দোতলার ঘরটার লাগাও বাথরুম ছিল। বাথরুমটার থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকটা ছাদ পাওয়া যায়। সমস্ত ছাদটা বড়ো মন্দ নয়। কিন্তু অন্য ভাড়াটে পরিবারটি ছাদের বেশির ভাগটাই প্রায় নিজেদের জন্য আলাদা করে রেখে দেওয়া দরকার মনে করেছে। কয়েকটা বেশ সুন্দর সবুজ তাণ্ডুলিন টাঙিয়ে চমৎকার একটা পার্টিশন করা হয়েছে। পার্টিশনের ওদিকে থাকে ওরা; এদিকে একটা ডেকচেয়ার, গোটা-দুই বেতের চেয়ার, তেপয়, জলচকি, সেলাইয়ের কল, মনুর পড়াশুনার বই। কোনো তিন বা একটা হারমোনিয়ম বা সেতার নিয়ে সমস্ত সকালবেলাটা গড়িমসি করে কাটিয়ে দিল উৎপলা।
এ-জায়গাটা তার খুব ভালো লাগে।
দুপুরবেলা রোদ খুব চড়চড় করে ওঠে বলে খানিকটা সময় বাধ্য হয়ে তাকে ঘটে। ভেতর থাকতে হয়। কিন্তু সূর্যটা যেই একটু হেলে পড়তে থাকে তার্পুলিনের ছায়ায় ডেকচেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে গিয়ে উৎপলা: গুন গুন করে, অথবা সেলাই; পড়ে নভেল, মনুকে পড়ায়, এস্রাজ বাজায়।
মাল্যবান সন্ধের সময় মাঝেমাঝে ছাদে আসে; একটা চেয়ারে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। মাঝেমাঝে মনুকে ডেকে ইতিহাস ভূগোল পৃথিবীর কথা ধর্মের কথা মনুষ্যত্ব মানুষের জীবনের মানে—প্রথম মানে—মাঝারি মানে—বিশেষ করে অন্তিম অর্থ সম্পর্কে অনেক জিনিস একে একে শেখাতে যায় সে। মেয়েটির সব সময়ই সে-সব ভালো লাগে না—মেয়েটিও ভালা লাগে না মাল্যবানের; কিন্তু অনেক সময়ই মেয়েটি খুব নিরিবিলি শোনে; ভাসা ভরা চোথ তুলে কীভাবে কেউ কি তা বলতে পারে। উৎপলা বলে : মেয়েটা একেবারে বাপের গোঁ পেয়েছে। শুনে ভালো লাগে মনুর। কিন্তু নিজে মাল্যবান মেয়েকে যে মাত্রাতিরক্ত ভালোবাসে তা নয়; স্ত্রীর জন্যও প্রমাণ শ্রদ্ধা ভালোবাসা রয়েছে তার। কিন্তু এদের জন্যই সে প্রাণে বেঁচে ফির সার্থক হয়ে রয়েছে; সে কথা ভাবা হয়তো ভুল। মনটা তার অনেক সময়ই একটা মুনিয়ার বা মেঠো ইঁদুরের মতো আকাশে আকাশে ফসলে ফসলে ভেসে যেতে চায়। বেশিক্ষণ এ-ছাদে বসে না সে; ধুতি চাদর পরে বেরিয়ে যায়—ময়দানে গেলেই ভালো হত; কিন্তু গোলদীঘিতেই যায়; ছড়ি হাতে করে অনেক রাত অব্দি পাক খায় সে—অনেক কথা ভাবে—কেরানীর ডেস্ক ও উৎপলার স্বামীত্ব থেকে নিজেকে ঘুচিয়ে—(কিন্তু কোনোটাই খুব নির্বিশেষে দানা বাঁধা নয়)—সে অনেক রকম আলতো জীবন যাপন করে। তারপর অবসন্ন হয়ে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে, একটা চুরুট জ্বালায়; ক্ষিদে পায়; বাড়িতে ফিরে আসে।
দোতলার বাথরুমে মাল্যবানকে চান করতে দেয় না উৎপলা।
অফিসে যাবার সময় সাত-তাড়াতাড়ি চান করে তুমি জল ময়লা করে ফেল—তুমি বাপু নিচের চৌবাচ্চায়ই নাইবে—
কিন্তু যে-দিন অফিস নেই?
হা, সে-দিনও।
অতএব নিচেই চান করে মাল্যবান। এক-একদিন তবু গামছা কাপড় নিয়ে দোতলার স্নানের ঘরের দিকে যায়।
এক টব আন্দাজ জল ধরে রেখেছি-ও-সব ফুরিয়ে যাবে–
এখনও তো কলে জল আছে। বলে মাল্যবান।
এই তো এখুনি মনু চান করতে যাবে।
আচ্ছা, বেশ, সে তৈরি হয়ে নিক, ওর মধ্যেই আমার হয়ে যাবে।
নিচের চৌবাচ্চার কী হল?
কেন, পাশের ভাড়াটেরাও তো সেখানে চান করে না, দোতলায় তাদের একটা বাথরুম আছে, সেখানেই তো তাদের সকলের কুলিয়ে যায়।
আরে বাবা, ঢেঁকির সঙ্গে তর্ক। তাদের তো পুকুরের মতো বাথরুম। তাদের আর আমাদের।
লোকও তো তাদের অনেক; কিন্তু নিচের চৌবাচ্চায় তবুও তো কেউ চান করতে যায় না।
ওদের বাড়িতে পুরুষ মানুষ আছে যে যাবে? যে-কটি আছে, তাও তো মেয়েদের পাশে-পাশে ফেরে। না হলে মেয়েমানুষের গোসলখানায় কখনো মিনসেরা ঢোকে?
মাল্যবান একটু উইঢুই করে নিচের চৌবাবচ্চায় চলে গেল।
একদিন আবার স্নানের সময় উৎপলাকে বললে, দেখ, নিচের জল বড়ো ঠাণ্ডা।
এত শীতে জল গরম পাবে কোথায় তুমি। বললে উৎপলা, ঠাকুরই তো রয়েছে, তাকে দিয়ে এক কেটলি জল গরম করিয়ে নিতে পার না?
তা পারি বটে, মাল্যবাণ অবসর মতো একটু ভেবে নিয়ে বললে, কিন্তু ও-রকমভাবে গরম জলে চান করলে বড্ড বদ অভ্যেস হয়ে যায়। শরীর ও খারাপ হয়।
কী চাও তাহলে।
তোমাদের টবের জল আমি একটুও ছোঁব না, ট্যাপের নিচে একটু বসব।
দিক কোরো না বাপু, মনু এই চানে যাচ্ছে–
তা আসুক না, আমার সঙ্গেই আসুক।
তোমার সঙ্গে আসবে!
উৎপলার চোখ দুটো পাক খেয়ে ঠিকরে উঠল, বুড়ো বাড়ির দেইজিপনা দেখ। না, না, ও-সব হবে না। নিচে যাও–নিচে যাও তুমি?
এই কথা বলো তুমি?
মাল্যবান একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে নিচে চলে গেল। অফিস যাওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে একটা কথা বলতে গেল না—অফিস থেকে ফিরে এসেও না। কিন্তু দেখা গেল তাতে কারুরই কিছু এসে যায় না। কাজেই বাধ্য হয়ে তাকে আড়ি ভাঙতে হল। আড়ি ভাঙতে গিয়েও দেখে স্ত্রীর মানই বেশি। কাজেই আড় ভাঙবারও প্রয়োজন হয়ে পড়ল।
মাল্যবানের তবুও পথ কাটা হয় না।
ছুটির দিন একদিন বললে, নাঃ, নিচে আমি আর চান করতে পারব না।
উৎপলা সে-কথায় কানও দিতে গেল না।
পঁচিশ দিনের মধ্যে একদিনও যদি জল বদলানো হয় নিচের চৌবাচ্চার। পচা জলে চান করে অসুখ করবে আমার।
শলগ্রামের কথা শোনো, উৎপলা বললে, কানে ধরে কাজ করিয়ে না নিলে পচা জল বেনো জল সাত ঘাটের জল এসে খায় মানুষকে। চোখ কান বুজে ঠাকুর-চাকরের ঘাড়ে চান করা চলে কি? ফাঁকি দেওয়ার অভ্যেস তো ওদের আঁতুরের থেকে। জল কেন বদলাবে, কী দায় ওদের!
আমি নিজে তবে বাসি জল খালাস করে চৌবাচ্চায় ঝাড়ু লাগাব রোজ? নতুন। জল রাখব?
চাকরকে নাই দিলে তাই করতে হয়। এটা তো কোনো অপমানের কাজ নয়—
উৎপলা সেলাই করতে করতে বললে, তোমার নিজেরই তো সুবিধে।
কিন্তু এ-দু-বাড়ির এত চাকর-ঝির সামনে চৌবাচ্চার বাসি জল নিকেশ করব আমি চৌবাচ্চার ছ্যাঁদার ন্যাতা খসিয়ে? মাল্যবান পায়চারি করতে করতে থেমে দাঁড়িয়ে একটু বিলোড়িত হতে উঠে বললে।
খসাবে তো।
ঝিগুলো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাসবে?
কেন, বলো তো? এরকম হ্যাংলা ঝি কোথায় দেখলে তুমি!
আমি দেখেছি। তুমি দেখবে কী করে! সংসারের তুমি বড়ো জান কি না। কত রকম জীব আছে! কী দেখেছ তুমি!
থাক, ও-সব জেনে আমার কী দরকার!
মাল্যবান বললে, তাই বুঝি? সংসারের বার তুমি?
উৎপলা শেমিজ টাকতে-টাকতে কোনো উত্তর দিল না।
এই যে আমি নিচে চান করি, মাল্যবান আবার পায়চারি করতে করতে বললে, তুমি মনে কর এতে তোমার খুব নামডাক?
উৎপলা ঠোঁটের ভেতর সূঁচ গুঁজে শেমিজটা নেড়ে-চেড়ে দেখছিল; বললে, বড্ড ছিঁচকে তুমি।
আমি?
একটা কথা নিয়ে এত বাড়াতে পার–
ওপরে কল রয়েছে, বাথরুম রয়েছে, অথচ আমি চৌবাচ্চায় চাকর-বাকরদের মতো নিদের পর দিন চান করি—ও-দিকের ভাড়াটেরাই বা কী মনে করে।
উৎপলা ঠোঁটের থেকে সূঁচ নামিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, এ সব ন্যাকড়া তারা দেখতেও যায় না। বড়ো মন নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছে। একটা ঢ্যাঙা মিনসেকে চৌবাচ্চায় সামনে দাঁড়াতে দেখলেই তারা হেসে শুয়ে পড়বে? নিজের বাপকে দেখে চোখ ওল্টাবে?
মাল্যবান পায়চারি করতে করতে এক জায়গায় থেমে দাঁড়িয়ে বললে, সে-দিন শুনলাম মেজগিন্নি বলছেন, চাকরবাকরদের চৌবাচ্চায় কেরাণীবাবুটি চান করেন, জল না-কি কলকাতায় সোনার-দরে বিকোয় নাকি মেজদি—এই সব, এই সব, ছ্যাঃ, শুনে চন করে উঠে মাথার নোম খাড়া হয়ে পড়ে—
কে বলছিল এই কথা?
মেজোঠাকরুণ।
তা সৎগুষ্টির মেয়ে তো এই রকমই বলবে।
ঠিকই তো বলেছিল।
ঠিকই যদি বলেছিল, তুমি মুখে কোঁচা গুঁজে চোরের মত চলে এলে যে!
আমি কী করতে পারি। পরের বাড়ির ঝি-বৌদের সঙ্গে ঝগড়া করতে যাব? কী বল তুমি, উৎপলা?
উৎপলা সেলাই করে চলেছিল, চটা আবার ঠোঁটে-দাঁতে আটকে নিয়েছে, বললে, পরের বাড়ির বৌ তো বললে, কিন্তু পরের বাড়ির ভাতার-ভাসুরদের শুনিয়ে যারা এই রকম কথা বলে—
মুখের কথা না শেষ করে থেমে গেল উৎপলা।
মাল্যবান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল, একটা ছেড়া তেলেময়লায় ঘামনো-চোবানো কৌচে বসল সে, আস্তে আস্তে বললে, যাক। আসল কথা হচ্ছে এক গা নোম নিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বৌ-ঝিদের আনাগোনা চোখমারা মুখটেপার ভেতর চান করতে জুৎ লাগছে না আমার। এক-একটা বৌ ওপরে রেলিঙে ভর দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আমার চান দেখে; যেন শিবলিঙ্গের কাকন হচ্ছে—সমুদ্রস্নান হচ্ছে।
উৎপলা কল চালাতে চালাতে বললে, তাহলে কি বলতে চাও, দরজা-জানালা বন্ধ করে এক হাত ঘোমটা টেনে তুমি ওপরের বাথরুমে গিয়ে ঢুকবে আর মেয়েমানুষ হয়ে আমি নিচের চৌবাচ্চায় যাব—ওপরের বারান্দায় ভিড় জমিয়ে দিয়ে ওদের মিনসেগুলোকে কামিখ্যে দেখিয়ে দিতে?
না, তা কেন? ছেড়া সেটির ছারপোকার কামড় খেতে খেতে একটা বেশি কামড়ে যেন অস্বস্তি বোধ করে মাল্যবান বললে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই রকম হলেই তো ভালো হত।
আমার কথাটা তুমি বুঝলে না।
আরে বাবা, সব বুঝি আমি। দেখেছি অনেক জমিদারের ছেলেদের আমি, আঘন পোষের শীতে একটা পুকুর-ডোবা পেলেই ঝাঁপিয়ে জাপটে চান করছে। চোখ জুড়িয়ে গেছে দেখে। এক ফোঁটা জলের জন্য মেয়েমানুষের কাছে এসে হামলা!
মাল্যবান উশখুশ করে উঠে গেল।
ছুটির দিন ছিল। চৌবাচ্চা ছাড়া আরো অনেক কথা বলবার ছিল। কিন্তু বলবে কাকে? শোনবার লোক কই? অনুভুতির সমতা নেই, সরসতা নেই; ছাদে খানিকক্ষণ চুইমুই চুইমুই করে হেঁটে থেমে—বসে থেকে মাল্যবান ঘরের ভেতর ঢুকল। একটা চেয়ারে বসে বললে, জীবনের সাতাশ-আটাশ বছর আমিও তো পুকুরে চান করেছি।
বেশ করেছ।
জমিদারের ছেলেদের কথা বললে কিনা। কিন্তু কলকাতায় পুকুর পাব কোথায় বলো তো দেখি।
চৌবাচ্চাই কলকাতার পুকুর।
বলেছ। কিন্তু গামছা পরে চান করতে হয়—চারদিকে মেয়েরা থাকে—
হাঁচতে কাশতে রূপও বেরিয়ে পড়ে রূপলালবাবুর। মেয়েরা হেঁসেলের ছ্যাচড়া পুড়িয়ে আড়ি পেতে থাকে রূপলালবাবুকে দেখবার জন্য। হেঁসেলে দুধ ধরে যায়—গায়ে গায়ে ঠাসঠাসি মাছপাতরি হয়ে রূপই দেখে মেয়েরা রূপসাগরের
মাল্যবান আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবল: আজ অফিস ছুটি ছিল, কথা বলবার ছিল ঢের, কিন্তু উৎপলা মনে করবে, ঝুড়ি খুলে বসেছি—পুরুষমানুষ হয়ে। মেয়েমানুষ—পুরুষমানুষের অন্তঃসার ও ইতিকর্তব্য সম্বন্ধে ধারণাও বটে এই মেয়েটির! কোথায় পেল সে এ ধারণা? কে শিক্ষা দিয়েছে তাকে? অপ্রেম-হয়তো অপ্রেমই শিখিয়েছে উৎপলাকে।
একটা চুরুট জ্বালিয়ে মাল্যবান ভাবল, পুরুষমানুষ হয়ে এসব মেয়েদের কাছে জীবনের বড়ো বড়ো হোমদড়াম কথা ছাড়া কোনো মিহি কথা বলতে যাওয়া ভুল। কোনোদিন যদি তারা সেধে শুনতে আসে সেই অপেক্ষায় থাকতে হয়। সেটা সুফলা জিনিস হয়। হয়? চুরুটে কয়েকবার টান দিয়েই মাল্যবান ভাবল : কিন্তু সেরকম ভাবে উৎপলা আসবে না কোনোদিন। বারোটা বছর তো দেখা গেল। এই স্ত্রীলোকটি মিষ্টি হোক, বিষ হোক, ঠাণ্ডা হোক, আমার জীবনের রাখা ঢাকা সবুজ বনে আতার ক্ষীরের মতো কথাগুলো অতার ক্ষীরের মতো কথাগুলো শুনতে আসবে সে-পাখি ও নয়। ওর চেহারা যদি কালো, খারাপ হত, তাহলে তো চামারের মেয়েরও অযোগ্য হত। একটা মোদ্দাফরাসকে নিয়ে ঘর করছি আতাবনের পাখির মতো নেই সেই পাখিনীকে চেয়ে আমি—
কিন্তু নিজের চিন্তাধারণা ও উপমার কেমন একটা আলঙ্কারিক অসহজতায়— অস্বাভাবিকতায়ও বিরক্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল মাল্যবানের মন। জিনিসটা ঠিক এই রকম নয়—অন্য একরকম। কিন্তু কী রকম? যে রকমই হোক, কোনো সহজ স্বাদ নেই জীবনে—খাওয়া দাওয়া শোয়া ঘুমোনোর স্থূল স্বাদগুলোকে সূক্ষ্ম হতে চেয়ে গোলমাল করে ফেলল।