০৩. প্রসারমান মহাবিশ্ব (The Expanding Universe)
কৃষ্ণপক্ষের নির্মল আকাশের দিকে তাকালে সবচাইতে উজ্জ্বল যে সমস্ত বস্তুপিণ্ড দেখা যায়, খুব সম্ভবত সেগুলো শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহ। তাছাড়া খুব বেশি সংখ্যক তারকাও থাকে। সেগুলো আমাদের সূর্যেরই মত তবে আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। আসলে এই স্থির তারকাগুলোর কিছু কিছুকে দেখা যায় পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরস্পর সাপেক্ষ অবস্থানের সামান্য পরিবর্তন করতে। তারা মোটেই স্থির নয়। এর কারণ তুলনায় তারা আমাদের কাছাকাছি। পৃথিবী সূর্য প্রদক্ষিণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঐ তারকাগুলোকে আমাদের বিভিন্ন অবস্থান থেকে দেখতে পাই। ঐগুলোকে দেখা যায় দূরের তারকাগুলোর পশ্চাদপটে। এটা ভাগ্যের কথা, কারণ, এর ফলে আমরা ঐ সমস্ত তারকা থেকে আমাদের দূরত্ব প্রত্যক্ষভাবে মাপতে সক্ষম। তারা যত নিকটবর্তী হয় তাদের চলাচলও তত বেশি দৃষ্টিগোচর হয়। নিকটতম তারকার নাম প্রক্সিমা সেন্টোরী (Proxima Centauri)। এর দূরত্ব প্রায় চার আলোকবর্ষ (ঐ তারকা থেকে আলোক পৃথিবীতে পৌঁছাতে সময় লাগে চার বছর) কিম্বা প্রায় ২৩ মিলিয়ন মিলিয়ান মাইল। খালি চোখে যে সমস্ত তারা দেখা যায় সেগুলোর বেশির ভাগেরই দূরত্ব আমাদের কাছ থেকে কয়েক’শ আলোকবর্ষের ভিতরে। তুলনায় আমাদের সূর্য আমাদের কাছ থেকে মাত্র আট আলোক মিনিট দূরে। দৃশ্যমান তারকাগুলো রাতের আকাশের সবটাই জুড়ে থাকে বলে মনে হয়। কিন্তু সেগুলো বিশেষ করে একটি বন্ধনীতে কেন্দ্রীভূত। আমরা তার নাম দিয়েছি ছায়াপথ (Milky Way)। বহু বছর আগে, অর্থাৎ ১৭৫০ সালে কিছু কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী মত প্রকাশ করেছিলেন : যদি অনুমান করে নেয়া যায় : দৃশ্যমান তারকাগুলোর অধিকাংশই একটি চাকতির মত বাহ্যিক গঠনের disklike configuration) অন্তর্ভুক্ত তাহলে ছায়াপথের দৃশ্যমান রূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এখনকার ভাষায় যাকে বলে : সর্পিল ছায়াপথ (spiral galaxy)। এটা তারই একটি দৃষ্টান্ত। মাত্র কয়েক দশক পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হারলেশ (Sir William Herschel) বিরাট সংখ্যক তারকার অবস্থান এবং দূরত্ব খুব পরিশ্রমের সঙ্গে তালিকাভুক্ত করে তার এই চিন্তাধারার সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন। তবুও এই ধারণা সম্পূর্ণভাবে মেনে নেয়া হয় শুধুমাত্র এই শতাব্দীর প্রথমে।
মহাবিশ্ব সম্পর্কিত আমাদের আধুনিক মানস চিত্রের (picture) শুরু ১৯২৪ সালে । তখন আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল (Edwin Hubble) দেখিয়েছিলেন আমাদের ছায়াপথই একমাত্র ছায়াপথ নয়। আসলে রয়েছে আরো বহু ছায়াপথ এবং তাদের মধ্যবর্তী বিরাট বিরাট শূন্যস্থান। এটা প্রমাণ করার জন্য তার প্রয়োজন ছিল এই ছায়াপথগুলোর দূরত্ব নির্ধারণ। সেগুলো এত দূরে অবস্থিত যে তাদের সত্যিই স্থির বলে মনে হয়। এ ব্যাপারে নিকটস্থ তারকাগুলোর সঙ্গে তাদের বৈসাদৃশ্য রয়েছে। হাবল : (Hubble) সেই কারণে দূরত্ব মাপার জন্য পরোক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একটি তারকার আপাতদৃষ্ট উজ্জ্বলতা দুটি কারণের উপরে নির্ভর করে। তকটা আলোক এর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে (তারকাটির জ্যোতি–its luminosity) এবং আমাদের কাছ থেকে তারকাটি কত দূরে অবস্থিত। নিকটস্থ তারকাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা হিসেব করে তাদের জ্যোতিও বার করতে পারি। আবার উল্টো দিক থেকে বলা যায় : অন্য ছায়াপথগুলোর জ্যোতি যদি আমাদের জানা থাকে তাহলে দৃশ্যমান ঔজ্জ্বল্য মেপে আমরা তাদের দূরত্ব হিসেব করতে পারি। হাবল (Hubble) দেখেছিলেন, কোন কোন ধরনের certain types) তারকার নৈকট্য যখন এমন যে সেটা মাপা সম্ভব, তখন দেখা যায় যে তাদের জ্যোতি সব সময় একই থাকে। তার যুক্তি : আমরা যদি অন্য ছায়াপথেও ঐ রকম তারকা দেখতে পাই তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি তাদের জ্যোতিও এক। সুতরাং সেই ছায়াপথের দূরত্ব গণনা করা সম্ভব। একই ছায়াপথে যদি আমরা অনেকগুলো তারকার ক্ষেত্রে এরকম করতে পারি এবং আমাদের গণনায় যদি আমরা অনেকগুলো তারকার ক্ষেত্রে এরকম করতে পারি এবং আমাদের গণনায় যদি সবসময় দূরত্ব একই হয়, তাহলে আমরা আমাদের অনুমানের সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট নিশ্চিত হতে পারি।
এডুইন হাবল (Edwin Hubble) নয়টি বিভিন্ন ছায়াপথের দূরত্ব এইভাবে নির্ণয় করেছিলেন। এখন আমরা জানি আধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্রে দৃশ্যমান প্রায় এক লক্ষ্য মিলিয়ান ছায়াপথের ভিতরে আমাদের ছায়াপথ একটি। প্রতিটি ছায়াপথে প্রায় এক লক্ষ মিলিয়ান তারকা থাকে। চিত্র : ৩.১ একটি সর্পিল ছায়াপথের। অন্য কোন ছায়াপথবাসী কেউ যদি আমাদের ছায়াপথ দেখেন, মনে হয় তাদের কাছে আমাদের ছায়াপথ ঐ রকমই দেখাবে। আমরা এমন একটি ছায়াপথে থাকি যেটা আড়াআড়ি মাপে (across) প্রায় এক লক্ষ আলোকবর্ষ হবে। আমাদের ছায়াপথটি ধীরগতিতে ঘূর্ণায়মান। এর সর্পিল বাহুগুলোতে অবস্থিত তারকাগুলো প্রায় কয়েকশ মিলিয়ন বছরে একবার করে কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে। আমাদের সূর্য একটি অতি সাধারণ হলুদ তারকা। এর আকার তারকাগুলোর গড় আকারের মতই। এর অবস্থান সর্পিল বাহুগুলোর একটির ভিতর দিককার কিনারায়। অ্যারিস্টটল এবং টোলেমীর সময় আমরা ভাবতাম পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র। নিশ্চয়ই আমরা সেই সময় থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।
তারকাগুলো আমাদের কাছ থেকে এত দূরে যে আমাদের কাছে সেগুলোকে এক একটি ক্ষুদ্র আলোক বিন্দুর মত দেখায়। আমাদের পক্ষে তাদের আকার এবং গঠন দেখা সম্ভব নয়। তা হলে আমরা বিভিন্ন ধরনের তারকাকে কি করে পৃথক করি? তারকাগুলোর বিরাট সংখ্যালঘু অংশের শুধু একটি মাত্র গঠনবৈশিষ্ট্য আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। সেটা হল : তাদের আলোকের রঙ। নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন সূর্যের আলোক যদি একটি কাঁচের প্রিজমের (ত্রিপার্শ্ব কাঁচ) ভিতর দিয়ে যায়, তা হলে আলোক তার উপাদানের বিভিন্ন রঙে ভেঙে যাবে। ঠিক যেমন হয় রামধনুতে (spectrum আলোকের বর্ণালী)। দূরবীক্ষণ (Telescope) যদি একটি তারকা কিম্বা ছায়াপথের দিকে নিশানা করা যায় তাহলে এ রকম ভাবেই একটা তারকা কিম্বা ছায়াপথের আলোকের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। বিভিন্ন তারকা বর্ণালী বিভিন্ন। কিন্তু একটি বস্তুপিণ্ড উত্তাপে লোহিত বর্ণ হয়ে যখন দীপ্ত হয়, তখন তা থেকে বিচ্ছুরিত আলোকে যে রকম আশা করা যায় বিভিন্ন রঙের আপেক্ষিক উজ্জ্বল্যও নির্ভুলভাবে সেই রকম (আসলে যে কোন অস্বচ্ছ বস্তু যখন উত্তপ্ত লোহিতবর্ণ হয়ে দীপ্তিমান হয়, তখন তার একটি বিশিষ্ট বর্ণালী থাকে। সে বর্ণালী শুধুমাত্র তার তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ তাপ-বর্ণালী। এর অর্থ একটি তারকার আলোকের বর্ণালী দেখে আমরা তার তাপমাত্রা বলতে পারি)। তাছাড়া আমরা দেখতে পাই কয়েকটি অত্যন্ত বিশিষ্ট রঙ তারকাগুলোর বর্ণালীতে অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিত রঙগুলো এক একটা তারকায় এক এক রকম হতে পারে। আমরা জানি প্রতিটি মৌলিক রাসায়নিক পদার্থ কয়েকটি অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রঙের কেতা (set) বিশোষণ করে। তারকার বর্ণালীতে যে রঙগুলো অনুপস্থিত, তার সঙ্গে এই রঙগুলো মেলালে আমরা তারকার পরিমণ্ডলে কি কি মৌলিক উপাদান রয়েছে, তা নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে পারি।
১৯২০ সালে যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অন্য ছায়াপথের তারকাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন, তখন তারা অতি অদ্ভুত একটা জিনিস দেখতে পান। আমাদের নিজেদের ছায়াপথের তারকাগুলোর ক্ষেত্রে যে রঙের কেতা (set) অনুপস্থিত, অন্য ছায়াপথের ক্ষেত্রেও সেই বিশিষ্ট রঙের কেতা অনুপস্থিত। কিন্তু তাদের সবকটি ক্ষেত্রেই রঙগুলো বর্ণালীর লোহিত প্রান্তের দিকে বিচ্যুত এবং সেই বিচ্যুতির পরিমাণ একই। এই তথ্যের ফলশ্রুতি বুঝতে হলে আমাদের প্রথম বুঝতে হবে ডপলার অভিক্রিয়া (Doppler effect)। আমরা দেখেছি দৃশ্যমান আলোক, বিদ্যুৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্থিরতা (fluctuation) বা তরঙ্গ। আলোকের স্পন্দাঙ্ক (frequency অর্থাৎ সেকেন্ড প্রতি তরঙ্গের সংখ্যা খুব বেশি সেকেন্ডে চার থেকে সাত লক্ষ মিলিয়ান মিলিয়ান । মানুষের চোখে যা বিভিন্ন বর্ণ বলে প্রতিভাত হয় সেগুলো হল আলোকের বিভিন্ন স্পন্দাঙ্ক (frequency)। সর্বনিম্ন স্পন্দাঙ্ক দেখা যায় বর্ণালীর লালের দিকে এবং সর্বোচ্চ স্পন্দাঙ্ক থাকে নীলের দিকে। এবার কল্পনা করা যাক আমাদের কাছ থেকে স্থির দূরত্বে অবস্থিত তারকার মত একটি আলোকের উৎস এবং কল্পনা করা যাক সেখান থেকে একটি স্থির স্পন্দাঙ্ক বিশিষ্ট আলোক উৎসারিত হচ্ছে। স্পষ্টতই যে তরঙ্গ আমরা পাই তার স্পন্দাঙ্ক এবং সেই তরঙ্গগুলো যখন উৎসারিত হচ্ছে, সেগুলোর তখনকার স্পন্দাঙ্ক- এই দুটি হবে অভিন্ন (ছায়াপথের মহাকর্ষীর ক্ষেত্র উল্লেখযোগ্য ক্রিয়া হওয়ার মত শক্তিশালী হবে না)। অনুমান করা যাক, উৎসটি আমাদের অভিমুখে চলতে শুরু করেছে। উৎসটি যখন পরবর্তী তরঙ্গশীর্ষ পাঠাবে, তখন সেটি হবে আমাদের নিকটতর। সুতরাং তরঙ্গশীর্ষের আমাদের কাছে পৌঁছাতে যে পরিমাণ সময় লাগবে, সেটা উৎস যখন স্থির ছিল, তখন যে সময় লাগত তার চাইতে কম। অর্থাৎ দুটি তরঙ্গশীর্ষের মধ্যবর্তী সময় হবে স্বল্পতর। সুতরাং প্রতি সেকেন্ডে আমাদের কাছে যে তরঙ্গ পৌঁছাবে (অর্থাৎ স্পন্দাঙ্ক) তার সংখ্যাটাও তারকার স্থির অবস্থার তুলনায় বেশি হবে। অনুরূপভাবে উৎস যদি আমাদের কাছ থেকে দূরে অপসৃয়মান হয়, তাহলে আমাদের কাছে যে তরঙ্গগুলো পৌঁছাচ্ছে তার স্পন্দাঙ্ক থেকে নির্গত আলোক বর্ণালীর লাল প্রান্ত অভিমুখে বিচ্যুত হবে (লাল বিচ্যুতি) এবং আমাদের অভিমুখে যারা চলমান তাদের বর্ণালীতে থাকবে নীল অভিমুখে বিচ্যুতি। স্পন্দাঙ্ক এবং দ্রুতির ভিতরে এই সম্পর্ককে বলা হয় ডপলার অভিক্রিয়া (Doppler effect)। তবে এ অভিক্রিয়া কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অংশ। রাস্তা দিয়ে চলমান একটি গাড়ির শব্দ শুনুন : গাড়িটা যখন কাছে এগিয়ে আসে তখন তার ইঞ্জিনের শব্দের তীক্ষ্ণতা তীব্রতর হয় (শব্দ উচ্চতর স্পন্দাঙ্কের অনুরূপ) এবং গাড়িটি যখন কাছে এসে দূরে অপসরণ করে তখন তার শব্দের তীক্ষ্ণতা নিম্নতর হয়। বেতার তরঙ্গ কিম্বা আলোক তরঙ্গেরও আচরণ এক রকম। আসলে পুলিশ গাড়ির দ্রুতি মাপার জন্য ডপলার অভিক্রিয়া ব্যবহার করে। পদ্ধতিটা হল গাড়ি থেকে প্রতিফলিত বেতার তরঙ্গের ঘাতের (pulse) স্পন্দাঙ্ক মাপা।
অন্যান্য ছায়াপথের অস্তিত্ব প্রমাণিত করার পরের বছরগুলোতে হাব (Hubble) তাঁর সময় ব্যয় করেছেন ছায়াপথগুলোর দূরত্বের তালিকা প্রস্তুত করে এবং তাদের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করে। সেই সময় অধিকাংশ লোকেরই আশা ছিল ছায়াপথগুলো বেশ এলোমেলোভাবে চলমান। সুতরাং আশা ছিল নীল বিচ্যুতি এবং লাল বিচ্যুতির সংখ্যা সমান সমান হবে। কিন্তু যখন তারা দেখলেন, অধিকাংশ ছায়াপথেই লাল বিচ্যুতির রয়েছে, অর্থাৎ সবগুলোই আমাদের কাছ থেকে দূরে অপসরণ করছে, তখন তারা রীতিমত বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু আরো বিস্মিত হওয়ার কারণ ছিল : ১৯২৯ সালে হাবলের প্রকাশিত আর একটি পর্যবেক্ষণ ফল। ছায়াপথগুলোর লাল বিচ্যুতির পরিমাণও এলোমেলো নয়। এই বিচ্যুতি আর আমাদের কাছ থেকে ছায়াপথের দূরত্ব সমানুপাতিক directly proportional) অর্থাৎ অন্য কথায় ছায়াপথটি যত দূরে, তার দূরাপসরণের গতিও তত বেশি। এর অর্থ হল, মহাবিশ্ব স্থিতাবস্থায় নেই। আগেকার দিনে সবাই ভাবত মহাবিশ্ব স্থিতাবস্থাতেই রয়েছে। কিন্তু মহাবিশ্ব আসলে প্রসারমান। ছায়াপথগুলোর অন্তর্বর্তী দূরত্ব সব সময়ই বেড়ে চলেছে।
মহাবিশ্ব প্রসারমান এই আবিষ্কার বিংশ শতাব্দীর বৃহত্তম বৌদ্ধিক বিপ্লবগুলোর অন্যতম। পশ্চাদৃষ্টি দিয়ে (আবিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর) আমরা অবাক হয়ে ভাবতে পারি এর আগে কেন কেউ এমনটা ভাবেনি। নিউটন এবং অন্যদের বোঝা উচিত ছিল, স্থির বিশ্ব অচিরে মহাকর্ষের প্রভাবে সঙ্কুচিত হতে শুরু করবে। কিন্তু তার বদলে অনুমান করা যায় মহাবিশ্ব প্রসারমান। এই প্রসারণ যদি যথেষ্ট শ্লথ গতিতে হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত মহাকর্ষীয় বল প্রসারণ বন্ধ করবে এবং তারপর শুরু হবে সঙ্কোচন। কিন্তু এ প্রসারণ যদি একটি বিশেষ ক্রান্তিক হারের (Critical rate) চাইতে বেশি হয় তা হলে মহাকর্ষীয় বল এমন শক্তিশালী হবে না যে প্রসারণ বন্ধ করতে পারে এবং মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারণশীলই থাকবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে একটি রকেট (হাউই) ছাড়লে যা হয় ব্যাপারটা অনেকটা সেই রকম হবে। রকেটের গতি যদি যথেষ্ট ধীর হয়, তা হলে মহাকর্ষ শেষ পর্যন্ত রকেটটাকে থামিয়ে দেবে এবং তারপর রকেটটি পড়তে থাকবে। অন্যদিকে রকেটের গতি যদি একটি ক্রান্তির দ্রুতির (critical speed) বেশি হয় (সেকেন্ডে প্রায় সাত মাইল) তাহলে মহাকর্ষীয় শক্তির তাকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা থাকবে না। সুতরাং রকেটটি অনন্তকাল ধরে পৃথিবী থেকে দূরে অপসরণ করবে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কিম্বা অষ্টাদশ শতাব্দীতে এমন কি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকেও মহাবিশ্বের এই আচরণ সম্পর্কে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত। অথচ স্থির মহাবিশ্ব সম্পর্কে বিশ্বাস এতই দৃঢ় ছিল যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকটা পর্যন্ত সে বিশ্বাস টিকে রইল। এমন কি ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন যখন ব্যাপক অপেক্ষবাদ গঠন করেন, তখনও পৃথিবীর স্থিরত্ব সম্পর্কে তিনি এত নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি এ স্থিরতৃ সম্ভব করার জন্য তার সমীকরণে একটি তথাকথিত সৃষ্টিতাত্ত্বিক ধ্রুবক cosmological constant) উপস্থাপন করেছিলেন। এ বলের অন্যান্য বলের মত কোন বিশেষ উৎস ছিল না। এ বল তৈরি ছিল স্থান-কালের গঠনের ভিতরেই। তিনি মনে করতেন, স্থান-কালের ভিতরে একটি অন্তর্নিহিত (inbuilt) প্রসারণ প্রবণতা রয়েছে এবং এ প্রবণতাকে মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থের মহাকর্ষীয় বল মিলে নাকচ করে নির্ভুল ভারসাম্য সৃষ্টি করে। এর ফলশ্রুতি সুস্থির বিশ্ব। মনে হয় শুধু একজনই ব্যাপক অপেক্ষবাদকে তার অভিহিত মূল্যে (face value) গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। আইনস্টাইন এবং অন্যান্য পদার্থবিদরা যখন ব্যাপক অপেক্ষবাদের অস্থিরবিশ্ব সম্পর্কীয় ভবিষ্যদ্বাণী এড়িয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজছিলেন, তখন রুশ পদার্থবিদ এবং গণিতবিদ আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান চেষ্টা করেছেন ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার।
ফ্রিডম্যান মহাবিশ্ব সম্পর্কে দুটি সহজ সরল অনুমান করেছিলেন : আমরা যেদিকেই। দৃষ্টিপাত করি না কেন মহাবিশ্বের রূপ একই রকম দেখায় এবং আমরা যদি মহাবিশ্বকে অন্য কোন স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। শুধুমাত্র এই দুটি অনুমান থেকেই ফ্রিডম্যান দেখিয়েছিলেন মহাবিশ্বকে স্থির মনে করা আমাদের উচিত নয়। আসলে এডুইন হাবলের আবিষ্কারের কয়েক বছর আগে ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান হাবলের যে আবিষ্কার সেটাই নির্ভুলভাবে বলেছিলেন। এটা ছিল ফ্রিডম্যানের ভবিষ্যদ্বাণী।
সমস্ত অভিমুখেই মহাবিশ্ব দেখতে এক রকম এ অনুমান বাস্তবে স্পষ্টতই সত্য নয়। উদাহরণ : আমরা দেখেছি আমাদের নীহারিকার অন্যান্য তারাগুলো আকাশে একটি স্পষ্ট আলোক বন্ধনী (band of light) সৃষ্টি করে। এর নাম ছায়াপথ। কিন্তু আমরা যদি দূরের নীহারিকাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে মনে হবে তাদের তারকাগুলোর সংখ্যা প্রায় একই। মহাবিশ্বকে সব অভিমুখেই মোটামুটি এক রকম দেখায়। অবশ্য হআমরা যদি নীহারিকাগুলোর অন্তর্বর্তী দূরত্বের সঙ্গে তুলনীয় বিরাট মাত্রায় পর্যবেক্ষণ করি এবং স্বল্প মাত্রায় পর্যবেক্ষণে যে পার্থক্য দেখা যায় তাকে যদি অগ্রাহ্য করি তা হলেই এ তথ্য সত্য। অনেক দিন পর্যন্ত ফ্রিডম্যানের অনুমানের সপক্ষে এই যুক্তিই ছিল যথেষ্ট। এটা ছিল বাস্তব মহাবিশ্বের মোটামুটি একটা আসন্ন রূপ কিন্তু আরো আধুনিক কালে একটি আকস্মিক শুভ ঘটনায় ফ্রিডম্যানের অনুমান যে মহাবিশ্ব সম্পর্কীয় উল্লেখযোগ্য নির্ভুল বিবরণ– সেই তথ্য আবিষ্কৃত হল।
১৯৬৫ সালে আর্নো পেঞ্জিয়াস (Arno Penzias) এবং রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) নামে দুজন আমেরিকান পদার্থবিদ নিউ জার্সির বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরীতে দুটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর অণুতরঙ্গ (microwave) অভিজ্ঞাপন যন্ত্র (detector) পরীক্ষা করছিলেন (অণুতরঙ্গগুলো আলোক তরঙ্গেরই মত, তবে তাদের স্পন্দাঙ্ক সেকেন্ডে মাত্র দশ হাজার মিলিয়ান)। পেঞ্জিয়াস এবং উইলসন দেখলেন, তাঁদের যন্ত্রে যে পরিমাণ গোলমাল (শব্দ) ধরা পড়া উচিত তার চাইতে বেশি গোলমাল ধরা পড়ছে। ওঁরা চিন্তিত হলেন। গোলমাল (noise) কোনও বিশেষ অভিমুখ থেকে আসছিল বলে মনে হয়নি। প্রথমে তাঁরা তাঁদের গ্রাহকযন্ত্রে কিছু পাখির মল পেলেন। তখন তারা খুঁজতে লাগলেন যন্ত্রের বিকৃতির অন্য কোন সম্ভাব্য কারণ। পরে সে সম্ভাবনাও দেখা গেল না। তাঁরা জানতেন, গ্রাহকযন্ত্র যখন সোজাসুজি উপর অভিমুখী তার তুলনায় যখন সে রকম নয়, তখনই পরিমণ্ডলের যে কোন গোলযোগ বেশি শক্তিশালী হয়। তার কারণ আলোক রশ্মি যখন সোজাসুজি উপর দিক থেকে গৃহীত হয়, তখনকার তুলনায় যখন দিকচক্রবাল (horizon) থেকে গৃহীত হয় তখন তাকে পরিমণ্ডলের অনেক বেশি অংশ অতিক্রম করতে হয়। অভিজ্ঞাপক যন্ত্রের অভিমুখ যাই হোক না কেন, বাড়তি গোলযোগটা একই থাকে। সুতরাং এ গোলযোগ অবশ্যই পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে আগত। সারা বছর, দিনরাত এই গোলযোগ একই রকম। অথচ পৃথিবী তার অক্ষে ঘুরছে এবং সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এ থেকে বোঝা গিয়েছিল এই বিকিরণ আসছে সৌরমণ্ডলের বাইরে থেকে, এমন কি, নীহারিকারও বাইরে থেকে। তাছাড়া পৃথিবীর গতির সঙ্গে অভিজ্ঞাপক যন্ত্রের অভিমুখের পরিবর্তনের ফলে এই গোলযোগেরও পরিবর্তন হত। আসলে আমরা জানি এই বিকিরণ পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের অধিকাংশ অতিক্রম করে আমাদের কাছে এসে পৌঁছে। যেহেতু, সব অভিমুখেই এটা অভিন্ন সেইজন্য মহাবিশ্বও সবদিকে এক রকম। অবশ্য যদি শুধুমাত্র বৃহৎ মানে (large scale) বিচার করা হয়। এখন আমরা জানি, আমরা যে অভিমুখেই অনুসন্ধান করি না কেন, গোলযোগের পরিমাণের যে পরিবর্তন হয়, সেটা দশ হাজার ভাগের এক ভাগের বেশি নয়। সুতরাং পেঞ্জিয়াস এবং উইলসন ফ্রিডম্যানের প্রথম অনুমানের নির্ভুল সত্যতার একটা উল্লেখযোগ্য প্রমাণ আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ, এ আবিষ্কার করার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না।
প্রায় একই সময়ে নিকটবর্তী প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন পদার্থবিজ্ঞানী বব ডি (Bob Dicke) এবং জিম্ পিলস্ Jim Peebles) অণুতরঙ্গ নিয়ে কাজ করছিলেন। তারা জর্জ গ্যামোর (George Gamow) (জর্জ গ্যামো একসময় আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যানের (Alexander Friedmann) ছাত্র ছিলেন একটি প্রকল্প (suggestion) নিয়ে কাজ করছিলেন। প্রকল্পটি হল, মহাবিশ্বের আদিম অবস্থায় খুবই ঘন এবং উত্তপ্ত হওয়া উচিত, হওয়া উচিত তাপদীপ্ত এবং উত্তাপে সাদা। ডিক এবং পিবলসের যুক্তি ছিল আদিম মহাবিশ্বের দীপ্তি এখনও আমাদের দেখতে পাওয়া উচিত। তার কারণ, মহাবিশ্বের বহু দূরবর্তী অংশ থেকে আলোক আমাদের কাছে মাত্র বর্তমান কালেই এসে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু মহাবিশ্বের প্রসারের অর্থ, এই আলোকেরও এত বেশি লাল বিচ্যুতি হবে যে আমাদের কাছে সেগুলোকে দেখাবে অণুতরঙ্গ বিকিরণের মত। ডি এবং পিবুল বিকিরণ অনুসন্ধান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। পেঞ্জিয়াস্ এবং উইলসন তাদের গবেষণার সংবাদ পেয়ে বুঝতে পারলেন তারা নিজেরা এটা আগেই আবিষ্কার করেছেন। পেঞ্জিয়াস্ এবং উইলসন এজন্য ১৯৭৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান (মনে হয় ডি ও পিল এর জন্য দুঃখ পেয়েছিলেন, গ্যামোর কথা না হয় নাই বলা হল)।
আমরা যে অভিমুখে লক্ষ্য করি না কেন মহাবিশ্ব একই রকম দেখায় এ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রমাণগুলো প্রথমে দেখলে মনে হতে পারে মহাবিশ্বের যে অংশে আমরা বসবাস করি, তার নিশ্চয়ই একটা গুরুত্ব আছে। বিশেষ করে, সমস্ত নীহারিকাগুলোকে যদি আমাদের কাছ থেকে দূরে অপসরণ করছে বলে দেখতে পাই, তা হলে মনে হতে পারে, আমরা নিশ্চয়ই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থান করছি। এর কিন্তু একটা বিকল্প ব্যাখ্যাও রয়েছে। যে কোন নীহারিকা থেকে দেখলে প্রতিটি অভিমুখে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাতে পারে। আমরা দেখেছি এটা ছিল ফ্রিডম্যানের (Friedmann) দ্বিতীয় অনুমান। এই অনুমানের সপক্ষে কিম্বা বিপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমাদের নেই। শুধুমাত্র বিনয়ের জন্যই আমরা এ তত্ত্বে বিশ্বাস করি : আমাদের সব দিকেই যদি মহাবিশ্বকে একই রকম দেখায়, কিন্তু মহাবিশ্বের অন্য কোন জায়গা থেকে সে রকম না দেখায়, তা হলে ব্যাপারটা খুবই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হত। ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপ বলে, প্রতিটি নীহারিকাই প্রত্যক্ষভাবে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পরিস্থিতি অনেকটা একটা বেলুনের মত। বেলুনটার কয়েকটা বিন্দুতে রঙ লাগানো আছে এবং বেলুনটা অবিরাম ফোলানো হচ্ছে। বেলুনটা ফোলার সঙ্গে সঙ্গে যে কোন দুটি বিন্দুর অন্তর্বর্তী দূরত্ব বাড়ে, কিন্তু কোন বিন্দুকেই প্রসারণের কেন্দ্র বলা যায় না। তাছাড়া, বিন্দুগুলোর দূরত্ব যত বাড়বে, তারা তত তাড়াতাড়ি পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবে। একইভাবে ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপে দুটি নীহারিকার পরস্পর থেকে দূরাপসারণের দ্রুতি তাদের অন্তর্বর্তী দূরত্বের আনুপাতিক। সুতরাং এ থেকে ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়া গিয়েছিল : একটি নীহারিকার লাল বিচ্যুতি আমাদের কাছ থেকে তার দূরত্বের সঙ্গে সমানুপাতিক directly proportional) হাব যা আবিষ্কার করেছিলেন, এ তথ্য তার সঙ্গে নিখুঁতভাবে মেলে। এই প্রতিরূপ সাফল্যলাভ করছিল এবং তিনি হাবলের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন। কিন্তু তবুও মহাবিশ্বের সমরূপ প্রসারণ সম্পর্কে হাবলের আবিষ্কারে সাড়া দিয়ে আমেরিকান পদার্থবিদ হাওয়ার্ড রবার্টসন (Howard Robertson) এবং ব্রিটিশ গণিতবিদ আর্থার ওয়াকার (Arthur Walker) ১৯৩৫ সালে সদৃশ প্রতিরূপ আবিষ্কার না করা পর্যন্ত পাশ্চাত্য দেশে ফ্রিডম্যানের গবেষণা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অজানা ছিল।
ফ্রিডম্যান একটি প্রতিরূপই আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু আসলে তার দুটি মূলগত অনুমান মেনে চলার মত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রতিরূপ রয়েছে। প্রথমটিতে (এটা আবিষ্কার করেছিলেন ফ্রিডম্যান) মহাবিশ্ব যথেষ্ট ধীরভাবে প্রসারমান এবং বিভিন্ন নীহারিকার পরস্পরের প্রতি মহাকর্ষীয় আকর্ষণের দরুন প্রসারণ ধীরতর হবে এবং শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাবে। নীহারিকাগুলো তারপর পরস্পরের অভিমুখে যেতে থাকে এবং মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হয় চিত্র :৩.২ তে দেখা যাচ্ছে, সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী দুটি নীহারিকার অন্তর্বর্তী দূরত্বের কি রকম পরিবর্তন হয়। শুরু হয় শূন্যে (০), বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়, তারপর আবার শূন্যে যায়। দ্বিতীয় ধরনের সমাধানে মহাবিশ্ব এত দ্রুত প্রসারমান যে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ কখনোই এ প্রসারণ বন্ধ করতে পারে না, তবে একটু ধীরতর করতে পারে। চিত্র : ৩.৩ এ দেখা যাচ্ছে, এই প্রতিরূপ প্রতিবেশী নীহারিকাগুলো বিচ্ছিন্নতা (separation)। এটা শুরু হয় শূন্য থেকে এবং শেষ পর্যন্ত নীহারিকাগুলো পরস্পর থেকে স্থির দ্রুতিতে দূরাপসরণ করে। আর শেষে আছে তৃতীয় সমাধান। এই সমাধানে মহাবিশ্বের প্রসারণের গতি মধুমাত্র যাতে আবার চুপসে না যায়, সেই রকম। চিত্র : ৩.৪ এ দেখানো হয়েছে এই ক্ষেত্রেও প্রসারণ শুরু হয় শূন্যে এবং চিরকাল বাড়তে থাকে। কিন্তু নীহারিকাগুলোর পরস্পর থেকে দূরাপসরণের দ্রুতি ক্রমশই কমতে থাকে তবে কখনোই একেবারে শূন্যে পৌঁছায় না।
ফ্রিডম্যানের প্রথম ধরনের প্রতিরূপের একটা উল্লেখযোগ্য অবয়ব হল : মহাবিশ্ব স্থানে অসীম নয়, কিন্তু স্থানেরও কোন সীমারেখা (boundary) নেই। মহাকর্ষ এত শক্তিশালী যে স্থান নিজেই নিজের উপর গোল হয়ে বেঁকে যায় (is bent)। ফলে এটা হয় অনেকটা ভূপৃষ্ঠের মত। ভূপৃষ্ঠে বিশেষ অভিমুখে গমন করলে কেউই অলঙ্নীয় বাধার মুখোমুখী হয় না। কিম্বা কিনারা থেকে পড়ে যায় না, বরং শেষ পর্যন্ত যেখান থেকে রওনা হয়েছিল, সেখানেই ফিরে আসে। ফ্রিডম্যানের প্রথম প্রতিরূপে স্থান ঠিক এই রকম। তবে ভূপৃষ্ঠের দুটি মাত্রার বদলে স্থানের রয়েছে তিনটি মাত্রা। চতুর্থ মাত্রা কালও বিস্তৃতির দিক থেকে সীমিত। কিন্তু এটা দুটি প্রান্ত বা সীমানা সমন্বিত রেখার মত– আদি এবং অন্ত। পরে আমরা দেখব ব্যাপক অপেক্ষবাদের সঙ্গে কণাবাদী বলবিদ্যার (quantum mechanics) সমন্বয় করলে স্থান এবং কাল হতে পারে সসীম অথচ কোন কিনারা কিম্বা সীমানা বিহীন।
গোটা মহাবিশ্ব পরিভ্রমণ করে যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানেই ফিরে আসা সম্ভব। এই ধারণা ভাল বৈজ্ঞানিক কল্পকথার ভিত্তি হতে পারে, কিন্তু এর বিশেষ কোন ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই। তার কারণ দেখানো যেতে পারে ভ্রমণ শেষ হওয়ার আগেই মহাবিশ্ব চুপসে যাবে এবং তার আয়তন শূন্যে পৌঁছাবে। মহাবিশ্ব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু, সেখানে পৌঁছাতে হলে আলোকের চাইতে দ্রুতগতিতে চলতে হবে। সেটা অনুমোদনীয় নয়।
ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপের প্রথম ধরনটায় মহাবিশ্ব প্রসারিত হয় আবার চুপসে যায়, স্থান নিজের উপরেই বাঁকানো অনেকটা ভূপৃষ্ঠের মত। সুতরাং এ বিস্তার সীমিত। দ্বিতীয় প্রতিরূপে মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারণশীল। স্থান ঘোড়ার জিনের (saddle) মত অন্যদিকে বাঁকানো। সুতরাং এক্ষেত্রে স্থান অসীম। সবচাইতে শেষেরটা অর্থাৎ ফ্রিডম্যানের তৃতীয় প্রতিরূপে প্রসারণের হার শুধুমাত্র ক্রান্তিক critical)। সুতরাং স্থান সমতল (অতএব অসীমও বটে)।
কিন্তু ফ্রিডম্যানের কোন প্রতিরূপ আমাদের মহাবিশ্বের সঠিক বিবরণ? মহাবিশ্বের প্রসারণ কি বন্ধ হয়ে যাবে এবং আবার সঙ্কোচন শুরু হবে; নাকি চিরকাল প্রসারণ চলবে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের জানা দরকার মহাবিশ্বের প্রসারণের বর্তমান হার এবং তার বর্তমান গড় ঘনত্ব। ঘনত্ব যদি একটি বিশেষ ক্রান্তিক পরিমাণের চাইতে কম হয় (এটা স্থির করা হয় প্রসারণের হার থেকে), তাহলে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ প্রসারণ বন্ধ করার মত শক্তিশালী হবে না। ঘনতু যদি ক্রান্তিক পরিমাণের চাইতে বেশি হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কোন এক সময় প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং মহাবিশ্ব আবার চুপসে যাবে।
ডপলার অভিক্রিয়ার (Doppler effect) ভিত্তিতে আমাদের কাছ থেকে নীহারিকাগুলো কত দ্রুত দূরাপসরণ করছে সেই গতিবেগ নির্ধারণ করে আমরা মহাবিশ্বের প্রসারণের বর্তমান হার বার করতে পারি। এটা খুব নির্ভুলভাবেই করা যায়। নীহারিকাগুলোর দূরত্ব কিন্তু খুব ভালভাবে জানা নেই। তার কারণ আমরা শুধুমাত্র পরোক্ষভাবেই দূরত্ব মাপতে পারি। সুতরাং আমরা যেটুকু জানি, সেটা হল প্রতি হাজার মিলিয়ন বছরে মহাবিশ্ব শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ হারে প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব সম্পর্কে আমাদের অনিশ্চয়তা আরো বেশি। আমরা যদি আমাদের নীহারিকা এবং অন্যান্য নীহারিকার প্রসারণ বন্ধ করার পক্ষে যেটা প্রয়োজন তার এক শতাংশের চাইতেও কম– এমন কি, আমরা যদি প্রসারণের হারের সর্বনিম্ন অনুমান গ্রহণ করি তা হলেও। আমাদের নীহারিকা এবং অন্যান্য নীহারিকায় কিন্তু কিছু অন্ধকারময় পদার্থ নিশ্চয়ই আছে। সেগুলো আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পারি না। কিন্তু নীহারিকাগুলোর অন্যান্য তারকার কক্ষের উপর এগুলোর মহাকর্ষীয় আকর্ষণের প্রভাব থেকে আমরা জানতে পারি ঐগুলোর অস্তিত্ব নিশ্চয়ই আছে। তাছাড়া অধিকাংশ নীহারিকাকেই গুচ্ছবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। নীহারিকাগুলোর গতির উপর তাদের প্রভাব থেকে আমরা এই সমস্ত নীহারিকার অন্তর্বর্তীস্থানে আরো অন্ধকারময় পদার্থের অস্তিত্ব অনুমান করি। এই সমস্ত অন্ধকারময় পদার্থ যোগ দিলেও আমরা যা পাই সেটা প্রসারণ বন্ধ করার জন্য যা প্রয়োজন তার এক দশমাংশেরও কম। কিন্তু মহাবিশ্বের সর্বত্র প্রায় সমভাবে বন্টিত অন্য কোন পদার্থের অস্তিত্বের সম্ভাবনা আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। হয়ত আমরা এখনো সেটা ধরতে পারিনি। সে পদার্থ হয়ত গড় ঘনত্বকে বাড়িয়ে এমন জায়গায় নিয়ে আসতে পারে, যা প্রসারণ বন্ধ করার পক্ষে প্রয়োজনীয় ক্রান্তিক পরিমাণে পৌঁছাতে পারে। সেইজন্য আপাতত যা সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তা থেকে মনে হয়, মহাবিশ্ব চিরকালই প্রসারমান থাকবে। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে যা বলতে পারি, সেটা হল মহাবিশ্ব যদি চুপসে যায়, তা হলেও সেটা অন্ততপক্ষে আগামী দশ হাজার মিলিয়ান বছরের আগে হবে না। তার কারণ, অন্তত ১০ হাজার মিলিয়ন বছর ধরেই মহাবিশ্ব প্রসারমান রয়েছে। এ নিয়ে অনর্থক দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই আমাদের। কারণ, আমরা যদি সৌরজগতের বাইরে কোথাও উপনিবেশ স্থাপন করতে না পারি, তা হলে তার বহু আগেই আমাদের সূর্য নিভে যাবে এবং তার সঙ্গে মনুষ্য জাতির মৃত্যু হবে।
ফ্রিডম্যানের সবকটি সমাধানেরই একটি দিক হয়, কোন এক অতীতকালে (অতীতে ১০ থেকে ২০ হাজার মিলিয়ন বছরের ভিতরে) প্রতিবেশী নীহারিকাগুলোর অন্তর্বর্তী দূরত্ব নিশ্চয়ই ছিল শূন্য। সেই কালকে আমরা বলি বৃহৎ বিস্ফোরণ (big bang)। তখন মহাবিশ্বের ঘনত্ব এবং স্থান-কালের বক্রতা ছিল অসীম। আসলে গণিতশাস্ত্র অসীম সংখ্যা নিয়ে (infinite number) কাজ করতে অক্ষম। এর অর্থ হল, ব্যাপক অপেক্ষবাদের ভবিষ্যদ্বাণী (এটাই ফ্রিডম্যানের সমাধানের ভিত্তি) অনুসারে মহাবিশ্বের এমন একটা বিন্দু আছে যেখানে এই তত্ত্বটা ভেঙে পড়ে। যাকে গণিতবিদরা অনন্যতা (singularity) বলেন এ রকম একটি বিন্দু তারই এক উদাহরণ। আসলে আমাদের সমগ্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই স্থান-কাল মসৃণ এবং প্রায় সমতল (flat) এই অনুমানের ভিত্তিতে গঠিত। বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতায় স্থান-কালের বক্রতা অসীম। সুতরাং, সেখানে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো ভেঙ্গে পড়ে। এর অর্থ হল বৃহৎ বিস্ফোরণের আগে যদি কোন ঘটনা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তার কারণ, আমরা যদি শুধুমাত্র জানি বৃহৎ বিস্ফোরণের পরে কি ঘটেছিল (ব্যাপারটা আসলে এই রকমই) তা হলেও আমরা তার আগে কি ঘটেছিল তা নির্ধারণ করতে পারি না। আমাদের ক্ষেত্রে বৃহৎ বিস্ফোরণের আগের ঘটনার কোন ফলশ্রুতি থাকতে পারে না। সুতরাং মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক প্রতিরূপের কোন অংশ সে ঘটনাগুলো হতে পারে না। অতএব সেগুলোকে আমরা প্রতিরূপ থেকে হেঁটে ফেলব এবং আমরা বলব কালের একটা আরম্ভ ছিল।
কালের একটা আরম্ভ রয়েছে এই ধারণা অনেকেই পছন্দ করেন না। তার কারণ এতে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের গন্ধ রয়েছে (অন্যদিকে ক্যাথলিক চার্চ এই বৃহৎ বিস্ফোরণ প্রতিরূপ গ্রহণ করে ১৯৫১ সালে সরকারিভাবে ঘোষণা করেন এর সঙ্গে বাইবেলের সঙ্গতি রয়েছে)। সুতরাং বৃহৎ বিস্ফোরণ হয়েছিল এই সিদ্ধান্ত এড়ানোর জন্য অনেক প্রস্তাবই উপস্থিত করা হয়েছে। যে প্রস্তাবের সব চাইতে বেশি সমর্থন ছিল তার নাম বলা যেতে পারে স্থিরাবস্থাতত্ত্ব (steady stte theory)। ১৯৪৮ সালের এই প্রস্তাবনা ছিল নাজি অধিক্রত অষ্ট্রিয়া থেকে পলাতক হারম্যান বন্ডি (Herman Bondi) এবং টমাস গোল্ড (Thomas Gold) এই দুজন এবং ফ্রেড হয়েল (Fred Hoyle) নামে একজন ব্রিটিশের। ফ্রেড হয়েল যুদ্ধের সময় এঁদের সঙ্গে রাডার বিকাশের জন্য কাজ করেছেন। চিন্তনটা ছিল : নীহারিকাগুলো যেমন পরস্পর থেকে দূরে সরে যায় অন্তর্বর্তী শূন্যস্থানে তেমনি অবিচ্ছিন্নভাবে নতুন নতুন নীহারিকার জন্ম হয়। নতুন পদার্থ সব সময়ই অবিচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টি হচ্ছে এবং নীহারিকাগুলো তা থেকেই জন্ম নিচ্ছে। সুতরাং, সর্বকালে এবং স্থানে সর্ববিন্দু থেকে মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। অবিচ্ছিন্ন পদার্থ সৃষ্টি মেনে নিতে হলে স্থিরাবস্থাতত্ত্বের প্রয়োজন ছিল ব্যাপক অপেক্ষবাদের পরিবর্তন করা। কিন্তু সৃষ্টির যে হার এর সঙ্গে জড়িত সেটা এত অল্প (প্রতি ঘন কিলোমিটারে বছরে একটি কণা) যে তার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। আমরা যে অর্থে প্রথম অধ্যায়ে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে ভাল বলেছি সেই অর্থে এই তত্ত্বটি ভালই ছিল। অর্থাৎ তত্ত্বটি ছিল সরল এবং এমন সুনিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম যা পর্যবেক্ষণের সাহায্যে প্রমাণ করতে পারা যায়। একটি ভবিষ্যদ্বাণী ছিল : স্থানের একটি নির্দিষ্ট আয়তনের ভিতরে নীহারিকা কিম্বা তার সমতুল্য বস্তুপিণ্ডগুলোর সংখ্যা সবসময় একই থাকবে। মহাবিশ্বের যে কোন কালে এবং যে কোন স্থানে পর্যবেক্ষণ করলেও কোন পরিবর্তন হবে না। ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৬০ এর দশকের প্রথম দিকে বহির্বিশ্ব থেকে (outer space) আগত রেডিও তরঙ্গগুলোর একটা জরিপ হয় (survey)। কাজটা হয়েছিল কেম্ব্রিজে, করেছিলেন মার্টিন রাইলের (Martin Ryle) (ইনিও যুদ্ধের সময় বন্ডি, গোল্ড এবং হয়েলের সঙ্গে রাডার নিয়ে কাজ করেছেন) নেতৃত্বে একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী। কেম্ব্রিজ এর দলটি দেখিয়েছিলেন, এই সমস্ত রেডিও তরঙ্গের অধিকাংশেরই উৎস অবশ্যই আমাদের নীহারিকার বাইরে (আসলে তরঙ্গের অনেকগুলোই অন্য নীহারিকার সঙ্গে জড়িত বলে বোঝা গিয়েছিল) এবং শক্তিশালী উৎসের তুলনায় দুর্বল উৎসের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তাদের ব্যাখ্যা ছিল দুর্বল তরঙ্গগুলোর উৎস অনেক দূরে এবং সবল তরঙ্গগুলোর উৎস নিকটে। তখন মনে হয়েছিল স্থানের প্রতিটি ঘন একক প্রতি সাধারণ (common) উৎসের সংখ্যা দূরের উৎসগুলোর তুলনায় নিকটের উৎসগুলোতে কম। এ তথ্যের অর্থ এমনও হতে পারে যে আমরা মহাবিশ্বের একটা বিরাট অঞ্চলের (great? মহান) কেন্দ্রে অবস্থান করছি। সে অঞ্চলে তরঙ্গের উৎসগুলো অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় স্বল্প। এর বিকল্প অর্থ হতে পারে উৎসগুলোর সংখ্যা অতীত অর্থাৎ তরঙ্গগুলো যখন আমাদের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে তখন এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। দুটি ব্যাখ্যাই স্থিরাবস্থাতত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর বিরোধী। তাছাড়া, ১৯৬৫ সালে পেঞ্জিয়াস (Penzizs) এবং উইলসনের (Wilson) অণুতরঙ্গ বিকিরণ (microwave) আবিষ্কারের ফলে ইঙ্গিত পাওয়া যায় মহাবিশ্ব অতীতে অনেক বেশি ঘন ছিল। সুতরাং স্থিরাবস্থাতত্ব পরিত্যক্ত হল।
একটি বৃহৎ বিস্ফোরণ ঘটেছিল, সুতরাং কালের একটি আরম্ভ আছে এই সিদ্ধান্ত এড়ানোর আর একটি প্রচেষ্টা ছিল ১৯৬৩ সালে দু’জন রুশ বৈজ্ঞানিকের ইভজেনী লিশি (Evgenii Lifshitz) এবং আইজাক খালাতনিকভ (Issac Khalatnikov) এর। তাঁদের প্রস্তাবনা ছিল বৃহৎ বিস্ফোরণ শুধুমাত্র ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপেরই বিশেষত্ব হতে পারে। সেগুলো আসলে বাস্তব মহাবিশ্বের আসন্ন। (approximation) প্রতিরূপ মাত্র। হয়ত যে সমস্ত প্রতিরূপগুলো মোটামুটি বাস্তব মহাবিশ্বের অনুরূপ সেগুলোর ভিতরে বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতা রয়েছে শুধুমাত্র ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপে। সে প্রতিরূপে নীহারিকাগুলো প্রত্যক্ষভাবে পরস্পর থেকে দূরে অপসৃয়মান। সুতরাং অতীতের কোন কালে সেগুলো একই স্থানে অবস্থিত ছিল এ অনুমানে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব মহাবিশ্বে নীহারিকাগুলো শুধুমাত্র পরস্পর থেকে প্রত্যক্ষভাবে directly) দূরে অপসৃয়মান তাই নয়; তাদের সামান্য একটু পার্শ্ব অভিমুখী গতিবেগও রয়েছে। সুতরাং, বাস্তবে তাদের ঠিক একই স্থানে একই অবস্থায় থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না, প্রয়োজন ছিল শুধুমাত্র খুব কাছাকাছি থাকার। তাহলে হয়ত বর্তমান প্রসারমাণ মহাবিশ্ব একটি অনন্য বৃহৎ বিস্ফোরণের ফলশ্রুতি না হতে পারে, হাতে পারে পূর্বতন সঙ্কোচনের ফলশ্রুতি। মহাবিশ্ব যখন সঙ্কুচিত হয়ে চুপসে গেল (collapsed) তখন এর ভিতরকার কণিকাগুলোর সবগুলোর সংঘর্ষ হয়ত হয়নি, হয়ত সেগুলো পরস্পরকে ছাড়িয়ে দূরে অপসরণ করেছিল এবং সৃষ্টি হয়েছিল মহাবিশ্বের বর্তমান প্রসারণ। তাহলে আমরা কি করে বলতে পারি যে বাস্তব মহাবিশ্বের শুরু একটি বৃহৎ বিস্ফোরণ থেকে? লিফশিজ এবং খালাতনিকভ মোটামুটি ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপের মত মহাবিশ্বের একাধিক প্রতিরূপ নিয়েও চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তিনি বাস্তব মহাবিশ্বের নীহারিকাগুলোর অনিয়মিত এবং এলোমেলো (random) গতিরও বিচার করেছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছিল, নীহারিকাগুলো যদি আর পরস্পর থেকে প্রত্যক্ষভাবে দূরে অপসরণ নাও করে, তা হলেও ঐরকম প্রতিরূপ একটি বৃহৎ বিস্ফোরণ থেকে শুরু হতে পারে। কিন্তু তারা বলেছিলেন, এটার সম্ভাবনা থাকতে পারে শুধুমাত্র এমন কতকগুলো প্রতিরূপের ক্ষেত্রে, যেখানে নীহারিকাগুলো নির্ভুল সঠিক ভাবে চলমান। সে সব ক্ষেত্রকে ব্যতিক্রমই বলা উচিত। তাদের আরো যুক্তি ছিল বৃহৎ বিস্ফোরণ ছাড়াও ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপের মত অসংখ্য প্রতিরূপ হতে পারে। সুতরাং আমাদের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত আসলে কোন বৃহৎ বিস্ফোরণ হয়নি। পরে কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছিলেন ফ্রিডম্যানের মত প্রতিরূপের অনেক বেশি সাধারণ (general) শ্ৰেণী রয়েছে, যেগুলোর এই অনন্যতা থাকতে পারে এবং সে সব ক্ষেত্রে নীহারিকাগুলো একটু বিশেষভাবে চলমান হওয়ার আবশ্যকতা নেই। সুতরাং ১৯৭০ সালে তাঁরা তাঁদের দাবি প্রত্যাহার করে নেন।
লিফশিজ এবং খালাতনিকভের গবেষণা ছিল মূল্যবান, কারণ, এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে ব্যাপক অপেক্ষবাদ যদি নির্ভুল হয়, তা হলে মহাবিশ্বের একটা অনন্যতা থাকতে পারত, হতে পারত একটা বৃহৎ বিস্ফোরণ। কিন্তু এর ফলে একটি নির্ণায়ক সমস্যার সমাধান হয়নিঃ ব্যাপক অপেক্ষবাদের ভবিষ্যদ্বাণী কি এই যে আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে একটি বিস্ফোরণ থাকতে হবে অর্থাৎ থাকতে হবে একটি কালের প্রারম্ভ? এর উত্তর পাওয়া গিয়েছিল ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে। ব্রিটিশ গণিত এবং পদার্থবিদ রজার পেনরোজ (Roger Penrose) সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চিন্তন তখন উপস্থিত করেন। ব্যাপক অপেক্ষবাদের আলোক শঙ্কুর (cone) আচরণ এবং মহাকর্ষের সর্বকালের আকর্ষণের সমন্বয় করে তিনি দেখালেন, একটি তারকা নিজস্ব মহাকর্ষের ফলে চুপসে যাওয়ার সময় এমন একটি অঞ্চলে বন্দী হয় (trapped) যার পৃষ্ঠ (surface) সঙ্কুচিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত শূন্যে পরিণত হয়। সে অঞ্চলের পৃষ্ঠ সঙ্কুচিত হয়ে শূন্য পরিণত হয়, সুতরাং তার আয়তনও অবশ্যই শূন্যে পরিণত হবে। তারকার ভিতরের সমস্ত পদার্থ সঙ্কুচিত হয়ে শূন্যে আয়তন বিশিষ্ট অঞ্চলে অবস্থান করবে। সুতরাং পদার্থের ঘনত্ব এবং স্থান কালের বক্রতাও হবে অসীম। অন্য কথায় কৃষ্ণগহ্বর নামে পরিচিত স্থান-কালের একটি অঞ্চলের একটি অনন্যতা থাকবে।
প্রথম দৃষ্টিতে পেনরোজের গবেষণার ফল শুধুমাত্র তারকাগুলোর ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়েছিল। অতীতে সমগ্র মহাবিশ্বের একটি বৃহৎ বিস্ফোরণরূপ অনন্যতা ছিল কিনা এই প্রশ্নের সঙ্গে তার কোন সম্বন্ধ ছিল না। কিন্তু পেনরোজ (Penrose) যখন তাঁর এ উপপাদ্য উপস্থিত করলেন আমি তখন গবেষণারত ছাত্র। আমি হন্যে হয়ে এমন একটা সমস্য খুঁজছি যেটা নিয়ে আমার পি. এইচ. ডি-র গবেষণাপত্র সম্পূর্ণ করা যেতে পারে। দুবছর আগে আমার রোগ নির্ণয় করা হয়েছিল। নির্ণীত হয়েছিল আমি ALS রোগে ভুগছি। রোগটি সাধারণত লু গেরিকের ব্যাধি (Lou Gehrig’s Disease) কিম্বা মোটর নিউরন ব্যাধি (Motor Neuron Disease) নামে পরিচিত। আমাকে বোঝানো হয়েছিল আমার আয়ু নাকি আর এক কিম্বা দুবছর। এই অবস্থায় আমার পি. এইচ. ডি. এর জন্য কাজ করার কোন অর্থ ছিল বলে মনে হয়নি। অতদিন আমার বাঁচার আশা ছিল না, অথচ দুবছন হয়ে গেল আমার অবস্থা এমন কিছু খারাপ হয়নি। আসলে ব্যাপারটা বরং আমার ক্ষেত্রে ভালই চলছিল। জেন ওয়াইন্ড Jne Wilde) নামে অত্যন্ত ভাল একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, কিন্তু বিয়ে করতে হলে আমার একটা চাকরির দরকার এবং চাকরি পেতে হলে দরকার ছিল পি. এইচ. ডি. ।
১৯৬৫ সালে আমি পেনরোজের উপপাদ্য সম্পর্কে পড়ি। উপপাদ্যটি হল, যে কোন বস্তুপিণ্ডের মহাকর্ষের ফলে সঙ্কুচিত হয় চুপসে যেতে হলে শেষ পর্যন্ত তার একটি অনন্যতা (singularity) গঠন করতে হবে। আমি শীঘ্র বুঝতে পারলাম পেনরোজের উপপাদ্যের সময়ের অভিমুখ যদি উল্টে দেয়া যায়, অর্থাৎ চুপসে যাওয়াটা যদি সম্প্রসারণ হয়ে যায়, তাহলেও উপপাদ্যের শর্তগুলো রক্ষিত হবে। অবশ্য আধুনিক কালের মহাবিশ্বের প্রতিরূপ বৃহত্মানে বিচার করলে যদি মোটামুটি ফ্রিডম্যানের প্রতিরূপের মত হয়। পেনরোজের উপপাদ্য দেখিয়েছে, যে কোন সঙ্কোচনশীল তারকা একটি অনন্যতম (singularity) শেষ হবে। কাল বৈপরীত্যভিত্তিক যুক্তিতে দেখা গেল ফ্রিডম্যান তত্ত্বের অনুরূপ যে কোন সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বকে একটা অনন্যতা দিয়ে শুরু করতেই হবে। ব্যবহারিক (technical) কারণে পেনরোজের উপপাদ্যের প্রয়োজন ছিল স্থানে অসীম হওয়া। আসলে শুধুমাত্র প্রসারণ যদি এত দ্রুত হয় যে সঙ্কোচন অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলেই মহাবিশ্বের একটা অনন্যতা থাকতে পারে– এই তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্যই আমি পেনরোজের তথ্য ব্যবহার করেছিলাম (কারণ, শুধুমাত্র ফ্রিডম্যানের ঐ প্রতিরূপগুলো স্থানে অসীম ছিল)।
পরবর্তী কয়েক বছরে আমি কতকগুলো নতুন গাণিতিক ব্যবহারিক পদ্ধতি (tech nique) উদ্ভাবন করি। উদ্দেশ্য ছিল, যে সমস্ত উপপাদ্যে প্রমাণ করা হয়েছে অনন্যতা হতেই হবে, তা থেকে এটা এবং অন্যান্য ব্যবহারিক শর্ত দূর করা। চূড়ান্ত গবেষণার ফল ছিল ১৯৭০ সালে আমার এবং পেনরোজের একটি যুক্ত গবেষণাপত্র। সে পত্রে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়, ব্যাপক অপেক্ষবাদ যদি নির্ভুল হয় এবং মহাবিশ্বে যে পরিমাণ পদার্থ আমরা পর্যবেক্ষণ করি, তার অস্তিত্ব যদি সত্য হয়, তা হলে একটা বৃহৎ বিস্ফোরণ অবশ্যই হয়েছিল। আমাদের গবেষণার বিরোধী ছিল অনেক। বিরোধিতা অংশত এসেছিল রুশদের কাছ থেকে। কারণ তাঁরা ছিলেন মার্ক্সীয় বৈজ্ঞানিক নিমিত্তবাদে (determinism) বিশ্বাসী। আর যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের ধারণা ছিল অনন্যতা (singularity) বিষয়ক সমগ্র ধারণাগুলোই আইনস্টাইনের তত্ত্বের বিরোধী এবং সে তত্ত্বের সৌন্দর্যহানি করে। কিন্তু কেউ তো আসলে গাণিতিক উপপাদ্যের বিরুদ্ধে তর্ক করতে পারে না। সুতরাং শেষ পর্যন্ত আমাদের গবেষণা সাধারণভাবে গৃহীত হয় এবং আজকাল প্রায় সবাই মেনে নিয়েছেন– মহাবিশ্বের শুরু একটি বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতা দিয়ে। ব্যাপারটা হয়ত পরিহাসের irony) মত শোনাবে– আমি নিজের মতটা পাল্টে ফেলে এখন অন্য পদার্থবিদদের বোঝাতে চাইছি যে মহাবিশ্বের শুরুতে আসলে কোন অনন্যতা ছিল না। আমরা পরে দেখব কণাবাদী অভিক্রিয়া (quantum effect) বিচার করলে অনন্যতা (singularity) মিলিয়ে যেতে পারে।
আমরা এই অধ্যায়ে দেখেছি মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি হাজার হাজার বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছিল, অর্ধ শতাব্দীর চাইতেও অল্প সময়ে সে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে। হাবল আবিষ্কার করলেন মহাবিশ্ব প্রসারমান এবং আমরা বুঝতে পারলাম, মহাবিশ্বের বিরাটত্বে আমাদের গ্রহটির স্থান নগণ্য। এই শুধু শুরু। পরীক্ষামূলক এবং তাত্ত্বিক সাক্ষ্য জমা হতে লাগল এবং ক্রমশই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হল যে, কোন এক কালে মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল। অবশেষে ১৯৭০ সালে, আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদের ভিত্তিতে আমি এবং পেনরোজ এ তত্ত্ব চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করেছি। এই প্রমাণ থেকে দেখা গেছে, ব্যাপক অপেক্ষবাদ একটি অসম্পূর্ণ তত্ত্ব। মহাবিশ্ব কি করে শুরু হল, এ তত্ত্ব তা বলতে পারে না। তার কারণ, এ তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে ব্যাপক অপেক্ষবাদ সমেত সমস্ত ভৌত তত্ত্ব মহাবিশ্বের প্রারম্ভের সময় ভেঙে পড়ে। ব্যাপক অপেক্ষবাদ কিন্তু দাবি করে সে নিজেও একটি আংশিক তত্ত্ব মাত্র। সুতরাং অনন্যতার উপপাদ্যগুলো (singulari ty theorem) আসলে প্রদর্শন করে যে, মহাবিশ্বের অতি আদি যুগে এমন একটি কাল অবশ্যই ছিল যখন মহাবিশ্ব ছিল এত ক্ষুদ্র যে সে সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় মহান আংশিক তত্ত্ব কণাবাদী বলবিদ্যার (quantum mechanics) ক্ষুদ্রমানের অভিক্রিয়াগুলো (small scale effect) কোন ক্রমেই অগ্রাহ্য করা যায় না। ১৯৭০ দশকের প্রথমে আমরা আমাদের অস্বাভাবিক বিরাট সম্পর্কীয় তত্ত্ব থেকে অস্বাভাবিক ক্ষুদ্র সম্পর্কীয় তত্ত্বের দিকে অভিমুখ ফেরাতে বাধ্য হই। এর উদ্দেশ্য মহাবিশ্বকে বোঝায়। দুটি আংশিক তত্ত্বকে সম্মিলিত করে একটি কণাবাদী মহাকর্ষ তত্ত্ব গঠন করার প্রচেষ্টার বিবরণ দেয়ার আগে আমরা কণাবাদী বলবিদ্যার বিবরণ দেব ।