আমার ভাশুরদের মধ্যে সব থেকে সুন্দর কথা বলেন, কী গুণী, গান-বাজনা-লেখা, সবদিকে ওঁর প্রতিভা,—তিনি ওঁর নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
যা সুন্দর দেখতে!
ওঁর চেয়েও সুন্দর!
তবে দেখলেই মনে হয় ভারি দুঃখী।
সব সময়ে মন খারাপ করে থাকেন। তেমন মেশেন না কারও সঙ্গে।
শুনেছি এক সময়ে খুব মিশুকে ছিলেন।
আমোদ-আহ্লাদ-গান-বাজনা-থিয়েটার, এইসব নিয়ে থাকতেন।
স্ত্রীর আত্মহত্যার পর থেকে উনি অন্য মানুষ।
আমি বরাবর এই অন্য মানুষটাকেই দেখেছি।
আগে যেরকম ছিলেন, সেই মানুষটি সম্পর্কে কত কথা শুনেছি। তাঁকে তো দেখলুম না কোনওদিন।
আমার সঙ্গে তো একেবারেই মিশলেন না কোনওদিন। হয়তো আমাকে এ-বাড়ির অপয়া বউ ভাবেন। তেমন ভাবাই তো স্বাভাবিক। আমার বিয়ের দিনেই শিলাইদহে মারা গেলেন আমার বড় ননদ সৌদামিনী দেবীর স্বামী সারদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবামশায় বিয়েতে অনুপস্থিত থাকলেন। আর আমার বিয়ের ক’মাস পরেই তো নতুন বউঠান আত্মহত্যা করলেন।
বরাবর একটা কথা আমার মনে হয়েছে।
ছোট বড় মুখে কথা হবে, তাই কথাটা কাউকে বলতে পারিনি।
কথাটা হল, ওঁর নতুনদাদার যদি একটি সন্তান হত, ওঁর জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।
কেন সন্তান হল না?
সবাই দোষ চাপাল নতুন বউঠানের ঘাড়ে।
এ-ব্যাপারে মেয়েমানুষেরই যেন যত দোষ, বরাবর দেখেছি।
আমার ভাশুরেরও তো দোষ থাকতে পারত।
কে বলবে? সে কথা ভাবাও অন্যায়।
পরিবারের সবাই নতুন বউঠানের দিকেই ঢিল ছুড়লেন।
উনিও মনে-মনে নিজেকে বাঁজা ভেবে অপরাধী করে ফেললেন।
মনের কষ্ট কাকে জানাবেন?
কষ্ট জানাবার একটিই লোক সারা পরিবারে—
আমার স্বামী।
আমার বিয়ের পরে নতুন বউঠানের নিশ্চয় মনে হয়েছিল, একমাত্র বন্ধু, তাঁর প্রাণের রবি, সেও দূরে সরে গেল।
নতুন বউঠানকে দূর থেকে দেখতুম।
কাছে গিয়ে তাঁকে চেনবার জানবার সুযোগ আর হল কই?
আমিও এলাম রবি ঠাকুরের বউ হয়ে আর উনিও চলে গেলেন চিরদিনের জন্যে।
তা ছাড়া কাছে যাওয়ার সুযোগ হলেও দশ বছর বয়েসে মাত্র মাস তিনেকের মধ্যে কতটুকুই বা বুঝতে পারতুম তাঁকে?
শুধু এইটুকু মনে আছে, আমাকে উনি এতটুকু ভালোবাসতেন না।
যদিও তাঁর প্রিয় দেওরের জন্যে বউ পছন্দ করার দলের মধ্যে উনিও ছিলেন।
উনি যেতে চাননি।
নিশ্চয়ই এই কাজটি করতে ওঁর নানা কারণেই ভালো না লেগে থাকতে পারে।
তবু গিয়েছিলেন।
যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বলেই মনে হয়। পিছনে ছিল বাবামশায়ের কড়া আদেশ। অনিচ্ছাসত্বেও গিয়েছিলেন বলেই হয়তো ধকল সহ্য করতে পারেননি।
খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
আমাকে নিশ্চয় প্রিয়তম পুরুষ রবির বউ হিসেবে ওঁর পছন্দও হয়নি।
ওঁর দেওরটির বিয়ে হয়ে যাক, এটাই তো উনি চাননি।
আমি যদি সুন্দরী হতুম?
বা নিদেনপক্ষে কিশোরী?
তাহলে নিশ্চয়ই আরও খারাপ লাগত ওঁর।
নেহাত বালিকা এবং রোগা ডিগডিগে এক্কেবারে হেলাফেলার যোগ্যা গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে—এই যা রক্ষে!
কোথায় পঁচিশ বছরের সুন্দরী, বিদুষী, রবি ঠাকুরের প্রাণের মানুষ নতুন বউঠান আর কোথায় আমি ন’বছর ন’মাসের একরত্তি গ্রাম্য বালিকা—কোনও তুলনা হয় নাকি?
আগেই বলেছি, আমার রবি ঠাকুরের বয়েস তখন তেইশ।
ছ’ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এক তরতাজা তরুণ, কী বলিষ্ঠ শরীর কী বলব!
আর নতুন বউঠান ছিপছিপে তরুণী। উনি যত ফরসা, নতুন বউঠান ততই শ্যামবর্ণ। কিন্তু কী যেন একটা কিছু নতুন বউঠানের ভিতরে ছিল, বিশেষ করে ওঁর চোখে, টেনে নেওয়ার শক্তি ছিল। উনি তো বলেন, নতুন বউঠানের চোখ উনি কখনও ভুলবেন না। একদিকে এইরকম এক বউদি, যাকে হাসলে ভারি সুন্দর দেখায়, যিনি তাকালে প্রাণে টান লাগে, যাকে দেখলেই অন্যদের থেকে অন্যরকম মনে হয়, আমার ভাষা নেই যে বোঝাই ঠিক কীরকম—আর একদিকে আমি বছর দশেকের ম্যাড়মেড়ে গ্রামের মেয়ে।
তবু আমিই রবি ঠাকুরের বউ!
আর নতুন বউঠান কেমন যেন ম্লান ছায়ার মতো একটা মানুষ—একদিন উনিই আমাকে বললেন, ছোটবউ, নতুন বউঠান কিন্তু একদমই এরকম ছিলেন না। ক’মাসের মধ্যে এরকম হয়ে গেছেন।
কীরকম ছিলেন উনি? জিগ্যেস করলুম আমার রবি ঠাকুরকে।
উনি বললেন, সে তুমি বুঝবে না। নাগপাশের মতো। যখন প্রথমবার বিলেত থেকে ফিরে এলুম, নতুন বউঠানের সঙ্গে দেখা হল, তখন তো মনে হয়েছিল, আবার আমার বাংলাদেশ, সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দক্ষিণে বাতাস আর সেই নতুন বউঠান, মনে হল নাগপাশের দ্বারা জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে বসে থাকতে চাই, আর কিছু চাইনে।
কী সুন্দর কথা বলেন বলুন তো আমার রবি ঠাকুর। এরকম কথা আর কাউকে বলতে শুনিনি কখনও।
উনি কবি মানুষ। অনেক কিছুই কল্পনা করে নেন। যা ঘটে না তাও। যা অতি সাধারণ তার মধ্যেও অসাধারণ কিছু অনুভব করে গান লিখে ফেলতে পারেন।
এই যে উনি বললেন, নতুন বউঠান নাগপাশের মতো, বিলেত থেকে ফিরে উনি সেই নাগপাশে জড়িত বেষ্টিত হয়ে বসে রইলেন,“আমার মনে হচ্ছে এই সবই ওঁর কল্পনা।
নতুন বউঠান তো কোনওদিন আমার কাছেই আসেননি।
কখনও কাছে ডাকেননি।।
ভালোবেসে আদর করা, জড়িয়ে উড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। আমাদের পাড়াতে দুপুরবেলা ডাক দিয়ে কত খেলনাওলা যেত, কৃষ্ণনগরের পুতুল, রান্নাবাটি হাঁড়িকুড়ি কতসব—একটা খেলনাও তো কিনে দিতে পারতেন নতুন বউঠান।
কোনওদিন দেননি।
আমার জন্যে বিয়ের পরেই অনেক খেলনা পাঠিয়েছিলেন বাবামশায়।
ছেলের বিয়েতে উনি আসেননি বটে। কিন্তু আমার জন্যে খেলনা পাঠাতে ভোলেননি। আমার বিয়ের তিন মাসের মধ্যে আমি নতুন বউঠানকে যতটুকু বুঝতে পেরেছিলুম, ওই বয়েসে কী-ই বা বোধবুদ্ধি আমার—তবুও যতটুকু বুঝেছি, মনে হয়েছে তিনি একেবারেই খোলামেলা মানুষ নন। কেমন যেন নিজের মধ্যে সিঁধিয়ে-যাওয়া মানুষ।
আমার পরে মনে হয়েছে—পরে মানে যখন আমি ছেলেপিলের মা হলুম, রীতিমতো সংসারী হয়ে উঠলুম, তখন বুঝতে পারলুম নতুন বউঠানের পায়ের তলায় কোনও মাটি ছিল না।
এই সংসারে কোনওদিন উনি হালে পানি পাননি।
যদিও সংসারের পুরুষমহলে ওঁর হঠাৎ বেশ কদর হয়েছিল।
সেটাও অনেকটাই অবিশ্যি আমার স্বামীর জন্যেই।
স্বয়ং রবি ঠাকুর ওঁকে কতগুলি বই পরপর উৎসর্গ করলেন।
আর কী ভাষায় সেইসব উৎসর্গ!
স্পষ্ট করে বলছেন না কিন্তু নতুন বউঠানকে দিলুম।
’প্রকৃতির প্রতিশোধ’ উনি উৎসর্গ করেছেন শুধু এইকথা লিখে ‘তোমাকে দিলাম।’
তারপর ‘শৈশবসংগীত’ বেরোল। উনি উৎসর্গ করলেন নতুন বউঠানকেই। লিখেছেন ‘তোমাকেই দিলাম।’
এসব আমি আগে কিছুই বুঝিনি।
এসব যে একটা ভাববার ব্যাপার, তাই মনে আসেনি কখনও।
অনেক পরে সব বুঝলাম। তখন তো নতুন বউঠান নেই।
কিন্তু নেই বলি কী করে?
‘ভানুসিংহের পদাবলী’ যখন বেরোল তখন তো নতুন বউঠান চলে গেছেন।
কিন্তু সেই বইও উৎসর্গ করলেন ওঁকেই। কী বললেন? বললেন, ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে তুমিই তো অনুরোধ করেছিলে। তোমার সেই অনুরোধ তখন পালন করিনি। আজ সেই বই ছাপিয়েছি।
কিন্তু তুমি আর দেখতে পেলে না।
ছ’বছর পরে ‘মানসী’ প্রকাশিত হল।
উনি উৎসর্গপত্রে লিখেছেন—তব করে দিনু তুলি সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ। কার হাতে, স্পষ্ট করে বললেন না। আমার হাতেও তো হতে পারত।
‘মানসী’ যে বছর বেরোল সে-বছর আমাদের বিয়েরও সাত বছর হল।
কিন্তু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ তিনি যাঁর হাতে তুলে দিলেন তিনি নতুন বউঠান—সবাই বুঝল আর আমি বুঝব না?
সাত বছর আগে নতুন বউঠান চলে গেছেন, তবু তিনিই তখনও আছেন ওঁর সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে।
আমি থেকেও নেই।
ঠিক মনে নেই, আরও বোধহয় বছর ছয়েক পরে ছাপা হল ওঁর বিখ্যাত কবিতার বই ‘চৈতালি’। আমি তখন ওঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের মা।
আমি জানতুম, আর যাকেই দিন, ‘চৈতালি’ উনি আমাকে দেবেন না। আমি তো তখন শুধু অমুকের আর অমুকের আর অমুকের মা। আর বাড়ির কাজের লোক।
কিন্তু ‘চৈতালি’ যেই হাতে এল, বইটি কাকে উনি উৎসর্গ করলেন সেটিই সবথেকে আগে জানতে চাইল আমার চোখ।
বলিহারি মেয়েমানুষের মন।
এ কীরকম উৎসর্গ?
উনি লিখেছেন, তব ওষ্ঠ দশনদংশনে টুটে যাক পূৰ্ণফলগুলি! প্রথমে আমি সত্যি বলছি কিছু বুঝতে পারিনি।
ভাবলুম, ওঁকেই জিগ্যেস করি।
তারপর মনে হল, কেউ তো ওঁকে কিছু জিগ্যেস করছে না। সবাই তো একেবারে চুপ।
তার মানে, সবাই বুঝছে আর বুঝেই চুপ করে আছে।
সবাই যা বুঝছে, আমিই বা বুঝব না কেন?
’দশনদংশন’ ছাড়া আর তো কোনও শক্ত কথা নেই। দশন মানে তো দাঁত, সে তো আমি জানি। আর দংশন হল কামড়।
তার মানে যাকে উৎসর্গ করা হল তার দাঁতের কামড়, এই তো?
কী হবে সেই দাঁতের কামড়ে?
ভেঙে যাবে রসে ভরতি ফলগুলি।
সেই রসে ভরতি ফলগুলিই কি নয় ‘চৈতালি’র কবিতা?
তখনই মনে এল, একদিন উনি আমাকে বলেছিলেন, নতুন বউঠানকে হাসলে ভারি সুন্দর দেখাত।
ওঁর দাঁতগুলি ভারি সুন্দর ছিল তো!
আমি উৎসর্গের এই কথাগুলির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেম। বুঝবার আর কিছু বাকি থাকল না আমার।
একসময়ে ঠাকুরবাড়িতে যে গানবাজনা, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, এই সব হত তার মাঝখানে ছিলেন আমার মেজোজা জ্ঞানদানন্দিনী। খুব দাপট ছিল তাঁর।
সব বদলে দিলেন ওঁর নতুন দাদার বন্ধু বিহারীলাল চক্রবর্তী।
উনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধু হিসেবে। এবং যাকে বলে, উড়ে এসে জুড়ে বসলেন।
বিহারীলাল ছিলেন খুব নামকরা কবি। নতুন বউঠান নাকি ওঁর কবিতা বিশেষ পছন্দ করতেন।
আর বিহারীলালও ক্রমে এ-বাড়িতে ঘনঘন আসতে শুরু করলেন নতুন বউঠানের জন্যেই।
নতুন বউঠানের উদ্দেশে কবিতা লিখতে লাগলেন। তাঁকে সেগুলি পড়ে শোনাতেন। শুনেছি, ভালোবাসার কবিতা।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো কবি যে-মেয়ের জন্যে কবিতা লেখেন, যে মেয়েকে সেইসব কবিতা পড়ে শোনাবার জন্যে আমাদের বাড়িতে আসেন, যে-মেয়ে ক্রমেই হয়ে ওঠে তাঁর প্রাণের মানুষ সেই মেয়ে ক্রমে এ-বাড়ির গানবাজনা, সাহিত্য, এসব নিয়ে আসরের প্রধান হয়ে তো উঠবেনই। আড়ালে সরে গেলেন জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি তো চলেই গেলেন এ-বাড়ি থেকে। আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলুম, নতুন বউঠানকে তিনি ঈর্ষা করতেন।
যাইহোক, আমার তো মনে হয় বিহারীলালের ভালোবাসাই নতুন বউঠানকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নায়িকা করে তুলল। তখন কোথায় আমার বর রবি ঠাকুর? তিনি তখন নিতান্ত নাবালক। বিহারীলাল ভালোবাসতেন নতুন বউঠানকে। আর নতুন বউঠান? শুনেছি, বিহারীলালের ভালোবাসার কবিতা শুনে খুশি হয়ে নতুন বউঠান তাঁকে রান্না করে নানারকম খাওয়াতেন। মাঝেমধ্যে উপহারও দিতেন। নিজের হাতে একটি আসন বুনে তিনি নাকি বিহারীলালকে দেন। তাতে আমার বরের খুব হিংসে হয়েছিল।
আর আমার বর খুব দুঃখ পেত যখন নতুন বউঠান ওকে বলতেন, ঠাকুরপো, তুমি কোনওদিন বিহারীলালের মতো ভালো কবিতা লিখতে পারবে না। ঠিক বললুম কি? দুঃখ হত, আবার অভিমানও হত আমার বরের নতুন বউঠানের মুখে একথা শুনে।
আপনাদের রবি ঠাকুর একদিন আমাকে কিঞ্চিৎ মজা করেই বললেন, জানো ছোটবউ, তখন আমার বছর পনেরো বয়েস, নতুন বউঠানের মুখে ক্রমাগত বিহারীলালের প্রশংসা শুনতে শুনতে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমি শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকটাই অনুবাদ করে নতুন বউঠানকে শোনাতে লাগলেম। কিন্তু তাতে নতুন বউঠান এতটুকু ইমপ্রেসড হয়েছিল বলে তো মনে হয় না। বিহারীলালের কবিতাতেই তিনি মুগ্ধ হয়ে থাকলেন।
কিন্তু ছোটবউ, ম্যাকবেথ অনুবাদ করতে-করতে আমার মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল, বললেন আপনাদের রবি ঠাকুর।
কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। হয়তো ভাবলেন আমি বুঝতে পারব না। উনি আবার বলতে লাগলেন–
ম্যাকবেথ নাটকেই আছে ‘হেকাট’ নামের এক ডাইনির প্রসঙ্গ। আসলে কিন্তু ওর নাম ‘হেকেটি’। হেকেটি বা হেকাট শুধু শেক্সপিয়রের ডাকিনি নয়। সে এক গ্রিক দেবী যে থাকে এক রহস্যময় অন্ধকারে। সে আসলে অন্ধকারের দেবী। তাকে দেখা বা বোঝা যায় না। শুধু অনুভব করা যায় তার আকর্ষণ। আমার মনে পড়ল নতুন বউঠানকে। হেকেটির মতোই নিঃসঙ্গ, হেকেটির মতোই অন্তরালবাসিনী। আমি আমার কবিতার খাতা মালতী পুঁথি-র পাতায় প্রবল আবেগে লিখতে লাগলেম, বারবার, হেকেট ঠাকরুণ, হেকেট ঠাকরুণ। কিছুদিনের মধ্যে আমি নতুন বউঠানকে হেকেটি বউঠান বলে ডাকতেও লাগলাম। তারপর শুধু ‘হে’ বলে।
আমি ‘হে’ বলে ডাকলে সে মুখে সাড়া দিত না।
শুধু আড়চোখে মৃদু হেসে তাকাত।
সেই তাকানো আমি ভুলতে পারিনি।
নতুন বউঠানের মধ্যে একটা দুষ্টুমি ছিল প্রথম থেকেই। ভারি মিষ্টি দুষ্টুমি, বললেন আমার স্বামী। আর বললেন, নতুন বউঠান চুপিচুপি একদিন বললে, ‘হে’ নামটা যেন কেউ জানতে না পারে। তোমার দেওয়া এই নামটি যেন তোমার কাছেই থাকে ঠাকুরপো।
সেদিন এর চেয়ে বেশি কিছু বলেননি আপনাদের রবি ঠাকুর।
নতুন বউঠান সম্পর্কে আমি যা জেনেছি, সবই আমার শোনা কথা।
নানা মুখের নানা কথা ক্রমে আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে একটা ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে নতুন বউঠান সম্পর্কে নানা কথা চলত।
নতুন বউঠানকে অনেকেই আড়ালে ‘মক্ষীরানি’ বলতেন।
নিজের কানে শুনেছি সেকথা।
দেবশ্রী চক্রবর্তীর বই যদি দেওয়া সম্ভব হয়, তবে দিলে খুব ভালো লাগবে। অশেষ ধন্যবাদ জানাই।