নাবালকবাবুর বাসা : প্রথম বোধোদয়
আমার জন্ম মামাবাড়ি কুমিল্লা শহরে, কিন্তু আমার প্রথম স্মৃতি যে জায়গাটিকে কেন্দ্র করে সে হল বরিশাল, বিশেষ করে নদীর পাড়ের একটি সাহেবি কেতার বাংলো বাড়ি। বরিশালবাসী বাড়িটিকে নাবালক লজ বা কীর্তিপাশার বাবুগো বাসা বলে জানত। লেখকের প্রপিতামহ প্রসন্নকুমার সেন। তাঁর পরিচয়ে বাড়িটির পরিচয়। তাঁর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা রাজকুমার সেনকে কুলগুরু এবং জমিদারির দেওয়ান ষড়যন্ত্র করে সরবতে বিষ মিশিয়ে খুন করে। রাজকুমারবাবুর স্ত্রী সহগমন করেন—স্বেচ্ছায় বলেই শোনা যায়। দেওয়ানবাবু শিশু প্রসন্নকুমারকেও স্বর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করছিলেন। তরুণ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বেইলি সাহেব কীর্তিপাশা গিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করেন। প্রথম কয়েক বছর প্রসন্নবাবু সাহেবের পরিবারেই মানুষ হন, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই, অর্থাৎ ওঁর নাবালক অবস্থায়ই উপরিউক্ত বাংলো বাড়িটিতে বেইলি সাহেব ওঁকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই সুবাদে বাড়ির নাম নাবালকবাবুর বাসা ওরফে নাবালক লজ। বাড়িটি বিশেষ করে ওঁর জন্য তৈরি, না কোনও সাহেবের কাছ থেকে কেনা—সঠিক জানা নেই। কিছু কিছু আসবাবপত্রে আঠারো-উনিশ শতকের বিশেষ করে রিজেন্সির সময়ের ছাপ ছিল। সেগুলি প্রপিতামহ কলকাতায় নিলামে কিনেছিলেন না বাড়ির সঙ্গে পেয়েছিলেন, তাও জানি না।
আমার প্রথম স্মৃতি ওই আসবাবপত্রের একটিকে কেন্দ্র করে। এখনও চোখ বুজলে সেই কালো রেক্সিনে মোড়া খাটের সাইজের কাউচটিকে দেখতে পাই এবং তার স্পর্শ অনুভব করি। হাসপাতালের খাটের ধরনে এর মাথা এবং পায়ের দিক দুইই ভাঁজ করে তোলা যেত—ওভাবে দুদিকই তুললে জিনিসটা ইংরেজি বর্ণমালার ভি অক্ষরটির আকার নিত। ওই ভি-আকৃতি কাউচে শুয়ে বড় গর্ব বোধ করতাম। কারণ অভিজ্ঞতাটা অনন্যসম্ভব। আমার সাইজের মানুষ ছাড়া আর কেউ ওভাবে শুতে পারত না এবং বাড়িতে ওই সাইজের মানুষ আর কেউ ছিল না। আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ।
শীতের সময় রেক্সিনের আবরণ ঠান্ডা হয়ে থাকত। অনেক বয়স বলে রেক্সিন জায়গায় জায়গায় ফেটে গিয়েছিল। সেই ঠান্ডা আর খসখসে স্পর্শ মনে পড়লে এখনও একটা ব্যাখ্যাহীন সুখ বোধ করি। ক্রমে রেক্সিন অব্যবহার্য হয়ে উঠলে তার জায়গায় বাদামি রঙের চামড়া আমদানি হল। আমার সাশ্রুজল বৃষনিনাদ বড়দের লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারল না। সান্ত্বনাস্বরূপ আমাকে রেক্সিনের টুকরো দিয়ে এক গদা বানিয়ে দেওয়া হয়। তখন উপেন্দ্রকিশোর রচিত ছোটদের মহাভারত শুনে ভীমের আদর্শে নিজের চরিত্র গঠনে আমি ব্যস্ত। তবে আমার এবং ভীমের গদা আকারে অনুরূপ ছিল না। এ নিয়ে মনে একটা সান্ত্বনাহীন ব্যর্থতাবোধ জমে ওঠে। ফলে ভীম হওয়ার স্বপ্ন সফল হল না। তবে এখনও বজ্জাত মানুষ দেখলে গদাঘাতে এবং পদাঘাতে তার মস্তকচূর্ণ করার ইচ্ছে প্রবল হয়। বাবরি মসজিদ এবং গুজরাতের ঘটনার পর ইচ্ছেটা অদম্য হয়ে ওঠে।
শৈশবের সব ইচ্ছে এবং অনুভূতি অবশ্যি আগ্রাসনধর্মী ছিল না। বাড়ির পাশেই নদী, তার সিক্ততা মেঝে ছাপিয়ে ওঠার আশঙ্কায় বাড়ির নীচে আর্চের আকারে কালেপ, সামনে গোলাপের বাগান (যা সাপের উৎপাতে উচ্ছেদ করে পরে লন তৈরি হয়) চারপাশে হাসনুহানা আর রঙ্গন ফুলের ঝাড়, স্থলপদ্ম, শেফালি আর কাঠচাঁপার গাছ, বাড়ির গেটের বাইরে মস্ত উঁচু এক সপ্তপর্ণী আর এক আঁশফলের গাছ, বাড়ি ঢোকার পথের এক পাশে আলোকলতায় ছাওয়া ল্যানটানার বেড়া, তার ধারেই ক্রমশ সংস্কারহীন পুকুর, পেছনের বাগানে লিচু, জাম, কাঁঠাল, আমলকী, কুর্চিফুলের গাছ, তরকারির বাগানে লাউ-কুমড়োর মাচা, বেড়ায় লতানো মটরশুটি—সব মিলিয়ে এক অন্তহীন রহস্যের জগৎ। কালেপের নীচে রাক্ষস-খোক্কসের বাসস্থান। নিশ্চিন্ত দূরত্ব থেকে উঁকি দিয়ে দেখতাম। মাঝে মাঝে খসখস শব্দে দেহধারী প্রাণীর অস্তিত্বের আভাস পেতাম। সোন-গুইল অর্থাৎ স্বর্ণগোধিকারা স্বচ্ছন্দে আসা-যাওয়া করত। ওদের প্রতি ভয়মিশ্রিত একটা আকর্ষণ বোধ করতাম। শুনতাম যে, সাপের শত্রু বলে ওরা আমাদের মিত্র। কিন্তু ওদের সর্পিল আঁকাবাঁকা গমনভঙ্গি দেখে ভয় আর জুগুপ্সাই বোধ হত। আর ছিল বেজি। এরাও সাপের শত্রু, অতএব সযত্নে পালনীয়, সম্ভব হলে শিক্ষণীয়ও বটে। তা ছাড়া লোমে ঢাকা এদের শরীর দেখে আকর্ষণই বোধ করতাম। জুগুপ্সা না। বরিশালে অনেক বাড়িতে পোষা বেজি ছিল। সাপের প্রতিষেধক। বলেই তাদের কদর। আমার খুব ইচ্ছে হত বেজি পোর। কিন্তু প্রাণীটির কুখ্যাতি ছিল, যে হাত তাদের খাদ্য জোগায়, সে-হাতই তারা দংশন করে বলে। ফলে আরও অনেক ইচ্ছার মতো ওটিও অপূর্ণ রয়ে গেছে।
বেজিপ্রীতি প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন তুলি। মানুষ যেসব প্রাণী আদর করে পোষে, তার অধিকাংশই রোমশ, যদিও সাপ কুমির এমনকী বাদুড় আর ট্যারান্টুলা-প্রেমিক মানুষও আছে। আমরা প্রায় নির্লোম হয়েও আমাদের এই রোমশ প্রীতির কারণ কী? এ কি রক্তকণিকায় লোমাকীর্ণ পূর্বপুরুষের স্মৃতি—যখন প্রাক-নিয়ানডার্থাল অতিবৃদ্ধ পিতামহরা রোমশ প্রেয়সীদের সানন্দে আলিঙ্গন করতেন? শরিয়তে নির্দেশ আছে মেয়েরা মাথার চুল সযত্নে ঢেকে রাখবেন—তার কারণ বীর্যবান পুরুষরা নারীর কেশাগ্র দেখলেও বিচলিত হতে পারেন, এই আশঙ্কা। মধ্যযুগে পুরুষশ্রেষ্ঠ আরবরা একটু সহজে উত্তেজিত হতেন।
পাঠিকা-পাঠক, এইসব সমাজতত্ত্বঘটিত চিন্তা আমার শৈশবে মাথায় আসেনি। ওগুলি পরবর্তীকালে মনোবিকলনেরই ফসল। সে কথা থাক, শৈশব-চেতনার অনেকটাই জুড়ে ছিল নানা জাতের পশুপক্ষী। বিশেষত যাদের নাম শুনতাম, কিন্তু কদাচিৎ ক্ষণিকের দেখা মিলত, তাদের সম্বন্ধে অন্তহীন কৌতূহল বা বিস্ময়বোধ ছিল, যথা কনবিড়াল বা ভাম। বনবিড়াল মোটেই গৃহমার্জারের বন্যসংস্করণ নয়। দীর্ঘদেহী নখদন্তহান স্বাধীন প্রাণী। হঠাৎ কখনও কালেভদ্রে কালেপের ভিতর থেকে দৌড়ে পালাতে দেখেছি, রাত্রে এরা আমাদের পোষা হাঁস, মুরগি, গিনি ফাউল শিকার করতে আসত। খাঁচার ভিতর থেকে প্রচণ্ড আর্তনাদ শোনা যেত। খাঁচার তার ছিঁড়তে ভামরা ছিল রীতিমতো সিদ্ধথাবা। আর তাদের নিকটাত্মীয় খাটাশ, বরিশালের ভাষায় খাড়াশ, তাদের দেহনির্গত তীব্র কুবাসকে প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করত। ভীষ্ম-দ্রোণও তার সামনে দাঁড়াতে পারতেন মনে হয় না। তবে খাটাশরা মহৎ প্রকৃতির প্রাণী। নিতান্ত চরম অবস্থা ছাড়া এই মহাস্ত্র ওঁরা ব্যবহার করতেন না।
আর ছিল সাপ–নানা বর্ণের, নানা জাতের। ওদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় তো ছিলই। তার চেয়ে বেশি ছিল গল্পকথা মারফত নানা ধারণা। বরিশালবাসী স্বভাবত কাঠখোট্টা হতে পারে, কিন্তু তাদের সর্পপুরাণে বিচিত্র এবং বহুব্যাপী কল্পনার প্রকাশ। কবে কোন সাপের ছানা কে মেরেছিল, মা সাপ তাকে সাত দিন অনুসরণ করে এক অমাবস্যার রাতে দিনক্ষণ দেখে মরণকামড় দেয়। কে নাকি বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়ি ফেরার পর শাশুড়ি ঘোমটা তুলে মুখ দেখতে যেতেই ঘোমটার ভিতর থেকে বিশাল এক কেউটে সাপ বেরিয়ে ফণা তুলে তাকে দংশন করল। সর্পিণী আসলে ছেলের নির্যাতিতা প্রথম পক্ষের স্ত্রীর অবতার। পুনর্জন্ম নিয়ে শাশুড়ির অত্যাচারের শোধ তুলল। আরও শুনতাম-বরিশালবাসী শত্ৰুনিপাতের কাজেও সাপকে ব্যবহার করে তার ল্যাজ চুলকে জানলা দিয়ে শত্রুর ঘরে ছেড়ে দিয়ে। রাত্রে শুতে গিয়ে চোখ বুজলেই এইসব ভয়াবহ কাহিনি মনে পড়ত। মনে মনে বলতাম, “বাবা সাপ, তুমি আমাকে কামড়িয়ো না। আমি তো দুষ্টু ছেলেদের মতো তোমাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করি না।” তবুও আচমকা ঘুম ভাঙলেই চারিদিকে যেন মৃদু হিস-হিস শব্দ শুনতে পেতাম। সন্তর্পণে দেখতাম–মশারি ভাল করে গোঁজা আছে কি না।
কিন্তু ভোরের আলো ফুটলেই রাত্রির সব বিভীষিকা কেটে যেত। প্রতিটি দিনই নানা বিস্ময়কর আবিষ্কারের সম্ভাবনায় ভরা। আমাদের বাড়িতে দৈনিক পূজা-আর্চার চল ছিল না। বাপ-ঠাকুর্দা নাস্তিক ছিলেন, ফলে মা-ও কখনও নিত্যপুজার চেষ্টা করেননি। এক আমার যিনি দেখাশোনা করতেন, সেই যতিদিদি আমাদের দালানের সংলগ্ন টিনের ঘরের এক কোনায় ঠাকুর দেবতার মূর্তি সাজিয়ে পূজা-আর্চা করতেন। মানুষটি নিত্যানন্দপন্থী বৈষ্ণব ছিলেন। উনি হাততালি দিয়ে সাশ্রনয়নে ভজন গাইতেন–
বল শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ
হরে কৃষ্ণ হরে রাম রাধে গোবিন্দ।
তালে তালে সাধ্যমতো নর্তনকুর্দন
করতাম।
সকালে উঠে প্রথম কাজ ছিল যতিদিদির ঠাকুরের জন্য পুষ্পসংগ্রহ। পূজাটা উপলক্ষ মাত্র, আসল উৎসাহ পুষ্পসংগ্রহে। যতদূর মনে পড়ে—তখন সব কিছুরই রঙ যেন বেশি উজ্জ্বল ছিল। সব কিছুই অন্তহীন বিস্ময়ের আকর। বাগানের কোনায় কোনায় লাল-সাদা চন্দনের ফোঁটার মতো চিহ্নে ভরা কচুপাতার জঙ্গল। তার উপর বৃষ্টি বা শিশিরের জল টলটল করত। সত্যিই মনে হত মস্ত বড় মুক্তোর দানা। কিন্তু পাতাসুদ্ধ জলকণা সংগ্রহ করে ঘরে আনার চেষ্টা কখনও সফল হয়নি। অনেক পরে জ্ঞান হয়েছে, ওই মুক্তো সংগ্রহের জন্য সৃষ্টি হয়নি, মূল্যাতীত আনন্দে গড়া প্রকৃতির দানটি শুধু বিষয়বুদ্ধিহীন শিশুরই সম্পত্তি হতে পারে।
চেতনার সেই প্রত্যুষলয়ে বিস্ময়ের কি শেষ আছে? শীতের গোড়ায় ঘাসের মধ্যে হঠাৎ দেখা যেত গুচ্ছ গুচ্ছ বেগুনি রঙের ফুল। গাছ নেই, পাতা নেই—যেন মাটি খুঁড়ে উঠেছে। মালি বলত, ভূঁইচাপা। আসলে ফুলটা ক্রোকাসেরই রকমফের। আর স্থলপদ্ম, গন্ধরাজ, শেফালি, গুলঞ্চ, টগর? রোজই তাদের সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু রোজই তারা নতুন, কখনও ক্লান্তিকর নয়, কখনও মনে হয় না অনেক দেখা হয়েছে, আর থাক। গন্ধে, রঙে, স্পর্শে তারা ইন্দ্রিয়াতীত এক তীব্র অনুভূতির সংবাদ নিয়ে আসে। বাড়ির সীমানা-নির্দেশ দেয়ালটিকে আমরা বলতাম ছার-দেওয়াল। ছার-দেওয়ালের গায়ে ঘন সবুজ এক লতা, তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ ফল ফলত। একটু টিপলে মট করে আওয়াজ হয়ে ফেটে যেত—আমরা বলতাম মটফল। এই মটফল আমাদের রান্নাবাড়ি খেলার প্রধান উপাদান ছিল, ওই লতা আর ফলের সত্যিকার জাতিধর্ম কী, সে সংবাদ সংগ্রহ করা হয়নি। আমার অভিজ্ঞতায় প্রথম শৈশবে সব বর্ণাঢ্য জিনিসেরই রং যেমন খুব উজ্জ্বল দেখায়, তেমন অনেক জিনিসই আকারে খুব বড় মনে হয়। অক্সফোর্ডে ছাত্রাবস্থায় এক ডাক্তারিবিদ্যায় গবেষকের গিনিপিগ হয়ে মেস্কালিন সেবন করেছিলাম। যে-ঔজ্জ্বল্যের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম, মেস্কালিন-প্রভাবে সেই ঔজ্জ্বল্য আবার কিছুক্ষণ চোখে দেখি। ফলে আমার ধারণা জন্মায় যে, আমাদের কিছু কিছু ইন্দ্রিয়বোধ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোঁতা হয়ে আসে। শিশুর ‘অকারণ পুলক’-এর একটা কারণ বোধ হয় তার চোখে পৃথিবীর উজ্জ্বলতা।
পুলক? পুলক তো তখন সব কিছুতেই। নিত্যই নতুন আবিষ্কারের পুলক। বাড়ির বাগানে গুবরে শালিক লাফিয়ে বেড়ায়, তার সাদা আর বাদামি রঙের পালকসজ্জা সাধারণ শালিকের থেকে অন্য রকম। ওকে কি ছোঁয়া যায়? যায় না, কিন্তু ছোঁয়ার চেষ্টাতেই আনন্দ। কিন্তু বাড়িতে পোষা হাঁসদের দু’ হাতে তুলে নিলে তারা অসম্ভব ছটফট করে—তখন ভয়ানক অস্বস্তি লাগে। শীতের দুপুরবেলা ঝোঁপের ভিতর কুখা বা কুবোর ডাক শুনি। ওদের ভয় পাই, কারণ ওদের চোখ অস্বাভাবিক রকম লাল, তাছাড়া শুনেছি ওরা সাপের রানি। আর যেসব প্রাণী দৃষ্টির প্রায় বাইরেই থাকে? পুকুরে সরু সরু প্রায় স্বচ্ছ থোরকিনা মাছের দল—গামছা দিয়ে যাদের ধরার চেষ্টা অধিকাংশ সময়ই ব্যর্থ হয়। নদীতে শু অর্থাৎ শুশুকরা ঘাই মারে। তাদের মসৃণ কালো রঙের পিঠটাই দেখতে পাই। ওদের পুরো শরীরটা কীরকম দেখতে? পঞ্জিকায় যে-মকরের ছবি দেখি তার মতো? এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আর বর্ষার সময় নদীতে জলের উপর শুধু নাকটি ভাসিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায়—তারা কি কুমির না শুকনো কাঠের টুকরো? যতিদিদির সঙ্গে নদীতে যখন নাইতে যেতাম তখন ওদের কুমিরই ধরে নিয়ে প্রাণভয়ে পালাতাম। শুকনো কাঠ হলে সেই উত্তেজনার আনন্দ কোথায় থাকত?
নদীতলের রহস্যের কি শেষ আছে? পাড় ধরে বালির নীচে কাছিম বা কাঠুয়ার ডিম। ডিমের জন্মদাতাদেরও প্রায়ই দেখতাম। ওরা আমাদের খাদ্যও বটে, বিশেষ সুখাদ্য। তবে জলের ভিতর ওদের দেখা পেলে ভয়ই হত-কামড়াতে পারে বলে। আর ছিল কাঙট, হাঙরেরই ছোট সংস্করণ। এদের কখনও চোখে দেখিনি। শুনতাম এদের তীক্ষ্ণ দাঁত এত সহজে মানুষের হাত-পা কেটে নেয় যে কিছু টের পাওয়া যায় না। যতিদিদির বিশ্বাস করার ক্ষমতা কিছু প্রবল ছিল। সে বলতকার নাকি একটি পা কাঙটে কেটে নিয়েছিল। পাড়ে ওঠার পরে সে টের পায়, পা-টি গচ্চা গেছে। কীভাবে পাড়ে উঠল এ প্রশ্নের উত্তরে বিরক্ত সরে যতি বলত—”কেন, মানুষ এক পায়ে হাঁটে না?”—”কিন্তু সে তো লাঠি নিয়ে!”—”ও লোকটাও লাঠি নিয়ে হেঁটেছিল।” এর পর আর কথা চলে না।
ভালবাসার জগতে মানুষ আর মনুষ্যেতর প্রাণীতে যে তফাত করতে হয়—এই চেতনা হতে আমার অনেকদিন লেগেছিল। অবশ্যি ইংল্যান্ডে দীর্ঘদিন বাস করে ধারণা হয়েছে যে, এ দেশের লোক মানুষের তুলনায় কুকুর, বেড়াল আর ঘোড়াই বেশি ভালবাসে। শহরের বাড়ির গোয়ালেই গরু বাছুর ছিল। আর ঘোড়ার গাড়ি টানার জন্য ছিল সাদা ওয়েলার ঘোড়া জ্যাক এবং বাদামি রঙের অশ্বিনী, বেগম। এ ছাড়া দাদার অশ্বারোহণের শখ মেটাতে একটি মণিপুরী টাট্ট। এরা সকলেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু লাথি মারতে পারে এই আশঙ্কায় এদের কিছুটা সম্ভ্রমের চোখে দেখতাম। ফলে একটু দূরত্ব বাঁচিয়ে চলতে হত। কোচম্যান উৎসাহ দিত হাতে করে জ্যাককে ঘাস খাওয়াতে, কিন্তু ওর কর্কশ জিভের স্পর্শে গা সিরসির করত। ফলে সে দূরের বন্ধুই রয়ে গেল।
শৈশবস্বপ্নের কেন্দ্রে ছিল দুটি অস্তিত্বহীন প্রাণী—একটি লোমে ঢাকা কুকুরছানা এবং একটি ভেড়ার বাচ্চা। অন্য অনেক কাম্য জিনিসের মতো এ দুটিও আমার বাস্তব জীবনের অঙ্গ হয়নি। জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী জুড়ানবাবু—জাতিতে ব্রাহ্মণ বলে যাঁর অভিধা জুড়ান ঠাকুর এবং যাঁকে আমাদের পরিবারেরই একজন বলে জানতাম শীতের সকালে আমাকে কাঁধে করে কুয়াশায় ঢাকা নদীর পাড়ে রেসের ঘোড়া দেখাতে নিয়ে যেতেন। আমার নানা গোপন ইচ্ছার কথা ওঁকে বলতাম। তাতে সায় দিয়ে উনি আমার প্রত্যাশা উস্কে দিতেন। ওঁর স্কন্ধারূঢ় অবস্থায় শুনতাম উনি আশ্বাস দিচ্ছেন, ‘একটা ম্যাড়ার বাচ্চা আর একটা কুত্তার বাচ্চা! হ, সামনের বার কইলকাতা গিয়াই তোমার লইগা কিন্নিয়া আনমু। নদীর পাড়ে বেস পার্কে দেখতাম কুয়াশায় আধ-ঢাকা রেসের ঘোড়াদের গা থেকে ধোঁয়া উঠছে। ইচ্ছে হত বলি, জুড়ানবাবু, ঘোট দেখে একটা ঘোড়ার ছানাও আনবেন।’ মানে যে ছানা ছোটই থাকবে, কখনও বড় হয়ে লাথি ছুঁড়বে না। কিন্তু সে তো আর আমার খাটের। নীচে ঘুমাবে না, আস্তাবলেই থাকবে। তাই ওই ইচ্ছেটা চেপেই যেতাম।
আমার জীবনে ঘোড়া বা ম্যাড়ার বাচ্চার আবির্ভাব ঘটেনি বটে, কিন্তু বাবার আদেশমতো কলকাতার নিউ মার্কেট থেকে দশ টাকা দিয়ে জুড়ানবাবু সত্যিই এক বিলৈতি কুত্তার বাচ্চা কিনে আনলেন। বিলৈতি’ তার প্রমাণ—ওর কান ভাঙা। বাবা ওর বিলেতিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘অ জুড়ান, এ ত শিং মাছের কাঁটা দিয়ে ফোড়াইয়া কান ভাঙছে।’ জুড়ানের উত্তর—তা হতে পারে না। এক সাক্ষাৎ শ্বেতাঙ্গ বিলাতি সাহেবের খানসামার কাছ। থেকে কেনা এই কুত্তার বাচ্চা। তার ভাঙা কান সাহেবের শ্বেতবর্ণর মতোই সহজাত এবং অব্যয়। এসব বিতর্ক আমার ভাল লাগেনি কারণ অসম্ভব রকম ছটফটে হলদেটে রঙের ক্ষুদ্র প্রাণীটি দেখামাত্রই আমার হৃদয় জয় করেছিল। বিলৈতি না হলে কি এত রূপগুণ সম্ভব?
শীতল জ্যাঠার কাছে প্রভুভক্ত কুকুর ফিডোর গল্প শুনেছিলাম, তারই নামে আমার কুকুরছানার নাম রাখলাম—ফিডো! যতিদিদি এবং বামনাবতার বসার সাহায্যে ফিডোর যত্নের অভাব নেই। যতি তাকে দুধভাত খাওয়ায়, বসা বাজার থেকে মাংসের ছাড লইয়া আসে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ফিডোর বংশগৌরব নিয়ে সন্দেহের কারণ ঘটল। দেখি তার ভাঙা কান বিলৈতিত্ব অস্বীকার করে উচ্চে তুলেছে মাথা। বাড়িতে যেসব ঠাকুর্দার পাশে দাঁড়ানো অভিজাত কুকুরদের ফটো ছিল—যথা ডালমেশিয়ান লিও বা রোমশ স্প্যানিয়েল জিমি, যারা আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই গতাস, তাদের সঙ্গে ফিডোর কোনও সাদৃশ্য পাওয়া গেল না। জুড়ানবাবু বললেন—ওটা ফকস টেরিয়ার, যাদের কান সোজা এবং লোম ছোট হয়। রসিক মনাইকাকা দেখেশুনে মত দিলেন—এটা টেরিয়ার ঠিকই, তবে রোডেসিয়ান অর্থাৎ রাস্তার কুকুর, দেশি কুকুরের সঙ্গে জাতিতে অভিন্ন। ক্রমে তাঁর সন্দেহই। সত্যি প্রমাণ হল। বিলৈতি কুকুরের আদর স্বাভাবিক, পোস্ট-মডার্নিস্ট মাত্রেই নাক সিটকে এ কথা বলবেন। ঔপনিবেশিক-পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য বণিকরাজ যে বিজিত জাতির মধ্যবিত্ত শ্রেণির মগজ জীবনের সর্ব ক্ষেত্রেই ধোলাই করেছিল, এ কথা আজ কে না জানে? আমি শৈশবেই এ সত্যের আভাস পেলাম। ফিডোর কান খাড়া হতেই যতিদিদি দুধভাত দেওয়া বন্ধ করল। বসা নিম্নবর্গের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মাংসের ছাড’ আনা ব্যাপারে উৎসাহ হারাল। বোধ হয় আমাদের মতো সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংস্পর্শে এসে তার নিম্নবর্গসুলভ বিশুদ্ধ প্রাক-ঔপনিবেশিক চেতনা গুলিয়ে গিয়েছিল। যা হোক, ফল এই দাঁড়াল যে, কার্যত আমাদের বাড়িতে ফিডোর ভাত উঠল। ভাঁড়ারের বা ক্যাশবাক্সের চাবি আমার হাতে ছিল না। তাই আহত বিস্ময়ে ফিডোর নিরন্ন হওয়ার ব্যাপারটা অসহায় দৃষ্টিতে দেখলাম। নেড়ি কুত্তার বাচ্চাকে কে আদর করে দুধ-ভাত-মাংস খাওয়াবে? প্রথম কিছুদিন সকলের খাওয়া হয়ে গেলে এঁটোকাটা ওর সামনে ফেলে দেওয়া হত। ক্রমে সেটাও বাদ পড়তে লাগল। যেখানে সেরেস্তার কর্মচারীরা অনেকে থাকতেন এবং খেতেন সেই পুকুরপাড়ের ঠিকাবাসার পাঁশগাদায় ফিডো আহার অন্বেষণ করতে লাগল। তখন সে সকলের উপহাসের বস্তুতার পরিচয় তপুবাবুর বিলৈতি কুত্তা’। ঠিকাবাসার রাঁধুনি এবং ভৃত্যরা খেয়ালখুশি মতো তাকে পেটায়, লাথি মারে, কারণ সে খাওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ার চেষ্টায় থাকে। দুই বছর বয়সে সে তখন আকারে বেশ বড়সড়। বোধহয় সে সত্যিই আলসেশিয়ান জাতীয় কোনও বনেদি বিলাতি কুকুরের অনুলোম বিবাহের সন্তান ছিল, কারণ আমাদের দেশি নেড়ি কুত্তা সাধারণত অত বড় হয় না। তাকে বিজাতীয় জ্ঞানে দেশি কুকুররা দল বেঁধে আক্রমণ করত। একদিন দেখি ফিডো কোমর ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে বাড়ির উঠানে এসেছে। কে যেন ডাল্ডার বাড়িতে ওর কোমর ভেঙে দিয়েছে। বাবা পশুচিকিৎসককে খবর দিলেন। তিনি এসে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞাতকুলশীল প্রাণীটির যন্ত্রণার অবসান ঘটালেন। সে রাত্রে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ভোরবেলা আর ফুল তুলতে উৎসাহ পেলাম না। সান্ত্বনাহীন শোকের সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়।
ছার-দেওয়ালের ওপারে এক দিকে কীর্তনখোলা নদী, আর এক দিকে নদীর পাড় ধরেই মানুষের বসতি। তৃতীয় দিকে ব্রাউন সাহেবের দোতলা বাড়ি এবং বাগান। ঔপনিবেশিক জগতের অলিখিত জাতিভেদ প্রথা অনুযায়ী প্রতিবেশী ব্রাউন পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বা যাতায়াত ছিল না। শুনেছি ব্রাউনরা পর্তুগিজ বংশাবতংস ফিরিঙ্গি। কিছু পয়সা হওয়ায় ইংরাজি ব্রাউন নাম গ্রহণ (যা তাদের গাত্রবর্ণরও সুষ্ঠু বর্ণনা) এবং নেটিভদের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ত্যাগ। আর ছার-দেওয়ালের অন্য পাশে যেসব ব্রাত্যজন বাস করতেন। তাঁদের সঙ্গেও আমাদের সামাজিক সম্পর্ক নিতান্তই সীমাবদ্ধ। যতির হাত ধরে কখনও কখনও মাটির দেওয়াল আর টিন অর্থাৎ করোগেটেড লোহা অথবা খড়ের ছাউনি দেওয়া সেইসব বাড়িতে মাঝে মাঝে যাইনি এমন না। কিন্তু এ জাতীয় সামাজিক আদানপ্রদানে গুরুজনদের বিশেষ আপত্তি ছিল। সামাজিক লক্ষ্মণগণ্ডি লঙ্ঘন করে আমাদের নিম্নশ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য যতি মাঝেমাঝেই বকুনি খেত। এই প্রসঙ্গে সেই ভয়াবহ শব্দ—‘ছোটলোক’ কথাটা মাঝেমাঝেই কানে আসত। কিন্তু যতি এসব বিশেষ গায়ে মাখত না। ওর কাছে মস্ত বড় একটা সুশিক্ষা পেয়েছিলাম। সে বলত, ‘সব মানুষই মানুষ’। ভাগ্যবান মানুষদের এই সত্য উপলব্ধি করতে সম্ভবত আরও অনেক শতাব্দী লাগবে।
ছার-দেওয়ালের ওপারের মানুষরা সবাই কিন্তু এক শ্রেণির ছিল না। পল্লীগ্রামের মতো মফস্বল শহরে বামুনপাড়া, কায়েতপাড়া, নমঃশূদ্রপাড়া এ রকম জাতিভেদভিত্তিক আবাসন নানা কারণেই সম্ভব হত না। নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে ভূঁইমালি, মুদি, ছোট দোকানদার, নাপিত, তাঁতি, অফিসের পিয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার লোক আমাদের প্রতিবেশী ছিল। কিন্তু তাদেরই পাশাপাশি স্বর্ণকার, মহাজন, বেশ অর্থবান মুদিদের ঘরও ছিল। জাতিভেদের আচারগুলি তখনও প্রবল। সব বাড়িতেই আমাদের নাড়-বাতাসা খেতে দিত। কিন্তু জল খেতে দিত শুধু যারা জলচল তারাই। যে-নাপিত তার পেশা ছাড়েনি, তার হাতের জল খাওয়ায় কোনও বাধা ছিল না। পরে আমার এক খ্যাতনামা সহকর্মীকে বলেছিলাম তাঁর ছোঁয়া জল দ্বিজ হয়ে আমি গ্রহণ করতে পারি না—কারণ তিনি জাতব্যবসা ছেড়ে মাস্টারি ধরেছেন, এখন আর কারও চুল কাটেন না বা দাড়ি কামান না! কথাটা ভুল বলেছিলাম–তাঁর পদবিতে বিভ্রান্ত হয়ে। আসলে তিনি জাত্যংশে নরসুন্দর না, সুবর্ণবণিক।
রান্না জিনিসের মধ্যে নিম্নবর্ণের রাঁধা-ভাজা-পোড়া উচ্চবর্ণের খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না, যদি তাতে নুন না থাকে। কিন্তু ভাত বা সেদ্ধ জিনিস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এক ভূঁইমালি বাড়িতে আলুনি নিমফুল, বকফুল ভাজার লোভে প্রায়ই যেতাম। তবে সেই আনন্দসংবাদ বাড়িতে জানানোর কোনও প্রয়োজন দেখিনি। ওই দরিদ্র বসতির মাঝখানে সাহাবাবুদের বিশাল দোতলা বাড়ি, যদিও তার বেড়া দরমার এবং ছাদ টিনের। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, দেশভাগের কিছু আগে সাহাবাবুরা আমাদের জমিদারি এবং বসতবাড়ি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নিতান্ত অপমানজনক জ্ঞানে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। সম্মানবোধটা একটু কম হলে সম্ভবত আমরা অনেক দুর্দশা থেকে রেহাই পেতাম। বদ্যির বামুন অতএব সেকেন্ড ক্লাস ধরণীতলবাসী দেবতাজ্ঞানে সাহা বাড়িতে মহিলারা আমাকেও প্রণাম করতেন। তখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়স। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রণাম করলে সংকোচে কুঁকড়ে যেতাম।
সামাজিক শ্রেণিবিভাগের গন্ডি এক যতিই লঙ্ঘন করত না। গরিব বসতির শিশুপালও এ ব্যাপারে নির্বিকার ছিল। বিকেল হলেই বাবুগো বাড়ি খ্যালতে যাবি না?’ এই জিকির দিয়ে জনা দশ বারো বালখিল্যযাদের বয়স চার-পাঁচ থেকে দশবারো অবধি আমাদের উঠোনে হাজির হত। তাদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান চরিত্রর স্মৃতি আজও রয়ে গেছে। যথা ‘অগো বেঙ্গি’, ‘মগো বেঙ্গি’, জগদীশ্যা, রাখাইল্যা, সন্না। দুই বেঙ্গি পাশাপাশি দুই বাড়ির কন্যা। অগো’ অর্থাৎ ওদের, মহো’ অর্থাৎ মোদের। এরা দু’জনেই কুমির কুমির খেলায় অলিম্পিক গোল্ড মেডালিস্ট। মগো বেঙ্গির বয়স তখন সাত। সে সামাজিক উচ্চাশাসম্পন্ন নারী। বাবুগো বাড়ির পোলাদের সঙ্গে বর বউ খেলায় তার উৎসাহ কিছু বেশি। ব্যাপারটা চোখে পড়লে গুরুজনরা বিশেষ অপছন্দ করতেন। মুদিকন্যা মগো বেঙ্গিকে পুত্রবধুরূপে বরণ করতে মার খুব উৎসাহ ছিল না। আর এক মুদিনন্দিনী যে কালে বিলাতে প্রধানমন্ত্রী হবেন এ তথ্য তখন অজ্ঞাত ছিল। তা ছাড়া গেরস্ত ঘরের মেয়ে মগোর-যার এগারোয় না পড়তেই বিয়ে হবে, বিবাহসংস্কারের আসল উদ্দেশ্যটা জানা ছিল। সেই জ্ঞান যাতে আমাদের চেতনায় অকালে সঞ্চারিত না হয়, এ নিয়ে মা-বাবার দুশ্চিন্তা ছিল। আর নীতিজ্ঞানসম্পন্ন জগদীশ্যা?—যে নদীর ঘাটে স্নানরতা রমণীদের ইজ্জত রক্ষা এবং তাদের দেখে ফেলে পুরুষরা যাতে সুষ্টচরিত্র না হয় তার তত্ত্বাবধান এই দুই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল? তার সঙ্গে মেলামেশাও বিপজ্জনক বলে মনে করা হত। আর চন্দ্রা ভূঁইমালির কন্যা সন্না, সে একটু বেশি সুন্দরী। আমার ন বছর বয়স্ক দাদা, দশ বছর বয়স্কা এই রূপসীর প্রতি বেশ আকৃষ্ট ছিল বলে আমার ধারণা। এইসব কারণে আমাদের কৌমার্য তথা মতির সুকুমারত্ব রক্ষার জন্য গুরুজনরা চিন্তিত হবেন—এ আর বিচিত্র কী? শ্রেণিঘটিত কারণে এইসব বাল্যসঙ্গী-সঙ্গিনীদের সোজাসুজি তাড়িয়ে দেওয়া যেত না, তখনকার সামাজিক মূল্যবোধে বাধত। কিন্তু সূর্যাস্তের অনেক আগেই—’অন্ধকার হইছে, এইবার ঘরে যা’ বলে এই প্রতিবেশী সন্তানদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত। অবাঞ্ছিত সঙ্গ থেকে ছেলেদের সম্পূর্ণ বাঁচানো না গেলেও তার সময়কাল যতটা সীমিত করা যায়—এই আর কী।
কোনও একটি বিশেষ দিনে মানুষের শৈশব শেষ হয় না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছিল বলে আমার ধারণা—একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। চন্দ্রা ভূঁইমালি তার জাতিগত পেশা ছেড়ে আমাদের কাছারির ভাণ্ডারী’ হয়েছিল। কোনও ভাণ্ডার রক্ষা তার কর্তব্যর অঙ্গ ছিল না। আমাদের জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারীদের সেবার্থে স্থাপিত ঠিকাবাসার জন্য বাজার করা ইত্যাদি ছোটখাটো কাজে তাকে লাগানো হত। এ ছাড়া তার খ্যাতি ছিল গুণিন বলে। কারও অসুখ-বিসুখ হলে চন্দ্রার ডাক পড়ত। সে এক হাতে ধুনুচি আর এক হাতে এক গোছ ঝাঁটার কাঠি নিয়ে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে এক ধরনের আরতিনৃত্য করত। কিছুক্ষণ নাচের পর ওর ওপর দেবীর ভর হত। তখন সে ওই ঝাঁটার কাঠি বা নিমগাছের পাতাসুদ্ধ ডাল দিয়ে রোগীকে ঝাড়ফুঁক করত। এসব কারণে চন্দ্রাকে সবাই একটু সমীহ করে চলত। ওর ধরনধারণও ঠিক নিম্নবর্গীয় ছিল না। সুন্দরী সন্না চন্দ্রার বড় মেয়ে। আমাদের উঠানে রোজ যারা খেলতে আসত-সন্না তাদের একজন, এ কথা আগেই বলেছি। হঠাৎ তার আমাদের বাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেল। সন্না কেন আসে না? সবাই পরস্পরের দিকে তাকায়, কিন্তু এ প্রশ্নের কেউ উত্তর দেয় না। হঠাৎ একদিন ঠোঁটকাটা ‘মগো’ বেঙ্গি কথাটা বলেই ফেলল। ‘সন্নারে হ্যার বাপে বেষ্টিয়া দিছে–সাহাবাবুর কাছে।’ ছ’-সাত বছর বয়সে কথাটার অর্থ বোধ হল না। মানুষ কি বেচা যায়? আর বাপ মেয়েকে বেচে? বাজারে লাউ-কুমড়োর মতো? কদিন পর বাবা চন্দ্রাকে তলব করলেন। আমাদের বললেন, ‘তোমরা ওই ঘরে যাও।’ পাশের ঘর থেকে শুনতে পেলাম বাবা চন্দ্রাকে প্রশ্ন করছেন, ‘তুই নাকি সাহার কাছে মাইয়াডারে বেষ্টিয়া দিছ?’ চন্দ্রা নতমস্তকে মৃদু স্বরে উত্তর দিল, হ হুজুর। প্রশ্ন : এমন কাজ ক্যাকরলি? প্রাণে ধরিয়া মাইয়াডারে জানোয়ারের হাতে দিতে পারলি? উত্তর : কী করমু কয়েন? মাইয়াডা দ্যাখতে হুন্দার। পাঁচ বদমাইসে নজর দেয়। ওর যুগ্যি ঘরে বরে দেওনের ত আমার ক্ষেমতা নাই। সাহাবাৰু তোক খারাপ না, দয়ামায়া আছে। মাইয়াডা থাকবে খাইবে ভাল। আর আমার আরও তিনডা মাইয়া, উনি যা টাকা দেছেন তাতে তাগোও বিয়া সাদি ভালমতো দিতে পারব।’বাবা : অর ত এখনও দশ পার হয় নাই। ও গিয়া বুড়ার লগে থাকবে? হ্যাসে বিষ খাইবে না ত? উত্তর : ‘হুজুর, না। ওর এহন এগারো চলতে আছে। কইছি না, সাহাবাবুর শরীলে দয়ামায়া আছে, সোমত্ত হইলেই তিনি অরে ঘরে লবেন। হ্যার আগে না।’ বাবা বললেন, ‘তাইলে তারে ক’ পুরুত ডাইক্কা বিয়া করতে। চন্দ্রা জিভ কেটে বলল, ‘হেয়া কি হয়! আমরা ছোট জাইত।’
ছ’ মাস পরে–সম্ভবত সন্না সোমত্ত হওয়ার পর সাহাবাবু তাকে ঘরে নিলেন। চন্দ্রা তো বলেইছিল—ওঁর মায়ার শরীর। মায়ার শরীরটি রীতিমতো দশাসই–ভুঁড়িষ্মান, লোমাচ্ছন্ন, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। শরীরটি যাঁর সম্পত্তি তাঁর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ ছাড়িয়েছে। সংসারাভিজ্ঞ জগদীশ্যা খিক খিক করে হাসতে হাসতে মেয়ে কেনার জৈবিক উদ্দেশ্যটা ব্যাখ্যা করল। সাহার আলিঙ্গনাবদ্ধ সন্নাকে কল্পনা করে আমার একই সঙ্গে কান্না আর বমি। পেল। যে-পৃথিবীতে ফুলের রঙে স্বর্গের উজ্জ্বলতা, গুবরে শালিক আর থোরকি মাছ অনন্ত বিস্ময়ের বস্তু, কচুর পাতায় জলবিন্দু আমার নির্লোভ কামনায় ভাস্বর—সেই পৃথিবীটা যেন হঠাৎ তার রূপ-রস-গন্ধ বর্ণের খোলস ছেড়ে একটা বীভৎস সরীসৃপের আকার নিয়ে বের হয়ে এল। এই নতুন পৃথিবীর গোসাপের মতো লেলিহান জিভ, কুমিরের মতো ক্লেদময় কর্কশ চামড়া। রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম এক বিকটাকার অজানা কোনও জন্তু সন্নাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। জন্তুটার মুখ সাহাবাবুর।
শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে আদম আর ইভ নন্দনকানন থেকে নির্বাসিত হয়েছিল। শয়তানের অবতার সাহাবাবু কুজ্ঞানের অঞ্জন শলাকা দিয়ে আমার চক্ষুরুন্মীলন করলেন। জীবন ও জগতের কুৎসিত রূপ আমার চেতনাগোচর হল৷ শৈশবের নিষ্পাপ স্বর্গ থেকে আমার চিরদিনের মতো নির্বাসন ঘটল।