০৩. প্রাচীন রাজত্ব

৩. প্রাচীন রাজত্ব

ইমহোটেপ

প্রথম দুই রাজবংশের রাজনৈতিক বিবরণ খুব কমই পাওয়া যায়। মানেথোর তালিকায় আমরা প্রায় বিশ জন রাজার নাম দেখতে পাই, তবে তার বেশি নয়। কাহিনী প্রচলিত আছে যে মেনেস প্রায় ষাট বছর রাজত্ব করেছিলেন, যারা মিশরের পশ্চিম উপকূলে কর্তৃত্ব করত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, আর শেষ পর্যন্ত তিনি একটি জলহস্তির উদরস্থ হন। তবে এগুলির কোনোটাকেই যথার্থ বলে মেনে নেয়া যায় না, বিশেষ করে শেষেরটি, কারণ জলহস্তিরা তৃণভোজী।

তৎসত্বেও প্রাচীন মিশর ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধিশালী হচ্ছিল, আর সেই সাথে দেবত্বের দাবীদার রাজাদের প্রতাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। প্রজাদের চোখে তারাই ছিল ধনসম্পদের নিয়ন্তা।

স্বাভাবিকভাবেই রাজারা ব্যাপৃত থাকত জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে। কারণ জনগণের শ্রদ্ধাভক্তি এবং তাদের উপর দেবত্ব আরোপ রাজাদের বিশেষভাবে আপুত করত। তাছাড়া এর একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবও ছিল। জীবিত ও মৃত উভয় ক্ষেত্রে রাজাদের শানশওকত, তাদের দেবত্ব নিয়ে প্রজাদের মধ্যে নিশ্চয়তা বৃদ্ধি করত, আর এতে করে তার নিরাপদে রাজ্য শাসনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেত।

এধরনের নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি নূতন রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পর আরও বৃদ্ধি পেত। আমরা খুব কমই জানতে পেরেছি কীভাবে পুরনো রাজবংশের সমাপ্তি আর নূতন রাজবংশের উত্থান ঘটত। অনুমান করা যায় পর পর কয়েকজন দুর্বল উত্তরাধিকারীর কারণেই রাজবংশের পতন ডেকে আনত। হয়তো কোনো শক্তিশালী জেনারেল ক্ষমতা দখল করত, অথবা রাজদরবারের কোনো প্রভাবশালী অমাত্য প্রথমে রাজার উপদেষ্টা, তারপর রাজার শক্তিদাতা এবং শেষ পর্যন্ত রাজার বার্ধক্য অথবা দুর্বলতার সুযোগে তাকে সরিয়ে দিয়ে বা গোপনে হত্যা করে নিজেই রাজক্ষমতা দখল। এমনও হতে পারে যে রাজবংশে পুরুষ উত্তরাধিকারীর অভাব দেখা দিল আর সেই সুযোগে কোনো জেনারেল বা রাজকর্মচারী পুরাতন বংশের কোনো মহিলাকে বিয়ে করে নিজেকে নূতন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বলে ঘোষণা করল।

জাতিও পুরনো রাজবংশের একজন দুর্বল, অক্ষম, অপ্রাপ্তবয়সী শাসকের পরিবর্তে একজন শক্তিশালী রাজাকে স্বাগত জানাত। তবে একজন দেবতৃপ্রাপ্ত রাজপরিবারের প্রতি মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা সহজে দূর করা সম্ভব হতো না। সে কারণে নূতন শাসক এমন কিছু চমকপ্রদ দৈবী শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করত যা পূর্বতন রাজাদের কীর্তিকে অতিক্রম করে যায়।

এটাই ঘটে থাকতে পারে যখন তৃতীয় রাজবংশ সিংহাসনে আরোহণ করে। ক্ষমতার প্রদর্শন এতই উল্লেখযোগ্য ছিল যে এই রাজবংশের আরম্ভকে বলা হয় প্রাচীন রাজত্ব (এর কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয় পরবর্তী রাজবংশসমূহের মহানুভবতা ও জাঁকজমক, ইতিহাসে যাদের পরিচয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাজবংশরূপে)।

তৃতীয় রাজবংশের প্রথম (সম্ভবত দ্বিতীয়) রাজা ছিলেন জোসার। তার রাজত্বকালের শুরু আনুমানিক ২৬৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, আর তিনি ভাগ্যবান ছিলেন ইমহোটেপের মতো একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে উপদেষ্টা পেয়ে।

ইমহোটেপ ইতিহাসে পরিচিত প্রথম বিজ্ঞানী হিসাবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয় আর তাকে ঘিরে কল্পকথা তৈরি হতে থাকে। তিনি পরিচিতি লাভ করেন একজন মহান চিকিৎসকরূপে, যার আরওগ্য করার ছিল যাদুকরী ক্ষমতা। প্রকৃতপক্ষে বহু শতাব্দী পরে মিশরীয়রা তাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের দেবতা বলে গণ্য করত। মনে করা হয় তিনি খাদ্য সঞ্চয় করে খরাজনিত দুর্ভিক্ষের হাত থেকে মিশরবাসীকে রক্ষা করেছিলেন। আর সম্ভবত বাইবেলের যোসেফের কাহিনী ইমহোটেপকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল।

চিকিৎসক হিসাবে গড়ে ওঠা কল্পকাহিনী ছাড়াও একজন কর্মকুশলী বিজ্ঞানী হিসাবেও তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তবে এটা বাস্তব সত্য যে ইমহোটেপই ছিলেন একজন সত্যিকারের স্থপতি। তিনি জোসারের জন্য একটা মাস্তাবা নির্মাণ করেন যেটা ছিল এযাবৎ নির্মিত কবরের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর এটা তৈরি হয় পাথর দিয়ে, ইট দিয়ে নয়। আর এতেই নূতন রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা হিসাবে খ্যাতি লাভের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হয়েছিল। ইমহোটেপ উভয় পার্শ্বে ২১০ ফিট দীর্ঘ আর ২৫ ফিট উচ্চ এই মাস্তাবাটা নির্মাণ করেছিলেন সাক্কারাতে। এটাই পৃথিবীতে সর্বোচ্চ প্রস্তর নির্মিত স্থাপনা, তবে এটা মানব নির্মিত সংরক্ষণ, কারণ পাথর এমনভাবে খোদাই করা হয়েছিল যাতে করে স্থাপনাটা বৃক্ষ বা নলখাগড়ার রূপ লাভ করে।

জোসার কিন্তু মাস্তাবা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি, অথবা হয়তো ইমহোটেপ নিজেও তার নূতনত্বে তৃপ্ত হতে পারেননি। তাই এর চাইতে উন্নততর কিছু করতে চেয়েছিলেন। কারণ যাই হোক না কেন ইমহোটেপ মাস্তাবাটার ভিত্তির দৈর্ঘ্য প্রস্থ বাড়িয়ে ৪০০ ও ৩০০ ফিট করেন। তারপর এর উপরে ক্ষুদ্রতর আর একটা মাস্তাবা নির্মাণ করেন, তার উপরে আরও একটা এমনি করে পর পর অনেকগুলি। অবশেষে যার উচ্চতা গিয়ে দাঁড়ায় ২০০ ফিট।

তার চেয়েও বড় কথা, একে ঘিরে আরও অনেকগুলি ক্ষুদ্রতর স্থাপনা নির্মাণ করেন, যার নিশানা এখনও রয়ে গেছে, আবার গোটা এলাকাটা লাইমস্টোনের প্যানেল দিয়ে ঘেরাও করা। পরিবেষ্টিত স্থানটির দৈর্ঘ্য ১৮০০ ফিট এবং প্রস্থ ৯০০ ফিট।

নির্মাণশৈলীর সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের অনেকটাই এখন ম্লান হয়ে গেছে, তবে আদি স্থাপনা ভাঙ্গাচোরা আর অযত্ন মেরামতে অনেকটা ম্লান হলেও নির্মাণের ৪৬০০ বছর পরেও এটা এখনও টিকে আছে। এটা যে শুধু পাথরের তৈরি পৃথিবীর প্রথম স্থাপনা তাই নয়, মানুষের তৈরি সর্বপ্রাচীন নির্মাণ যা এখনও পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সন্দেহ নাই ইমহোটেপ কর্তৃক জোসারের বহুমুখি মাস্তাবা নির্মাণ অতীতের নির্মাণশৈলীর এক মহান নিদর্শন, সময়ের মাপকাঠিতে এ বিশাল অগ্রগতি, যার প্রশংসা করে কখনো শেষ করা যাবেনা, তবে শূন্য থেকে এর আবির্ভাব ঘটেছিল মনে করা ভুল হবে। আটলান্টিসের আশ্রয়প্রার্থীদের দ্বারা এর সূত্রপাত ভাবাও ঠিক নয়। মিশরীয়দের বহু শতাব্দীর ধীর ও কষ্টসাধ্য পরিশ্রমেই গড়ে উঠেছিল এই কৌশল।

তবে বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মধ্যেই প্রাচীন রাজবংশের কীর্তিকলাপ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। জোসারের রাজত্বকালেই মিশরীয় লিপি পরিপূর্ণতা লাভ করে (ইমহোটেপ, যার উপর মিশরের সকল অগ্রগতির কৃতিত্ব আরোপিত হয়, মিশরীয় লিপি ও স্থাপত্যেরও যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন)। হায়ারোগ্লিফিক লিখন আর শুধু বস্তুর কার্টুনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না, মানবচিন্তার বিমূর্ত অভিব্যক্তিও প্রকাশ পেল।

প্যাপিরাস রীড (প্যাপিরাস শব্দটি আমাদের কাছে এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে তবে এর উৎস অজানাই রয়ে গেছে), যা নীল নদের উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে জন্মত, তাই লেখার উপকরণরূপে ব্যবহৃত হতো। রীডের অন্তঃসার নিষ্কাশন করে নেয়া হতো, তারপর আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে শুকিয়ে নেয়া হতো, যার ফলে একটি মসৃণ, দৃঢ়, এবং স্থায়ী অবতল পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীন কোনো জাতিই এত উন্নত লেখার উপকরণ লাভ করেনি। ইউফ্রেতিস তাইগ্রিস অঞ্চলে ভারী মাটির ফলক ব্যবহার করা হতো আর প্রতীকগুলি এর উপর ঠুকে দেয়া হতো। এটা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পর্যাপ্ত ছিল ঠিকই তবে মিশরীয়দের মতো এত সুন্দর ছিলনা।

গ্রিক ও রোমান সভ্যতাতেও প্যাপিরাস ব্যবহার করা হয়েছিল যতদিন না এর সরবরাহ এত কমে গিয়েছিল যে এটা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজকাল আমরা প্রায় একই ধরনের একটা জিনিস লেখার কাজে ব্যবহার করি যার উপাদান কাঠ থেকে সংগ্রহ হয়, আর আমরা এটাকে এখনও বলি পেপার, যদিও প্যাপিরাসের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নাই।

লেখার জন্য সুবিধাজনক ও সস্তা অবতল প্রাপ্তি সভ্যতার অগ্রগতিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। মুখের কথার চাইতে লিখিত নির্দেশনা প্রদান অনেক বেশি কার্যকর ছিল, বিশেষ করে যে সব বিষয়ে ভ্রান্তি বিপজ্জনক হতে পারে, যেমন অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে।

সম্ভবত এটা কোনো দৈবক্রম নয় যে সর্বপ্রাচীন যে প্যাপিরাস গ্রন্থটি আবিষ্কৃত হয়েছে (হয় এটা প্রাচীন রাজবংশের আমলের, নয়তো সে সময়ের কোনো বইয়ের কপি) বলা হয় এডুইন স্মিথ প্যাপিরাস, যাতে ফ্র্যাকচারের মতো রোগের চিকিৎসার কথা লেখা আছে।

.

পিরামিড

বিশালাকৃতি সমাধিগৃহ নির্মাণ মিশরীয়দের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মিশরীয় রাজাদের উত্তরসূরিরাও পূর্বজদের মতো সমাধি নির্মাণের চিন্তায় উদগ্র হয়ে পড়ত, সেই সমাধি হবে আরও বিশাল আরও জাঁকজমকপূর্ণ। এই ইচ্ছার চাপ থেকেই স্থাপত্য কলাকুশলতায় উন্নতি হচ্ছিল। ইমহোটেপ তার স্থাপনায় ব্যবহার করেছিলেন ছোট ছোট পাথর, ইতিপূর্বে ব্যবহৃত পোড়ামাটির ইটের অনুকরণে। এসব ছোট পাথরের টুকরা মাপমতো কেটে, মসৃণ করে সঠিক স্থানে বসানোর চাইতে বড় বড় প্রস্তরখণ্ড সাইজ মতো কেটে সঠিক স্থানে বসানো অনেক সহজ ছিল। পাথরের আকার যত বড় হতো, সেগুলি যথাস্থানে বসাতে সময় তত কম লাগত, অবশ্য পাথরগুলির বহনসাধ্য হওয়া আবশ্যক ছিল।

বিশাল বিশাল পাথরখণ্ড বহন করার কাজে মিশরীয়রা ব্যবহার করেছিল শ্লেজ, রোলার, এবং ঘর্ষণ কমানোর জন্য প্রচুর পরিমাণ তেল, আর বিপুল পরিমাণ মানুষের পেশিশক্তি। পরবর্তী দুই শতাব্দী যাবৎ যেসব বিপুলায়তন সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল, তা সর্বকালের জন্য বিশ্বের বিস্ময়রূপে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকে, যা প্রাচীন রাজবংশ তথা মিশরের সার্বিক পরিচিতি।

দুহাজার বছর পরে যখন গ্রিকরা দলে দলে মিশরে প্রবেশ করেছিল, এসব বিপুলায়তন স্থাপনা দেখে তাদের মুখ হা হয়ে গিয়েছিল, যেসব স্থাপনা ইতিমধ্যেই বহু শতাব্দী পার হয়ে এসেছে। তারা এগুলির নাম দিয়েছিল পিরামিড (pyramid), শব্দটির উৎস অজ্ঞাত। জোসারের বহুমুখী মাস্তাবা এই প্রকারের একক উদাহরণ, যা এযাবৎ টিকে আছে। পরবর্তী রাজাদের মাথায় এই চিন্তাটা খেলে গিয়েছিল যে পিরামিডের প্রান্তগুলি ধাপে ধাপে উত্তোলিত না করে মসৃণ রাখলেই তা টেকসই হওয়ার বেশি সম্ভাবনা (ধাপবিশিষ্ট হওয়ায় জোসারের পিরামিডকে বলা হয় সিঁড়ি পিরামিড)।

নূতন ধারার প্রচলন হয় ২৬১৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যখন মিশরে চতুর্থ রাজবংশ ক্ষমতা লাভ করে। এই রাজবংশের শাসনকালে মিশর তার সংস্কৃতির শীর্ষে আরোহণ করে।

সম্ভবত স্নেফেরু ছিলেন এই রাজবংশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি তার পূর্বসূরি তৃতীয় রাজবংশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এটা করার জন্য তিনি তার সিঁড়ি পিরামিডকে আগের চাইতে আরও অনেক বড় করে বানিয়েছিলেন- যার ধাপ ছিল আটটি। তারপর তিনি ধাপের মধ্যবর্তী অবচ্ছেদগুলি পূরণ করে দেন যাতে পার্শ্বদেশগুলি সুসমতল দেখায়, অবশেষে পুরো স্থাপনাটা সাদা লাইমস্টোন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, যাতে উজ্জ্বল মিশরীয় সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয়ে এর মহিমা পূর্বতন সকল কীর্তিকে ছাড়িয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত পরবর্তী প্রজন্মে এর লাইমস্টোন খুবলে তুলে নিয়ে অন্যত্র ব্যবহার করা হয়েছে (অন্য পিরামিডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য)। তাছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইমস্টোন এমনিতেই খসে পড়েছে, যাতে মনে হয় পিরামিডটি অসম স্তরে নির্মিত।

স্নেফেরু আরও একটা পিরামিড তৈরি করান যেখানে প্রতিটি উপরের ধাপ নিচের চাইতে সামান্য ছোট, কাজেই পিরামিড স্তরবিন্যস্ত করেও মসৃণ রইল। উপরের দিকের প্রস্তরগুলিকে একটু বেশি ঢালু করা হয়েছিল যাতে শীর্ষে পৌঁছনো দ্রুততর হয়। হয়তো বয়োবৃদ্ধির কারণে মেফেরু চাইছিলেন নির্মাণ কাজটা দ্রুততর করতে যাতে তার মৃত্যুর পূর্বেই নির্মাণ কাজটা সম্পূর্ণ হয়ে যায়। তাই এটাকে বলা হয় বক্র পিরামিড।

স্নেফেরুর পর প্রত্যেকটি পিরামিড সত্যিকারের পিরামিড হয়ে উঠেছিল (আশিটার মতো এখনও টিকে আছে) যেগুলি মসৃণভাবে ঢালু হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে।

চতুর্থ রাজবংশের বিলাসিতা, যা রূপলাভ করেছে পিরামিডের মধ্য দিয়ে, তাতে অনুমান করা যায়, তারা নিশ্চয়ই চাকচিক্যময় দুর্গ বানিয়েছিল, আর রাজারা ব্যবসাবাণিজ্যে উৎসাহ যোগাত। মিশরের ক্রমবর্ধমান সম্পদ ব্যয় করা হতো, যেসব সম্পদ দেশে উৎপন্ন হতো না সেগুলি বিদেশ থেকে ক্রয় করার কাজে। মিশরীয় সেনাবাহিনী সিনাই উপদ্বীপ দখল করেছিল, কারণ ছিল এর তামার খনি- যে তামা অলংকার হিসাবে দেশে ব্যবহার করা যেত, আবার বিদেশেও রফতানি করা হতো।

একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পণ্য দেশে পাওয়া যেত না, আর তা হলো কাঠের গুঁড়ি, যা পাওয়া যেত সোজা দীর্ঘ গাছ থেকে। কাঠের গুঁড়ি ব্যবহার হতো দৃঢ়, আকর্ষণীয় স্তম্ভ নির্মাণে। বিশাল স্থাপনা নির্মাণে পাথরের চাইতে সহজে পরিবহণযোগ্য। পাথরকাটা, বহন করা, মসৃণ করা অনেক বেশি কঠিন। নীলের উপত্যকায় সঠিক প্রজাতির গাছ জন্মাত না, ওখানকার গাছপালা উপ-উষ্ণমণ্ডলীয়, তবে এগুলি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব-উপকূলে সিনাই উপদ্বীপে পাহাড়ের ঢালে জন্মায়।

এই অঞ্চলটার নানারকম নাম আছে। প্রাচীন হিব্রম্নরা উপকূলের দক্ষিণাংশকে বলত কেনান, এর সামান্য উত্তরাঞ্চল পরিচিত ছিল লেবানন নামে। লেবাননের সিডার বৃক্ষ ছিল চতুর্থ রাজবংশের কাছে দারুণ কাঙ্খিত। তাই বাইবেলে বহুবার এর গুণকীর্তন করা হয়েছে।

পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে গ্রিকরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলকে বলত ফিনিশিয়া, আর এর পেছনের এলাকাকে বলত সিরিয়া। এসবই খুব পরিচিত, আর আমি এই নামগুলিই ব্যবহার করব।

চতুর্থ রাজবংশের রাজারা হয়তো সিনাইয়ের উপর দিয়ে স্থলপথে বাণিজ্যবহর পাঠাত, আর তারপর উত্তর দিকে যেখানে সিডারবৃক্ষ সহজলভ্য ছিল। উভয় পথ মিলে এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৩৫০ মাইল, আর সেসব দিনে স্থলপথে যাতায়াত ছিল শ্রমসাধ্য আর কষ্টকর। তার চেয়েও বড় কথা এত দীর্ঘ পথে কাঠের গুঁড়ি টেনে আনা ছিল প্রায় অসম্ভব।

বিকল্প ব্যবস্থা ছিল জলপথে ফিনিশিয়া পৌঁছানো। দুর্ভাগ্যবশত মিশরীয়রা সমুদ্রগামি জাতি ছিলনা (আর কখনো হতেও পারেনি)। তাদের অভিজ্ঞতা বলতে নীলের মৃদু শান্ত স্রোতধারা। তারা এটা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে স্নেফেরুর আমলে ১৭০ ফিটের মতো নৌকা নীলের উজান ভাটিতে নির্বিঘ্নে চলাচল করত।

তবে নদীতে চলাচলের উপযোগী জাহাজ ভূমধ্যসাগরের অশান্ত ঝড়ো আবহাওয়ার জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না। তবু চাহিদার তাগিদে স্নেফেরু চল্লিশটার মতো জাহাজ পাঠিয়েছিলেন সিডার কাঠ সংগ্রহের জন্য। এ ধরনের কিছুটা শক্ত করে বানানো জাহাজ নীল নদ থেকে বেরিয়ে ভূমধ্যসাগরে ঢুকে পড়ত আর সমুদ্রের কূল ঘেঁষে যাত্রা করে অবশেষে ফিনিশিয়ায় প্রবেশ করত। সেখানে বিশাল বিশাল কাঠের গুঁড়ি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বোঝাই করে আবার মিশরে ফিরে আসত।

আমাদের সন্দেহ, কিছু কিছু জাহাজ মাঝপথে হারিয়ে যেত (যেমনটা সব যুগেই হয়ে থাকে, এমনকি আমাদের সময়েও), তবে যথেষ্টসংখ্যক টিকে থাকত লাভজনক বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার জন্য। মিশরীয়রা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র লোহিত সাগরেও প্রবেশ করার সাহস দেখিয়েছিল, যেটা ছিল দেশের পূর্বপ্রান্তে, আর সে পথে তারা দক্ষিণ আরবে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল, আর সেখান থেকে আফ্রিকার সোমালি উপকূলে। সেখান থেকে তারা ধুনা আর রেসিন সংগ্রহ করত।

এমনকি নীলের প্রবাহ ধরে প্রথম প্রপাত পার হয়ে দক্ষিণের রহস্যময় অরণ্যে প্রবেশ করত, আর সেখান থেকে হাতির দাঁত আর পশুর চামড়া নিয়ে আসত, (চতুর্থ রাজবংশের আমলে উপত্যকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং নিবিড় চাষাবাদের কারণে, ইতিমধ্যেই সেখানকার বৃহদাকার প্রাণীদের উপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছিল, হাতিরা দক্ষিণ দিকে প্রথম প্রপাত পার হয়ে চলে গিয়েছিল)।

.

বিশাল পিরামিড

স্নেফেরুর উত্তরাধিকারী ছিলেন খুফু। তার আমলেই পিরামিড নির্মাণ সর্বোচ্চ রূপ লাভ করে, কারণ তিনিই সর্বকালের সর্ববৃহৎ পিরামিড নির্মাণ করেন। এটা ঘটেছিল ২৫৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, ইমহোটেপের নির্মাণের ঠিক এক শতাব্দী পরে। এ সময়টাতে মিশরীয় প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ ঘটছিল।

খুফু তার দানবাকার পিরামিড বানিয়েছিলেন সাক্কারা থেকে কয়েক মাইল উত্তরে একটা পাহাড়ী উপত্যকায়, আজ যেখানে গিজা শহর অবস্থিত। এর নির্মাণ কাজ শেষ হলে দেখা গেল এর বর্গাকৃতি তলদেশে প্রত্যেক পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ৭৫৫ ফিট, যাতে করে এটা তেরো একর জায়গা দখল করে ছিল। এর দেয়ালগুলি ঢালু হয়ে উঠে গেছে ভূমি থেকে ৪৮১ ফিট। বিশাল পিরামিডটা নির্মাণ হয়েছিল ২৩০০০০০ নিরেট পাথরের স্ল্যাব দিয়ে যার প্রত্যেকটার ওজন ছিল ২.৫ টন। প্রত্যেকটি বয়ে আনা হয়েছিল প্রায় ছয়শ মাইল দূর থেকে (জাহাজে করে নীল নদের স্রোতের সাহায্য নিয়ে প্রথম প্রপাতের পাহাড়ি এলাকা থেকে)।

সে সময়কার প্রযুক্তির বিবেচনায়, যখন কোনো স্থাপনা নির্মাণের জন্য শুধু মানুষের হাতের সাহায্যই একমাত্র সম্বল ছিল (এমনকি চাকার সাহায্যও পাওয়া যায়নি), মহান পিরামিডকে অবশ্যই সারা পৃথিবীর অনন্য স্থাপত্যকীর্তিরূপে স্বীকৃতি দিতে হবে, চীনের প্রাচীরকে একমাত্র ব্যতিক্রম মনে করা যেতে পারে।

পিরামিডকে নিয়ে মানুষের বিস্ময় কখনো নিবৃত্ত হবার নয়, মানুষের তৈরি সর্ববৃহৎ স্থাপনা; এর নির্মাণের ৪৫০০ বছর পরেও একে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। গ্রিকরা একে এবং এর আশেপাশের পিরামিডগুলিকে “বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের” একটি বলে অভিহিত করেছে। আর তাদের তালিকাভুক্ত আশ্চর্যের মধ্যে একমাত্র পিরামিডই আজ অবধি টিকে রয়েছে। হয়তো প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিক সভ্যতার মতো বর্তমান সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও এগুলি টিকে থাকবে।

মহান পিরামিডটি স্বভাবতই হেরোডোটাসের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল, আর তিনি এ সম্বন্ধে অধিকতর তথ্য সংগ্রহের জন্য মিশরীয় পুরোহিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তারা তাকে অনেক দীর্ঘ মজাদার কাহিনী শুনিয়েছিল যেগুলি মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য ছিলনা। তারা হেরোডোটাসকে বলেছিল যে এই পিরামিডটা তৈরি করতে বিশ বছর সময় লেগেছিল, আর এক লক্ষ লোক নিয়োজিত ছিল। কথাটা হয়তো সত্যি।

তারা হেরোডোটাসকে রাজার নামও বলেছিলেন যিনি এটা বানিয়েছিলেন, তবে তিনি সেটা এমনভাবে অনুবাদ করেছিলেন যাতে গ্রিকদের কাছে শ্রবণসুখকর হয়, তাই খুফু হয়ে গিয়েছিল খিওপৃস। তারপর ল্যাটিন ভার্সনে সেটা হয়ে গেল চিপস, (সাধারণভাবে মিশরীয় নামের ল্যাটিন বানানে গ্রিক ভার্সনের সাথে আমরা অধিক পরিচিত (এরপর আমি কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ল্যাটিন বানান ব্যবহার করব)।

এটা বহুল প্রচলিত যে লাখ লাখ পিরামিড নির্মাতারা সবাই ছিল ক্রীতদাস, যারা তত্ত্বাবধায়কদের কষাঘাতে কাতরাতে কাতরাতে কাজ করতে বাধ্য হতো। বাইবেলের বুক অব এক্সোডাস থেকে অনেকেই ধারণা লাভ করে যে নির্মাতারা ছিল ক্রীতদাসে পরিণত করা ইসরাইলি, তবে প্রকৃত সত্য হলো ইসরাইলিদের মিশরে প্রবেশ করার হাজার বছর আগেই পিরামিডগুলি নির্মিত হয়েছিল, আর যাই হোক না কেন, পিরামিডগুলি স্বাধীন মানুষদের দ্বারাই নির্মিত হয়েছিল, আর শ্রমিকেরা খুশি মনেই কাজ করেছিল, আর তাদের সাথে ভালো ব্যবহারই করা হয়েছিল।

আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখা উচিত যে সে যুগের মিশরীয় সংস্কৃতিতে এধরনের পিরামিড নির্মাণ অতি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এগুলি নির্মিত হয়েছিল ঐশ্বরিক রাজা এবং দেবতাদের খুশি করার জন্য, আর সেই সাথে জনগণের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য। নির্মাতারা সম্ভবত একই মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল, যে মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মধ্যযুগে মানুষ ক্যাথিড্রাল নির্মাণে এগিয়ে এসেছিল, আর আধুনিক মানুষ নির্মাণ করে বিশাল হাইড্রোলিক ড্যাম। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে পিরামিড নির্মাণের একটা বিশেষ মওসুম ছিল, আর তা হলো নীলের বন্যার সময়, যখন কৃষিক্ষেত্রে কোনো কাজ থাকত না। কাজেই বলা যায় একটা উদ্দেশ্য মানুষকে কাজ পাইয়ে দেয়া আর তাদের ব্যস্ত রাখা।

গত শতাব্দীতে পিরামিড সম্বন্ধে যে ঔৎসুক্য, তার মূলে ছিল আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ। কারণ স্থাপনাগুলি এত বিশাল আর এত নিখুঁতভাবে তৈরি (বর্গাকার অবকাঠামো সঠিকভাবে উত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব পশ্চিম নির্ণয় করে বসানো হয়েছিল)। অনেকেই মনে করে মিশরীয়দের বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক গণিতের জ্ঞান অনেক সমৃদ্ধ ছিল। এমনটা ভাবা হয় যে অভ্যন্তরীণ গলিপথগুলি কোনো দৈববাণীকে অনুসরণ করে নির্মিত, আর সেগুলি এগিয়ে গেছে ভবিষ্যকালের পরিমাপ করে আর তার শেষ প্রান্ত পৃথিবীর সমাপ্তি জ্ঞাপন করে। অনেকেই এটাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন যে মহান পিরামিড এমন এক জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে যেখানে ৩০ ডিগ্ৰী উত্তর অক্ষাংশের সাথে ৩০ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ছেদ করেছে, মনে হয় যেন মিশরীয়রা জানত যে পৃথিবী বর্তুলাকার, বৃত্তের মাঝে ৩৬০ ডিগ্রী পাওয়া যায়, আর সব চাইতে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বহু সহস্রাব্দ পরে নির্ণীত হয় যে ভূমধ্যরেখা ঠিক লন্ডনের কাছ দিয়েই চলে গেছে।

অনেকেই অনুমান করেন যে মহান পিরামিডটি ছিল প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক মানমন্দির, আর একদা এক ব্যক্তি একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন (যার পাণ্ডুলিপি আমাকে দেখানো হয়েছিল) যাতে ইঙ্গিত করা হয়েছিল যে অবকাঠামোটি প্রকৃতপক্ষে নির্মাণ করা হয়েছিল মহাকাশযান উড্ডয়নের ঘাঁটি হিসাবে।

তবে দুঃখের বিষয়, এসব জল্পনা কল্পনা নেহাতই ভিত্তিহীন। মিশরতত্ত্ববিদরা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করেছেন মহান পিরামিড যা হওয়ার কথা আসলে তাই- একটি সুনির্মিত সমাধি। তাছাড়া এটা তার আসল উদ্দেশ্য সাধনেও ব্যর্থ হয়েছে, অর্থাৎ রাজার মৃতদেহ ও সম্পদ রক্ষা করা। খুফুর মৃতদেহটি এক বিশাল প্রস্তরস্তূপের নিচে সংরক্ষণ করা সত্ত্বেও, আর সেখানে পৌঁছানোর পথটিও নানান গোলকধাঁধার মাধ্যমে তৈরি করা এবং গন্তব্যে নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, চোরেরা সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গেচুরে মূল কেন্দ্রে ঢুকে যায়। শেষ পর্যন্ত আধুনিক পর্যবেক্ষকরা যখন কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছান, তখন সেখানে এক শূন্য শবাধার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। খুফুর পিরামিড উল্কর্ষের পরম শিখরে পৌঁছেছিল। তারপর থেকে স্থাপত্যশৈলীর বিচারে শুরু হয় অধোগতি।

খুফুর উত্তরাধিকারীরূপে শাসনভার লাভ করেন তার জ্যেষ্ঠপুত্র এবং তারপর আর এক কনিষ্ঠ পুত্র। এই কনিষ্ঠজন ছিলেন খাফ্রে, হেরোডোটাস যাকে অভিহিত করেছিলেন কেফ্রেন (Chephren)। ২৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যিনি বানিয়েছিলেন তার পিতার চাইতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির একটা পিরামিড। তিনি তার পিতা খুফুকে টেক্কা দিতে চেয়েছিলেন তার পিরামিডকে পিতার পিরামিডের চাইতে আরও উঁচু করে বানিয়ে। এর অধিকাংশ চুনাপাথরের আস্তরণ রয়ে গেছে শীর্ষদেশের কাছকাছি।

খাফ্রের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী ছিলেন মেনকুরে, গ্রিকদের কাছে যিনি মাইসেরিনাস (Mycerinus)। তিনি তৃতীয় আর একটি পিরামিড বানিয়েছিলেন যেটি ছিল তিনটির মধ্যে সবচেয়ে ছোট, যার নির্মাণকাল ২৫১০ এর কাছাকাছি।

এই তিনটি পিরামিড একসাথে গিজায় অবস্থিত, ৪৫০০ বছর আগের প্রাচীন সাম্রাজ্যের মহত্ত্বের নিদর্শন। অবশ্য আদিতে এগুলি যে আকারে ছিল এখন আমরা এগুলিকে আর সে আকারে দেখতে পাই না। কথাটা যে শুধু চুনাপাথরের আস্তরণ সম্বন্ধে প্রযোজ্য তাই না, প্রত্যেকটাকে ঘিরেই রয়েছে পরবর্তী রাজাদের অসংখ্য ছোট ছোট পিরামিড, যেগুলি নির্মিত হয়েছিল পরবর্তী রাজা এবং রাজ পরিবারের সদস্যদের সমাধি হিসাবে। খাফ্রের পিরামিডের প্রবেশপথে রয়েছে কমপক্ষে ২৩ জন রাজার মূর্তি। কাজেই এগুলিকে শুধু পিরামিড না বলে বলা চলে পিরামিড কমপ্লেক্স।

একটা জিনিস, যা পিরামিডে ছিল না, চতুর্থ রাজবংশের সময়ে নির্মিত সেই জিনিসটি পিরামিডের খ্যাতিকেও ম্লান করে দিয়েছিল, আর সেটা ছিল খাফ্রের পিরামিডের প্রবেশপথে বিশাল এক শায়িত সিংহের মূর্তি, পিরামিড থেকে মাত্র ১২০০ ফিট দূরে। একটা প্রাকৃতিক প্রস্তর স্তূপ শিল্পীর বাটালের আঁচড়ে রূপ নেয় এক বিস্ময়কর শিল্প নিদর্শনরূপে। সিংহের মাথাটি রাজকীয় সজ্জায় ভূষিত। মূর্তিটি রাজা খাফ্রের প্রতিবিম্ব আর সমগ্র মূর্তিটি রাজার ক্ষমতা ও গৌরবের রূপায়ণ।

পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে গ্রিকরা মিশরীয় ভাস্কর্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিংহের মূর্তির মধ্যে সিংহের শরীরে মানব (বরং মানবীর) মস্তকে একটা দানবের কল্পকাহিনী আবিষ্কার করেছিল। গ্রিকরা এই মূর্তির মধ্যে মানবের অমঙ্গলের ধারণা পেয়েছিল, তাই তারা মূর্তিটার নাম দিয়েছিল স্ফিংক্স, যার অর্থ শ্বাসরোধকারী। গ্রিক প্রবাদে বলা হয়েছে, সিংহমানবী স্ফিংক্স পথিকদের একটা ধাঁধার উত্তর জিজ্ঞাসা করত আর উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে তাকে গলা টিপে হত্যা করত। তাই যে কোনো মানুষ যদি রহস্যজনক আচরণ করে তাহলে বলা হয় সে ফিংক্সের মতো ব্যবহার করছে।

মিশরে হাজার হাজার স্ফিংক্স আছে তবে সর্ববৃহৎ স্ফিংক্সটি নির্মাণ করেছিলেন খাফ্রে। আর এর গম্ভীর মুখাবয়ব মরুভূমির মধ্যে এক মহা রহস্যের সৃষ্টি করেছে। তবে নেপোলিয়নের সৈন্যরা এই মহান সিংহমানব মূর্তিটি দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের কামানের ধার পরীক্ষা করার জন্য। এমনকি পরবর্তী রাজবংশের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতি পিরামিডগুলির দেয়ালের লিপি, যার উদ্দেশ্য ছিল সমাহিত ব্যক্তির পারলৌকিক জীবনযাপন সহজতর করা। পিরামিডের এসব লিপিতে মিশরীয়দের তৎকালীন ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে ধারণা লাভ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে এসব লিপি এবং “দ্য বুক অব ডেড” সর্বপ্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের দলিল।

.

অবক্ষয়

মেনকুরের মৃত্যুর মাত্র কয়েকবছর পর এবং কয়েক শতাব্দী সাফল্যমণ্ডিত রাজত্বের পর প্রায় ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ চতুর্থ রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে। এটা কি মেনকুরের বংশধরের অপ্রাপ্ত বয়সে মৃত্যু, নাকি কোনো সফল বিদ্রোহের কারণে, সেটা নির্ণয় করা আমাদের আয়ত্তের বাইরে। এ ক্ষেত্রে কল্পকাহিনীও নীরব।

তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, বিভক্তি এসেছিল। চতুর্থ রাজবংশের আগমনের পূর্বে একটানা পাঁচ শতাব্দীব্যাপী মিশর একক রাজবংশের শাসনাধীনে ছিল, তবে তার মাঝে যে রীতি প্রথার বিভেদ ছিল না তা নয়। এই বিভক্তি ছিল ধর্মভিত্তিক, এবং প্রত্যেক নগরের আলাদা আলাদা দেবতা ছিল, আর সে বিভক্তি কালান্তরে বেড়েই চলেছিল। রাজবংশের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মাচরণ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন সূচিত হতো। আর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুরোহিতরাও রাজবংশ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখত।

এভাবেই চতুর্থ রাজবংশ হোরাসকে তাদের প্রধান দেবতারূপে গণ্য করত, আর তাকে মান্য করত তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতীকরূপে। যেহেতু মেম্ফিসের পৃষ্ঠপোষক দেবতা বিশ্বস্রষ্টা প্টা, যিনি ছিলেন শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, তাই তাকেও মান্য করা হতো। তবে মেম্ফিসের ত্রিশ মাইল উত্তরে ওনুতে প্রধান দেবতা ছিল সূর্যদেবতা রী, নগরটি হাজার হাজার বছর ধরে রী এর অনুগত ছিল। গ্রিকদের কাছে নগরটি পরিচিত ছিল হেলিওপলিস (Heliopolis), অর্থাৎ দ্য সিটি অব সান বা সূর্য নগরী নামে।

রী এর পুরোহিতরা ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাধর, এমনকি চতুর্থ রাজবংশের রাজারাও তাদের সিংহাসনের সাথে সূর্যদেবতার নাম যুক্ত করতে পেরে গৌরবান্বিত মনে করত, যাতে করে খাফ্রে আর মেনকুরেকে একসাথে পাই।

চতুর্থ রাজবংশ দূর্বল হওয়ার সাথে সাথে সেটা যে কারণেই হোক না কেন- মেনকুরের মৃত্যুর পর রী এর পুরোহিতরা তাদের নিজেদের একজনকে সিংহাসনে বসিয়ে পঞ্চম রাজবংশের সূচনা ঘটায়। এই বংশটি টিকেছিল প্রায় দেড় শতাব্দী যাবৎ, আর তারপর আনুমানিক ২৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় ষষ্ঠ রাজবংশের।

পিরামিড নির্মাণের অবনতি ঘটতে থাকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ রাজবংশের আমলে। কোনো বিশাল দানবীয় মূর্তি নির্মাণ হয় নাই, তার জায়গায় তৈরি হয়েছিল ছোট ছোট মূর্তি। হয়তো মিশরীয়রা বিশালত্বে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছিল, যার মধ্যে কোনো নূতনত্ব খুঁজে পাওয়া যেত না। এতে শুধু জাতীয় শ্রমেরই অপচয় ঘটছিল, ইতিমধ্যেই মিশরে যার অভাব দেখা দিয়েছিল।

মিশরে শিল্পের উৎকর্ষ সাধন হচ্ছিল, আর সামরিক শক্তির দিক দিয়েও মিশর এগিয়ে যাচ্ছিল। মিশর সামরিক শক্তিতে চরমোল্কর্ষ লাভ করেছিল প্রথম পেপির শাসনামলে, যিনি ছিলেন ষষ্ঠ রাজবংশের তৃতীয় রাজা, আর যিনি ছিলেন মেমফিসের বাসিন্দা। পেপির আমলেই অন্য যে কোনো রাজার চাইতে সর্বাধিক স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছিল, আর সাক্কারাতে তার একটা ছোট পিরামিড ছিল।

তার ছিল এক জেনারেল যার নাম উনি, যার সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি তারই ছেড়ে যাওয়া একটা শিলালিপি থেকে (আমাদের বিশ্বাস এই শিলালিপিটাতে তেমন অতিরঞ্জন ছিল না)। একজন অখ্যাত দরবারী থেকে তিনি নিজেকে একজন জেনারেলের পদমর্যাদায় উন্নীত করতে পেরেছিলেন। তিনি পাঁচবার সীমান্ত আক্রমণকারী যাযাবরদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়েছিলেন, যার ফলে খনিজসমৃদ্ধ সিনাই উপদ্বীপে মিশরের অধিকার পাকাঁপোক্ত হতে পেরেছিল। এমনকি তার বাহিনী সিনাইয়ের উত্তরপূর্বে এশীয় ভূখণ্ডেও প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম জলপ্রপাতের দক্ষিণেও তিনি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

তবে হয়তো এসব দুঃসাহসিক সামরিক অভিযান আর সেই সাথে পিরামিড আর মন্দির নির্মাণ তৎকালীন মিশরীয় সম্পদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছিল আর মিশরীয় সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় অবক্ষয়ের সূচনা করেছিল। একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে রাজ্যের সীমা যতই প্রসারিত হতে থাকে, কাজকর্ম বৃদ্ধি পেতে থাকে, তত বেশি পরিমাণে রাজন্যদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করতে হয়, আর তখন স্বাভাবিকভাবেই কর্মচারী, জেনারেল আর প্রাদেশিক শাসকদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে, আর আনুপাতিক হারে রাজার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে।

এই সময়ে অভিজাত শ্রেণীর পৃথক মমিকরণ আর পারলৌকিক জীবন নিশ্চিতকরণের দাবি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিক থেকে দেখলে এটাকে হয়তো প্রগতিশীল মনে হতে পারে, কারণ এতে রাজার সাথে সমষ্টিগত পারলৌকিক জীবনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত মুক্তির দাবি উচ্চারিত হয়েছিল, যাতে প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত অর্জনের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এভাবে ধর্মের গণতান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে এর মধ্যে একটা নৈতিকতার প্রক্ষেপ দেয়া সম্ভব হয়েছিল।

অপরপক্ষে রাজন্যরা শক্তিধর হলে, তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদ করে, আর তার ফলে দেশের সর্বসাধারণের সমস্যাগুলি চাপা পড়ে যায়, যার পরিণাম ভোগ করে সর্বসাধারণ।

প্রথম পেপির একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্র পেপি দ্বিতীয় নাম ধারণ করে ২২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন, তবে সিংহাসনে আরোহণের সময় তিনি ছিলেন নিতান্তই নাবালক। একদিক দিয়ে বিচার করলে তার শাসনকাল ছিল ইতিহাসে অনন্য। এর স্থায়ীত্বকাল ছিল নব্বই বছর। এটাই ছিল ইতিহাসে রেকর্ডভুক্ত একক ব্যক্তির দীর্ঘতম শাসনকাল। এই দীর্ঘ শাসনকাল মিশরের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে এনেছিল।

প্রথমত, প্রায় প্রথম এক দশক, যেহেতু এত কমবয়সী একজন রাজা দেশ শাসনে অসমর্থ, তাই প্রয়োজন ছিল একজন শক্তিধর রাজন্যের বা একজন সক্ষম দরবারীর। এরূপ একজন ব্যক্তি রাজার সমান পরিপূর্ণ আস্থা ও সম্মান অর্জন করতে পারেনা। এমতাবস্থায় অবিরাম প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও দ্বন্দ্ব চলতে থাকে ক্ষমতা দখলের জন্য। একজন নাবালকের দীর্ঘদিন সিংহাসনে আসীন থাকার ফলে রাজার হাত থেকে ক্ষমতা রাজন্যদের হাতে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

দ্বিতীয় পেপির আমলে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। অভিজাত শ্রেণীর সমাধিগুলি রাজাদের সমাধির চাইতে আরও বেশি সৌকর্যময় হয়ে উঠছিল, আর যদিও মিশরীয় বাণিজ্যের বিস্তার ঘটছিল, এটা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় ধনিকশ্রেণীর হাতে।

যখন দ্বিতীয় পেপি সত্যিকারের রাজদণ্ড হাতে তুলে নিলেন, ততদিনে রাজন্যবর্গ এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, যে তাদের সামলানো কঠিন, আর রাজাকেই সন্ত্রস্ত হয়ে চলতে হয়, কারণ ততদিনে তিনি নিজেই জরাগ্রস্ত, দুর্বল, আর সেই দুর্বল মুষ্ঠিতে রাজ্যের রশি সামলে রাখা সম্ভব ছিলনা। সিংহাসনে যে ব্যক্তিটি বসে আছেন তিনি রাজার ছায়ামাত্র, মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

২১৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পেপির মৃত্যু হয়, আর তার মৃত্যুর দুই বছরের মধ্যেই মিশর খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। কোনো রাজাই কলহরত অভিজাত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বেশিদিন টিকতে পারেনি। ষষ্ঠ রাজবংশ এবং সেইসাথে প্রাচীন সাম্রাজ্যও ধসে পড়ল, মিশরের একত্রীকরণের সব সম্ভাবনাই লোপ পেল আর মিশর পরিণত হলো এক খণ্ড বিখণ্ড অরাজক ভূখণ্ডে।

ষষ্ঠ রাজবংশের শেষ সময়ের একটা প্যাপিরাস লিখন সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এর লেখক ইপুয়ার রাজ্যে অরাজকতা আর ঘৃণা বিদ্বেষের ফলে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয় তার জন্য প্রচুর বিলাপ করেন। তার বিলাপের মধ্যে হয়তো কাব্যিক অতিশয়োক্তি ছিল তবে একটা ক্ষয়িষ্ণু রাজ্যে প্রজাদের দুঃখকষ্টের একটা জীবন্ত চিত্র পাওয়া যায়।

ইপুয়ারের লেখায় মানব দুর্ভোগের কাহিনী* এতই জীবন্ত ছিল যে, ১৯৫০ সালে লেখা ইসরাইলী লেখক ইমানুয়েল ভেলিকভস্কি তার লেখা “ওয়ার্লর্ডস ইন কলিশন” বইতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে বাইবেলের এক্সোডাস পর্বে যে ভয়াবহ প্লেগের উল্লেখ আছে তা অবিকল ইপুয়ারের লেখার সাথে মিলে যায়।

 [*একটা অংশে তিনি বলেছেন… ‘চিরতরে মুছে গেছে মানুষের মুখের হাসি যা আর কোনোদিন ফিরে আসবেনা। বিষাদ ঘুরে বেড়াচ্ছে মূর্তিমান হয়ে, আর তার সাথে মিশে আছে বিলাপ… এখন যে ভূখও পেছনে পড়ে আছে তা ক্লান্ত, অবসন্ন… চারদিকে ফসলের ধ্বংসপ… গোলাঘর এখন শূন্য আর তার মালিক এখন ধরাশায়ী…’] তবে ব্যাপারটার মধ্যে যথেষ্ট অতিকথন রয়ে গেছে। ভেলিকভস্কির নৈসর্গিক দুর্যোগ বৈজ্ঞানিকভাবে অসিদ্ধ (আর ইপুয়ারের কাব্যিক অতিকথন মোটেই আক্ষরিক সত্য বলে মেনে নেয়া যায়না) যে সময়ের উল্লেখ রয়েছে সেটা বাইবেলে উল্লিখিত সময়ের চাইতে অন্তত হাজার বছর পূর্বের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *