নতুন বাঙালি বড়লোক
সুরসিক ভবানীচরণ কলকাতা শহরকে ‘কমলালয়’ বলেছেন, এবং সাগরের সঙ্গে তার তুলনা করেছেন। সাগরে ‘অপেয়’ অগাধ জল, বর্ষাকালে সেই জল নির্গত হয়ে দেশ-বিদেশে যায়, নানা নদীর সমাগম হয় সাগরে। সাগর নানাবিধ রত্নের আকর। দেবাসুর সংগ্রামে সাগর মন্থিত হয়ে হলাহল ও অমৃত উঠেছিল। সাগরে হাঙর কুমির থেকে ভগবান নারায়ণ ও লক্ষ্মী পর্যন্ত বাস করেন। সাগরে সর্বদা তরঙ্গ ও কল্লোল শোনা যায়। এ-হেন সাগরের সঙ্গে কলকাতা শহরের সাদৃশ্য কোথায়?
সাদৃশ্য আছে। ভবানীচরণ লিখেছেন, ‘কলিকাতা মুদ্রারূপে অপেয় অগাধ জলে পরিপূরিতা হইয়াছে, বৃহৎ কর্মকালে মুদ্রাজল নির্গত হইয়া নানাদিগ-দেশগামি হইতেছে, নানাবিধ মুদ্রানদীর নিরন্তর গমনাগমন হইতেছে, বিবিধ বিদ্যা ও বিদ্বানরূপ বহু রত্ন আছে।’ ইংরেজের সঙ্গে নবাবের যে সংগ্রাম হয়েছিল, তাকেই তিনি দেবাসুর সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার ফলে দেশের মধ্যে বিষাদের হলাহল ও হর্ষের অমৃত উঠেছে, এবং কলকাতা শহর হয়েছে ‘নিরুপমা ও সর্ব্বদেশখ্যাত’। পরনিন্দাপরায়ণ লোকদের তিনি হাঙর বলেছেন, এবং মুর্খদের বলেছেন কুমির। এরকম অনেক নিন্দুক হাঙর ও মূর্খ কুমিরের বাস হয়েছে কলকাতা মহানগরে। লক্ষ্মী যে সর্বদাই শহরে বিরাজ করছেন তা বলে দিতে হয় না, কারণ এই শহরের পথের ধুলো ভাগ্যবান লোকের হাতে পড়ে মুঠো-মুঠো সোনা হয়ে যায়। সাগরের মতন শহরেরও ‘ধনমত্ততাদির’ তরঙ্গ ও কল্লোল নিয়ত শোনা যায়।
এই কলকাতা শহরে, ভবানীচরণের ভাষায়, ‘ইংরাজ কোম্পানির বাহাদুর অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা করিয়াছেন’। আমরা এখানে সকল পন্থার হদিশ ও পরিচয় দিতে পারব না। কলকাতা যখন অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে মহানগরের রূপ ধারণ করতে থাকল, এবং ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফা-শিকারের প্রধান লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠল, তখন এদেশের লোকের কাছেও অর্থ রোজগারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠল নতুন মহানগর। নাগরিক সমাজে বংশগত ও জাতিগত বৃদ্ধির বন্ধন ক্রমে শিথিল হয়ে গেল, কুলগত পেশার ও কর্মের সামাজিক কোনো বাধ্যতা বিশেষ রইল না। কুলের চেয়ে ব্যক্তি হয়ে উঠল বড়। নানাবিধ বৃত্তি পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজ-কর্মের স্বাধীন মুক্ত পরিবেশ যখন সৃষ্টি হল শহরে, তখন নানাশ্রেণির ও নানাজাতির লোকের অফুরন্ত কর্মপ্রেরণা ও কুশলতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশও হল তার মধ্যে। ভবানীচরণ ঠিকই বলেছেন, শহরের ভিতর থেকে ‘মুদ্রাজল’ নির্গত হয়ে নানাদেশে যাচ্ছে, এবং নানাবিধ ‘মুদ্রানদীর’ নিরন্তর গমনাগমন হচ্ছে শহরের মধ্যে। এই সব ‘মুদ্রানদীতে’ অবগাহন করে যাঁরা প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেছিলেন, এবং তারই দৌলতে নতুন নাগরিক সমাজে উচ্চশ্রেণিতে আরোহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সেকালের বাঙালি দেওয়ান বেনিয়ান, দাদনীব্যবসায়ী ও দালালরা প্রধান। কলকাতার শহুরে সমাজের বিকাশের আদিপর্বে, অর্থাৎ আঠার শতক থেকে উনিশ শতকের প্রথম পর্ব পর্যন্ত, এঁরাই আমাদের দেশের নতুন বড়লোক বা ধনিকশ্রেণিরূপে গড়ে উঠেছিলেন। এঁদের সম্বন্ধেই আমরা দু’চার কথা বলব।
ভারত-সরকারের জাতীয় মহাফেজখানায় পররাষ্ট্র-বিভাগের নথিপত্রের মধ্যে (১৮৩৯ সালের) কলকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত বংশপরিচয়সহ একটি নামের তালিকা আছে (Foreign Department Miscellaneous Records, S. No. 131), এই দীর্ঘ তালিকা থেকে আমরা কয়েকজনের কথা এখানে উল্লেখ করছি :
মহারাজা রাজকৃষ্ণ বাহাদুর। রাজকৃষ্ণ হলেন মহারাজা নবকৃষ্ণের পুত্র ও বংশধর। বাংলার মসনদে মিরজাফরের প্রতিষ্ঠার সময় নবকৃষ্ণ ক্লাইবের দেওয়ান ছিলেন। নবকৃষ্ণ সম্বন্ধে দলিলে বলা হয়েছে : ‘He amassed an immense fortune on that occasion and subsequently upon the acquisition of the Dewanee, was-placed, by Lord Clive in most confidential situation.’ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পর ক্লাইভ তাঁর উপর গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার দেন। ১৯৯৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। রাজকৃষ্ণ তখন নাবালক। রাজকৃষ্ণের ছয় পুত্রের মধ্যে শিবকৃষ্ণ দেব হলেন জ্যেষ্ঠ! এই বংশের কালীকৃষ্ণ দেব ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রাজবাহাদুর উপাধি পান।
বাবু গোপীমোহন দেব। ইনি মহারাজা নবকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্র। নবকৃষ্ণের যখন কোনো পুত্রলাভের আশা ছিল না, তখন তিনি গোপীমোহনকে দত্তক গ্রহণ করেন এই শর্তে যে ভবিষ্যতে তাঁর পুত্র হলেও তিনি মহারাজার সম্পত্তির অর্ধাংশের ন্যায্য অধিকারী হবেন। এই উত্তরাধিকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে রাজকৃষ্ণের সুপ্রিমকোর্টে মামলা হয় এবং তিনি মামলায় জয়ী হন। গোপীমোহনের একমাত্র পুত্র ও বংশধর হলেন রাধাকান্ত দেব। পিতা ও পুত্র উভয়েই সমাজে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র।
রাজা রামচন্দ্র রায়। ইনি রাজা সুখময় রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র। কয়েক বছর আগে রাজা সুখময় মারা যান, এবং তার আগে দেড়লক্ষ টাকা দান করে যান জগন্নাথযাত্রীদের রাস্তা তৈরির জন্য। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত ধর ‘কর্নেল’ ক্লাইভ ও অন্যান্য গবর্ণরদের বানিয়ার (বেনিয়া বা ব্যাংকার) কাজ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। সুখময় হলেন তাঁর দৌহিত্র। তিনি স্যার এলিজা ইম্পের দেওয়ানী করে মাতামহের ধনসম্পত্তির অনেক বেশি বৃদ্ধি করেন। মিণ্টোর আমলে তিনি ‘রাজা’ উপাদি পান। তাঁর বিশাল সম্পত্তির সমান অংশীদাররা হলেন রাজা রামচন্দ্র ও তাঁর ভাই বাপু কৃষ্ণচন্দ্র রায়, বাবু বৈদ্যনাথ রায়, বাবু শিবচন্দ্র রায় ও বাবু নরসিংহ রায়।
মল্লিক পরিবার। এই পরিবার কলকাতায় বহুদিন থেকে প্রতিষ্ঠিত, এবং কয়েক পুরুষ আগেই তাঁরা বিপুল ধনসম্পত্তিলাভের সুযোগ পান। শুকদেব মল্লিক ও নয়নচন্দ্র মল্লিক দুই ভাই এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। মল্লিক বংশের দুটি প্রধান শাখার একটি হল বর্তমানে শুকদেবের পৌত্রদের নিয়ে, আর একটি নয়নচন্দ্রের প্রপৌত্রদের নিয়ে গঠিত। নয়নচন্দ্রের দুই পুত্র গৌরচরণ ও নিমাই চরণ। নিমাই চরণ ‘নিমু মল্লিক’ বলেই কলকাতার সমাজে সমধিক খ্যাত। নিমু মল্লিকের অগাধ সম্পত্তি তাঁর আটজন পুত্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ভাগাভাগি নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে অনেকদিন ধরে মামলা চলে এবং তাতে ছয় লক্ষেরও বেশি টাকা ব্যায় হয়ে যায়। দলিলে উল্লেখ আছে : ‘The litigation of this property in the Supreme Court is said to have cost upwards of six lac of rupees already and there are Appeals still pending in England.’
বাবু শ্রীনারায়ণ সিংহ। ইনি কৃষ্ণচন্দ্র সিংহের নাবালক পুত্র। কৃষ্ণচন্দ্র ‘লালাবাবু’ বলেই জনসমাজে সুপরিচিত। কয়েক বছর আগে বৃন্দাবনে লালাবাবুর মৃত্যু হয়। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন লালাবাবুর পিতামহ গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। গঙ্গাগোবিন্দ ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে কৌন্সিল ও বোর্ড অব রেভিনিউ’র দেওয়ান। দেওয়ানি করে তিনি অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হন।
আন্দুলের রায়বংশ। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান রামচরণ রায়ের বংশধররা হলেন রাজনারায়ণ রায়, তারকনাথ রায় ও অন্যান্য রায়েরা। গবর্ণর ভ্যান্সিটার্ট ও জেনারেল স্মিথের দেওয়ান ছিলেন রামচরণ। দেওয়ানি করে তিনি প্রচুর ধনৈশ্বর্যের মালিক হন।
খিদিরপুরের ঘোষাল পরিবার। এই পরিবারের কালীশঙ্কর ঘোষাল হলেন জয়নারায়ণ ঘোষালের পুত্র। কিছুদিন আগে বারাণসীতে জয়নারায়ণের মৃত্যু হয়। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোকুলচন্দ্র ঘোষাল ভেরেলস্ট সাহেবের দেওয়ানি করে প্রচুর বিত্ত সঞ্চয় করেন। সেই সূত্রেই তিনি সন্দীপের জমিদারি লাভ করেন।
ঠাকুর পরিবার। দলিলে বিখ্যাত ঠাকুর (Tagore) পরিবার সম্বন্ধে উল্লেখ আছে। ‘There is an extensive and very rich family, the principal branch of it is that dereived from Durop Narayan Thakoor who made his fortune as Dewan to Mr. Wheeler and in the Pay office of that time.’ এরকম ধনিক ও প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী পরিবার এদেশে বিরল। এই পরিবারের প্রধান শাখার আদি-পুরুষ হলেন দর্পনারায়ণ ঠাকুর। দর্পনারায়ণ হুইলার সাহেবের দেওয়ানি করে সর্বপ্রথম প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর সাত পুত্র-রামমোহন ঠাকুর (মৃত), গোপীমোহন ঠাকুর (পিতার সম্পত্তি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করে ১৮১৬ সালে মারা যান), কৃষ্ণমোহন ঠাকুর (উন্মাদ), প্যারিমোহন ঠাকুর (বোবা ও মৃত), হরিমোহন ঠাকুর (জীবিত ও সর্বজনশ্রদ্ধেয়) ল্যাডলিমোহন ঠাকুর (জীবিত) এবং মোহিনীমোহন ঠাকুর (বছর দুই আগে শিশুসন্তান রেখে মারা যান)। গোপীমোহন ছয় পুত্র রেখে মারা যান। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সূর্যকুমার ঠাকুর নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোকগমন করেন। বাকি পুত্রদের মধ্যে চন্দ্রকুমার ঠাকুর, কালীকুমার ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর জীবিত আছেন।
ঠাকুর-পরিবারের আর-একটি শাখার বিশেষ কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না দলিলপত্রের মধ্যে। এই শাখাটিকে ‘নবীন শাখা’ (Junion Branch) বলা হয়। জলরাম ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র নীলমণি ঠাকুরের বংশধরদের নিয়ে এই শাখা গঠিত। ঠাকুরবংশের এই শাখায় দ্বারকানাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৪ সালে। কোম্পানির অধীনে দ্বারকানাথ বহুদিন কমার্সিয়াল এজেণ্ট ছিলেন। পরে তিনি ২৪-পরগণার কলেক্টর ও নিমক-এজেণ্টের সেরিস্তাদার থেকে নিমক-মহলের (Salt Agency) দেওয়ান হন। কিছুকাল তিনি ‘কাস্টমস-সল্ট-ওপিয়াম’ বোর্ডেরও দেওয়ানি করেন। এদেশের স্বাধীন বাণিজ্যক্ষেত্রের প্রথম কৃতী পুরুষদের মধ্যে তিনি স্মরণীয়। দ্বারকানাথ কয়লাখনির ব্যবসায়ে-এদেশের একজন উদযোগী পুরুষ এবং ‘কার, ট্যাগোর অ্যাণ্ড কোম্পানির’ প্রতিষ্ঠাতা। বিত্ত ও প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে তাঁর সমসাময়িককালে দ্বারকানাথের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কিনা সন্দেহ। দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং দেবেন্দ্রনাথের পুত্রদের মধ্যে স্বনামধন্য হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শেঠ পরিবার। বহুদিন থেকে এই পরিবার কলকাতার অধিবাসী। শেঠদের বর্তমান বংশধর গৌরচরণ শেঠ, কৃষ্ণমোহন শেঠ, ব্রজকুমার শেঠ ও রাজকুমার শেঠের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তাঁরা ‘conduction a very extensive banking business in the Bura Bazar where they have established for several generations’, এঁরা কিন্তু বাঙালি তন্তুবণিক ‘শেঠ’, কলকাতার ‘সুতানুটি’ বাজারের প্রতিষ্ঠাতা।
বসাক পরিবার। এই পরিবারের রাধাকৃষ্ণ বসাক জেনারেল ট্রেজারির খাজাঞ্চি। ইনি বড়বাজারের বিখ্যাত শরফ (Shroff) পরিবারের সন্তান, শেঠদের আত্মীয় এবং অত্যন্ত ধনী। এঁরাও তন্তুবণিক বাঙালি, কলকাতার আদিবাসিন্দা।
রামদুলাল দে। কলকাতার সিমলা অঞ্চলে দে-পরিবার বলতে এঁরই পরিবারকে বোঝায়। রামদুলাল ছিলেন কলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ী। সরকারি দলিলপত্রে তাঁর কথা এইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘Ram Doolal De, the richest man nearly in Calcutta, acquired his wealth wholly by trade and as Dewan to Messrs. Fairlie & Co. He had most extensive dealings with Americans at the time when they engrossed much of the carrying trade of the Port. Ram Doolal is now old, but still carries on business.’ ১৮৩৯ সালেও রামদুলাল জীবিত ছিলেন, এবং বৃদ্ধ হলেও তিনি তখনও তাঁর বিরাট ব্যবসায়ের তত্ত্বাবধান করতেন। রামদুলালের পুত্র আশুতোষ দেবেরও কলকাতায় ধনিক ও বাবু সমাজে অখণ্ড প্রতিপত্তি ছিল।
রামহরি বিশ্বাস। ভুলুয়া ও চট্টগ্রামের নিমক-মহলের এজেণ্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ান ছিলেন রামহরি বিশ্বাস। দেওয়ানি করে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তি করেন এবং তাঁর দুই পুত্র প্রাণহরি বিশ্বাস ও জগমোহন বিশ্বাস সেই সম্পত্তি পরে বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। কয়েক বছর আগে জগমোহনের মৃত্যু হয়। প্রাণকৃষ্ণ ও তাঁর পুত্র আনন্দময় বারাকপুরের কাছে বহু ভূসম্পত্তির মালিক।
জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার। শান্তিরাম সিংহ এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। পাটনার চীফ মিঃ মিডলটন ও স্যার টমাস রামবোল্ড সাহেবের দেওয়ান ছিলেন তিনি। তাঁর দুই পুত্র প্রাণকৃষ্ণ ও জয়কৃষ্ণ। প্রাণকৃষ্ণের পুত্র রাজকৃষ্ণ, শিবকৃষ্ণ ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ ট্রেজারির খাজাঞ্চি ছিলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ এই পরিবারের বংশধর।
কুমোরটুলির মিত্র পরিবার। ভগবতী চরণ মিত্র, ভবানীচরণ মিত্র এবং তাঁদের আর চার ভাই অভয়চরণ মিত্রের পুত্র। এঁরা সকলে বিশ্বনাথ মিত্রের পুত্র কাশীনাথ মিত্রের সঙ্গে প্রপিতামহ গোবিন্দরাম মিত্রের বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছেন। গোবিন্দরাম কলকাতার জমিদারি কাছারির দেওয়ান ছিলেন। কোম্পানির আমলে কলকাতার দেওয়ানি করে তো বটেই, অন্যান্য ব্যবসায়ের দ্বারাও তিনি প্রচুর বিত্তলাভ করেছিলেন।
গোকুল মিত্রের পরিবার। /নবকৃষ্ণ মিত্র, হরলাল মিত্র, হরিশ্চন্দ্র মিত্র প্রভৃতি গোকুলচন্দ্রের পৌত্র। রসদের ঠিকাদারি করে তিনি সমৃদ্ধিলাভ করেন, এবং বাগবাজারে চিৎপুর রোডের কাছে বিশাল বসতবাড়ি নির্মাণ করেন।
গঙ্গানারায়ণ সরকার। মেমার্স পামার কোম্পানির খাজাঞ্চি ছিলেন সরকার মশাই। দলিলে বলা হয়েছে যে গঙ্গানারায়ণ হলেন ‘one of the richest natives in Calcutta’, এবং তিনি কেবল ব্যবসায়ের দ্বারাই বিত্তলাভ করেন (‘made his fortune wholly by trade’)।
পালচৌধুরী পরিবার। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণচন্দ্র পালচৌধুরী সম্বন্ধে দলিলে বলা হয়েছে, ‘One of the three brothers originally in very low circumstances, acquired an immense fortune in the salt trade’। তাঁর চার পুত্র পৈতৃক সম্পত্তি অনেক বৃদ্ধি করেছেন, কিন্তু তাঁর পিতৃব্যপুত্ররাও সেই সম্পত্তির অংশীদার। সম্প্রতি কৃষ্ণচন্দ্রের ছোট ভাইয়ের একমাত্র পুত্র বৈদ্যনাথও সুপ্রিমকোর্টের বিচারে পালচৌধুরীদের সমস্ত সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের মালিক সাব্যস্ত হয়েছেন।
ব্যানার্জি পরিবার। রামসুন্দর ব্যানার্জি এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। রাধামাধব ব্যানার্জি ও গৌরীচরণ ব্যানার্জি তাঁর দুই পৌত্র। রামসুন্দর কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং রাজনারায়ণ মিশ্রের এক ভগিনীকে তিনি বিবাহ করেন। দলিলে বলা হয়েছে : ‘By this (বিবাহ) and as Dewan to the Patna Opium Agent the family acquired a considerable fortune. There are several other rich families of the name of Bannoorjea, all Koolins.’
পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ পরিবার। শিবনারায়ণ ঘোষ ও তাঁর দুই ভাই রামলোচন ঘোষের পুত্র এবং তাঁর বিশাল ধনসম্পত্তির মালিক। রামলোচন ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের সরকার এবং এই সরকারি করেই তিনি বিপুল বিত্তলাভ করেছিলেন।
মল্লিকবংশ। পূর্বোক্ত মল্লিক-পরিবারের সঙ্গে এই বংশের কোনো সম্পর্ক নেই। পরলোকগত সনাতন মল্লিকের ভাই বৈষ্ণবদাস মল্লিক এবং তাঁর ভাইপো নীলমণি মল্লিক অত্যন্ত ধনী এবং সমাজের বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ মল্লিক প্রধানত ব্যবসায়ের দ্বারাই সমৃদ্ধিলাভ করেছিলেন।
মদন দত্তের পরিবার। কলকাতার বিখ্যাত ধনিক ব্যবসায়ী ছিলেন মদন দত্ত, লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক। তাঁর দুই পুত্র রসিকলাল দত্ত ও হরলাল দত্ত। রসিকলাল বেশির ভাগ সময় বারাণসীতেই থাকেন, এবং তাঁর পুত্র উদয়চাঁদ দত্ত কলকাতার ভদ্রাসনে বাস করেন। পাঁচ পুত্র রেখে হরলাল ১৮০০ সালে মারা যান।
এই কয়েকটি পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের পর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের ধনিক বাঙালি ভদ্রলোকের (‘Rich Bengalee Gentlemen’) নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে। দলিল ছাড়াও অন্যান্য পুঁথিপুস্তক থেকে আমরা আরও দু’চারটি পরিবারের বিবরণ দিচ্ছি।
দেওয়ান কাশীনাথের পরিবার। কাশীনাথের পিতামহ ঘাসিরাম বাদশাল সাজাহানের দেওয়ান ছিলেন। ঘাসিরাম জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন এবং লাহোরে বাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর একমাত্র পুত্র মুলুকচাঁদ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে প্রথমে বাংলাদেশে মুর্শিদাবাদে আসেন এবং সেখান থেকে পরে কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। তাঁরই একমাত্র পুত্র হলেন বিখ্যাত দেওয়ান কাশীনাথ, বাইরে ‘কাশীনাথবাবু’ বলে সমধিক পরিচিত। কয়েক পুরুষ ধরে বাংলাদেশে বাস করে এঁরা প্রায় বাঙালিই হয়ে গেছেন। এঁরা সাধারণত দাসবর্মণ পদবি ব্যবহার করেন।
দেওয়ান কাশীনাথ কোম্পানির আমলের গোড়ার দিকে কিছুদিন ক্লাইভের দেওয়ানি করেছেন। তা ছাড়া তিনি উত্তর পশ্চিম প্রদেশের ধনিক রাজা ও জমিদারদের স্থানীয় প্রতিনিধির কাজ করতেন কলকাতায়। শ্যামলদাস ও শ্যামচরণ নামে দুই পুত্র রেখে তিনি অতিবৃদ্ধ বয়সে মারা যান। শ্যামল দাসের পৌত্র দামোদর দাসবর্মণ (রাজাবাবু) কলকাতার সমাজে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে, একজন বিশেষ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন।
শ্যামবাজারের বসু পরিবার। দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। কৃষ্ণরাম লবণের ব্যবসায়ে প্রচুর বিত্তলাভ করেন। এমন একসময় ছিল (আঠার শতকের শেষদিকে) যখন তিনি কলকাতা শহরে গবর্ণমেণ্টের সমস্ত লবণের Public Sale-এর প্রধান এজেণ্ট ছিলেন। লবণ ছাড়া আরও অন্যান্য ব্যবসায়ে পরে তিনি প্রচুর অর্থলাভ করেন এবং শেষে পদস্থ কর্মচারী হবার বাসনায় কোম্পানির অধীনে হুগলিতে দেওয়ানির কাজে নিযুক্ত হন।
কলুটোলার শীল পরিবার। মতিলাল শীল এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। উনিশ শতকের প্রথমভাগে কলকাতার ধনিক ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে, ১৮১৫-১৬ সালে, তিনি সর্বপ্রথম ব্যবসাক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন এবং কেল্লার সৈন্যদের রসদ সরবরাহ করতে আরম্ভ করেন। কিছুদিন তিনি কলকাতার কাস্টমস আফিসের দারোগার কাজ করেন। তারপরে তিনি বেনিয়ানি করতে আরম্ভ করেন এবং স্মিথসন ও অন্যান্য প্রায় সাত-আটজন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর বেনিয়ান নিযুক্ত হন। বেনিয়ান করে তিনি প্রচুর বিত্তলাভ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম ‘মেসার্স মুর হিকি অ্যাণ্ড কোং’ নামে একটি ইণ্ডিগো (নীল) মার্ট স্থাপন করেন এবং এই ব্যবসায়ে বহু টাকা মুনাফা করেন। কলকাতার সমাজে মতিলালও ধনকুবের বলে পরিচিত ছিলেন এবং অনেক টাকাকড়ি তিনি ও তাঁর পুত্ররা স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদির জন্য দান করে খ্যাত হয়েছেন।
মতিলাল পরিবার। বহুবাজারের বিশ্বনাথ মতিলাল এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ইনি দুর্গাচরণ পিতুড়ির ভাগনে। ১৭৭৯ সালে বিশ্বনাথ জয়নগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং এক লবণের গোলায় মাসিক ৮ টাকা বেতনের মুহুরি হয়ে প্রথম কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন। পরে স্বাধীনভাবে নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। তিনি মৃত্যুকালে নগদ প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা ও বহু বিষয়সম্পত্তি রেখে যান। বাণিজ্যসূত্রে তিনি দুটি বিখ্যাত ব্রিটিশ কুঠি ‘ম্যাকিণ্টস’ কোম্পানি ও ‘ক্রুটেগুন’ কোম্পানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। একসময় বড়বাজারের কাঁসারিপট্টির মালিক ছিলেন মতিলালরা।
ঠনঠনিয়ার ঘোষ পরিবার। ‘ঠনঠনের ঘোষ’ বলতে স্বনামধন্য রামগোপাল ঘোষের পরিবারকে বোঝায়। রামগোপালের পিতা গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, এবং কুচবিহারের মহারাজার কলকাতায় এজেণ্ট ছিলেন। ১৮১৫ সালে রামগোপালের জন্ম হয়। তিনি শেরবোর্ণ সাহেবের স্কুলে ও হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর কাছে শিক্ষালাভ করেন। ডিরোজিওর শিষ্য ইয়ংবেঙ্গল দলের তিনি অন্যতম নেতা ছিলেন এবং তাঁর শিক্ষাদীক্ষার জন্য তিনি কলকাতার শিক্ষিত বাঙালি সমাজে ‘এজুরাজ’-অর্থাৎ এজুকেটেডদের রাজা-বলে পরিচিত ছিলেন।
ডেভিড হেয়ারের অনুরোধে জোসেফ নামে ইহুদি ব্যবসায়ী রামগোপালকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীরূপে নিযুক্ত করেন। অল্পদিনের মধ্যে এদেশের শিল্পদ্রব্যের রপ্তানির বাণিজ্যে রামগোপাল এমন দক্ষতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন যে জোসেফ সাহেব তাঁর প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হন এবং তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য পরিচালনার কাজে প্রধান পরামর্শদাতার সম্মান দিতে থাকেন। কিছুদিন পরে যখন জোসেফ ইংলণ্ডে চলে যান, তখন রামগোপালের উপরেই তাঁর প্রতিষ্ঠানের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে যেতে দ্বিধা করেননি। কেলসল নামে এক সাহেব পরে জোসেফের অংশীদাররূপে যোগ দেন। তখনও অবশ্য রামগোপাল তাঁদের সহকারী ছিলেন। ব্যবসা থেকে জোসেফ যখন অবসর গ্রহণ করেন তখন কেলসল তাঁকেই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করে নেন। প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘কেলসল ঘোষ অ্যাণ্ড কোং’। অল্পদিনের মধ্যে কেলসলের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়, এবং তিনি ১৮৪৬ সালে দুই লক্ষ টাকা নিয়ে তাঁর অংশ ছেড়ে দেন। এই সময় গবর্ণমেণ্ট তাঁকে ছোট আদালতের বিচারকের পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু কোম্পানির নিমক খাবেন না বলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে স্বাধীন ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেন।
আরাকান ও বর্মার চালের ব্যবসায়ে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই বিশেষ প্রতিষ্ঠালাভ করেন এবং আকিয়াব, রেঙ্গুন প্রভৃতি স্থানে কোম্পানির শাখা স্থাপনে উদযোগী হন। স্বাধীন ব্যবসায়ী হিসেবে কলকাতার ইউরোপীয় বণিকসমাজেও তিনি যথেষ্ট প্রতিপত্তি লাভ করেন এবং তার ফলে ২৬ নভেম্বর ১৮৫০, ‘বেঙ্গল চেম্বার্স অফ কমার্সের’ সভ্যপদে নিযুক্ত হন। ১৮৫৪ সালে ফিল্ড নামে এক সাহেব তাঁর ব্যবসায়ে পার্টনাররূপে যোগ দেন, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তিনি ব্যবসাক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৮৪৭ সালের বাণিজ্যিক সংকটের সময়, যখন অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ‘ফেল’ হয়ে যায়, তখন রামগোপালের প্রতিষ্ঠান একটুও টলেনি পর্যন্ত। দু-একজন চতুর ব্যবসায়ী তাঁকে তখন বেনামী ব্যবসা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি তাঁর উত্তরে বলেছিলেন, ‘I Would rather sell the last rag I have than deceive my creditors with such swinding tricks.’ কোনো অপকৌশলের বা চালাকির প্রয়োজন হয়নি তাঁর। নিজের বুদ্ধি, নিষ্ঠা ও সততার জোরেই বাংলাদেশের ‘এজুরাজ’ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে তিনি কলকাতার মতন মহানগরে ‘বণিকরাজ’ হবারও যোগ্য।
রামবাগানের দত্ত পরিবার। লোকনাথ ঘোষ লিখেছেন : ‘The members of this family are noted for their learning as well as for the highly hororable offices they have held and still hold under Government.’ এই পরিবারের রসময় দত্ত তাঁর সময়ে একজন বিশেষ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ করেন ‘মেসার্স ডেভিডসন অ্যাণ্ড কোম্পানির’ সামান্য একজন খাতালেখার কেরানি হিসেবে। পরে তিনি ‘Court of Request’-এর কমিশনার নিযুক্ত হন এবং এই পদই পরে ছোট-আদালতের জজের পদে পরিণত হয়। কলকতার হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজের কর্মকর্তাদের মধ্যে রসময় দত্ত একজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পাঁচ পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত, কৈলাশচন্দ্র দত্ত, গোবিন্দচন্দ্র দত্ত, হরচন্দ্র দত্ত ও গিরিশচন্দ্র দত্ত সকলেই প্রায় কলকাতার বিত্তবান ও বিদ্বান-সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন।
কুমোরটুলির সরকার পরিবার। এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বনমালী সরকার। কুমোটুলিতে তাঁর বিশাল প্রাসাদতুল্য বসতবাড়ির খ্যাতি তাঁর নিজের নামের চেয়েও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল বেশি। গোবিন্দরাম মিত্রের ছড়ির মতন তাঁর বাড়ির কথাও শহরের লোকের মুখে মুখে শোনা যেত। অতুল সম্পদের মালিক ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে এই বিস্ময়কর প্রাসাদ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছিল। পাটনার কমার্শিয়াল রেসিডেণ্টের দেওয়ান ছিলেন বনমালী সরকার এবং কিছুকালের জন্য তিনি ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কলকাতার ডেপুটি ট্রেজারারের পদেও নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর বিপুল বিত্তের অধিকাংশই তিনি নানাস্থানে জমিদারি কিনে ব্যয় করেন এবং বাকি অংশ দানধ্যানে, উৎসব-পার্বণে ও ধর্মকর্মে উড়ে যায়।
বাগবাজারের মুখার্জি পরিবার। দুর্গাচরণ মুখার্জী এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ‘দেওয়ান মুখুজ্যে’ বলে তাঁর প্রসিদ্ধি ছিল। তার কারণ তিনি রাজশাহির কালেক্টর রুস সাহেবের, মিণ্ট-মাস্টার হ্যারিস সাহেবের এবং আফিমের এজেণ্ট হ্যারিসন সাহেবের দেওয়ান ছিলেন। দেওয়ানি করে মুখুয্যে মশায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন, কিন্তু তার অনেকটা অংশই বাগবাজারের গঙ্গাতীরে ‘দুর্গাচরণ মুখুজ্যের ঘাট’ নির্মাণেই ব্যয় হয়ে যায়। বাকি অর্থ ভূ-সম্পত্তিতেই গর্ভস্থ হয়।
রামচন্দ্র মিত্রের পরিবার। রামচন্দ্র সেকালের কলকাতার একজন বিখ্যাত বেনিয়ান ছিলেন। কলকাতার বন্দরে যে-সব ইউরোপীয়ান ক্যাপ্টেন বাণিজ্যের জাহাজ নিয়ে আসতেন এবং নিজেরাও নানাবিধ পণ্যদ্রব্যের ব্যবসা করতেন, মিত্র মশায় ছিলেন তাঁদের অন্যতম বেনিয়ান। তিনি বেনিয়ানি করে প্রচুর অর্থ রোজগার করেন এবং অগাধ সম্পত্তির মালিক হন। তাঁর একমাত্রপুত্র জয়নারায়ণ মিত্র, ‘জয়া মিত্তির’ বলে খ্যাত, নিশ্চিন্ত আলস্য-বিলাসে সেই সম্পত্তি ভোগ করেন। কায়স্থ-পরিবারে জন্মেও তিনি লেখাপড়ার বিশেষ চর্চা করেননি, কিন্তু বহু দেবদেবীর মন্দির নির্মাণ করে তিনি গোঁড়া হিন্দুয়ানির বহর দেখাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন।
নিমতলার মিত্র পরিবার। এই বিখ্যাত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাধর মিত্র বাণিজ্যসূত্রে খ্যাতনামা ব্যবসায়ী রামদুলাল দে-র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র ও কিশোরীচাঁদ মিত্র গঙ্গাধরের পৌত্র। কলকাতার শিক্ষা ও সাহিত্য-সমাজে প্যারীচাঁদের অখণ্ড প্রতিপত্তি ছিল এবং প্রগতিশীল ইয়ং বেঙ্গল দলের তিনিও একজন প্রধান মুখপাত্র ছিলেন। কিন্তু তাঁর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠা ছাড়াও, স্বাধীন বাণিজ্যলব্ধ অর্থের জোরে তিনি কলকাতার ধনিক-সমাজে যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন তা রামগোপাল ঘোষের মতনই বিস্ময়কর। প্যারীচাঁদ যখন ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির’ সরকারি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন, তখনই (১৮৩৯-৪০) তিনি কালাচাঁদ শেঠ ও তারাচাঁদ চক্রবর্তীর সহযোগে ‘কালাচাঁদ শেঠ অ্যাণ্ড কোং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং আমদানি-রপ্তানির বাণিজ্যে লিপ্ত হন। ১৮৪৪ সালের আগস্ট মাসে তারাচাঁদ চক্রবর্তী ব্যবসা থেকে অবসর গ্রহণ করলে, প্যারীচাঁদ ও কালাচাঁদ উভয়ে মিলে পুনরায় ব্যবসা আরম্ভ করেন। ১৮৪৯ সালে কালাচাঁদের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ট্র্যাস্টিরা (trustees) ব্যবসায়ের হিসেবপত্র চুকিয়ে দেন। প্যারীচাঁদ তখন সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বেই ব্যবসা করতে আরম্ভ করেন এবং নিজের দুই পুত্রকে অংশীদার করে নিয়ে, প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘প্যারীচাঁদ মিত্র অ্যাণ্ড সন্স’। ব্যবসায়ের দ্বারা তিনি প্রচুর অর্থও উপার্জন করেন। সততা ও বলিষ্ঠতার জন্য রামগোপালের মতনই ইউরোপীয় ব্যবসায়ী মহলে তার যথেষ্ট সুনাম ও প্রভাব ছিল। এই সুনামের জন্যই তিনি ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল’, ‘পোর্ট ক্যানিং ল্যাণ্ড ইনভেস্টমেণ্ট কোং’ ‘হাওড়া ডকিং কোং’, ‘বেঙ্গল টি কোং’, ‘ডারাং টি কোং’ প্রভৃতি বহু বিখ্যাত বিলিতি কোম্পানির ‘ডিরেক্টর’ নির্বাচিত হন।
দেওয়ানি বেনিয়ানি। ইংরেজ আমলে ‘অধিক ধনী হওনের’ নানারকম পন্থার কথা ভবানীচরণ উল্লেখ করেছেন, কিন্তু পন্থাগুলি সম্বন্ধে বিশেষ কোনো আলোচনা করেননি। কলকাতার প্রাচীন কয়েকটি বনেদি পরিবারের আত্মপ্রতিষ্ঠার যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা দিয়েছি, তা থেকে এই ধনিক হওয়ার অন্তত কয়েকটি ঐতিহাসিক পন্থার আভাস পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রধান হল এইগুলি : (১) দেওয়ানি, (২) (৩) বেনিয়ানি, (৩) এবং নানাধরনের ব্যবসাবাণিজ্য।
দেওয়ান ছিলেন যে-কোনো অফিসের, প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির প্রধান কর্মচারী। তাঁর উপরেই সমস্ত কাজকর্মের দায়িত্ব থাকত। তিনি ব্যবসায়ীর ব্যবসা দেখতেন, জমিদারদের জমিদারি তদারক করতেন, রাজকর্মচারী রাজকর্মের দায়িত্ব পালন করতেন, অর্থাৎ এককথায় তিনিই ছিলেন প্রত্যক্ষ কর্মক্ষেত্রের হর্তাকর্তাবিধাতা। ইউল ও বার্নেল তঁদের ‘হবসন-জবসন’ অভিধানে বলেছেন :
Dewaun is the chief native officer of certain government establishments… or the native manager of a Zemindary, or (in Bengal) a native servant in confidential charge of the dealings of a house of business with natives.
সেইজন্য দেখা যায়, ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠার শতকের মধ্যে, কলকাতা শহরের যে সমস্ত কৃতী ব্যক্তি তাঁদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে। প্রাচীন ধনিক বনেদি পরিবারের আদি-প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অনেকেই তাই দেখা যায় দেওয়ান ছিলেন। একপুরুষের দেওয়ানি করে তাঁরা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তাই পরবর্তী বংশধরদের পুরুষ-পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক যুগিয়ে এসেছে।
দেওয়ান ছাড়া, কলকাতার অনেক ‘ফ্যামিলি ফাউণ্ডার’ বেনিয়ান ছিলেন। ‘বেনিয়া’ বা ব্যবসায়ী কথা থেকে ‘বেনিয়ান’ কথার উৎপত্তি হয়েছে। ‘হবসন-জবসন’ লিখেছেন :
In Calcutta it is (or perhaps rather was) specifically applied to the native brokers attached to houses of business, or to persons in the employment of a private gentleman doing analogous duties.
বেনিয়ানরাও সাধারণত ব্যবসায়ী বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতেন। বিশেষ করে তাঁরা ছিলেন বিদেশি ব্যসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা। আঠার শতকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ও তাঁদের কর্মচারীরা এদেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ভ করেন, তখন দেশ ও দেশের লোক সম্বন্ধে তাঁদের কোনো ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেইজন্য তাঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত ব্যাপারেই পদে পদে যাঁদের উপর নির্ভর করতে হত, তাঁরাই হলেন, ‘বেনিয়ান’। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথমযুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য-প্রতিনিধি ছিলেন, লাভ-লোকসানের গ্যারাণ্টার ছিলেন, হিসেবরক্ষক ছিলেন, এমন কি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে। এই কারণে ইংরেজরাই আঠার শতকের বেনিয়ানকে বলেছেন, ‘interpreter, head book-keeper, head secretary, head broker, the supplier of cash and cash-keeper…serving to further such acts and proceedings as his master durst not avow…They knew all the ways, all the little frauds, all the defensive armour, all the artifices and the contrivances by which object slavery secures itself against the violence of power.’
বিলেত থেকে কোম্পানির নতুন ‘রাইটাররা’ বাংলাদেশে আসতেন, এবং তাঁদের লক্ষ্য থাকত খুব অল্পসময়ের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য করে কিছু অর্থ উপার্জন করা। ‘রাইটাররা’ যা বেতন ও ভাতা পেতেন, তাতে তাঁদের ব্যবসার মূলধন যোগানো তো দূরের কথা, কোনোরকমে জীবনধারণ করাই দায় হয়ে উঠত। কিন্তু স্বভাবতঃই তাঁরা সাত সমুদ্দূর তের নদী পার হয়ে বিদেশে এসে কায়ক্লেশে দিনযাপন করে কেবল কোম্পানির একান্ত অনুগত সেবক হয়ে থাকতে চাইতেন না। লুকিয়ে-চুরিয়ে ব্যবসা করে দু-দশটা অতিরিক্ত পয়সা তাঁরা রোজগার করার চেষ্টা করতেন। নাগরিক জীবনর বিলাসিতা ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করার জন্যও তাঁরা উন্মুখ হয়ে উঠতেন। কোম্পানির বড়সাহেবরা অবশ্য তাঁদের সকল রকমের স্বাচ্ছন্দ্য পরিহার করে চলার জন্যই বিলেত থেকে ঘন ঘন নির্দেশ পাঠাতেন। ‘রাইটাররা’পালকি চড়বেন না, বাবুগিরি ও আমোদ-প্রমোদে মন দেবেন না, সভা-ক্লাব-ট্যাভার্ন-কফিহাউস বা হোটেলে অর্থ ও সময় কোনোটারই অপব্যয় করবেন না, সন্ধ্যার পর সুবোধ বালকের মতন নিজেদের আবাসে (রাইটার্স বিল্ডিং) ফিরে আসবেন এবং নিজেদের লেখাপত্রের কাজে যথাসম্ভব মনোযোগ দেবেন। এই ধরনের সব আদেশ ও নির্দেশ কোম্পানির ডিরেক্টররা প্রায়ই বাংলাদেশের রাইটারদের জন্য পাঠাতেন। কিন্তু রাইটাররা তা কদাচিৎ মেনে চলতেন। তাঁরা সাধারণত এই সব আদেশ-নির্দেশ অমান্য করে যতদূর সম্ভব বিলাসিতাও করতেন, এবং তার জন্য নানা উপায়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনেরও প্রয়োজন হত।
কিন্তু বিলাসিতার জন্য অর্থের প্রয়োজন হলে তাঁরা তা কোথা থেকে পেতেন? অথবা কোম্পানির কর্তৃপক্ষের অগোচরে ব্যবসাবাণিজ্য করে তাঁরা যে দু-পয়সা রোজগার করার চেষ্টা করতেন, তার মূলধন পেতেন কোথা থেকে? বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রয়োজনের সময় তাঁদের টাকা ধার দিতেন এবং ব্যবসার জন্যও মূলধন জোগাতেন। বেনিয়ানদের সান্নিধ্যে আসতে তাঁদের খুব কষ্ট করতে হত না, কারণ দালালদের মারফত বেনিয়ানরা এই সব শিকারের খোঁজ পেতেন এবং টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সহজেই তাঁদের নিজেদের প্রভাবাধীন করতে পারতেন। বেনিয়ানদের সুবিধা হত এই যে তাঁরা সাহেবদের নাম ও তার সঙ্গে জড়িত সমস্ত মহিমার ও ক্ষমতার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি হয়ে বাইরের সমাজে চলাফেরা করতে পারতেন। তাতে তাঁদের নিজেদের ব্যবসাবাণিজ্যের ও নানাবিধ স্বার্থসিদ্ধির যথেষ্ট সুবিধা হত। ইংরেজরাও যে তাঁদের বেনিয়ানদের কাছে দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়তেন, তা থেকে আর সহজে চেষ্টা করেও সারাজীবনে মুক্তি পেতেন না। অবশেষে যাঁরা ভরাডুবি হয়ে যেতেন, তাঁদের মধ্যে অনেককে নিজেদের অর্জিত বিষয়সম্পত্তি ও টাকাকড়ি সমস্ত বেনিয়ানদের লিখেপড়ে দান করে যেতে হত। দৃষ্টান্ত হিসেবে উইলিয়ম ল্যাম্বার্টের কথা উল্লেখ করা যায়। ল্যাম্বার্ট বকসী ছিলেন, ঢাকার কুঠির ‘চীফ’ এবং দিনাজপুরের রেভিনিউ কৌন্সিলেরও ‘চীফ’ ছিলেন। তিনি তাঁর উইলে লিখে যান (১৭৭৪) :
I give and bequeath upto my faithful banian Bulluram Mazumder, so faithful that words are insuflicient to describe it, and to whom I am indebted for every rupee I have hitherto gained.
ল্যাম্বার্ট স্বীকার করেছেন যে জীবনে তাঁর যা অর্থলাভ হয়েছে, তার জন্য তিনি তাঁর বেনিয়ান বলরাম মজুমদারের কাছে ঋণী। বলরাম যে কত বিশ্বাসী ছিলেন, তা সাহেব বলেছেন, তাঁর পক্ষে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
বেনিয়ানরা যে সবসময় লাভ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে সাহেবদের টাকা ধার দিতেন তা নয়। অনেক সময় তাঁদের যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে টাকা দিতে হত। ইংরেজ রাইটার বা অন্যান্য কর্মচারীরা অনেকেই এদেশে বিশেষ কোনো বিষয়-সম্পত্তি না রেখেই অসময়ে মারা গেছেন এবং তার ফলেও তাঁদের বেনিয়ানদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যাঁরা বিষয়-সম্পত্তি রেখে গেছেন, তাঁদের ওয়ারিসদের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা করতেও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
আঠার শতকের কলকাতার বড় বড় বেনিয়ানদের মধ্যে গোকুল ঘোষাল, বারাণসী ঘোষ, অক্রুর দত্ত, হিদারাম ব্যানার্জী, নিমাইচরণ মল্লিক প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। আগেই বলেছি, খিদিরপুরের ঘোষাল-পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গোকুল ঘোষাল গবর্ণর ভেরেলস্টের বেনিয়ান ছিলেন। তাঁর পদমর্যাদা ও ব্যবসায়ীবুদ্ধির জন্য তিনি বাণিজ্যক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন তা অতুলনীয় বলা চলে। প্রতিপত্তিশালী ইংরেজদের সঙ্গে নানাবিধ ব্যবসায়ে জড়িত থেকে তিনি অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। যাঁরা বিদেশি বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানের বেনিয়ান নিযুক্ত হতেন, তাঁদের উপরেই সেই প্রতিষ্ঠানের ‘নেটিব’ কর্মচারী নিয়োগের ভার থাকত, এবং স্বভাবতঃই সেই কর্মচারীদের নৈতিক দায়িত্বও তাঁদের বহন করতে হত। উইলিয়ম হিকির ‘স্মৃতিকথায়’ (Memories of william Hickey, Vol. IV, Ch. 15.) বেনিয়ান নিমাইচরণ মল্লিকের কাহিনি থেকে তা বোঝা যায় (‘সূতানটি সমাচার’ দ্রষ্টব্য)।
বেনিয়ানদের এই সব কার্যকলাপ থেকে বোঝা যায় যে অন্তত আঠার শতকের কলকাতা শহরে তাঁদের বৃত্তি বা পেশা অন্য কোনো ভাগ্যবানদের তুলনায় কম অর্থকরী ছিল না। ইংরেজদের সাহচর্যে এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের মূলধন খাটিয়ে, আধুনিক যুগের আদিপর্বে, এদেশের বাণিজ্যক্ষেত্রে যাঁরা অসাধারণ কর্মকুশলতার পরিচয় দিয়ে বিপুল বিত্ত ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন, বাঙালি বেনিয়ানরা তাঁদের মধ্যে প্রধান।
দেওয়ান ও বেনিয়ানরা ছাড়াও কেউ কেউ ইংরেজদের অধীনে অন্যান্য দায়িত্বপূর্ণ কাজকর্মের ভার পেয়ে, তার কর্তৃত্বের সুযোগ নিয়ে, নানা উপায়ে অনেক টাকা উপার্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে কুমোরটুলির মিত্র-পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গোবিন্দরাম মিত্রের নাম সবদিক দিয়েই স্মরণীয়। সতের শতকের শেষদিকে গোবিন্দরাম বারাকপুর-চার্নকের কাছাকাছি কোনো গ্রাম থেকে কলকাতায় গোবিন্দপুর অঞ্চলে এসে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। শোনা যায় কিছুদিন তিনি যোব চার্নকের অধীনেও কাজ করেছিলেন। তার পর আনুমানিক ১৭২৪ সালে তিনি কলকাতার ইংরেজ জমিদারের অধীনে ‘ডেপুটি জমিদার’ বা নায়েব নিযুক্ত হন। সাধারণ জমিদারদের নায়েবদের ক্ষমতার কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা সহজেই অনুমান করতে পারবেন, ইংরেজ প্রভুত্বের আদিকালে গোবিন্দরামের কতখানি প্রতাপ-প্রতিপত্তি ছিল। ইংরেজরা এদেশে রাজা হবার আগে কলকাতা অঞ্চলের জমিদার হয়ে এসেছিলেন। দেশি জমিদারের প্রতাপই তখন মারাত্মক ছিল, বিদেশি ইংরেজ জমিদারের তো কথাই নেই। দেশি জমিদার ও প্রজা সকলেই তাঁদের ভয়ে কাঁপতেন। এহেন ইংরেজ জমিদারের নায়েব ছিলেন গোবিন্দরাম। সাহবেরা জমিদারির কিছু জানতেন না বা বুঝতেন না। পদে পদে তাঁদের সকল ব্যাপারে নির্ভর করতে হত নায়েবের উপর। দেশের লোকের কাছে গোবিন্দরামই ছিলেন ইংরেজদের প্রধান প্রতিনিধি এবং আসল জমিদার। গোবিন্দরামের ‘ছড়ি’ তখন জনপ্রবাদে পরিণত হয়েছিল, বাবুগিরির নিদর্শন হিসাবে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজদণ্ডের সাক্ষী হিসাবে। জমিদারির আয়ব্যয় সংক্রান্ত সমস্ত তদারক করার ভার ছিল তাঁর উপর। কলকাতার হাট-বাজারের বাৎসরিক বন্দোবস্ত দেওয়া (farming), রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ ও সংস্কার করা, বাণিজ্যের পণ্যদ্রব্যের শুল্ক, ট্যাক্স ইত্যাদি আদায় করা, নাগরিকদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা-এইসব ছিল তাঁর প্রধান কাজ। এর মধ্যে হাট-বাজারের আয়ই ছিল জমিদারির প্রধান আয়। নিয়ম ছিল, কলকাতার কাছারিতে সর্বসাধারণের সামনে নিলামে হাট-বাজারের বন্দোবস্ত দেওয়া। কিন্তু গোবিন্দরাম তা করতেন না বলে হলওয়েল অভিযোগ করছেন। হলওয়েল যখন কলকাতার জমিদার ছিলেন তখন তিনি প্রেসিডেণ্ট ও গবর্ণর রোজার ড্রেকের কাছে একাধিক দীর্ঘ পত্রে (১৭৫২ সালে) গোবিন্দরামের বিরুদ্ধে জাল-জুয়াচুরির বিস্তৃত তালিকা দাখিল করেন। তাতে দেখা যায়, গোবিন্দরাম কাছারিতে ‘পাবলিক অকশনে’ হাট-বাজারে বিলি না করে, সাধারণত বাড়িতে বসেই তা করতেন। তাঁর বাড়ির সামনে হাট-বাজারের দাম তিনি লটকে রেখে দিতেন এবং নিজেই দাম ঠিক করতেন। আয়ের দিক থেকে যেগুলি ভাল ভাল হাট ও বাজার, সেগুলি তিনি নিজে খুশি মতন দাম দিয়ে, অধিকাংশই বেনামীতে কিনে নিতেন, এবং তার উপর মোটা মুনাফা রেখে অন্য আর একজনকে সেগুলি আবার বন্দোবস্ত দিতেন। হলওয়েল তাঁর অভিযোগ পত্রে লিখেছেন (ফোর্ট উইলিয়াম ১৩ আগস্ট ১৭৫২) :
This man (গোবিন্দরাম) has an absoulute trust and confidence reposed in him in the disposal of the Company’s farms, the best of which he farms, at an under rate to himself in a fictitious name, and at the same time farms them out again at an immediate gain; a fraud than which I know not a greater.
আঠাশ বছর ধরে গোবিন্দরাম এই কৌশলে হাট-বাজারের আয় আত্মসাৎ করে আসছেন, এবং হলওয়েল দুঃখ করে বলেছেন যে, খাতাপত্রে বা হিসাবে তাঁর এই অপকৌশল ধরতে পারা মুশকিল। কারণ সবই তাঁর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল, এবং সবই তিনি কাগজে-কলমে প্রায় ঠিক করে রেখেছেন। তবু অন্যান্য প্রমাণ থেকে এবং খানিকটা কাগজপত্র থেকেও তাঁর প্রতারণার এত পরিষ্কার হদিশ পাওয়া যায় যে, কোনো লিখিত দলিলের দরকারই করে না। এইভাবে বেনামীতে হাট-বাজার বন্দোবস্ত নিয়ে গোবিন্দরাম কোম্পানির জমিদারির আয়ের কয়েক লক্ষ টাকা অপহরণ করেন।
হলওয়েল আরও অভিযোগ করেছেন যে, এই ‘ব্ল্যাক ডেপুটির’ ‘ব্ল্যাক ইনকামের’ আরও অনেক পন্থা ছিল, যা ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যায় না। কলকাতার কাছারির জন্য তিনি পাইক-বরকন্দাজ, মুহুরি-সরকার প্রভৃতির বেতন আদায় করতেন কোম্পানির কাছ থেকে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই হয় তাঁর নিজের বাড়িতে, না হয় তার কোনো জমিদারি-মহলে বা হাট-বাজারে কাজ করত। অর্থাৎ তিনি তাঁর নিজের কর্মচারীদের বেতন, কাছারির নাম খাতায় লিখে, কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করতেন। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, বনজঙ্গল পরিষ্কার, ঘাট ও পুল তৈরি বাবদ তিনি কোম্পানির কাছ থেকে মধ্যে মধ্যে যে টাকা নিয়েছেন, তা বেশিরভাগই কাজে খরচ না করে আত্মসাৎ করেছেন। এমনকী, কলকাতার কাছারি-সংস্কারের টাকাও মেরে দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। এ দেশের লোকেরা, বিশেষ করে জমিদারির অধীন প্রজারা, তাদের সমস্ত অভাব-অভিযোগ স্বভাবতঃই তাঁর কাছে পেশ করত, কিন্তু রীতিমত সেলামি না নিয়ে কোনো অভিযোগই তিনি কর্ণপাত করতেন না। এই সব উপায়েও যে তিনি আঠাশ বছরে কোম্পানির কত হাজার হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার হিসাব নেই কোথাও।
জমিদার হলওয়েল হয়ত তাঁর ‘ব্লাক ডেপুটি’ গোবিন্দরামের উপর কোনো কারণে অত্যাধিক বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন, তাই প্রতারণার অভিযোগও তাঁর দীর্ঘ হয়েছে। হয়ত তাঁর অভিযোগ সব সত্য নয়, কিছুটা অতিরঞ্জিত ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষপ্রসূত। তা ছাড়া, গোবিন্দরামের যে শঠতা ও প্রতারণার কথা তিনি বলেছেন, তা থেকে তিনি বা তাঁর স্বজাতিরা কেউই তখন মুক্ত ছিলেন না। ব্যক্তিগত উদ্যম ও উদযোগের সঙ্গে খানিকটা শঠতা ও প্রতারণাই ছিল তখনকার দিনে কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থলাভের ক্ষেত্রে, সবচেয়ে সুগম ও সুবিস্তৃত পথ। গোবিন্দরাম, তাঁর সমসাময়িক আরও দু-চারজন ভাগ্যবানদের মতন, সেই পথেই অগ্রসর হয়ে নবযুগের বাংলার প্রথম পারিবারিক ধনাভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিদেশি ইংরেজদের যখন রাজাবাদশাহরাও ভয় করে চলতেন, তখন সাধারণ একজন স্বল্পশিক্ষিত বাঙালি হয়ে গোবিন্দরাম তাঁদের যেভাবে আয়ত্তে রেখে কার্যোদ্ধার করেছিলেন, তাতে তাঁর ক্ষমতার তারিফ না করে পারা যায় না। নতুন যুগের বাংলার সমাজে ‘ধনিক হওনের’ অনেক পন্থার মধ্যে গোবিন্দরামের পন্থা একটি, এবং অন্যতম।
দালাল ও দাদন-ব্যবসায়ী। কোম্পানির ব্যবসায়ের দালালি করে আঠার শতকে বাংলাদেশের একদল লোক প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বাঙালি শেঠ বসাকরা প্রধান। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দেশে যে-সব পণ্যদ্রব্য কিনতেন ইংলণ্ড ও ইউরোপের বাণিজ্যের জন্য, তাকে তখন ‘ইনভেস্টমেণ্ট’ বলা হত। এই ‘ইনভেস্টমেণ্ট’ যাঁরা দাদন দিয়ে কোম্পানিকে সরবরাহ করতেন, তাঁদের বলা হত ‘দাদনি-মার্চেণ্ট’ বা ‘দাদনি-বণিক’। কোম্পানির আমলের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রভাবশালী দালাল ও দাদনি-বণিক হলেন শেঠরা এবং তাঁদেরই জ্ঞাতি বসাকরা। শেঠরা ও বসাকরা, ইংরেজরা কলকাতায় পদার্পণ করার আগেই, সূতানুটি কলকাতা অঞ্চলে এসে (ভাগীরথীর পশ্চিমে হুগলি-সপ্তগ্রাম থেকে) বাণিজ্যের জন্য বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৭০৭ তারিখের ডাইরি ও ‘কনসাল্টেশন বুকের’ একটি প্রস্তাব থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রস্তাবে শেঠদের বাগানের খাজনা বিঘা প্রতি আটআনা করে কমিয়ে দেওয়া হয়। তাতে বাগানের খাজনা মোট প্রায় ৫৫ টাকা কমে যায়। এই হিসেব থেকে বোঝা যায়, শেঠদের অন্তত ১১০ বিঘার একটি বাগান ছিল কলকাতায়। শেঠরা কলকাতার প্রাচীন বাসিন্দা বলে, এবং তাঁদের এলাকাধীন রাস্তাঘাট নিয়মিত সংস্কার করে তাঁরা ঠিক রাখবেন বলে, কোম্পানির কর্তারা তাঁদের খাজনা হ্রাস করেছিলেন। সেইটাই, স্বভাবিক, কারণ ইংরেজরা আসলে ছিলেন বস্ত্র-ব্যবসায়ী, এবং শেঠ-বসাকরাও জাতিতে ছিলেন তন্তুবণিক। সুতরাং কোম্পানির কাপড়ের ইনভেস্টমেন্টের জন্য দাদন তাঁরা নিজেদের জাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বণ্টন করে দেবার চেষ্টা করতেন। ২৩ মে ১৭৪৮, তারিখের ‘কনসাল্টেশন’ থেকে তার চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায়। শেঠরা নিজেদের জাত-ব্যবসায়ীদের ছাড়া আর কাউকে দাদন দিতে সম্মত হন না :
The Sets being all present at the Board inform us that last year they dessented to the employing of Fillick Chund, Gosserain, Occore, and Otteram, they being of different caste and consequently they could not do business with them, upon which account they refused Dadeny, and having the same objection to make this year, they propose taking their shares of the Dadney if we should think proper to consent thereto. (Consultations May 23, 1748)
জনৈক ‘ফিল্লিকচাঁদ’ (ফটিকচাঁদ?), ‘গোসারেন’ (গোঁসাই?) ‘ওক্কোর’ (অক্রুর?) ‘ওত্তিরাম’ (আত্মারাম?) ব্যবসায়ের জন্য কোম্পানির কাছ থেকে দাদন পেয়েছিলেন বলে শেঠরা আপত্তি জানিয়েছিলেন কারণ তাঁরা ভিন্নজাতের লোক। এইভাবে ভিন্নজাতের লোককে দাদন দিলে শেঠরা আর কোম্পানির ইনভেস্টমেণ্টের জন্য দাদন নেবেন না বলে তাঁদের সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তের বিশেষ সামাজিক গুরুত্ব আছে। এ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তখনও সনাতন জাতিগত সীমানার মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই গণ্ডিও যে ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছিল, এবং অন্যান্য জাতির ও পেশার লোকেরাও যে নিজেদের প্রথাসিদ্ধ জাতিকর্ম ছেড়ে স্বাধীন বাণিজ্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হচ্ছিলেন, তাও ফটিকচাঁদ, গোঁসাই, অক্রুর ও আত্মরামের দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়। তা হলেও, দালালি ও দাদনি-ব্যবসা আঠার শতকের দিকে যে মোটামুটি কলকাতার শেঠ বসাকদেরও আয়ত্বে ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তখনকার বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বৈষ্ণবদাস শেঠ, শ্যামসুন্দর শেঠ,গোপীনাথ শেঠ, রামকৃষ্ণ শেঠ, শোভারাম বসাক, লক্ষ্মীকান্ত শেঠ ও অমিচাঁদ। যে বিপুল বিত্ত তাঁরা দালালি ও বাণিজ্যের দ্বারা সঞ্চয় করেছিলেন তার কোনো তুলনা হয় না।
কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের আদি বাসিন্দা এই বাঙালি তন্তুবণিক শেঠ-বসাকরা। বাণিজ্যে ও সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তাঁদের সমকক্ষ তখন কেউ ছিলেন কিনা সন্দেহ। ধনদৌলতের আভিজাত্য ও আড়ম্বরের দিক থেকেও তখন এই বাঙালি শেঠ-বসাকরা সত্যই বড়বাজারের সবচেয়ে প্রভাবশালী বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু আজও তাঁদের আভিজাত্য ও প্রতিষ্ঠা দুইই ম্নান হয়ে গেছে। জাত-ব্যবসা থেকেও তাঁরা বহুদূরে কোণঠাসা হয়ে গেছেন। বড়বাজারে একদা তাঁরাই বড় ছিলেন আজ তা অবাঙালি ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তি দেখে কিছুই বোঝা যায় না। আভিজাত্যের কঙ্কালের মতন দণ্ডায়মান তাঁদের জীর্ণ অট্টালিকাগুলির দিকে চেয়ে মনে হয়, এসব যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদের ইতিহাস তাঁদের বর্তমান বংশধররাই জানেন না, দেশের অন্যান্য লোক তো দূরের কথা। বড়বাজারে কি কৌশলের জোরে অন্যেরা বাণিজ্যের সিংহাসন দখল করে বসলেন, এবং বাঙালি তন্তুবণিকরা সিংহাসনচ্যুত হলেন, সে-কাহিনির উৎস আজ অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।
এ ছাড়া স্বাধীন বাণিজ্যক্ষেত্রে মতিলাল শীল, রামদুলাল দে, মদন দত্ত, বারাণসী ঘোষ প্রভৃতির মতন কৃতী ব্যবসায়ীও তখন অনেক ছিলেন। আর্থিক ও সামাজিক প্রাধান্য দুইই তাঁদের যথেষ্ট ছিল। পরবর্তীকালে সেই প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য তাঁদের উত্তরপুরুষেরা পাননি। কেন পাননি তাও অনুসন্ধানের বিষয়।
বাস্তবিকই ভবানীচরণের ভাষায় বলা যায়, ‘ধার্ম্মিক ধর্মাবতার ধর্মপ্রবর্তক দুষ্টনিবারক সৎপ্রজাপালক সদ্বিবেচক ইংরাজ কোম্পানির বাহাদুর’ এদেশের লোকদের ‘অধিক ধনী হওনের অনেক পন্থা’ করেছিলেন। সেইসব পন্থার সুযোগ গ্রহণ করতে আমাদের দেশের লোক দ্বিধা করেননি। কেউ বেতনভুক কর্মচারী হয়ে, কেউ সর্দারি-পোদ্দার করে, কেউ দাদনি-বণিক ও দালাল হয়ে, কেউ দেওয়ানি বেনিয়ান করে, কেউ বা ঠিকাদারি ও স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য করে, কলকাতার নতুন শহুরে সমাজে নতুন বড়লোক হয়েছিলেন। সেকালের নবাবি আমলের বড়লোকেরা নবযুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ে একেবারে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন বলা চলে। কোম্পানির আমলে যাঁরা নতুন বড়লোক হলেন তাঁদের একপুরুষের বড়লোক বললে ভুল হয় না। অর্থাৎ একপুরুষের মধ্যে, প্রধানত একজন ব্যক্তির উদ্যম ও চেষ্টার ফলে, নবযুগের বাংলার সমাজে নতুন ধনিকশ্রেণির পত্তন হয়েছিল। সেই উদ্যম ও প্রচেষ্টার ধারা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, দ্বিতীয় পুরুষ পর্যন্ত কোনো রকমে প্রবাহিত হয়ে, হয় একেবারে থিতিয়ে গেছে, না হয় অন্য কোনো খাতে চালিত হয়েছে। স্বাধীন বাণিজ্যক্ষেত্রের ব্যক্তিগত উদ্যম অতি অল্পকালের মধ্যে চাকুরিজীবীর নিশ্চিন্ত আলস্য-বিলাসে পরিণত হয়েছে। নবযুগের বাংলার সমাজের এই শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিণতির জন্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নবজাগরণের ধারারও সুস্থ স্বাভাবিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে।
কিন্তু যে বিপুল বিত্ত নবযুগের বাংলাদেশের নতুন বড়লোকেরা নানা উপায়ে সঞ্চয় করেছিলেন, তা কোনদিকে এবং কী কারণে অবশেষে উজাড় হয়ে গেল? সক্রিয় বাণিজ্যিক উদ্যামের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে সঞ্চিত মূলধন বিপুল বেগে নিষ্ক্রিয় জমিদারি, মহাজনি ও বিচিত্র অমিতব্যয়ী ভোগবিলাসের পথে ধাবমান হল। স্বাভাবিক বাণিজ্যিক উদ্যমের পথে বিদেশি শাসক-বণিকরা অবশ্যই অনেক বাধা বিপত্তির সৃষ্টি করেছিলেন নিজেদের স্বার্থে। কিন্তু বাঙালিদের বাণিজ্যের উদ্যম কেবল সেই কারণে উবে গেছে, একথা সম্পূর্ণ সত্য নয়, অর্ধসত্য মাত্র। মতিলাল বা রামদুলালের বংশধরদের ইংরেজরা নিশ্চয়ই ফরমান জারী করে বলেন নি যে, তাঁদের জমিদার বা বাড়িওয়ালা হতে হবে, টাকাপয়সা সিন্দুকে পুরে সুদখোর মহাজন হতে হবে, ঘৌড়দৌড়ের মাঠে, যাত্রা-থিয়েটারে বা বাইজীনাচে ও ভোজসভায় দুহাতে অর্থের অপব্যয় করতে হবে, ধর্মকর্মে পিতৃমাতৃশ্রাদ্ধে, অথবা পোষা কুকুর-বাঁদরের বিয়েতে লাখ-লাখ টাকা ফুঁকে দিতে হবে, এবং স্বাধীন বাণিজ্যের উদ্যম ছেড়ে পরাধীন চাকরির দাসত্ব করতে হবে। ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থেও নতুন বড়লোকদের এই পরিণতি চাইতে পারেন না। আঠার শতকের শেষদিকেই ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে ‘public credit’-এর অভাব প্রসঙ্গে বলেছিলেন :
The fact is, that our public credit, by which I mean the credit of our Intrerest Notes, and Treasury Orders, never extended beyond the English servants of the Company, and the European inhabitants of Calcutta; and to these may be added a few, and a very few, of the old Hindoo families at the Presidency. All the other inhabitants of the Provinces are utterly ignorant of the advantage and security of our funds, and have other ways of employing their money, such as purchases of landed property, loans at an usurious and accumulating monthly interest, and mortgages, to which though less profitable in the end, and generally insecure, they are so much attached by long usage, and the illusion of a large growing profit, that it would not be easy to wean them from these habits… (Mr. Hasting’s Review of the state of Bengal, London, 1786.)
কোম্পানির ‘ইণ্টারেস্ট নোট’, ‘ট্রেজারি অর্ডার’ এদেশের ধনী লোকেরা কিনতে চান না বলে হেস্টিংস অভিযোগ করেছেন। কারণ ভূসম্পত্তিতে ও সুদের কারবারে সঞ্চিত মূলধন খাটালে তাঁরা অনেক বেশি লাভবান হবেন বলে তাঁদের ধারণা। সেইজন্য কোম্পানির ‘পাবলিক ক্রেডিটের’র ক্ষেত্র কলকাতার ইউরোপীয়ানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশের ধনিক হিন্দু পরিবারের মধ্যে দু-চারজন মাত্র এই ক্রেডিটের সুযোগ নিতেন, বাকি সকলে বন্ধকী ও মহাজনি কারবারে এবং জমিদারি কেনাকাটায় তাঁদের মূলধন খাটাতেন। আঠার শতকের শেষদিকের মধ্যেই বাঙালি ধনিকদের এই মনোভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ আধুনিক ধনিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা যাঁরা, তাঁরাই তাঁদের জীবনের সঞ্চিত মূলধন এই চিরাচরিত বিনিয়োগ করতে আরম্ভ করেছিলেন। যেসব অর্থনৈতিক গুণের জন্য শিল্পবাণিজ্যের যুগের সঞ্চিত টাকা সক্রিয় মূলধন হয়ে ওঠে, তার কোনো গুণেই আমাদের দেশের ধনবানদের টাকা গুণী হয়ে ওঠেনি। সুদ খাটালে টাকায় টাকা বাড়ে, এবং জমিজমায় নিয়োগ করলে তার নিরাপত্তা বাড়ে, টাকা সম্বন্ধে এই সনাতন মনোভাব বাঙালি ধনিকরা নতুন যুগের সামাজিক পরিবেশে বিশেষ বদলাতে চাননি। গোড়া থেকে এই মনোভাব বদলানোর সুযোগ, ঐতিহাসিক কারণে তাঁরাই বেশি পেয়েছিলেন, এবং গোড়া থেকেই তাঁরা তা জাতীয় চরিত্রের রক্ষণশীলতার জন্য গ্রহণ করতে চাননি। অবশ্য বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থনৈতিক স্বার্থের অন্তরায়ও ছিল যথেষ্ট, কিন্তু তাঁরা সচেষ্ট ও সক্রিয় হলে তা কিছুটা হয়ত অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারতেন।
আধুনিক যুগের সূচনা থেকে বাঙালিরা উদযোগী হয়ে সামাজিক অগ্রগতির পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, ইতিহাসে তার পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে। কিন্তু সেই অগ্রগতির ধারা যে নিরবচ্ছিন্ন ছিল না, এবং পদে-পদে বিপরীত পশ্চাদগতির ধারার আঘাতে তা যে ব্যাহত হয়েছে, উনিশ শতকের জাগরণের ইতিহাসের বিস্ময়কর উত্থান ও পতন তার প্রমাণ। সেইজন্য প্রশ্ন জাগে মনে যে, বাঙালির রক্ষণশীলতাই আসল জাতীয় চরিত্র কি না, এবং তার প্রগতিশীলতা নকলনবীশের সাময়িক উচ্ছ্বাস-প্রবণতার নামান্তর কি না। একথাও মনে হয়, যে-জাতি গত দুশো বৎসর ধরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেকালের জমিদার ও সুদখোর মহাজনের মনোবৃত্তি বর্জন করতে পারেনি, সামাজিক ক্ষেত্রে তার সত্যিকার প্রগতিশীল মনোভাব থাকতে পারে কি না! দুএকজন কৃতী পুরুষের দৃষ্টান্ত দিয়ে জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ব্যাখা করা যায় না। তাঁদের ‘ব্যতিক্রম’ বলাই হয়ত সঙ্গত। আজকের বাংলার আর্থিক সঙ্কট ও চাকুরিগত নিশ্চিন্ত নিষ্ক্রিয় মনোভাবের জন্য এই রক্ষণশীলতা কতখানি দায়ী, তাও চিন্তার বিষয়। তা যদি হয়, তা হলে আধুনিক যুগের বাঙালি বড়লোকদের ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের উৎপত্তি, বিকাশ ও পরিণতির ধারা থেকেই চিন্তার খোরাক পাওয়া যাবে বেশি।