নারী শরীর নিয়ে এতকাল পুরুষেরা লিখেছেন, এঁকেছেন, গড়েছেন তাঁদের মনের মাধুরী মিশিয়ে। নারীর অধিকার ছিল না নারীর শরীর নিয়ে লেখার। মন নিয়ে লিখতে পারে, কিন্তু শরীর নিয়ে নয়। কিন্তু নারী-লেখক-কবিরা এখন পুরুষের তৈরি করা গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তাঁরা তাঁদের শরীর নিয়ে তাঁদের মতো করে লিখছেন। নারীর শরীর যে পুরুষের সম্পত্তি নয়, অথবা পুরুষ-লেখক-কবিদের অধিকৃত বিষয় নয়, তা নারী-লেখক-কবিরা যদি অনুধাবন করতে পারেন, তবে সাহিত্যের জগতে খুব বড় একটি পরিবর্তন দেখা দেবে। বাঙালি সমাজ কুৎসিত পুরুষতন্ত্র দ্বারা এখনও আক্তান্ত, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে পুরুষতান্ত্রিক নিয়মনীতিগুলো ভাঙার চেষ্টা সামান্য হলেও চলছে, সম্ভবত বাঙালি নারী-লেখক-কবিদের অনেকেই সুশিক্ষিত এবং স্বনির্ভর এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন বলেই। কিন্তু সমাজে এখনও নারী অসহায়, এখনও নারী পণ্য, ভোগ্যপণ্য, যৌনসামগ্রী হিসেবেই চিহ্নিত। নারী ইস্কুল কলেজে যাচ্ছে, কিন্তু সত্যিকার শিক্ষিত হচ্ছে না। নারী উপার্জন করছে, কিন্তু পুরুষের ওপর নির্ভরশীলই থেকে যাচ্ছে। বেশির ভাগ নারীই পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক। বেশির ভাগ নারীই জানে না যে তারা নির্যাতিত। বেশির ভাগ নারীই ভয় পায় বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেতে। নারীর জন্য এই অসহায় অবস্থাটি সৃষ্টি করেছে এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। নারী এই সমাজে পুরুষের দাসী। খালি চোখে দাসীকে দাসী বলে মনে হয় না যদিও, সম্পর্কের গভীরে গেলেই বোঝা যায় যে দাসী। নারী যখন প্রেমিকা, সে দাসী, নারী যখন স্ত্রী, তখনও সে দাসী। উন্নতমানের দাসী। পুরুষ প্রেমিক বা স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে চলতে হয় তাকে। পুরুষ যেভাবে চায়, নারীর সেভাবে নিজেকে গড়তে হয়। সাজসজ্জা, আচার ব্যবহার, দোষগুণ সবকিছুর ধারণাই পুরুষের তৈরি করা। প্রেম ভালোবাসা পুরুষের জন্য অস্ত্র, নারীকে দুর্বল করার। প্রভু এবং দাসীতে প্রেম হয় না। পণ্যের সঙ্গে আর যাই হোক, প্রেম হতে পারে না। নারী নিজের যৌনইচ্ছের কথা প্রকাশ করলে তাকে ছি ছি করে সমাজের সকলে। নারীর যৌনকামনা থাকতে নেই, থাকলে সে নির্লজ্জ, সে নষ্ট, সে বেশ্যা। নারী তার শরীর সাজাবে পুরুষের জন্য, নিজের জন্য নয়। নারী বেঁচে থাকবে পুরুষের জন্য, নিজের জন্য নয়। এরকমই তো নিয়ম। ক’জন নারী জানে সঙ্গমে শীর্ষসুখ বলে একটি ব্যাপার আছে! খুব কম নারীই জানে। বেশির ভাগই মনে করে যৌনতা পুরুষের জিনিস। নারী শুধু পুরুষের আনন্দের জন্য ব্যবহৃত হবে। শরীর নারীর, কিন্তু এতে অধিকার পুরুষের। নারী এক হাত থেকে আরেক হাতে সমর্পিত হয় সারাজীবনই। তার মালিক বদলায়। পিতা থেকে প্রেমিকে, প্রেমিক থেকে স্বামীতে, স্বামী থেকে পুত্রতে। নারীর জীবন তো নারীর নয়। বিভিন্ন সম্পর্কের পুরুষের কাছে নারী বাঁধা, শৃঙ্খলিত। এই যখন অবস্থা আমাদের সমাজের, তখন নারী-লেখক-কবিরা যখন নিজের শরীরের ওপর নিজের অধিকারের কথা লেখেন, যৌনস্বাধীনতার কথা লেখেন, তা হয়তো সমাজের সত্যিকার রূপকে তুলে ধরে না, কিন্তু একধরনের বিপ্লব, সেটি ছোটখাটো হলেও, কাগজে কলমে হলেও, ঘটায়। অনেকটা আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো, কেউ জ্বালিয়ে দিল, এখন কেবল ছড়িয়ে পড়লেই হলো। যে মেয়েরা লেখক-কবি নয়, তাদের মধ্যে আগুন নেই তা নয়, কিন্তু তাদের আগুন তাদের মধ্যেই থেকে যায়, প্রকাশ হয় না খুব। তাই সমাজ পরিবর্তনে শিল্পী সাহিত্যিকরা সবসময়ই খুব বড় ভূমিকা রাখে।
আমি নাকউঁচু সমালোচকদের মতো করে বলবো না যে শরীর নিয়ে লিখলেই তো শুধু হবে না, লেখা সাহিত্যপদবাচ্য হল কি না তা দেখতে হবে। না, আমি তা দেখবো না। মেয়েরা যাই লিখুক, যেভাবেই লিখুক, হৃদয় দিয়ে যদি লেখে, তা অন্যের হৃদয় স্পর্শ করবেই। সাহিত্যকে আমি কোনও সংজ্ঞায় ফেলতে চাই না। পাঠকের যদি ভালো লাগে, পাঠক যদি আলোড়িত হয় কোনও কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ পড়ে, তা-ই সাহিত্য। আমার ভাবনাটি এরকম।
নারী শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে, এটি আমার কাছে অনবদ্য একটি কবিতা। শৃঙ্খল ছেঁড়ার বা ভাঙার যে শব্দ, সে শব্দ আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গীত। এ নিয়ে কেউ যদি গল্প লেখে বা কবিতা লেখে, তা আশ্চর্য সুন্দর সাহিত্য, আমি তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। হাজার বছর ধরে পরা শেকল ভেঙে যে নারী মুক্ত হয়, সে কবিতা না লিখুক, আমি তাঁকে কবি বলি বিশ্বাস করি।