নবিতুন, নবিতুন, তুই কই?
এ কি, কাকে খুঁজছে কদম?
ঘুমটা ভেঙে যায় কদমের। বুঝি স্বপ্ন দেখেছিল। চোখ কচলে উঠে বসল কদম। আশপাশে কাউকে স্পষ্ট করে চেনা যায় না। শুধু দেখা যায় লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে হাফ জাইংগা পরা লোকগুলো। মাথার উপর বার হাত উঁচু সিলিংয়ের লাগ টিমটিমে বিজলি বাতিটাও নিভে গেছে কখন। টাটপট্টি আর কম্বলের ফাঁক থেকে একটা বিড়ি বের করল কদম। বিড়িটা নিয়ে এগিয়ে এলো দরজার দিকে। সিপাহি বাবুকে ডাকল। সিপাহি বাবু হ্যারিকেন থেকে ধরিয়ে দিল বিড়িটা। লম্বা একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফিরে এলো বিছানায়।
তিন বছরে নবিতুনকে কখনো স্বপ্নে দেখেনি কদম। আজই প্রথম দেখল। দেখল স্বপ্নে এবং স্বপ্নের মাঝেই আবার হারিয়ে ফেলল। ঘুমের ঘোরেই তাই খুঁজেছে ওকে, চেঁচিয়ে উঠেছে। ভাগ্যিস কেউ জেগে ওঠেনি। বামনছড়িতেও বুঝি এখন রাত। হয় অঘোরে ঘুমোচ্ছে নবিতুন। হয়তোবা এমনি স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে। বুকের ধন চোখের মণি আককি, সেও হয়তো জেগে উঠেছে মায়ের চিৎকার শুনে।
ফু-উ-উ। আর একটা লম্বা টানে বিড়ির ধোঁয়া খেল কদম। তারপর চটের জায়নামাজ দিয়ে প্যাঁচিয়ে বাঁধা পোঁটলাটা খুলল আস্তে-আস্তে। তুলে নিল কোর্তাটা। কোর্তার চোর পকেট থেকে অতি যত্নে বের করে আনল নবিতুনের চিঠিখানা।
দুবছর আগে লেখা চিঠি। হাতের ঘষায় আর বারবার খুলে পড়ার দরুন ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে চার-পাঁচ টুকরো হয়েছে চিঠিটা।
এখন অধিকাংশ অক্ষর তার অস্পষ্ট। তবু রোজই অন্তত একবার চিঠিখানা খুলবে কদম। পড়ুক বা না পড়ুক একবার চোখ বুলিয়ে নেবে মুখস্থ হয়ে যাওয়া অক্ষরগুলোর ওপর। তারপর ছিন্ন টুকরোগুলো আবার ভাঁজে ভাঁজে মিলিয়ে পরিত্যক্ত সিগারেট প্যাকেটের অয়েল পেপারে মুড়ে রেখে দেবে কোর্তার সেই চোর পকেটে। দিনভর কোর্তার সাথে সাথে চিঠিটাও যেন জড়িয়ে থাকে ওর গা। রাতে সেই কোর্তাটাকেই তা করে মাথার নিচে বালিশ হিসাবে ব্যবহার করে কদম।
আলো নেই। বাইরের উঁচু ফ্লাশ লাইটের কয়েক ছোপ আলো জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে। সেই আলোতে জীর্ণপত্রের ছিন্ন টুকরোগুলো একবার দেখে নিল কদম। আবার ভাঁজ করে রেখে দিল। খালাসের দিনটা যত ঘনিয়ে আসছে নবিতুনের কথাটা যেন ততই মনে পড়ছে কদমের। আর ওই চিঠি পড়ার মাত্রাটাও বুঝি বেড়ে গেছে। কেমন করে কি যে হয়ে গেল। আর তিন বছর পরেও সবটা থিতিয়ে চিন্তা করতে পারে না কদম। চিন্তা করতে গেলেই কেমন তালগোল পাকিয়ে যায় তার।
দুনিয়ার নানা বন্দরে মাল নিয়ে খিদিরপুরে এসে নোঙর ফেলেছে র্যাভেন পোর্ট জাহাজ। দেশী সারেং খালাসিদের মুখে নামটা হয়েছে রবেনপোর্ট বা রাবণপোত।
কদমের পরিচিত জাহাজ। বার দুই এই জাহাজেই দুনিয়াটা চক্কর দিয়ে এসেছে ও, এবারও এই জাহাজেই বহাল হবার ইচ্ছে ওর।
বিকেল নাগাদ বোধহয় জাহাজটা ভিড়বে জেটিতে। সকালেই স্থানীয় লঞ্চের সুকানি হারেস এসে বলল– চল জব্বর ভাইকে দেখে আসি। জব্বর রাবণপোতের সারেং, কদমের মুরুব্বি পর্যায়ের লোক।
ইতিমধ্যেই মাল আনা-নেয়ার একটা নৌকা টেনে এনে অনেকেই চড়ে বসেছে। ওরা চলেছে রাবণপোতের পুরনো দোস্ত-ইয়ারদের সাথে সাথে আগে ভাগেই সালামত মোলাকাতের পর্বটা সেরে আসতে। হারেসের সাথে কদমও চড়ে বসল নৌকোয়।
মাঝ দরিয়ায় রাবণপোতের সংগে নৌকাটা ভিড়িয়ে দোয়া-সালাম-কুশলাদি আদান প্রদানের পর অনেক ঠাট্টা মশকারার বান ছোটাল ওরা। পার থেকে ওরা নিয়ে গেছিল খিলি পান, জর্দা কিমাম। সে পান ছুড়ে দিল জাহাজে। জাহাজ থেকে জব্বর সারেং উপুড় হয়ে ছোট্ট একটা চামড়ার প্যাকেট তুলে দিল কদমের হাতে। বলল– রেখে দাও, পাড়ে গিয়ে নেব।
পাড় থেকে বুঝি সবই লক্ষ্য করছিল শুল্ক ইন্সপেক্টর আরদালি হরকিষণ। নৌকাটা কূলে ভিড়তেই এগিয়ে এলো হরকিষণ। চেপে ধরল কদমের জামার কলারটা। কদমকে টেনে নিয়ে গেল এক পাশে।
কদম অপ্রস্তুত।
হরকিষণ চায় কদমের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটা।
যদি রসিকতাই হয় কদম বুঝতে পারে না হরকিষণের এই বিচিত্র রসিকতা। গেল খেপের আগের খেপে এই রাবণপোতে জাহাজেই চুক্তিতে ছিল কদম। সে বছরই হংকং থেকে ঘড়িটা কিনেছিল কদম। ঘড়ি যে তার খুব কাজে লাগে তা নয়। সখ করেই কিনেছিল ও। সেই সখের জিনিসটার ওপর হঠাৎ হরকিষণের নজর পড়ল কেন, বুঝতে পারে না কদম।
কিসের ঘড়ি? বলল কদম।
আ-বে, দিল্লেগি রাখ। ধমকে উঠে হরকিষণ। কদমের জামার কলারের ওপর আরো শক্ত হয় মুঠোটা। দৃষ্টিটা কঠিন।
এবার শুধু অপ্রস্তুত নয়, রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা কদম। হরকিষণের দৃষ্টিতে যেন অন্য কিছু।
লে আধাআধি বখরা। পাকেট হাম নেহি দেখেগা, হাতমে জ হ্যায় দে দে। এবার ধমকের গলাটাকে নিচু আর শান্ত করে বুঝি আপসের প্রস্তাব দিল হরকিষণ। এই সুযোগে হরকিষণের মুঠো থেকে জামার কলারটা মুক্ত করে নিল কদম। ঠাট্টার সুরেই বলল, যা যা। এক হাতে বহিন দিবি আর এক হাতে ঘড়ি নিবি। ঘড়ি মুফতে আসে কি-না? বহিনের উল্লেখে মুহূর্তে তেলে-বেগুনে হলো হরকিষণ। হাত বাড়িয়ে ধরতে গেল কদমের জামার কলারটা। চকিতে সরে গেল কদম।
এতক্ষণে যেন বুঝল কদম, রসিকতা নয় হরকিষণের। সত্যি সত্যি কদমের হাত ঘড়িটা চায় হরকিষণ।
বহিনের উল্লেখে ক্ষিপ্ত হরকিষণ। হাতের সুমুখ থেকে কদমের গলাটা অমন করে ফসকে যাওয়ায় আরও ক্ষিপ্ত হলো ও। মুহূর্তে পকেট থেকে পেনসিল কাটা একখানি ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কদমের ওপর।
আত্মরক্ষার তাগিদে শিরাগুলোকে টান করে সজাগ হলো কদম। বার দুই গোঁত্তা খেয়ে ব্যর্থ করে দিল হরকিষণের লক্ষ্যটা। দুজন দুজনকে ধরে ফেলল বাহুর বেষ্টনে। নবিতুনের কদম। বাহু যার শালতি কাঠের থাম। শক্ত বলবান। সে বাহুর পেষণে শিথিল হলো হরকিষণের হাতের মুঠো। খসে পড়ল সেই পেনসিল কাটা ছুরিটা।
ব্যাপার-স্যাপার দেখে সটকে পড়েছে নৌকার লোকগুলো। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে হারেস, কি করবে কিছুই যেন ঠিক করে উঠতে পারছে না। খসে পড়া সেই ছুরিটা তুলে নিল কদম। কোনদিক দৃকপাত করার বুঝি সময় নেই। পর মুহূর্তেই ছুরিসুদ্ধ নেবে এলো ওর উত্তোলিত বাহু। পিঠের দিকে হরকিষণের জামায় জেগে উঠল বড় এক ছোপ লাল।
তবু নাছোড়বান্দা হরকিষণ। জখমি হয়েও জড়িয়ে থাকল কদমের কোমরটা। পাছড়াপাছড়ি, ধস্তাধস্তি চলল সমানে সমানে।
কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে সেটা ওরা কেউ ভাবেনি। হরকিষণও না, কদমও না। ধস্তাধস্তির সময় কদমের কোমরের গোঁজ থেকে ছিটকে পড়ল জব্বরের আমানত সেই চামড়ামোড়া প্যাকেটটা।
ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে পোর্ট পুলিশ। তুলে নিয়েছে সেই চামড়ার প্যাকেটটা আর হরকিষণের কাঁধ থেকে সেই ছুরিটা।
যথারীতি আইনের বিধানে ফাটকে চালান গেল কদম। যথা সময় সম্পন্ন হলো হাকিমের বিচার।
অপরাধ কদমের, আইনের চোখে ধুলা দিয়ে বিঝাড়া মাল পাচারের চেষ্টা করেছে, কর্তব্যরত কর্মচারীকে কর্তব্য পালনে বাধা দিয়েছে আর তিন নম্বর, দায়িত্বরত হরকিষণ নামক কর্মচারীকে তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে জখম করেছে।
সাজা হলো কদমের। দুবছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদণ্ড।
আইনবেত্তারা বলল গুরু পাপে লঘু দণ্ড দিয়েছে মেহেরবান হাকিম। অমন যে ধারাল ছুরি নিয়ে কদম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হরকিষণের ওপর, কে বলবে খুন করার ইচ্ছে ছিল না কদমের? কিন্তু দয়ালু হাকিম সে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন কদমকে। তাই, আইনবেত্তারা আরো বলল, আল্লার দরবারে শোকর গুজার করুক কদম আর দোয়া মাংগুক মেহেরবান হাকিমের জন্যে।
আইনবেত্তাদের কথায় কি সান্ত্বনা পেল কদম?
মনটা আজ উড়ু উড়ু কদমের। তিন বছরের সাজার মেয়াদ আজই শেষ। বাকি শুধু আজকের বিকেল আর রাতটা। আগামীকাল সকালেই খালাস পাবে ও।
কাজে মন বসছে না কদমের। দশ সের ডাল নিয়ে ভাংতে বসেছে সেই সকাল বেলায়। সকাল পেরিয়ে গেছে। সুস্তির ঘণ্টি পড়েছে। সুস্তি শেষ হয়েছে। আবার কাজের তিন ঘণ্টি পড়ে গেল। অথচ এক সের ডালও ভাঙা হয়নি কদমের।
পাথরের চাকতিগুলো যেন বড় ভারি আজ। কিছুতেই নড়তে চায় না। একবার কি দুবার ঘুরিয়ে এনেই অবশ হয়ে পড়ে কদমের হাত। হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কদম। এদিক-ওদিক ঢুঁ মারে মনটা।
সে কবে একখানি চিঠি পেয়েছে নবিতুনের, তারপর আর কোন চিঠি নেই ওর। কেন? কদমের চিঠিগুলো পেল কি না নবিতুন তাও তো জানতে পারল না কদম।
অবশ্য মামলার পর ওকে চিঠি দেয়নি কদম। দেয়নি, কেননা আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ছাপ মারা চিঠিটা যখন পৌঁছুবে বামনছড়ি, তৈরি হবে নানা ব্যাখ্যা, নানা অর্থ, তার চেয়ে বেশি কদর্থ। সেসব কথা পৌঁছবে নবিতুনের কানে।
পড়তে না জানলেও কদমের চিঠিগুলো উল্টিয়ে দেখে নবিতুন। এই চিঠিখানাও তেমনি করে দেখবে ও। দেখবে ভেতরের সেই বিচিত্র ছাপগুলো। মানুষের কথায় বিশ্বাস না করে উপায় থাকবে না নবিতুনের। ছোট হবে, দমে যাবে ওর মনটা। কালো হবে ওর মুখটা। তাই চিঠি লেখার লোভটাকে সামলে গেছে কদম।
পাহারাটা ঘুরঘুর করছে। মেট আসছে। এবার ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে। সারা দিনের বাঁধা কামটা। তাড়াতাড়ি চাকতির উপর হাত রাখল কদম, পেশল শক্ত হাতের জোরে ঘুরে গেল চাকতি। শব্দ উঠল গর-র-গ-র পরিচিত শব্দ। চাকতির ঘর্ষণে গোটা ডালগুলো ভেঙে চুরে ছিটিয়ে পড়ল।
কিন্তু না, কি এক ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে কদমের শরীর। হাত জোড়া আর চলতে চায় না। এমন তো হয়নি কখনো?
কারা মেয়াদটা তো ওর এই ডাইল চাক্কিতেই কাটাল। ডাইল চাক্কি সম্পর্কে কয়েদিদের ভয়। ডাইল চাক্কির কাম বড় ভারি কাম, পানি করে দেয় গায়ের রক্ত। কিন্তু কদমের কাছে খাটনিটা খাটনিই মনে হতো না। নিজের হিস্যাটা সেরে আরও দু-পাঁচ জনের ডাল ভেঙে দিত কদম।
কদমের হাতের টানে বোঁ বোঁ গর-র-র-র বিদ্যুতের মতো ঘুরত যাঁতা। চাকতিতে চাকতিতে ঘর্ষণে যেন আগুন ছুটবে। শব্দটাই শুধু কানে আসত, চাকতি আর চোখে পড়ত না। মনে হতো গাদা মতো একটা তপ্ত ঘূর্ণী চারদিকের বাতাসটাকে ঘুঁটিয়ে পাকিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঘুরে চলেছে। আর দেখা যেত মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত কদমের কালো শরীরটা ধুলো আর ডালের গুঁড়োয় সাদা হয়ে গেছে। সেই সাদা শরীরের উপর দিয়ে কালচে রকমের রেখায় রেখায় দরদরিয়ে ঘাম ছুটছে। একসাথে পুরো দশ সের ডাল ভেঙে তবে থামত কদম। বাইরে এসে জিরিয়ে নিত। সেই কদমের হাত চলে না আজ।
পাশে যাঁতার সুধির অনেকক্ষণ ধরে দেখছে কদমের কাণ্ডটা। নিজের কাজের হিসেবটা মেটকে বুঝিয়ে দিয়ে কদমের পাশে এসে দাঁড়ায় ও, বলে, হ বুইযছি, দ্যাশের লাইগা ক্যামন ক্যামন কইরতাছে। যাও, বাতাস খাইয়া আহ।
ঢাকার মানুষ সুধির। পাকিস্তান হবার পর চলে এসেছে কলকাতায়। কিন্তু দ্যাশের বুলিটা ছাড়তে পারেনি।
একটু হাসল কদম। চাকতির ডাঁটিটা সুধিরের হাতে সঁপে দিয়ে বেরিয়ে এলো ও। এতদিন ওদের মদদ দিয়েছে কদম। আজ ওরাই করে দেবে কদমের কাজ।
কিন্তু খালাসের দিনে গায়ে বল নেই, মনে ফুর্তি নেই কদমের, এ কেমন কথা? অথচ এই দিনটির জন্য কত ব্যাকুল প্রতীক্ষা, আঙুলে আঙুলে প্রতি ঘণ্টা আর প্রতিদিনের হিসেব গোনা।
তিনটি বছর যেন গরম খোলার উপর জ্যান্ত মাছের মতো ছটফটিয়ে মরেছে কদমের মনটা। মনে হয়েছে এই জিন্দা খানার দিন বুঝি শেষ হবে না কখনো। আসবে না মুক্তির দিন। অথচ এই মুক্তির দিনেই আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই মনে। এই মুক্তির দিনটিতেই যেন দুনিয়ার যত আশঙ্কা ভয় দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা একসাথে কদমের মনটার ওপর আছড়ে পড়েছে।
নবিতুন আর আককি, কেমন করে দিন কাটছে ওদের?
সেই যখন ফ্যাসাদে পড়েছিল কদম তখুনি বুদ্ধি করে কিছুটা টাকা হাওলাৎ করেছিল, নবিতুনের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই টাকাটা যে পৌঁছেছে নবিতুনের হাতে তাতে কোন সন্দেহ নাই, কেননা সালেক সাহেব নিজে এসে সে খবরটা জানিয়ে গেছে ওকে। জাহাজিদের দরদি সালেক সাহেব। সালেক সাহেব কখনও বাজে কথা বলে না।
কিন্তু সে টাকায় বড়জোর ছয় মাসের খোরাকি চলেছে নবিতুনের। তারপর? তারপর তো আর কোন টাকা পাঠাতে পারেনি কদম। কেমন করে চলেছে নবিতুনের, কে জানে। কদমের মনে হয় কে যেন কোঁচ চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেল ওর কলজেটা।
আগামীকাল যে বেরিয়ে যাচ্ছে কদম, বেরিয়েইবা কি করবে ও? নবিতুনকে, আককিকে না দেখেই জাহাজ ধরবে? একবার মনে হয় ওর, না বাড়িই যাবে ও। কিন্তু সে ইচ্ছাটা এক পলের বেশি বুঝি ঠাঁই পায় না ওর মনে। খালি হাতে ও কেমন করে যাবে নবিতুনের সম্মুখে! বৌ মেয়ে ওদের জন্য কি নিয়ে যাবে কদম? খালি হাতে বাড়ি গিয়ে খাবেইবা কি! কোন মীমাংসাই খুঁজে পায় না কদম। দুশ্চিন্তাগুলো যে ডাল-ভাঙার ওই মোটা মোটা চাকতির মতোই ভারি হয়ে বসে থাকে ওর বুকের ওপর।
সুধির এসে বসে কদমের পাশে। বলে– নাও, অহনে বুঝাইয়া দাও গিয়া তোমার মেটেরে।
কৃতজ্ঞতায় কেমন ছলছলো হাসে কদম। সুধিরও হাসে। কয়েদি বন্ধুকে ফাটকের ওপারে মুক্তির জগতে বিদায় দিয়ে খুশি, আশা, বেদনা আর শূন্যতা মিশিয়ে যেমন করে হাসে অন্য কয়েদিরা।
ডাইল চাকতির অন্য কয়েদিরাও হাসল–পরদিন সকাল বেলায়– তেমনি খুশি আশা বেদনা আর শূন্যতায় এক বিচিত্র মিশ্রণ হাসি। তারপর গলায় গলা মিলিয়ে বিদায় দিল প্রায় তিন বছরের সুখ-দুঃখের সাথী কদমকে।