০৩. নজরুল

নজরুল

পদ্মানদীর তীরে আমাদের বাড়ি। সেই নদীর তীরে বসিয়া নানা রকমের কবিতা লিখিতাম, গান লিখিতাম, গল্প লিখিতাম। বন্ধুরা কেউ সে সব শুনিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিতেন, কেউ-বা সামান্য তারিফ করিতেন। মনে মনে ভাবিতাম, একবার কলিকাতায় যদি যাইতে পারি, সেখানকার রসিক-সমাজ আমার আদর করিবেনই। কতদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখিয়াছি, কলিকাতার মোটা মোটা সাহিত্যিক দের সামনে আমি কবিতা পড়িতেছি। তাহারা খুশি হইয়া আমার গলায় ফুলের মালা পরাইয়া দিতেছেন। ঘুম হইতে জাগিয়া ভাবিতাম, একটিবার কলিকাতা যাইতে পারিলেই হয়। সেখানে গেলেই শত শত লোক আমার কবিতার তারিফ করিবে। কিন্তু কি করিয়া কলিকাতা যাই। আমার পিতা সারা জীবন ইস্কুলের মাস্টারী করিতেন। ছেলেরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে এইরূপ আকাশকুসুম চিন্তা করে, তিনি জানিতেন। কিছুতেই তাহাকে বুঝানো গেল না, আমি কলিকাতা গিয়া একটা বিশেষ সাহিত্যিক খ্যাতি লাভ করিতে পারি। আর বলিতে গেলে প্রথম প্রথম তিনি আমার কবিতা লেখার উপরে চটা ছিলেন। কারণ পড়াশুনার দিকে আমি বিশেষ মনোযোগ দিতাম না, কবিতা লিখিয়াই সময় কাটাইতাম। তাতে পরীক্ষার ফল সব সময়ে ভাল হইত না।

তখন আমি প্রবেশিকার নবম শ্রেণীতে কেবলমাত্র উঠিয়াছি। চারিদিকে অসহযোগ-আন্দলনের ধুম। ছেলেরা ইস্কুল-কলেজ ছাড়িয়া স্বাধীনতার আন্দোলনের নামিয়া পড়িতেছে। আমিও স্কুল ছাড়িয়া বহু কষ্ট করিয়া কলিকাতা উপস্থিত হইলাম।

আমার দূর সম্পর্কের এক বোন কলিকাতায় থাকিতেন। তাঁর স্বামী কোন অফিসে দপ্তরীর চাকুরী করিয়া মাসে কুড়ি টাকা বেতন পাইতেন। সেই টাকা দিয়া অতি কষ্টে তিনি সংসার চালাইতেন। আমার এই বোনটিকে আমি কোনদিন দেখি নাই। কিন্তু অতি আদরের সঙ্গেই হাসিয়া তিনি আমাকে গ্রহণ করিলেন। দেখিয়াই মনে হইল, যেন কত কালের স্নেহ আদর জমা হইয়া আছে আমার জন্য তাহার হৃদয়ে। বৈঠকখানা রোডের বস্তিতে খোলর ঘরের সামান স্থান লইয়া তাঁহাদের বাসা। ঘরে সঙ্কীর্ণ জায়গা, তার মধ্যে তাদের দুইজনের মতন চৌকিখানারই শুধু স্থান হইয়াছে। বারান্দায় দুই হাত পরিমিত একটি স্থান, সেই দুই হাত জায়গা আমার বোনের রান্নাঘর। এমনি সারি সারি সাত-আট ঘর লোক পাশাপাশি থাকিত। সকাল-সন্ধ্যায় প্রত্যেক ঘরে কয়লার চুলা হইতে যে ধূম বাহির হইত, তাহাতে ওইসব ঘরের অধিবাসীরা যে দম আটকাইয়া মরিয়া যাইত না—এই বড় আশ্চর্য মনে হইত। পুরুষেরা অবশ্য তখন বাহিরে খোলা বাতাসে গিয়া দম লইত, কিন্তু মেয়েরা ও ছোট ছোট বাচ্চাশিশুরা ধুয়ার মধ্যেই থাকিত। সমস্তগুলি ঘর লইয়া একটি পানির কল। সেই কলের পানিও স্বল্প-পরিমিত ছিল। সময়মত কেহ স্নান না করিলে সেই গরমের দিনে তাহাকে অস্নাত থাকিতে হইত। রাত্রে এঘরে-ওঘরে কাহারও ঘুম হইত না। আলো-বাতাস বঞ্চিত ঘরগুলির মধ্যে যে বিছানা-বালিস থাকিত, তাহা রৌদ্রে দেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। সেই অজুহাতে বিছানার আড়ালে রাজ্যের যত ছারপোকা অনায়াসে রাজত্ব করিত। রাত্রে একে তো গরম, তার উপর ছারপোকার উপদ্রব। কোন ঘরেই কেহ ঘুমাইতে পারি না। প্রত্যেক ঘর হইতে পাখার শব্দ আসিত, আর মাঝে মাঝে ছারপোকা মারার শব্দ শোনা যাইত। তা ছাড়া প্রত্যেক ঘরের মেয়েরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে পরদা মানিয়া চলিত, অর্থাৎ পুরুষেরাই যার যার ঘরে আসিয়া পর্দায় আবদ্ধ হইত। প্রত্যেক বারান্দায় একটি করিয়া চটের আবরণী। পুরুষলোক ঘরে আসিলেই সেই আবরণী টাঙাইয়া দেওয়া হইত। দুপুরবেলা যখন পুরুষেরা অফিসের কাজে যাইত, তখন এঘরের ওঘরের মেয়েরা একত্র হইয়া গাল-গল্প করিত, হাসি-তামাসা করিত, কেহ-বা সিকা বুনিত, কেহ কাঁথা সেলাই করিত। তাদের সকলের হাতে রঙবেরঙের সূতাগুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া নক্সায় পরিণত হইত। পাশের ঘরের সুন্দর বউটি হাসিয়া হাসিয়া কখন ও বিবাহের গান করিত, বিনাইয়া বিনাইয়া মধুমালার কাহিনী বলিত। মনে হইত, আল্লার আসমান হইতে বুঝি এক ঝলক কবিতা ভুল করিয়া এখানে ঝরিয়া পড়িয়াছে।

এ হেন স্থানে আমি অতিথি হইয়া আসিয়া জুটিলাম। আমার ভগ্নীপতিটি ছিলেন খাঁটি খোন্দকার বংশের। পোলাও-কোর্মা না খাইলে তাহার চলিত না। সুতরাং মাসের কুড়ি টাকা বেতন পাইয়া তিনি পাঁচটাকা ঘরভাড়া দিতেন। তারপর তিন-চার দিন ভাল গোস্ত-ঘি কিনিয়া পোলাও-মাংস খাইতেন। মাসের অবশিষ্ট কোন কোন দিন খাইতেন, কোন দিন বা অনাহারে থাকিতেন।

মাসের প্রথম দিকেই আমি আসিয়াছিলাম। চার-পাঁচ দিন পরে যখন পোলাও-গোস্ত খাওয়ার পর্ব শেষ হইল, আমার বোন অতি আদরের সঙ্গে আমার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “সোনাভাই, আমাদের সংসারের খবর তুই জানিস না। এখন থেকে আমরা কোনদিন বা অনাহারে থাকব। আমাদের সঙ্গে থেকে তুই এত কষ্ট করবি কেন? তুই বাড়ি যা।”

আমি যে সঙ্কল্প লইয়া কলিকাতায় আসিয়াছি, তাহা সফল হয় নাই। কলিকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে এখনও আমি পরিচিত হইতে পারি নাই। বোনকে বলিলাম, “বুবুজান, আমার জন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না। কাল থেকে আমি উপার্জন করতে আরম্ভ করব।”

বুবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবে উপার্জন করবি রে?”

আমি উত্তর করিলাম, “এখন তাহা আপনাকে বলব না। পরে জানাব।”

পরদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া খববের কাগজের অপিসে ছুটিলাম। তখনকার দিনে ‘বসুমতী’ কাগজের চাহিদা ছিল সব চাইতে বেশী। কয়েকদিন আগে টাকা জমা দিলে হকাররা কাগজ পাইত না। নায়ক’ কাগজের তত চাহিদা ছিল না। বসুমতী অপিসে চার-পাঁচ দিন আগে টাকা জমা দেওয়ার সঙ্গতি আমার ছিল না। সুতরাং পাঁচখানা নায়ক কিনিয়া বেচিতে বাহির হইলাম। রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া ‘নায়ক, নায়ক’ বলিয়া চীৎকার করিয়া ফিরিতে লাগিলাম। সারাদিন ঘুরিয়া পঁচিশখানা নায়ক বিক্রয় করিয়া যখন বাসায় ফিরিলাম, তখন শ্রান্তিতে আমার শরীর অবশ হইয়া আসিয়াছে। পঁচিশখানা বিক্রয় করিয়া আমার চৌদ্দ পয়সা উপার্জন হইল। আমার পরিশ্রান্ত-দেহে হাত বুলাইতে বুলাইতে বোন সস্নেহে বলিলেন, “তুই বাড়ি যা। এখানে এত কষ্ট করে উপার্জন করার কি প্রয়োজন? বাড়ি গিয়ে পড়াশুনা কর।”

কিন্তু এসব উপদেশ আমার কানে প্রবেশ করিল না। এইভাবে প্রতিদিন সকালে উঠিয়া খবরের-কাগজ বিক্রয় করিতে ছুটিতাম। রাস্তায় দাঁড়াইয়া কাগজে বর্ণিত খবর গুলি উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করিতাম। মাঝে মাঝে কাগজের সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতাম। কলিকাতা সহরে কৌতূহলী লোকের অভাব নাই। তাহারা ভীড় করিয়া জড়াইয়া আমার বক্তৃতা শুনিত। কিন্তু কাগজ কিনিত না।

কাগজ বিক্রয় করিতে করিতে কার্তিকদাদার সঙ্গে পরিচয় হইল। বিক্রমপুরের কোন গ্রামে তাহার বাড়ি। তিনিও খবরের কাগজ বিক্রয় করিতেন। কি ভাবে তাহার সঙ্গে আলাপ হইল, আজ সমস্ত মনে নাই। তবে এতটুকু মনে আছে, আমার অবিক্রীত কাগজগুলি কার্তিকদাদা বিক্রয় করিয়া দিতেন। আমারই মত অনেক হকারের এটা-ওটা কাজ তিনি করিয়া দিতেন। সেইজন্য আমরা সকলে তাহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করিতাম।

আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে কার্তিক দাদা থাকিতেন। আমার বোনের বাড়িতে থাকার অসুবিধার কথা শুনিয়া কার্তিক দাদা আমাকে তাহার বাসায় উঠিয়া আসিতে বলিলেন। আট আনায় একটি মাদুর কিনিয়া লইয়া কার্তিকদাদার বাসায় উপস্থিত হইলাম। এক ভাঙা বাড়ির দ্বিতল কক্ষ কার্তিকদাদা ভাড়া লইয়াছিলেন। কক্ষটির সামনে প্রকাণ্ড খোলা ছাদ ছিল। সেই ছাদেই আমরা অধিকাংশ সময় যাপন করিতাম। বৃষ্টি হইলে সকলে ছাদ হইতে মাদুর গুটাইয়া আনিয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া আশ্রয় লইতাম।

সকাল হইলে যে যার মত খবরের কাগজ লইয়া বিক্রয় করিতে বাহির হইতাম। দেড়টা বাজিলে সকলে বাসায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর দুইটা তিনটার মধ্যে রান্না ও খাওয়া শেষ করিয়া তাড়াতাড়ি ছুটিয়া যাইতাম খবরের কাগজের আপিসে। তখনকার দিনে বাংলা কাগজগুলি বিকেলে বাহির হইত। রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত কাগজ বিক্রয় করিয়া ‘সায় ফিরিয়া আসিতাম। তারপর রান্নাখাওয়াটা কোন রকমে সারিয়া ছাদের উপর মাদুর বিছাইয়া তাহার উপর শ্রান্ত ক্লান্ত দেহটা ঢালিয়া দিতাম। আকাশে তারাগুলি মিটিমিটি করিয়া জ্বলিত। তাহাদের দিকে চাহিতে চাহিতে আমরা ঘুমাইয়া পড়িতাম। আকাশের তারাগুলি আমাদের দিকে চাহিয়া দেখিত কিনা কে জানে?

কোন কোন রাত্রে মোমবাতি জ্বালাইয়া কার্তিকদাদা আমার কবিতাগুলি সকলকে পড়িয়া শুনাইতেন। আমার সেই বয়সের কবিতার কতটা মাধুর্য ছিল, আজ বলিতে পারিব না। সেই খাতাখানা হারাইয়া গিয়াছে। আর আমার শ্রোতারা সেই সব কবিতার রস কতটা উপলব্ধি করিত, তাহাও আমার ভাল করিয়া মনে নাই।

কিন্তু তাহাদেরই মত একজন হকার যেসব কাগজ তাহারা বিক্রয় করে সেই সব কাগজের লেখার মত করিয়া যে লিখিতে পারিয়াছে, ইহা মনে করিয়া তাহারা গর্ব অনুভব করিত। কার্তিকদাদা আই. এ. পর্যন্ত পড়িয়াছিলেন। নন-কোঅপারেশন করিয়া কলিকাতায় আসিয়া খবরের কাগজ বিক্রয় পেশা হিসাবে লইয়াছেন। তিনি কট হামসুন ও ম্যক্সিম গোর্কীর জীবনী পড়িয়াছেন। আমাকে লইয়া তাঁহার গর্বের অন্ত ছিল না। কোন শিক্ষিত লোকের সঙ্গে দেখা হইলেই সগর্বে আমাকে কবি বলিয়া পরিচয় করাইয়া দিতেন।

আমাদের সংসারে ছিল দিন আনিয়া দিন খাওয়া। কেহই বেশী উপার্জন করিতে পারিত না। নন-কোঅপারেশন করিয়া আমাদের মতই বহু ভদ্রঘরের ছেলে খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে। সুতরাং কাগজ বিক্রয় করার লোকের সংখ্যা ছিল অত্যধিক। সারা দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করিয়াও আমাদের কেহ চার-পাঁচ আনার বেশী উপার্জন করিতে পারি না। আমি চৌদ্দ পয়সার বেশী কোন দিনই উপার্জন করিতে পারি নাই। মাঝে মাঝে শরীর খারাপ থাকিলে বেশী ঘুরিতে পারিতাম না, সুতরাং উপার্জনও হইত না। সেই দিনটার খরচ কার্তিকদাদা চালাইয়া দিতেন। পরে তাহার ধার শোধ করিতাম। কোন কোন দিন আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইতাম।

একদিনের কথা মনে পড়ে। কাগজ বিক্রয় করিয়া মাত্র এক আনা সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি! দুই পয়সার চিড়া আর দুই পয়সার চিনি কিনিয়া ভাবিলাম, কোথায় বসিয়া খাই? দুপুরবেলা আমার সেই বোনের বাড়ি গিয়া উপস্থিত হইলাম। বোন আমার শুষ্ক মুখ দেখিয়া প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলেন। তিনি আমার হাত হইতে চিড়া আর চিনির ঠোঙা ফেলিয়া দিয়া আমাকে আদর করিয়া বসাইয়া ভাত বাড়িয়া দিলেন।

আমি বলিলাম, “বুবু, আপনি তত খান নাই। আপনার ভাত আমি খাব না।”

বুবু বলিলেন, “আমায় আজ পেট ব্যাথা করছে। আমি খাব না। তুই এসে ভাল করলি। ভাতগুলি নষ্ট হবে না।”

আমি সরল মনে তাহাই বিশ্বাস করিয়া ভাতগুলি খাইয়া ফেলিলাম। তখন অল্প বয়সে তাঁহার এ স্নেহের ফাঁকি ধরিতে পারি নাই। এখন সেই সব কথা মনে করিয়া চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসে। হায় রে মিথ্যা! তবু যদি তাঁর মায়ের পেটের ভাই হইতাম! সাতজন্মে যাকে কোন দিন চোখে দেখেন নাই, কত দূরের সম্পর্কের ভাই আমি, তবু কোথা হইতে তাহার অন্তরে আমার জন্য এত মমতা সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। এইরূপ মমতা বুঝি বংলাদেশের সকল মেয়েদের অন্তরেই স্বতঃপ্রবাহিত হয়। বাপের বাড়ির কোন আত্মীয়কে এদেশের মেয়েরা অযত্ন করিয়াছে, এরূপ দৃষ্টান্ত চিৎ মেলে।

কার্তিকদার আড্ডায় দিনগুলি বেশ কাটিয়া যাইতেছিল। কিন্তু আমাকে খবরের কাগজ বিক্রয় করিলেই চলিবে না। কলিকাতায় আসিয়া লেখাপড়া করিতে হইবে। নেতাদের কথায় গোলামখানা ছাড়িয়া চলিয়া আসিয়াছি এখানকার জাতীয় বিদ্যালয়ে আমাকে পড়াশুনা করিতে হইবে। আমহাস্ট স্ট্রীটে একদিন জাতীয় বিদ্যালয় দেখিয়া আসিলাম। ক্লাসে গিয়াও যোগ দিলাম। ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক সবাই ইংরেজীতে পড়ান হয়। মাস্টার একজনও বাংলায় কথা বলেন না। কারণ ক্লাসে হিন্দীভাষী ও উদুভাষী ছাত্র আছে। বাংলায় পড়াইলে তাহারা বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু নবম শ্রেণীর ছাত্রদের কাছে ইংরেজীতে বক্তৃতা দিলে কতটাই বা তাহারা বুঝিতে পারিবে! তাদের ইংরেজী বিদ্যার পুজি তো আমার চাইতে বেশী নয়। সুতরাং জাতীয় বিদ্যালয়ের মোহ আমার মন হইতে মুছিয়া গেল। নেতাদের মুখে কত গরম গরম বক্তৃতা শুনিয়াছি। ইংরেজ-অমিলের বিদ্যালয়গুলি গোলামখানা; উহা ছাড়িয়া বাইরে আইস। এখানে বসন্তের মধুর হাওয়া বহিতেছে। আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ে আসিয়া দেখ, বিদ্যার সূর্য তার সাত ঘোড়া হাঁকাইয়া কিরূপ বেগে চলিতেছে। কিন্তু গোলামখানা ছাড়িয়া আমি কতদিন আসিয়াছি, বসন্তের হাওয়া তো বহিতে দেখিলাম না। জাতীয় বিদ্যালয়ের সেই সাত ঘোড়ার গতিও অনুভব করিতে পারিলাম না।

জাতীয় বিদ্যালয়ের এই সব মাস্টারের চাইতে আমাদের ফরিদপুরের জেলা-ইস্কুলের দক্ষিণাবাবু কত সুন্দর পড়ান, যোগেনবাবু পণ্ডিত মহাশয় কত ভাল পড়ান! আমার মন ভাঙিয়া পড়িল। সারাদিন খবরের কাগজ বেচিয়া রাত্রে ছাদের উপর শুইয়া পড়িতাম, এপাশের ওপাশের সহকর্মীরা ঘুমাইয়া পড়িত, কিন্তু আমার ঘুম আসিত না। মায়ের কথা ভাবিতাম, পিতার কথা ভাবিতাম। তাঁহারা আমার জন্য কত চিন্তা করিতেছেন! চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়া যাইত। এ আমি কি করিতেছি? এইভাবে খবরের কাগজ বিক্রয় করিয়া জীবন কাটাইয়া দিব? আমি লেখাপড়া শিখিব, মূখ হইয়া থাকিব? কে যেন অদৃশ্য স্থান হইতে আমার পিঠে সপাং সপাং করিয়া বেত্রাঘাত করিতেছে। নাঃ, আমি আর সময় নষ্ট করিব না, দেশে ফিরিয়া যাইব। দেশে ফিরিয়া গিয়া ভালমন্দ লেখাপড়া করিয়া মানুষ হইব। আমি সংকল্প স্থির করিরা ফেলিলাম।

দেশে ফিরিবার পূর্বে আমি কলিকাতার সাহিত্যিকদের কাছে পরিচিত হইয়া যাইব। ছেলেবেলা হইতে আমি সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুরাগী ছিলাম। তাঁহার সওগাত নামক গল্পগ্রন্থখানিতে মুসলমানদের জীবন লইয়া কয়েকটি গল্প লেখা ছিল। তাহা ছাড়া চারুবাবুর লেখায় যে সহজ কবিত্ব মিশ্রিত ছিল, তাহাই আমাকে তাহার প্রতি অনুরাগী করিয়া তুলিয়াছিল। আমি ভাবিলাম, তাঁহার কাছে গেলে তিনি আমাকে উৎসাহ দিবেন। এমন কি, আমার একটি লেখা প্রবাসীতেও ছাপাইয়া দিতে পারেন। তিনি তখন প্রবাসীর সহকারী-সম্পাদক।

অনেক কষ্টে প্রবাসী-অফিসের ঠিকানা সংগ্রহ করিয়া একদিন সেখানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তখনকার দিনে কনওয়ালিস স্ট্রীটে ব্রাহ্মসমাজের নিকটে এক বাড়ি হইতে প্রবাসী বাহির হইত। প্রবাসী-অফিসের দারোয়ানের কাছে চারুবাবুর সন্ধান করিতেই দারোয়ান মোটা একটি কালো লোককে দেখাইয়া আমাকে বলিল, উনিই চারুবাবু। সেই ভদ্রলোকের সামনে গিয়া সালাম করিয়া দাঁড়াইলাম।

“কি চাই?” বলিয়া তিনি আমাকে প্রশ্ন করিলেন।

আমি বলিলাম, “আমি কিছু কবিতা লিখেছি, আপনি যদি অনুগ্রহ করে পড়ে দেখেন বড় সুখী হব।”

ভদ্রলোক বলিলেন, “আমার তো সময় নেই।”

অতি বিনয়ের সঙ্গে বলিল, “বহুকাল হতে আপনার লেখা পড়ে আমি আপনার অনুরাগী হয়েছি। আপনি সামান্য একটু যদি সময়ের অপব্যয় করেন!”

এই বলিয়া আমি বগলের তলা হইতে আমার কবিতার খাতাখানা তাঁর সামনে টানিয়া ধরিতে উদ্যত হইলাম। ভদ্রলোক যেন ছুৎমার্গ গ্রস্ত কোন হিন্দু বিধবার মত অনেকটা দূরে সরিয়া গিয়া আমাকে বলিলেন, “আজ আমার মোটেই সময় নেই। কিন্তু ডুবন্ত লোকের মত এই তৃণখণ্ডকে আমি কিছুতেই ছাড়িতে পারিতেছিলাম না। কাকুতিমিনতি করিয়া তাহাকে বলিলাম, “একদিন যদি সামান্য কয়েক মিনিটের জন্যও সময় করেন।” ভদ্রলোকের দয়া হইল। তিনি আমাকে ছয়-সাত দিন পরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসিতে বলিলেন। তখন আমার প্রবাসের নৌকার নোঙর ছিড়িয়াছে। দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য আমার মন আকুলিবিকুলি করিতেছে। তবুও আমি সেই কয়দিন কলিকাতায় রহিয়া গেলাম। আমার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, একবার যদি তাহাকে দিয়া আমার একটি কবিতা পড়াইতে পারি, তবে তিনি আমাকে অতটা অবহেলা করিবেন না। নিশ্চয়ই তিনি আমার কবিতা পছন্দ করিবেন।

আবার সেই খবরের কাগজ বিক্রয় করিতে যাই। পথে পথে ‘নায়ক-নায়ক’—বলিয়া চীৎকার করি। কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে আমার গৃহগত মনের আবেগে সিক্ত হইয়া উঠে। দলে দলে ছেলেরা বই লইয়া ইস্কুলে যায়। দেখিয়া আমার মন উতলা হইয়া উঠে। আমিও পড়িব। দেশে গিয়া ওদের মত বই লইয়া আমিও ইস্কুলে যাইব। এত যে পয়সার অনটন, নিজের আহারের উপযোগী পয়সাই সংগ্রহ করিতে পারি না, তবুও মাঝে মাঝে এক পয়সা দিয়া একটা গোলাপফুল কিনিতাম। দেশে হইলে কারও গাছ হইতে বলিয়া বা না বলিয়া ছিড়িয়া লইলে চলিত। এখানে ফুল পয়সা দিয়া কিনিতে হয়। আমার একহাতে খবরের কাগজের বাণ্ডিল, আর এক হাতে সেই গোলাপফুল। সঙ্গীসাথীরা ইহা লইয়া আমাকে ঠাট্টা করিত।

আজও আবছা আবছা মনে পড়িতেছে—তের-চৌদ্দ বৎসরের সেই ছোট্ট বালকটি আমি, মোটা খদ্দরের জামা পরিয়া দুপুরের রৌদ্রে কলিকাতার গলিতে গলিতে ঘুরিয়া ‘চাই নায়ক’ ‘চাই নায়ক ‘চাই বিজলী’ করিয়া চিৎকার করিয়া ফিরিতেছি। গলির দুই পাশে ঘরে ঘরে কত মায়া, কত মমতা. কত শিশুমুখের কলকাকলি। গল্পে কত পড়িয়াছি, এমনি এক ছোট্ট ছেলে পথে পথে ঘুরিতেছিল; এক সহৃদয়া রমণী তাহাকে ডাকিয়া ঘরে তুলিয়া লইলেন। আমার জীবনে এমন ঘটনা কি ঘটিতে পারে না! রবীন্দ্রনাথের “আপদ” অথবা “অতিথি” গল্পের সহৃদয়া মা-দু’টি তত এই কলিকাতা শহরেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। মনে মনে কত কল্পনাই করিয়াছি। কিন্তু মনের কল্পনার মত ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটিল না। আমার নিকট সুবিস্তৃত কলিকাতা শুধু ইট-পাটকেলের শুষ্কতা লইয়াই বিরাজ করিল।

একদিন খবরের কাগজ লইয়া গলিপথ দিয়া চলিয়াছি। ত্রিতল হইতে এক ভদ্রলোক হাত ইশারা করিয়া আমাকে ডাকিলেন। উপরে গিয়া দেখি তাহার সমস্ত গায়ে বসন্তের গুটি উঠিয়াছে। কোন রকমে তাকে কাগজখানা দিয়া পয়সা লইয়া আসিলাম। সেদিন রাত্রে শুধু সেই বসন্তরোগগ্রস্ত লোকটিকেই মনে হইতে লাগিল। আর মাঝে মাঝে ভয় হইতে লাগিল, আমাকেও বুঝি বসন্তরোগে ধরিবে।

আস্তে আস্তে চারুবাবুর সঙ্গে দেখা করার সেই নির্দিষ্ট দিনটি নিকটে আসিল। বহু কষ্টের উপার্জিত দুইটি পয়সা খরচ করিয়া একটি বাংলা সাবান কিনিয়া ধূলি-মলিন খদ্দরের জামাটি পরিষ্কার করিয়া কাচিলাল। দপ্তরীপাড়ার কোন দপ্তরীর সঙ্গে খাতির জমাইয়া কবিতার খাতাখানিতে রঙিন মলাট পরাইলাম। তারপর সেই বহু-আকাঙিক্ষত নির্দিষ্ট সময়টিতে প্রবাসী-অফিসের দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম অল্পক্ষণ পরেই আমার সেই পূর্ব-পরিচিত চারুবাবুকে সামনে দিয়া চলিয়া যাইতে দেখিলাম। তিনি আমার দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। আমি তাড়াতাড়ি সামনে আগাইয়া গিয়া পদধুলি গ্রহণ করিয়া তাঁহার সামনে দাঁড়াইলাম। তিনি পূর্বদিনের মত করিয়াই আমাকে প্রশ্ন করিলেন,

“তা কি মনে করে?”

আমি তাহাকে স্মরণ করাইয়া দিলাম, “আপনি আমাকে আজ এই সময় আসতে বলেছিলেন। আপনি যদি আমার দু-একটি কবিতা দেখে দিতেন…”

তিনি নাক সিটকাইয়া বলিলেন, “দেখুন, কবিতা লিখে কোন কাজই হয় না। আপনি গদ্য লিখুন।”

আমি আমার পদ্য-লেখা খাতাখানা সামনে ধরিয়া বলিলাম, “আমি তো গদ্যও কিছু লিখেছি।”

ভদ্রলোক দাঁত খিঁচাইয়া ধমকের সঙ্গে বলিলেন, “মশায়, আপনি কি ভেবেছেন আপনার ঐ আজেবাজে লেখা পড়ার সময় আমার আছে?” এই বলিয়া ভদ্রলোক আগাইয়া চলিলেন। কিছুতেই আমার বিশ্বাস হইতেছিলেন না, আমার ধ্যানলোকের সেই সাহিত্যিক চারুবাবু ইনিই হইতে পারেন। ভদ্রলোকের চাকর মাছের খালুই হাতে করিয়া তাঁহার পিছনে পিছনে যাইতেছিল। আমি গিয়া তাহাকে ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। চাকর কি-একটা নাম যেন বলিল। তাহাতে বুঝিতে পারিলাম, তিনি চারুবাবু নহেন।

রামানন্দ বাবুর বাড়ি আবার গিয়া কড়া নাড়িতেই এক নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। তাহার নিকট হইতে চারুবাবুর ঠিকানা লইয়া শিবনারায়ণ দাস লেন তার বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। খবর পাঠাইতেই আমাকে দ্বিতলে যাইবার আহ্বান আসিল। অর্ধশায়িত অবস্থায় সেই আগের লোকটির মতই তিনি আমাকে প্রশ্ন করিলেন, “কি চাই?” ঘরে বোধ হয় আরও দু-একজন ভদ্রলোক ছিলেন। পূর্বের লোকটির কাছ হইতে প্রত্যাখ্যাত হইয়া আসিয়াছি, তার চিহ্ন বোধ হয় মুখে-চোখে বর্তমান ছিল। তার উপরে একতলা হইতে দ্বিতলে উঠিয়া শ্রান্তিতে দীর্ঘনিঃশ্বাস লইতেছিলাম। কোন রকমে বলিলাম, “আমার কিছু কবিতা আপনাকে দেখাতে এসেছি।”

ভদ্রলোক অতি কর্কশ ভাবে আমাকে বলিলেন, “তা আমার বাড়িতে এসেছেন কবিতা দেখাতে?”

কল্পলোকের সেই চারুবাবুর কাছে আমি এই জবাব প্রত্যাশা করি নাই। আমি শুধু বলিলাম, “আমার ভুল হয়েছে, আমাকে মাফ করবেন।”

এই বলিয়া রাস্তায় নামিয়া আসিলাম। তখন সমস্ত আকাশবাতাস আমার কাছে বিষে বিষায়িত বলিয়া মনে হইতেছিল। ইচ্ছা হইতেছিল, কবিতার খাতাখানা ছিড়িয়া টুকরা টুকরা করিয়া আকাশে উড়াইয়া দিই। নিজের কর্ম-শক্তির উপর এত অবিশ্বাস আমার কোন দিনই হয় নাই। আজ এই সব লোককে কত কৃপার পাত্র বলিয়া মনে করিতেছি। কী এমন হইত, গ্রামবাসী এই ছেলে, টিকে যদি তিনি দুটি মিষ্টিকথা বলিয়াই বিদায় দিতেন। যদি একটা কবিতাই পড়িয়া দেখিতেন, কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হইত।

আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলার অধ্যাপক, চারুবাবু তখন জগন্নাথ কলেজে পড়ান। একবার আলাপ-আলোচনায় এই গল্প তাঁহাকে কিছুটা মৃদু করিয়া শুনাইয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, “আমার জীবনে এই ঘটনা ঘটেছে, এটা একেবারে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।”

বস্তুত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে চারুবাবু বহু অখ্যাত সাহিত্যিককে উৎসাহ প্রদান করিয়াছেন।

আমার কলিকাতা আসার সকল মোহ কাটিয়া গিয়াছে, এবার বাড়ি যাইতে পারিলেই হয়। কিন্তু আমার যে টাকা আছে তাহাতে রেল-ভাড়া কুলাইয়া উঠিবে না। ফরিদপুরের তরুণ উকিল অধুনা পাকিস্তান গণ-পরিষদের সভাপতি মৌলবী তমিজউদ্দিন সাহেব তখন ওকালতি ছাড়িয়া কলিকাতা জাতীয় কলেজে অধ্যাপনা করিতেছেন। তিনি ছোটকাল হইতেই আমার সাহিত্য-প্রচেষ্টায় উৎসাহ দিতেন। তাহার নিকটে গেলাম বাড়ি যাইবার খরচের টাকা ধার করিতে। তিনি হাসিমুখেই আমাকে একটি টাকা ধার দিলেন, আর বলিলেন, “দেখ, ভোলার কবি মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে আমি তোমার বিষয়ে আলাপ করেছি। তুমি যদি তার সঙ্গে দেখা কর, তিনি তোমাকে উৎসাহ দেবেন। এমন কি তোমার দু-একটি লেখা ছাপিয়েও দিতে পারেন।”

ছোটকাল হইতে কি করিয়া আমার মনে একটা ধারণা জন্মিয়াছিল, মুসলমানেরা কেহ ভাল লিখিতে পারেন না। সেইজন্য মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিবার আমার বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তমিজউদ্দিন সাহেব আমাকে বার বার বলিয়া দিলেন, “তুমি অবশ্য মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যেও।”

সাধারণ কৌতূহলের বশেই মোজাম্মেল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম। তিনি তখন কারমাইকেল হোস্টেলে থাকিতেন। মোজাম্মেল হক সাহেব আমার কয়েকটি কবিতা পড়িয়া খুবই প্রশংসা করিলেন এবং আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “বৎসরের প্রথম মাসে আমার পত্রিকায় কোন নূতন লেখকের লেখা ছাপি না। কিন্তু আপনার লেখা আমি বৎসরের প্রথম সংখ্যাতেই ছাপব।”

আমি মুসলমান হইয়া কেন মাথায় টুপি পরি নাই—এই বলিয়া তিনি আমাকে অনুযোগ করিলেন। আমি লজ্জায় মরিয়া গেলাম। আমি বাড়ি হইতে টুপি লইয়া আসি নাই, আর এখানে টুপি কেনার পয়সা আমার নাই, সেকথা বলিতে পারিলাম না। সে আজ তিরিশ বৎসরেরও আগের কথা। তখনকার দিনে মুসলমানের অধিকাংশই ধুতি আর মাথায় টুপি পরিতেন। বড়রা সকলেই দাড়ি রাখিতেন। আজ নতুন ইসলামী জোস লইয়া মুসলমান-সমাজ হইতে টুপি ও দাড়ি প্রায় অন্তর্হিত হইয়াছে।

তিনি তখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।

মোজাম্মেল হক সাহেব আমাকে আরও বলিয়াছিলেন, “আপনি অবশ্য অবশ্য হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি আপনার লেখার আদর করবেন। আপনার লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার কিছু সাদৃশ্য আছে।”

 

কবি নজরুল ইসলামের বেশী লেখা আমি ইহার আগে পড়ি নাই। মুসলমান লেখকের মধ্যে মহাকবি কায়কোবাদের পর আমি কবি সাহাদাত হোসেন সাহেবকেই সবচেয়ে বড় লেখক বলিয়া মনে করিতাম। নজরুলের ‘বাদল বরিষণে’ নামক একটি প্রবন্ধ পড়িয়াছিলাম, তাহা রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ অনুকরণ বলিয়া মনে হইয়াছিল।

কবি মোজাম্মেল হক সাহেবের নিকট উৎসাহ পাইয়া পূর্ব অবহেলার ক্ষতগুলির আঘাত আমার মন হইতে কতকটা প্রশমিত হইয়াছিল। আমি নজরুলের সঙ্গে দেখা করিব স্থির করিলাম। পকেটে যে যক্ষের সম্পত্তি জমা ছিল;—তাহা ভাল মত গুণিয়া মনে মনে অঙ্ক কষিয়া দেখিলাম, ইহা হইতে যদি তিনটি পয়সা খরচ করি, তাহা হইলে আমার বাড়ি যাওয়ার ভাড়া কম পড়িবে না। সুতরাং তিনটি পয়সা খরচ করিয়া বৈঠকখানা রোডের এক দর্জীর দোকান হইতে একটি সাদা টুপি কিনিয়া মাথায় পরিয়া নজরুল সন্দর্শনে রওনা হইলাম। টুপির জন্য ইতিপূর্বে মোজাম্মেল হক সাহেবের কাছে অনুযোগ শুনিয়াছি, নজরুলও হয়ত সেইরূপ অনুযোগ করিতে পারেন। সেইজন্য সেই বহু আয়াসের উপার্জিত তিনটি পয়সা খরচ করিতে হইল।

তখন নজরুল থাকিতেন কলেজ স্ত্রীটের বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যসমিতির অফিসে। গিয়া দেখি, কবি বারান্দায় বসিয়া কি লিখিতেছেন। আমার খবর পাইয়া, তিনি লেখা ছাড়িয়া ছুটিয়া আসিলেন। আমি তাঁহাকে নিষেধ করিয়া বলিলাম, “আপনি লিখছিলেন—আগে আপনার লেখা শেষ করুন, পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করব। আমি অপেক্ষা করছি।” কবি তাঁহার পূর্ব লেখায় মনোনিবেশ করিলেন। আমি লেখন-রত কবিকে লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। কবির সমস্ত অবয়বে কী যেন এক মধুর মোহ মিশিয়া আছে। দু’টি বড় বড় চোখ শিশুর মত সরল। ঘরের সমস্ত পরিবেশ নিরীক্ষণ করিয়া আমার ইহাই মনে হইল, এত কষ্টের তিনটি পয়সা খরচ করিয়া কিস্তি-টুপিটি না কিনিলেও চলিত। কবির নিজের পোশাকেও কোন টুপি-আচকান-পায়জামার গন্ধ পাইলাম না।

অল্প সময়ের মধ্যেই কবি তাহার লেখা শেষ করিয়া আমার নিকট চলিয়া আসিলেন। আমি অনুরোধ করিলাম, কী লিখিয়াছেন আগে আমাকে পড়িয়া শোনান।

হার-মানা হার পরাই তোমার গলে…ইত্যাদি–

কবি-কণ্ঠের সেই মধুর স্বর এখনও কানে লাগিয়া আছে। কবিকে আমি আমার কবিতার খাতাখানি পড়িতে দিলাম। কবি দুই-একটি কবিতা পড়িয়াই খুব উচ্ছ্বাসিত হইয়া উঠিলেন। আমার কবিতার খাতা মাথায় লইয়া নাচিতে আরম্ভ করিলেন। আমার রচনার যে স্থানে কিছুটা বাকপটুত্ব ছিল, সেই লাইনগুলি বারবার আওড়াইতে লাগিলেন।

এমন সময় বিশ্বপতি চোধুরী মহাশয় কবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। তখন বিশ্বপতিবাবুর ‘ঘরের ডাক’ নামক উপন্যাস প্রবাসীতে ধারাবাহিক ভাবে বাহির হইতেছে। দুই বন্ধুতে বহু রকমের আলাপ হইল। কবি তাহার বহু কবিতা আবৃত্তি করিয়া শুনাইলেন। সেইদিন কবির মুখে তাঁহার পলাতকা কবিতাটির আবৃত্তি বড়ই ভাল লাগিয়াছিল :

আচমকা কোন্ শশক-শিশু চমকে ডেকে যায়,
ওরে আয়–
আয়ুরে বনের চপল চখা,
ওরে আমার পলাতক!
ধানের শীষে শ্যামার শিষে
যাদুমণি বল সে কিসে
তোরে কে পিয়াল সবুজ স্নেহের কাঁচা বিষে রে!

এই কবিতার অনুপ্রাস-ধ্বনি আমাকে বড়ই আকর্ষণ করিয়াছিল। আজ পরিণত বয়সে বুঝিতে পারিতেছি, কবিতার মধ্যে যে করুণ সুরটি ফুটাইয়া তুলিতে কবি চেষ্টা করিয়াছেন, অনুপ্রাস বরঞ্চ তাহাকে কতকটা ক্ষুণ্ণ করিয়াছে। কিন্তু একথা ভুলিলে চলিবে না, নজরুলের বয়স তখন খুবই অল্প।

গল্পগুজব শেষ হইলে কবি আমাকে বলিলেন, “আপনার কবিতার খাতা রেখে যান। আমি দুপুরের মধ্যে সমস্ত পড়ে শেষ করব। আপনি চারটার সময় আসবেন।”

কবির নিকট হইতে চলিয়া আসিলাম। কিন্তু কবির ব্যক্তিত্ব আর স্নেহ-মধুর ব্যবহার আমার অবচেতন মনে কাজ করিতে লাগিল। কোন্ অশরীরী ফেরেস্তা যেন আমার মনের বীণার তারে তাহার কোমল অঙ্গুলি রাখিয়া অপূর্ব সুর-লহরীর বিস্তার করিতে লাগিল। তাহার প্রভাবে সমস্ত বিশ্ব-প্রকৃতি, এমন কি, কলিকাতার নোংরা বস্তি গাড়ী-ঘোড়া-ট্রামও আমার কাছে অপূর্ব বলিয়া মনে হইতে লাগিল।

চারিটা না বাজিতেই কবির নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, কবি আমারই কবিতার খাতাখানা লইয়া অতি মনোযোগের সঙ্গে পড়িতেছেন। খাতা হইতে মুখ তুলিয়া সহাস্যে তিনি আমাকে গ্রহণ করিলেন। অতি মধুর স্নেহে বলিলেন, “তোমার কবিতার মধ্যে যেগুলি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, আমি দাগ দিয়ে রেখেছি। এগুলি নকল করে তুমি আমাকে পাঠিয়ে দিও। আমি কলিকাতার মাসিকপত্র গুলিতে প্রকাশ করব।”

এমন সময় কবির কয়েকজন বন্ধু কবির সঙ্গে দেখা করিতে আসিলেন। কবি তাহাদিগকে আমার কয়টি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। বন্ধুরা আমার কবিতা শোনার চাইতে কবিকে কোথাও লইয়া যাইবার জন্য মনোযোগী ছিলেন। কবি হাবিলদারের পোশাক পরিতে পরিতে গান গাহিয়া উচ্চ হাস্যধ্বনি করিয়া লাফাইয়া ঝাপাইয়া নিজের প্রাণ-চাঞ্চল্যের প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আমি কবির নিকট হইতে বিদায় লইয়া চলিয়া আসিলাম।

কার্তিকদার আড্ডায় আসিয়া দেখি, তিনি মাথায় হাত দিয়া বসিয়া আছেন। আমারই মতন জনৈক পথে-কুড়ান ভাই তাঁহার বাক্স হইতে টাকাপয়সা যাহা-কিছু ছিল, সমস্ত লইয়া পলাইয়া গিয়াছে। আমার কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই লোকটি আমাদের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করিতেন : নিজে অভুক্ত থাকিয়া, কতদিন দেখিয়াছি, এমনই পথে-পাওয়া তার কোন অনাহারী ভাইকে খাওয়াইতেছেন। এই কি তার প্রতিদান!

আমি দেশে চলিয়া যাইব কলিতে কার্তিকদা খুশী হইলেন। আমাকে বলিলেন, “তুমি দেশে গিয়ে পড়াশুনা কর। মানুষ হয়ে আবার কলকাতা এসো। দেখবে, সবাই তোমায় আদর করবে। আমিও তোমার মত দেশে গিয়ে পড়াশুনা করতাম, লজ্জায় যেতে পারছি না। যে সব ছাত্র আমার মত বিদ্যালয়ের গোলামখানা ছেড়ে আসেনি, তাদের কত গালি দিয়েছি; টিটকারী করে বক্তৃতা দিয়েছি। আবার তাদের মধ্যে কোন্ মুখে ফিরে যাব?”

বিদায় লইবার সময় আমার মাদুর থানা কার্তিকদাকে দিয়া আনিলাম কার্তিকদা তাহা বিনা দামে কিছুতেই লইলেন না তিনি জোর করিয়া আমার পকেটে মাদুরের দামটা দিয়া দিলেন। স্টেশনে আসিয়া আমার টিকিট খরিদ করিয়া দিলেন। বিদায় লইয়া আসিবার সময় তিনি আমাকে বলিলেন, “জসীম, যখন যেখানেই থাকবি, মনে রাখিস তোর এই কার্তিকদার মনে তোর আসনটি চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। আমার জীবন হয়তো এই ভাবেই নষ্ট হয়ে যাবে। পড়াশুনা করে মানুষ হবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তা জীবনে ঘটবে না। নেতাদের কথায় কলেজ ছেড়ে যে ভুল করেছি, সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে হয়তো সারা জীবন করতে হবে। কিন্তু তোর জীবনে এই ভুল সংশোধন করার সুযোগ হল; তুই যেন বড় হয়ে তোর কার্তিকদাকে ভুলে যাসনে। নিশ্চয় তুই একজন বড় কবি হতে পারবি। তখন আমাদের কথা মনে রাখিস।”

আমি অশ্রুসজল নয়নে বলিলাম, “কার্তিকদা, তোমাকে কোনদিন ভুলব না। ভাল কাজ করলে সেই কাজে বোনা বীজের মত মানুষের মনে অঙ্কুর জন্মাতে থাকে। হয়তো সকলের অন্তরে সেই বীজ হতে অঙ্কুর হয় না। কিন্তু একথা মনে রাখবেন, ভাল কাজ বৃথা যায় না। আপনার কথা এই দূরদেশী ছোট ভাইটির মনে চিরকাল জাগ্রত থাকবে।”

তখনকার কিশোর বয়সে এইসব কথা তেমন করিয়া গুছাইয়া বলিতে পারিয়াছিলাম কিনা মনে নাই। কিন্তু আজও আমার মনের গহন কোণে কার্তিকদার সৌম্য মূর্তি চির-উজ্জ্বল হইয়া আছে। এতটুকুও ম্লান হয় নাই। দেশে ফিরিয়া আসিয়া কার্তিকদার কাছে পত্র লিখিয়াছিলাম। কোন উত্তর পাই নাই। হয়তো তিনি তখন অন্যত্র বাসা বদল করিয়াছিলেন। তারপর কতজনের কাছে কার্তিকদার অনুসন্ধান করিয়াছি। কেহ তাহার খবর বলিতে পারে নাই। আজ আমার কিঞ্চিৎ কবিখ্যাতি হইয়াছে। আমার বইগুলি পড়িলে কার্তিকদা কত সুখী হইতেন! বঙ্গ বিভাগের পর তিনি কোথায় গিয়াছেন, কে জানে? হয়তো অনেকগুলি ছেলেমেয়ে লইয়া তিনি কোন সুদূর পশ্চিম অঞ্চলে দুঃখ-দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া কোন রকমে বাঁচিয়া আছেন।

দেশে ফিরিয়া আসিয়া দেখি, আমার মা আমার জন্য চিন্তা করিয়া শুখাইয়া গিয়াছেন। পিতা নানাস্থানে আমার খোঁজখবর লইয়া অস্থির হইয়াছেন। আজীবন মাস্টারী করিয়া ছেলেদের মনোবিজ্ঞান তাঁর ভাল ভাবেই জানা ছিল। তিনি জানিতেন চোদ্দপনর বৎসরের ছেলেরা এমনি করিয়া বাড়ি হইতে পলাইয়া যায়; আবার ফিরিয়া অস। সেই জন্য তিনি আমার ইস্কুলের বেতন ঠিকমত দিয়া আসিতেছিলেন।

মা আমাকে সামনে বসাইয়া খাওয়াইতে লাগিলেন। বাড়ির আম সেই কবে পাকিয়াছিল, তাহা অতি যত্নে আমার জন্য রাখিয়া দিয়াছেন। অর্ধেক পচিয়া গিয়াছে তবু ছোট ভাই-বোনদের খাইতে দেন নাই আমি আসিলে খাইব বলিয়া।

আবার ইস্কুলে যাইতে লাগিলাম। নজরুল ইসলাম, সাহেবের নিকট কবিতার নকল পাঠাইয়া সুদীর্ঘ পত্র লিখিলাম। কবির নিকট হইতে কবিতার মতই সুন্দর উত্তর আসিল। কবি আমাকে লিখিলেন—

“ভাই শিশুকবি, তোমার কবিতা পেয়ে সুখী হলুম। আমি দখিন হাওয়া। ফুল ফুটিয়ে যাওয়া আমার কাজ। তোমাদের মত শিশু কুসুমগুলিকে যদি আমি উৎসাহ দিয়ে আদর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার বড় কাজ। তারপর আমি বিদায় নিয়ে চলে যাব আমার হিমগিরির গহন বিবরে।”

কবির নিকট হইতে এরূপ চার-পাঁচখানা পত্র পাইয়াছিলাম। তাহা সেকালের অতি উৎসাহের দিনে বন্ধুবান্ধবদের দেখাইতে দেখাইতে হারাইয়া ফেলিয়াছি। কিছুদিন পরে মোসলেম ভারতে যে সংখ্যায় কবির বিখ্যাত ‘বিদ্রোহ’ কবিতা প্রকাশিত হইয়াছিল, সেই সংখ্যায় ‘মিলন-গান’ নামে আমারও একটি কবিতা ছাপা হইয়াছিল। চট্টগ্রাম হইতে প্রকাশিত সাধনা পত্রিকাতেও আমার দুই-তিনটি কবিতা ছাপা হয়। ইহা সবই কবির চেষ্টায়। আজও ভাবিয়া বিস্ময় লাগে, তখন কী-ই বা এমন লিখিতাম। কিন্তু সেই অখ্যাত অস্ফুট কিশোর কবিকে তিনি কতই না উৎসাহ দিয়াছিলেন।

তারপর বহুদিন কবির কোন চিঠি পাই নাই। ইনাইয়াবিনাইয়া কবিকে কত কী লিখিয়াছি, কবি নিরুত্তর। হঠাৎ একখানা পত্র পাইলাম, কবি আমাকে ফরিদপুরের অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার নরেন্দ্র রায় মহাশয়ের পুত্রবধূ এবং তাঁর নাতি-নাতকুড়দের বিষয়ে সমস্ত খবর লিখিয়া পাঠাইতে অনুরোধ করিয়াছেন। নরেন্দ্রবাবুর এক নাতি আমারই সহপাঠি ছিল। তাহার সঙ্গে গিয়া তাহার মায়ের সঙ্গে দেখা করিলাম। ভদ্রমহিলা আমাকে আপন ছেলের মতই গ্রহণ করিলেন। আমি তাহাকে মাসীমা বলিয়া ডাকিলাম। তাঁহাদের বাসায় গিয়া শুনিতে পাইলাম, মাসীমার বড় বোন বিরজাসুন্দরী দেবীকে কবি মা বলিয়া ডাকেন। কবির বিষয়ে তিনি আরও অনেক কথা বলিলেন। সেই হইতে মাসীমা হইলেন কবির সঙ্গে আমার পরিচয়ের নূতন যোগসূত্র। কবি আমাকে পত্র লিখিতেন না। কিন্তু মাসীমা বড়বোন বিরজাসুন্দরী দেবীর নিকট হইতে নিয়মিত পত্র পাইতেন। সেইসব পত্র শুধু নজরুলের কথাতেই ভর্তি থাকিত।

মাসীমা কবির প্রায় অধিকাংশ কবিতাই মুখস্থ বলিতে পারিতেন। নজরুলের প্রশংসা যে দিন খুব বেশী করিতাম, সেদিন মাসীমা আমাকে

খাওয়াইয়া কিছুতেই আসিতে দিতেন না। মাসীমার গৃহটি ছিল রক্ষণশীল হিন্দু-পরিবারের। আজ ভাবিয়া বিস্ময় মনে হয়, কি করিয়া একজন মুসলিম কবির আরবী-ফরাসী মিশ্রিত কবিতাগুলি গৃহ-বন্দিনী একটি হিন্দু-মহিলার মনে প্রভাব বিস্তার করিতে পারিয়াছিল।

নজরুলের রচিত ‘মহরম’ কবিতাটি কতবার আমি মাসীমাকে আবৃত্তি করিতে শুনিয়াছি। মাসীমার আবৃত্তি ছিল বড় মধুর। তার চেহারাটি প্রতিমার মত ঝকমক করিত। একবার আমি নজরুলের উপর একটি কবিতা রচনা করিয়া মাসীমাকে শুনাইয়াছিলাম। সেদিন মাসীমা আমাকে পিঠা খাওয়াইয়াছিলেন। সেই কবিতার কটি লাইন মনে আছে—

নজরুল ইসলাম!
তছলিম ঐ নাম!
বাংলার বাদলার ঘনঘোর ঝঞ্ঝায়,
দামামার দমদম লৌহময় গান গায়;
কাঁপাইয়া সূর্য ও চন্দ্রের কক্ষ,
আলোড়িত আসমান ধরণীর বক্ষ;
সেই কালে মহাবীর তোমারে যে হেরিলাম,
নজরুল ইসলাম।

নজরুল কাব্য-প্রতিভার যবনিকার অন্তরালে আমার এই মাসীমার এবং তার বোনদের স্নেহ-সুধার দান যে কতখানি, তাহা কেহই কোনদিন জানিতে পারিবে না। বৃক্ষ যখন শাখাবাহু বিস্তার করিয়া ফুলে ফুলে সমস্ত ধরণীকে সজ্জিত করে, তখন সকলের দৃষ্টি সেই বৃক্ষটির উপর। যে গোপন মাটির স্তন্যধারা সেই বৃক্ষটিকে দিনে দিনে জীবনরস দান করে, কে তাহার সন্ধান রাখে? কবি কিন্তু তার জীবনে ইহাদের ভোলেন নাই। মাসীমাকে কবি একখানা সুন্দর শাড়ী উপহার দিয়াছিলেন। মৃত্যুর আগে মাসীমা বলিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহাকে শ্মশানে লইয়া যাইবার সময় যেন তাঁর মৃতদেহ সেই শাড়ীখানা দিয়া আবৃত করা হয়।

মাসীমার বড় বোন বিরজাসুন্দরী দেবী অশ্রুসজল নয়নে আমাকে বলিয়াছিলেন, “তোমার মাসীমার সেই শেষ ইচ্ছা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিল।”

বহুদিন কবির চিঠি পাই না। হঠাৎ এক পত্ব পাইলাম, কবি ‘ধূমকেতু’ নাম দিয়া একখানা সাপ্তাহিক পত্র বাহির করিতেছেন তিনি আমাকে লিখিয়াছেন ধূমকেতুর গ্রাহক সংগ্রহ করিতে। ছেলেমানুষ আমি—আমার কথায় কে ধূমকেতুর গ্রাহক হইবে? সুফী মোতাহার হোসেন অধুনা কবিখ্যাতিসম্পন্ন; সে তখন জেলা ইস্কুলের বোর্ডিং-এ থাকিয়া পড়াশুনা করিত। সে আমার কথায় ধুমকেতুর গ্রাহক হইল। তখন দেশে গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলন চলিতেছিল। দেশের নেতারা পুঁথিপত্র ঘাটিয়া রক্তপাতহীন আন্দোলনের নজির খুঁজিতেছিলেন। নজরুলের ধূমকেতু কিন্তু রক্তময় বিপ্লববাদের অগ্নি-অক্ষর লইয়া বাহির হইল। প্রত্যেক সংখ্যায় নজরুল যে অগ্নি উদারী সম্পাদকীয় লিখিতেন, তাহা পড়িয়া আমাদের ধমনীতে রক্ত প্রবাহ ছুটিত। সেই সময়ে বিপ্লবীরা বৃটিশ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে যে মারণ যজ্ঞের আয়োজন করিয়াছিলেন, নজরুল-সাহিত্য তাহাতে অনেকখানি ইন্ধন যোগাইয়াছিল। তাহার সেই সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলি আমরা বার বার পড়িয়া মুখস্থ করিয়া ফেলিতাম। একটি প্রবন্ধের নাম ছিল “ম্যাঁয় ভুখা হুঁ! ভারতমাতা অন্তরীক্ষ হইতে বলিতেছেন, আনি রক্ত চাই, নিজ সন্তানের রক্ত দিয়া তিমিররাত্রির বুকে নব-প্রভাতের পদরেখা অঙ্কিত করিব।” ধূমকেতুর মধ্যে যে সব খবর বাহির হইত, তাহার মধ্যেও কবির এই সুরটির রেশ পাওয়া যাইত।

ধূমকেতুতে প্রকাশিত একটি কবিতার জন্য কবিকে গ্রেপ্তার করা হইল। বিচারে কবির জেল হইল। জেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা না মানার জন্য কর্তৃপক্ষ কবির প্রতি কঠোর হইয়া উঠিলেন। কবি অনশন আরম্ভ করিলেন। কবির অনশন যখন তিরিশ দিনে পরিণত হইল তখন সারা দেশ কবির জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিল। রবীন্দ্রনাথ হইতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পর্যন্ত সকলেই কবিকে অনাহার-ব্বত ভঙ্গ করিতে অনুরোধ করিলেন। কবি নিজ সঙ্কল্পে অচল অটল। তখনকার দিনে বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সভাপতিত্বে কবির অনশন উপলক্ষে গভর্নমেন্টের কার্যের প্রতিবাদে কলিকাতায় বিরাট সভার অধিবেশন হইল। সেই সভায় হাজার হাজার লোক কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাইলেন। দেশবন্ধু তাঁহার উদাত্ত ভাষায় কবির মহাপ্রতিভার উচ্চ প্রংশসা করিলেন। বাংলাদেশের খবরের কাগজ গুলিতে প্রতিদিন নজরুলের কাব্য-মহিমা বাঙালীর হৃদয় তন্ত্রীতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। নজরুলের বিজয়বৈজয়ন্তির কী-ই না যুগ গিয়াছে! কেহ কেহ বলিতে লাগিলেন, নজরুল রবীন্দ্রনাথের চাইতেও বড় কবি।

অনশন ব্রত কবির জীবনে একটা মহাঘটনা। যাঁহারা কবিকে জানেন, তাঁহারা লক্ষ্য করিয়াছেন, কবি সংযম কাহাকে বলে জানিতেন না। রাজনৈতিক বহু নেতা এরূপ বহুবার অনশন-ব্রত অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহারা ছিলেন ত্যাগে অভ্যস্ত। কবির মত একজন প্রাণচঞ্চল লোক কি করিয়া জেলের মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন, তাহা এক আশ্চর্য ঘটনা। দিনের পর দিন এইরূপ অনশন একেবারে অসম্ভব বলিয়া মনে হয়। কিন্তু নজরুল-জীবনের এই সময়টি এক মহামহিমার যুগ। কোন অন্যায়ের সঙ্গেই মিটমাট করিয়া চলিবার পাত্র তিনি ছিলেন না। সেই সময়ে দেখিয়াছি, কত অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া তাঁহার দিন গিয়াছে। যদি একটু নরম হইয়া চলিতেন, যদি লোকের চাহিদা মত কিছু লিখিতেন, তবে সম্মানের আর সম্পদের সিংহাসন আসিয়া তাঁহার পদতলে লুটাইত।

তাঁহার ভিতরে কবি এবং দেশপ্রেমিক একসঙ্গে বাসা বাঁধিয়াছিল। আদর্শবাদী নেতা এবং সাহিত্যিকের সমন্বয় সাধিত হইয়াছিল। তাঁহার জীবনে। চল্লিশ দিন অনশনের পর কবি অম্ল-গ্রহণ করিলেন। তারপর জেল হইতে বাহির হইয়া আসিলে চারিদিকে কবির জয় ডঙ্কা বাজিতে লাগিল। আমার মত শিশু-কবির ক্ষীণ কণ্ঠস্বর সেই মহা কলরব ভেদ করিয়া কবির নিকট পৌঁছিতে পারিল না।

আমি তখন সবে আই. এ. ক্লাসে উঠিয়াছি। আমার কবিতার রচনা-রীতি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। পূর্বে রবীন্দ্র-রচনার পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া যাহা লিখিতাম, বহু কাগজে তাহা ছাপা হইয়াছে। এমন কি প্রবাসী কাগজে পর্যন্ত আমার লেখা প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু গ্রাম্য-জীবন লইয়া গ্রাম্য-ভাষায় যখন কবিতা রচনা করিতে আরম্ভ করিলাম, কেহই তাহা পছন্দ করিল না। কাগজের সম্পাদকেরা আমার লেখা পাওয়া মাত্র ফেরত পাঠাইয়া দিতেন। সবটুকু হয়তো পড়িয়াও দেখিতেন না। সেই সময়ে আমার মনে যে কি দারুণ দুঃখ হইত, তাহা বর্ণনার অতীত।

একবার গ্রীষ্মকালে দুপুরবেলায় আমাদের গ্রামের মাঠ দিয়া চলিয়াছি, এমন সকয় পিয়ন আসিয়া ভারতবর্ষ হইতে অমানেনীত “বাপের বাড়ির কথা” নামক কবিতাটি ফেরত দিয়া গেল। পিয়ন চলিয়া গেলে আমি মনোদুঃখে সেই ঢেলা-ভরা চষা-ক্ষেতের মধ্যে লুটাইয়া পড়িলাম। কিন্তু চারিদিক হইতে যতই অবহেলা আসুক না কেন আমার মনের মধ্যে জোর ছিল। আমার মনে ভরসা ছিল, আমি যাদের কথা লিখিতেছি, আরও ভাল করিয়া লিখিতে পারিলে নিশ্চয়ই দেশ একদিন আমার কবিতার আদর করিবে।

সেই সময়ে আমার কেবলই মনে হইত, একবার যদি কবি নজরুলের সঙ্গে দেখা করিতে পারি, নিশ্চয় তিনি আমার কবিতা পছন্দ করিবেন। গ্রাম্য-জীবন লইয়া কবিতা লিখিতে লিখিতে আমি গ্রাম-কবিদের রচিত গানগুলিরও অনুসন্ধান করিতেছিলাম। আমার সংগৃহীত কিছু গ্রাম-গান দেখিয়া পরলোকগত সাহিত্যিক যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় আমাকে শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে দেখা করিতে পরামর্শ দেন।

 

কংগ্রেস-অফিসের সাময়িক স্বেচ্ছাসেবক হইয়া তাহাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করিতে করিতে আমি কলিকাতা আসিয়া উপস্থিত হই। পথের যত ধূলি আর গুড়ো-কয়লা রজক গৃহ-সম্পর্কহীন আমার শ্বীঅঙ্গের মোটা খন্দরে, কিস্তি-নৌকার মত চর্ম-পাদুকাজোড়ায়, এবং তৈলহীন চুলের উপর এমন ভাবে আশ্রয় লইয়াছিল যে তাহার আবরণীর তল ভেদ করিয়া আমার পূর্বপরিচিত কেহ আমাকে সহজে আবিষ্কার করিতে পারিত না।

সুবিস্তৃত জন-অরণ্য কলিকাতায় আমি কাহাকেও চিনি না। কোথায় গিয়া আশ্রয় পাইব? কে আমাকে থাকিবার জায়গা দিবে। যদি কবি নজরুলের সন্ধান পাই,তার স্নেহের শিশু-কবিকে নিশ্চয় তিনি অবহেলা করিবেন না। মুসলিম পাবলিশিং হাউসে আসিয়া আফজল মিঞার কাছে কবির সন্ধান লইলাম। আফজল মিঞা বলিলেন, “আপনি অপেক্ষা করুন। কবি একটু পরেই এখানে আসবেন।”

অল্পক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের মত কবি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

আফজল সাহেব বলিলেন, “জসীম উদ্দীন এসেচে আপনার সঙ্গে দেখা করতে।”

“কই জসীম উদ্দীন?” বলিয়া কবি এদিক-ওদিক চাহিলেন। আফজল সাহেব আমাকে দেখাইয়া দিলেন। আমি কবিকে সালাম করিলাম।

কবি আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “কই, তোমার লেখা কোথাও তো দেখিনি?” আমি কবির নিকট আমার কবিতার খাতাখানা আগাইয়া দিতে গেলাম। কিন্তু কবি তাঁহার গুণগ্রাহীদের দ্বারা এমনই পরিবৃত হইলেন যে আমি আর বৃহভেদ করিয়া কবির নিকটে পৌঁছিতে পারিলাম না।

অল্পক্ষণ পরেই কবি ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন, “আমাকে এখন হুগলী যেতে হবে।”

আগাইয়া গিয়া বলিলাম, “আমি বহুদূর থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”

কবি আমাকে বলিলেন, “একদিন হুগলীতে আমার ওখানে এসো। অজি আমি যাই।”

এই বলিয়া কবি একটি ট্যাক্সী ডাকিয়া তাহাতে আরোহণ করিলেন। আমিও কবির সঙ্গে সেই ট্যাক্সীতে গিয়া উঠিলাম। কবির প্রকাশক মৈনুদ্দিন হুয়েন সাহেবও কবির সঙ্গে ছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, ট্যাক্সীতে বসিয়া কবির সঙ্গে দু-চারটি কথা বলিতে পারি। কিন্তু মৈনুদ্দিন সাহেবই সব সময় কবির সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। আমি মৈনুদ্দিন সাহেবকে বলিলাম, “আপনি তো কলকাতায় থাকেন। সব সময় কবির সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। আমাকে একটু কবির সঙ্গে কথা বলতে দিন।”

কবি কহিলেন, “বল বল, তোমার কি কথা?”

আমি আর কি উত্তর করিব। কবি আবার মৈনুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা বলিতে লাগিলেন। ট্যাক্সী আসিয়া হাওড়ায় থামিল। কবি তাড়াতাড়ি ট্যাক্সী হইতে নামিয়া রেলগাড়ীতে গিয়া উপবেশন করিলেন। রাশি রাশি ধূম উদারণ করিয়া সোঁ-সোঁ শব্দ করিয়া গাড়ী চলিয়া গেল। আমি স্তব্ধ হইয়া প্লাটফর্মে দাঁড়াইয়া রহিলাম। গাড়ীর চাকা যেন আমার বুকের উপর কঠিন আঘাত করিয়া চলিতে লাগিল।

এখন আমি কোথায় যাই—কাহার নিকটে গিয়া আশ্রয় লই? ফরিদপুরের এক ভদ্রলোক হারিসন রোডে ডজ-ফার্মেসীতে কাজ করিতেন। তাঁহার সন্ধানে বাহির হইলাম। কিন্তু হারিসন রোডের ডজ-ফার্মেসী কোথায় আমি জানি না। একে তো ট্রেনভ্রমণে ক্লান্ত, তার উপর সারাদিন কিছু আহার হয় নাই। হাওড়া হইতে শিয়ালদহ পর্যন্ত রাস্তার এপারে-ওপারে তিন-চার বার ঘুরিয়া ভজ-ফার্মেসীর সন্ধান পাইলাম। ফার্মেসীতে কংগ্রেসের জন্য সংগৃহীত টাকার বাক্সটি রাখিয়া ফুটপাথের উপর শুইয়া পড়িলাম। তখন আমি এত ক্লান্ত যে সারাদিনের অনাহারের পরে খাওয়ার কথা একেবারেই ভুলিয়া গেলাম।

 

ইহার বহুদিন পরে আমাদের ফরিদপুরে বঙ্গীয় রাষ্ট্বীয় সমিতির অধিবেশন বসিল। এই অধিবেশনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। প্রতিদিন গাড়ী ভরিয়া বহু নেতা আমাদের বাড়ির পাশের স্টেশনে আসিয়া নামিতে লাগিলেন। স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ পরিয়া আমরা তাহাদের অভ্যর্থনা করিতাম। একদিন আশ্চর্য হইয়া দেখিলাম, কবি নজরুল কয়েকজন শিষ্য সহ আমাদের বাড়িতে উঠিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। কবির সঙ্গে কমিউনিস্ট আবদুল হালিম, গায়ক মণীন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও আর একজন যুবক ছিলেন আমি কবিকে সানন্দে আমাদের বাড়ি লইয়া আসিলাম। রান্নার দেরি ছিল। কবিকে আমাদের নদীতীরের বাঁশবনের ছায়াতলে মাদুর পাতিয়া বসিতে দিলাম। তখন বড়-পদ্মা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া প্রবাহিত হইত। এখন চর পড়িয়া পদ্মা অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু একটি ছোট্ট নদীরেখা এখনও আমাদের বাড়ির পাশ দিয়া প্রবাহিত হয়।

কবির হাতে একখণ্ড কাগজ দিয়া বলিলাম, “কবিভাই, আপনি একটা কিছু লিখে দিন।”

আধঘণ্টার মধ্যে কবি একটি অপূর্ব কবিতা লিখিয়া ফেলিলেন কবিতাটি হারাইয়া ফেলিয়াছি। সেজন্য মনে বড়ই অনুতাপ হয়। তার দুটি লাইন মনে আছে—

“আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ
নদীর তীরে ডিঙিতরী পথিক-ধরা ফাঁদ।”

সন্ধ্যাবেলা নৌকা করিয়া কবিকে নদীর ওপারের চরে লইয়া গেলাম। সেখানে আমি একটি ইস্কুল খুলিয়াছিলাম। গ্রামের লোকেরা রাত্রিকালে আসিয়া সেই ইস্কুলে লেখাপড়া করিত। তারপর সকলে মিলিয়া গান গাহিত। আমার মনে হইয়াছিল, এই গান যদি কবির ভাল লাগে তবে কবিকে এখানে বহু দিন ধরিয়া রাখিতে পারি।

সেদিন কবির আগমনে বালুচরের কৃষাণ-পল্লীতে সাড়া পড়িয়া গেল। ওপাড়া হইতে আজগর ফকিরকে খবর দেওয়া হইল, চরকেষ্টপুরের মথুর ফকিরও আসিলেন। তাহারা যখন গান ধরিলেন, তখন মনে হইল আল্লার আসমান গানের সুরে সুরে কাঁপিতেছে। কবি সে গানের খুবই তারিফ করিলেন। কিন্তু তবু মনে হইল, যেমনটি করিয়া কবিকে এই গানে মাতাইতে চাহিয়াছিলাম, তাহা হইল না। সেই সময়ে কবির মন রণ-দুন্দুভির নিনাদে ভরপুর ছিল। এই সব গ্রাম-গানের ভাববস্তুর জন্য কবির হৃদয়ে কোন স্থান তৈরী হয় নাই।

রাত্রিবেলা এক মুস্কিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিকালে কে সাহস করিয়া এত বড় পদ্মা-নদী পাড়ি দিবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠান হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের চা খাওয়াইয়া তাজ্জব বানাইয়া দিবার জন্য কলিকাতর হইতে তিনি কিছু চা-পাতা লইয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা-পাতা যখন কম হইয়া আসিত, তখন তাহার সহিত কিছু শুকনা ঘাসপাতা মিশাইয়া চায়ের ভাণ্ডার তিনি অফুরন্তু রাখিতেন। তিনি অতি গর্বের সহিত তাহার কলিকাতা-ভ্রমণের অশ্চর্য কাহিনী বলিতে বলিতে সেই চা-পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ।

মহামূল্য চা এখন কে জ্বাল দিবে? এ-বাড়ির বড়বো ও-বাড়ির ছোটবৌ—সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যাহার যত রন্ধন-বিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া সেই অপূর্ব চা রন্ধন-পর্ব সমাধা করিল। অবশেষে চা বদনায় ভর্তি হইয়া বৈঠকখানায় আগমন করিল। কবির সঙ্গে আমরাও তাহার কিঞ্চিৎ প্রসাদ পাইলাম। কবি তো মহাপুরুষ। চা পান করিতে করিতে চারাঁধুনিদের অজস্র প্রশংসা করিয়াছিলেন। আমরাও কবির সঙ্গে ধুয়া ধরিলাম। গ্রামচাষীর বাড়িতে যত রকমের তরকারী রান্না হইয়া থাকে, সেই চায়ের মধ্যে তাহার সবগুলিরই আস্বাদ মিশ্রিত ছিল। কমিউনিস্ট-কর্মী আবদুল হালিম বড়ই সমালোচনাপ্রবণ। তাঁহার সমালোচনা মতে সেই চা-রামায়ণের রচয়িত্রীরা নাকি লঙ্কাকাণ্ডের উপর বেশী জোর দিয়াছিলেন। আমাদের মতে চা-পর্বে সকল ভোজনরসের সব গুলিকেই সম মর্যাদা দেওয়া হইয়াছিল। পরবর্তীকালে বহু গুণীজনের কাছে এই চা খাওয়ার বর্ণনা করিয়া কবি আনন্দ পরিবেশন করিতেন।

পরদিন পূর্ব আকাশে অপূর্বদ্যুতি জবাকুসুমের রঙে রঙিন হইয়া সূর্যোদয় হইল। আমরা কবিকে লইয়া বিদায় হইলাম। দুই পাশের শস্যক্ষেত্রে সবুজ নতুন পত্র-মঞ্জরী দেখা দিয়াছে। রাতের শিশির-স্নাত পত্রগুলি বিহানবেলার রৌদ্রে ঝলমল করিয়া কবিকে অভ্যর্থনা করিতেছিল। কবি ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙ্গার গান’ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। এই বই দুইখানি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। কবির শিষ্যদল কনফারেন্সের অধিবেশনে এই বই বিক্রয় করিবার জন্য, আনিয়াছিলেন। বইগুলি আমার বাড়িতে রাখিয়া কবি ফরিদপুর শহরে কনফারেন্সের ময়দানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। থাকিবার জন্য তাঁহাকে একটি তাঁবু দেওয়া হইল। আমি হইলাম কবির খাস-ভলান্টিয়ার।

এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের বহু নেতা আসিয়াছিলেন। তখন কবি ভাল বক্তৃতা করিতে শেখেন নাই। সভায় কবি যাহা বলিলেন, তাহা নিতান্ত মামুলী ধরনের। কিন্তু কবি যখন গান ধরিলেন, সেই গানের কথায় সমস্ত সভা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। গান ছাড়িলে সভার লোকে আরও গান শুনিবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। কবির কণ্ঠস্বর যে খুব সুন্দর ছিল তাহা নয়, কিন্তু গান গাহিবার সময় গানের কথা-বস্তুকে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিলেন। কবি যখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া অথবা ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সভায় যে অপূর্ব ভাবরসের উদয় হইতেছিল, তাহা ভাষায় বলিবার নয়। জেল হইতে সদ্য খালাস পাইয়া বহু দেশকর্মী সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। দেশকে ভালবাসিয়া শতসহস্র কমী আপন অঙ্গে লাঞ্ছনার তিলক-চিহ্ন ধারণ করিয়াছিলেন। নজরুলের গান যেন তাহাদের দুঃখ-লাঞ্ছনার আশাআকাক্ষার জীবন্ত প্রতীক।

একদিন মহাত্মা গান্ধীর সামনে নজরুল তাঁর ঘোর ঘোর ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর’—গানটি গাহিলেন। গান্ধীজী গান শুনিয়া হাসিয়া কুটিকুটি। কনফারেন্স শেষ হইলে কবি আবার আমার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কবি স্থির করিলেন, তিনি এখানে বসিয়া বাবুচর’ নামে একখানা বই লিখিবেন। কিছুদিন কবির সঙ্গে কাটাইতে পারিব, এই আশায় মন পুলকিত হইয়া উঠিল।

কিন্তু অল্পদিন পরে পাবনা হইতে এক ভদ্রলোক আসিয়া কবিকে চিলের মত ছোঁ। মারিয়া লইয়া গেলেন। যাইবার সময় কবি কথা দিয়া গেলেন, ফিরিবার সময় আবার আমার এখানে আসিবেন।

কবির বাজেয়াপ্ত বইগুলির কিছু আমার কাছে রাখিয়া গেলেন। কিন্তু কবি আর ফিরিয়া আসিলেন না। বহুদিন পরে কবি চিঠি লিখিলেন, বইগুলির কিছু যদি বিক্রয় হইয়া থাকে তবে আমি যেন সত্বর তাহাকে টাকাটা পাঠাইয়া দিই। কবির অসুখ। অর্থের খুব টানাটানি। কিন্তু বাজেয়াপ্ত বই কেহ কিনিতে চাহে না। পুলিসে ধরা পড়িবার ভয় আছে। কিছুই বিক্রয় করিতে পারি নাই। আমি তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে গ্রাম্য-গান সংগ্রহের জন্য মাসে সত্তর টাকা করিয়া স্কলারশিপ পাইতাম। সেই টাকা হইতে কিঞ্চিৎ অর্থ কবির নিকট মনিঅর্ডার করিয়া পাঠাইলাম।

 

একবার কলিকাতা গিয়া কবির সঙ্গে দেখা করিতে তাঁহার বাসায় যাই। তখন বিবাহ করিয়া সদ্য সংসার পাতিয়াছেন। হাস্যরসিক নলিনী সরকার মহাশয়ের বাসায় তিনি থাকেন। কবি আমাকে শয়ন-গৃহে ডাকিয়া পাঠাইলেন। নতুন ভাবীর সঙ্গে কবি লুডো খেলিতেছিলেন। ভাবীর সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিয়া কবি আমাকেও খেলিতে আহ্বান করিলেন। আমি অনেকক্ষণ তাহাদের সঙ্গে খেলিলাম। ভাবীর সেই রাঙা-টুকটুকে মুখের হাসিটি আজও মনে আছে। তখন কবির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কবিপ্রিয়া কিন্তু আমাকে না খাইয়া আসিতে দিলেন না। আমি কবির কোন রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় নই। তবু কবি আমাকে আপন ভাইএর মত তাঁর গৃহের একজন করিয়া লইলেন। এর পর যখনই কবিগৃহে গমন করিয়াছি, কবি-পত্নীর ব্যবহারে সঁহাদের গৃহখানি আমার আপন বলিয়া মনে হইয়াছে।

আমি তখন মেছুয়াবাজারে ওয়াই, এম. সি এ হোস্টেলে থাকিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ি। আমাদের হোস্টেলে মাঝে মাঝে নানা রকম উৎসব-অনুষ্ঠান হইত। তাহাতে হোস্টেলের ছাত্রেরা নিজেদের আত্মীয়া মহিলাদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিতেন। কলিকাতায় আমার কোন নিকট আত্মীয়া নাই, আমি আর কাহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিব! একদিন সেই কথা ভাবীকে বলিলাম। ভাবী অতি সহজেই আমাদের হোস্টেলে আসিতে রাজী হইলেন। ভাবীর মা খালাআম্মাও সঙ্গে আসিলেন। উৎসব-সভায় তাঁহারা আসিয়া যখন উপবেশন করিলেন, তখন ভাবীকে দেখিবার জন্য ছাত্রমহলে সাড়া পড়িয়া গেল। আমার মনে হয়, কবি-গৃহিণীর জীবনে বাহিরের কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এই প্রথম।

ভাবীর মতন এমন সর্বংসহা মেয়ে বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। কবির ছন্নছাড়া নোঙরহীন জীবন। এই জীবনের অন্তঃপুরে স্নেহ-মমতায় মধুর হইয়া চিরকাল তিনি কবির কাব্যসাধনাকে জয়যুক্ত করিয়াছিলেন। কোন সময় তাঁহাকে কবির সম্পর্কে কোন অভিযোগ করিতে দেখি নাই। প্রথম জীবনে কবি ভাবীকে বহু সুন্দর সুন্দর পত্র লিখিয়াছেন। ভাবী সেই পত্রগুলি যখের ধনের মত রক্ষা করিতেন। একদিন ভাবীকে বলিলাম, “ভাবী, আমি আপনার ভাই। যদি ভরসা দেন তো একটা অনুরোধ আপনাকে করব?

ভাবী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “কি অনুরোধ, বল তত ভাই।”

আমি বলিলাম, “কবিভাই আপনাকে যেসব চিঠি লিখেছেন, তার দু-একখানা যদি আপনি আমাকে দেখান।

ভাবীর চোখ দু’টি ছলছল করিয়া উঠিল। সামনে খালাআম্মা বসিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “বাবা, সেসব চিঠি কি ওর কাছে আছে। একবার কি-একটা সামান্য কারণে নুরু রাগ করে সবগুলি চিঠি পুড়িয়ে ফেলেছে।”

কবির প্রথম ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল। বুলবুলের বয়স যখন পাঁচ-ছয় বৎসর, তখন কবি কে সঙ্গে লইয়া বেড়াইতেন। অতটুকু ছেলে কী সুন্দর গান করিতে পারিত! কেমন মিষ্টি সুরে কথা বলিত। কবির কোল হইতে কাড়িয়া লইয়া আমরা তার মুখের মিষ্টিকথা শুনিতাম। অতটুকু বয়সে ওস্তাদী গানের নানা সুর-বিভাগের সঙ্গে সে পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। কবি হারমনিয়ামে যখন যে কোন সুর বাজাইতেন, বুলবুল শুনিয়াই বলিয়া দিতে পারিত, কবি কোন সুর বাজাইতেছেন। বড় বড় মজলিসে খোকাকে লইয়া কবি বহুবার ইহার প্রমাণ দিয়াছেন। অতটুকু শিশুর সংগীত-জ্ঞান দেখিয়া বড় বড় ওস্তাদ ধন্য ধন্য করিতেন। এই শিশুটিকে পাইয়া কবির ছন্নছাড়া জীবন কতকটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া উঠিতেছিল।

কবিকে আর কবি-পত্নীকে অনন্ত কান্নার সাগরে ডুবাইয়া সেই বেহেস্তের বুলবুল পাখি বেহেস্তে পলাইয়া গেল। কবির গৃহে শোকের তুফান উঠিল। কবি তার বড় আদরের বুলবুলকে গোরের কাফন পরাইয়া মুসলিম প্রথা অনুসারে কবরস্থ করিয়াছিলেন। বুলবুলের যত খেলনা, তার বেড়াইবার গাড়ী, পোষাক-পরিচ্ছদ সমস্ত কবি একটি ঘরে সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন।

বুলবুলের মৃত্যুর সময় আমি কলিকাতা ছিলাম না। কলিকাতা আসিয়া কবি-গৃহে কবির অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম, কবি ডি এম. লাইব্রেরীতে গিয়াছেন। আমি সেখানে গিয়া দেখিতে পাইলাম, কবি এক কোণে বলি… হাস্যরসপ্রধান ‘চন্দ্রবিন্দু নামক কাব্যের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করিতেছেন। পুত্রশোক ভুলিবার এই অভিনব উপায় দেখিয়া স্তম্ভিত হইলাম। দেখিলাম, কবির সমস্ত সঙ্গে বিষাদের ছায়া। চোখ দু’টি কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলিয়া গিয়াছে। কবি দু-একটি কবিতা পড়িয়া শুনাইলেন। এখনও আমি ভাবিয়া স্থির করিতে পারি না, কোন্ শক্তি বলে কবি পুত্রশোকাতুর মনকে এমন অপূর্ব হাস্যরসে রূপান্তরিত করিয়াছিলেন। কবিতা লিখিবার স্থানটিও আশ্চর্যজনক। যাহারা তখনকার দিনে ডি, এম, লাইব্রেরীর স্বল্পপরিসর স্থানটি দেখিয়াছেন, তাঁহারা অবস্থা অনুমান করিতে পারিবেন। দোকানে অনবরত বেচাকেনা হইতেছে, বাহিরের হট্টগোল কোলাহল—তার এক কোণে বসিয়া কবি রচনা-কার্যে রত।

আমি এই সময় প্রায়ই কবির কাছে গিয়া বসিয়া থাকিতাম। একদিন এক ভদ্রলোক একখানা চিঠি দিয়া গেলেন। চিঠিখানা পড়িয়া কবি অজস্রভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। তারপর রুমাল দিয়া চোখ মুছিয়া আবার চন্দ্রবিন্দু পুস্তকের হাস্যরসের গানগুলি লিখিতে মনোনিবেশ করিলেন। চিঠিখানা পড়িয়া দেখিলাম—ইহা লিখিয়াছেন, কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু মোজাফফর আহমদ সাহেব জেল হইতে। বুলবুলের মৃত্যু-সংবাদ পাইয়া কবিকে এই পত্র লিখিয়া তিনি সমবেদনা জানাইয়াছেন। বুলবুলের মৃত্যুর পর তার শতচিহ্ন-জড়িত গৃহে কবির মন টিকিতেছিল না। তাই ডি, এম, লাইব্রেরীর কোলাহলের মধ্যে আসিয়া কবি হাস্যরসের কবিতা লিখিয়া নিজের মনকে বুলবুলের চিন্তা হইতে সরাইয়া রাখিবার প্রয়াস করিতেছিলেন। আমরা শুনিয়াছি, খোকার অসুখে অজস্র খরচ করিয়া এই সময়ে কবি ভীষণ আর্থিক অভাবে পড়িয়াছিলেন। ডি. এম. লাইব্রেরীতে আসিয়া প্রতিদিন কিছু কিছু লিখিয়া লাইব্রেরীর কর্মকর্তার নিকট হইতে কবি কিছু অর্থ লইয়া যাইতেন। অভাবের তাড়নায় এরূপ শোকতাপগ্রস্ত অবস্থায় কবি চন্দ্রবিন্দুর মত অপূর্ব হাস্যরসের কার্য রচনা করিয়াছেন। যদি তিনি মনের সুখে ‘সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ লিখিতে পারিতেন, তবে সেই লেখা আরও কত সুন্দর হইতে পারিত।

একদিন গ্রীষ্মকালে হঠাৎ কবি আমার পদ্মাতীরের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রীয়-আইন সভার সভ্য হইবার জন্য দাঁড়াইয়াছেন। এই উপলক্ষে ফরিদপুরে আসিয়াছেন প্রচারের জন্য। আমি হাসিয়া অস্থির : “কবিভাই, বলেন কি? আপনার বিরুদ্ধে এদেশে গোঁড়া মুসলিম-সমাজ কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ভোটযুদ্ধে তারাই হলেন সব চাইতে বড় সৈন্যসামন্ত। আমাদের সমাজ কিছুতেই আপনাকে সমর্থন করবে না।”

কবি তখন তার সুটকেস হইতে এক বাণ্ডিল কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “এই দেখ, পীর বাদশা মিঞা আমাকে সমর্থন করে ফতোয়া দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের এত বড় বিখ্যাত পীর যা বলবেন, মুসলিম-সমাজ তা মাথা নিচু করে মেনে নেবে। জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয় সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বই ভাগ ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি কিছু পাই, তা হলেই কেল্লা ফতে। যদি নির্বাচিত হয়ে যাই—আর নির্বাচিত আমি তো হবই, মাঝে মাঝে আমাকে দিল্লী যেতে হবে। তখন তোমরা কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাবে।”

রাতের অন্ধকারে আকাশে অসংখ্য তারা উঠিয়াছে। আমরা দুই কবিতে মিলিয়া তাদেরই সঙ্গে বুঝি প্রতিযোগিতা করিয়া মনের আকাশে অসংখ্য তারা ফুটাইয়া তুলিতেছিলাম।

কেন্দ্রীয় সভার ভোট-গ্রহণের আর মাত্র দুইদিন বাকী। ভোর হইলেই আমরা দুইজনে উঠিয়া ফরিদপুর শহরে মৌলভী তমিজউদ্দিন খানের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তমিজউদ্দিন সাহেব আইনসভার নিম্ন-পরিষদের সভ্য পদের প্রার্থী ছিলেন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব। আমরা লাল মিঞা সাহেবের সমর্থক ছিলাম। বাদশা মিঞা তমিজউদ্দিন সাহেবকে সমর্থন করিয়া ফতোয়া দিয়াছিলেন। সেইজন্য আমাদের বিশ্বাস ছিল, তমিজউদ্দিন সাহেবের দল নিশ্চয়ই কবিকে সনব্থন করিবেন। কারণ বাদশা মিঞাও কবিকে সমর্থন করিয়া ইতিপুর্বে ফতোয়া দিয়াছেন। আর, লাল মিঞার দলে তো আমরা আছিই। সুতরাং সবাই কবিকে সমর্থন করিবে।

কবিকে সঙ্গে লইয়া যখন তমিজউদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তমিজউদ্দিন সাহেব তাঁহার সমর্থক গুণগ্রাহীদের দ্বারা পরিবৃত হইয়া দরবার সাজাইয়া বসিয়াছিলেন। কবিকে দেখিয়া তাঁহারা সবাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কবি যখন তাঁহার ভোটঅভিযানের কথা বলিলেন, তখন তমিজউদ্দিন সাহেবের একজন সভাসদ বলিয়া উঠিলেন, “তুমি কাফের। তোমাকে কোন মুসলমান ভোট দিবে না।”

তমিজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আমাদের শত মতভেদ থাকিলেও তিনি বড়ই ভদ্রলোক। কবিকে এরূপ কথা বলায় তিনি বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। কবি কিন্তু একটুও চটিলেন না। তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আপনারা আমাকে কাফের বলছেন, এর চাইতে কঠিন কথাও আমাকে শুনতে হয়। আমার গায়ের চামড়া এত পুরু যে আপনাদের তীক্ষ্ণ কথার বাণ তা ভেদ করতে পারে না। তবে আমি বড়ই সুখী হব, আপনারা যদি আমার রচিত দু-একটি কবিতা শোনেন।”

সবাই তখন কবিকে ঘিরিয়া বসিলেন। কবি আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। কবি যখন তাহার “মহরম” কবিতাটি আবৃত্তি করিলেন, তখন যে ভদ্রলোক কবিকে কাফের বলিয়াছিলেন তারই চোখে সকলের আগে অশ্রুধারা দেখা দিল। কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন—যে কাজে আমরা আসিয়াছি, সে দিকে তাঁর দৃষ্টি নাই। আমি কবির কানে কানে বলিলাম, “এইবার আপনার ইলেকসনের কথা ওঁদের বলুন।”

কিন্তু কে কাহার কথা শোনে! কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। তখন আমি মরিয়া হইয়া সবাইকে শুনাইয়া বলিলাম, “আপনারা কবির কবিতা শুনছেন—এ অতি উত্তম কথা। কিন্তু কবি একটি বড় কাজে এখানে এসেছেন। আসন্ন ভোট-সংগ্রামে কবি আপনাদের সমর্থন আশা করেন। এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করুন।”

তমিজউদ্দিন সাহেব চালাক লোক। কবিতা আবৃত্তি করিয়া কবি তাঁহার সমর্থক ও ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে কিঞ্চিৎ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। তিনি যে কবিকে সমর্থন করিবেন না, এই আলোচনা তিনি তাঁহাদের সকলের সামনে করিলেন না। কবিকে তিনি আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। পাঁচ-ছয় মিনিট পরে হাসিমুখেই তাহারা দুইজনে আসরে ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়া কবি আবার পূর্ববৎ কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। আমি ভাবিলাম, কেল্লা ফতে! কবির হাসিমুখ দেখিয়া এবং আবার আসিয়া তাহাকে কবিতা আবৃত্তি করিতে দেখিয়া ভাবিলাম, নিশ্চয়ই তমিজউদ্দিন সাহেবের দল কবিকে সমর্থন করিবে।

কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। বেলা দুইটা বাজিল। কবির সে দিকে হুশ নাই। কবির শ্রোতারাই এ বিষয়ে কবিকে সজাগ করিয়া দিলেন। কবি তাহার কাগজপত্র কুড়াইয়া লইয়া বিদায় হইলেন। তাদের মধ্য হইতে একটি লোকও বলিলেন না, এত বেলায় আপনি কোথায় যাইবেন, আমাদের এখান হইতে খাইয়া যান। আমার নিজের জেলা ফরিদপুরের এই কলঙ্ক-কথা বলিতে লজ্জায় আমার মাথা নত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু এ কথা না বলিলে, সেই যুগে আমাদের সমাজ এত বড় একজন কবিকে কি ভাবে অবহেলা করিতেন, তাহা জানা যাইবে না। অথচ এদেরই দেখিয়াছি, আলেম-সমাজের প্রতি কী গভীর শ্রদ্ধা! কত গরীব ছাত্রকে তমিজউদ্দিন সাহেব অন্নদান করিয়াছেন!

দুইটার সময় তমিজউদ্দিন সাহেবের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ভাবিলাম, এখন কোথায় যাই। আমার বাড়ি শহর হইতে দুই মাইলের পথ; হাঁটিয়া যাইতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগিবে। পৌঁছিতে তিনটা বাজিবে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া আজ আর শহরে ফিরিয়া কাজকর্ম করা যাইবে না। স্থির করিলাম, বাজারে কোন হোটলে খাওয়া সারিয়া অন্যান্য স্থানে ভোট-সংগ্রহের কাজে মনোনিবেশ করিব।

পথে আসিতে আসিতে কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তমিজউদ্দিন সাহেবের দল আমাদের সমর্থন করিবে। এবার তবে কেল্লা ফতে!”

কবি উত্তর করিলেন, “না রে, ওঁরা বাইরে ডেকে নিয়ে আমাকে আগেই খুলে বলে দিয়েছেন, আমাকে সমর্থন করবেন না। ওঁরা সমর্থন করবেন বরিশালের জমিদার ইসমাইল সাহেবকে।”

তখন রাগে দুঃখে কাঁদিতে ইচ্ছা হইতেছিল। রাগ করিয়াই কবিকে বলািম, “আচ্ছা কবিভাই, এই যদি আপনি জানলেন, তবে ওঁদের কবিতা শুনিয়ে সারাটা দিন নষ্ট করলেন কেন?”

কবি হাসিয়া বলিলেন, “ওরা শুনতে চাইলে, শুনিয়ে দিলুম।”

এ কথার কী আর উত্তর দিব? কবিকে লইয়া হোটলের সন্ধানে বাহির হইলাম। তখনকার দিনে ফরিদপুর শহরে ভাল হোটেল ছিল না। যে হোটেলে যাই, দেখি মাছি ভনভন করিতেছে। ময়লা বিছানা-বালিশ হইতে নোংরা গন্ধ বাহির হইতেছে। তারই মধ্যে অপেক্ষাকৃত একটি পরিষ্কার হোটেল বাছিয়া লইয়া কোন রকমে ভোজনপর্ব সমাধা করিলাম।

শ্রেষ্ঠ কবিকে আমার দেশ এই সম্মান জানাইল। এই জন্যই বুঝি আধুনিক মুসলিম-সমাজে বড় লেখক বা বড় কবির আগমন হয় নাই। মিশর, তুরস্ক, আরব—কোন দেশেই আন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের উদয় হইতেছে না। অথচ ইসলামের আবির্ভাবের প্রারম্ভে আমাদের সমাজে কত বিশ্ববরেণ্য মহাকবির আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। হাফিজ, রুমী, সানী, ওমর খৈয়াম—এদের লেখা পড়িয়া জগৎ মোহিত। কিন্তু আজ কি দেখিতেছি? সমস্ত মুসলিম-জগতে কোথা হইতেও প্রতিভার উদয় হইতেছে না। প্রতিভাকে বড় ও পুষ্ট করিয়া তুলিবার মত মানসিকতা আমাদের সমাজ-জীবন হইতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বনে জঙ্গলে আগাহার অন্তরালে বহু ফুল ফুটিয়া থাকে। কে তাহাদের সন্ধান রাখে? ফুলের বাগান করিতে হইলে উপযুক্ত মালির প্রয়োজন; ফুলগাছের তদ্বির-তালাসী করিবার প্রয়োজন। গাছের গোড়া হইতে আগাছা নষ্ট করিয়া দিতে হয়; গোড়ায় পানি ঢালিতে হয়। তবেই ফুলের গাছে ফুল ফোটে, সেই ফুলের গন্ধে দুনিয়া মাতোয়ারা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে যদি ভুলেও দু-একটা ফুলগাছ জন্মে, আমরা গোড়ায় পানি ঢালা তো দূরের কথা, কুঠার লইয়া তাহাকে আঘাত করিতে প্রবৃত্ত হই। নজরুল-জীননের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তারা সকলেই এ কথার সাক্ষ্যদান করিবেন। নজরুলের কবিজীবনের আবির্ভাবের সময় আমাদের সমাজ যে কুৎসিত ভাষায় কবিকে আক্রমণ করিয়াছেন, যে ভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছেন, তাহার কণ্টক-ক্ষতগুলি মহাকাল কবির কাব্যের সঙ্গে বহন করিয়া চলিবে। অনাগত যুগের কাব্য-রসগ্রাহীদের কাছে আমরা এইজন্য হেয় হইয়া থাকিব।

যাক এসব কথা। কবি কিন্তু আসন্ন ভোটযুদ্ধে বড়ই আশাবাদী ছিলেন। আমি লোক-চরিত্র কিছুটা জানিতাম; আমাদের সমাজের মানবিকতার কথাও অবগত ছিলাম। তাই কবির মনকে আগে হইতেই পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করিবার জন্য তৈরি রাখিতে চেষ্টা করিতেছিলাম। কিন্তু সবই বৃথা। পীর বাদশা মিঞার সমর্থন-চিঠি তিনি পাইয়াছেন। আরও বহু মুসলিম নেতা কবিকে সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু মুসলিম-সমাজের কাগজগুলি বহুদিন হইতে তাঁহার বিরুদ্ধে যে বিষেশার করিতেছিল, তাহার ধাক্কায় শত বাদশা মিঞা ভাসিয়া যাইবেন—এই বয়স্ক-শিশুকে তাহা আমি কেমন করিয়া বুঝাইব?

প্রথম ভোটের দিন কবিকে ভোটগ্রাহক অফিসারের সামনে বসাইয়া দিলাম। কবির সামনে গিয়া ভোটারেরা ভোট দিবেন। মনে একটু ভরসা ছিল, কবিকে সামনে দেখিয়া ভোটারেরা হয়তো তাহাকে সমর্থন করিবেন। কবি সন্ধ্যাবেলায় আসিয়া আমাকে বললেন, বছ লোক তাহাকে ভোট দিয়াছেন; তাঁহাদের মুখ দেখিয়াই নাকি কবি ইহা বুঝিতে পারিলেন। পরদিন সকালে আমরা নদীতে গোসল করিতে চলিয়াছি। কবি আমাকে বলিলেন, “দেখ জসীম, ভেবে দেখেছি, এই ভোটযুদ্ধে আমার জয় হবে না। আমি ঢাকা চলে যাই। দেখি, অন্ততপক্ষে জামানতের টাকাটা যাতে মারা না যায়।”

তখন বড়ই হাসি পাইল। জয়ী হইবেন বলিয়া কাল যিনি খুশীতে মশগুল ছিলেন, হারিয়া গিয়া জামানতের টাকা মার যাওয়ার চিন্তা আজ ভঁহার মনে কোথা হইতে আসিল। ব্যবহারিক জীবনে এই বয়স্ক শিশুটির সারা জীবন ভরিয়া এমনই ভুল করিয়া প্রতি পদক্ষেপে নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হইয়াছেন।

দুপুরের গাড়ীতে কবি চলিয়া গেলেন। মনটা বড়ই খারাপ হইয়া গেল। হঠাৎ এমন করিয়া কবির সাহচর্য হইতে বঞ্চিত হইব, তাহার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

 

একবার পরলোকগত সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে কবি আর হেমন্তকুমার সরকার আমাদের ফরিদপুরে আসিলেন। সরোজিনী নাইডু একদিন পরেই চলিয়া গেলেন। কবিকে আমরা কয়েকদিন রাখিয়া দিলাম।

আমি তখন ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়ি। আমরা সকল ছাত্র মিলিয়া কবিকে কলেজে আনিয়া অভিনন্দন দিব, স্থির করিলাম। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল কামাখ্যাচরণ মিত্র মহাশয় খুশী।  হইয়া আমাদের প্রস্তাবে রাজি হইলেন।

খবর পাইয়া ফরিদপুরের পুলিশ-সাহেব আমাদের প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়ের নিকট পত্র লিখিলেন, নজরুলের মতিগতি গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে; তিনি তাঁহার বক্তৃতায় সরলমতি ছাত্রদিগকে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে ক্ষেপাইয়া তুলিবেন। নজরুলকে যদি কলেজে বক্ত তা করিতে দেওয়া হয়, তবে সি. আই. ডি. পুলিশদেরও কলেজের সভায় উপস্থিত থাকিতে দিতে হইবে। আমাদের প্রিন্সিপ্যাল কামাখ্যা বাবুর প্রতিও গভর্নমেন্টের মুনজর ছিল না। বহু বৎসর আগে তিনি পুলিশের কোপদৃষ্টিতে অন্তরীণ ছিলেন। নজরুলকে দিয়া বক্ততা করাইলে পরিণামে কলেজের ক্ষতি হইতে পারে বিবেচনা করিয়া তিনি আমাদিগকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “নজরুলকে লইয়া কলেজে যে সভা করার অনুমতি দিয়েছিলাম, তাহা প্রত্যাহার করলাম।”

আমরা মুষড়িয়া পড়িলাম। সবাই মুখ মলিন করিয়া কবির কাছে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদের অবস্থা দেখিয়া কবি বলিলেন, “কুছ পরওয়া নেই। উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে সভা কর। আমি সেইখানে বক্তৃতা দেব।”

তখন আমাদিগকে আর পায় কে! দশ-বিশটা কেরোসিনের টিন বাজাইতে বাজাইতে সমস্ত শহর ভরিয়া কবির বক্তৃতা দেওয়ার কথা প্রচার করিলাম। সন্ধ্যাবেলা অম্বিকা-হলের ময়দান লোকে লোকারণ্য। হাজার হাজার নর-নারী আসিয়া জমায়েত হইলেন কবি-কণ্ঠের বাণী শুনিবার জন্য।

সেই সভায় কবিকে নূতনরূপে পাইলাম। এতদিন কবি শুধু দেশাত্মবোধের কথাই বলিতেন। আজ কবি বলিলেন সাম্যবাদের বাণী। কবি যখন ‘উঠ রে চাষী জগৎবাসী, ধর কষে লাঙ্গল’ অথবা ‘আমরা শ্রমিকদল, ওরে আমরা শ্রমিকদল’—প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সমবেত জনতা কবির ভাব-তরঙ্গের সঙ্গে উদ্বেলিত হইতেছিল। সর্বশেষে কবি তাহার বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতা আবৃত্তি করিলেন। সে কী আবৃত্তি, প্রতিটি কথা কবির কণ্ঠের অপূর্ব ভাবচ্ছটায় উদ্বেলিত হইয়া সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলীর হৃদয়ে গিয়া ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিতেছিল। মাঝে মাঝে মনে হইতেছিল, কবিকণ্ঠ হইতে যেন অগ্নি-বর্ষণ হইতেছে। সেই আগুনে যাহা কিছু ন্যায়ের বিরোধী, সমস্ত পুড়িয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে।

সেই সভায় আমি বলিয়াছিলাম, ইনি আমাদের কবি; ইহার অন্তর হইতে যে বাণী বাহির হইতেছে, সেই বাণীর সঙ্গে আমাদের যুগান্তরের দুঃখ-বেদনা ও কান্না মিশ্রিত হইয়া আছে; শত জালিমের অত্যাচারে শত শোষকের পীড়নে আমাদের অন্তরে যে অগ্নিময় হাহাকার শত লেলিহ জিহবা মিলিয়া যুগ-যুগান্তরের অপমানের গ্লানিতে তাপ সঞ্চয় করিতেছিল, এই কবির বাণীতে আজ তাহা রূপ পাইল। এই কবির অন্তর হইতে বাণীর বিহঙ্গের অগ্নির পাখা বিস্তার করিয়া আজ দিগ-দিগন্তে সর্বত্যাগের গান গাহিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে। কাব্য এই কবির কাছে ভাব-বিলাসের বস্তু নয়। তাহার কাব্যলোক হইতে যে বাণী স্বতঃই উৎসারিত হইতেছে, নিজের জীবনকে ইনি সেই বাণী-নিঃসৃত পথে পরিচালিত করিতেছেন। আমাদের আসমানে, সুবেহ সাদেকে ইনি উদীয়মান শুকতারা। উহার ত্যাগের রক্তরঙ্গিমায় স্নান করিয়া নূতন প্রভাতের অরুণ আলোক দিগদিগন্ত আলোকিত করিয়া তুলিবে।

আমার বক্তৃতার শেষের দিকে আমি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়ের কঠোর সমালোচনা করিয়াছিলাম। পরদিন তিনি আমাকে ডাকাইয়া ইহার জন্য কৈফিয়ৎ চাহিলেন। আমি তাহাকে বলিলাম, “আপনার কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি, তারই জোরে সভায় আপনার বিরূপ সমালোচনা করতে সাহসী হয়েছিলাম। আপনিই তো বলে থাকেন, আমরা রাজভয়ে ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুত হব না। কিন্তু পুলিশ-সাহেবের একখানা পত্র পেয়ে আপনি আপনার পুর্ব-অনুমতি ফিরিয়ে নিলেন।”

আমার কথা শুনিয়া তিনি হাসিয়া উঠিলেন। বুঝিলাম, তিনি আমাকে ক্ষমা করিয়াছেন। বস্তুত তাঁহার মত ক্ষমাসুন্দর শিক্ষক জীবনে খুব কমই দেখিয়াছি।

ইহার পরে আরও একবার কবি আমার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, আমাদের নদী-তীরের বাঁশঝাড়ের ছায়াতলে বসিয়া আমরা দু’টি কবি মিলিয়া উন্মুক্ত প্রকৃতির রহস্যদেশ হইতে মনি মাণিক্য কুড়াইয়া আনিব। কবিও তাহাতে রাজী হইয়াছিলেন। কিন্তু ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব মোটর হাঁকাইয়া আসিয়া একদিন কবিকে শহরে লইয়া আসিলেন। আমার নদীতীরের চখা-চখির ডাকাডাকি কবিকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।

বাঁশঝাড়ের যে স্থানটিতে কবির বসিবার আসন পাতিয়া দিয়াছিলাম, সেই স্থান শূন্য পড়িয়া রহিল। চরের বাতাস আছাড়িবিছাড়ি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। আমার নদীতীরের কুটিরে কবির এই শেষ আগমন।

একদিন রাত্রে বন্ধুবর লাল মিঞার বাড়িতে আমরা তিন-চার জন মিলিয়া কবির সঙ্গে গল্প করিতে বসিলাম। কবি ভাল কবিতা লেখেন, ভাল বক্তৃতা দেন, ভাল গান করেন—তাহা সকলেই জানেন। কিন্তু মজলিসে বসিয়া যিনি কবির গালগল্প না শুনিয়াছেন, তাহারা কবির সব চাইতে ভাল গুণটির পরিচয় পান নাই। অনেক বড় বড় লোকের মজলিসে কবিকে দেখিয়াছি। মজলিসি গল্পে বিখ্যাত দেশবরণ্যে নেতা ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে কবিকে দেখিয়াছি; সেখানেও একমাত্র কথক কবি—আর সকলেই শ্রোতা। কথায় কথায় কবির সে কী উচ্চ হাসি! আর সেই হাসির তুফানে আশেপাশের সমস্ত লোক তাঁর হাতের পুতুলের মত একবার উঠিতেছে, একবার পড়িতেছে। কিন্তু এইদিন রাত্রে কবিকে যেন আরও নূতন করিয়া পাইলাম। কবির মুখে গল্প শুনিতে শুনিতে মনে হইল, কবির সমস্ত দেহটি যেন এক বীণার যন্ত্র। আমাদের দু-একটি প্রশ্নের মৃহ করাঘাতে সেই বীণা হইতে অপূর্ব সুরঝঙ্কার বাহির হইতেছে। কবি বলিয়া যাইতেছেন তাহার সমস্ত জীবনের প্রেমের কাহিনী। বলিতে বলিতে কখনও কবি আমাদের দুই চোখ অশ্রু-ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতেছেন আবার কখনও আমাদিগকে হাসাইয়া প্রায় দম বন্ধ করিবার উপক্রম করিয়া তুলিতেছেন। সেসব গল্পের কথা আজো বলিবার সময় আসে নাই।

গল্প শুনিতে শুনিতে শুনিতে কোন দিক দিয়া যে ভোর হইয়া গেল, তাহা আমরা টের পাইলাম না। সকালবেলা আমরা কবিকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইলাম।

একবার কবিকে আর একটি সভায় খুব গল্পমুখর দেখিয়াছিলাম। কবির এক গানের শিষ্য পুষ্পলতা দে’র জন্মদিনে। সেই সভায় জাহানারা বেগম, তাঁহার মা, কবির শাশুড়ী এবং কবি-পত্নী উপস্থিত ছিলেন।

আমরা সকলে খাইতে বসিয়াছি। ছোট ছোট মাটির পাত্রে করিয়া নানা রকম খাদ্যবস্তু আমাদের সামনে আসিয়া দেওয়া হইতেছে। কবি তার এক একটি দেখাইয়া বলিতেছেন—এটি খুড়ীমা, এট পিসীমা, এটি মাসীমা।

আমি কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা কবিভাই, সবাইকে দেখালেন—আমার ভাবী কোটি, তাকে তো দেখালেন না।”

কবি একটুও চিন্তা না করিয়া পানির গেলাসটি দেখাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এইটি তোমাদের ভাবী ৷ যেহেতু আমি তার পাণিগ্রহণ করেছি।”

চারিদিকে হাসির তুফান উঠিল। ভাবী হাসিয়া কুটিকুটি হইলেন। কোন রকমে হাসি থামাইয়া আমরা আবার আহারে মনোনিবেশ করিয়াছি, অমনি কবি গম্ভীর হইয়া উঠিলেন : “জসীম, তুমি লুচি খেও না।”

বাড়ীর গৃহিণীর মুখ ভার। না জানি লুচির মধ্যে কবি কোন ত্রুটি পাইয়াছেন।

আমি উত্তর করিলাম, “কেন কবিভাই?” সকলেই ভোজন ছাড়িয়া কবির দিকে চাহিয়াছিলেন।

কবি বলিয়া উঠিলেন, “যেহেতু আমরা বেলুচিস্তান হতে এসেছি, সুতরাং লুচি খেতে পারব না।”

চারিদিকে আবার হাসির চোটে অনেকেরই খাদ্যবস্তু গলায় আটকাইয়া যাইতেছিল।

বাড়ীর গৃহিণী কৃত্রিম গলবস্ত্র হইয়া কবিকে বলিলেন, “বাবা নুরু, লক্ষ্মীটি, তুমি একটু ক্ষণের জন্য হাসির কথা বন্ধ কর। এদের খেতে দাও।”

আগেই বলিয়াছি, বিষয়বুদ্ধি কবির মোটেই ছিল না। একবার কবির বাড়ি গিয়া দেখি, খালাআম্মা কবিকে বলিতেছেন, “ঘরে আর একটিও টাকা নেই। কাল বাজার করা হবে না।”

কবি আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিলেন তাঁর গ্রন্থ-প্রকাশকের দোকানে। পথে আসিয়া কবি ট্যাক্সি ডাকিলেন। কলেজ ষ্টীটের কাছে আসিয়া আমাকে ট্যাক্সিতে বসাইয়া রাখিয়া চলিলেন কলেজ ঈটি মার্কেটের দ্বিতল কক্ষে “আর্যস্থান পাবলিশিং হাউসে টাকা আনিতে। প্রায় আধ ঘণ্টা কাটিয়া গেল, কবির দেখা নাই। এদিকে ট্যাক্সিতে মিটার উঠিতেছে। যত দেরী হইবে, কবিকে তত বেশী ট্যাক্সী ভাড়া দিতে হইবে। বিরক্ত হইয়া আমি উপরে উঠিয়া গেলাম। দেখি, কবি প্রকাশকের সঙ্গে একথা-ওকথা লইয়া আলাপ করিতেছেন। আসল কথা—অর্থাৎ টাকার কথা সেই গল্পের মধ্যে কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। কবির কানে কানে আমি সমঝাইয়া দিলাম, কিন্তু কবির সেদিকে খেয়াল নাই তখন রাগত ভাবেই বলিলাম, “ওদিকে ট্যাক্সির মিটার উঠছে, সেটা মনে আছে?” কবি তখন প্রকাশকের কানে কানে টাকার কথা বলিলেন।

প্রকাশক অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া কবির হাতে পাঁচটি টাকা দিলেন। অল্পে তুষ্ট কবি মহাখুশী হইয়া তাহাই লইয়া গাড়ীতে আসিলেন। দেখা গেল, গাড়ীর মিটারে পাঁচ টাকা উঠিয়াছে। ট্যাক্সিওয়ালাকে তাহাই দিয়া কবি পায়ে হাঁটিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন।

কবিকে কত ভাবে কত জায়গায় দেখিয়াছি! যখন যেখানে তাহাকে দেখিয়াছি, স্ব-মহিমায় তিনি সমুজ্জ্বল। বড় প্রদীপের কাছে আসিয়া ঘোট প্রদীপের যে অবস্থা আমার তাহাই হইত। অথচ পরের গুণপনাকে এমন অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করিতে নজরুলের মত আর কাহাকেও দেখি নাই। অপর কাহাকেও প্রশংসা করিতে পারিলে তিনি যেন কৃতার্থ হইয়া যাইতেন। অপরকে হেয় করিয়া নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে তিনি কোনদিনই প্রয়াস পান নাই। কবি যখন গানের আসরে আসিয়া বসিয়াছেন, সেখানে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। গায়ক। সকলেই তার গান শুনিতে চাহিতেন। হয়তো বা সেই সভায় কবির চাইতেও অনেক সুকণ্ঠ গায়ক বর্তমান। তেমনি গল্পের আসরে, সাহিত্যের মজলিসে, রাজনৈতিক বক্তৃতার মঞ্চে—সব জায়গায় সেই এক অবস্থা। ইহার একমাত্র কারণ স্বাভাবিক গুণপনা তো কবির ছিলই, তার সঙ্গে ছিল তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। সেই ব্যক্তিত্বের কাছে স্বেচ্ছায় সকলে নত হইয়া পড়িল। তবু এই লোকের শত্রুর অন্ত ছিল না। দেশ-জোড় প্রশংসা শুনিয়া তাহারা ঈর্ষায় জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিত। কাগজে নানারূপ ব্যঙ্গরচনা করিয়া তাহারা কবিকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা পাইত। কবি প্রয়ই সেদিকে খেয়াল করিতেন না। যদিই বা তাহাদের কামড়ে উত্ত্যক্ত হইয়া কখনো কখনো কবি দু-একটি বাক্যবাণ ছুঁড়িয়াছেন, কবির রচনার জাদুর স্পর্শে তাহা বাংলা-সাহিত্যে অমর হইয়া আছে।

 

নজরুলের জীবন লইয়া অনেক চিন্তা করিয়া দেবিয়াছি। এই লোকটি আশ্চর্য লোকরঞ্জনের ক্ষমতা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। যখনই যেখানে গিয়াছেন, যশ অর্থ সম্মান আপনা হইতেই আসিয়া তাঁহার পদতলে লুটাইয়া পড়িয়াছে। রবীন্দ্রনাথ হইতে সত্যেন্দ্রনাথ পর্যন্ত—কবিতা রচনা করিয়া সেকালে অর্থ উপার্জন করিতে পারেন নাই। রবীন্দ্রনাথের বহু পুস্তকের তখন দ্বিতীয় সংস্করণ হইত না। মাসিক পত্রিকার সম্পাদক কবিদের কবিতার জন্য অর্থ তত দিতেনই না—যে সংখ্যায় কবির কবিতা ছাপা হইত, সেই সংখ্যাটি পর্যন্ত কবিকে কিনিয়া লইতে হইত। নজরুলই বোধ হয় বাংলার প্রথম কবি, যিনি কবিতা লিখিয়া মাসিক পত্রিকা হইতেও প্রচুর অর্থ উপার্জন করিয়াছেন।

আগে গ্রামোফোনের জন্য যাহারা গান রচনা করিতেন, গ্রামোফোন কোম্পানীর নিকট হইতে তাহাদের খুব কম লোকই রচনার মূল্য আদায় করিতে পারিতেন। নজরুল গ্রামোফোনেয় গান রচনা করিয়া শুধু নিজের গানের জন্যেই পারিশ্রমিক আদায় করিলেন না; তাহার আগমনের পর হইতে সকল লেখকই রচনার জন্য উপযুক্ত মূল্য পাইতে লাগিলেন। নজরুল প্রমাণ করিলেন, গানের রেকর্ড বেশী বিক্রয় হয়—সে শুধু গায়কদের সুকণ্ঠের জন্যই নয়, সুন্দর রচনার সহিত সুন্দর সুন্দরের সমাবেশ রেকর্ড বিক্রয়-বাড়াইয়া দেয়। নজরুলের আগমনের পর হইতে গ্রামোফোন কোম্পানী আরও নূতন নূতন রচনাকারীর সন্ধানে ছুটিল, নূতন নূতন সুরসংযোজন কারীর খোঁজে বাহির হইল। নজরুলের রচনা আর সুর লইয়া তাহারা বুঝিতে পরিল, সুন্দর কথার সঙ্গে সুন্দর সুরের সমাবেশ হইলে সেই গান বেশি লোকপ্রিয় হয়। গ্রামোফোনকোম্পানীতে আজ যে এত কথাকার আর এত সুরকার গুঞ্জরণ করিতেছেন, এ শুধু নজরুলের জন্য। একথা কি তাঁহারা কেহ আজ স্বীকার করিবেন?

একটি গান রচনা করা অনেক সময় একটি মহাকাব্য রচনার সমান। মহাকাব্যের লেখক সুবিস্তৃত কাহিনীর পদক্ষেপের মধ্যে আপনার ভাব রূপায়িত করিবার অবসর পান। গানের লেখক মহাকাব্য রচনা করেন অতি-সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথার ভিতর দিয়া। মহাকাব্যের পাঠক বার বার সেই কাব্য পাঠ করেন না; করিলেও সেই কাব্যের ত্রুটি-বিচ্যুতির সন্ধান সহজে পান না। কিন্তু গানের সমঝদার গানটিকে বার বার করিয়া আবৃত্তি করিয়া সেই গানের পুঙ্খানুপুঙ্খ ত্রুটিবিচ্যুতি ও গুণের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই জন্য একটি ভাল গান রচনা করা প্রায় একটি মহাকাব্য রচনার মতই কঠিন। নজরুলের বেলায় দেখিয়াছি, গান রচনা তাঁহার পক্ষে কত সহজ ছিল। তিনি যেন গান রচনা করেন নাই, বালকের মত পুতুল লইয়া খেলা কয়িয়াছেন। সুরগুলি পাখির মত সহজেই তাহার কথার জালে আসিয়া আবদ্ধ হইয়াছে।

গ্রামোফোন-কোম্পানীতে গিয়া বহুদিন কবিকে গান রচনা করিতে দেখিয়াছি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! এঘরে-ওঘরে গায়কেরা নানা রাগ-রাগিণী ভাজিয়া সুরাসুরের লড়াই বাধাইয়া তুলিয়াছেন, কানে তালা লাগিবার উপক্রম। মাঝখানে কবি বসিয়া আছেন হারোমমানিয়াম সামনে লইয়া। পার্শ্বে অনেকগুলি পান, আর পেয়ালা-ভরা গরম চা। ছয়-সাত জন গায়ক বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়। একজনের চাই দুইটি শ্যামাসঙ্গীত, অপরের চাই একটি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কীর্তন, একজনের চাই দুইটি ইসলামী সঙ্গীত, অন্যজনের চাই চারিটি ভাটিয়ালী গান, আর একজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান। এরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বসিয়া আছেন। কবি তাহার মানস-লোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া আনিয়া তাহাদের করপুট ভরিয়া দিলেন।

কবি ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম বাজাইতেছেন, আর গুনগুন করিয়া গানের কথাগুলি গাহিয়া চলিয়াছেন। মাঝে মাঝে থামিয়া কথাগুলি লিখিয়া লইতেছেন। এইভাবে একই অধিবেশনে সাতআটটি গান শুধু রচিত হইতেছে না—তাহারা সুর সংযোজিত হইয়া উপযুক্ত শিষ্যের কণ্ঠে গিয়া আশ্রয় লইতেছে। কবির কাব্যের মধ্যে বহু স্থানে বাজে উচ্ছ্বাস ও অসংযমের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু গানের স্বল্পপরিসর আয়তনের মধ্যে আসিয়া কবির রচনা যেন দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছে। কবি যেন তাহার গানের ক্ষুদ্র কৌটার মধ্যে মহাকাশের অনন্ত রহস্য পুরিয়া দিয়াছেন। সেই গান যতই গাওয়া যায়, তাহা হইতে ততই মাধুর্যের ইন্দ্রজাল বিস্তৃত হইতে থাকে। কবির যে গানে রচনার মাধুর্য পাওয়া যায় না, সুরের মাধুর্য সেখানে রচনার দৈন্য পূরণ করে। কবি যখুন সাহিত্য করিয়াছেন, সেই সাহিত্যকে তিনি জনসাধারণের উপভোগ্য করিয়া তুলিয়াছেন।

সাহিত্য করিতে করিতে কবি যখন জেলে গেলেন, সেখানেও আত্মসম্মানের মহিমা লইয়া কবি সমস্ত দেশের অন্তর জয় করিয়াছেন। চল্লিশ দিন ব্যাপী অনশনের সুদীর্ঘ বন্ধুর পথে এই নির্ভীক সেনানীর প্রতি পদক্ষেপ তাঁহার দেশবাসীর অন্তর উদ্বেলিত করিয়া তুলিয়াছে। ইদানীং রোগের শর-শয্যায় শয়ন করিয়া কবি দেশবাসীর অন্তরে আরও সমুজ্জল হইয়া বিরাজ করিতেছেন।

 

কবিকে আমি শেষ বার সুস্থ অবস্থায় দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনিলাম মুসলিম-হলে কবি আসিবেন ভোর আটটায়। কিন্তু কবি আসিলেন বেলা দশটায়। সময়-অনুবর্তিতার জ্ঞান কবির কোনদিনই ছিল না। নোঙরহীন নৌকার মত তিনি ভাসিয়া বেড়াইতেন। সেই নৌকায় যে-কেহ আসিয়া হাল ঘুরাইয়া কবির গতি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিত। এক জায়গায় যাইবার জন্য তিনি যাত্রা করিলেন, তাহার গুণগ্রাহীরা তাহাকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য স্থানে লইয়া গেলেন। এজন্য কবিকেই আমরা দায়ী করিয়া থাকি। যবনিকার অন্তরালে থাকিয়া যাহারা কবিকে নিয়ন্ত্রিত করিতেন, তাঁহারা কোনদিনই দায়ী হইতেন না। শিশুর মত আপন-ভোলা কবিকে সে জন্য কত লোকের বিরাগভাজন হইতে হইয়াছে।

আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রূপে দেখিয়া কবি কত সুখী হইলেন। তিনি আমার কানে কানে বলিলেন, “মায়েরা ছেলেদের প্রতি যে স্নেহ-মমতা ধারণ করে, তোমার চোখে-মুখে সমস্ত অবয়বে সেই স্নেহ-মমতার ছাপ দেখতে পেলাম।”

কবি আসিয়াই তাহার স্বভাবসিদ্ধ রূপে ছেলেদের সামনে কবিতাগান আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। আমার ক্লাস ছিল, ঘণ্টাখানেক থাকিয়া আমি চলিয়া গেলাম।

দুপুরবেলা ক্লাস করিতেছি, দেখিলাম ক্লাসে ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। মেয়েরা সবাই অনুপস্থিত। কারণ অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, ফজলুল হক হলে নজরুল আসিয়াছেন। সবাই তাহার বক্তৃতা শুনিতে গিয়াছে। বেলা তিনটার সময় ফজলুল হক-হলে গিয়া দেখি, ছেলে-মেয়েদের চাহিদা অনুসারে কবি গানের পর গান গাহিয়া চলিয়াছেন, কবিতার পর কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিয়াছেন। কবির মুখ শুষ্ক; সমস্ত অঙ্গ ক্লান্তিতে ভরা। খোঁজ লইয়া জানিলাম— সেই যে সকাল দশটায় কবি আসিয়াছেন, বারোটা পর্যন্ত মুসলিমহলে থাকিয়া তারপর ফজলুল হক-হলে আগমন করিয়াছেন—ইহার মধ্যে কয়েক পেয়ালা চা আর পান ছাড়া কিছুই কবিকে খাইতে দেওয়া হয় নাই। আমার তখন কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই অবুঝ বয়স্ক-শিশুটিকে লইয়া ছেলেরা কী নিষ্ঠুর খেলাই না খেলিতেছে! কিন্তু অবেলায় কোথাও কিছু খাবার পাইবার উপায় ছিল না। আমি এক রকম জোর করিয়াই সভা ভাঙিয়া দিলাম। খাওয়ার ব্যাপারটা আমি যে এত বড় করিয়া ধরিয়াছি, এজন্য কবি খুব খুশী হইলেন না। দোকান হইতে সামান্য কিছু খাবার আনাইয়া বহু সাধ্যসাধনায় কবিকে খাওয়ান গেল।

সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা করিবার সময় আমি কবির বাক্যের ভিতরে কতকটা প্রলাপ-উক্তির আভাস পাইয়াছিলাম। এক জায়গায় কবি বলিয়া ফেলিলেন, “আমি আল্লাকে দেখেছি। কিন্তু সে সব কথা বলবার সময় এখনও আসে নাই। সে সব বলবার অনুমতি যেদিন পাব, সে দিন আবার আপনাদের সামনে আসব।”

ইহার কিছুদিন পরেই শুনিলাম, কবি পাগল হইয়া গিয়াছেন। অসুস্থ অবস্থায় কবিকে দেখিবার জন্য বহুবার কবি-গৃহে গমন করিয়াছি। আগে তিনি আমাকে দেখিলে চিনিতে পারিতেন; আমার আব্বা কেমন আছেন, ছেলেরা কেমন আছে, জিজ্ঞাসা করিতেন। এখন আর চিনিতে পারেন না। কবির কোন কবিতা আবৃত্তি করিলে কবি বড়ই সুখী হন। কিছু খাইতে দিলে খুশী হইয়া গ্রহণ করেন।

কবির শাশুড়ী খালাআম্মার বিষয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর বিরূপ আলোচনা হইয়া থাকে। এই নিরপরাধ মহিলার বিষয়ে কিছু বলিয়া প্রসঙ্গের শেষ করিব।

একদিন বেলা একটার সময় কবি-গৃহে গমন করিয়া দেখি, খালআম্মা বিষণ্ণ বদন বসিয়া আছেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার মুখ আজ বেজার কেন?”

খালাআম্মা বলিলেন, “জসীম, তোমারা জান, সব লোকে আমার নিন্দা করে বেড়াচ্ছে। নুরুর নামে যেখান থেকে যত টাকা-পয়সা আসে, আমি নাকি সব বাক্সে বন্ধ করে রাখি। নুরুকে ভালমত খাওয়াই না, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি না। তুমি জান, আমার ছেলে নেই; নুরুকেই আমি ছেলে করে নিয়েছি। আর, আমিই বা কে! নুরুর দু’টি ছেলে আছে—তারা বড় হয়ে উঠেছে। আমি যদি শুরুর টাকা লুকিয়ে রাখি, তারা তা সহ্য করবে কেন? তাদের বাপ খেতে পেল কিনা, তারা কি চোখে দেখে না। নিজের ছেলের চাইতে কি কবির প্রতি অপরে: দরদ বেশী? আমি তোকে বলে দিলাম, জসীম এই সংসার থেকে একদিন আমি কোথাও চলে যাব। এই নিন্দা আমি সহ্য করতে পারি নে।”

এই বলিয়া খালাআম্মা কাঁদিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম, “খালাআম্মা, কাঁদবেন না একদিন সত্য উদঘাটিত হইবেই।”

খালাআম্মা আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গেলেন, যে ঘরে নজরুল থাকিতেন সেই ঘরে। দেখিলাম, পায়খানা করিয়া কাপড়-জামা সমস্ত অপরিষ্কার করিয়া কবি বসিয়া আছেন। খালাআম্মা বলিলেন, “এই সব পরিষ্কার করে স্নান করে আমি হিন্দু-বিধবা তবে রান্না করতে বসব। খেতে খেতে বেল পাঁচটা বাজবে। রোজ এই ভাবে তিন-চার বার পরিষ্কার করতে হয়। যারা নিন্দা করে তাদের বোললা, তারা এসে যেন এই কাজের ভার নেয়। তখন যেখানে চক্ষু যায়, আমি চলে যাব।” তখন বুঝতে পারি নাই, সত্য সত্যই খালা-আম্মা ইহা করিবেন।

ইহার কিছুদিন পরে খালাআম্মা সেই যে কোথায় চলিয়া গেলেন, কিছুতেই তাহার খোঁজ পাওয়া যায় নাই। আজ দুই-তিন-বৎসরের উপরে খালা-আম্মা উধাও। কবির দুই পুত্র কত স্থানে তাহার অনুসন্ধান করিতেছে, তাঁহাকে পাওয়া যায় নাই।

দু-একজন কৃত্রির নজরুল-ভক্তের মুখে আজও খালাআম্মার নিন্দা শোনা যায়। তাঁহারা বলিয়া থাকেন, “নজরুলের টাকা সমস্ত তার শাশুড়ীর পেটে।” বিনা অপরাধে এরূপ শাস্তি পাইতে আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। রক্ষণশীল হিন্দু-ঘরেব এই বিধবা নিজের মেয়েটির হাত ধরিয়া একদিন এই প্রতিভাধর ছন্নছাড়া কবির সঙ্গে অকূলে ভাসিতেছিলেন। নিজের সমাজের হাতে আত্মীয়-স্বজনের হাতে সেদিন তাহার গঞ্জনার সীমা ছিল না। সেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনাকে তিনি তৃণের মত পদতলে দলিত করিয়াছেন। কিন্তু পরবর্তী নিন্দা অন্য ধরনের। এই নিন্দা তিনি সহ করিতে পারিলেন না।

খালাআম্মা আজ বাঁচিয়া আছেন কিনা জানি না, ইহলোকে বা পরলোকে যেখানেই থাকুন, তিনি যেন তার এই পাতান বোনপোটির একফোটা অশ্রুজলের সমবেদনা গ্রহণ করেন। মুহূর্তের জন্যও যেন একবার স্মরণ করেন, ভাল কাজ করিলে তাহা বৃথা যায় না। খালাম্মার সেই নীরব আত্মত্যাগ অন্তত পক্ষে একজনের অন্তরের বীণায় আজও মধুর সুরলহরে প্রকাশ পাইতেছে।

আমার ভাবী সাহেবার কথা আর কি বলিব! কত সীমাহীন দুঃখের সাগরেই না তিনি ভাসিয়া চলিয়াছেন! অর্ধাঙ্গ হইয়া তিনি বিছানা হইতে উঠিতে পারেন না। তবু মুখে সেই মধুর হাসিটি যে হাসি সেই প্রথম বধূজীবনে তাঁহার মুখে দেখিয়াছিলাম। যে হাসিটি দিয়া ছন্নছাড়া কবিকে গৃহের লতা শৃঙ্খলে বাঁধিয়াছিলাম। যে হাসিটির বিনিময়ে আকাশের চাঁদ হইতে, সন্ধ্যা-সকালের রঙিন মেঘ হইতে নুড়ি পাথর কুড়াইয়া আপন বুকের স্নেহমমতায় শিশু কুসুমগুলি গড়িয়া কবির কোলে সাজাইয়া দিয়াছিলেন। সেই হাসি এখনও তাঁহার মুখ হইতে ম্লান হইয়া যায় নাই।

রোগগ্রস্ত কবি প্রায় অধিকাংশ সময় ভাবীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পুরাতন পুস্তকের পাতা উল্টাইতে থাকেন। হায়রে, কবির অতীত জীবন-নাট্যের বিস্মৃত পাতাগুলি আর কি তাহার কাছে অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *