৩. প্রতিযোগিতা
আপনি আমেরিকার যে কোনও লোক অথবা ইংল্যান্ডের যে কোনও ব্যবসায়ে লিপ্ত লোকের কাছে যদি জানতে চান, জীবনকে উপভোগ করার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক কী, তা হলে তিনি বলবেন : ‘জীবন সংগ্রাম’। তিনি অবশ্য আন্তরিকভাবেই সে কথা বলবেন। কারণ তিনি তা বিশ্বাস করেন। কথাটা একদিক দিয়ে যেমন সত্য, তেমনি অন্য অর্থে এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থেই তা মিথ্যা। জীবনসংগ্রাম এমন একটি জিনিস, যা ঘটবেই। আমরা যদি সৌভাগ্যবান না হই, তা হলে আমাদের সকলকেই জীবনসংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়। কনরাডের(১) কাহিনীর নায়ক ফকের কথা উদাহরণস্বরূপ ধরে নেওয়া যায়। ফক ছিল এক পরিত্যক্ত জাহাজে। নাবিকদের মধ্যে যে দুজনের আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, তাদের মধ্যে সে একজন। অন্য কয়েকজন নাবিকের শরীর ছাড়া তাদের জন্যে কোনও খাদ্যবস্তু ছিল না। দুজনে সেইসব শবদেহকে খাদ্যরূপে গ্রহণ করে যখন সব শেষ হয়ে গেল তখন শুরু হল প্রকৃত জীবনসংগ্রাম। দুই জনের মধ্যে জয়ী হয়েছিল ফক। কিন্তু তারপর থেকে সে নিরামিশাষী হয়ে গেল। কোনও ব্যবসায়ী যখন জীবনসংগ্রামের কথা বলেন তখন তিনি এই ধরণের জীবনসংগ্রামের কথ ভাবেন না। তার কাছে জীবনযুদ্ধ কথাটি ভুল অর্থে ব্যবহৃত। অত্যন্ত সাধারণ একটা ব্যাপারকে মহিমা দান করার জন্যে এটিকে তিনি নির্বাচিত করেছেন। তার স্বশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের কজন না খেয়ে মারা গেছেন, সে কথা জানতে চান তার কাছে। আরো জানতে চান তার বন্ধুরা, যারা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। পরে তাদের কী ঘটেছে, সকলেই জানে কোনও ব্যবসায়ী সর্বহারা হলেও তিনি আহারে-বসনে, যে লোকটি যথেষ্ট ধনী হয়ে সর্বহারা হওয়ার সুযোগ পাননি, তার চেয়ে অনেক সুখে থাকেন। এই শ্রেণীর লোকেরা জীবনসগ্রামের অর্থ বলে বোঝে জীবনে সাফল্য পাওয়ার সংগ্রামকে। যারা সগ্রামে রত, তাদের মনে এই যে ভয় নেই যে পরদিন সকালে তাদের প্রাতঃরাশ জুটবে না। তাদের ভয় হল প্রতিবেশীদের চেয়ে যদি কয়েক ধাপ ওপরে উঠতে না পারেন।
অবাক হতে হয় একথা ভেবে যে, তারা উপলব্ধি করতে পারছেন না যে এমন কোনও যন্ত্রে তারা ধরা পড়েননি যা থেকে তাদের অব্যাহতি নেই। মূল কথাটা হল, যে দৈনন্দিন একঘেয়ে, বাঁধাধরা ও ক্লান্তিকর কাজ তারা করছেন। সেটা ওপরে ওঠার সোপান নয়। আমি অবশ্য উচ্চ-স্তরের ব্যবসায়ীদের কথা ভাবছি। তারা এর মধ্যেই প্রচুর উপার্জন করেছেন এবং তারা যদি চান তা দিয়েই সারা জীবন কাটাতে পারেন।
এইরকম জীবন কাটানো তাদের কাছে গ্লানিকর মনে হয়। যেন তারা শত্রুর ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যদি তাদের কাছে জানতে চান তাদের কাজ দিয়ে জনসাধারণের কোন্ উপকারটা করছেন, তা হলে তারা কর্মব্যস্ত জীবনের প্রচারমূলক অসার কিছু কথা তুলে ধরবেন। ঐ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কিছু তাদের কাছে নেই।
এই রকম একজন মানুষের জীবন বিবেচনা করুন, মনে করুন তার সুন্দর বাড়ি, সুন্দরী পত্নী এবং সুন্দর সব সন্তান রয়েছে। তিনি অন্য সবার ঘুম ভাঙার আগেই ওঠেন এবং তাড়াতাড়ি অফিসে বেরিয়ে পড়েন। সেখানে গিয়ে তাকে কুশলী কর্মকর্তার স্বরূপ প্রকাশ করতে হয়। তাকে চোয়াল দৃঢ় নিবদ্ধ করার কৌশল আয়ত্ত করতে হয়। অভ্যাস করতে হয় বাচনভঙ্গিতে দৃঢ়তা প্রকাশ এবং বাক সংযমের, যাতে অফিসভৃত্য ছাড়া আর, সবার কাছে তা প্রভাব বাড়াতে পারে। তিনি অফিসের চিঠির বিষয়ে নির্দেশ দেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে টেলিফোনে আলাপ করেন, বাজারের অবস্থা যাচাই করেন। তারপর এমন কোনও ব্যক্তির সাথে দুপুরের আহার সারেন, যার সাথে তিনি কোনও লাভজনক লেনদেন করছেন অথবা করবেন বলে আশা করেন। সারা অপরাহ্ন একই ধরণের কাজ চলে। তারপর তিনি বাড়ি ফেরেন। তখন তিনি ক্লান্ত, নৈশাহারের পূর্বে যথাযথ পোষাক পরে তিনি নৈশাহারে বসেন তারই মতো ক্লান্ত অন্য লোকদের সাথে। খাওয়ার সময়, যেসব মহিলা তখনো ক্লান্ত হওয়ার সুযোগ পাননি, তাদের সঙ্গ উপভোগ করছেন, এমন ভান করে যেতে হয়। এই হতভাগ্য লোকটি ঠিক কত ঘণ্টা পরে মুক্তি পান তা আগে বলা সম্ভব নয়। অবশেষে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এবং কয়েক ঘণ্টার জন্যে তার উত্তেজিত স্নায়ু বিশ্রাম পায়।
এই ব্যক্তির কর্মজীবনে রয়েছে একশত গজ দৌড়ের মনস্তত্ত্ব। কিন্তু যেহেতু এই দৌড়ের শেষ লক্ষ্য হচ্ছে কবরস্থান, সেহেতু একশত গজের পক্ষে যে নিবিষ্টতা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তিনি তার সন্তানদের সম্পর্কে কী জানেন? সপ্তাহের কাজের দিনগুলিতে তাকে থাকতে হয় অফিসে। আর রবিবারে তিনি থাকেন গলফ লিংকে। তিনি তার স্ত্রীর সম্পর্কে কতটুকু খবর রাখেন? সকালে যখন স্ত্রীকে ফেলে বেরিয়ে যান, তখনো স্ত্রীর ঘুম ভাঙে না। সারা সন্ধ্যা স্বামী-স্ত্রী দুজনে সামাজিকতা রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন, যা দুজনের অন্তরঙ্গ আলাপ-আলোচনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার সম্ভবত কোনও পুরুষবন্ধু নেই যিনি তার কাছে মূল্যবান। কিন্তু তার এমন অনেক বন্ধু আছে যাদের সাথে আনন্দলাভের অভিনয় করতে হয়। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হয় এই আনন্দ যদি তিনি সত্যিই অনুভব করতে পারতেন। তিনি বসন্তকালকে বা ফসল তোলার কালকে ততটুকুই জানেন, যতটা বাজারে লাভক্ষতির সাথে যুক্ত। মনে হয় তিনি অনেক বিদেশও ঘুরে দেখেছেন, কিন্তু চরম ক্লান্তির চোখে। বই তার কাছে তুচ্ছ, সঙ্গীত মূল্যহীন। এভাবে বছরের পর বছর কাটিয়ে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, তার মনোযোগ আরো একাগ্র হয়, ব্যবসার বাইরে জীবন হয় শুষ্ক এবং নিরানন্দময়। আমি এই জাতীয় প্রৌঢ় আমেরিকানদের স্ত্রীকন্যাদের সাথে ইউরোপে দেখেছি। স্পষ্টই বোঝা গেল এরা বেচারাকে বুঝিয়েছেন কিছু ছুটি উপভোগ করা উচিত এবং মেয়েদের পুরানো মহাদেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। মাতা-কন্যা আনন্দে তাকে ঘিরে দাঁড়ায় এবং যা কিছু তাদের কাছে দেখার মতো মনে হয় তাদের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। গৃহস্বামী চরম ক্লান্ত, বিরক্ত। শুধু ভাবতে থাকেন অফিসের লোকেরা এখন কী করছে অথবা বেসবল ক্রীড়াজগতে কী হচ্ছে। তার নারী-সঙ্গীরা অবশেষে তার সম্পর্কে হতাশ হন এবং মনে করে পুরুষরা এক একজন বস্তুবাদী বর্বর। একথা তাদের কখনো কী মনে হয় না যে লোভের কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। এ কথা অবশ্য সম্পূর্ণ সত্যি নয়, যেমন সতীদাহ প্রথা একজন ইউরোপীয়ানের দৃষ্টিতে যেমন, আসলে ঠিক তা নয়। হতে পারে দশটির ক্ষেত্রে নটি বিধবা স্বেচ্ছায় আত্মদান করেছে। কারণ তাকে তৈরী করা হয়েছে পুড়ে মরার গৌরব লাভের জন্যে। কারণ তাই ছিল ধর্মের বিধান। ব্যবসায়ীর গৌরব এবং ধর্ম দাবি করে আরো অধিক অর্থ উপার্জন। সুতরাং তিনি হিন্দু বিধবার মতো এই অত্যাচার আনন্দের সঙ্গে মেনে নেন। অমেরিকান ব্যবসায়ীকে আরো সুখী করতে হলে তার ধর্মকে পরিবর্তন করে নিতে হবে। যতদিন তিনি শুধু সফলতা নয়, অন্তর থেকে বিশ্বাস করবেন সাফল্যের পিছনে ধাবমান হওয়াই মানুষের কর্তব্য। যিনি তা করেন না তিনি হতভাগ্য। ততদিন তার জীবন এমন কেন্দ্রীভূত এবং চিন্তাময় থাকবে যাতে তিনি কোনওভাবেই সুখী হতে পারবেন না। অর্থ বিনিয়োগের একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রায় প্রত্যেক আমেরিকান তার অর্থের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে শতকরা ৮ ভাগ লভ্যাংশ চাইবেন, তবুও নিরাপদ বিনিয়োগ ৪ শতাংশ চাইবেন না। এর ফলে তাদের প্রায়ই অর্থনাশ হচ্ছে, সাথে সাথে অবিরাম মানসিক উদ্বেগ আর অশান্তি বেড়ে চলেছে। আমার নিজের কথা হচ্ছে আমি অর্থ থেকে যা চাই তা হচ্ছে নিরাপত্তার সাথে অবসর। কিন্তু একজন আধুনিক মানুষ যা চান তা হচ্ছে আরো বেশি অর্থ যা দিয়ে চমকপ্রদ সমারোহ প্রকাশ করা যায়। যাতে তিনি দীপ্তির আভায় সমশ্রেণীর ব্যক্তিকে অতিক্রম করতে পারেন। আমেরিকার সামাজিক মান অনির্দিষ্ট এবং সবসময় ওটা ওঠা-নামা করে। তার ফলে সব ধরনের উন্নাসিক প্রবৃত্তি সেখানে সামাজিক অবস্থান ভেদে একরকম স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে। ফলে তা বড় অস্থির। যদিও একমাত্র অর্থ দিয়েই শুধু মানুষ বড় হয়ে ওঠে না, তবু অর্থকে বাদ দিয়েও বড় হওয়া কঠিন। তার ওপর অর্থ সৃষ্টি করাই হল মস্তিষ্কের স্বীকৃত মাপ। যে ব্যক্তি অনেক অর্থ উপার্জন করেন তিনি চালাক, যিনি করতে পারেননি তিনি চালাক নন। কে আর নির্বোধ বলে পরিচিত হতে চান! সুতরাং বাজারের অবস্থা অনিশ্চিত হলে তার অবস্থা পরীক্ষার সময় তরুণদের অবস্থার মতো অস্থির হয়ে পড়ে।
ব্যবসায় বিনষ্ট হলে পরিণতি কী হতে পারে, ব্যবসায়ীর এই দুশ্চিন্তার ভিতর যথার্থ অথচ অযৌক্তিক ভয়ের একটা অংশ প্রায়ই অনুপ্রবেশ করে। একথা স্বীকার করে নেওয়া উচিত, আরনল্ড বেনেটের(১) ‘ক্লে-হ্যাংগার’ যতই ধনবান হন, তার মন সবসময় শংঙ্কিত ছিল যে, তিনি কারখানার ভিতর মারা যাবেন। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, যারা শৈশবে দারিদ্র্যে কষ্ট পেয়েছেন, তারা সবসময় ভয়ে। কাতর থাকেন যে, তাদের সন্তানরাও সেই দারিদ্র ভোগ করবেন। তারা ভাবতে থাকেন সেই দারিদ্র্য রুখে দিতে যত অর্থের সঞ্চয় গড়ে তোলা প্রয়োজন তা প্রায় অসম্ভব এই ভয় প্রথম প্রজন্মে অনিবার্য, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম, যারা কঠিন দারিদ্র্যের মুখোমুখি হননি তাদের কাছে এই ভয় সামান্য, বাস্তব সমস্যার শুধু একটা অংশবিশেষ।
সন্তোষের মূল উৎস প্রতিযোগিতামূলক সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। এর ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়াই হল বাস্তব সংকট। একথা আমি অস্বীকার করি না যে, সাফল্যের অনুভূতি জীবন উপভোগ সহজ করে দেয়। একজন চিত্রশিল্পীর কথা ধরা যাক, তিনি যদি প্রথম যৌবনে অখ্যাত থাকেন এবং পরে তার প্রতিভা যথার্থ স্বীকৃতি পায়, তিনি আরো সুখী হবেন। একথাও আমি অস্বীকার করি না যে অর্থ। কিছুদূর পর্যন্ত সুখকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেই দূরত্ব অতিক্রম করলে, সুখ আরো বেড়ে যাবে আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি সাফল্য সুখের একটা উপাদান মাত্র। অন্যান্য আর সব উপাদানকে ত্যাগ করে যদি সাফল্য পেতে হয়, তা হলে তাকে অনেক বেশি মূল্যে কেনা হয়।
ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জীবনে যে দর্শন প্রচলিত, তাই হল তাদের সকল দুঃখের আকর। ইউরোপে এখনো অন্যান্য কিছু গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মর্যাদা নষ্ট হয়নি। কিছু কিছু দেশে একটি অভিজাত গোষ্ঠী আছে। বুদ্ধিবৃত্তি সব দেশেই রয়েছে। দু একটি ছোট দেশ বাদ দিলে অন্যসব দেশে সেনা এবং নৌবহর খুব সম্মান পায়। এখন একথা সত্যি যে একজন ব্যক্তির বৃত্তি যাই হোক, তার সাফল্যের মধ্যেই প্রতিযোগিতার একটি উপাদান আছে। তথাপি একথাটা সত্যি যে, যে ধরনের বস্তু মর্যাদা পায়, তা শুধু সাফল্য নয়, তা হল তার উৎকর্ষতা। যাই হোক তা, তার ওপরই নির্ভর করে সাফল্য। একজন বিজ্ঞানীর অর্থ থাকতে পারে, নাও পারে, অর্থ রয়েছে বলে তিনি বেশি শ্রদ্ধেয়, না হলে ততটা শ্রদ্ধেয় নন। একথা কখনো সত্যি নয়। একজন নৌবহরের খ্যাত এডমিরাল বা জেনারেলকে দরিদ্র দেখলে কেউ অবাক হন না। প্রকৃতপক্ষে এসব ক্ষেত্রে দারিদ্র্য নিজেই এক প্রকার সম্মান বহন করে যেন। এইসব কারণে ইউরোপে শুধুমাত্র অর্থ-প্রতিযোগিতা কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমিত এবং মনে হয়, সে কারণে তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারকারী বা সম্মানিত নন। কিন্তু আমেরিকায় বিষয়টি অন্যরকম, সেখানে পরিসেবাসমূহ জাতীয় জীবনে খুব ছোট ভূমিকা পালন করে বলে তাদের কোনও প্রভাব দেখা যায় না। জ্ঞানসমৃদ্ধ বৃত্তি সম্পর্কে বলা যায় যে, বাইরের কোনও ব্যক্তি বলতে পারেন না, একজন ডাক্তার কিংবা একজন আইনজীবী তাদের নিজ নিজ পেশায় কতটা যোগ্য। তাদের যোগ্যতা বিচার হবে শুধু তাদের উপার্জন থেকে, এবং তাদের জীবনযাত্রার মান থেকে। অধ্যাপকেরা তো ব্যবসায়ীদের ভাড়া করা ভৃত্য। সেজন্যে তারা প্রাচীন দেশগুলিতে যে শ্রদ্ধা পান, আমেরিকাতে পান তার চেয়ে অনেক কম। এই কারণেই সেখানকার পেশাজীবীরা ব্যবসায়ীদের অনুকরণ করেন এবং ইউরোপের মতো তাদের আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই। সুতরাং ধনিক গোষ্ঠীদের মধ্যে আর্থিক সাফল্যের জন্যে যে অশালীন এবং নির্ভেজাল সংগ্রাম চলছে তা বন্ধ করতে পারার মতো কিছুই নেই।
প্রথম বয়স থেকেই আমেরিকান বালকেরা উপলব্ধি করে যে অর্থ-ই হল একমাত্র বস্তু যাকে গণ্য করা যায়। শিক্ষালাভে যথেষ্ট অর্থ উপার্জনের সুযোগ নেই তাই শিক্ষা নিয়ে তারা ভাবে না। শিক্ষার যে উদ্দেশ্য পরিকল্পিত হয়েছিল, তা হচ্ছে উপভোগের ক্ষমতাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিখিয়ে দেওয়া। উপভোগ বলতে আমি বোঝাতে চাই সেইসব সূক্ষ্ম বিষয়ের উপভোগ, যা অপরিশীলিত মানুষের অধিকারের সীমার বাইরে। অষ্টাদশ শতকে একজন ভদ্রলোকের একটি বিশেষ পরিচয় ছিল, তিনি সাহিত্য, চিত্রকলা এবং সঙ্গীতে বিশেষ আনন্দ পেয়ে থাকেন। আজকের দিনে আমরা তার রসবোধের সাথে একমত নাও হতে পারি। কিন্তু এর মধ্যে অন্ততপক্ষে কোনও অসাধুতা ছিল না। আজকের দিনে ধনীলোকের রসবোধ সম্পূর্ণ আলাদা হতে চলেছে। তিনি কখনো বই পড়েন না। যদি তিনি নিজের সুনাম বৃদ্ধির জন্যে চিত্রশালা স্থাপনের ব্যবস্থা করতে থাকেন, তবে তার জন্যে ছবি পছন্দ করার ভার ছেড়ে দেবেন চিত্রবিশেষজ্ঞদের ওপর। এ থেকে যে আনন্দ তিনি পাবেন, তা ছবির সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে নয়, অন্য ধনী ব্যক্তিদের এইসব ছবি সগ্রহ করতে দেননি সেই আনন্দে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও, যদি ইহুদী হন, তবে মমগ্রাহী হতে পারেন। ইহুদী না হলে তিনি যেমন অন্যান্য শিল্পে, তেমনি এখানেও বেরসিক হতে পারেন। এসবের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, অবসর নিয়ে কী করবেন, তিনি তা জানেন না। তিনি যতই ধনবান হতে থাকেন ততই তার পক্ষে আরো বেশি অর্থ উপার্জন করা সহজতর হয়। এবং অবশেষে দিনে পাঁচ মিনিটের অবসর পেলেও তা কীভাবে কাটাবেন তা তিনি জানেন না। বেচারা শেষ পর্যন্ত সাফল্যের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েন। সাফল্যই যতদিন জীবনের লক্ষ্য বলে স্বীকৃতি পাবে, ততদিন এরকমই হবে। সাফল্য অর্জনের পর তা নিয়ে কী করা যায় তা যতদিন লোকে না শিখবে, ততদিন তার জন্যে তাকে বিরক্তি আর ক্লান্তির বোঝা বহন করে যেতেই হবে।
মনের প্রতিযোগিতামূলক অভ্যাস ধীরে ধীরে নিজের সীমা ছাড়িয়ে অন্যদিকে প্রসারিত হয়। একটা বই পড়ার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। এক বইটার পাঠ উপভোগ, আর সেই পড়ার কথা অন্যদের বলা। আমেরিকায় মেয়েদের অভ্যাস হচ্ছে প্রত্যেক মাসে কোনও কোনও বই পড়া অথবা পড়ার ছলনা করা। কেউ কেউ সম্পূর্ণ বইটা শেষ করে, কেউ মাত্র প্রথম অধ্যায়টি পড়ে, কেউ শুধু বইটির সমালোচনা পড়ে। কিন্তু সবার টেবিলেই এসব দেখা যায়। তারা কিন্তু প্রথম শ্ৰেণীর সাহিত্যপুস্তক পড়ে না। পাঠাগারগুলি কখনো পড়বার জন্যে ‘হ্যামলেট’ অথবা ‘কিং লিয়র’ বেছে নিয়েছে এমন একটি মাসের নাম পাওয়া যাবে না। এমন কোনও মাসের কথা বলা যাবে না, যে মাসে দান্তে(৩) সম্বন্ধে জানার প্রয়োজন মনে হয়েছে। ফলে যা পড়া হয় তা সবই সাধারণ মানের আধুনিক বই, কোনও শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গ্রন্থ নয়, এটাও প্রতিযোগিতার ফলাফল। সম্ভবত এর সব কিছুই খারাপ। নয়। কেননা যেসব মেয়ের কথা বলা হচ্ছে তারা নিজেরা পছন্দ করে বই পড়লে, তাদের সাহিত্য-পুরোহিত এবং সাহিত্য-প্রভুরা তাদের জন্যে যা পছন্দ করতেন, তার চেয়েও খারাপ হত।
আধুনিক জীবনে প্রতিযোগিতার ওপর যে প্রাধান্য আরোপ করা হয়েছে তার সাথে সভ্য সমাজের আদর্শাবলীর ক্ষয়ের সম্পর্ক বিদ্যমান। অগাস্টার যুগ শেষে রোমে যা যা ঘটেছিল তা অবশ্যই এই ধরনের। নারী ও পুরুষ, বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দ উপভোগের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সাধারণ আলাপচারিতায় শৈল্পিক দক্ষতা, অষ্টাদশ শতকের ফরাসী সালোঁ-তে যার চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল, চল্লিশ বছর পূর্বেও তার ঐতিহ্য সজীব ছিল। এটা এক উচ্চস্তরের শিল্প, যা প্রদর্শন করতে হত এমন কিছুর জন্যে যা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এ যুগে তার কোনও মূল্য নেই যেন। চীনে দশ বছর পূর্বেও এর চর্চা ছিল। কিন্তু আমার ধারণা জাতীয়তাবাদীদের দেশসেবার নতুন উদ্যম এর চর্চাকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করেছে। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের জ্ঞান যা পঞ্চাশ বা একশত বছর আগেও শিক্ষিতসমাজে বিশ্বজনীন নির্মল আনন্দ পরিত্যক্ত হয়েছে। বসন্তকালে কয়েকজন আমেরিকান ছাত্র তাদের ক্যাম্পাস-সীমান্তের বনানীর ভিতর দিয়ে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। চমৎকার সব বনফুলে চারিদিক ছেয়ে রয়েছে। কিন্তু পথপ্রদর্শকদের একজনও ঐ কাননের একটি ফুলের নামও জানে না। এই জ্ঞান তো তাদের কোনও কাজে লাগবে না। এই জ্ঞান তাদের উপার্জনও বাড়াবে না।
এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। কোনও ব্যক্তি বিশেষ তার সমস্যা বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধও করতে পারবে না। এই সমস্যার প্রকাশ ঘটেছে সাধারণভাবে যে জীবনদর্শন গৃহীত হয়েছে তা থেকে। যে দর্শন অনুযায়ী জীবনটাই একটা সগ্রাম, একটা প্রতিযোগিতা, যাতে শুধু সম্মান অর্জন করবে বিজয়ী। এর জন্যেই বুদ্ধি এবং মেধাকে কাজে না লাগিয়ে প্রবৃত্তির অতিরিক্ত চর্চা করা হচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত একথা বলবার সময় আমরা ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ে দিচ্ছি। পিউরিটান (রক্ষণশীল) নীতিবাগিশরা আধুনিক সময়ে সর্বদা ইচ্ছাশক্তির ওপর জোর দিয়েছেন, যদিও মূলে তারা বিশ্বাসকেই প্রধান্য দিতেন। হতে পারে ইউরিটানবাদ তার দীর্ঘজীবনে এমন একটা প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে ইচ্ছাশক্তির অতিবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সেই সাথে ইন্দ্রিয়বোধ এবং মেধাকে অনাহারে শুকিয়ে মারা হয়েছে, এবং এরকম একটি প্রতিযোগিতার দর্শনকে তাদের প্রকৃতির পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত বলে গ্রহণ করেছে। সে যাই হোক, প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় ডাইনোসরদের বুদ্ধির চেয়ে দৈহিক শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, আধুনিক ডাইনোসরদের দৈহিক ক্ষমতার বিশাল সাফল্য সর্বাঙ্গীনভাবে তাদের অনুকরণ করতে প্ররোচিত করেছে। প্রত্যেক দেশের শ্বেতাঙ্গদের জন্যে এরাই হচ্ছে আদর্শ এবং আগামী একশত বছর পর্যন্ত এটা আরো বেড়ে যাবে বলে মনে হয়। যারা এই ফ্যাশনের অনুসরণ করেনি, তারা অবশ্য একথা ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারে যে, ডাইনোসররা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পারেনি। তারা পরস্পরকে হত্যা করেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বুদ্ধিমান যারা দূরে দাঁড়িয়ে তাদের হত্যালীলা দেখেছিল, তারাই পেয়ে গেছে তাদের রাজত্বের উত্তরাধিকার। আমাদের আধুনিক ডাইনোসররাও এমনিভাবে নিজেদের হত্যা করে শেষ হয়ে যাচ্ছে, গড়ে প্রত্যেক বিবাহ থেকে দম্পতিরা দুটি সন্তানও পেতে চান না। সন্তান আসুক এমন কামনা থেকে তারা জীবনকে উপভোগ করেন না। এখানে এই অহেতুক উদ্দীপনাহীনতার দর্শন যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে তাদের পিউরিটান পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, তা বর্তমান পৃথিবীতে অগ্রহণযোগ্য বলে দেখা গেছে। তারা তাদের জীবনদর্শনে এমনি অসুখী যে, সন্তানলাভের কামনা তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তাই জৈবিক বিচারে তাদের বিলুপ্তি অনিবার্য। সেদিন খুব দূরে নয়, যখন তাদের স্থান দখল করবে এমন কিছু মানুষ যারা আরো আমোদপ্রিয় এবং প্রাণচঞ্চল।
যে প্রতিযোগিতা জীবনের মূল লক্ষ্যরূপে বিবেচিত, তা অত্যন্ত ভয়ানক, তেমনি একাগ্র, তেমনি দৃঢ়পেশিবদ্ধ এবং অনড় বাসনার ব্যাপার যে তা খুব বেশি হলে এক বা দুই প্রজন্ম পর্যন্ত জীবনের সমরূপ ভিত্তি বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই কালসীমা শেষ হলে তা থেকে অবশ্যই স্নায়বিক ক্লান্তি জন্ম নেবে, নানারকম পলায়নী মনোবৃত্তির উদয় হবে এবং কাজের মতো-ই কঠিন এবং কঠোরভাবে আমোদপ্রমোদের পিছনে ছুটবে (কাজে অবসর উপভোগ সম্ভব নয় বলে)। এবং সবার শেষে বন্ধ্যাত্বের কারণে বংশলুপ্তি ঘটবে। প্রতিযোগিতার দর্শনে শুধু যে কাজের স্পৃহা বিষময় হয়ে ওঠে তা নয়, অবকাশও একই পরিমাণ বিষময় হয়ে ওঠে। যে অবকাশ শান্তিদান করে এবং ক্লান্ত স্নায়ুকে সজীব করে তোলে তাকেই বিরক্তিকর মনে হয়। প্রতিযোগিতর বেগ অবধারিতভাবে বেড়ে যাবেই এবং তার স্বাভাবিক পরিণতি হবে মাদকদ্রব্য সেবনে আশ্রয় লাভ এবং ভেঙে পড়া। এর থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে জীবনের সুষম আদর্শে সুস্থ এবং প্রশান্তির জায়গাটা নির্বাচন করে তাকে স্বীকৃতিদান।
——–
১. কনরাড, Joseph Conrad (১৮৫৭-১৯২৫)। বৃটিশ ঔপন্যাসিক, তিনি জাতিতে পোলিশ। Lord Jim তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
২. আরনল্ড বেনেট, Amold Bennet (১৮৬৭-১৯৩১) ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, The Old Wives Tale তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
৩. দান্তে, Durante Alighieri (১২৬৫-১৩২১) ইতালীর কবি। বিশ্বনন্দিত মহাকবিদের একজন। তাঁকে বলা হয় ইউরোপীয় বেঁনেসার প্রথম সূর্যরশ্মি Divine Comedy তার কালজয়ী রচনা।