ধ্রুব যেন যুদ্ধ জয় করে ফিরছে এমন একটা আনন্দ নিয়ে হাঁটছিল। ওদের দোতলা বাড়িটার সামনে রাস্তার ওপারে বিশাল চারতলা ফ্ল্যাটে বাড়িটা মাথা তুলে দাঁড়ানোর পর থেকে ওদের দক্ষিণ চাপা পড়ে গেছে, হাওয়া ঢোকে না। ধ্রুবর ঘরে তো একেবারেই না। জানালা আছে, সামনের দিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা, তবু বাতাসের নামগন্ধ নেই। জানালা তো আর হাত ধরে দখিনা বাতাসকে আসুন আসুন বলে ডেকে আনতে পারে না। সে আসার আগে বেরোনোর রাস্তা আছে কিনা দেখে নেয়। কোথায় যেন পড়েছিল, চোর এবং হাওয়া একই চরিত্রের, পালানোর পথ না থাকলে ঢোকে না।
রাখালবাবুর ফ্ল্যাটে উঠে এলে নিশ্চয় প্রচুর হাওয়া পাবে। আর কতখানি জায়গা। তিন তিনখানা ঘর।
মনের ভিতর তখন একটা দারুণ ফুর্তি। রাস্তায় বেশ হাওয়া দিচ্ছে। বাড়িতে না থাক, রাস্তায় হাওয়া থাকে বলেই তো বিকেল হতে না হতে সকলেই বাইরে বেরিয়ে পড়ে। তাই এত ভিড়।
ধ্রুব এসে ঘন ঘন দরজার কড়া নাড়ল। কলিং বেলটা অনেককাল খারাপ হয়েছে, সারানো হয়নি। কেই বা মিস্ত্রি ডেকে এনে সারাবে। ধ্রুব ইচ্ছে করে মিস্ত্রি খুঁজতে যায়নি। বারবার ওকেই যেতে হবে কেন। দাদা কিংবা মেজদাও তো ডাকতে পারত। সবাই ভাবছে আরেকজন কেউ ডেকে আনবে। মিস্ত্রি ধরে আনাও এক ঝামেলা, একবার গেলেই তো আর পাবে না। তাছাড়া বেটা খারাপই হয়ে গেছে, নতুন কিনতে হবে। যে কিনে আনবে তাকেই দিতে হবে টাকাটা। বাবা রিটায়ার্ড মানুষ, এখন তো আর সব ব্যাপারে হাত পেতে টাকা চাওয়া যায় না।
দরজা খুলতেই এক এক লাফে দুদুটো সিঁড়ি ভেঙে সটান নিজের ঘরে চলে এল। প্রীতি শুয়ে একটা সিনেমার কাগজ পড়ছিল।
ধড়মড় করে উঠে ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন করল, বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা হল?
ধ্রুব উজ্জ্বল মুখ নিয়ে রসিদটা পকেট থেকে বের করে দেখাল।—ফাইনাল। একেবারে রসিদ নিয়ে এসেছি।
প্রীতির মুখেও উজ্জ্বল হলি। যেন এতদিন বাদে সত্যি সত্যি যুদ্ধ জয় করেছে।
তারপরই ধ্রুব বললে, একটা অবাক কাণ্ড, তোমাকে তো আসল কথাটাই বলা হয়নি।
প্রীতির চোখে প্রশ্ন।
খুব হাসতে হাসতে বললে, বাড়িওয়ালা তো চেনা লোক, খুব চেনা। ওই সামনের ফ্ল্যাট বাড়িটা হওয়ার আগে…
কথাটা বলে ফেলে ধ্রুবর নিজেরই কেমন খারাপ লাগল। চেনা লোেক, খুব চেনা। সত্যি কি তাই?
কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল ওর গলার স্বর।—জানো প্রীতি, মাত্র একখানা না দেড়খানা অন্ধকূপ ঘর নিয়ে থাকত একটা গোটা সংসার। এখন ফেঁপেফুলে বড়লোক হয়ে গেছে। কিসের ব্যবসা কে জানে।
চেনা লোক বলার অধিকার কি ধ্রুবর আছে! ও তো লোকটিকে এড়িয়ে এড়িয়ে যেত। লুঙ্গি পরে ফতুয়া গায়ে দিয়ে থলি হাতে করে যখন বাজার যেত, ডেকে কথা বললেও ধ্রুব এড়িয়ে যেত। যেন পাড়ার কেউ দেখলে ওর নিজেরও দাম কমে যাবে। ওর ট্রাউজার্সের কাপড় যে বেশ দামি, কেউ ভাববে না। অথচ এখন তাকেই খুব চেনা লোক হিসেবে স্বীকার করতে একটুও অস্বস্তি হচ্ছে না।
ধ্রুবর মনে হয়েছিল ও যুদ্ধজয় করে ফিরছে। এখন আর তেমন মনে হচ্ছে না।
শুনলে বাবার হয়ত একটু সম্মানে লাগবে। দাদাদের বৌদিদের।
আশ্চর্য, ভাগ্য এক একজন মানুষকে কত তাড়াতাড়ি বদলে দিতে পারে।
কিন্তু একে কি যুদ্ধজয় বলে। এতদিন তো ওর সামনে ছিল আত্মসম্মানের প্রশ্ন। সে আত্মসম্মান শুধু নিজের পরিবারের কাছে, দাদা বৌদিদের কাছে, তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে।
খুব অহঙ্কার নিয়ে বলেছিল, এত অশান্তি নিয়ে থাকা যায় না। আমরা উঠে যাচ্ছি।
কথা রাখতে পেরেছে, একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করে তাদের চোখের সামনে দিয়ে সদর্পে উঠে যাবে, সেটাই যেন যুদ্ধজয়।
অথচ এটা যে এত বড় পরাজয় ধ্রুব এতক্ষণ ভেবে দেখেনি। পরাজয় একটা নগণ্য মানুষের কাছে। দীনদরিদ্র দুঃস্থ মানুষ বলে মনে হত, ধ্রুবদের সঙ্গে কথা বলতে পেলেই ধন্য মনে করত। দু লাইন ইংরিজি লিখতে পারে না। রসিদে সইটা দেখেই হাসি পেয়ে গিয়েছিল।
উপমন্ত্রীকে গ্রামের স্কুলে নিয়ে যাবে, একটা অভিনন্দনপত্র লিখে দেবেন ইংরিজিতে। কাকে কি ভাবে তোয়াজ করতে হয়, ঠিক জানে। হাসতে হাসতে বলেছিল, না না, ইংরিজি। ইংরিজিতে হলেই ওঁরা খুব খুশি হন। ছাপার অক্ষরে ইংরিজিতে নিজের নাম, বুঝলেন কিনা!
প্রীতি সব শুনে বলে উঠল, তা হোক। তারপরই হেসে বললে, দেখো, এবার ওর ব্যবসার চিঠিপত্র সব তোমাকে দিয়ে লেখাতে আসে।
ধ্রুবও হাসল।
মাকে গিয়ে বলল, আমরা চলে যাচ্ছি, ফ্ল্যাট পেয়ে গেছি।
মা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালেন। -সত্যি চলে যাবি?
মার মুখ দেখে মনে হল যত রাগারাগি করেই ও সেদিন বলে থাকুক, মা একটুও বিশ্বাস করেননি। দুমাস ধরে ও ফ্ল্যাট খুঁজছে বটে, কিন্তু ও-সব নিয়ে আর তো কথা হয়নি; তাই ভেবেছিলেন, ওটা রাগের কথা, সত্যি চলে যাবে না।
—ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে কোন সংসারে ঝগড়াঝাঁটি হয় না।
মা এসে প্রীতিকে ধরলেন, ছোটবৌমা, তুমিই একটু বুঝিয়ে বল।
প্রীতি কোনও কথা বলল না। ও তখন একটা সজারু হয়ে আছে, সর্বাঙ্গে কাঁটা ফুলিয়ে। কেউ না গায়ে হাত দিয়ে একটু আদর করে ফেলে।
শেষ পর্যন্ত মা বুঝতে পারলেন ও-সবে কিছু হবে না।
তাই ধীরে ধীরে বললেন, তোর বাবাকে একটা ভাল দিন দেখে দিতে বলিস। তোর সংসারের মঙ্গলও তো আমাকেই ভাবতে হবে।
অথাৎ পাঁজি দেখিয়ে দিনস্থির করতে হবে। ওসরে ধ্রুবর কোনও বিশ্বাস নেই, প্রীতিরও না। তবু মনটা কেমন নরম হল। বললে, তুমিই বল।
মা’র এ ইচ্ছেটা অন্তত রাখতে চাইল। না কি, নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়ার আগে ওদেরও ভয়-ভয় করছিল। এতদিন ধরে এখানে আছে, মাথার ওপর বাবা-মা। পাড়াটাও রক্তমাংসের সঙ্গে মিশে গেছে।
এখন তো যেতে হবে একেবারে নতুন পরিবেশে। বিপদ-আপদ অসুখ-বিসুখে এখন আর কারও ওপর ভরসা করা চলবে না।
টিপুর হঠাৎ একদিন একেবারে একশ-তিন জ্বর। ধ্রুব বাড়ি ছিল না। প্রীতি এপাড়ার কোনও ডাক্তারকেই চিনত না। দাদা অফিস থিকে ফিরে যেই শুনল, পোশাক না বদলেই বেরিয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। প্রীতি তখন উভ্রান্ত, ডাক্তারের কথায় ঠাণ্ডা জল নিয়ে টিপুর মাথা ধুইয়ে দিতে ব্যস্ত। ডাক্তারকে ফি দেওয়ার কথা মনে ছিল না।
ধ্রুব এসে সব শুনে জিগ্যেস করল, ডাক্তারের ফি কে দিল?
—তা তো জানি না। এই যা! আমি তো দিতে ভুলেই গেছি। খুব দাদাকে টাকাটা দিতে গিয়েছিল। দাদা হেসে ফেলেছিল। —তুই কি রে? টিপু কি আমাদের পর?
টাকা নেয়নি।
অথচ এদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ। একটা ফ্ল্যাট পেয়ে আলাদা হতে পারছে বলে ভাবছে যুদ্ধজয় করেছি।
দিনকয়েক পরে মা এসে তারিখটা বললেন।—তোর বাবা বলছিল, এ মাসে তেমন ভাল দিন নেই। সাতাশে ফাল্গুন, একটা অবধি বারবেলা, তার পর।
ধ্রুব বললে, আচ্ছা।
ও বাবার সামনে যেতেই পারছিল না। সেদিন প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল বলেই বলতে পেরেছে। এখন আর সম্ভব নয়। সেজন্যই মাকে বলেছে, তুমি বল। মাকে বলতেও খুব কষ্ট হয়েছে ধ্রুবর। মা-বাবার কি দোষ। ওঁরাও তো ধ্রুবর মতোই, কিংবা ধ্রুবর চেয়েও অনেক বেশি ভিতরে ভিতরে ছিন্নভিন্ন হচ্ছেন। দোটানার মধ্যে ভিতরে ভিতরে পুড়ছেন। ওঁরা তো আর বিচারকের আসনে বসতে পারেন না, যে কার দোষ সেটাই বিচার করবেন।
মা আক্ষেপের স্বরে একদিন বলেছিলেন, কার দোষ? আমার কপালের দোষ রে, আর কারও দোষ নয়।
এ সব কথা শুনলে বড় ব্যথা লাগে, মন খারাপ হয়ে যায়। বাবার চাপা কষ্টের মুখ কিংবা মার দীর্ঘশ্বাস মাখানো কথা যখন ধ্রুবর বুকের ভিতরটা নিঙড়ে দেয়, তখনও তা প্রীতিকে স্পর্শ করে না। অন্তত ধ্রুবর তাই মনে হয়।
অবশ্য কেন তা স্পর্শ করবে প্রীতিকে। ধ্রুবর সঙ্গে ওঁদের সম্পর্কটা জন্ম থেকে। প্রীতি তত সম্পর্ক গড়ে তোলারই সময় পেল না, দিল না। তার জন্যে দোষও দিতে পারে না। ধ্রুবই কি কোনওদিন বুঝতে চেয়েছে, ওর নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে প্রীতির এ বাড়িতে আসার সময় প্রীতির ভিতরটা কতখানি ছিন্নভিন্ন হয়েছিল? কেউ বুঝতে পেরেছে? বুঝতে চেয়েছে? দাদা, মেজদা, ও নিজে! কেউ না।
মেজবৌদি এই সেদিন তার বাবা-মার কাছে গিয়ে দিনকয়েক থাকবে বলেছিল।
মেজদা রেগে গিয়ে ধমক দিয়েছিল–তোমার তো এ বাড়িতে থাকতেই ইচ্ছে করে না, সুযোগ পেলেই কেবল বাপের বাড়ি যাব।
ধ্রুবরও শুনে খারাপ লেগেছিল। বাবা মা যেন শুধু ছেলেদের, মেয়েদের বাবা মা যেন সত্যি সত্যি বাবা মা নয়। কই, তাদের বুকের ভিতরটা কি ভাবে ছিঁড়ে যায় আমরা তো ভেবে দেখি না। আমরাই তো ওদের স্বার্থপর করে তুলি। ওরা হয়ত মনে মনে বলে, আমার আজন্ম সম্পর্কটা যদি এতই তুচ্ছ, যদি তোমার জন্যে ছিঁড়ে ফেলতে হয়, তা হলে তোমার জন্মসুত্রের স্নেহ ভালবাসাই বা তুমি ছিঁড়ে ফেলবে না কেন।
খুব তো মনে মনে ভেবে দেখেছে, মা তো এত ভাল, প্রীতিকে এত ভালবাসেন, কিন্তু ওর যে একটা আলাদা পছন্দ থাকতে পারে, রুচি থাকতে পারে, সে কথা মনে রাখেন না কেন? যেন মা যা চায়, যা ভাল মনে করে, সেটাই ঠিক। বাড়ির বউ হয়ে এসেছ, তোমার সমস্ত অস্তিত্ব ড়ুবিয়ে দিতে হবে। কেন? মাকে দোষ দিয়ে কি হবে, ধ্রুব নিজেও তো সেরকমই ভাবে। ঠাণ্ডা মাথায় যখন ভাবে তখন বুঝতে পারে প্রীতির, মানে প্রীতিদের কি অসীম সহ্যশক্তি।
–হোয়াইট ওয়াশের কথাটা কিন্তু বলে আসতে ভুলো না।
প্রীতি মনে পড়িয়ে দিয়েছিল। আর তালাচাবি নিয়ে গিয়ে দরজায় লাগিয়ে দিয়ে আসতে হবে। বাড়িওয়ালাদের কিছু বলা যায় না।
ধ্রুব হেসে বলেছে, না না, সকলে কি একই রকম নাকি? রাখালবাবু দারুণ ভালমানুষ, আমরাই আগে বুঝতে পারিনি।
বুঝতে সত্যিই পারেনি কেউ। কত সাদাসিধে ভাবে থাকতেন ওঁদের সামনের বাড়ির একতলায়। এত বড় একখানা বাড়ি হাঁকিয়ে বসবেন কোনওদিন ভাবেনি কেউ। ধ্রুব অবশ্য বাড়ির কাউকেই বলবে না। ওরা শুনলে অবাক হয়ে যাবে। কিন্তু সম্মানেও লাগবে।
বড় বৌদি হয়ত বলে বসবে, ওই লোকটাকে তোমরা অত হতশ্রদ্ধা করতে, তারই বাড়ির একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে তোমাব লজ্জা করল না।
ঘরগুলো চুনকাম করিয়ে দেওয়ার কথা বলার জন্যেই খুব গেল একদিন। এমন কিছু রাত হয়নি তখন।
গোঁপওয়ালা পালোয়ান টাইপের দারোয়ানকে বললে, বাবুকে একবার খবর দাও, দেখা করব।
দারোয়ান বললে, সকালে আসবেন।
ধ্রুব বললে, তুমি গিয়ে খবরই দাও না। বল, ধ্রুববাবু এসেছেন। বলবে, ধ্রুববাবু। যিনি ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন।
দারোয়ান অখুশি মুখ করে বললে, ঠহরিয়ে।
একটু পরেই ওপর থেকে নেমে এসে বললে, বাবু শুয়ে পড়েছেন।
ধ্রুবর বিশ্বাস হল না। এত তাড়াতাড়ি কেউ শুয়ে পড়তে পারে না। তা হলে কি ইচ্ছে করেই দেখা করলেন না রাখালবাবু? এতখানি হেঁটে এসেছে ও, আবার ফিরে যেতে হবে। আবার আসতে হবে কাল। অথচ দুমিনিটের তো কথা।
ধ্রুবর রীতিমতো অপমান লাগল। প্রীতি ঠিকই বলেছে। বাড়িওয়ালা হলেই বোধহয় এইরকম হয়ে যায়। ভাড়াটের সুখসুবিধে, সম্মান-অসম্মান যেন কিছুই নয়।
রাগ চেপে ধ্রুব বললে, কাল আর আসতে পারব না হয়ত, তুমি বলে দিও ঘরগুলো চুনকাম করিয়ে দিতে। আসলে দারোয়ানের কাছে আত্মসম্মান রাখার জন্যেই বলতে হল, কাল আসতে পারব না।
দারোয়ান ঘাড় নেড়ে বললে, আচ্ছা বাবুজি।
ধ্রুব মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চলে আসছিল। দারোয়ান হাসল।রাতমে বাবুর সঙ্গে মোলাকাত হয় না বাবুজি। ওর হাসিটা কেমন রহস্যজনক।
—কেন? ধ্রুব প্রশ্ন করল।
দারোয়ান হাসতে হাসতে হাতটা মুখের কাছে তুলে গ্লাসে চুমুক দেওয়ার ভঙ্গি করলে।
তাই বুঝি!
রাখালবাবু তা হলে টাকাই করেননি, এই গুণটাও হয়েছে। না কি আগে থেকেই ছিল, ওরা জানত না।
এতক্ষণ ওর অপমান লাগছিল, মুহূর্তে তা ধুয়েমুছে গেল। কিন্তু প্রীতি আবার এ কথা শুনলে বেঁকে বসবে না তো? হয়তো বলে বসবে, একটা মাতালের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুলছ!
না, প্রীতিকে বলার দরকার নেই।
আসলে রাখালবাবু লোকটাই একটা রহস্য। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধ্রুব কবে এতটুকু উপকার করেছিল, তার জন্যে আজও কৃতজ্ঞ। কোনও কোম্পানি, কত মাইনে কিছুই জিগ্যেস করেনি। অথচ হাতকাটা দালালটা কত ভয় দেখিয়েছিল। জিগ্যেস তো করেইনি, উপরন্তু পঞ্চাশটা টাকা ফিরিয়ে দিল। প্রথমে হয়ত লোভে পড়ে সব টাকাটাই পকেটে ঢুকিয়েছিল, পরে কিছু মনে হতে ফেরত দিয়েছে।
কিসের ব্যবসা ভদ্রলোকের ধ্রুব জানে না। যখন ওদের বাড়ির সামনের একতলায় থাকত, তখন কোনও কোনওদিন দেখত, অনেক রাতে, রাত এগারোটা কি বারোটা, অন্ধকারে একটা ঠ্যালা গাড়ি এসে দাঁড়াত। বিরাট বড় বড় পিপের মতো ড্রাম, তিনটে কি চারটে–কুলিদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে রাখালবাবু সেগুলো বাড়ির ভিতর ঢোকাতেন।
আবার আরেকদিন একটা ঠ্যালা গাড়ি আসত, ড্রামগুলো নিয়ে চলে যেত। সেও ওই মধ্যরাত্রে।
ওরা নিজেরা বলাবলি করত। ড্রাম তোলা নামানোর শব্দে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যেত ওদের। বারান্দায় গিয়ে কোনও কোনওদিন দাঁড়িয়ে দেখত। কিন্তু ওই ড্রামগুলোর ভিতরে কি আছে কেউ জানত না।
ধ্রুব আজও জানে না।
ওসব জানার ওর প্রয়োজনও নেই। এখন একটাই কাজ, ইলেকট্রিকের মিটার নিজের নামে করাতে হবে। বাড়ি বদলাতে গেলে কত রকম ঝামেলা। আরেকটা কাজ লরি জোগাড় করা। দিনে দিনে তো কম আসবাবপত্র জমা হয়নি। খাট, আলমারি, আয়না, বুককেস, আরো হাজার রকম টুকিটাকি। জমতে জমতে এমন অবস্থা, ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই। তা হোক, ওখানে গিয়ে আর এত অসুবিধে হবে না, তিন তিনখানা ঘর, দিব্যি ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাজিয়ে রাখা যাবে।
তবে সময় থাকতে থাকতে লরির ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। কোথায় পাওয়া যায় কে জানে। অফিসে কাউকে জিগ্যেস করে দেখবে। কিন্তু লরির চেয়ে বেশি চিন্তা কুলিদের নিয়ে। ট্রেড কুলি না হলে হয়ত কাচফাচ ভেঙে কেলেঙ্কারি করে বসবে।
প্রীতি একসময় বললে, এই বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, সেই হাতকাটা দালালটা টাকার তাগাদায় এসেছিল।
–ও হ্যাঁ, ওকে তো আবার এক মাসের ভাড়া দিতে হবে।
প্রীতি হেসে বললে, না, বাড়িওয়ালা কমিয়ে দিয়েছে বলেও ছাড়বে না, বলেছে পুরো সাড়ে চারশোই দিতে হবে।
কথাটা শুনে ধ্রুব একটু ক্ষুণ্ণ হটল, তবুবললে, তাই দেব।
আসলে লোকটা তো আমাদের উপকারই করেছে, ও না থাকলে তো যোগাযোগ হত। এর আগে তো এক জায়গায় মোটামুটি পছন্দও হয়েছিল, কিন্তু বাড়িওয়ালার কত রকম ফিরিস্তি। চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েও এত কথা বলতে হয়নি। সে জায়গায় এখানে তো কিছুই বলতে হল না। সেজন্য ও লোকটার কাছে কৃতজ্ঞ।
কিন্তু, যে লোকটা এমন একটা উপকার করল, প্রথম থেকে আজ এখন অবধি সে একজন হাতকাটা দালাল হয়েই রয়েছে। পঞ্চাশটা টাকা বেশি দিতে হবে বলে মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিল তোকটা কি লোভী। আশ্চর্য, ওর তো একটা নাম আছে, কোনওদিন জিগ্যেস করতেও ইচ্ছে হয়নি। একজন দুঃখী লোক, নামমাত্র উপার্জন, কোনও দুর্ঘটনায় হয়ত হাতটা কাটা গেছে, তার পরিচয় হয়ে গেল হাতকাটা দালাল। নামটা জেনে নিলে নাম ধরেই তো ওরা কথা বলতে পারত। ধ্রুবর মনে হল, আমরা কি স্বার্থপর, বোধহয় প্রথম থেকেই ভেবে নিয়েছি ফ্ল্যাট পেলেই ওর দালালির টাকাটা দিয়ে বিদেয় করে দেব, তার আবার নাম জানার কি দরকার। কিংবা নোকটা হয়ত নাম বলেও ছিল মনে রাখা প্রয়োজন মনে করেনি। পঞ্চাশটা টাকা তাকে বেশি দিতে হচ্ছে বলে এখন গায়ে লাগছে!
-তোকে একটা কথা বলছিলাম…
মা এসে চুপ করে দাঁড়ালেন।
আসলে মার তো খুবই খারাপ লাগছে। হয়ত আবার বলে বসবেন থেকে গেলেই ভাল করতিস; অথবা ওই রকম কিছু, এই আশঙ্কায় ধ্রুব একটু কঠিন স্বরে বললে, কি বলছ বল না।
মা ধীরে ধীরে বললেন, তোরা তো এ সব কিছু মানিস না, তবু আমার কথা ভেবে, বলছিলাম কি, যাবার আগে তোদের ফ্ল্যাটে যদি সত্যিনারাণ দিস।
একটু থেমে বললেন, ছোটবৌমা তো ওসব জানে না, আমি বলছিলাম, যদি আমি গিয়ে ওখানে ওসব দেবার ব্যবস্থাটা করে দিই….
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি একটু মনে শান্তি পেতাম আর কি।
ধ্রুব একবার প্রীতির মুখের দিকে তাকাল। ও চাইছিল প্রীতি খুশি হয়ে মাকে বলুক, হ্যাঁ, মা, আপনি গিয়ে দেখেশুনে দেবেন, পুজোআচার আমি তো কিছুই জানি না…
কিন্তু না, প্রীতি যেন কি একটা কাজে বড় ব্যস্ত, শুনতেই পায়নি।
তাই ধ্রুব বললে, হ্যাঁ তা তত দিতে হবেই, তুমি যদি পারো মা, খুব ভাল হয়।
মা হাসলেন।—পারব না কি রে। যেন খুব খুশি হয়েছেন ধ্রুব ওঁর কথায় সায় দিয়েছে বলে। বললেন, আমি মরতে মরতেও তোদের জন্যে সব পারব।
মা হাসতে হাসতেই বললেন, কিন্তু চলে যাবার সময়, ধ্রুবর মনে হল, মা যেন চোখে আঁচল ঘষলেন।
ওর মনের ভিতরটায় একটা বিষাদের ছায়া পড়ল। এ বড় যন্ত্রণা। কষ্টও হয়, অথচ যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে, ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ও এবং প্রীতি যেভাবে বাঁচতে চায়, এখানে সেভাবে বাঁচা যাবে না। সমস্ত বন্ধনগুলো একে একে ছিঁড়ে গেছে। যেন অনেকদিন ধরে হাতকড়া পরানো ছিল, হাতকড়া খুলে ফেলে মনে হচ্ছে আমি মুক্ত, আমি আর বন্দি নই, কিন্তু হাতের কজিতে এখনও যেন হাতকড়ার স্পর্শটা লেগে রয়েছে। মনেই হচ্ছে না ওটা খুলে ফেলেছে।
বুকের মধ্যে একটা তোলপাড় চলছে, কাউকে না বলেও যেন শাস্তি নেই। অথচ এ-সব কথা প্রীতিকে বলা যাবে না। ও শুনলে উপহাস করবে, কিংবা কথায় বিছুটি মাখিয়ে বলবে, তা হলে বৌদিদের আঁচল জড়িয়েই থাকো, এতই যখন ছেড়ে যেতে কষ্ট।
অফিসে গিয়ে অবিনাশকেই বললে। ওর সঙ্গেই তো অন্তরঙ্গতা। জীবনের অনেক কথাই ওকে বলতে পেরেছে। কিন্তু ঘরোয়া টানাপোড়েনের খবর একটুও জানতে দেয়নি। বলতে লজ্জা। সঙ্কোচ। যেন বললেই অবিনাশের চোখে ও ছোট হয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল। বড় অশান্তির মধ্যে দিন কাটছে ভাই। জয়েন্ট ফ্যামিলির মতো খারাপ জিনিস আর নেই।
অবিনাশ হো হো করে হেসে উঠল। তোমাদের আবার জয়েন্ট ফ্যামিলি কোথায় হে। বাবা মাকে নিয়ে তিন ভাইয়ের সংসার, একে কি জয়েন্ট ফ্যামিলি বলে।
হাসতে হাসতে বললে, যেতে আমাদের হুগলির গ্রামের বাড়িতে, এখন নয়, বছর দশেক আগে, দেখতে কাকে যৌথপরিবার বলে।
একটু থেমে বললে, রান্নাঘর মানে টাটা কোম্পানির ফার্নেস, দাউ দাউ জ্বলছে সব সময়।
অবাক হয়ে গেল ধ্রুব। আগে কখনো শোনেনি ওর কাছে। হেসে ফেলে বললে, তাই নাকি?
অবিনাশ বললে, একটা বড় বারান্দায় লাইন দিয়ে দুপাশে বাইশজন খেতে বসতে পারে। সব মেঝেতে, আসন নয় হে, গোটা কয়েক কম্বল আধ ভাঁজ করে।
–বাইশজন আর এমন কি! ধ্রুব এবার আর অবাক হল না।
অবিনাশ হাসল।—শুনবে তো সবটা।
একটা কাঁসর বাজানো হত খাবার সময় হলে। গ্রামে যে যেখানে আছে। পরিবারের লোক, শুনেই চলে আসবে। তার আবার ফাস্ট বেল, সেকেন্ড বেল, থার্ড বেল।
এবার সত্যিই অবাক হতে হল ধ্রুবকে।
অবিনাশ বললে, ফাস্ট বেল বাচ্চাদের জন্যে, বিলো ফোটিন, ছেলেমেয়েদের সব। সেকেণ্ড বেল পুরুষদের, ফর অ্যাডাল্ট মেল মেম্বার্স। থার্ড বেল মেয়েদের, সে প্রায় বেলা তিনটেয়।
বলে হো হো করে হাসল।—পুজোর সময় সে এক এলাহি কাণ্ড, যে যেখানে আছে সব আসত, ছেলে মেয়ে জামাই নাই। এখনও আছে? ধ্রুব জিগ্যেস করল।
অবিনাশ হেসে বললে, দশ বছর আগেও ছিল। প্রথম পৃথক হলেন জ্যাঠামশাই, তারপর একে একে সকলেই। লাস্ট আমি, কলকাতায় সংসার নিয়ে চলে এলাম। বাবা মা সেই গ্রামেই, মাঝে মাঝে আসেন। ও সব আর চলে না হে, চলে না। নিকুচি করো তোমার ওই জয়েন্ট ফ্যামিলির। মার সারাটা জীবন তো কেটেছে ওই রান্নাঘরে, বউটাকে হাড় জিলজিলে করে দিয়েছিল, পালিয়ে এসে বেঁচেছি। বউয়ের কোনও সাধআহ্লাদ থাকবে না, ভালবাসা মানে রাতে একসঙ্গে শোয়া। ধুত্তোর।
ধ্রুবর সঙ্কোচ কেটে গেল। যতখানি না বললে নয় সেটুকুই বলল। তারপর জানাল, ফ্ল্যাট পেয়েছে। কিন্তু বড় কষ্ট।
অবিনাশ গম্ভীর হয়ে বললে, হবেই তো। বলে কেমন আনমনা হয়ে গেল, যেন কিছু মনে পড়ে গেছে। যেন ওর চোখের সামনে কিছু ভেসে উঠছে, কোনও স্মৃতি। মুখের ওপর কি ওটা বেদনার ছাপ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে অবিনাশ। ধীরে ধীরে বললে, জন্মের পর যখন নাড়ি কাটে তখন শিশু কিছু টের পায় কিনা কে জানে। কিন্তু এতকাল এক সংসারে কাটিয়ে আবার নাড়ি কাটা, কষ্ট হবে না? কিন্তু উপায় নেই ধ্রুব, সব মেনে নিতে হয়। একদিকে অনেক কিছু ছাড়তে হয়, আবার অনেক কিছু পাওয়াও তো যায়। নিজের মতো করে বাঁচতে কে
চায় বল।
একটু থেমে বললে, ভালই করেছ। সাহস করে চলে যাও, দিব্যি ভাল থাকবে। দেখবে দূরে থাকলেই আরো আপন মনে হবে।
অবিনাশের কাছে সমর্থন পেয়ে ধ্রুবর মনের অপরাধবোধ অনেকখানি সরে গেল। যেন নিজেই নিজেকে বোঝাতে চাইছে এ-ভাবে বললে, ভেবে কি হবে বল, এটাই এ যুগের নিয়ম।
অবিনাশ সায় দিয়ে বললে, হিউম্যান নেচার। সব ব্যাপারে জ্যাঠামশাইয়ের কাছে। হাতজোড় করে দাঁড়ানো, সে যে কি দিন ছেলেবেলায় দেখেছি। স্বাধীনতার চেয়ে দামি জিনিস আর কিছু নেই, বুঝলে ধ্রুব। বাবা-মাও তার কাছে তুচ্ছ।
অবিনাশই লরির ব্যবস্থা করে দিল।
চুনকাম হয়ে যেতেই মা গিয়ে সত্যনারায়ণ পুজো দিয়ে এলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল ধ্রুব আর প্রীতি।
পুরুতঠাকুর দেখে বললেন, বাঃ এ তো চমৎকার ফ্ল্যাট।
মা বললেন, হ্যাঁ, ভালই।
পুজোর বাসনকোসন কোশাকুশি সব মা নিয়ে গিয়েছিলেন। পিতলের গামলায় খুব যত্ন করে সিন্নি বানালেন।
প্রীতি বেশ খুশি। ও মাকে সাহায্য করছিল, হেসে হেসে গল্প করছিল। দেখে ভাল লাগছিল ধ্রুবর। কিন্তু বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধছিল একটাই কথা। কি অকৃতজ্ঞ, কি অকৃতজ্ঞ।
রাখালবাবু লোকটার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই। বরং তাচ্ছিল্যই করত তাকে। তবু, কবে সামান্য একটা উপকার করেছে ধ্রুব, বিরক্তির সঙ্গে, চাপা রাগের সঙ্গে তুচ্ছ একটা উপকার করতে বাধ্য হয়েছিল, অথচ রাখালবাবু কৃতজ্ঞতা দেখালেন, একটাও প্রশ্ন না করে ওকেই ফ্ল্যাট ভাড়া দিলেন, উপরন্তু পঞ্চাশ টাকা ফেরতও দিলেন। তোমার পাশের ফ্ল্যাটও চারশোই দেয়।
আর ধ্রুব দিব্যি সব ভুলে যেতে পারল। এমন কি আর অসুবিধে কিংবা অশান্তি। ও চলে আসার পর বাবা-মা যা কষ্ট পাবেন, যে অশান্তিতে ভুগবেন তার তুলনায় কতটুকু। তবু সব ভূলে যেতে পারল ধ্রুব।
বেশ কয়েকবছর আগের একটা দৃশ্য মনে পড়তেই নিজেকে ভীষণ ছোট লাগে। অনুশোচনা হয়।
মা এসে ধ্রুবকে বললেন, তোর বাবা ডাকছে! আয়।
এর আগেও একবার ডেকে গিয়েছিলেন। ধ্রুব তেমন গা করেনি। আজকাল বাবার ডাক মানেই তো ফালতু আজেবাজে কথা। বড় বেশি কথা বলেন আজকাল, এমন সব কথা যার সম্পর্কে ধ্রুবর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
দ্বিতীয়বার মা ডাক দিয়ে যেতেই বড়বৌদি এসে বললে, কি ব্যাপার বলো তো? তিন ভাইকেই একসঙ্গে ডাকছেন?
ধ্রুব ঠোট ওল্টাল। অর্থাৎ কি জানি। কিন্তু ওদের তিন ভাইকেই একসঙ্গে ডেকেছেন জেনে একটু কৌতূহলও হল।
গিয়ে দেখল একটা মোড়ায় বসেছেন, বাবা সেই হাতলওয়ালা আরামকেদারায়। দাদা আর মেজদা দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে, দুপ্রান্তে।
ঘরগুলো, বারান্দা চুনকাম হয়নি বহুদিন। এখানে ওখানে দাগ লেগে বেশ নোংরা হয়েছে, তাই এখন দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় সবাই। বাড়িওয়ালা তো আজকাল হোয়াইট ওয়াশ করিয়ে দেয় না, তাই নিজেদের খরচেই করা হয়েছিল। প্রথম প্রথম তখন কত সাবধানতা, ঠিকে ঝি এসে দেয়ালে ঠেস দিলে সকলেই ধমক দিত। এখন নিজেরাই ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। আসলে নোংরা দেখলেই মানুষ নোংরা করতে চায়।
ধ্রুব কি করবে, সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইল।
বাবা তাঁর তিন ছেলের মুখের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিয়ে মার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
বললেন, আমার বয়েস হয়েছে। কদিন আছি না আছি কেউ বলতে পারে না। তোর মা বলছে বেঁচে থাকতে কিছু একটা ব্যবস্থা করে যেতে। পরে যাতে লাঠালাঠি না হয়।
বলে হাসলেন। বললেন, তোরা লাঠালাঠি করবি না তা জানি, তবু আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে।
মা বলে উঠলেন, শোন তোরা, ওসব কথা নয়, তোর বাবা যদি আমাকে ফেলে পালায়, আমি বাপু ওসব টাকাপয়সা সইসাবুদ ওসব পারব না। তাই বলছি…
কথাটা বাবাই শেষ করলেন। বললেন, আমার পেনশন আছে, তার চেয়েও বড় কথা তোরা তিন ভাই আছিস। আমাদের আর ভাবনা কীসের।
একটু থেমে বললেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডে কিছু বেশি বেশি জমিয়েছিলাম। সুদে বেড়ে এখন প্রায় এক লাখ কুড়ি। তা এখনই তোদের তিনজনের নামে চল্লিশ হাজার করে ইউনিট কিনে দিতে চাই।
বাবা স্বেচ্ছায় কাণ্ডটা করছেন বলে ধ্রুবর অবশ্য মনে হল না। মার প্ররোচনা। মা সই করতে খুব ভয় পান, যে কোনও ফর্মেই হোক বা রেজিস্ট্রি চিঠির জন্যেই হোক। সব সময় বাবাকে জিগ্যেস করেন সই করবেন কিনা।
ধ্রুবর শুনে ভালই লেগেছিল, কিন্তু দাদা বোধহয় পিতৃভক্ত ভাল ছেলে সাজবার জন্যে ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ করলে, এখনই ওসব নাই বা করলেন। সে পরের কথা পরে।
মা বললেন, হ্যাঁরে শেষদিন কি কারো নোটিস দিয়ে আসে? যা কিছু আছে তা তো তোদের জন্যেই। আমাদের জন্যে তো তোরাই আছিস।
আমাদের জন্যে তো তোরাই আছিস। মনে পড়লেও এখন খারাপ লাগে। সেই চল্লিশ হাজার টাকা এখন প্রায় পঞ্চাশ হাজারে দাঁড়িয়েছে। কিংবা আরো বেশি।
ও বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় এসব কথা মনেই পড়েনি। তখন শুধু সর্বাঙ্গে রাগ। এখন নিজেকে ছোট লাগে, অনুশোচনা হয়।
এখন সমস্ত ব্যাপারটা ঠাট্টার মতো মনে হচ্ছে। মার অভিযোগ অনুযোগ কোনও কিছুতেই কান দেয়নি। একটা নেশা তখন ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, নতুন ফ্ল্যাট, আলাদা ফ্ল্যাট। অথচ মা বুকের মধ্যে সব কষ্ট, সব অশান্তি চেপে রেখে এই ফ্ল্যাটে এসেছেন সত্যনারায়ণ দিতে। ধ্রুব আর প্রীতি যাতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারে।
—তোদের মঙ্গল, অমঙ্গল, টিপুর মঙ্গল অমঙ্গল, তোমরা যতই দূরে সরে যাও ছোটবৌমা, আমি তো নিভাবনা হতে পারব না।
মা এমনভাবে কথাগুলো বলছিলেন যেন ভিক্ষে চাইছেন। জানেন, ধ্রুব আর প্রীতি ওসবে বিশ্বাস করে না, হয়তো মনে মনে অসন্তুষ্ট হচ্ছে এই ভেবে বলেছিলেন, শুধু একটা দিনের তো ঝামেলা, কয়েক ঘণ্টা, তোরা যাবার আগে অন্তত আমাকে পুজোটা দিতে দিস।
বাইরে একটা ফুর্তির ভাব রেখেছিল ধ্রুব। কিন্তু ভিতরে ভিতরে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। ও মার মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে পারছিল না।
বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারেনি।
চলে আসার সময় কেবলই মনে হচ্ছিল যেন পালিয়ে যাচ্ছে।
লরি এলো নির্দিষ্ট দিনে। বাবা পাঁজি দেখে বলেছিলেন একটা পর্যন্ত বারবেলা। কুলিদের বসিয়ে রেখেছিল কিছুক্ষণ। হাতের ঘড়িতে একটা বাজতেই তাদের মাল তুলতে বললে। তারা ঝটপট খাটটা খুলে ফেলল। আলমারি বুক কেস বসার চেয়ার সব একে একে লরিতে তুলতে শুরু করল।
সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। কেউ কোনও কথা বলছে না। যেন কারো মৃতদেহ পড়ে আছে। উঠোনে, সবাই শোকে নিঃশব্দ।
ধ্রুবও মাথা তুলে কারো দিকে তাকাতে পারছে না। যেন সকলের কাছে ও ছোট হয়ে গেছে। অথচ তখন ভেবেছিল যুদ্ধজয়।
হেমন্তবাবুর কথা মনে পড়ে গেল। সামনের সেই ভাঙা পোড়ো বাড়িটা আঁকড়ে ধরে পড়েছিলেন, ভিতরে ভিতরে যে নিঃস্ব হয়ে গেছেন কেউ জানতে পারেনি। গোপনে গোপনে বাড়িটা বেচে দিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়েছিলেন। সেও কি এই রকমই কোনও লজ্জা!
—লোকটা কি বোকা, এত লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ি বিক্রি না করে যদি সকলকে জানিয়ে করত, হয়তো অনেক বেশি দাম পেত। ধ্রুব বলেছিল।
ও জানত না, দাম বেশি পাওয়ার চেয়েও দামি জিনিস কিছু আছে। আত্মসম্মান। পাড়ার এই এতগুলি লোকের সামনে ছোট হয়ে যেতে চাননি।
ধ্রুবর মনে হল হেমন্তবাবুর মতোই ও পালিয়েই যাচ্ছে।
যাবার আগে কি বাবাকে একটা প্রণাম করবে, বলবে, আমি যাচ্ছি!
সেটা যে কত কঠিন কাজ, ধ্রুব ভাবতে পারেনি।
প্রীতির ভাই গিয়ে লরিতে বসল। বললে, তোমরা কিছু ভেবো না, আমি সব গোছগাছ করে দেব। তোমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসো।
ধ্রুব গিয়ে বাবাকে প্রণাম করল। প্রীতিও।
বাবা মাথা তুললেন না। নিজের পায়ের দিকেই যেন তাকিয়ে আছেন।
আমরা চলে যাচ্ছি এ কথাটাও বলতে পারল না ধ্রুব। বলার তো কিছু নেই, নিজেই পাঁজি দেখে দিন বলে দিয়েছিলেন, মা সত্যনারায়ণ দিতে গিয়েছিলেন, তাও জানেন, লরিতে মালপত্র খোলা হচ্ছে দেখেছেন, অথবা শুনেছেন সিমলির কাছে।
ধ্রুব আর বাবার সামনে দাঁড়াতে পারছিল না, চলে আসছিল। বাবা ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন, ছোটবৌমা। টিপুকে একবার দেবে, কোলে নেব।
ধ্রুবর বুকের মধ্যে একটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা হল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল ও।
টিপু তো সারাক্ষণ বাবার কাছে কাছেই থাকত। বাবার যত কথা ওর সঙ্গে। যত হাসি।
তা নিয়ে বড়বৌদি মেজবৌদি একটু টীকাটিপ্পনী করতেও ছাড়ত না।
মেজবৌদি বলেছিল, কই আমাদের ছেলেমেয়েদের তো কোনওদিন এত আদর করতে দেখিনি।
ওসব ঈর্ষার কথা। ধ্রুবর সব মনে আছে, ওরাই ভুলে গেছে।
প্রীতি টিপুকে নিয়ে গিয়ে বাবার কোলে দিল।
উনি টিপুকে একেবারে বুকের ওপর চেপে ধরলেন, যেন একেবারে হৃৎপিণ্ডের ওপর। ধ্রুবর ভয় হল, টিপুর ব্যথা লাগবে। একটা বাচ্চা ছেলেকে এমন করে কেউ চেপে ধরে নাকি।
ওর গালে থুতনি ঘষলেন। গালে গাল ঠেকালেন। তারপর টিপুকে ফিরিয়ে দিলেন প্রীতির কোলে। এমনভাবে হাত দুখানা বাড়িয়ে ওকে ছেড়ে দিলেন, যেন চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছে।
আর তখনই প্রীতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর দুচোখে জল।
ধ্রুব আর দাঁড়াতে পারছিল না। মাকে প্রণাম করেই তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এল।
বড়বৌদি, মেজবৌদি, সিমলি সবাই তখন নীচে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
বড়বৌদি ধীরে ধীরে বললে, একেবারে পর করে দিও না ঠাকুরপো।
মেজবৌদি কান্না কান্না মুখে এগিয়ে এসে ধ্রুবর হাত ধরল।কাছেই তো রইলে ধ্রুবদা, এসো মাঝে মাঝে।
এতদিন ধ্রুবর মনে হয়েছে, সকলেই যেন শুধু বাঁধন ছিড়তে চাইছে। এখন মনে হচ্ছে, সবাই যেন বাঁধতে চাইছে। আর ও সেই বাঁধন ছিঁড়ে কিছুতেই বেরোতে পারছে না।
ধ্রুব বললে, প্রীতিকে দাঁড়াতে বলল। আমি ট্যাক্সি ডাকতে যাচ্ছি।
আশ্চর্য, ট্যাক্সিও যেন ওর সঙ্গে শত্রুতা করছে। একটুও সময় দিতে চায় না। বাড়ি থেকে বের হতে না হতেই কাছেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল। সে যেতে রাজিও হল।
নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠতেই মুহূর্তে সব যেন ধুয়েমুছে গেল। আসবাবপত্র ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওরা তিনজনই। ধ্রুব, প্রীতি, প্রীতির ভাই পুলক।
ডবল বেড খাটখানা খুলে আনা হয়েছে, ওটা প্রীতির বাবা মেয়ের বিয়েতে দিয়েছিলেন। ডবল বেডের চেয়েও একটু বেশি চওড়া। ভবিষ্যতে টিপু আসবে ভেবে নিয়েই অডার দিয়ে বেশি চওড়া করিয়ে নিয়েছিলেন প্রীতির মা। ওঁর দূরদৃষ্টি আছে।
ওরা তিনজনে মিলে সেই খাটটা লাগাল শোবার ঘরের জানালা ঘেঁষে। তারপরও অনেকখানি জায়গা। খাটে গদি খোলা হল ধস্তাধস্তি করে। তোষক বালিশ।
একটা বসার ঘরও হয়ে গেল। সেটায় আপাতত বুককে, আলমারি। তৃতীয় ঘবখানাতেও সামান্য কিছু আসবাব।
ওখানে এই কখানা জিনিসেই ঘরটা ছিল একেবারে ঠাসা। পা ফেলার জায়গা নেই, যে আসত সেই বলত। ওদের নিজেদেরও শুনতে খারাপ লাগত।
এখানে এসে একেবারে উল্টো।
পুলক প্রথম দেখেই বলেছিল, কত স্পেস রে প্রীতি। এত জায়গা নিয়ে কি করবি? দুখানা ঘর হলেই তোদের চলে যেত।
প্রীতির দাদাও একটু সাবধানী প্রকৃতির মানুষ। সাড়ে চারশো টাকা ভাড়ার কথা শুনে বলেছিল, বাড়ি ভাড়াই দেবে সাড়ে চারশো, তা হলে খাবে কি!
তিন-তিনখানা ঘর বেশ ফাঁকা ফাঁকা রয়েছে দেখে পুলকও বললে, দুখানা ঘর হলেই চলে যেত।
ওদের তো সরকারি ফ্ল্যাট, ভাল জায়গায়, ভাড়াও নামমাত্র। তাই জানে না, এ বাজারে অডার মতো ফ্ল্যাট পাওয়া যায় না। চারশো টাকাই মনে হচ্ছে দিব্যি সস্তা। দু মাস ধরে ফ্ল্যাট খুঁজে খুঁজে তো হন্যে হয়ে গিয়েছিল ধ্রুব।
জিনিসপত্র সব কিছুটা গুছিয়ে রেখে প্রীতি মেঝের ওপরেই হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল, কিছুটা ক্লান্তিতে।
তারপর ফুর্তিতে বলে উঠল, আঃ, এতদিনে স্বাধীন হলাম।
ধ্রুবর নিজেরও সেরকমই মনে হচ্ছিল, কিন্তু প্রীতির মুখে শুনতে ভাল লাগল না। বিশেষ করে পুলকের সামনে। এ কবছর আগের বাড়িতে প্রীতি কি খাঁচায় পোরা বন্দি হয়ে ছিল! সেখানেও তো স্বাধীনই ছিল, শুধু মনে হয়নি স্বাধীন।
ধ্রুব আর পুলকও টিপুকে নিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।
ধ্রুবর মনে ফ্ল্যাট সম্পর্কে তখনও একটু অসন্তোষ লেগে আছে।
আক্ষেপের সঙ্গে বললে, ব্যাটা দালালটা এত তাড়াহুড়ো করল, আর আমরাও দুজনই এসে দেখলাম, বাড়িটার যে দক্ষিণ একেবারে চাপা, খেয়ালই হয়নি।
পুলক বলল, একেবারে হাওয়া পাবে না।
প্রীতি ওই দক্ষিণের ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চাইছিল। একটা পৃথক ফ্ল্যাটে উঠে আসতে পেরেছে, তাতেই সারা শরীরে ওর খুশি উপছে পড়ছে।
বললে, কলকাতায় কখানা ফ্ল্যাটে হাওয়া বাতাস খেলে? দক্ষিণ খোলা হবে, বে অফ বেঙ্গলের হাওয়া খাব, ওসব ভাবতে গেলে খাবার বেলাতেও হাওয়াই জুটবে।
ওরা দুজনই হেসে উঠল।
আর তখনই প্রীতি বলে বসল। এবার বাবা হাউসকোট পরব, আর কাউকে কেয়ার করি না।
ধ্রুব আর পুলক আবার হেসে উঠল।
আসলে কার যে কোথায় লাগে, সামান্য একটা ইচ্ছে না মেটাতে পারলে মানুষ যে কত দুঃখী হয়, বন্দি ভাবে নিজেকে, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। ধ্রুব জানে, প্রীতির ট্রাকের মধ্যে দু-দুখানা হাউসকোট একেবারে নতুন হয়েই পড়ে আছে। ও বাড়িতে হাউসকোট পরার সাহসই হয়নি প্রীতির। একদিন ধ্রুবকে জিগ্যেস করেছিল। নিজের ঘরের মধ্যে পরলে কার কি বলার আছে!
ধ্রুব নিষেধ করেছিল। বাবা-মা কি মনে করবে। কিংবা ওঁরা কিছু না মনে করলেও বড়বৌদি তো ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে ছাড়বে না। উপরন্তু বাবা-মার বিরুদ্ধেও বিষােদগার করবে। এখন ছোটবৌমা যাই করুক, কোনও আপত্তি নেই, অথচ আমার বেলায় পান থেকে চুন খসলেই…।
প্রীতি বুঝি একদিন মেজবৌদিকে চুপিচুপি বলেছিল হাউসকোট পরার কথা।
মেজবৌদি উৎসাহ দেখিয়েছিল।—পর না, কে কি বলবে ভাবছিস কেন। তারপর হেসে বলেছিল, তুই চালু করে দিলে আমিও পরব।
কিন্তু ধ্রুব নিষেধ করেছিল বলে প্রীতি আর ওপথে যায়নি।
আশ্চর্য। এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে বাবা-মাকে অসন্তুষ্ট করতে, আঘাত দিতে চায়নি। ধ্রুব। প্রীতিও চেষ্টা করেছে মেনে চলতে। অথচ শেষ পর্যন্ত একটা বড় আঘাত দিতে বাধল না। নিশ্চিন্তে ছেড়ে চলে এল। এর চেয়ে ছোটখাটো বাধানিষেধগুলো তুচ্ছ করতে পারলে হয়তো বড় আঘাতটা দিতে হত না। অন্তত এত তাড়াতাড়ি দিতে হত না।
একটা কেরোসিন স্টোভ কিনে রেখেছে প্রীতি, কেরোসিনও জমা করে রেখেছিল কিছু। বাসনকোসনও মোটামুটি চলে যাবার মত।
কিন্তু রান্নার পাট নেই এখন। প্রীতিদের বাড়িতে রাত্তিরে খাওয়ার কথা। ওরাও খুব একটা দূরে থাকে না। রাত্তিরে খেয়ে ফিরে আসবে, নাকি ওখানেই রাতটা কাটাবে, এখনও ঠিক করেনি।
প্রীতি বললে, গ্যাসের জন্যে নাম লেখাতে হবে। কবে পাব কে জানে!
ধ্রুব হতাশ সুরে বললে, কোনটা যে আগে করি, কোনটা পরে। এত কাজ…
প্রীতি হাসল। বললে, বসার ঘরের জন্যে শোফাকৌচ…
ধ্রুব বললে, আপাতত তিনটে বেতের চেয়ার হলেই হবে।
প্রীতির মনঃপূত হল না।–তুমি কি বারবার বদলাবে নাকি? কতগুলো টাকা জলে দিয়ে লাভ কি!
ধ্রুব চুপ করে রইল। কোনটাকে যে জলে দেওয়া বলে ও বুঝতেই পারছে না।
কিন্তু দিনে দিনে বাড়িটার শ্রী ফিরে আসছিল। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে নিচ্ছিল প্রীতি, বাড়িটা, অর্থাৎ এই তিনখানা ঘরের ফ্ল্যাট। এখন তো এটাই বাড়ি।
প্রীতির বাবা-মা দুদিন এলেন, অনেকক্ষণ থাকলেন, গল্পগুজব করলেন, টিপুকে আদর। দেখে মনে হচ্ছিল ওঁরাও খুব খুশি।
প্রীতির বাবা হাসতে হাসতে মেয়েকে বললেন, ইচ্ছে হলেই এবার থেকে তোর এখানে চলে আসব।
একটু থেমে বললেন, যাই বলিস, তোদের আগের বাড়িতে যেতে কেমন সঙ্কোচ হত। ওঁরা খুবই ভালমানুষ, আমি গেলে খুব খুশি হতেন, আদর আপ্যায়ন করতেন, কিন্তু তবু…
ধ্রুবর নিজেরও সেকথাই মনে হল। আগের বাড়িতে প্রীতির বাবা মা, কিংবা দাদা দিদি কেউ বেড়াতে গেলে, মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে, ধ্রুবর ভাল লাগত। কিন্তু কেমন আড়ষ্ট লাগত। এখানে এদের যতখানি আপন মনে হচ্ছে, আপন করে নিতে পারছে, আগের বাড়িতে তা সম্ভব ছিল না। সব সময়েই কেমন একটা সঙ্কোচ। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা ভয়। প্রীতির তো আরো বেশি। যেন সব কটা চোখ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে, সব কটা কান সজাগ।
এখানে এখন সত্যি একটা মুক্তির হাওয়া।
প্রীতির মা নানা রকম উপদেশ দিচ্ছিলেন প্রীতিকে। ভাঁড়ারের জিনিসপত্র। কোথায় কীভাবে রাখবে, একটা মটসেফ আনিয়ে নে, আরো কত কি।
বাড়িওয়ালা রাখালবাবুও খোঁজখবর নিতেন। সকালে মর্নিং ওয়াক করতে বেরোতেন। বেরোবার সময় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করতেন, ধ্রুব, কিছু অসুবিধে হচ্ছে না তো? কিছু দরকার হলে বলল। একসঙ্গে আছি আমরা, বুঝলে কিনা…।
হরিশ মুখার্জি রোডে থাকার সময় রাখালবাবু লুঙি পরে ফতুয়া গায়ে বাজারে যেতেন। হাতে থলি নিয়ে। এখন আর ওসব করেন না। চাকরবাকরদের হাতে বাজার তুলে দিয়েছেন। কিন্তু সকালে বাইরে একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরতে যেতেন বাজার করার নাম করে। এখন বাজার করা সাজে না, তাই মর্নিং ওয়াকে বের হন।
—তোমার তো গ্যাস স্টোভ নাই। একদিন হঠাৎ বললেন, রিনা বলছিল। আমার একটা চেনা লোক আছে, করিয়ে দোবো, বুঝলে কিনা।
প্রীতি শুনে বললে, যাই বলো, সব বাড়িওয়ালা একরকম নয়। রাখালবাবু লোকটি কিন্তু সত্যি খুব ভাল লোক।
রাখালবাবুর সংসার নিতান্ত ছোট নয়। দুই ছেলে, এক মেয়ে রিনা। ছোট ছোট তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে হরিশ মুখার্জি রোডের একতলার ঘরে কি করে থাকতেন কে জানে। আসলে ব্যবসার ব্যাপারটাই হয়তো এই রকম। প্রথম দিকে কষ্টেসৃষ্টে থেকে টাকা জমাতে হয়। তখন সবাই ভাবে লোকটা দুঃস্থ। তারপর হঠাৎ একদিন মুখখাশ খুলে ফেলতেই সকলে অবাক হয়ে যায়।
কিন্তু তার জন্যে রাখালবাবু মানুষটা বদলে যাননি। কোনও গর্ব নেই, ভাড়াটে বলে তাচ্ছিল্য করেন না। বরং ধ্রুবকে যেন একটু সমীহই করেন।
ধ্রুবর শুধু একটাই অনুশোচনা হয়। না জেনে মানুষটিকে দুঃখ দিয়ে ফেলেছে।
প্রতিকে একদিন বলেছিল, ভদ্রলোক এত খোঁজখবর নেন, গ্যাসের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন, একদিন ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসো।
প্রীতি হেসে বললে, যাব। তবে গ্যাসের জন্যে ওঁর চিন্তাই বেশি, কেন জানো? তা না হলে বাড়ি নষ্ট হবে যে। কয়লা কিংবা কেরোসিনে শেষে এত যত্নের বাড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে কে চায় বলো।
এদিকটা ধ্রুব একবারও ভাবেনি। বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হল না।
সেদিনই রাস্তায় রাখালবাবুর সঙ্গে দেখা। উনি মর্নিং ওয়াক করে ফিরছেন। ওঁকে খুশি করার জন্যেই বললে, আপনার স্ত্রীকে তো একদিনও দেখলাম না, প্রীতি আজ যাবে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে।
রাখালবাবু কথাটা শুনেই ধ্রুবর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ ড়ুকরে কেঁদে উঠলেন।
ধ্রুবর হাতটা ধরলেন, থরথর করে যেন কাঁপছেন, বললেন, সে তত নেই ধ্রুব। আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তিন-তিনটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে…
গলা কাঁপছিল ওঁর। ছলছল চোখে বললেন, কি আর বলব তোমাকে, তিনটে মাসও পার হল না, শুধু বাড়িই করলাম আমি, সে ভোগ করতে পেল না ধ্রুব। বুঝলে কিনা, এ বাড়িতে আসার তিন মাসের মধ্যে…
ধ্রুব সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। অনুশোচনায় মনটাও খারাপ হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে প্রীতিকে সেকথা বলতেই ও বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল। হেসে বললে, দূর, তুমি কি শুনতে কি শুনেছ।
ধ্রুব বললে, ভুল শুনব কেন, বললাম, তুমি ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। স্পষ্ট বললেন, গৃহপ্রবেশের তিন মাসের মধ্যেই মারা যান।
প্রীতি অবাক হয়ে বললে, কিন্তু ওঁর ছেলেমেয়েরা, রিনি বিন্টু ওরা তো এসেছিল, কত গল্প হল। কিছু তো বলেনি। বরং মা মা বলে কি যেন বলছিল।
তারপর বললে, ওরা ভীষণ ভাল, জানো।
এটুকুই পরম তৃপ্তি। এতকাল আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কাছে বাড়িওয়ালাদের সম্পর্কে কত কি শুনে এসেছে। খারাপ, খারাপ, বাড়িওয়ালা মানেই খারাপ লোক।
অফিসে অবিনাশকে আগেই বলেছিল একদিন, শুনে এমন অবাক হয়ে গিয়েছিল যে প্রত্যেককে ডেকে ডেকে বলেছে, শুনুন শুনুন, বাড়িওয়ালা ভালও হয়। ধ্রুবর বাড়িওয়ালা ওর মুখ দেখে এমন গলে গেছে যে পঞ্চাশটা টাকা ভাড়া কমিয়ে দিয়েছে।
অবিনাশকেই এসে বললে। রাখালবাবু মানুষটা একেবারে ভালমানুষ। স্ত্রীকে বোধহয় খুবই ভালবাসতেন। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন, বেচারি বউটা নতুন বাড়িটা ভোগ করতে পেল না বলে দুঃখ করছিলেন।
অবিনাশ বললে, তুমি খুব লাকি ধ্রুব। এ বাজারে এমন ভাল বাড়িওয়ালা পাওয়া পরম সৌভাগ্য। তুমি বরং একটা কাজ করো, একটা লটারির টিকিট কেটে ফেল, সময়টা তোমার খুবই ভাল যাচ্ছে।
ধ্রুব হাসল। কিন্তু সত্যিই মনের মধ্যে একটা পরম তৃপ্তি। বাড়িওয়ালাকে নিয়ে কত লোকের কত ঝামেলা। নিত্যই তো শুনছে। ছোটমাসিদের তো মামলা চলছে। অফিসের বীরেশ্বরও সেদিন বলছিল, হাইকোর্টে ঝুলছে, নিত্যদিন উকিলের বাড়ি। তা ছাড়া ওর আবার একটু ভয়ও আছে, রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়ার টাকা জমা দেওয়া নিয়ে কি যেন ভুলভ্রান্তি…
ধ্রুবকে অন্তত সে-সব কথা ভাবতে হবে না। তেমন অবস্থা হলে ও নিজেই ছেড়ে দেবে।
ভালমানুষ! কিন্তু একটা লোক, একজন মানুষকে কি বিচার করে ভাল বা মন্দ বলা যায়!
গলির মোড়ের বাড়ি থেকে যে ভদ্রলোক সেদিন বের হলেন, এখন নাম জেনে গেছে, অনাদিবাবু…মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হত, হাসতেন, কখনও মুখ ফুটে ভাল? ধ্রুবও সংক্ষেপে সারত!
কথায় কথায় একদিন জিগ্যেস করলেন, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো!
তারপরই অনাদিবাবু বলে বসলেন, লোক সুবিধের নয় মশাই, আপনার ওই বাড়িওয়ালা।
ধ্রুব আশ্চর্য হয়ে বললে, না না, উনি খুব ভাল, আমাদের সঙ্গে তো রীতিমত ভাল ব্যবহার করেন।
অনাদিবাবু হেসে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, জানবেন সব। বাইরে খুব মিষ্টি মিষ্টি ব্যবহার, কথাবার্তা…
কথা শেষ না করেই ঝট করে ছাতাটা খুলে মাথায় দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন।
অনাদিবাবু লোকটিকেই খারাপ মনে হয়েছিল ধ্রুবর। হয়তো কোনও কারণে রাখালবাবুকে পছন্দ করেন না। কিংবা স্রেফ ঈর্ষা। রাখালবাবুর এই বিশাল তিনতলা বাড়ি, দোতলায় আর গ্রাউন্ড ফ্লোরে চারখানা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছেন, দুখানা গাড়ি, বিরাট ব্যবসা। ঈর্ষা হবারই তো কথা।
কিন্তু তার জন্যই কি যেচে আলাপ করে তাঁর সম্পর্কে সাবধান করলেন অনাদিবাবু? নাকি ভালমানুষ বা খারাপ মানুষ বলে কেউ নেই। প্রত্যেকটি মানুষ তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়ে বিচার করে। যে একজনের কাছে ভাল, অন্যজনের কাছে সেই খারাপ।
অবিনাশকে ধ্রুব পছন্দ করে, এত আপন মনে হয়, ধ্রুবর তো ধারণা ও খুবই ভালমানুষ, অথচ অফিসের অনেকেই অবিনাশকে পছন্দ করে না। টীকাটিপ্পনীও করে।
কিন্তু রাখলবাবু যে এভাবে ওকে অবাক করে দেবেন ধ্রুব ভাবতেও পারেনি।
বাড়ি ফিরেই দেখলে একেবারে শোবার ঘরে প্রীতি মেয়েদের সভা বসিয়েছে। হো হো হাসির শব্দ আগেই শুনতে পেয়েছিল। যেন অনেকগুলি মেয়ে একসঙ্গে কথা বলছে। আর এলোপাথারি একটা হাসির ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
দরজা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল। আভাসে বুঝতে পারল তিন তিনটি ফ্ল্যাটের মেয়েরা। কিন্তু এত হাসি হল্লা কেন বুঝতে পারেনি।
বসার ঘরের জন্যে এখনও কিছু কেনা হয়ে ওঠেনি। তাই সকলেই শশাবার ঘরে। নতুন সংসার পাততে গেলে যে একসঙ্গে এত জিনিস কিনতে হয়, ধ্রুবর ধারণাই ছিল না।
শুধু পাখা আর বালব কিনতে গিয়েই হেসে বলেছিল, ফতুর হয়ে গেলাম।
প্রীতি হেসে বলেছিল, এর মধ্যেই? এখনও তো সবই বাকি।
তারপর চোখ বুজে গলার স্বরটা কিস্তৃত করে মৃদু মৃদু হেসে বলেছিল, একসঙ্গে আড্ডা দেব, একসঙ্গে ঘুরব, একসঙ্গে বাড়ি ফিরব…একই বাড়িতে…
ধ্রুব ওর ভাবভঙ্গি দেখে হেসে ফেলেছিল।
প্রীতি ধ্রুবর কথাগুলোই আউড়ে যাচ্ছিল। বিয়ের আগের কথাগুলো।
তখন ওরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল, প্রীতি ঝট করে উঠে পড়ে বলেছিল, সর্বনাশ, নটা বেজে গেছে। পৌঁছতে পৌঁছতে…।
ধু তখনই বলেছিল প্রীতিকে।–দুজনে একসঙ্গে আড্ডা দেব, একসঙ্গে ঘুরব, একসঙ্গে বাড়ি ফিরব, একই বাড়িতে, এমন হলে, কি ভাল যে হত।
শুনে প্রীতি বুঝতে পারেনি, বিস্ময়ের গলায় বলেছিল, যাঃ, তা কি করে সম্ভব?
ধ্রুব হেসে বলেছিল, কেন, বিয়ে করে।
মুহূর্তের জন্যে লজ্জা পেয়েছিল প্রীতি। মাথা নীচু করেছিল, সারা পথ ধ্রুবর মুখের দিকে তাকাতে পারেনি। কিংবা ধীর পায়ে ধ্রুবর পাশে পাশে হেঁটে বাসস্টপ অবধি আসার সময় ওর বুকের মধ্যে কিছু গুনগুন করে উঠেছিল।
পাশের ঘরে একা বসে ছিল ধ্রুব। ও এসেছে দেখেই বোধহয় মেয়েদের হাসিহল্লা থেমে গেল। একে একে সকলে চলে গেল।
আর প্রীতি হাসতে হাসতে এসে বললে, আজ যা একটা খবর দেব-না, দাঁড়াও…
বলে ওষুধের তাক থেকে স্মেলিং সল্টটা নিয়ে এসে বললে, নাও, হাতে রাখো, কি জানি যদি ফেন্ট হয়ে যাও খবর শুনে…
খুব সপ্রশ্ন চোখে তাকাল।
প্রীতি বললে, তোমার ওই রাখালবাবু, তুমি বলছিলে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন স্ত্রীর কথা বলতে বলতে…
ধ্রুব বললে, কী হয়েছে?
প্রীতি হেসে লুটোপুটি।–দ্বিতীয় পক্ষকে আজ নিয়ে এলেন, নতুন বৌকে দেখলাম আজ…
ধ্রুব বিশ্বাস করতে পারছিল না।
প্রীতি বললে, আমি একা নই, সব ফ্ল্যাটের সবাই দেখেছে।
তারপর হাসতে হাসতে বললে, দুমাস আগেই নাকি রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছিল। কী অসুবিধে ছিল বলে এতকাল আনতে পারেনি।
তারপরই সেই ব্রহ্মাস্ত্র।—অবাক হবার তো কিছু নেই। তোমরা ছেলেরা স্যার, সবাই এক।
ধ্রুব কোনও উত্তর দিল না, প্রতিবাদ করল না। শুধু মনে হল, সত্যিই অবাক হবার কিছু নেই। প্রত্যেকটি মানুষই এই রকম কিনা কে জানে। তার একটা দিক যখন বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে, হয়তো অন্যদিকটা তখন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরতে চায়। সেটাই স্বাভাবিক। নাকি, কান্নাটা রাখালবাবুর অভিনয়?