০৩. প্রবাসী বাঙালি হলেও

প্রবাসী বাঙালি হলেও বাঙালি তো বটে। বাংলাদেশের ইতিহাস পুরোটা না জানলেও কিছু কিছু তো জানেন ক্যাপ্টেন রায়। কিছু পড়েছেন কিছু শুনেছেন। স্যার জন অ্যান্ডারসনের নাম তাঁর কাছে অজ্ঞাত নয়।

হাজার হোক এলাহাবাদের ছেলে। মেদিনীপুর, ঢাকা, কুমিল্লা থেকে অনেক দূর। তবুও যে বাংলা, পাঞ্জাব আর মহারাষ্ট্র ইংরেজ সাম্রাজ্যের বনিয়াদ ধরে টান দিয়েছিল সেই অগ্নিক্ষরা দিনগুলিতে এলাহাবাদ ছিল তাদের কেন্দ্রবিন্দু। মিলনক্ষেত্র। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর পুণ্য সঙ্গম এই এলাহাবাদ। ধর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষের প্রয়াগ তীর্থ। আধুনিক ভারততীর্থের পুণ্যভূমি। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম মর্মস্থল।

স্যার স্টেইনলি জ্যাকসনের নামটা ঠিক মনে না থাকলে অ্যান্ডারসন সাহেবের নাম বেশ মনে আছে। তিরিশের বাংলাদেশ-বিপ্লবের ভরা যৌবন! সেদিনের কাহিনিতে অ্যাভরসন সাহেবের বার বার উল্লেখ জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতীদের বার বার নজর পড়ছে এই ঘৃণা নায়কের দিকে।

রমজান অত শত জানে না, বুঝে না। তবে সে জানে, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে অ্যান্ডারসন সাহেবের মনের আগুন, অন্তরের জ্বালা।

অ্যান্ডারসন সাহেবের বড় গুস্‌সা ছিল। এই আপনাদের বাঙালিদের উনি বরদাস্ত করতে পারতেন না।

ক্যাপ্টেন রায় ছোট্ট প্রশ্ন করেন কেন?

রমজান আবার বলে, এখনকার মতো তখন হিন্দী বা উর্দু আখবার পাওয়া যেত না। আংরেজি পেপারই শুধু গভর্নমেন্ট হাউসে থাকত। তাছাড়া আমাদের পেপার পড়ার পারমিশান ভি ছিল না।

আচ্ছা? অবাক হন এ-ডি-সি।

অর কিয়া? রমজান একটু হাসে। আমি কি এমনি এমনি বলি জামানা বদলে গেছে? জামানা বহুত বদল গ্যায়া সাব!

খবরের কাগজ পড়তে পারত না রমজানের দল। তবুও খবর পৌঁছে যেত ওদের কাছে। পাষাণে গাঁথা পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে যেমন চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু জল বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনি করে গভর্নমেন্ট অফিসের সতর্ক দৃষ্টির অজ্ঞাতসারেই আসত মেদিনীপুর, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের খবর। খবর আসত পাঞ্জাব থেকে, মহারাষ্ট্র থেকে; এই কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসে। বসেই শোনা গিয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের সর্বনাশা কাহিনি। বড় বড় রাজকর্মচারীর ফিস ফিস করে আলোচনা করত পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার ও তার সহচর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হ্যারি ডায়ারের কীর্তি। অমর কীর্তি। বিশ্ববিশ্রুত কীর্তি।

সরি! সেদিন আমার কাছে সাড়ে বারোশ রাউন্ড গুলির একটাও অবশিষ্ট ছিল না। যদি থাকত, নিশ্চয়ই সদ্ব্যবহার করতাম।

জেনারেল ডায়ার দুঃখ করে আরো বলেছিলেন, গলিটা বড় সরু ছিল বলে মেসিনগান দুটো ভিতরে নেওয়া যায়নি। ও দুটো ভিতরে নিতে পারলে বড় খুশি হতাম!

এরাই হচ্ছে স্যার জন অ্যান্ডারসনের পথিকৃত। মনে মনে বোধহয় ইনিও স্বপ্ন দেখতেন বিলেতের কাগজে বীরপুরুষ জেনারেল ডায়ারের মতো তারও ছবি ছাপা হয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ কীর্তির মহানায়ক এই জেনারেলকে বিলেতের লোক কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পঁচিশ-ছাব্বিশ হাজার পাউন্ডের এক তহবিল পুরস্কার দিয়েছিল। অ্যান্ডারসন বোধহয় দেশবাসীর কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের তহবিল আশা করেছিলেন।

জানেন ক্যাপ্টেন সাহেব, লাটসাব একদম উন্মাদ হয়েছিলেন। তাছাড়া মেদিনীপুরে হরদম আংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে মেরে ফেলার জন্য কলকাতার আংরেজরাও বড় ক্ষেপে উঠেছিল।

এমন গুরুত্বপূর্ণ কাহিনি বলতে বলতেও বুড়ো রমজান ফিক করে একটু হাসে। বলে, একদিন ওই পিছনের বাগানে বেড়াবার সময় লাটসাব মেমসাবকে একটা গাছের ছায়া দেখিয়ে বললেন, হায়াটা ঠিক মেদিনীপুরের ম্যাপের মতো!

সব সময় ওই এক চিন্তা! মেদিনীপুর।

সাহেবের অফিস কামারায় সামনে ছিল ওই মেদিনীপুরের ম্যাপ আর পিছনে থাকত বাংলাদেশের ম্যাপ।

ইংরেজ অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এই স্যার জন অ্যান্ডারসনকে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশে। বোধহয় পঞ্চ নদীর পুণ্যতীর্থ জালিয়ানওয়ালাবাগের পুনরাবৃত্তি চেয়েছিলেন বাংলাদেশে। কর্ণফুলি, বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ভাগীরথীর বাংলাদেশে!

ডালহৌসীর গভর্নমেন্ট হাউসের এই নব নায়ক আগে ছিলেন ইমন ডি ভ্যালেরার আয়ারল্যান্ডে। সিন-ফিন মুভমেন্টের জন্য ইংরেজ শাসকদের অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হচ্ছিল। তাই তারা পাঠিয়েছিলেন স্যার জনকে।

জার্মানদের সহযোগিতায় স্বাধীনতাকামী আইরশিরা শুরু করেছিলেন সিন-ফিন আন্দোলন। এদের শায়েস্তা করার জন্য অ্যান্ডারসন সৃষ্টি করেছিলেন কুখ্যাত ব্ল্যাক এন্ড ট্যান ইংরেজ পুলিশ বাহিনী! ওদের অত্যাচারের কাহিনি শুনলে গা শিউরে উঠবে।

অ্যান্ডারসন সাহেব বাংলাদেশে এসে গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো করতে চেয়েছিলেন। বাঙালি দিয়ে বাঙালিকে শায়েস্তা করার জন্য জন্ম নিল ভিলেজ গার্ড!

দিন রাত্তির চব্বিশ ঘণ্টা ওই এক চিন্তায় মেতে থাকতেন অ্যান্ডারসন। মেদিনীপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম! নিজেদের মেয়েদের চাইতে প্রিয় ছিল আর্মি আর পুলিশ অফিসাররা। ওরাই ছিল স্যার জনের প্রিয় সহচর। বন্ধু, আত্মীয়, পরমাত্মীয়!

এখনকার মতো তখন এই গভর্নমেন্ট হাউসের শুধু নর্থ গেটেই পুলিশ প্রহরী থাকত না। নর্থ, সাউথ, ইস্ট, ওয়েস্ট-সব গেটেই থাকত পুলিশ। সশস্ত পুলিশ। আরো পার্থক্য ছিল। এখন হিজ একসেলেন্সির দ্বাররক্ষক হচ্ছেন একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও জনা কয়েক কনস্টেবল। হিজ একসেলেন্টসি ইজ্জত বাঁচাবার জন্য মাঝে দেখা যাবে একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সার্জেন্টকে। দিল্লী থেকে লাটসাহেবের বস গেলে অবশ্য অর্থহীন ঝাণ্ডা হাতে নেওয়া ঘোড়সওয়ার পুলিশ দেখা যায়।

আর তখনকার দিনে? স্যার জন অ্যান্ডারসনের আমলে? চার ফটকে পুলিশ। ডজন ডজন পুলিশ। বেছে নেওয়া হিংস্র প্রকৃতির কিছু কনস্টেবল, দেশি সব ইন্সপেক্টর, অ্যাংলো অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। এ ছাড়া থাকত আর্মড পুলিশ। চারপাশে ঘোরাঘুরি করত গোয়েন্দা।

এখন তো রাজভবনের চারপাশের ফুটপাতে হকার বসে, দেওয়ালে পসার সাজায়। ছআনায় গেঞ্জি, আট আনার তিনটি রুমাল, সস্তায় বেনারসী পেয়ারা ও ভাগ্যগণনা করাবার জন্য আশে পাশের অফিসের বাবুরা তো এখন রাজভবনের ফুটপাতেই আসেন। শুধু বাবুরা কেন? লুকিয়ে চুরিয়ে হয়তো লাটসাহেবের বৌ বা বৌমাও আসেন।

বাংলার তখৎ-এ-তাউসে যখন এই কুখ্যাত অ্যান্ডারসন আসীন, তখন ইন্ডিয়ান মাছি-মশা  পর্যন্ত গভর্নমেন্ট হাউসের চৌহদ্দিতে আসতে পারত না।

লেড়কি দুজন প্রথম প্রথম লাটসাহেবের কোনো পার্সোনাল আংরেজ অফিসারকে নিয়ে বাইরে যেতেন। এক, দো, ঘণ্টার জন্য। কিন্তু ওতে কি ওরা খুশি হয়?

কথাটা বলে রমজান একটু অর্থপূর্ণ হাসি হাসে।

গভর্নমেন্ট হাউসে নিত্য যেসব স্থানীয় ইংরেজরা আসা-যাওয়া করতেন, তাদের সঙ্গে মেয়ে দুটির খাতির শুরু হল।

সন্ধের আগে দুটি উন্মনা পাখি ঘরে ফিরে আসত সত্য কিন্তু প্রতীক্ষা করত ককটেল বা ডিনারের গেস্টদের জন্য।

হুইস্কির গেলাসটা চট পট ডান থেকে বাঁ হাতে নিয়ে মিঃ জেফারসন মাথাটা একটু নীচু করে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন, ভেরি গ্ল্যাড টু মিট ইউ, মিস অ্যান্ডারসন। মিস অ্যান্ডারসন খুশি হয়ে একটু যেন হাসেন। ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে হ্যাঁন্ডসেক করেন, গ্ল্যাড টু মিট ইউ।

জেফারসন বড় খুশি হন। মিস অ্যান্ডারসনের হাতে গেলাস না দেখে উৎকণ্ঠিত হন; হোয়াট অ্যাবাউট ইওর ড্রিংকস?

কিছু চিন্তা করবেন না, আমি নেব এখন।

তাই কি হয়?

জেফারসন আর কথা না বলে থ্রোন রুমের ওই বিরাট পার্টির মধ্যে হারিয়ে যান! আবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুহাতে দুটি গেলাস নিয়ে হাজির হন অ্যান্ডারসনের সামনে।

দুটি গেলাস দেখে মিস অ্যান্ডারসনের বেশ মজা লাগে! কি ব্যাপার দুটি গেলাস?

স্যাম্পেন এন্ড ফ্রেঞ্চ ওয়াইন। জানি না আপনি কোনটা পছন্দ করবেন। তাই দুটোই…

লোকটা তো বেশ মজার। মিস অ্যান্ডারসন মুহূর্তের জন্য ভাবেন।

কিন্তু হুইস্কি আনলেন না যে?

জেনারেলি…

জেফারসন বলতে গিয়েও যেন দ্বিধা করেন।

জেনারেলি কি?

সুড আই সে?

মিস অ্যান্ডারসনের আরো মজা লাগে। কাম অন! আমার বাবা গভর্নর, আমি নই। আই অ্যাম জাস্ট এ ইয়ং গার্ল লাইক অল আদার ইংলিশ গার্লস।

এক্সকিউজ মী। তাহলে বলছি।

একশোবার বলুন। ইউ ক্যান সে এনিথিং ইউ লাইক।

পাশের টিপাই থেকে নিজের হুইস্কির গেলাসটা তুলে এক চুমুকে দেন। যেন দ্বিধা সঙ্কোচের জন্য গলা দিয়ে কথাটা বেরুচ্ছিল না, তা বোধ হয় পরিষ্কার হয়!

জেনারেলি সাধারণ মেয়েরা ওয়াইন খায় আর রোমান্টিক মেয়েরা স্যাম্পেন খায়। তাই…

মিস অ্যান্ডারসনের মুচকি হাসিটা আর লুকিয়ে থাকে না, প্রকাশ হয়ে পড়ে। সো হোয়াট?

আই ডোন্ট নো আপনি কি ধরনের মেয়ে। তাই দুটো গেলাসই…

পরিতৃপ্তির হাসিতে অ্যা ডারসন-নন্দিনীর সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

আই অ্যাম অ্যাফ্রেড ইভন আফটার দিস আমি আর ওয়াইন খেতে পারি না।

ওয়ান্ডারফুল!

মিঃ জেফারসন স্যাম্পেনের গেলাসটা তুলে দিলেন ওর হাতে।

দুজনের হাতের দুটি গ্লাস এগিয়ে এল কাছে; একেবারে নিবিড় হবার পর ক্ষণিকের জন্য স্পর্শ হল দুটি গেলাসে।

চিয়ার্স!

চিয়ার্স!

এই হল শুধু। একটি অধ্যায়ের শুরু। একটি কাহিনির শুরু।

রমজানের কি সব মনে আছে? বিশ পঁচিশ বছর আগেকার কথা কি মনে থাকে? মনে আছে জেফারসন সাহেবও নতুন বিলেত থেকে এসে একটা বড় বিলেতি কোম্পানির বড় অফিসার ছিলেন। তবে রমজান জানে না উনি শৈশব, কৈশোর কাটিয়েছেন এডিনবরায়, যৌবনে পড়াশুনা করেছেন কিংস কলেজে। কলেজ থেকে বেরুবার পর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে বা কলোনিয়াল সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা দেবার কথা ভেবেছিলেন, তাও রমজান জানে না। কি দরকার ওসব জানার।

ওই সাহেবের দপ্তর ছিল ডালহৌসি স্কোয়ারের ওই কোণায় আর থাকতেন বেঙ্গল ক্লাবে।

বুড়ো রমজান ঠিক বলছে তো? ক্যাপ্টেন রায় একটু জেরা করেন, ওই সাহেব কোথায় থাকতেন কোথায় চাকরি করতেন, তা তুমি জানলে কেমন করে?

রমজান এ-ডি-সি সাহেবের কথা শুনে হাসে। আরে সাব, আমি জানবো নাতো কে জানবে? আমাকে যে ডিউটি দিতে হতো। সকালে, সন্ধেয়, রাত্তিরে।

তার মানে?

প্রথম প্রথম লাটসাহেবের কোনো পার্সোন্যাল অফিসার সঙ্গে থাকলেও পরবর্তীকালে একজন বেয়ারা-চাপরাশীকে নিয়েই ওঁরা ঘোরাঘুরি করতেন। সাদা পোশাকে। তাছাড়া গভর্নমেন্ট হাউসের ক্লাউন মার্কা রোলস রয়েস বা ফোর্ড গাড়ি চড়ে নয়, সাধারণ ছোট গাড়ি চড়েই ওঁরা ঘুরতেন।

ক্যাপ্টেন রায় আবার প্রশ্ন করেন, কেন?

কেন আবার? তখনকার দিনকাল কি ছিল, তা জানা নেই? গভর্নমেন্ট হাউসের গাড়ি দেখলে কোথা থেকে কে বোমা মেরে দেবে, তার কি কোনো ঠিকানা ছিল? তাইতো খোদ মিলিটারি সেক্রেটারি পরামর্শ দিয়েছিলেন, তোমরা ঘোরাফেরা করতে চাও, কোনো আপত্তি নেই। বাট ইউ মাস্ট মুভ অ্যারাউন্ড লাইক কমোনার্স।

নিছক সাধারণ ইংলিশ গার্লের মতো ঘোরাঘুরি করলে বিপদ নেই বলেই সাধারণ গাড়ি আর সাদা পোশাকের চাপরাশী-বেয়ারার ব্যবস্থা হল।

ক্যাপ্টেনসাব, বিশওয়াশ করুন কভি কভি বেঙ্গল ক্লাব থেকে ঐহি হোকরী রাত দুতিন বাজে ফিরত।

এতক্ষণ…

আরে সাব, লাচ-গান, খানা-পিনা আউর কত কি চলত, কে জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *