০৩. নারকেল আর কলা

নারকেল আর কলা নিয়ে ইতিপূর্বেই শ্যামের ছেলে মধু চলে গিয়েছিল। লখাই এসে বাড়িতে পা দিতেই শ্যাম বলদজোড়া ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত দেখল লখাইয়ের মুখের দিকে, তারপর বলল, এট্ট ঘরোয়াভাবের তুমি হও দিকি বাপু। ছাড়া পেলে তো দেখি তোমার কিছু মনে থাকে না। মধু এল সেই কখন, আর তুমি আতপুরের ঘাটে এতক্ষণ করছিলে কী?

এক মুহূর্তেই লখাই বুঝতে পারল, শুধু কালী বৌঠান নয়, কাঞ্চন বউয়ের দুরন্ত ক্রুদ্ধ চোখও কোন বেড়ার ফাঁক থেকে তাকে বিঁধছে। বলল, ওই চুড়োর সঙ্গে এটু

চেঁকিঘরের পাশ থেকে আচমকা বটির কোপের মতো কালীর তীঙ্গ গলা ভেসে এল, কলকে সেবা করে এলাম, কেমন? আর আমরা যে ইদিকে দুটো মাগী উপোস বসে আছি পুজো দিতে যাব বলে, সে জানা কথাও কি গাঁজায় দম মেরে দিয়েছে? দ্যাখো তোমরা, মিনসের চোখ দুটো একবার দ্যাখো। হ্যাঁ, এমনি কথা কালীর। চেঁচিয়ে রেগে কথা বলা তার অভ্যাস। সে যে ব্যাপারই হোক, রাগের না হোক হাসির, প্রকাশ্যে না হোক গোপনীয়, কালীর গলাই অমনি চড়া। মনে হবে মারতে আসছে বুঝি। একসময়ে পাড়ার লোকে উকিঝুকি মারত, এখন আর মারে না। এ তো খুবই সামান্য। পাড়াঘরে ঝগড়া-বিবাদের সময় সে যে-কোনও কারণেই তোক একবার যদি কালী সেখানে গিয়ে পড়ল তবে আর রক্ষে নেই। কালীই বটে, সারা জগদ্দল গাঁ চমকে ওঠে তার গলায়। আর সরস গালি দিতে তার জুড়ি মেলানো ভার। মদন কৈবর্তের মা, অথবা অমন যে বাকপটিয়সী ডাকাতনি, সেও গালে হাত দিয়ে বলে, মা গো, মাগী কী সব কথাই আমদানি করেছে বোদই থেকে। অর্থাৎ কালীর বাপের বাড়ি হল বরুতিবিলের পুবে বোদাই গাঁয়ে। তা ছাড়া খায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কালী মেজাজ রাখতে পারে না। লখায়ের রা কম, মুখে যেন মেঘের ভার। ডাকলে মিনসের চোখ তুলতেও কি না এক পোহর লাগে! প্রথম প্রথম ভেবেছিল, নতুন বলে এমন। পুরনো হলে কেটে যাবে এসব। মধু তখন পেটে, শ্যাম থাকে ঘাটেমাঠে, নারান তো ডাকাবুকো মানুষ। স্যানেদের দপ্তরের বন্দুকধরা পাহারাদার। লখাই দেবর পেয়ে প্রাণটা তার খুশিতে ভরে উঠেছিল। ওমা! কাজ করে তো কাজই করে, খায় তো খেয়েই চলে, বসে থাকে তো সারাদিন বসেই কেটে গেল। এ কী মানুষ গো কথা না হয় না বলতে পারে, বোঝবার চেষ্টাও তো করবে। মা গো! এত যে ঠাট্টা-মাট্টা করি, হেসে গইড়ে কথা বলি বোঠানের সে মর্ম কী ছাই ও কিছু বোঝে? যেন এই সেদিন পেট থেকে জন্মালো ছেলে, হাঁ করে চেয়ে থাকে। কী জ্বালা বল দিকিনি!…জ্বালাই না বটে। সে জ্বালাতেই লখাইকে গড়ে পিটে তুলবে বলে দিব্যি কেটে বসল কালী। শুতে বসতে লখাই, খেতে ধুতে লখাইমায় শ্যামের সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত। আর এ গাঁয়ের কোটনা কুটনীর মরণ নেই, তাই লখাইয়ের সঙ্গে তার পিরিত জমার ঢাক পেটায়। তাই শুনে শ্যাম গম্ভীর হয়ে থাকত, থমথমে হয়ে থাকত তার মুখ। এসব যখন কালীর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন বাড়ির পেছনে একদিন জামরুল তলায় সকলের আড়ালে শ্যামকে দুহাতে সাপটে ধরে বুকে মুখ রেখে বলল, তুমিও কি তবে অবিশ্বেস করো আমাকে?

আর নারান সর্বজ্ঞ কি না জানা নেই, কে জানে সে লখাইয়ের মনের এ বিভ্রমের কথা জানে কি না। তা ছাড়া, কাঞ্চনের প্রতি তার সে প্রাণের টানও দেখা যায় না। তবু তারই প্রতি মনসার কোপের আশঙ্কায় যেখাইকে ঘরে এনে তোলা হল, তার সঙ্গেই নারানের কেমন যেন একটা মস্ত ফারাক থেকে গেল। লখাইকে সে প্রথম প্রথম চাপা বিদ্রূপে কিছুটা তুচ্ছ জ্ঞানই করেছে, তারপর থেকে কবে যেন একটা চাপা বিদ্বেষভাব ছড়িয়ে গিয়েছে তার মনে লখাইয়ের বিরুদ্ধে। লখাইয়ের প্রসঙ্গ সে শুধু এড়িয়ে যায় না, অপরকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ কটুক্তি করে বসে।…সে কথা আর কতদিনকার আগের যেদিন বালক মধুর সামান্য সোহাগ কথায় হঠাৎ নারান তাকে এক থাপ্পড় কষিয়ে বলে উঠেছিল, ঘরে কি তোর খুড়ো একটা যে, আদর করতে এসেছিস আমার সঙ্গে?

শ্যাম শান্ত মানুষ। লখায়ের সঙ্গে কালীর সম্পর্ক তার বুকে নতুন আনন্দ এনে দিয়েছে। নারান তার সহোদর ভাই, কালীর সাক্ষাৎ দেওর। কিন্তু নারান যেন ঘরে থেকেও বাইরে। আপনার হয়েও পর। অমন সুন্দর কাঞ্চন বউয়ের মুখ চাইতে যে চোখ ফিরিয়ে থাকে, সে মানুষ কালীর কাছে ভুলেও দুদিন সোহাগ কাড়েনি, ধার ধারেনি গালগল্পের। তার মজলিস অন্যখানে, মনের খেয়ালের সাধ মেটাতে ঘরে বাইরে। সেদিক থেকে, পর হয়েও পর থাকেনি যে লখাই, কম কথার মানুষ হয়েও আপন মানুষ কালীকে চিনতে তার ভুল হয়নি। সে বললে, তুই কি পাগল হয়েছিস বউ? তবে গাঁয়ের এ মিছে রটিয়েদের একবার আমি দেখে নেব। আর এসব যদি সত্যি হত, তবে স্যানেদের পদ্মপুকুরের পাড়ের মাটি কি এতই শক্ত হয়ে গেছে যে, দু হাতে ধরে তোকে আমি পুতে দিতে পারব না?

সে কথা শুনে শিউরে উঠেছে কালী, কিন্তু শান্তি পেয়েছে। শ্যাম তাকে বার বার বলে দিয়েছে, তোর লখাই দেওর মা মনসার বর পাওয়া ছেলে, যে যাই বলুক, পেটের ছেলের চেয়ে ওর আদর কম নয়। সেদিন ঘরের ছেচে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য শত্রুকে উপলক্ষ করে প্রায় সারাদিন কালী তার নতুন পুরনো গালাগালি ও শাপ-মন্যিতে জগদ্দলের আকাশ ভরে তুলেছিল।

আর লখাই যে দেশেরই মানুষ হোক, তবু মানুষ তো! কালীকে বুঝতে তার বেশি দেরি হল না। বউঠান হয়েও কালী তার কাছে মার চেয়েও বড় হয়ে উঠল। শ্যাম বিচিত্র নীরবতার মধ্যে এক অসীম স্নেহবন্ধনে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ল সে এদের কাছে। পলাতক সিপাহির লখাই বাগদী হতে আর দেরি হল না।

কেবল তার বুকে নতুন করে শ্বাস আটকে দিল দিন দিন বেড়ে ওঠা নারানের বউ কাঞ্চন। থেকে থেকে তার কপালের কাঁচপোকার টিপের ঝিলিক তার সব চিন্তা এলোমেলো করে দেয়। ভাবে, ওই টিপ কি সোনার টিকলি হয়ে দুলতে পারত না। না কি বুবি টিকলিই কাঁচপোকার টিপ হয়ে গেছে। …

আধ ধামা মুড়ি, খানিক গুড় নিয়ে কাঞ্চন ধপাস করে বসিয়ে দিয়ে গেল দাওয়ার উপর। বাগদী মেয়ে কাঞ্চন, কিন্তু রূপের তার ধার যেন বড়ঘরের মেয়ে বউদেরও হার মানায়। মানুষটা দেখতে ছোট, কিন্তু কালীর কাঞ্চী বউ কিংখাবে লুকিয়ে রাখা ছুরির মতো শক্ত ও ধারালো। যেখান দিয়ে যায় সেখানে দাগ রেখে যায়! মুড়ির ধামাটা বসিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সে তার সব রাগটুকু প্রকাশ করে গেল। শ্যাম রয়েছে তাই গলা খুলতে পারল না সে। নইলে বুঝি খায়ের রক্ষা ছিল না।

মুড়ি দিতে দেখে কালী বলে উঠল, হাঁ, মুড়ি খেয়ে দাওয়ায় পড়ে পড়ে ঘুমোও। নেশাও জমবে, রাত জাগার বিশ্রামও হবে।বলে সে দুড়দাড় করে ঘরে গিয়ে ঢুকল।

শ্যাম বলল, নেও, মুড়ি কটা ঝট করে চিবিয়ে নে বেইরে পড়ো, আর দেরি করো না। নাইতে হয়, কালীবাড়ির ঘাটে দুটো ড়ুব দিয়ে নিয়ে।

কিন্তু লখাই তো কালীবউয়ের শুধুমাত্র বাধ্য দেবর নয়, সম্পর্কের তল তাদের আরও গভীর। তার নতুন জীবনের ভাবনা-চিন্তার গতি, রাগ-অভিমান চলা-ফেরা যাই-ই বলো, সমস্ত কিছুর নিকটতম সম্পর্ক কালীর সঙ্গেই তার। যেমন নাকি ঝড়-ওঠা নদীতে সব মানা পারে না নৌকো সামলাতে, সব মাটির চরিত্রের হদিস পায় না সব চাষী, তেমন লখায়ের জীবনের হাল ধরতে পেরেছে শুধু এক কালীবউ। স্বল্পভাষী লখাইয়ের মনের স্রোতের ধার বোবে মাত্র সে-ই। শুধু সে নয়, পরস্পর। পেটের ছেলে মধুর সব খুনসুটি সব সময় ঠাহর করতে পারে না কালী, কিন্তু এই পনেরো বছর ধরেও যে মিনসে শিশু রয়ে গেছে, তার সব কিছু তার নখদর্পণে আর লখাইও সেই নখদর্পণেই শুধু মন খুলে দেখা দেয়। কালী লখাইকে বড় হতে দেয়নি, লখাই চায়নি বড় হতে, বড় হলে বোধ করি কালীবউয়ের যমুনার মতো কালো ঢলঢলে শরীরটার মধ্যে সুকননা মমতাময়ী মনের বিচিত্র গতিবিধি চকিতে ধরতে পারত না সে।

কালীবউয়ের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকাতে গিয়ে বড় ঘরের ছোবড়া কাটা জানালায় তার চোখ আটকে গেল। রোদ পড়ে জানালার কঞ্চির এলোমেলো ছায়া পড়েছে কাঞ্চনের মুখে। বাঁকানো র মাঝে কপালের চামড়া বেঁকে টিপ খানিক সরে গেছে, তলার ঈষৎ দুই বড় চোখের দৃষ্টিতে কী দুরন্ত অভিমান, আক্রমণের অভিসন্ধিতে সে কটাক্ষ বঙ্কিম, যেন সবাক। টেপা ঠোঁটের কোণের রেখাটিতে শুধু থেকে থেকে বিচিত্র খেলার কাঁপুনি।

কালীবউকে সে বুঝতে পারে কিন্তু কালীর কাঞ্চীবউকে সে বুঝতে পারে না। যা বোঝে, সেটা বোঝা নয়, জট পাকিয়ে ওঠে ক্ষণে, ঝড় ওঠে বুকে। গাছপালা উপড়ে ফেলা এক মহা ভাঙনের সর্বনাশা ইঙ্গিত পায় সে। সেদিনের মেয়ে কী এক জাদু বলে যেন জগৎ-জুড়ে মাতন লাগিয়েছে। কিন্তু হায়, তুমি তো জানো না কাঞ্চীবউ, এই পলাতক জোয়ানের উপবাসী অন্তরের কথা। তুমি নিজের ঐশ্বর্য-গরিমায় গরিয়সী, দীর্ঘদিনের কটাক্ষে কটাক্ষে কেবলি যে ক্ষতের সঞ্চার করছ, সারা বাংলার সব নদীর প্লাবনেও তা শান্ত হবার নয়। অমন করে মেরো না আমাকে। আমি তোমাদের মা মনসার ছেলে, নারান আমার দাদাভাই কিন্তু তোমার কাঞ্চবর্ণের ধার দিয়ে এ কি রক্তাক্ত খেলা শুরু করেছ তুমি?

তবু হায়, চোখ ফেরে না। কতদিন কালীবউ কত ঠাট্টা করেছে। সে ঠাট্টা চাপা আগুনে দিয়ে উসকে তুলেছে লেলিহান শিখা। কালী ঠাট্টা করেছে, কাঞ্চন তাকে দুহাতে সাপটে ধরে গুম গুম করে কিলিয়েছে আর সেই গুম গুম শব্দের সঙ্গে কাঞ্চনের কাঁচা হাসির খিলখিল শব্দ এক বিচিত্র রঙের পাকা ছোপ ধরিয়ে দিয়েছে বুকে। সেনবাড়ির মেরজাওস্তাদের সুললিত কণ্ঠের সেই গানের কলি রিনরিন করে বেজে উঠেছে কাজে,

অয় গুল্‌ তেরি আঁখমিচোলি দিল মেরা কাটতি হ্যায়।
খুসবাশশে তেরি ছিপছিপকে দিল মেরা রোতি হ্যায়!

সে গান শুনেই না কত্তা হুকুম করেছিল কয়েদখানার সেপাইকে খিলপাড়ার পবন চাড়ালকে খালাস দিতে! দুঃসাহসী নরাধম পবন চাঁড়াল মহেশ চাঁড়ালের বিয়ের আসর থেকে তার কনেবউকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সে মেয়ের সঙ্গে তার জন্মকালের পিরিত। সেনবাড়ির লাঠিয়াল বলে অহঙ্কারে জোর করে সে মেয়েকে বিয়ে করবে মহেশ চাঁড়াল। সমস্ত খিরপাড়াকে অবাক করে দিয়ে কনেবউয়ের হাত ধরে তুলে নিয়ে এল সে। বলল, কার ক্ষমতা আছে, এসো লড়বে আমার সঙ্গে, এ বউ আমার।

কী সর্বনাশ! হোক ছোটজাতের কাণ্ডকারখানা, ঘটনা শুনে সারা হালিশহর পরগনাটাই ভয়ে ঘৃণায় রাগে সিঁটিয়ে উঠেছিল। পরের কনেবউকে বিয়ের আসর থেকে তুলে নিয়ে গেল নিজের বউ বলে!

ভাটপাড়ার শিবমন্দিরের রকে ধর্মরক্ষী বৈদিকদের পর্যন্ত আসর বসে গেল। এক সর্বনাশা বিপদের গন্ধ পেয়েছেন তাঁরা। তাঁদের আলোচনার মধ্যে খালি উত্তেজনা নয়, শঙ্কার ভাবও সুপরিস্ফুট। কেন না, তাঁরা যে জানতেন, দেশের এ অবনতি ঘটবেই। বিশেষ, জগদ্দল সেনপাড়ার মতো ম্লেচ্ছ জায়গায়। ওখানকার যত পিরুলী বামুনেরাই তো এ-সবের প্রশ্রয়দাতা। জাত-মান খোয়ানো মুসলমানের দরবারী নফর ওই পিরুলীদের উসকানিতেই ছোটজাতের এই স্পর্ধা। কেউ কেউ কাঁটালপাড়ার হাকিম চাটুজ্যের কথা বলতেও ভুললেন না। যে বিধর্মীর ইংরেজিয়ানা বাংলা কেতাবে যে সমস্ত অখাদ্য-কুখাদ্য পরিবেশন করতে শুরু করেছে তাতে সমাজেরও সাংঘাতিক অবনতি ঘটবে—এতে আর বিস্ময়ের কী আছে।

সে দিন কাটারও শেষ নেই, কারও শেষ নেই। শেষ নেই গোলাপের চোখের লুকোচুরি খেলা, ঘামগন্ধ ছড়াবার। সে তত গোলাপের ধর্ম, ধর্ম কাঞ্চনবউয়ের। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে কোমরের গামছা খুলে মাথায় বেঁধে সে কালীবউয়ের উদ্দেশে হাঁক দিল, আর দেরি নয় বোঠান জলদি চলল।

শ্যাম বলল, দেরি হতে আর বাকিটা কী আছে। মুড়ি কটা চিবেই নেও। ফিরবে সেই কোন পহরে তার ঠিক কী? ওদিকে পুজো বসে গেল বুঝি।

গম্ভীর মোটা গলায় লখাই বলল; উপোস আমিও থাকব, পুজো হলে পেসাদ খাব।

শ্যাম বোধ হয় এটুকু আঁচ করেই ছিল। ঘরের দরজার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। বুঝল, রাগ ঝামেলা মিটল এতক্ষণে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার গরুর সেবায় মন দিল সে। ওর গোঁফের পাশে লুকনো হাসির হদিস পেল না কেউ। মনে মনে সে লখাইয়ের তারিফ করে। কম কথা বলে, থাকে গম্ভীর, সব সময় লখাইয়ের ভাব বোঝা তার দায় হয় সত্যি, কিন্তু ঠিক সময়ে যথার্থ কথাটি বলে এরকম অনেক সমূহ প্রলয়কে বশ করে ফেলতে জানে লখাই। বিশেষ করে কালীবউয়ের মনের অলিগলির সব ফাঁকগুলো এমনি আয়ত্ত করে নিয়েছে সে।

হাসির দমকেই হোক বা রাগের উত্তাপেই হোক জানালা থেকে মুখ লুকাল কাঞ্চনবউ।

তবু সবাইকে চুপচাপ থাকতে দেখে শ্যাম খানিকটা আপন মনেই বলল, বোঝে সেটা তোমরা ভাজ-দেওরে। তবে যা করতে হয়, একটু তাড়াতাড়ি করো, রোদে তো উঠোন ভরল দিকি।

ঘর থেকেই শোনা গেল কালীর গলা, ভরুক। রোদ তো কারুর মর্জি মেনে চলে না আমাদের মতো। কই লো কাঞ্চী, তরকারি কী আছে, কেটে কুটে নে, আমি উনুনে আগুন দিই, ভাত ডাল তোত রয়েইছে কালকের। তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলল, সোহাগ দেখে আর বাঁচি না।

দুই বউ উপোস থাকবে, তাই গতকাল রাত্রেই ভাত ডাল রান্না করে রাখা ছিল। ছিল না কিছু তরকারি বেনুন। কথা ছিল, আম আর জল্পাই আচারের টাকনা দিয়েই পুরুষেরা ভাত খাবে।

কপট বিপদে শ্যাম তাকাল লখাইয়ের দিকে। কিন্তু সে তো জানে তার ঘাড়ে পিঠে করা মানুষ করা কালীবউয়ের মন। বুঝল, আরও খানিক মনোকষ্টের ভোগান্তি আছে তার লখাই ভাইয়ের।

লখাই সোজা ঘরে ঢুকে দেখল কালীবাড়ি নিয়ে যাওয়ার ফল মূলের ধামাটার কাছে কালীবউ বসে আছে মুখ ফিরিয়ে। অদূরে তেল সিঁদুরে মাখামাখি লক্ষ্মীর মূর্তির কাছে কাঞ্চন বসে আছে কালীর দিকে চেয়ে। বোধ হয় তারা চোখেচোখেই তাকিয়েছিল।

লখাই বলল, কালীবউয়ের পিঠের দিকে তাকিয়ে, জঙ্গলপীরে নতুন বিয়নো গাইয়ের দুধও তো দিয়ে আসতে হবে। খালি কি তোমাদের কালীবাড়ির পুজোই নাকি?

কালীবউয়ের মুখ দেখা গেল না, গলা শোনা গেল; ঢং রেখে মুড়ি খেয়ে নিতে বল কাঞ্চী। জঙ্গলপীরে দুধ দিতে হয়, মধু দে আসবে।

কাঞ্চন ঠোঁট টিপে নিস্পলক তাকিয়ে ছিল খায়ের দিকে। না, তার লজ্জাও নেই, ভয়ও নেই অত বড় পুরুষটাকে। ভাসুর নেই সামনে, এখন সে আসল মূর্তিতেই বিরাজ করছে। বলল ঠোঁট বাঁকিয়ে, মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না এ-সব মানসের। বলতে হয় তুমিই বলো।

কাউকেই বলতে হল না। লখাই আবার বলল, মুড়ি খাব না বললুম তো সে কথা।

মুখ না ফিরাইয়াই বলল কালী, বলি—কেন, কেন?

জবাব দিল কাঞ্চন ভ্রূ তুলে, উপোস দেবে।

কালী বলল, কোন দুঃখে?

অপাঙ্গে খায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল কাঞ্চন, বোধ হয় তোমার দুঃখে।

বেঁজে উঠল কালী, আহা, মরে যাই আর কী। আরও দুটো দম দিয়ে আসতে বল গ্যাঁজায়।

কাঞ্চন কটাক্ষ আরও দুর্জয় করে বলল, চুড়োপাটনির নতুন বউয়ের চাঁদমুখের কথা বললে না?

ওই একটি কথাতেই কালীর রাগের লক্ষ্যস্থল পালটে গেল। শ্যামকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল সে গলা খানিক বাড়িয়ে, তোর ভাসুরের তো সে কথা কানে যাবে না, আমি মাগী চেঁচ্চে মরলে আর কী হবে।

কত বললুম যে, মিনসের বে দেও, ঘরে ওর মন বসুক, সমসার করুক, তবে ওর টান বাড়বে। এখন এ ঘরে ওর টান হবে কোন দুঃখে, ওর আছে কে?

লখাই এবার গম্ভীর গলায় আরও খানিক ঝাঁজ মিশিয়ে বলল, খালি বকবে, না কী, সব ফেলে ছড়ে দিয়ে আসব। পুজো কি তোমাদের জন্যে বসে থাকবে?

কালী নিশ্চপ, কাঞ্চন বলল, দেও না ফেলে ছড়ে, দেখি একবার ক্ষ্যামতা?

হ্যাঁ, কাঞ্চনের বোধ করি লখাইয়ের ক্ষমতার দৌড় দেখবার সাহসী অহঙ্কার আছে। নইলে চকিতে কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে সে চোখ ফেরাবে কেন? কিন্তু সে সোজাসুজি কখনও কাঞ্চনের সঙ্গে কথা বলে না। কথার আড় খোঁজে, নয় তো শুধু চোখের ভাষাতেই কথা বলে। কালী তাদের দেওর-ভাজের সম্পর্ক স্থির করে দিলেও তারা দেওর-ভাজে এখনও স্থির করে উঠতে পারেনি।

শ্যাম এবার ধমকে উঠল বাইরে থেকে কালীর উদ্দেশে, নে বাপু, যেতে হয় যা, নয় তো থাক। ওদিকে পালির দুধটুকু বেড়ালের পেটে গে বসে থাকবে। পাঠাতে হয়, পাইটে দে মধুকে জঙ্গলপীরে।

কাঞ্চন আর কালী চোখাচোখি করে হাসল মুখ টিপে। কালী বলল, এবার লখাইকে উদ্দেশ্য করে, খুব বুঝেছি ঢং তোমার, মুড়ি কটা খেয়ে নেওগে, তাপর যাব।

না। মাত্র এক কথার জবাব দিল লখাই এবং আর সকলে বুঝল, এ না-এর আর কোনও নড়চড় হবে না। সে পুজোর সামগ্রীভরা ধামা কাঁধে তুলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

কাঞ্চন বলল, মা মনসার গোঁ যে! বলে সে হেসে উঠল খিলখিল করে।

শুধু করুণ হয়ে উঠল কালীর গলা, দ্যাখ দিনি কাণ্ড, সারারাত পাহারা জেগে এখন আবার উপোস। এ-সব মানুষকে দুটো কথা বলে নিজের পোড়ানি।

যাওয়ার সময় বায়না ধরল মধু যাওয়ার জন্য। কিন্তু শ্যামের এক ধমকেই থেমে গেল সে। চৈত মাসের এ বোদ মাথায় করে কী দরকার ছেলের যাওয়ার।

ঘরে বড় গুমোট, বাইরেও রোদ বটে। কিন্তু মিষ্ট হওয়ায় প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়। আমগাছে বোল ধরেছে; কোনও কোনও গাছে ছোট ছোট আমে উঠেছে ভরে। ঝরা রুক্ষ বট অশ্বত্থের ডালে ডালে নতুন পাতার চকচকানি। মস্ত কুকুরীর পেটে ছোট ছোট বাচ্চা ঝুলে থাকার মতো এঁচোড় ঝুলছে কাঁঠালগাছে। চক্রবর্তীদের বাগানে বসন্তের পাখির বারো মাসের আস্তানা। চৈত্র-সকাল পাখির গানে সুরের দোলায় ঝুলছে।

বাগান পেরিয়ে মুসলমানদের গোরস্থানের ধার দিয়ে দক্ষিণ কোণের পথ ধরল লখাই। পেছনে কালী আর কাঞ্চন। কালীর ঘোমটা কম, কাঞ্চনের ঘোমটা একটু বেশি। সেনপাড়া পেরিয়ে কাঞ্চনের ঘোমটা উঠে গেল অনেকখানি। রোদে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে তার সুন্দর মুখে। কিন্তু ক্লান্তির চিহ্ন নেই তাতে। চোয়াল খানিক চওড়া, চাকাপানা মুখ। তার সারা অঙ্গে অনমনীয় বলিষ্ঠতার ছাপ, কিন্তু রমণীয়। চওড়া গড়ন, একটু খাটো কিন্তু সেটুকুই যেন তাকে মানিয়েছে। চোখ তার বড় নয়, টানা টানা। চোখের কোণ বেঁকে উঠেছে উপর দিকে সুর শেষ প্রান্ত স্পর্শ করার জন্য। সেই জন্য স্বাভাবিকভাবেই তার কটাক্ষ যেন দুর্জয় হয়ে উঠেছে। একটুকু বা নিষ্ঠুরতা যেন সেই বঙ্কিম রেখায় ফুটে রয়েছে। নাক খানিক বোঁচা, কিন্তু সরু বলে মনে হয় না বোঁচা বলে। গায়ে আভরণ বিশেষ কিছু নেই রুপোর আর কাচের কিছু চুড়ি ছাড়া। এয়োস্ত্রীর নাকের সোনা ভোয়াতে নেই, তাই এক চিমটি সোনার ঝুটো নীল পাথরের নাকছাবি নাকে। রোদে তার কাঁচপোকার টিপ অস্থির চকমকানিতে জ্বলছে।

কালী ঠিক কালী নয়, তেল দিয়ে পোঁছা বেগুনের মতো তার গায়ের রং, চলতি কথায় দলমলে চেহারা তার। শরীরটা খানিক বিশালই বটে, আঁট একটু কম। মুখের শীটুকু যেন এক কিশোরী মেয়ের। বড় বড় একজোড়া কালো চোখে বিয়োনো গাইয়ের শান্ত ভরাট দৃষ্টি। শাঁখা আর নোয়া ছাড়া তার আর কিছু নেই। নাকে সোনার সরু তারে রূপার মোলক উপর ঠোঁটের মাঝে একবিন্দু ঘামের মতো দুলছে। রূপপার গয়না যা কিছু আছে মধুর জন্মের পর তা সে খুলে রেখেছে। অল্পতেই কালী আঁপিয়ে পড়ে, গায়ের কাপড় ভিজে ওঠে ঘামে। একটু চলেই মনে হয় যেন কত রাজি পেরিয়ে এসেছে সে।

আতপুরের ঘাটের কাছাকাছি আসতেই পা যেন তার অবশ হয়ে এল। মাগো! লখাইটা কি মানুষ পাথর। কাঁধে ধামা নিয়ে যেন ছুটছে। পিছনে যে দুটো মেয়েমানুষ, তা বোধ হয় ভুলেই গেছে। বলল, ওরে কাঞ্চী, মিনসেকে দাঁড়াতে বল, ওর মতো তো আমার দস্যির পা নেই।

লখাইয়ের পেছন ধাওয়া করতে গিয়ে কাঞ্চনেরও নিশ্বাস একটু দ্রুত হয়ে উঠেছে। তবু বলল কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো, মোনর ছেলেকে খেইপেছ, মিনসে কি না ভুগিয়ে ছাড়বে?

কিন্তু উপোস দে অমন ডাকাতের মতো হাঁটতে পারব না বাপু আমি।

লখাই ততক্ষণে আতপুরের ঘাট পেরিয়ে জঙ্গলপীর ধরো-ধরো। কালী বলল, কাঞ্চনের হাতের দুধের পালি দেখিয়ে, ওখানে দুধ দিতে হবে, থামতে বল ওকে।

কাঞ্চন বলল, থাক না, দুধ কি আমরা দিতে পারব না?

আতপুর ঘাট থেকে এবার চুড়োপাটনীকে দেখা গেল। সে হেঁকে উঠল, ক্যা, শ্যামদাদার বউ নাকি গো?

কালী কথা বলে চুড়োর সঙ্গে। শত হলেও চুড়ো যে অনেক ছোট, কত বার কারণে-অকারণে তাদের বাড়ি গিয়েছে। কালী তাকে বলেছে তুই-তোকারি করে। বলল, হ্যাঁ। চুড়ো আড়চোখে কাঞ্চনের দিকে দেখে বলল, তোমাদের পাহারাদার যে দৌড়তে লেগেছে, এই তত, দে আসব নাকি?

কালী দাঁড়িয়ে পড়ল। এবার তার রাগ হয়েছে। বলল, দ্যাখো দিনি কাণ্ড। মেয়েমানুষ নে লোকটা কি ষাঁড় দৌড় শুরু করেছে। আমি তো আর পারিনে। তা বলে তোমাকে—এই গে—দে আসতে হবে না। হাঁক দেও দিনি ওর নাম নে।

চুড়ো গলুইয়ের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, হই লখাইদাদা!

দীর্ঘ পাথরের মূর্তি ফিরে দাঁড়াল। হাওয়ায় উড়ছে তার বাবরি চুল। খালি গায়ে রোদ পড়ে কালো অঙ্গে রুপোর ধার লেগেছে।

কালী হাত তুলে থামতে বলল তাকে।

জবাবে সে পেছন ফিরে আরও কয়েক পা এগিয়ে বসে পড়ল।

কিন্তু কালীও হাঁটু মুড়ে বসল। লখাইয়ের নামে অভিযোগ পেড়ে বসল চুড়োর কাছে। বলল, তোমার গ্যাজার টানেই ও রোজ আসে এখেনে?

চুড়ো চোখ পিট পিট করে বোেকার মতো হাসতে থাকে।

কাঞ্চন বলল ফিসফিসিয়ে, নোক ডেকে নতুন বউ দেখাতে চায়।

কাঞ্চনের ইচ্ছানুসারেই সেকথা শুনতে পেল চুড়ো। হেসে বলে, সে তো ওপারে গো নারান ঠাকুরানী। আর তোমাদের লখাই দেওরকে কতবার বলেছি যেতে, যায়নি। কেন যাবে বলো?– সে টিপে টিপে হাসতে লাগল আড়চোখে দুই বউকে দেখে।

দামাল কাঞ্চনও জবাব দিল ঘোমটার ফাঁক থেকে তার চোখের কোণ দিয়ে।

কালী বলে, কেন?

খুশির দমকে ট্যাঁক থেকে গাঁজার ড্যালা বের করে বলে, ঘরে অমন দুই ভাজ রয়েছে যে!

আ মরণ! নোক নাড়িয়ে ঘাড় বাঁকাল কালী। তারপর দুই জায়ে হেসে কুটিপাটি হল। হাসতে হাসতেই উঠল তারা আবার।

চুড়ো বলল, তা, হাঁগো বোঠান, তোমাদের লখাই দেওরকে কেটে দেবে না নাকি? অমন জোয়ান কার্তিকের মতন পুরুষ। বিবাগী হয়ে না চলে যায় ও। বয়সের একটা ধম্মে আছে তো?

কালী বলল, বলে নাকি কিছু?

এর আবার বলা লাগে নাকি? তোমাদের চোখ নেই? কথা বলে না, গুম খেয়ে বসে থাকে, কেবলি ভাবে, বোঝো না তোমরা? কথাগুলো সরল আর দুঃখের সঙ্গেই বলল চুড়োমণি, তোমরা বড় নির্দয় বাপু।

কথাটা লাগল কালীর। বলল, মধুর বাপ-তোমাদের দাদাকে বলল ভাই, আমি তো মুখ পইচে ফেলেছি। তারপর গলা খাটো করে বলল, আমাদের জাতের মধ্যে যে কেউ রাজি নয় মেয়ে দিতে। বলে, কী জাত, কার ছেলে। ল্যাঠাও কী কম, তবে বলেছ ঠিকই।

চুড়ো গাঁজা ডলতে ডলতে বলল, হ্যাঁ, বলে জাত। শ্যাম দাদার ভাই, এই তো ওর জাত, একবার যদি বলে ও স্যানকত্তাকে মুখ ফুটে তবে কোন বাগদী মেয়ে না দেয় একবার দেখি। আমার সে কথা লখাই দাদা শুনবে না। গাঁজায় দম দিয়ে খালি বোম হয়ে বসে থাকবে, নয় তো হা হা করে হাসবে।

কাঞ্চন ঘোমটার মধ্যে কান দিয়ে গিলল কথাগুলো। মুখে তার কত বিচিত্র ছাপই খেলে গেল, হসি রাগ বেদনা, কত রকম। কেন? কেন কে জানে!

কালী কাঞ্চন আবার হাঁটা শুরু করল। জঙ্গলপীরের ধারে কাঠুরেদের গাঁয়ের মধ্য দিয়ে সকলের সঙ্গে দেখা করে তারা গেল দুধ দিতে পীরদহের থানে।

লখাই ধামা কাঁধেই শ্রীনাথ কাঠুরের হাত থেকে হুঁকো নিয়ে কয়েক টান দিয়ে নিল।

শ্রীনাথ বয়স্ক, মাথার চুলে পাক ধরেছে, গোঁফজোড়া পাঁশুটে, প্রায় কানের কাছ অবধি বিস্তৃত, বিশাল। বয়স হয়েছে, কিন্তু দোহারা শরীরটা তার পাকা বাঁশের মতো শক্ত আর উজ্জ্বল। উজ্জ্বল তার দুই চোখ। সে চোখে অনুক্ষণ দুষ্ট ছেলের মতো সরল দুষ্টমিতে ভরা। তার মুখের প্রতিটি রেখায় এক অদ্ভুত ব্যঙ্গ হাসি লেগেই আছে। কাঠুরেপাড়ায় বীরত্বে, কথায়, ছড়ায়, নেশায় তার জুড়ি নেই। শুধু তাই নয়, শ্রীনাথ দুই বউ নিয়ে ঘর করে। আর তার প্রতাপ এতই অখণ্ড, তার হৃদয়ের বেগ এতই গভীর ও বিস্তৃত যে, ঘরে দুই সতীনে কেউ কোনও দিন চুলোচুলি হতে দেখেনি। কিন্তু তার দুটি বউই সন্তানহীনা। ফলে বউ দুটো আজও সেই বালিকাই রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে শ্রীনাথ দুই বউকে দুই পাশে নিয়ে দূরে অদূরে সাধু-ফকিরের ডেরায় ছোটে, এ-সম্পর্কে পাড়াঘরে যে যা বলে তাই মনোযোগ দিয়ে শোনে। কিন্তু সব চেষ্টাই প্রায় বিফল হয়েছে। একটা লজ্জার কথা, শ্রীনাথ এখনও ব্রত উদ্যাপন মতো পালা করে সারারাত বউ নিয়ে জাগে। উদ্দেশ্য, এততেও ছেলে হয় কি না একবার পরখ করা। তাতে প্রাণান্ত তার, প্রাণান্ত বউগুলোর। জের চলে তার কয়েকদিন ধরে। কোথায় রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করা, কাঠ কাটা। সব ইতস্তত ছড়ানো, বিক্ষিপ্ত। সংসার নয়, যেন গাছতলায় বেদের ডেরা। ব্যাপার দেখে নলিন কাঠুরের বউ কামিনী বাঁশঝাড়ে বসে বাঁশঝাড়ের বিলম্বিত হাওয়ায় নিশ্বাস ফেলে। শ্রীনাথের মতো জোয়ানকে পাওয়ার আশায় কামাতুর বুক তার উথালিপাথালি করে। কাইরেপাড়ায় সেকথা গোপন নেই কারও। এমন কী নলিনেরও নয়। অথচ নলিনের তাতে সায়ও নেই আপত্তি নেই। কিন্তু শ্রীনাথ সেদিক থেকে বড় সজাগ। বলে, হ্যাঁ, তোমার মতো মেয়েমানুষকে ঘরে এনে তুলি, তাপরেতে নলের মতো অথর্বে হয়ে ঘরে বসে থাকি। ওসব মরদখেগো মাগী নে ছিনাথ ঘর করবার ব্যাটা লয়।…এর পরেও আছে তার এই তীব্র সন্তান-আকাঙক্ষার যৌনস্বেচ্ছাচারের ক্লান্তরাত্রির পর বিচিত্র প্রতিক্রিয়া। বউ দুটোকে চুলে চুলে বেধে খুঁটিতে দুদিকে মুখ করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। খেতে দেয় না। বলে, মাগী, বাচ্চা-খেগো কী তুক পুরে রেখেছিস পেটে, বের কর, নইলে তোদেরই একদিন কী আমারই একদিন। এ যেন সেই রূপকথার ছদ্মবেশী রাক্ষসীরানী, সর্বনাশী গুণতুকে শ্রীনাথের জীবনে অশান্তিতে ভরে রেখে দিয়েছে। কিন্তু এরও শেষ হয়। বাঁধন খোলা হয়, সোহাগের জোয়ার শুরু হয়ে যায়, ফরাসডাঙায় ছোটে একটু ভাল-মন্দ খাবারের সন্ধানে। কোন ফকির বলে দিয়েছেন, খবরদার ঘরের লক্ষ্মীদের কখনও অনাদর করো না। শ্রীনাথের ঘরে সোহাগের জোয়ার বইছে লোকে টের পায়, যখন শোনা যায় তার দুই বউ গলা ছেড়ে কান্না জোড়ে। মাগো মা-যষ্ঠি; তোর জিভ দে আমাদের চেটে সাবড়ে দে মা, এত কষ্ট আর সয় না গো।

এ শ্রীনাথ হল লখাইয়ের বন্ধু। বন্ধু হিসাবে শ্রীনাথের চেয়ে ভালমানুষ বোধ করি আর হয় না। সে মানুষকে হাসাতে পারে, দুঃখীকে দুটো মজার কথা বলে খুশি করতে পারে, মিষ্টি তার স্বভাব। শুধু মাঝে মাঝে তীব্র বংশ-আকাঙক্ষায় তার ওই বিচিত্র বিকৃতিগুলো ছাড়া।

লখাই বলল এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে, ঠাকরুনেরা কোথা গেল?

শ্রীনাথ বলল, পাতা কুড়োতে। তা, তুমি চলেছ কোথা দুই বউ নে?

কালীবাড়ি। ধরো হুঁকো, যাই লইলে আবার গোঁসা করবে বউয়েরা।

করবে বই-কী। স্বাভাবিক উপহাস ফুটে উঠল শ্রীনাথের চোখে। পরের বউয়েরা পরপুরুষে একটু বেশি গোঁসাই দেখায়।

কী যে বলো, তার ঠিক নেই। লখাই হাসতে হাসতে পথ ধরে।

মন্দ বলনুবুঝি, হাঁরে ও লখা শ্রীনাথ ডাকে পেছন থেকে, ফের দিনি, দেখি মুখোনা একবার।

লখাই ফিরল না। একটা হাসির শব্দ শোনা গেল, মিষ্টি আর দরাজ হাসি।

শ্রীনাথের মুখে হঠাৎ এক অদ্ভুত করুণ হাসি দেখা দিল। একটা নিশ্বাস ফেলে উপরের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, বুঝিনে বাপু তোমার কেরামতি, কী যে তোমার নীলা।

লখাইয়ের জন্য শ্রীনাথের এক বিচিত্র বেদনা-বোধ আছে। দশ মাস দশ দিনে মায়ের পেট থেকে মানুষ জন্মায় আর লখাই জন্মেছে একুশ বছরে, মা-মনসার পেটে। একুশ বছরের কথা যার স্মৃতিতে চিরদিনের জন্য লুপ্ত হয়ে গেছে। এ-জীবনে তার চেয়ে অভিশপ্ত আর কে আছে।

.

লখাইরা যে মুহূর্তে কালীবাড়ির অঙ্গনে এসে হাজির হল, সেই মুহূর্তেই পুরোহিত ঠাকুর মন্দিরের দ্বার বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। এদের দেখেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটি বিলম্বিত বিরক্তির শব্দ।

লখাইয়ের কাছ থেকে পুজোর বস্তুর ধামা নিয়ে কালী তাড়াতাড়ি মন্দিরের দরজায় উঠে এল। মস্ত শরীর নিয়ে আর একজন জোগানদার বামুন ধামাটা ঢুকিয়ে নিল মন্দিরের মধ্যে।

পুরোহিত না বলে পারলেন না, পুজো কি তোমাদের জন্য বসিয়ে রাখতে হবে।

গলায় আঁচল দিয়ে জোড় হাতে কালী বলল—তার ঘর্মাক্ত ক্লান্ত মুখে ভক্তি আর করুণা নিয়ে, জঙ্গলপীরে খানিক দেরি হয়ে গেছে বাবাঠাকুর।

ভূলুণ্ঠিত প্রণামে ভেঙে পড়ল সে।

মন্দিরের দরজা বন্ধ হল। যমদুতের মতো দুই লাঠিয়াল পাহারাদার মন্দিরের দুই পাশে। মহামূল্য স্বর্ণআবরণে মা কালীর সর্বাঙ্গ ভরা, বিশাল স্বর্ণমুকুট। কখন কী বিপদ-আপদ ঘটে বলা তো যায় না! সিঁড়ির নীচে চারদিকে থাম দেওয়া ছাদ তোলা বলিদানের ঘর, থামে রং দিয়ে সব বিচিত্র মূর্তি আঁকা। তার দুই পাশে প্রাঙ্গণ জুড়ে ফুলের বাগান।

মন্দিরের উত্তর সীমায় পাঁচিলের পরে সংস্কৃত টোল, দক্ষিণের পাঁচিলের পর গঙ্গার ধার ঘেঁষে নাটমন্দির, বিচিত্র কারুকার্যে ভরা গোল দেওয়ালের ঢেউ-বেষ্টনী উঠেছে নহবতখানার। তার ধারেই পাঁচিল দিয়ে আড়াল করা হয়েছে গঙ্গার বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাট ঘেঁসেই উঠেছে রাজপ্রাসাদ। গঙ্গা দিনরাত্রি রাজপ্রাসাদের গায়ে এসে আছড়ে পড়ে। বড় বড় জানালা দিয়ে কক্ষাভ্যন্তরের ছাদের বরগায় বরগায় রঙিন ঝাড়লণ্ঠন দুলতে দেখা যায় গঙ্গার হাওয়ায়।

পুজো শুরু হলেও তখনও সানাইয়ের সঙ্গীত থেমে যায়নি, ঢোলকের চাঁটি ঠিক বেসুর না হলেও কিঞ্চিৎ মস্থর হয়ে এসেছে।

লখাই গঙ্গায় নেমেছে স্নান করতে। কালী বউ মন্দিরের দরজার সামনেই আরও কয়েকজনের সঙ্গে রয়েছে বসে। কাঞ্চন কৌতূহলবশত সারি সারি শিবমন্দিরের বারান্দা ধরে টোলের পাচিলের সামনে এসে দাঁড়াল। এখান থেকেই টোলের ভেতর দিক দেখা যায়। সেখানেও নানান ফুলের বাগান, একসঙ্গে কয়েকটি দেবদারু গাছের ছায়ায় ভরে রয়েছে বাড়িখানি। কয়েকটি যুবক মাঝে মাঝে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করছে।

তুলসী-মঞ্চের সামনে একটি যুবক সামনে বই খুলে উদাস হয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার দীর্ঘ শিখা হাওয়ায় দুলছে, গায়ে চাদর। মুখের অবয়বটি ভরাট, চোখ দুটি স্বপ্নমাখা।

হঠাৎ তার নজরে পড়ল কাঞ্চনকে! পড়ামাত্রই তার সারা মুখে বিস্ময়ে আনন্দে এক অদ্ভুত জ্যোতি ফুটে উঠল। যেন এতক্ষণ গঙ্গার দিকে তাকিয়ে এ মুর্তিরই আরাধনা করছিল সে। কাঞ্চন দেখতে পেল না, টোলের পড়ুয়া যুবক তার দিকেই জোড়হাত প্রসারিত করে দিয়েছে। সে তখন আড়চোখে গঙ্গার ঘাটের দিকে দেখছে লখাইয়ের স্নান সাঙ্গ হল কি না। তার সারা মুখে এক গুপ্ত অভিসন্ধি ফুটে উঠেছে। বোধ হয় তাইতেই এক বিচিত্র চাপা হাসিতে তার সারা মুখ উদ্ভাসিত, কটাক্ষ বঙ্কিম।

হঠাৎ চাপা গম্ভীর গলায় যুবক বলে উঠল :

দেবি, আস্তাং তাব বচনরচনাভাজনত্বং বিদুরে
দূরে চাস্তাং তব তনুপরীরসম্ভাবনাপি।
ভূয়ো ভূয়ঃ প্রণতিভিরিদং কিন্তু যাচে বিধেয়া
স্মারং স্মারং স্বজনগণনে কাপি রেখা সমাপি ॥

কাঞ্চন প্রথমটা বিস্ময়ে পরে ভয়ে খানিক ঘোমটা টেনে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেল। মাগো। পুরুতটা তার দিকে জোড়হাত করে অমন সাংসাং করে কী মন্ত্র আওড়াচ্ছে! কী গুণতুক করছে ওই টিকিওলা বামুন! কে যেন তার পা দুটো চেপে ধরেছে, সরতে পর্যন্ত পারল না সে। শুনতে পেল কে একজন বলছে, কী হে বনমালী, কোন সুন্দরীর দেখা পেলে যে, তার স্বজনগণনাকালে তোমার নামের চ্যারাটিও টানতে বলছ?

এবং বনমালীর দৃষ্টি অনুসরণ করে কয়েকজন যুবক সকলেই কাঞ্চনকে দেখতে পেল। না দেখলেও কাঞ্চন যেন ওই দৃষ্টিগুলির অদৃশ্য খোঁচায় জর্জরিত হয়ে উঠল। ওমা! পুরুষগুলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

একজন বলল, ছি ছি, সিদ্ধিপানমত্ত হয়ে তুমি পরনারীর অপমান করছ?

আর একজন বলল, পাঁচিলটা উঁচু করে দিতে বলতে হবে দেখছি। তুমি না ভট্টপল্লীর সন্তান?

বনমালী তেমনি শান্ত গলায় বলল, সেইরূপই শ্রুতি বটে। তবে, আমি তো আমার কথা ওকে বলিনি। ধরে নাও, আমি যদি ওর কান্ত হতাম, তা হলে দূর থেকে ওই মুখ দেখে একথা বলতাম। ওই দেখো, ওর স্বামী গঙ্গায় স্নান করছে, ও তাই দেখছে। আমি ওর স্বামীর হয়ে উক্ত শ্লোক ব্যবহার করেছি! বলে সে লখাইকে স্নান করে উঠতে দেখে আবার বলে উঠল, এব স্মেরো মিলতি মৃদুলে, বল্লরীচিত্তহারী, হারী গুঞ্জাবলিভিরলিভিলীগন্ধো মুকুন্দ।

কাঞ্চন ঘোমটার ফাঁকে আবার দেখল পুরুত তার দিকে তাকিয়েই মন্ত্র আওড়াচ্ছে। কিন্তু ওদের কথাবার্তায় এটা সে বুঝেছে, বামুনটা শুধুমাত্র মন্ত্র বলছে না। আরও কিছু বলছে। তা বোধ হয় এ বাগদী বউয়ের উপলক্ষে কোনও কথা। আর সেকথা কাঞ্চনের রূপ দেখে নয়? দুঃখ নয়, মুখের হাসি তার আরও সরস হয়ে উঠল, বুক ফুলে উঠল নিশ্বাসে। লখাইকে দেখল সে আবার তার বঙ্কিম চোখ তুলে। প্রাণভরে দেখল। যেন কত দিন দেখেনি।

একজন যুবক অতঃপরও বনমালীকে ওরকম কাব্য করতে দেখেও বলে উঠল, টোল তোমার ছেড়ে দেওয়া উচিত। তুমি ভট্টপল্লীর নাম ডোবালে।

বনমালীর শান্ত নির্বিকার গলা শোনা গেল, সে নাম ডোবার মেঘ-আয়োজন বহুপূর্বেই আকাশে দেখা দিয়েছে, তোমরা তা দেখতে পাওনি বন্ধু। আমি তো সুন্দরীর সম্মান দিয়েছি। প্রয়োজন নেই আমার তার কুলমানের, নাম গোষ্ঠীর পরিচয়ের। এমন কী, তার কাছেও যেতে চাইনি।

হঠাৎ কালীবউয়ের ডাক ভেসে এল, কাঞ্চী।

কাঞ্চন তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে কালীর আঁচল ধরে টেনে বাগানে নেমে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, দিদি, চলো বেইড়ে আসি এক জায়গা থেকে।

কালী চোখ বড় করে বলল, কোথায় লো?

যাবে কি না বলো?

না বললে কেমন করে বলব?

মুরলীদাসের আখড়ায়, গারলেতে। ওদের রাধাকেষ্টোর মূর্তি নাকি বড় সোন্দর।

কালী শুধু অবাক নয়, কী যেন খুঁজল সে কাঞ্চনের সারা শরীরে আঁতিপাতি করে। কী হয়েছে। কাঞ্চীর। ওর চোখ এমন লাল হয়েছে কেন, ওর সারা মুখে এত আলো কীসের! কী রয়েছে ওর মনে? জিজ্ঞেস করল, কেন লো, আখড়ার ঠাকুর দেখতে যাব কেন?

ইচ্ছে হয়েছে।

মরণ তোর ইচ্ছের। এ বরাদুরে আমার গারলে যাওয়ার ক্ষ্যামতা নেই বাপু।

তবে আমি একাই যাব। তোমার দেওরকে বলো।

দেওর বুঝি তোর নয়, তুই বল না।

না, তুমি বলো।

কিন্তু ফিরতে তোদের দেরি হবে যে!

হবে না দিদি, তোমার পুজো না মিটতেই আসব।

লখাই তখন স্নান সেরে শুকনো কাপড়খানি পরে বাগানের মধ্যে ঢুকেছে ভেজা কাপড় মেলে দিতে। কালীর ডাকে কাপড় মেলে দিয়ে কাছে এল।

কালী বলল কাঞ্চনের গারলের আখড়ায় যাওয়ার ইচ্ছার কথা। লখাই বিস্ময়ে ফিরে তাকাল কাঞ্চনের দিকে। কাঞ্চনও ঠায় তাকিয়ে ছিল তার দিকে। শুধু একবার ভ্রূ কেঁপে টিপ ঝলকে উঠল তার।

লখাই বলল, ইচ্ছে হয়েছে তো চলুক।

বলে সে দক্ষিণের দেউড়ির দিকে এগুল। কালী হঠাৎ কাঞ্চনের আঁচল ধরে টেনে কাছে এনে বলল, কাঞ্চী, তোর কী হয়েছে? সব্বোনাশী মাগী, সোয়ামীর ওপর তোর টান নেই কেন লো।

কী কথায় কী কথা, কাঞ্চী বলল মুখ অন্য দিকে করে।

কালীর সারা মুখে চোখে হাজার রুদ্ধ কথার ছটফটানি। যেন ভয় পেয়েছে সে। বুঝি কান্না আসছে তার। বার বার বলল কাঞ্চনের স্বামীর নাম নিয়ে, সে যে মনিষ্যি নয়, সে যে ডাকাত। দিব্যি রইল, ঘরে যেন অশান্তি ডেকে আনিসনি, কাঞ্চী।

কাঞ্চন অনুসরণ করল লখাইকে। লখাই চলেছে আগে আগে, রাজবাড়ি পেরিয়ে, নিস্তব্ধ আমবাগানের ভিতর দিয়ে, গঙ্গার ধারে ধারে ঝোপঝাড়ের মাঝে পথ ভেঙে।…তার ইচ্ছে করল ফিরে তাকাতে, দেখতে কাঞ্চীবউকে। কত দিনই দেখেছে কতরকমভাবে, নিষ্পলক দেখে শ্বাসরুদ্ধ নিরালায়। কিন্তু আজ ঘাড় ফেরাতে গিয়ে যেন হাড়ে হাড় ঠেকে গেল। কেবল এক উদ্দাম ঝড়ের ঘূর্ণি হাওয়া তার বুকের মধ্যে আটকা পড়ে মাতন লাগিয়েছে।

কাঞ্চী যেন কোন্ ভাবের ঘোরে তন্ময়। লখাইয়ের দীর্ঘ বলিষ্ঠ মূর্তির দিকে তাকিয়ে সে শুধুই অনুসরণ করে চলেছে। যেন তার আশেপাশে কিছু নেই, নেই কিছু পেছনে, সামনে, অফুরন্ত পথ আর সেই পথের উপরে লখাই।

গারলের নীলকুঠির কাছে আসতেই লোকজন দেখা গেল। নীলকুঠির পেছনেই মুরলীদাসের আখড়া। অপরিচিত মানুষ দেখে কেউ কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। বিশেষ লখাইয়ের দীর্ঘ বলিষ্ঠ মূর্তি দেখে।

একজন জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে আসছ গো তোমরা?

লখাই বলল, স্যানপাড়া থেকে।

নাম?

লখাই মৈত্তির, জাতে বাগদী।

যাবে কোথায়?

মুরলীবাবাজির আখড়ায়।

অ।

কুটিরের পেছনে আখড়ার ঝকঝকে তকতকে উঠানে লখাই কাঞ্চন এসে ঢুকল। নিস্তব্ধ, নিঃসাড়, ঠাণ্ডা ছায়ায় ঘেরা যেন স্বর্গরাজ্যে মর্তের গোলপাতার ছাউনি ঘেরা বাড়ি। মানুষ নেই নাকি! মিঠেকড়া তামাক আর পাঁচমেশালি তরকারিতে কালোজিরের গন্ধে ভরে উঠেছে। তার ফাঁকে ফাঁকে হালকা বনতুলসীর গন্ধ, দাওয়ার নীচে সারবাঁধা সন্ধ্যামালতী গাছে ফুল ফুটে রয়েছে।

খুট করে একটা শব্দ হল। মুরলীদাস বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এসেই লখাইকে দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হঠাৎ যেন দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছে তার। তারপর আস্তে আস্তে তার সারা চোখে অদ্ভুত জ্যোতি ফুটে উঠল। তাড়াতাড়ি লখাইয়ের কাছে এসে হাসি মুখে আবার দেখল। তারপর আলতো হাতে এমন ভাবে লখাইয়ের গায়ে হাত দিল যে, লখাইয়ের শরীরের লোমকূপ বিচিত্র শিহরনে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। বলল, বাঃ, এ যে আমার প্রাণকান্তের মূর্তি। সোন্দর, বড় সোন্দর! এসো, বসবে এসো। কাঞ্চনের দিকে ফিরে বলল, এসো তো কান্তপ্রাণহারিণী, তোমরা দেখবে আমাদের মন্দিরের যুগল, আমরা দেখব তোমাদের যুগল। বলে সে লখাইকে দুহাতে হাত ধরে দাওয়ায় তুলে নিয়ে গেল। বার বার লখাইকে দেখায়, দেখা আর শেষ হয় না। তারপর হাঁক দিল, সরি, পুনি, কানি আয় শিগগির করে, কে এসেছে দেখবি আয়।

কাঞ্চন বলল, আমরা ঠাকুর দেখে ফিরব তাড়াতাড়ি।

ফিরবে বইকী, ধরে রাখতে চাইলেই তো সবাই ধরা দেয় না। বলল মুরলী দাস।

মেয়েরা এল। সকলেই হয়তো সেবাদাসী। সকলেই বয়সে যুবতী। সকলেরই চেহারায় কাজের চিহ্ন, ঘর্মাক্ত মুখ, কিন্তু বেশবাসে ফিটফাট, নিখুঁত করে তিলক কাটা। সকলেই তারা লখাইকে দেখতে লাগল।

লখাই তাকাল কাঞ্চনের দিকে, কাঞ্চন হাসল মুখ টিপে। কাঞ্চনের সমস্ত অবয়ব ও চেহারার মধ্যে যেন আখড়ার কোনও মিল নেই। এই শান্ত উন্মুক্ত পরিবেশের মধ্যে তার চোখে কেবলি অকারণ বিদ্যুতের ঝলকানি, এক নির্মম ক্ষুরধারে চকচক করছে।

দ্বিপ্রহর ভোগের সময় হয়েছে। মুরলী দাস তাদের ঠাকুর দেখাল।

ঠাকুর দেখে কাঞ্চন লখাই ফিরল। দূরে দূরে নয়, পাশাপাশি দুজনে। গায়ে গা ঠেকছে উভয়ের। পদক্ষেপ উভয়েরই অসমান নীলকুঠি পেরিয়ে গঙ্গার ধারের নিরালায় এসে পড়ল তারা।

লখাইয়ের দৃষ্টি সরল না কাঞ্চনের মুখের উপর থেকে। লজ্জাহীনা কাঞ্চন মুখ তুলি-তুলি করেও তুলতে পারল না। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, কী দ্যাখো তুমি মিনসে অমন করে–অ্যাঁ, কী দ্যাখো গো!

বাঁধভাঙা বন্যার কলরোল বুঝি শোনা গেল লখাইয়ের নিশ্বাসে। কথা বলতে পারল না, স্তব্ধ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী দেখে সে? সোনার টিকুলি দুলে দুলে আজ স্থির উজ্জ্বল টিপ হয়েছে কাঁচপোকার। তাই কি? কাঞ্চন কাছ ঘেঁসে এল আরও। তার তপ্ত নিশ্বাস লাগল লখাইয়ের খালি গায়ে, উপোস দে মিছে কথা বলো না। বললা তুমি কী দ্যাখো?

লখাই বিকৃত গলায় বলল, তুমি কী দ্যাখো, বলল আগে।

অস্থির ব্যাকুলতায় বলে উঠল কাঞ্চন, মিনসে, আমি যে মেয়েমানুষ, কেমন করে বলব সে কথা? সে তার শরীরের বন্য ঢেউ দিয়ে স্পর্শ করল লখাইকে।

লখাই বলল, কাঞ্চন, নারানভাই যে তোমার সোয়ামী?

তুমি কি কেউ নও? উপোস দে মিছে কথা বলো না।

কাঞ্চী বউ!

অশ্বত্থের আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো লতার মতো কাঞ্চন আঁকড়ে ধরল লখাইকে। খুনি লাঠিয়াল বাগদী বউয়ের রক্তে আজ মাতন লেগেছে। কোনও সর্বনাশকে সে ভয় পায় না, সর্বনাশের নায়িকা আজ সে নিজে। বলল, মা কালী ও রাধাকেষ্টর নামে পিতিজ্ঞে করো লখাই, য্যাত কুরুক্ষেত্তর হোক, আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে না কোনও দিন।

তুমি ছাড়া আমি লয়, বলো বলো মিনসে। বলে নিজের শাড়ির আঁচল টেনে লখাইয়ের কাপড়ের খুঁটে বাঁধল। মাথায় ঘোমটা নেই, ঘাড় থেকে কাপড় সরে গেছে, কাঁচা সোনার বরণ নিটোল বুক বসনহীন, উদ্ধত। অনাদৃত উদ্বেলিত যৌবন কামনায় উন্মুখ, কাঞ্চনের সারা দেহ থরথর করে কাঁপছে। টানা টানা চোখের দৃষ্টিতে তার বিহুল আমন্ত্রণ, ঠোঁটে বিচিত্র হাসি। কপালের টিপ জ্বলছে যেন আগুনের মতো দপদপ করে।

বিদেশি সিপাহির ভাঁটাপড়া রক্তে জোয়ার এল। রাজপুতনার মরুভূমিতে আছড়ে পড়ল ভয়ঙ্কর বন্যা। সারা শরীর জ্বলে উঠল, যেন আগুনের লেলিহান শিখা। বলল, তবে তাই হোক এ জীবনে, কাঞ্চীবউ। ভেসে আসা মানুষের জীবনে বুঝি এই হয়। আগেপাছে সব ঢাকা ও প্রাণের ভার তোমারে দিলুম, দিলুম। বলে একখণ্ড তুলোর মতো কাঞ্চনকে দুহাতে তার বলিষ্ঠ শরীরে তুলে গঙ্গার ধার ছেড়ে এক অতিকায় দানবের মত আমবাগানের ঝোপের দিকে সে এগিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *