০৩. ধূর্জটিকে বাড়িটা চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে

ধূর্জটিকে বাড়িটা চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে আসতে বলা হয়েছে বার বার। সুতরাং, যেকোনো সময় আবার আসার একটা নৈতিক অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। ধূর্জটি একটা কলেজে পড়ায়—ওদের তো অফিসের নির্দিষ্ট সময় নেই, যখন-তখন ছুটি। ইচ্ছে করলে একদিন ক্লাসে নাও যেতে পারে। দুপুরে আসবার ওর অনেক সুযোগ।

কিন্তু আসবে কি? যদি আসেও, শুধু গল্প করবে? প্রথম দিন নিশ্চয়ই তাই। যদি পর পর কয়েকদিন আসে? সুপ্রিয়া এখনও ঠিক আগেকার মতনই সুন্দরী—ধূর্জটির কি ইচ্ছে করবে না তাকে একটু ছুঁতে। কবিরা কী খুব একটা শারীরিক ব্যাপারে আগ্রহী? চাঁদ, ফুল, পাখির মতন তারা তো শুধু নারীর রূপ দেখেই মুগ্ধ। তারা কি নারীকে শয্যাসঙ্গিনীও করতে চায়? তাহলে অবশ্য সুপ্রিয়া একটু মুশকিলে পড়বে। রাঁধুনি আছে, চাকর আছে, কোন ছুতোয় তাদের সরাবে? চাকরটা দুপুরের দিকে নিশ্চয়ই কোথাও আড্ডা মারতে যায়। রাঁধুনিকেও বাইরে পাঠাতে হলে অনেক বুদ্ধি খাটাতে হবে। অবশ্য সুপ্রিয়ার শারীরিক অতৃপ্তি নেই বলেই তো মনে হয়। স্বামীর কাছ থেকে সে সবই পায়, শুধু শুধু সে ঝুঁকি নিতে যাবে কেন? তবে যদি ধূর্জটি করুণভাবে আবেদন জানায় কিংবা জোর করে…

ধূর্জটি করুণ আবেদন জানাবে, না জোর করবে—সেটা জানার জন্য দীপংকর কৌতূহলে একেবারে ছটফট করতে লাগল। অথচ তার জানার কোনো উপায় নেই। সে তত আর কোনোদিনই স্ত্রীর ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য অসময়ে বাড়ি ফিরে আসবে না। তা সে কিছুতেই পারবে না। তার রুচিতে বাধে।

ধূর্জটি যদি আসে, তাহলে সুপ্রিয়া কি সে-কথা গোপন করে যাবে দীপংকরের কাছে? সুপ্রিয়া তো আজ পর্যন্ত কোনো কথাই লুকোয়নি। সুপ্রিয়া ধূর্জটিকে খুব বেশি প্রশ্রয় দেবে বলে মনে হয় না। তবু, ধরা যাক, ধূর্জটি যদি বাড়াবাড়ি করে? তাহলে কি সুপ্রিয়া তার স্বামীর সাহায্য চাইবে? কোনো মেয়ে কি স্বামীর কাছে প্রেমিকের নামে নালিশ জানায়? সেটা তো প্রেমের অপমান!

সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েও দীপংকর ওপরের দিকে একবার তাকাল। আজ যেন সে তার ফ্ল্যাটের দরজাটা নতুন করে দেখছে।

দুপুর বেলা সিঁড়িতে একটাও লোক থাকে না।

অফিসে দীপংকরের আলাদা ঘর। শুধু তার স্টেনো বসে সেখানে। মেয়েটি বাঙালি ক্রিশ্চান। নাম শুনে অবশ্য কিছুই বোঝবার উপায় নেই, সরলা বিশ্বাস। অফিসে সবাই জানে যে মিসেস বিশ্বাস বিবাহিতা, একমাত্র দীপংকরকেই মিসেস বিশ্বাস বলেছে যে, তার স্বামী আলাদা একটি মেয়েকে নিয়ে থাকে—ওদের সেপারেশন হয়ে গেছে।

এয়ার কণ্ডিশনিং-এর জন্য ঘরের দরজা সবসময় বন্ধ থাকে। সরলা নিবিষ্টমনে নিজের কাজ করে যায়। কাজ না থাকলে গল্পের বই পড়ে, কথাবার্তা বিশেষ বলে। নিজে থেকে সে কোনো দিনই দীপংকরের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তবে মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতী। সাধারণ একজন স্টেনোর তুলনায় সে অনেকরকম বইপত্র পড়েছে, অনেক খবর রাখে। দীপংকরের বেশ ভালোই লাগে সরলাকে। আহা, মেয়েটি সাংসারিক জীবনে সুখ পেল না।

সুপ্রিয়া কয়েকবার এসেছে স্বামীর অফিসে। মিসেস বিশ্বাসের সঙ্গে তার আলাপ আছে। প্রথম প্রথম সুপ্রিয়া ঠাট্টা করেছে দীপংকরকে, দেখো, সরলা বিশ্বাসের সঙ্গে যেন প্রেম-ট্রেম করে ফেলো না!

সুপ্রিয়া জানে, তার স্বামী কোনোদিনই এ-রকম কিছু করতে পারবে না। দীপংকর অতিমাত্রায় ভদ্রলোক। অবৈধ কোনো কিছু করার মতন ব্যাপার তার চরিত্রেই নেই! তা ছাড়া, সরলা বিশ্বাসকে দেখতেও এমন কিছু সুবিধের নয়—সুপ্রিয়ার সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না। ধূর্জটির চেহারাও তো দীপংকরের তুলনায় বেশ খারাপ।

নিজের স্টেনোগ্রাফারের সঙ্গে প্রেম করাটা অরুচিকর ব্যাপার হলেও অপরের স্টেনোর সঙ্গে প্রেম করায় বোধ হয় কোনো দোষ নেই। অফিসের সকলেই যখন জেনে গেল যে দীপংকর বন্দ্যোপাধ্যায় কখনো সরলা বিশ্বাসের সঙ্গে হালকা সুরে কথা বলে না, তখন অন্য দু-একজন সরলা বিশ্বাস সম্পর্কে উৎসাহী হল।

দীপংকরেরই সমবয়েসি অফিসার দিলীপ বসু প্রায়ই দীপংকরের ঘরে আসে। কখনো কাজের উপলক্ষ্যে, কখনো গল্প করার জন্য। দীপংকর বুঝতে পারে, দিলীপ ইদানীং একটু ঘন ঘন আসছে, সরলার দিকে চোরাচোখে তাকায়। সরলার সঙ্গে এমন সুরে কথা বলে, যাতে সন্দেহ হয় যে দিলীপ বোধ হয় সরলার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে। সম্ভবত ওর বাড়িতেও যায়। সাধারণ বাঙালির ধারণা আছে যে, অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান বা ক্রিশ্চান মেয়েদের নৈতিক মান বলে কিছু নেই।

দীপংকর কিছুই লক্ষ না করার ভান করে। কোনোদিন সে দিলীপকে সামান্যতমও নিরস্ত করার চেষ্টা করেনি। শুধু একটা ব্যাপারে খটকা লাগে। দিলীপের স্ত্রী বেশ সুন্দরী এবং সপ্রতিভ, অথচ তার কাছেও দিলীপ নিশ্চয়ই সব কিছু পায় না। নইলে তার এ-রকম চুকচুঁকে ভাব কেন? এর আগেও দিলীপ কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করেছে।

দিলীপের ভালোবাসার জন্য কোনো অতৃপ্তি নেই। সে চায় একাধিক নারীসঙ্গ। এটাকে লালসাই বলা উচিত। এ জিনিসটাও ভালো কী খারাপ, তা দীপংকর জানে না। অনেকরকম মূল্যবোধই তো আজকাল বদলে যাচ্ছে। কাজের ব্যাপারে দিলীপের বেশ সুনাম, অফিসে সে একটি রত্ন–বিশেষ, সেইজন্যই নারীঘটিত দুর্বলতার ব্যাপারটা নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না।

কিন্তু যেহেতু দিলীপ দীপংকরের ঘরে এসেই সরলার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করে তাই দীপংকরকে মাথা ঘামাতেই হয়। দিলীপ আবার যেন বেশি বাড়াবাড়ি কিছু করে না ফেলে। এইসব কথা যদি কোনোক্রমে দিলীপের স্ত্রীর কানে যায়, তাহলে সে কত দুঃখ পাবে! তা ছাড়া অফিসের মধ্যে কোনো কিছু ঘটে যাওয়া খুবই অরুচিকর ব্যাপার, সেইজন্যই দিলীপ যখন আসে তখন দীপংকর ঘর ছেড়ে পারতপক্ষে যায় না। আজকাল দিলীপ যেন তাকে সূক্ষ্মভাবে একটু অবজ্ঞা করতে শুরু করেছে। তার ভাবখানা যেন এই, দীপংকর নিজের ঘরের মধ্যে সর্বক্ষণের জন্য সরলাকে পেয়েও কবজা করতে পারল না। কিন্তু দিলীপ বাইরে থেকে এসে কীরকম কায়দা করে নিল।

অর্থাৎ দীপংকর যেন একটা অপদার্থ। সামান্য একটা মেয়েকে দখল করার ক্ষমতাই তার নেই। তার যে ওই ইচ্ছেটাই নেই, সেটা কি কেউ বুঝবে না।

ছাত্ৰবয়েসে দীপংকর পড়াশুনো নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে, মেয়েদের সঙ্গে তেমনভাবে মেশার সুযোগই হয়নি। তার জীবনে সুপ্রিয়াই প্রথম নারী। বিয়ের আগে কিছুদিন আলাপ পরিচয় হয়েছিল সুপ্রিয়ার সঙ্গে। তাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না। তারপর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব আসে। এবং মন্ত্র পড়ে কিছু লোককে নেমন্তন্ন খাওয়াবার পরেই সুপ্রিয়া তার শয্যাসঙ্গিনী হয়ে যায়।

দীপংকরের কোনো অতৃপ্তি নেই। বরং সে প্রায়ই ভাবে, স্বামী হিসেবে সুপ্রিয়াকে তার আরও কিছু দেওয়া উচিত। সুপ্রিয়ার পূর্বপ্রণয়ীকে ফিরিয়ে দেওয়াই কি একটা উপহার নয়! তা ছাড়া, তার আর একটা কথাও মনে পড়ে, সে যেন একটু অন্যায়ভাবেই ধূর্জটির কাছ থেকে সুপ্রিয়াকে জিতে নিয়েছে। তার ভালো চাকরি আর সামাজিক মর্যাদা দিয়ে সে ধূর্জটির ভালোবাসাকে খর্ব করে দিয়েছে। সেইজন্যই ধূর্জটিকে এখন সুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা করার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। ধূর্জটি আর সুপ্রিয়া কি সীমা লঙ্ঘন করবে?

দীপংকর বাল্যকালে কারুকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসার কথা ভেবে তার এখন একটু মন কেমন করে। যেন তার বাল্যকালটা ব্যর্থ গেছে। তা বলে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দিলীপের মতন যেকোনো মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সে করতে পারবে না কখনো। সরলা বিশ্বাসকে দেখে মনে হয়, ওকে নার্স হিসেবে বেশ মানাত, অসুখের সময় এইসব মেয়ের হাতের সেবা নেওয়া যায়। কিন্তু এদের কাছে মনের কথা বলা যায় না।

মি. ব্যানার্জি, এই ড্রাফটটা ঠিক আছে?

দীপংকর মন দিয়ে একটা ফাইল পড়ছিল, চোখ তুলে তাকাল। সরলা আজ একটা নীল রঙের শাড়ি পরে এসেছে। সাধারণত সাদা শাড়িই সে পছন্দ করে।

পদাধিকারবলে দীপংকর সরলার ওপরওয়ালা। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপরেই সরলার চাকরি নির্ভর করছে। সাধারণত নীচের কর্মচারীরা ওপরের অফিসারদের স্যার বলে। দীপংকর সেরকম সম্পর্ক রাখতে চায়নি। সরলার মুখে প্রথম কয়েক দিন স্যার সম্বােধন শুনেই তার খুব খারাপ লেগেছে। তখনই সে বলে দিয়েছিল, আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন। সরলা অবশ্য দীপংকরবাবু বলে না, অফিস-টফিসে সেরকম নিয়মই নেই, মি. ব্যানার্জি বলে। দীপংকরও প্রথম কিছুদিন ওকে মিসেস বিশ্বাস বলে ডাকা শুরু করেছিল, এখন সরাসরি সরলাই বলে।

সরলার হাত দু-টি নিরাভরণ। ক্রিশ্চান মেয়েরা কি গয়না পরে? সরলা যে বিবাহিতা তা বোঝার কোনোই উপায় নেই। এমনকী বিয়ের আংটিটাও খুলে ফেলেছে।

সরলা, তুমি যে ছুটি নেবে বলছিলে… বাইরে কোথাও যাবে নাকি?

না, এখন আর ছুটি নেব না, কাজের খুব চাপ।

দীপংকর ব্যস্ত হয়ে বলল, না, না, তোমার ছুটি নেওয়ায় আমি আপত্তি করছি না, কাজ যা আছে আমি কয়েকদিন ঠিকই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব—আমি এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম, তুমি কোথাও বাইরে বেড়াতে যাবে কিনা—তুমি তো এ বছরে একদিনও ছুটি নাওনি।

সরলা বলল, পাটনায় আমার দিদি থাকেন, ভেবেছিলাম, সেখানে যাব—কিন্তু এখন আর যাব না, দিদিই এখানে আসছেন…

সরলার স্বামীর কথা দীপংকর নিজে থেকে জিজ্ঞেস করতে পারে না। সরলাই একদিন বলেছিল। অন্য একটা কোম্পানি থেকে একটা সুন্দর ডাইরি দিয়ে গিয়েছিল দীপংকরকে। দীপংকর এ-রকম ডাইরি একাধিক পায়। সেদিন সে ডাইরিটা সরলাকে দিয়ে বলেছিল, এটা তুমি তোমার স্বামীর জন্য নিয়ে যাও!

সরলা বলেছিল, আপনি বোধ হয় জানেন না, আমার স্বামী আমার সঙ্গে আর থাকেন না।

দীপংকর অবাক হয়ে তাকিয়েছিল শুধু। মুখে কিছু বলেনি। সরলাই বলেছিল, উনি পার্ক সার্কাসে আর একটি মেয়ের সঙ্গে থাকেন, প্রায় এক বছর হয়ে গেল।

কথাগুলো বলার সময় সরলা কোনো দ্বিধা করেনি। সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতন তার গলার আওয়াজে রাগ কিংবা দুঃখ দুঃখ ভাব নেই। সে যেন ব্যাপারটা সহজভাবেই মেনে নিয়েছে।

কিন্তু দীপংকর মেনে নিতে পারে না। নানান টুকরো-টাকরা কথায় দীপংকর আরও কয়েকটা তথ্য জেনে নিয়েছে। সরলা বিয়ে করেছিল একজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানকে। তবে সাধারণ ইঞ্জিন ড্রাইভার কিংবা ডকের খালাসি নয়। রীতিমতন শিক্ষিত, একটি কমার্স কলেজে পড়ায়। সরলা লোকটিকে নিজে পছন্দ করেই বিয়ে করেছিল। সেই লোকটি, বিয়ের মাত্র দু বছর বাদে, নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে আর একটি মেয়েকে নিয়ে প্রকাশ্যে বসবাস করছে। একই শহরে। হয়তো যাওয়া-আসার রাস্তায় সরলার সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়। তখন কীরকম মনের অবস্থা হয় সরলার? তার ভালোবাসার এই পরিণতি?

নিশ্চয়ই সাংঘাতিক দুঃখ পেয়েছে সরলা, কিন্তু মুখে তা কক্ষনো প্রকাশ করে না। দীপংকরও চিন্তা করে সরলার জন্য, কিন্তু সে-কথা বলে না সরলাকে।

দরজাটা একটু ফাঁক করে দিলীপ বলল, কী খবর, বস?

দিলীপ যদিও কথাটা বলল দীপংকরকে উদ্দেশ্য করে, কিন্তু তাকিয়ে আছে সরলার দিকে। কী লোভীর মতন দৃষ্টি! যেন চোখ দিয়ে চেটে নিচ্ছে মেয়েটির শরীর। দীপংকর বেশ বিরক্ত হল।

একসময় দিলীপ তার বেশ বন্ধুই ছিল। দিলীপের অনেক গুণ আছে। কিন্তু সরলার প্রতি তার ব্যবহারটা বড্ড চোখে লাগে। একটি মেয়ে, স্বামী পরিত্যক্তা, দুঃখের প্রতি কোনো সহানুভূতি না জানিয়ে শুধু তার শরীরের প্রতি লোভ করতে হবে? সরলা একা থাকে বলেই যেন দিলীপ ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। সরলার প্রয়োজন এখন ভালোবাসার। কিন্তু দিলীপ তো ভালোবাসতে জানে না, সে শুধু শরীর চেনে।

দিলীপ ঘরে ঢুকে দীপংকরের টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিয়ে ধরালো। তারপর অনাবশ্যক অফিসের কাজের কথা তুলল। এসব কথা দু-দিন বাদে বললেও কোনো ক্ষতি ছিল না। দীপংকর শুধু হুঁ-হাঁ করে গেল।

দিলীপ এবার সরলার দিকে ফিরে বলল, মিসেস বিশ্বাস, আমার কাছে একটা ফ্রেঞ্চ চিঠি এসেছে, আপনি একটু সেটা পড়ে মানে বলে দেবেন তো?

দীপংকর একটু অবাক হল। সরলা ফ্রেঞ্চ জানে? তাকে তো বলেনি!

সরলা বলল, কাল নিয়ে আসবেন।

সরলা জিনিসপত্র গুছোচ্ছে। সে এখন বাড়ি যাবে। দীপংকর মাঝে মাঝেই লক্ষ করছে। সরলাকে। সে তো দিলীপ সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। মেয়েদের মুখ দেখলে ঠিকই বোঝা যায়। হয়তো সরলা ভদ্রতা করে দিলীপকে সহ্য করে মাত্র। তার বেশি কিছু না। কারুকে ভালোবেসে বিয়ে করতে না-পারার যে দুঃখ, তার চেয়েও ভালোবেসে এবং বিয়ে করে তারপর ব্যর্থ হওয়ার দুঃখ অনেক অনেক বেশি। সরলার সেই দুঃখটা বোঝার মতো মন দিলীপের নেই।

দীপংকরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সরলা বেরিয়ে গেল। দিলীপও তখন চঞ্চল হয়ে কাজের কথা থামিয়ে বলল চলি।

দিলীপ নিশ্চয়ই এখন সরলার পেছন পেছন যাবে। ওর গাড়িতে লিফট দিতে যাবে। ওর বাড়িতে গিয়ে জুলুম করবে!

দীপংকর এবার ইচ্ছে করেই কতকগুলি অনাবশ্যক অফিসের কথা শুরু করল। এবার দিলীপটা বুঝুক মজা!

বাড়ি ফিরে দীপংকর কৌতূহলী হয়ে থাকে। ধূর্জটি কি এসেছিল? কোনো চিহ্ন আছে? অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই? বুলান যদি কথায় কথায় বলে দেয়, আজ একজন কাকু এসেছিল তাও সে বলে না। কোথাও কোনো চিহ্ন না-পেয়ে দীপংকর রীতিমতন নিরাশ হয়। কেন এল না ছেলেটা? এত করে বলা হল।

অবশ্য ঠিক পরের দিনই যে আসবে, তার কোনো মানে নেই। একটু চক্ষুলজ্জা হতে পারে। একদিন দু-দিন সময় নিলে তারপর আর বলার কিছু থাকে না।

এমনও হতে পারে, আরও দু-একবার ঠিক দুপুরে না এসে, সন্ধ্যে বেলাতেই আসবে। যেন দীপংকরের সঙ্গেই দেখা করা উদ্দেশ্য। তারপর আস্তে আস্তে জড়তা কেটে গেলে দুপুরে চলে আসবে।

ধূর্জটি তো দীপংকরকে ঠিক ভালোরকম চেনে না। তাই বোধ হয় বুঝে নিতে চাইছে। কিন্তু দীপংকর তো বুঝিয়েই দিয়েছে যে, ধূর্জটি যেকোনো সময় আসুক, সুপ্রিয়ার সঙ্গে গল্প করুক, তার কোনো আপত্তি নেই।

সুপ্রিয়াকে এ প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না। সেটা যেন একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। অন্যান্য কথাবার্তা বলার সময় হঠাৎ হঠাৎ সে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সুপ্রিয়ার মুখে কি একটু উদবেগের ভাব?

দিন পাঁচ-ছয়ের মধ্যেও ধূর্জটির কোনো পাত্তা না পেয়ে দীপংকর রীতিমতন ব্যস্ত হয়ে উঠল। এ কীরকম ব্যবহার ছেলেটার! সে যদি সুপ্রিয়াকে একেবারে ভুলে গিয়ে থাকে, সেটা সুপ্রিয়ার অপমান। সুপ্রিয়ার মতন সুন্দরী আর চমৎকার মেয়েকে একবার ভালোবেসে কেউ ভুলে যেতে পারে? কক্ষনো না। ধূর্জটি সুপ্রিয়াকে কিছুতেই ভোলেনি। এখনও বুকের মধ্যে ব্যথা পুষে রেখেছে। সেদিন কি ধূর্জটিকে যথেষ্ট ভালোভাবে আসতে বলা হয়নি? আর একবার দেখা হলে দীপংকর ওকে বেশি খাতির করবে।

ধূর্জটি কাজ করে একটা কলেজে। দীপংকর সেই কলেজের নাম জানে। সেখানে গিয়ে ধূর্জটিকে অনায়াসেই খুঁজে বার করা যায়। কিন্তু দীপংকরের সেখানে যাওয়াটা কি ভালো দেখাবে? যাঃ, সেটা একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। খোঁজাখুঁজি করে স্ত্রীর প্রেমিকের কর্মক্ষেত্রে গিয়ে তাকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে আসা যায় নাকি? কিন্তু ছেলেটা এল না কেন? ধূর্জটির না-আসার কোনো কারণই সে খুঁজে বার করতে পারে না। তা হলে কী দীপংকরের ব্যবহারে সত্যিই কোনো ত্রুটি থেকে গেছে? কিছুতেই সে মনস্থির করতে পারে না।

রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দীপংকরের। সুপ্রিয়া পাশে নেই। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। সুপ্রিয়া বোধ হয় বাথরুমে গেছে। আবার সে ঘুমিয়ে পড়ল। আবার ঘুম ভাঙল একটু বাদেই। তার খুব পাতলা ঘুম। সুপ্রিয়া এখনও ফেরেনি কেন?

দীপংকর ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর একটুক্ষণ ভাবল। সুপ্রিয়া কোথায় যেতে পারে? ফ্ল্যাটের বাইরে নিশ্চয়ই যাবে না। কোথায় যাবে, রাস্তায়? অসম্ভব! ওসব নভেল নাটকে হয়। তা হলে সুপ্রিয়া নিশ্চয়ই বাথরুমেই গেছে। শরীর-টরীর খারাপ হয়নি তো হঠাৎ? তা হলে সুপ্রিয়া সেকথা দীপংকরকে বলবে না কেন? হঠাৎ কখনো পেট ব্যথা করলে সুপ্রিয়া তো দীপংকরকেই ডেকে তোলে। দীপংকর আরও একটুক্ষণ অপেক্ষা করল। আর একখানা ঘর আছে, সেখানে দীপংকরের বাবা-মা পাটনা থেকে এসে থাকেন মাঝে মাঝে। সুপ্রিয়া সেই ঘরে শুতে গেছে? কেনই-বা যাবে? বিয়ের সাত বছরের মধ্যে সুপ্রিয়া একদিনের জন্যও আলাদা শোয়নি।

তবু দীপংকর উঠে, চুপি চুপি সেই ঘরটা দেখতে গেল। অন্ধকারে ভালো বোঝা যায় না। পাশবালিশটাকেই মানুষ মনে হয়। আসলে কেউ নেই। শূন্য ঘর।

একে একে বাথরুম, বসবার ঘর সব খুঁজে দেখল। কোথাও নেই। তারপর সুপ্রিয়ার গলার আওয়াজ পেয়ে সে চমকে উঠল একেবারে।

বারান্দাটা দেখার কথা তার মনেই আসেনি। সুপ্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। একবার উফ ধরনের একটা আওয়াজ করল।

দীপংকর এসে নিঃশব্দে দাঁড়াল বারান্দার দিকের দরজার পাশে। তার একটু ভয় করতে লাগল। সুপ্রিয়া ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছে? সে কি রাস্তায় দাঁড়ানো কারুর সঙ্গে কথা বলছে? তা যদি হয়, তাহলে দীপংকর মাঝপথে মোটেই গিয়ে বাধা দিতে পারবে না! সেটা দারুণ লজ্জার ব্যাপার। সুপ্রিয়া এরপর আর তার কাছে মুখ দেখাবে কী করে? সুপ্রিয়াকে এ-রকম অপমানজনক অবস্থায় দীপংকর কিছুতেই কোনোদিন ফেলবে না। হাজার হোক, সুপ্রিয়া তার অতি আদরের মেয়ের মা।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরই দীপংকরের ভুল ভাঙল। এ কখনো হতে পারে? সুপ্রিয়ার মতন মেয়ে কখনো রাতদুপুরে রাস্তার কোনো লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারে? ছি, ছি, ছি, এসব কী ভাবছিল সে?

একটু এগিয়ে গিয়ে সে ডাকল সুপ্রিয়া!

সুপ্রিয়া চমকাল না। পেছন ফিরে তাকাল না পর্যন্ত। শুকনো গলায় বলল, কী?

তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ?

এমনিই?

দীপংকর সুপ্রিয়ার পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মাথা-টাথা ধরেছে?

না।

তা হলে রাত্রি বেলা এখানে এ-রকমভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

বললাম তো, এমনিই!

সুপ্রিয়া, তোমার কী হয়েছে? আমাকে বলবে না?

সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়ল সুপ্রিয়া।

দীপংকর ব্যাকুলভাবে বলতে লাগল, কী হয়েছে? এই, কী হয়েছে? আমাকে বলে? দীপংকরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগল, তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না! আর একটুও ভালোবাসো না!

সহাস্য উদারতায় দীপংকর সুপ্রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগল, পাগল! তুমি কী ছেলেমানুষ হয়ে গেলে নাকি? তোমায় আমি ভালো না বেসে পারি? তোমার জন্যই তো আমার সব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *