শুটিং ফ্লোর তো আর শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জ না। মিজান একটু দূরে সরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। লাইটম্যানদের ইশারায় জানাল— শুটিং আসলেই প্যাকআপ। লাইট নামানো হচ্ছে। চারদিকে আনন্দময় ব্যস্ততা।
রেশমার বুক ধকধক করছে। তার মন বলছে আজ পেমেন্ট হবে না। গতকাল দু’ শিফট কাজ হয়েছে। পেমেন্ট হয় নি–বলা হয়েছে আজকের কাজ শেষ হলে একসঙ্গে পেমেন্ট। আজ যে অবস্থা তাতে পেমেন্টের কোনো সম্ভাবনা সে দেখছে না। জয়দেবপুর ফিরে যাবার ভাড়া পর্যন্ত নেই। দুদিন হলো ঘরে চাল নেই। আশপাশের দোকান থেকে ধারে আনার উপায় নেই। সবাই টাকা পায়, ধার কেউ দেবে না। তারপরেও সে তিন কেজি চালের ব্যবস্থা করেছিল। আজ টাকা নিয়ে ফেরার পর এক সপ্তাহের চাল-ডালের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। রেশমা মিজানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মিজান বলল, কী চাস?
পেমেন্ট হবে না মিজান ভাই?
উঁ।
‘উঁ’ শব্দটা মানে কী রেশমা ধরতে পারছে না। ‘হ্যাঁ’ না ‘না’?
খুব অসুবিধায় আছি মিজান ভাই।
আমরা কি খুব সুবিধায় আছি! বেআক্কেলের মতো কথাবার্তা বলিস কী জন্যে? ছবির বারটা বেজে গেছে আর তোর হলো পেমেন্ট? টাকা দরকার ভালো কথা–তার সময়-অসময় আছে না?
বড় অসুবিধার মধ্যে আছি মিজান ভাই।
অফিসে যা, অফিসে গিয়ে মুনশি সাহেবকে বল। এখানে কোনো পেমেন্ট হবে না। সব পেমেন্ট অফিসে।
ম্যানেজার সাহেবকে একটু বলে দেবেন?
আচ্ছা।
মনে থাকবে মিজান ভাই?
হুঁ।
রেশমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। গত মাসে ‘বিনাকা স্টোর’ থেকে খুব কায়দা করে বাজার করেছে। বিনাকা স্টোরের মালিক ইসমাইল সাহেবকে বলেছে, চাচা আজ আমার একটা সুসংবাদ আছে। আমাদের লাস্ট ছবিটা হিট করেছে তো–এই জন্যে সবাইকে বোনাস দেয়া হয়েছে।
ইসমাইল হাই তুলতে তুলতে বলল, ভালোই তো।
আপনার দোকান থেকে তো শুধু ধারেই বাজার করি আজ নগদা-নগদি খরিদ। ভুটানের মরিচের আচার আছে না! আজ ভুটানের একটা মরিচের আচারও কিনব। আছে?
ইসমাইল আবারো হাই তুলে বলল, হুঁ। সে হাই না তুলে কোনো কথা বলতে পারে না।
চাল, ডাল, আটা, ভুটানের মরিচের আচার, সয়াবিন তেল, চা, চিনি সব মিলিয়ে পাঁচ শ তিয়াত্তর টাকা। রেশমা বাজারের সব প্যাকেট একত্র করে দাম দেয়ার জন্যে ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে–হতভম্ব চোখে ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইল।
ইসমাইল সন্দেহজনক গলায় বলল, কি টাকা চুরি গেছে?
না। আনতে ভুলে গেছি। চাচা আমার সঙ্গে কাউকে দিয়ে দিন। বাসা থেকে নিয়ে আসবে। যাবে আর আসবে। আমি রিকশা ভাড়া দিয়ে দেব।
ইসমাইল খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে বলল, কাল দিলেই হবে।
আমি স্টুডিওতে যাবার সময় দিয়ে যাব। আমি সকাল আটটার আগেই যাই—তখন দোকান খোলে না?
দশটার আগে দোকান খুলি না।
তাহলে ফেরার পথে দিয়ে যাব।
আচ্ছা।
রেশমা আর যায় নি। যাবে কীভাবে, হাত খালি। আল্লাহর অসীম মেহেরবানি ইসমাইল তার বাসা চেনে না। বাসা চিনলে লোক পাঠিয়ে দিত।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। রেশমা শুকনো মুখে বসে আছে বাণী কথাচিত্রের অফিসে। মিজান ম্যানেজার সাহেবকে রেশমার পেমেন্টের ব্যাপারে কিছু বলে নি। বাণী কথাচিত্রের ম্যানেজার মুনশি শুকনো মুখে বলেছে–শুটিঙের পেমেন্ট এখন বন্ধ। স্যারের লিখিত অর্ডার ছাড়া পেমেন্ট হবে না। মুনশি কঠিন লোক–কাঁদতে কাঁদতে তার পা জড়িয়ে ধরলেও কিছু হবে না। তারপরেও রেশমা বসে আছে যদি মিজান ভাই চলে আসেন। ইউনিটের লোকেরা ফিল্ম অফিসে দিনের মধ্যে একবার আসেই।
মুনশি বলল, খামাখ্যা বসে আছ কেন চলে যাও।
মিজান ভাই আমাকে থাকতে বলছেন।
তাহলে থাক।
রেশমা মনে মনে হাসল। অভাব তাকে আর কিছু শেখাক বা না শেখাক একটা জিনিস শিখিয়েছে। সুন্দর করে মিথ্যা বলা শিখিয়েছে। পৃথিবীতে সবচে’ সুন্দর করে মিথ্যা কারা বলে–অভাবী মানুষেরা। সবচে’ সুন্দর অভিনয় কারা করে? অভাবী মানুষেরাই করে। সারাক্ষণ তাদের অভিনয় করতে হয়। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা নিয়ে রেশমা অপেক্ষা করছে অথচ সে তার মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে। এই অভিনয় মোটেই সহজ অভিনয় না।
রাত আটটায় অফিস বন্ধ হয়ে যায়। আটটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। মুনশি বলল, কই মিজান সাহেব তো এলেন না।
রেশমা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না। মিজান ভাই বললেন, সন্ধ্যার পর অফিসে চলে এস, জরুরি কথা আছে। ভুলে গেলেন। কিনা কে জানে। সম্ভবত ভুলে গেছেন।
সে উঠে দাঁড়াল। জয়দেবপুর ফিরে যাবার বাস ভাড়া তার কাছে নেই। সেটা সমস্যা না। তার মতো রূপবতী মেয়ে যদি কন্ডাক্টরকে নরম গলায় বলে–ভাড়া নাই–কন্ডাক্টর কিছু মনে করবে না। তবে এদের কাছে সত্য কথা বলতে হবে। এদের কাছে বানিয়ে কোনো গল্প বলা যাবে না। একজন অভাবী মানুষ অন্য একজন অভাবী মানুষের অভিনয় চট করে ধরে ফেলে। বাসের কন্ডাক্টরও অভাবী লোক।
আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামতে পারে। রেশমাকে মগবাজার বাসস্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে। সে মনে মনে চাইছে বৃষ্টি নামুক। তবে এখন না বাসে ওঠার পর ঝুম বৃষ্টি নামুক। সে বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবা হয়ে বাসায় যেতে চায়। গরমে ঘামে গা ঘিনঘিন করছে।
মানুষের অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছা বোধহয় সব সময় পূরণ হয়। বাস থেকে নেমেই রেশম বৃষ্টি পেয়ে গেল। ভালো বৃষ্টি। রিকশাওয়ালারা ঘণ্টা বাজিয়ে আসছে, আসুক, রিকশায় ওঠা যাবে না। প্রথমত টাকা নেই, দ্বিতীয়ত ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টিতে ভিজতেও খুব যে আরাম লাগছে তা না। ফোটাগুলো ধারালো বলে মনে হচ্ছে। কেমন যেন গায়ে বিঁধে যাচ্ছে। কিছু কিছু বৃষ্টি নরম করে গায়ে পড়ে, কিছু কিছু বৃষ্টি ধারালো বালির কণার মতো শরীরে বিঁধে যায়। এ রকম কেন হয় কে বলবে?
বাসার কাছাকাছি এসেই রেশমা তার শরীর থেকে ছবির নাম মুছে মিতু হয়ে গেল। এখন সে আর রেশমা না, এখন সে মিতু।
বাসার বারান্দায় মোড়ার উপর মবিন ভাই বাসা। তাঁর পাশে মিতুর বোন ঝুমুর। গালে হাত দিয়ে গল্প শুনছে। ঝুমুর মিতুকে দেখে নি। মবিন প্রথম দেখল এবং আঙুল উচিয়ে ঝুমুরকে দেখাল। ঝুমুর উঠে দাঁড়াল, খুশি খুশি গলায় চেঁচাল–আপা চলে এসেছে, আপা। ঝুমুরের, চিৎকার শুনে তার মা শাহেদা এসে দরজায় দাঁড়ালেন। তাঁর মুখও আনন্দে উজ্জ্বল। তিনি এগিয়ে এসে মেয়ের হাত ধরে নরম গলায় বললেন, ভিজে কী হয়েছিস, ভিজলি কেন? রিকশা নিয়ে চলে এলেই হত।
মিতু মবিনের দিকে তাকাল। মা’র সামনে এই মানুষটির সঙ্গে কথা বলতে তার লজ্জা লাগে। আগে যখন আপনি করে বলত তখন লজ্জা লাগত না। এখন তুমি তুমি করে বলে বলেই লজ্জা লাগে। মিতু বলল, তুমি কখন এসেছ?
মবিন জবাব দিল না। মুখ টিপে হাসল। ঝুমুর বলল, মবিন ভাইয়া বিকেলে এসেছে। আমি বললাম, আপার আজ সেকেন্ড শিফট পর্যন্ত শুটিং, বারটার আগে আসবে না। মবিন ভাইয়া বলেছে অবশ্যই সে আটটার আগে চলে আসবে। উনার কথাই ঠিক হলো। আপা তুমি কাপড় বদলে আস। শীতে কাঁপছ।
মিতু কাপড় বদলাতে গেল। শাহেদা বাথরুমের পাশে তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চাপা গলায় বললেন, মবিন আজ বাজার টাজার করে নিয়ে এসেছে।
কেন?
জানি না কেন? দু’কেজির মতো পোলাওয়ের চাল, খাসির মাংস, বাটার অয়েল। আমাকে বলল, মা আপনার হাতে পোলাও-কোরমা খেতে ইচ্ছা করছে।
রেঁধেছা পোলাও-কোরমা?
হুঁ। ঘরে আদা, গরম মসলা কিছুই নাই… তুই তো টাকা-পয়সাও দিয়ে যাস নি।
গরম মসলা ছাড়াই কোরমা রেঁধেছ?
না। মবিন বলল, আর কী কী লাগবে আমি তো জানি না–একটা কাগজে লিস্ট করে দিন নিয়ে আসি। বুদ্ধিমান ছেলে, আমাদের অবস্থা যে জানে না তা তো না।
তাড়াতাড়ি খাবার দিয়ে দাও মা, প্ৰচণ্ড খিদে লেগেছে।
তুই কি টাকা-পয়সা কিছু এনেছিস? মিতু জবাব দিল না। টাকা-পয়সা নিয়ে কথা বলতে কিংবা টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবতে এই মুহুর্তে ভালো লাগছে না। শাহেদা চাপা গলায় বললেন, ও তোর জন্যে কী জানি এনেছে। হঠাৎ করে এইসব কী বুঝলাম না।
শাহেদা না বুঝলেও মিতু বুঝেছে। আজ ১৮ তারিখ, তার জন্মদিন। বাসায় কারোর মনে নেই–তার নিজেরও মনে নেই, কিন্তু মবিন ভাইয়ের ঠিকই মনে আছে। এই এক উপলক্ষ ধরে শুধু শুধু এতগুলো টাকা খরচ করার কোনো মানে হয় না। মিতু তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুল জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। মবিন একা একা বসে আছে। তাকে কেমন রোগা রোগা লাগছে। মিতু হাসিমুখে বলল, তুমি নাকি আমার জন্যে কী উপহার এনেছ–মা বলল।
হুঁ।
কই উপহারটা দাও।
ঝুমুরের কাছে দিয়েছি।
জিনিসটা কী? বই?
উঁহুঁ। একটা শাড়ি। কমদামি জিনিস, সুতি শাড়ি। রঙটা খুব মনে ধরল।
কী রঙ?
জমিনটা হালকা বেগুনি, পাড় সবুজ।
কালো মেয়েদের জন্যে কখনো বেগুনি রং কিনতে নেই। বেগুনি রঙে কালো মেয়েদের আরো কালো দেখায়। বেগুনি রং আশপাশ থেকে রং শুষে নেয়।
এতসব জানি কীভাবে?
আমাদের মেকআপম্যান, তার কাছে শুনেছি।
আজ তোমাদের শুটিং ক্যানসেল হলো কেন?
নানান কারণ। অন্য কথা বল— তোমার সঙ্গে ছবির গল্প করতে ভালো লাগে না। চাকরি টাকরির কোনো খবর পেয়েছ?
না।
বাজার, উপহার এইসব দেখে ভাবলাম হয়তো কিছু পেয়ে গেছ।
এখনো পাই নি।
তাহলে করছি কী?
আগে যা করতাম, তাই করছি–জ্ঞানের ফেরিওয়ালা। বাড়ি বাড়ি জ্ঞান ফেরি করে বেড়াচ্ছি। প্রাইভেট টিউশ্যানি।
চাকরির ইন্টারভুদ্য দেয়া কি বন্ধ করে দিয়েছ?
না। এখনো দিচ্ছি। আমার ধৈৰ্য আমার দুর্ভাগ্যের মতোই সীমাহীন।
বইয়ের ভাষায় কথা বলবে না। আমার খুবই বিরক্তি লাগে। যা বলার সহজ সাধারণ ভাষায় বলবে।
আচ্ছা বলব।
মিতু মবিনের পাশে রাখা মোড়ায় বসতে বসতে বলল, তুমি জ্ঞানের ফেরিওয়ালা হয়ে যা রোজগার কর তাতে তোমার নিজেরই চলে না, তার উপর দেশে টাকা পাঠাতে হয়–এই অবস্থায় শুধু শুধু এতগুলো টাকা খরচ করা খুব অন্যায়।
মবিন হালকা গলায় বলল, ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে জানিনে…
তোমাকে না বললাম। বইয়ের ভাষায় কথা বলবে না।
দিনরাত বই পড়তে পড়তে নিজে খানিকটা বইয়ের মতো হয়ে গেছি। শুষ্কং কাষ্ঠং।
এই যে এত ইন্টারভ্যু দিচ্ছ–কোথাও কিছু হচ্ছে না?
প্ৰতিবারই হচ্ছে হচ্ছে একটা ভাব হয়, তারপর হয় না।
সেটা আবার কেমন?
দিন কুড়ি আগে চাকরির একটা ইন্টারভ্যু দিলাম। বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন, আপনার বাইরের পড়াশোনা তো বেশ ভালো। কোয়াইট ইম্প্রেসিভ। আপনার ইন্টারভ্যু নিয়ে ভালো লাগল। এই পর্যন্তই। চাকরি হয় নি।
একদিন নিশ্চয়ই হবে।
মবিন হাসল। সুন্দর করে হাসল। অন্ধকারে তার হাসিমুখ দেখা গেল না। মিতুর মনে হলো–দেখা না যাওয়াটাই ভালো। মানুষটার হাসিমুখ এত সুন্দর। দেখলেই বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়।
ঝুমুর এসে বলল, মবিন ভাই খেতে আসুন।
মবিন উঠে দাঁড়াল।
মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খাবার আয়োজন। মবিনকে মাঝখানে রেখে দু’বোন দু’পাশে বসেছে। শাহেদা খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। মবিন তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, মা আপনি খাবেন না? সুন্দর করে মা ডাকল, কিন্তু শাহেদার সেই মা ডাক ভালো লাগল না। ছেলেটা ভালো। খুবই ভালো। তাঁর বড় ছেলে রফিকের প্ৰিয় বন্ধুদের একজন। তাকে দেখলেই রফিকের কথা মনে হয়। কিন্তু শাহেদার এই ছেলেকে পছন্দ না। অপছন্দের কারণও তিনি জানেন না।
মবিন বলল, মা আপনিও আমাদের সঙ্গে বসুন।
শাহেদা যন্ত্রের মতো বললেন, তোমরা খাও। রাতে আমি কিছু খাই না। অম্বল হয়।
ঝুমুর বলল, মবিন ভাই খেতে খেতে ঐ গল্পটা আবার বলুন না। সবাই শুনুক।
কোন গল্পটা?
জ্ঞানী ভূতের গল্পটা–আপা, তুমিও শোন–ভয়ঙ্কর হাসির। হাসতে হাসতে বিষম খাবে। ভূতরা তো সাধারণত খুব বোকা হয়–ঐ ভূতটা ছিল বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের প্রথম ছাব্বিশ পৃষ্ঠা তার মুখস্থ ছিল।
শাহেদা বিরক্ত গলায় বললেন, খাওয়ার সময় এত গল্প কী? চুপচাপ খেয়ে যা। মবিন খেতে পারছ? খেতে কেমন হয়েছে?
খুব ভালো হয়েছে মা। হোটেলের কুৎসিত খাবার খাই। পোলাও-কোরমা অমৃতের মতো লাগছে।
ঝুমুর বলল, মবিন ভাই অমৃত খেতে কি পোলাও-কোরমার মতো?
মবিন হাসিমুখে বলল, না। অমৃত খেতে মিষ্টি।
এমনভাবে বললেন যেন আপনি অমৃত খেয়ে দেখেছেন।
শাহেদা আবারো বিরক্ত গলায় বললেন, খাওয়ার সময় এত কথা কেন?
খাওয়া শেষ করে মবিন বারান্দায় বসে আছে। খুব জোরেশোরে বৃষ্টি নেমেছে। মবিনের পাশে ঝুমুর বসে আছে। সে চোখ বড় বড় করে গল্প শুনছে।
শাহেদা শুয়ে পড়েছেন। তাঁর শরীর ভালো লাগছে না। মিতু রান্নাঘরে চায়ের পানি বসিয়েছে। চায়ের দুধ নেই। রং চা বানাতে হবে। মবিন রং চা খেতে পারে না। ঝুমুর এসে পাশে বসল— চাপা গলায় বলল, আপা, কী রকম ঝুম বৃষ্টি নেমেছে দেখেছ?
হুঁ।
মবিন ভাই এ রকম ঝুম বৃষ্টির মধ্যে যাবে কীভাবে?
ভিজতে ভিজতে যাবে, আর কীভাবে যাবে।
আজ আমাদের বাসায় থেকে যাক না। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা তিনজন মিলে গল্প করব।
থাকবে কোথায়?
বসার ঘরে বিছানা করে দেব।
ও রাজি হবে না।
বললেই রাজি হবে। বলে দেখব আপা?
দেখতে পারিস।
ঝুমুর ছুটে চলে গেল। উৎসাহে তার চোখে ঝলমল করছে। মিতু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে কাপে চা ঢালছে। সে জানে মবিন রাজি হবে না। এইসব ব্যাপারে সে ভয়ঙ্কর সাবধান।
মিতু চা নিয়ে বারান্দায় গেল। ঝুমুর করুণ গলায় বলল, আপা, মবিন ভাই থাকতে রাজি হচ্ছে না। তুমি একটু বলে দেখ না।
মবিন চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, তোমার আপা বললেও রাজি হব না।
বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধাবেন?
হুঁ, অনেক দিন অসুখবিসুখ হচ্ছে না। একটা অসুখ বাঁধাতে ইচ্ছা করছে।
চা শেষ করে বৃষ্টির মধ্যেই মবিন নেমে গেল। ঘরে কোনো ছাতা নেই। মিতুর মনটা খারাপ লাগছে। একটা ছাতা থাকলে বেচারাকে দেয়া যেত।
দু’বোন বারান্দায় বসে আছে। ঝুমুর বলল, মবিন ভাই নামল আর কী বৃষ্টিটাই শুরু হলো–আপা দেখলে?
হুঁ।
অসুখ অসুখ করছিল। এখন সে নির্ঘাত অসুখে পড়বে।
পড়ুক।
আপা উনি যে তোমার জন্যে শাড়িটা এনেছেন সেটা পরবে?
রাতদুপুরে নতুন শাড়ি পরব কেন?
পর না দেখি কেমন লাগে। প্লিজ।
শুধু শুধু বিরক্ত করিস না তো ঝুমুর। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আমি এখন শুয়ে পড়ব।
বেচারা শখ করে এনেছে পর না।
পরলে কী হবে? ও তো আর দেখবে না।
না দেখুক। তুমি তো জানবে–সে তোমার জন্যে কষ্টটষ্ট করে একটা শাড়ি এনেছে, তুমি সেটা পরেছ।
ওই শাড়ি আমাকে মানাবে না। বেগুনি রঙের শাড়ি, আমি কালো একটা মেয়ে।
প্লিজ আপা, প্লিজ।
ঝুমুর তোর খুব বিরক্ত করা স্বভাব হয়েছে। এক লক্ষবার প্লিজ বললেও আমি এখন শাড়ি পরব না।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি পরবে।
আয় শুয়ে পড়ি। রাতদুপুর পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
আরেকটু বসি আপা।
তুই বসে থাক। আমি শুয়ে পড়ি।
ও আপা, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। বিকেলে এক ভদ্রলোক এসে তোমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেছেন।
মিতু বিস্মিত হয়ে বলল, কী চিঠি?
আমি কী করে বলব। কী চিঠি? খামে বন্ধ। আমি খাম খুলি নি।
খাম খুলে মিতু চারটা চকচকে পাঁচ শ টাকার নোট পেল। কোনো চিঠি নেই, শুধুই টাকা। টাকাগুলো সে মোবারক সাহেবের বাড়িতে ফেলে এসেছিল।
ঝুমুর অবাক হয়ে বলল, এত টাকা কীসের আপা?
মিতু ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল।