নুরানি বিলকিস ফিরা যায়, কি করবে ফিরা না যায়, পোলার মার কোন গরজ নাই, সেতো কোথাকার কোন খালা; কি তার শান্তি লাগে না, তার মনে হয় দীর্ঘ সময় ধরে সে কাছেই কোথাও একটা মানুষের বাচ্চার কান্দার শব্দ শুনতে পায়, তার মনে হয় যে, এইটা চানমিঞাই হবে, তার মা খৈমন হয়তো মিছা কথা বলে, আহারে পোলাটা, হয়তো বান্দরেরা তাকে মাঝেমধ্যেই নিয়া যায়, পালে, তাতে ক্ষতি নাই ভেবে খৈমনও নিশ্চিন্তে ঘুমায়! মিসেস জোবেদা রহমান বন্দরের বাসায় মানুষের পোলার কান্দার শব্দ হয়তো শোনে না, তার প্রয়োজন হয় না, কারণ এইসব বিষয় একজন শুনতে পাওয়াই কি যথেষ্ট না? ফলে সে বলে যে, যে পোলার মা তার পোলারে বান্দরের দুদ খাইতে দেয়, বান্দরে যুদি সেই পোলা নিয়া যায় পালে তাহলে অবাক হওয়ার কি আছে? অবাক হওয়ার কিছু নাই, এইটা খুবই সম্ভব; ফখরুল আলম লেদুকে সে হয়তো বলে, বান্দরের দুদতো খাইছেই, বান্দরে অরে লয়া গেছিল গা!
ফখরুল আলম লেদুর বিশ্বাস হয় না, তবু তার মনে হয় যে, হইতে পারে, পারবে না কেন? কারণ লেদুর মনে পড়ে যে, সিলভারডেল কেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সাদা সার্ট, মেরুন কালারের হাফ প্যান্ট আর টাই এবং বাটার টিবয় জুতা পরে প্রথম যেদিন স্কুলে যায় সে দেখতে পায় যে, তাদের কেজি ওয়ানে ভূতের গল্লির আরো দুইজন আছে, এদের একজন মামুন, তার খুব প্রিয় বন্ধু, এবং অন্যজন চানমিঞা, যার সঙ্গে সম্পর্কের ধরনটাই সে কোন দিন বুঝতে পারে না। লেন্দু যখন মামুনের মার কথা শোনে চানমিঞার কথা তার মনে পড়ে, তখন তার মনে হয়, চানমিঞা বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা হতে পারে, কারণ তার মনে পড়ে যে, মানুষের এমন এলোমেলো পোলা সে দেখে নাই। হয়তো মিসেস জোবেদা রহমান যে কথা বলে চানমিঞার তা জানা ছিল, সে হয়তো খৈমুনের ঘরে বাস করে বান্দরের দুধ খায়া বড় হতে থাকে, তারপর তার বয়স যখন তিন কিংবা চাইর হয় তখন কেউ হয়তো প্রথম তাকে বলে, তুই বান্দরের দুদ খাছ, তুই কি বান্দর? ফলে তখন, সেইদিন, জীবনে প্রথম তার শিশু মন বিভ্রান্ত হয়া পড়ে, হয়তো মানুষের সঙ্গে থেকে বান্দরের দুধ খাওয়ার জন্য তার লজ্জা এবং ভয় হয়, অথবা হয় বান্দরের দুধ খায়া মানুষের সঙ্গে থাকার জন্য-পরে হয়তো সেজন্য সে বান্দরদের কাছেই ফিরা যায়। কিন্তু ফখরুল আলম লেদু যত মোটা এবং তার সামনের দাঁত যত উঁচাই হোক, অথবা তাকে যত সোজা কিসিমেরই লাগুক, সে মোটেই ভোন্দা না, সেই কারণে পরে মামুনের মা তাকে যখন একদিন বলে, মামুন বাড়ি নাই, লেদু, তখন বলধা গার্ডেন পার হয়া নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে মেরি টিচারের বাসায় যায় হাজির হয়, জুলি ফ্লোরেন্স দরজা খুলে দিয়া বলে, হু লেদু ভাই, গুড যে আপনে আসছেন, ইয়োর ফ্রেন্ড ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।
তখন সিঁড়ি দিয়া জুলির পিছন পিছন লেদু দোতলার ফ্লাটে এসে দেখে, মামুনুল হাই দেওয়ালের ছবির দিকে তাকায়া আছে; সে লেদুকে দেখে এবং জুলিকে বলে, জুলি এইটা কি মসজিদ?
বালিকা-কিশোরি জুলি হয়তো একটা লাল এক কালারের জামা পরে ছিল, সে মামুনের কথা শুনে বলে, ইটস নট এ মস্ক, ইটস এ চার্চ।
: এইটা কোথায়?
: ভ্যাটিকানে, রোমে।
: রোম কোথায়?
তখন ঘরের ভিতরে জগদ্দল লেদুকে নিয়া এইসব কথা কি আর আগায়? আগায় না, মামুনুল হাইয়ের খুব খারাপ লাগে, তার মনে হয় যে, . লেদুটা ভোন্দাই, বাবা তুই যখন জানিস যে আমি আসছি টিচারের বাসায়, তর জেনে শুনে আসার দরকার কি, আমারে একা থাকতে দে, আমার মত কইরা কথা কইতে দে, তারপর তুই অন্য একদিন আয়, কথা ক তর মত কইরা; কিন্তু তা না, সে আইসা আমার কাবাবের মধ্যে একটা মোটা লেদু হয়া থাকবে। কিন্তু লেদু এত কিছু বোঝে না, দুই জনে মিলা জুলিকে দেখলে ক্ষতি কি? সে তার বিরাট মোটা একটা হাত জুলির মাথার উপরে রেখে বলে, টিচার কৈ, কি করে? ডাক না।
জুলি ফ্লোরেন্স হয়তো যায় তার মাকে ডেকে আনে, মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক ভিতরের ঘর থেকে বের হয়া এসে বাইরের রুমে বসে, চোখের চশমা খুলে নিয়া তাদের দিকে তাকায়, তার মুখের পেশি শিথিল এবং চুলের একটা অংশ সাদা হয়া গেছে; তখন হয়তো ছেলেদের দিকে তাকায়া সে ক্লান্তভাবে হাসে, লেদুকে বলে, ফখরুল কেমন আছ তুমি, ডুয়িং ওয়েল? হয়তো মামুনকে বলে, মামুন মিঞা তুমার কি খবর?
তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়া লেদুর হয়তো কইলজী দুই ভাগ হয়া যেতে থাকে, আপনে কেন এমন হয়া যাইতাছেন টিচার, আপনে কত যে সুন্দর আছিলেন-কি সে এসব কিছু বলে না, কেবল তাকায়া থাকে-তারপর সে বলে, ভাল আছি টিচার, মামুন বলে, ভাল আছি টিচার; অথবা জুলি হয়তো তার মাকে ডেকেই আনে না, কারণ তার ক্লান্ত মা হয়তো তখন ঘুমায় অথবা ঘুমায় না, চুপ করে বসে থেকে বিড়বিড়ায়, কিন্তু জুলি বলে, মম ইজ ব্লিপিং।
তখন লেদু তার ভারি একখানি হাত পুনরায় জুলির কান্ধের উপরে রাখে, কিন্তু এত হালকা করে রাখে যে জুলির মনে হয় একটা টিয়া পাখির হয়া থাকবে কি সে তার কবরভাক না কে ডেকে আনে বসে, চোখে পালক বুঝি তার কান্ধের উপর খসে পড়লো এবং সে লেদুর দিকে তাকায়, লেদু বলে, আমাগো চা খাওয়াও, আমরা ছিলাম টিচারের সব থেইকা প্রিয় ছাত্র, চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দিও আমাদের!
জুলি ফ্লোরেন্স আপ্যায়নের জন্য একদম ব্যস্ত হয় না, ঘরে বিস্কুট টিস্কুট হয়তো নাই-ও, সে তার মার এই দুই প্রাক্তন ছাত্রের কাছ থেকে একটু দূরে বসে থাকে এবং তারপর হঠাৎ কেন যেন বলে, মম লাইকড দা মাঙ্কি বয় মোষ্ট, হোয়্যার ইজ হি? হয়তো লেদুর মনে হয় যে, এই মাইয়াটা মাঙ্কি বয়কে এত খোঁজে কেন? ক্যালা? তখন খৈমনের পোলার নামকরণের প্রসঙ্গটা এসে যায়, কারণ একাত্নর সনে জিঞ্জিরা থেকে পাকিস্তানি মিলিটারির ধাওয়া খায়া ফিরা আসার পর জুন/জুলাই কিংবা আগস্ট মাসে গৈমনের সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় হয়, মনে হতে থাকে তার পেট ছিঁড়া ভূড়ি খসে পড়বে, তার পায়ের পাতায় পানি জমে ফুলে ওঠে, কিন্তু আব্দুল জলিল বলে, অখনেই হইবো, আর দেরি করা পারে না কয়েকদিন? জরিমন বলে, অখনেই না, দেরি কর কয়েকদিন। কিন্তু খৈমনের শরীরেরতো আর দেরি সয় না, রাজাকার সর্দার আব্দুল গনি হয়তো সকালে কিংবা বিকালে আসে, জিগাস করে, কি ময়না মিঞা, তুমার বৌ বিয়ায় না ক্যান?
ময়না মিঞা বলে, এই কথা ক্যান জিগান?
: না, এমনেই জিগাস করি!
তখন আব্দুল জলিলের পুরা পরিবার আতঙ্কের মধ্যে পরে এবং চানমিঞার নাম বিজয় মিঞা কিংবা স্বাধীন আলি হয়া যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যদিও ময়না মিঞা সেই সম্ভাবনা আগেই নষ্ট করে রাখে, কিন্তু রাজাকারদেরতো সেটা জানা থাকে না, ফলে তারা বগলের মধ্যে লাঠি চেপে ধরে মহল্লায় হাঁটাহাঁটি করে, তাদের কাজ হয় মহল্লার লোকের খোঁজখবর নেওয়া; তারা তখন একদিন আব্দুল জলিলের বাসায় যায় হাজির হয়, তাদের দেখে জরিমন ঘর থেকে বের হয়া বারান্দায় এসে খাড়ায়, এবং খৈমন হয়তো ঘরের ভিতর বসে জানালা দিয়া রাজাকারদের দিকে তাকায়া থাকে, কারণ খৈমনতো খৈমনই, গর্ভের ভারে যতই সে কাবু হোক তার মনে হয় যে, তার মার দিকে লক্ষ রাখা দরকার যদিও তার নিজের বের হয়া আসতে সঙ্কোচ কিংবা ভয়ও হয়তখন আব্দুল গনি জরিমনের সঙ্গে কথা বলার সময় ঘাড় ফিরায়া জানালার ফাঁক দিয়া খৈমনকে দেখে। খৈমন ঘরের ভিতর বসে থাকায় আব্দুল গনি তার পুরা অবয়ব দেখতে পায় না, কেবল মুখটা দেখে, তখনো হয়তো খৈমনের মুখ ফুলে ওঠা শুরু করে নাই, তার ফরসা এবং শ্যামলার মাঝামাঝি রঙের এই মুখটা দেখে রাজাকার আব্দুল গনি হয়তো বিচলিত হয়, এবং মিসেস জোবেদা বেগম যেমন বলে যে, খৈমন হচ্ছে ধুরন্ধর দি গ্রেট, ফলে সে অবশ্যই জানালার পাশে বসে থেকে আব্দুল গনির চোখের ভাষা পড়ে-পুরুষের চোখের ভাষা পড়তে পারে না কোন নারী? মানুষ খুন করা ছাড়াও দেশে পাকিস্তানি মিলিটারি আর কি করে বেড়ায় তার খবর আব্দুল গনির কাছে ছিল, তার মনে হয় যে, মহল্লায় শিগগিরই পাকিস্তানি মিলিটারি আসবে, বাড়ি বাড়ি ঘুরবে, ঘর পোড়াবে, তারপর যা করার করবে, এবং এই মহল্লায় কয়েক দিন ঘুরে আব্দুল গনির হঠাৎ মনে হয় যে, জানালার পাশে বসে থাকা মায়াইলোকটার কোন উপায় নাই! তখন রশিদুলের কথা আব্দুল গনি জানতে পারে, সে জানতে পারে যে, বুড়িটা তাকে মিথ্যা কথা বলেছে, এই বাড়ি থেকে অবশ্যই কেউ মুক্তিযুদ্ধে গেছে, কারণ মানুষের হিসাব করলেই দেখা যাবে যে একজন মানুষ কম, সেই একজন কোথায়? না, মুক্তিযুদ্ধে! আব্দুল গনি আবার তার দল নিয়া খৈমনদের বাসার উঠানে এসে খাড়ায়, জরিমনের কোন উপায় থাকে না।
: আপনের পোলার নাম কি?
: রশিদুল।
তখন খৈমনকেও অবশ্যই জানালার পাশে দেখা যায়, হয়তো সে কাছেই মজুদ ছিল, আব্দুল গনি যখন রশিদুলের কথা বলে সে হয়তো ভাবে যে, জানলার কাছে যায়া ইকটু বহি-কিন্তু এই খেলা মারাত্মকই ছিল। কারণ, খৈমনকে দেখা মাত্র আব্দুল গনি তার কথা ঘুরায়, রশিদুলের প্রসঙ্গ ছেড়ে জরিমনকে জিগাস করে, আপনের মাইয়ার নাম কি?
: খৈমন।
আব্দুল গনির মনে হয় যে, খৈমন ইচ্ছা করে এসে জানালার পাশে বসে থাকে, চেহারা দেখায়, ফলে আব্দুল গনির সাহস বাড়ে সে বলে, আপনের মাইয়ারে ডাকেন, কথা জিগাই।
খৈমন নিশ্চয়ই সব শোনে, সে জানালার ভিতর থেকেই বলে, কি বলতে চান বলেন, এবং আব্দুল গনি হয়তো বিচলিত হয়া পড়ে, সে বলে, আপনের নাম খৈমন?
: আমার মায় আমার নাম কয় নাইকা আপনেরে? আপনে কি বয়রা, হুনেন না কানে?
আব্দুল গনি ঘাবড়ায়া যায়।
: কইছে, তবু জিগাইলাম।
রাজাকার আব্দুল গনির তার দলের সামনে আর ইজ্জত থাকে না, সে চেষ্টা করে কোনভাবে সেটা বাঁচায় চলে আসতে, ফলে তাকে আরো কিছু বাড়তি কথা বলতেই হয়, সে বলে, আপনের ভাই তাইলে নবাবগঞ্জে আপনের খালার বাইতে গেছে? নবাবগঞ্জ, এই জিঞ্জিরার পরেইতো?
: হঁ।
: আপনের খালা কি আপন খালা?
: হ, আপন।
আব্দুল গনি তার দল নিয়া ফিরা আসে, তারপর খৈমনের সঙ্গে সাক্ষাতের খবর আবু বকর মওলানার কানেও যায়, সে আব্দুল গনিকে সেইদিন অথবা পরদিন বাসায় ডেকে পাঠায় এবং তখন আব্দুল গনির মনের ভিতরে হয়তো একটা নারীর মুখ জেগে থাকে, সে যখন মওলানা আবু বকরকে বলে যে, ভূতের গল্লির মানুষরা অত খারাপ বলে মনে হয় না, তারা ভালই, সে কি তখন খৈমনের কথা চিন্তা করেই এই কথা বলে না? হয়তোবা, এবং সে হয়তো তার রাজাকার বাহিনীকেও এই কথা বোঝায় যে, লোক এরা খারাপ না, খামাখা ঝামেলা করে লাভ কি? এবং তার রাজাকার বাহিনীর বুদ্ধিমান সদস্যরা বিষয়টা হয়তো মেনে নেয়, কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্স যখন মাবিয় কোথায় জানতে চায়, জুলি কার কথা বলে ফখরুল আলম লেদু বোঝে, মামুনুল হাইও, তবু তারা দুইজন তাদের মুখ কেমন বেঁকা করে রাখে; তারপর মামুন বলে, কি জানি-লস্ট পারহ্যাপস।
তখন লেদু ভেবে দেখে, হয়তো সত্যি সে জানে না, এক মহল্লায়। থাকলেও চানমিঞার সঙ্গে তার বহুদিন দেখা নাই-বান্দরের দুধ খাওয়া পোল সে! অথবা লেদুর মনে হয়, এইটা ঠিক না, কিন্তু তথাপি সে জানে যে, বান্দরের দুধ হয়তো চানমিঞা ঠিকই খেয়েছিল, কারণ সে কি মাঙ্কিবয় ছিল না? শিশুকাল থেকে হয়তো এই কথা চানমিঞার নিজেরও জানা ছিল, ফলে সে ছিল বিভ্রান্ত, ক্রমে হয়তো তার কথা অন্য সকলে জেনে যায়, এমন কি তাদের কেজি ওয়ানের টিচার মিসেস ক্লার্ক পর্যন্ত। সে কারণে চানমিঞার জন্য মিসেস ক্লার্কের হয়তো বিশেষ এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়, মমতা জন্মে, হয়তো ভাবে, পুওর চাইল্ড, কারণ লেদুর মনে হয় যে, এই মহিলা ছিল শুধুই ভালবাসার আধার; তখন ছবির মত সুন্দরী এই মহিলার সঙ্গে একদিন তারা ক্লাসের সকল পোলাপান বলধা গার্ডেনে বেড়াতে যায়-ক্লাস পিকনিকে-এবং বলধা গার্ডেনের ভিতরে পানির চৌবাচ্চার কাছে গেলে বদমাইশ পোলাপান চানমিঞাকে বলে, পানিতে তাকাইলে দেখবা একটা বান্দর চায়া আছে।
ফলে চানমিঞা ভয়ে অথবা অন্য কোন কারণে চৌবাচ্চার কাছে যায় শক্ত হয় থাকে, পানির দিকে তাকায় না–তখন ঢাকা শহরে হয়তো কেবল এইখানে, বলধা গার্ডেনে, গোল্ড ফিস ছিল-টিচার যখন তাকে বলে, দেখ চানমিঞা গোল্ড ফিস, তখন চনিমিঞাকে বিহ্বল লাগে, সে মুখ আকাশের দিকে উঁচা করে রাখে, তার জীবনের প্রথম গোল্ড ফিস দেখা হয় না। তখন কয়েকটা ছেলে তাকে জোর করার চেষ্টা করলে চানমিঞা তীক্ষ তীব্র একটা আর্তচিৎকার করে চৌবাচ্চার কাছ থেকে সরে যায় প্রাঙ্গণ প্রাচিরের সঙ্গে নিজেকে ঠেসে ধরে রাখে এবং তখন মেরি জয়েস তার হৃদয়কে মেলে দেয়, সে আগায়া যায় এই পুচি বালক চানমিঞার মুখ তার দুই হাতের জড়ো করা করতলের ভিতরে নেয় এবং বলে, ও মাই বয়, ওকে ওকে! তবে শিশু অথবা বালক চানমিঞাকে তার মা খৈমন কি মনে করে সিলভারডেল স্কুলে ভর্তি করে তা লোকে বোঝে না, মনে হয় যে, সে হয়তো কাজটা দেখাদেখিই করে, অথবা হয়তো হিসাব তার একটা ছিলই; মাসে পঁচিশ টাকা বেতনের স্কুলে ছেলে পড়ানোর অবস্থা খৈমনের ছিল না নিশ্চয়ই, সে চানমিঞাকে নারিন্দা সরকারি ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিতে পারতো, তা না দিল সিলভারডেলে-এই বাড়াবাড়ির ব্যাখ্যা কি? পরে মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, খৈমনের হিসাবতো ছিলই, কারণ সে এমন সেয়ানা এক মাইয়ালোক চালাকি ছাড়া যে কুটাখন ছিঁড়া দুইভাগ করে না, এবং তার প্রমাণ যে পাওয়া যায় নাই তাও না। কেজি ওয়ানের টিচার মেরি জয়েসের সঙ্গে বলধা গার্ডেনে ক্লাস পিকনিকে গেলে চানমিঞাকে মেরি জয়েস আবিষ্কার করে, চানমিঞা যখন ভয় অথবা অন্য কোন আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়া দেওয়ালের সঙ্গে পিঠ লাগায়া খাড়ায়া থাকে তখন মেরি এই শিশু বালকের ভীত কিন্তু একই সঙ্গে তীঃ ও উজ্জ্বল হয়া ওঠা চোখের দিকে তাকায়া বিচলিত হয়, এবং সে যখন তার মুখটা অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করে বলে, ভয় কি বাবু, চানমিঞা কান্দতে থাকে, সেদিন তার চোখের উত্তপ্ত অশ্রুতে মেরি জয়েসের করতল শিক্ত হয়।
বাবু, অর্থাৎ চানমিঞার জানা ছিল না কি ভয়, কারণ সে তখন নিতান্তই শিশু ছিল, তার শরীর ছিল সদ্য অঙ্কুরিত বৃক্ষ পল্লবের মত হাল্কা ও স্নিগ্ধ এবং ভঙ্গুর, মন ছিল নতুন কাটা পুকুরের মত খোলা, টলটলে এবং আগাছাহীন। কিন্তু সে হয়তো দ্রুত শিখে ফেলে সমাজ এবং সংসারের রহস্য ও ভাষা, ফলে তার মনের পানির গভীরে সহসা কাঁটা গুল্ম জলে, পাড়ের জীবনের ছায়া এসে পড়ে-তা না হলে বলধা গার্ডেনে তার আচরণের ব্যাখ্যা কি? মিসেস জোবেদা রহমান হয়তো এই ঘটনার কথা জানে, হয়তো মামুন তাকে বলেছিল, ফলে অনেক পরে একদিন, মামুন এবং ফখরুল আলম লেদু যখন সেন্ট যোসেফ অথবা সেন্ট গ্রেগরিজে পড়ে মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, চানমিঞার এসব চালাকি ছিল, তার মাও কি খুব বেশি চালাক না? তাহলে তার ছেলের চালাক হতে অসুবিধা কোথায়! মিসেস জোবেদী রহমানের যুক্তি হচ্ছে খৈমন এইসকল চালাকি করে মেরি জয়েসকে পটানোর জন্য, যদিও হয়তো সে এই কাজে পুরাপুরি সফল হয় না; কারণ মেরি জয়েসতো বান্দর না যে সারাদিন অন্যের পোলাকে আদর যত্ন দিয়া দেখে রাখবে, খাওয়াবে পরাবে, কিন্তু তারপরেও সে হয়তো তার প্রকৃতিগত কারণে কিছুটা কাবু ইয়া পড়ে বাচ্চাঅলা বান্দরনিটার মত। এর কারণ কি তা বোঝা মুশকিল, খালি একটা বাচ্চা সুন্দর হলেই কেউ আদর করে না, পৃথিবীতে সুন্দর বাচ্চার অভাব নাই, মামুনও হয়তো সুন্দর, তার মা তাই বলে, লেদুকেও হয়তো ছুটুকালে সুন্দরই লাগতো; ক্লাসের পনের/বিশটা বাচ্চার ভিতর সব রেখে কোথাকার মোছা: খৈমনের পোলা চানমিঞাকে নিয়া মেরি জয়েস আকুল হয়া পড়লো-এইটা হয় না। চানমিঞার সৌন্দর্যের রহস্যটাই বা কি? মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, এর পিছনে আছে খৈমনের বদমাইশি-ই, রাস্তায় পড়ে থাকা এক তরকারিঅলাকে দেখে তার সৌন্দর্যে সে মজে গেল, এবং দুইজনে মিলা এক খেলা খেললো, বিয়ার রাইতে সে পানি ঢেলে তরকারিঅলা ময়না মিঞার সম্পত্তির দলিল নষ্ট করে দিল; ময়না মিঞা যখন কান্দে সে তাকে বোঝায় যে, আরেকটা কাগজ পরে লিখা দেওয়া যাবে। কিন্তু খৈমনকে ময়না মিঞা চেনে নাই, এই পরেটা আর আসে না, আসে নাতো আসেই না, সে খৈমনকে চাপাচাপি করে, তুমার বাপরে কও আর একটা কাগজ লেইখা দেওনের লাইগা।
খৈমন বলে, কমু, এত হুড়াহুড়ি করেন ক্যালা?
খৈমনে এই কথা শুনে ময়না মিঞা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর সে যখন বলে, আমার সঙ্গে চালাকি করলে মরবা, খৈম হয়তো ভয় পায়, কারণ গ্রামের এই লোকদের সম্পর্কে তার ধারণা কম, সে তার স্বামীর দিকে তাকায়া থাকে, তার লম্বা শরীর কালা কিন্তু চকচইকা, শহরের লোকদের শরীর এইরকম না, শহরের সাদা লোকগুলা সাদা না, কালা লোকগুলা কালা না; কি এই কালা তরকারিঅলা লোকটা কালাই ছিল এবং সে ছিল সুন্দর-তখন তার মন নরম হয়া আসে, সে বলে, চিন্তা কইরেন না, পাইবেন! অথবা হয়তো খৈমনের মনে অন্য কিছু ছিল, তবু ময়না মিঞার মনে হয় যে, খৈমন হয়তো মিথ্যা বলে না, কিন্তু বিয়ার আগে কুত্তা লেয়া দেওয়ার ঘটনাও সে ভুলতে পারে না, এবং খৈমন যতই অস্বীকার করুক সে বোঝে খৈমন বদমাইশি জানে; কারণ, যেদিন সে বাবুল মিঞাকে বলে, যান বিয়া ঠিক করেন, তার পরদিন সে ঠাটারি বাজারে তার নির্ধারিত জায়গায়, দোকান না বসায়া মাথায় তরকারির আঁকা নিয়া ভূতের গল্লিতে যায় তরকারি ফেরি করার জন্য, তখন তার মাথায় একটা ফন্দি ছিল, সে ভূতের গল্লির রাস্তায় যায় চিৎকার করে, তরকারি তরকারি, এই তরকারি!
বাড়ির মহিলারা তাকে ডাকে, এই কি তরকারি, চিচিংগা আছে?
ময়না মিঞার কাছে চিচিংগী নাই, সে আগায়; তখন হয়তো বাঘঅলা বাড়ি থেকে পারভিন সুলতানা বের হয় তাকে ডাক দেয়, এই তরকারিঅলা, পাপী আছে?
তার কাছে পেঁপেও নাই, সে আবার হাঁটে, তরকারি তরকারি, বলে চেচায়; তখন শওকতের বইন জহুরা আসে, এই তরকারি, এদিকে আসো।
ময়না মিঞা আসে না, সে হাঁটে, জহুরা হয়তো ভাবে তার বয়স কম। বলে তরকারিঅলা তাকে পাত্তা দেয় না! ময়না মিঞা তখন রাস্তায় টুলু বুলু এবং দুলালকে পায়, সে তাদের চিনতে পারে, তারা গল্লির ভিতরে ব্রিং কিংবা ডাণ্ডাগুল্লি খেলে; ময়না মিঞা এক দান খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে টুলু অথবা বুলু অথবা দুলালকে বলে, তুমরা নতুন মানুষ পাইলে কুত্তা ছুঁয়ায়া দেও, নাকি?
ক্রিড়ারত পোলাপানগুলা তার কথায় অবাক হয়, বুঝতে পারে না এই লোকটা কি বলে, তারপর তাদের হয়তো ঘটনাটা মনে পড়ে এবং তারা বলে, একদিন দুয়াইছিলাম, একজনে কইছিল ছুঁয়াইতে!
: কে বলছিল?
: খৈমনে।
: বদমাইশ মায়ালোক!
বালকেরা ভাবে, তাদের মনে হয় যে, খৈমন অবশ্যই বদমাইশ, তবে হয়তো পুরাপুরি না; ময়না মিঞা বাসর রাইতে খৈমনকে যখন কুত্তা চুয়ানোর কথা বলে, খৈমনের মনে হয় যে, লোকটা আন্দাজে ঢিল মারে, কি তারপর ময়না মিঞা হয়তো একটু বেশি বলে ফেলে, কারণ, খৈমনও খৈমনই ছিল, ফলে অর্ধেক বাড়ি লিখা দেওয়া দলিল তার হাত ছাড়া হয়া যায়, এবং আর কোন দিন সে এর নাগাল পায় না; তবে খৈমনের গর্ভে জন্মানো ছেলের নাম সে তার পছন্দ মত চানমিঞা রাখতে পারে, খৈমন মেনে নেয়। মিসেস জোবেদা রহমান যখন এই মোছা: খৈমনের কথা বলে তার নাকটা কুঁচকায়া থাকে, ঘৃণায় না কিসে, বোঝা যায় না, তবে খৈমনকে সে দেখতে পারে না এ বিষয়ে ফখরুল আলম লেদুর কোন সন্দেহ নাই। প্রথমে হয়তো ঘৃণার এই বিষয়টা অপ্রকাশিত থাকে, কারণ ২৫নম্বর বাড়ির লোকের সঙ্গে ৩৬নম্বর বাড়ির লোকের ঝগড়া লেগে থাকার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ পাওয়া মুশকিল হয়, হিসাব মত খৈমনের ঝগড়া থাকা উচিত ছিল ৩৭নম্বর বাড়ির নুরানি বেগম উপমা কিংবা ৩৫নম্বর বাড়ির রাজিয়া বানুর সঙ্গে, কিংবা স্বাধীনতার পরেই তাদের বাড়ি বেদখল করে যারা দুইভাগ করেছিল, সেই ৩৫/১ এর শারমিন ইয়াসমিনের সঙ্গে, তা না এতগুলা বাড়ি ডিঙ্গায়া মিসেস জোবেদা রহমানের সঙ্গে খৈমনের সম্পর্ক খারাপ হয়া গেল, আশ্চর্য, কিংবা হয়তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই, কারণ সংসারে কে কাকে ভালবাসবে বা ঘৃণা করবে তার বস্তুত হয়তো কোন সূত্র থাকে না। মিসেস জোবেদা রহমান যখন বাংলাবাজার স্কুলে লেখাপড়া করতো তখন সে মসজিদের গল্লিতে তার বাপের ৬২নম্বর বাসায় থাকতো, তখনই হয়তো খৈমনের ব্যাপারে তার বিষ্ণা দেখা দেয়, যদিও জীবনের প্রায় সব কিছু তার পক্ষেই ছিল। খৈমনদের বাড়িটা ছিল মহল্লায় সব চাইতে ছোট এবং জরাজীর্ণ, খালবালা ওঠানো, তার বাপ ছিল একটা মুখ পানবিড়ি দোকানদার, মা নেহায়েত মাতারি, ভাই অপদার্থ গুণ্ডা, সে লেখাপড়া বলতে কিছু করে নাই, তারপর তার বিয়া হয় এক তরকারিঅলার সঙ্গে। মিসেস জোবেদা রহমানের এইসব বিষয়ে অবস্থা ভালই ছিল, সে বাংলাবাজার গার্লস হাই স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করা মহিলা, ফিরোজা রঙের ইউনিফর্ম পরে সে মহল্লার মানুষের সামনে দিয়া যাতায়াত করতো, মহল্লার মানুষ এর সাক্ষী, তার বিয়াও হয় মহল্লাতেই, তার বাপের ছিল বিস্কুটের কারখানী এবং শশুরের দোলাইখালে লোহালক্কড়ের দোকান, তার স্বামী গোলাম রহমান সলিমুল্লা কলেজের আইএ পাশ, কলতাবাজার খাদ্যগুদামের কেরানি-কোন দিক দিয়াই সে খারাপ ছিল না, তারপরেও খৈমনের সঙ্গেই তার লাইগা যায়। হয়তো বিয়ার আগেই এর শুরু, হয়তো কোন একদিন-যখন দোলাই খাল একটা খালই ছিল, নৌকা দিয়া গুয়ের মত পানি পার হয়া রায়সা বাজার কিংবা পাতলা খান লেনের দিকে যাওয়া যেত—জোবেদা বেগম তার স্কুলে যাচ্ছিল; সে যখন লালমোহন সাহা স্ট্রিটের কাছের গুদারী ঘাটে পৌছায় তখন এপাড়ের ঘাটে সোয়ারিতে ভরা একটা ডিঙ্গি নৌকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, এই সময় জোবেদা বেগম দৌড়ায়া যায় নৌকায় উঠে পড়ে, ফলে নৌকা টলমল করে ওঠে, খেয়ার মাঝি তাকে ধমকায় এবং নেমে যেতে বলে। জোবেদা বেগমের হয়তো সেদিন পরীক্ষা ছিল, দেরি হলে হয়তো ঝামেলা হয়া যেত, “তাই সে নৌকা থেকে নামতে অস্বীকার করে, কিন্তু নৌকাটা এমনিতেই অতিবোঝাই থাকায় মাঝি কোনভাবেই তাকে নিতে রাজি হয় না; তখন জোবেদা বেগম ভিড়ের মধ্যে খৈমনকে দেখে, খৈমন কোথাও যাচ্ছিল, তার তাড়া ছিল কিনা বোঝা যায় না, কিন্তু জোবেদা নিশ্চয়ই ভাবে যে স্কুলে না যাওয়া বেকার মেয়ের আবার তাড়া কি, সে অনায়াসে পরের নৌকায় আসতে পারে, তার পরেরটায় আসলেই বা কি অসুবিধা! কিন্তু খৈমন তা মানবে কেন? জোবেদা বেগম যখন তাকে নেমে যেতে বলে সে রাজি হয় না, সে বলে, ক্যালা?
: পরে আয় ছেমড়ি, যা নাম, আমার স্কুলে যাওন লাগব!
খৈমন তখন ক্ষেপা ষাড়ের মত জোবেদা বেগমের উপর ঝাপায়া পড়ে, দুইজনের মারামারিতে নৌকা কাইত হয়া যায়, ফলে সব সোয়ারি যায়া পড়ে পচা পানিতে; তখন বোঝা যায় যে জোবেদা বেগমের খুব জরুরি তাড়া হয়তো ছিল না, কারণ সেদিন পানিতে ভিজা তারা দুইজন হেঁটে হেঁটে ঘরে ফেলে। তবুও হয়তো জোবেদা বেগম বিষয়টা মেনে নেয়, খৈমন বয়সে ছুটু বলে পরে, হয়তো সে ঝগড়া মিটায়া ফেলতে চায়, রাস্তায় আলাপ জমাইতে চায়, বলে, কৈ যাছ?
: খালার বাইতে যামু।
কিন্তু খৈমনের স্বভাব খারাপই, ক্ষেপলে লেঙ্গুরে আগুন দেয়, যা তা কাণ্ড করে, ফলে এই আপোষ প্রচেষ্টা বেশি দূর আগায় না; তখন হয়তো জোবেদা বেগম ক্লাস এইটে দুইবার ফেল করে ঘরে বসে আছে, বর্ষায় অথবা কোন এক ঋতুতে চন্দ্রকান্ত বসাকদের বাড়িতে ঝুলন উৎসব শুরু হয়, মঞ্চের মত কাঠের একটা কাঠামোর সঙ্গে ফুল এবং লতাপাতা দিয়া ঢাকা একটা দোলনা বেন্ধে রাধা-কৃষ্ণের দুইটা মূর্তি বসায়া উলুলু করে তারা দড়ি দিয়া টেনে দোলায়। মহল্লার লোকেরা দল ধরে ঝুলন দেখতে যায়, একদিন হয়তো জোবেদা বেগম যায়া দেখে সেখানে খৈমন হাজির, চুকান্তের মেয়ে পূর্ণলক্ষ্মীর সঙ্গে সে গুজুরগুজুর করে; জোবেদা বেগম তখন মায়ারানির দেওয়া প্রসাদ খায়া পূর্ণলক্ষ্মীকে জিগাস করে, কিরে পূর্ণ, কি করছ?
: কথা কই।
: এত কি কথা কচ!
খৈমনের তখন রাগ হতে থাকে, ক্যালা আমার লগে কথা কওন যায়? খালি তুমিই কথা কয়া পার-কেলেছ এইটে দুইবার ফেল দিছ!
জোবেদা বেগম ছাড়ে না, তুইতো একটা গোল্লা, সে বলে, নামও লিখা পারছ না, ক্লাসরে কচ কেলেছু, ফকিন্নি একটা!
ফকিরনি বলায় খৈমনের চেহারা লাল হয়া আসে, প্রথমে মনে হয় যে, সে কেন্দে দেবে, কিন্তু তা না করে সে আবার আক্রমণ করে, আমারে কও ফকিন্নি, নিজের চেহারাটা দেখছ? চাকরানি বেডি!
কিন্তু চাকরানি বলার পরেও জোবেদা বেগমেরই আগে বিয়া হয়, বাপের ৬২নম্বর বাসা ছেড়ে শ্বশুরের ২৫নম্বর বাসায় এসে ওঠে, অন্যদিকে খৈমনের ভাগড়া স্বাস্থ্য এবং ভাল চেহারা হলেও তার বিয়ার জন্যই পাত্র পাওয়া যায় না, তারপর পাওয়া যায় এক তরকারিঅলাকে এই তরকারিঅলা ময়না মিঞা একাত্তর সনে জিঞ্জিরা থেকে ফিরা আসার পর কাজকর্ম না করে শ্বশুরের বাসায় শুয়ে বসে খায়, বলে যে, বাজারে যেতে তার ভর করে। তখন, রাজাকার আসার আগে অথবা পরে মহল্লা থেকে পোলাপান মুক্তিযুদ্ধে যেতে শুরু করে, রশিদুল যায়, জোবেদা বেগমের আইএ পাশ স্বামী গোলাম রহমান যায়, কিন্তু ময়না মিঞা নড়ে না, সে মহল্লায় থেকে যায়, হয়তো সে সত্যি যুদ্ধকে ভয় পায়; এবং ফখরুল আলম লেদুকে মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমান যখন বলে যে, মামুন চুলার জন্য ভুসি আনতে গেছে, তখন মামুনুল হাই হয়তো চটের ছালা বগলে করে দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এল্ড টিম্বার ডিপার্ট এর সামনে এসে খাড়ায়। কাঠ চেরাইয়ের কারখানার কুলি এবং শ্রমিকেরা সব গাধাই, যদিও তারা চালাকিও খুবই জানে; এই করাত কলের কুলি-মজুরদের কাছে মামুন মিঞা হয়তো পরিচিতই ছিল, সে এক/দেড় মাস পর পর এসে হাজির হয়, এবং দরদাম করে এক কস্তার নামে তার মায়ের জোড়া দেওয়া ছালায় দেড়/দুই বস্তার মাল নিয়া চলে যায়, তারা কিছু মনে করে না, কারণ সকলেই এইরকম করে। কিন্তু এই দিন, হয়তো এইদিনও বৃষ্টি ছিল, অথবা ছিল না, হয়তো বৃষ্টির পর শুকনা শরৎ শুরু হয়েছে, তখন সে এসে খাড়ায় এবং তাকে দেখে স মিলের শ্রমিকেরা, বিশেষ করে কুলিরা কানাঘুষা করে, তাদের মনে হয় যে, এই ছেলেটাকে কি তারা পনের দিন কিংবা এক মাস কিংবা দুই মাস আগে কাঠের ভুসির সঙ্গে ট্রাকে করে পাচার করে দেয় নাই? তখন দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট এর বোকা কিংবা চালাক কুলিরা বিষয়টা প্যাচায়া ফালায়, এই বিষয়ে মালিকের কড়া নিষেধ সত্ত্বেও এই কুলিদের-হয়তো তাদের নাম ছিল ইদ্রিস, মকবুল, শ্রীধর দাস-কোন পোকায় কামড়ায়, তাদের মন কেমন ছটফটায়, ছোট একখান বিবেক নিয়া তারা পুনরায় কাহিল হয়া পড়ে, তাদের মনে হয় যে, কার জানি পোলা আহা, এবং তখন তারা হয়তো ইদ্রিস এবং মকবুল-ভূতের গল্লিতে এসে মামুনদের বাড়ি খোজে। তারা একে জিগাস করে, তাকে জিগাস করে, এবং তারপর ২৫নম্বর বাড়ির বাইরের উঠানে কামিনি ফুল গাছ তলায় যায় ডাক পাড়ে।
মামুনের মা, মিসেস জোবেদা বেগমের মনে হয় যে, এটা কোন এক ধরনের ষড়যন্ত্রই ছিল, কারণ, তার পোলা বাসায় থাকতে কেউ যদি বাসায় এসে বলে যে, আপনের পোলা আপনের পোলা না, তাহলে কেমন লাগে, তখন ব্যাপারটা কেমন হয়! সেদিন দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট এর দুই ভূত এসে কামিনি গাছ তলায় খাড়ায়া ডাকাডাকি করে, বাড়িতে কে আছেন? বাড়ির ভিতরে মামুনের মা ছিল, তার মনে হয় যে, এইটা নির্ঘাত ডাকপিয়ন হবে, ওয়ারি সাব-পোস্টাপিসের খাকি রঙ্গের পোশাক পরা পিয়ন কালেভদ্রে কোন চিঠি নিয়া ভাদের বাসায় আসে, হয়তো কোন একটা পোস্টকার্ড কিংবা একটা খাম নিয়া এসে অতিভদ্রলোকের মত ডাক দেয়, এই ডাক শুনে ঘরের লোক ঠিক বুঝতে পারে যে, এইটা ডাক পিয়নই, ডাক পিয়নরাই এমন মোলায়েম হয়; কিন্তু করাত কলের কুলিদের ডাকাডাকি শুনে ঘর থেকে বের হয়া জোবেদা বেগম দেখে যে, দুইটা লোক পিয়নের মত ডাকে কিন্তু তারা পিয়ন না। যাহোক, জোবেদা বেগম যখন দেখে গাছ তলায় দুই বান্দা খাড়ায়া, তার মনে হয় যে, এরা হয়তো মহল্লার রাইতের পাহারাদার কিংবা অন্য কিছু একটা হবে, সামনে রোযা আসছে, তারপর ঈদুল ফিতর আসবে-হয়তো কোন না কোন বকশিসের জন্য এইগুলা এসে খাড়া হয়েছে। কিন্তু ইদ্রিস এবং মকবুলতে অবশ্যই বকশিসের জন্য আসে নাই, তারা করাত কলের শ্রমিক, বকশিস
তারা চেনে না এবং তারা যখন জিগাস করে, এইটা মামনুগো বাসা না? তখন জোবেদা বেগম বিভ্রান্ত হয়, কারা এরা, কি চায় এই ব্যাটারা? এবং সে বলে, ই ক্যালা? . সেদিন, তারপর, ইদ্রিস এবং মকবুল গাছের তলা থেকে বারান্দার উপরে খাড়ানো মামুনের মার কাছে আগায়া আসে এবং যখন নিচা পারে বলে যে, তার ছেলে মামুন হারায়া গেছে, করাত কলের কাঠের ভুসির সঙ্গে ট্রাকের ভিতরে করে পাচার হয়া গেছে সে, মামুনের মা হঠাৎ মনে হয় যেন ভ্যাবাচেকা খায়া থাকে, বলে কি লোকগুলা!
কি কন আপনেরা, সে বলে।
কিন্তু এই লোকেরা, অর্থাৎ ইদ্রিস এবং মকবুল মামুনের মার আচরণ দেখে উল্টা ভ্যাবাচেকা খায়, তারা বুঝতে পারে না যে, ব্যাপারটা কি, হারাইনা পোলার খবর শোনার পরেও পোলার মায়ের কোন বিকার নাই; তারা এক অদ্ভুত সঙ্কটে পড়ে চুপ মেরে থাকে, উপায় খুঁজে পায় না, তাদের মনে হয়, উপকার করতে আইস কি যন্ত্রণায় পড়লাম, কিন্তু তখন তারা বলে যে, তারা যা বলে তা ঠিকই বলে।
: আপনে ভুসির চুলা জ্বালান না?
: জ্বালামুন ক্যালা!
: আপনের পোলা পনরা দিন কিংবা এক মাস আগে তুসি আননের লাইগা নায়াবাজার গেছিল না?
: যায়া পারে, কাইলইতো জুছি লায়া আইলো!
: আপনের পোলা আয় ফিরা আসে নাই!
তখন জোবেদা বেগম বিচলিত হয়, তাহলে কাইল ভুসি নিয়া ফিরা আসলে কে? সে বলে, আপনেরা কন আমার পোলা মামুনে ভূছি লয়া ফিরা আহেনিকা?
তখন করাত কলের এই দুই শ্রমিক বলে যে, মামুন মিঞার হারায় না যাওয়ার কোন কারণ নাই, সে অবশই হারায়া গেছে, কারণ তারা তাদের কাস্টমারদের চেনে, তারা মামুন মিঞাকেও চেনে, এবং তারা জানে যে, মামুন পনের দিন কিংবা এক মাস আগে করাত কলের মালিকের টেরাকে কাঠের ভুসির লগে চলে গেছে। তারপর তারা যখন বলে যে, এখনো করাত কলে যায়া খুজলে হয়তো মামুন মিঞার খোঁজ তার মা জানতে পারবে, জোবেদা বেগমের মনে হয় আসলে হয়তো এই গাধা দুইটা কোথাও কিছু একটা প্যাচ খাওয়ায়া ফালাইছে; সে বলে, তাইলে ভুছি লয়া আইলো কেঠা?
: আপনের পোলা আসে নাই, তারে জলদি খুঁজেন।
: আপনারা কেঠা?
: আমরা কেউ না, মামুনরে অখনেই যায়া খুঁজেন, করাত কলের মালিকরে যায়া জিগান,পরে পাইবেন না।
জোবেদা বেগমকে ভয় পাইতেই হয়, সে হৈচৈ করে, কিন্তু কাউকে পায় না যে বলবে, দেখতো মামুনে কৈ, অরে ডাইকা আনতো, ফলে বিষয়টা ছড়ায়া পড়ে, মহল্লার দুই/একজন মহিলা এসে জোটে, এবং তারা যখন জোবেদা বেগমের সমস্যার কথা শোনে, তারা বুঝতে পারে না যে, আসলে সমস্যাটা কি, জোবেদা বেগম তাদেরকে বলে যে, নয়াবাজারের দুই ব্যাটা এসে তাকে বলে গেল মামুন পনেরবিশ দিন কিংবা এক মাস আগে কাঠের ভুসি কিনা আনতে যায় আর ফিরা আসে নাই, এবং যে কাঠের ভুসি নিয়া ফিরা আসে—সে মামুন না! মহল্লার এই মহিলারা তাজ্জব হয়া যায়, তারা জিন্দেগিতে এই রকম কৃগ্ধা শোনে নাই, তারা বলে, আপনে আফা চিনা পারলেন না, মামুনে যে মামুন না আপনে বুজা পারলেন না?
: না, পারি নাইতো।
এই মহিলাদের তখন সন্দেহ হয় যে, আসলে হয়তো ভুসি আনতে যায়া মামুন আর ফিরাই আসে নাই, হয়তো ভুসি টুসি কিছুই কেউ আনে নাই, জোবেদা বেগম হয়তো ভুলে গেছে, সে হয়তো দুই মাস আগে আনা পুরান ভুসি জ্বালায় এবং আন্দাজে বলে যে, মামুন ভুসি নিয়া ফিরা এসেছে; তখন তারা বলে, আপনে আফা মনে কইরা দেখেন, হাচাই মামুনে যাওনের পর ফিরা আইছিল, নিকি আহে নাইকা, আপনে হুদাহুদি মনে করতাছেন যে ভুছি লয়া আইছে, আদতে হয়তো আহে নাইকা।
তখন জোবেদা বেগমের মত শক্ত মহিলাও এলোমেলো হয় পড়ে, তার মনে হয়, তাহলে মামুন কি ভুসি আনতে যাওয়ার পর আসলেই ফিরা আসে নাই? কি সে দ্রুত তার মনের স্বচ্ছতা ফিরা পায় এবং সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য ভিতরে যায়া দেখে যে, রান্না ঘরের বারান্দায় ভুসির নতুন ভরা বস্তা রাখা—কেউ ভুসি আনতে যায়া থাকলে অবশ্যই সে ভুসি নিয়া ফিরা এসেছিল! মহল্লার দুই মহিলার কাছেও তখন পরিষ্কার হয় যে, তাহলে ভুসির বস্তা নিয়া কেউ ঠিকই ফিরেছে, এখন প্রশ্ন হলো, এইটা কে? মামুন যদি হারায়া যায়াই থাকে, তাহলে ভুসি নিয়া কে ফিরলো, এইটা কে, কেঠা?
মামুনের মা বিচলিত হয়, তখন হয়তো মামুনের ছোটভাই মাহমুদ বাড়ি ফেরে, হয়তো তার বাপ গোলাম রহমানও আসে এবং তারা জোবেদা বেগমের কথা শুনে কিছুই বোঝে না, কিন্তু তখন আসল অথবা নকল মামুনকে খুঁজে বের করা জরুরি হয়া পড়ে। তারা টিপু সুলতান রোডের মাথায় খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের কাছে পোলাপানদের পায়, এই বালকেরা। ভাঙ্গা খাপরা এবং টেনিসবল দিয়া সাতখাপরা খেলায় ব্যস্ত ছিল, গায়ে ছুড়ে দেওয়া বল লাগার ভয়ে মামুন হয়তো লুকায়া ছিল কাছেই, সহসা সে বের হয়া আসে এবং তার বাপের কবলে পড়ে। মামুনকে যখন বাসায় ধরে আনা হয়, সে বুঝতে পারে না কি অপরাধে তার কি শাস্তি হতে যাচ্ছে, তবে সে বোঝে যে, কিছু একটা হবেই, তার মার হাতে পড়লে সে এমনিতেই ছেড়ে দেবে না। তাকে জোবেদা বেগমের হাওলা করার পর, জোবেদা বেগম তাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে, অন্য ঘরে যায় তার নাম ধরে ডেকে দেখে সে ঠিকমত সাড়া দেয় কি না, স্কুলের কথা জিগাস করে, তুই কোন ক্লাসে পড়? এবং তার এই প্রশ্ন শুনে মামুন ঘাবড়ায়া যায়, কিন্তু জোবেদা বেগমের কিছু করার থাকে না, মামুনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে এইসব করতেই হয়, এবং অবশেষে সে যখন বলে, তর জন্ম দাগটা দেখি, মামুন হাফ প্যান্ট গুটায়া তার বাম উরুর কালা জড়ল দেখায়। তখন জোবেদা বেগম এইসব প্রমাণ অবিশ্বাস করতে পারে না, তার মনে হয় যে, এই মামুন মামুনই, ভেজাল না, করাত কলের দুই গরু এসে সব উল্টাপাল্টা বলে তার মাথা খারাপ করে দিয়া গেছে; সে বলে, তুই যা খেলা গা, এবং মামুন খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া একটা পাখির মত ফুরুৎ করে উড়ে যায়। তখন জোবেদা রহমানের অবশ্যই মনে হয় যে, ব্যাপারটা আসলে কি? এই দুইটা লোক এসে তার সঙ্গে এমন আচরণ করে গেল কেন? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর তাকে কে দেবে? কাজেই এই ঘটনার কথা সে ভুলে যায়; কিন্তু তখন বহুদূরে ট্রগ্রামের সাতকানিয়ায় আসমানতারা হুরে জান্নাতের হাতের ভিতর দড়ি বান্ধা অবস্থায় খরকোস বড় হয়া ওঠে, করাত কলের ঘটনার কথা সে ভুলে যায়, শুধু স্মৃতির একটা কৌটার মধ্যে সে পায় তার নাম এবং ঠিকানা। ফলে আসমান তারার খরকোস পনেরবিশ বছর পর আর এক বিকালে বুড়া কামিনি গাছ তলায় এসে হাজির হয়, এবং বলে যে, তার নাম মামুন মিঞা, সে অনেক বছর আগে হারায়া গেছিল, তখন জোবেদা বেগমের সামনে বহুবছর পর পুরান প্রসঙ্গ এসে খাড়া হয়, এবং সে ভাবে যে, এইগুলা আসলে কি? এর উত্তর হয়তো দেওয়া মুশকিল-এইগুলা আসলে কি—তবে এই জটিলতার কারণ হচ্ছে এই যে, করাত কলের কুলিরা চালাক হলেও, তারা যা, তাই; তারা একটা ছেলেকে কাঠের ভুসির সঙ্গে পাচার করে দেয়, ঠিক আছে, ছেলে ভুসি আনতে গেলে ভুসির সঙ্গে সে পাচার হয়া যেতেই পারে, তরা বাবা চুপ মাইরা থাক, কিন্তু তা হওয়ার নয়, তাদের জিলা নড়বেই, ফলে তখন ট্রাকের ভিতরে পাচার হয়া যাওয়া বালকের পরিচয়ের বিষয়ে তারা গলা নামায়া আবার আলাপ করে দেখে, করাত কলের এই কুলিরা একমত হয় যে, এরা সকলেই প্রায় বান্ধা গ্রাহক, মামুন মিঞার সঙ্গে তাদের এর আগে আলাপও হয়ে থাকতে পারে, সে দক্ষিণ মৈশুন্দি ভূতের গল্লির পোলা—সে মামুন মিঞাই; তখন করাত কলের এই শ্রমিকদের কথা যখন আব্দুল মাবুদ চৌধুরির কানে যায়, সে এই গাধাদের চুপ থাকতে বলে এবং ফোন করে তার ছোট ভাই আব্দুল ওদুদ চৌধুরিকে ভুসির মধ্যে মামুন মিঞার পাচার হয়া যাওয়ার খবর দেয়, কিন্তু আব্দুল ওদুদ চৌধুরির বিষয়টা বুঝতে অসুবিধা হয়, সে বলে, আঁই অনের হতা ন বুজিদ্দে।
আব্দুল মাবুদ চৌধুরি তাকে বিষয়টা বুঝায় বলে, ট্রাকের ভুসির সঙ্গে কুলিরা একটা মরা অথবা আধমরা ছেলেকে তুলে দিয়েছে, তার নাম মামুন, সে ঢাকার নারিন্দা ভূতের গল্লির পোলা; ওদুদ চৌধুরির তখন চিন্তা হয়, বুঝতে পারে না যে, পুলিশের কাছে ধরা পড়া ট্রাকগুলার ভিতর ছেলেটা ছিল কিনা, সে বিভিন্ন জায়গায় তার কর্মচারিদের ফোন করে জানতে পারে যে, ট্রাক সাতকানিয়ার দিকে গেছে, হয়তো সেটা এর মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে, অথবা পৌঁছে যাবে।
সেইদিন মামুন মিঞা যখন ভুসির ভিতরে করে পাচার হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল তখন সাতকানিয়ার বোয়ালিয়া পাড়ায় আসমানতারা হুরে জান্নাত তার মা ডলি আক্তারকে সকাল থেকে খুব জ্বালায়, হয়তো জন্মের আগেই পেটে থাকতেই সে তার মাকে ত্যক্ত করতে শুরু করে; সস্তানের জন্মদান ডলি আক্তারের জন্য নতুন কিংবা জটিল কঠিন বিষয় কখনোই ছিল না, সময় হয়ে গেলে, প্রতিবেশী আম্বিয়ার মাকে খবর পাঠায়া ঘরের দরজা টেনে দিয়া, অনেক সময় আমিয়ার মা আসার আগেই সে তার কাজ সেরে বসে থাকে, তখন আম্বিয়ার মা এসে হয়তো গর্ভের ফুল পরার জন্য প্রতীক্ষা করে, ফুল বের হয়া এলে ব্লেড দিয়া নাড়ি কেটে বাচ্চাকে গোসল দিয়া সাফসুতর করে, প্রসূতির কাপড় বদলায়া মেঝে থেকে খাটের উপর ওঠায়, তারপর বাচ্চা তার কোলে দিয়া সে ঘর পরিষ্কার করে এবং শেষে রক্তাক্ত ফুল, ডলি আক্তারের পরনের নোংরা কাপড়, মেঝেতে পাতা খেতা, রক্ত মোছার তেনা, এইসব নিয়া যায়া চৌধুরি বাড়ির ভিটার পিছনে পুকুরের পুব দিকে দেওয়ালের পাশে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। বহুবছর আগে যখন আর প্রথম বাচ্চা হয় ছেলের মুখ দেখে ডলি আক্তারের খুশি লাগে, কারণ তার মনে হয় এরপর মেয়ে হলে কারো কিছু বলার থাকবে না; তখন আব্দুল আলি চৌধুরি হয়তো বেঁচে ছিল, বড় ছেলে আব্দুল মাবুদ প্রথমে চিটাগাং শহরে তারপর ঢাকায় যায় স্থায়ী হওয়ায় তার মনে আনন্দ ছিল না, কিন্তু ওদুদ চৌধুরি বিয়া করে বৌ সাতকানিয়ায়ই রেখে দেয়ায় সে খুশি হয়, তারপর যখন ডলি আক্তারের ছেলে হয় বুড়ার মুখে আর হাসি ধরে না, সে নাভির ডাইন কানে আল্লাহুআকবর আল্লাহুআকবর বলে মৃদু স্বরে আযান দিয়া, নাম রাখে আব্দুল কাদের চৌধুরি; নাতি তার বড় হয়, এবং আব্দুল আলি চৌধুরি তাকে কোলে নিয়া ও দাদা ও দাদা করে। পনের মাস পরে ডলি আক্তারের দ্বিতীয় বাচ্চা হয়, এইটাও ছেলে, আম্বিয়ার মা এসে দেখে যে, ডলি আক্তার প্রসবের কজি পুনরায় সেরে রেখেছে, আম্বিয়ার মা নবজাতক এবং প্রসূতিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে খাটের উপর তুলে দেয়, বুড়া আব্দুল আলি হয়তো সাতকানিয়া বাজারে টহল দিয়া ফিরা আসে, এসে শোনে আর একটা নাতি হয়েছে তার, সে বলে, আলহামদু লিল্লাহ, এবং ডাইন কানে আযান দিয়া নাম রাখে মোহসিন আলি চৌধুরি। তখন পরপর দুই ছেলের জন্ম দিয়া ডলি আক্তারের পায়া ভারি হয়া যায়, সে আবার ভাবে যে এইবার মেয়ে হলে আর কোনই ভয় নাই, কিন্তু পনের মাস পরে ডলি আক্তারের আবার ছেলে হয় এবং আব্দুল আলি বাচ্চার নাম রাখে নুরুল হক চৌধুরি। উলি আক্তার যখন চতুর্থবারের মত গর্ভে সন্তান নেয় তার খুবই মনে হয় যে, একটা মেয়ে হোক, আঁরে একয়া মাইয়াগোয়া অও খোদা, হয়তো জায়নামাজে বসে হাত তুলে কান্দে, হয়তো একটা মেয়ে চায় বুড়া আব্দুল আলিও, কিন্তু তাদের প্রার্থনা কবুল হয় না, পুনরায় ছেলে হয় এবং আব্দুল আলি তার নাম রাখে রইসুদ্দিন চৌধুরি। ডলি আক্তারের মন খারাপ লাগে, সে একে বলে, তাকে বলে, কেন তার একটা মেয়ে হয় না, ওড়ি আম্বিয়ার মা, আঁর বেতন মদপোয়া, আঁতুথে খুশি ন লার, আঁর একগুয়া মাইয়াফোয়া ন হয় কিয়া! আম্বিয়ার মা বিষয়টা ভেবে দেখে, তার প্রথমে মনে হয় যে, এরকম হতেই পারে, অনেক মহিলার কোন মেয়ে হয় না, আবার অনেক মহিলার কোন ছেলেই হয় না; তখন উলি আক্তার পুনরায় তাকে মেয়ে কেন হয় না জিগাস করলে সে তাকে সব বুঝায়া বলে, তারপর তার কি ঘটে, তার মাথায় একটা ভাবের উদয় হয়, এবং সে বলে যে, হয়তো এইটা এক রকমের অসুখ। কিন্তু এই কথা ডলি আক্তারের ভাল লাগে না, সে সাতকানিয়া গালর্স স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মেয়ে, সে জানে এসব কোনই অসুখ না; তবে সে তার কোমরের চারপাশে তাবিজ বেন্ধে ভরায়া ফালায়, কিন্তু চৌদ্দ কিংবা পনের মাস পরে তার পঞ্চম ছেলে হলে সে ভেঙ্গে পড়ে, বুড়া আব্দুল আলি তবু খুশি, সব বাচ্চাই আল্লার দান, সে নাতির নাম রাখে শাজাহান আলি চৌধুরি। তখন আর একবার আম্বিয়ার মার কথাটা ভুলি আক্তারের মনে পড়ে, কিন্তু সে নিশ্চিত হয় যে মূর্ব আম্বিয়ার মা কিছুই জানে না, খামাখা বেশি কথা বলে, তারপরেও তার মন খারাপ লাগে এবং সে বিচলিত ও বিভ্রান্ত হয়। পড়ে, এবং তখন সে ষষ্ঠ বারের মত গর্ভ ধারণ করে। সে মন মরা হয়া থাকে, মেয়ে হয়াও তার জরায়ুতে মেয়ে সন্তানের জায়গা নাই, তার ক্ষুধামন্দা দেখা দেয় এবং রাইতে সে অদ্রিায় আক্রান্ত হয়, তাকে বারে বারে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, কিংবা বাড়ির লোক যায় ডাক্তার ডেকে আনে। মোজাহার ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে, যন্ত্র বের করে রক্তচাপ মাপে, চোখের নিচের পাতা টেনে সে দিকে তাকায়া থাকে, এবং সে বলে, অনের অবস্থা তো গম নয় ভাবি, হাওয়াহাইদ্য ঠিকমত ন খান ফানলার!