তিন
দেবব্রতবাবু খুব কাজের মানুষ। নইলে পুলিশ এত সহজে হাত গুটিয়ে নিত না। অনিমেষ শুনল, লালবাজারে দেবব্রতবাবুর খুব জানাশোনা আছে। কী করে কী হল অনিমেষ জানে না কিন্তু সেদিনের পর আর কোনও পুলিশ ওর সঙ্গে কথা বলতে আসেনি। ব্যাপারটা জেনে দেবব্রতবাবুর ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।
হাসপাতালে এখন সে অনেকটা স্বচ্ছন্দ। দেবব্রতবাবু সেদিনই দুটো শার্ট আর পাজামা কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরদিন নীলা একটা ছোট বাস্কেটে তোয়ালে সাবান আর পাউডার এনে দিয়েছে। একইভাবে দীর্ঘদিন শুয়ে থাকলে নাকি পিঠে ঘা হয়ে যায় তাই পাউডারের ব্যবস্থা। শরীরটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় অনিমেষের মেজাজ ভাল হল। শুধু এই একভাবে শুয়ে থাকাটাই অস্বস্তিকর। ঘুম আসে না, বদলে আজেবাজে চিন্তার ভিড় জমে। নীলার মা কখনও আসেননি। কিন্তু নীলার সঙ্গে কথা বলতে অনিমেষের রীতিমতো ভয় করে। যদিও দেবব্রতবাবু সামনে থাকলে নীলার কথাবার্তা খুব সাধারণ হয়ে যায়, বোঝা যায় রেখেঢেকে কথা বলছে। কিন্তু একা থাকলেই এমন ভঙ্গি করে তাতে সে যে কলকাতার মেয়ে, অনেক বেশি জানে অনিমেষের চেয়ে, এটা বোঝাতে কসুর করে না। অনিমেষ আন্দাজ করে ওদের সংসার বেশ সচ্ছল, নীলা নিত্য পোশাক পালটে আসে, দেবব্রতবাবুকে রোজ ইস্ত্রি-ভাঙা পাঞ্জাবি পরতে দেখেছে সে। বাবা তো চিরকাল স্বর্গছেঁড়ায় রয়ে গেলেন, এঁদের সঙ্গে কী করে আলাপ হল কে জানে! ওদের পরিবারের কোনও মেয়ে রোজ রোজ অপরিচিত কোনও ছেলেকে দেখতে হাসপাতালে আসত না।
মহীতোষ যে বিকেলে এলেন সেই দিনই মৃত্যু দেখল অনিমেষ। নিজের মাকে যে চোখের সামনে একটু একটু করে মরে যেতে দেখেছে তার কাছে মৃত্যু কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এই ঘটনাটা একদম অবাক করে দেবার মতো। সকালে নার্স সবাইকে দেখাশোনা করছেন তখনই ওঁর নজরে পড়ল অনিমেষের পাশের বেডের বৃদ্ধ টানটান হয়ে শুয়ে আছেন। নার্সদের ডিউটি রোজ এক সময়ে থাকে না, আজকে যিনি আছেন তিনি গম্ভীর মুখের এবং অনিমেষ তাঁকে হাসতে দেখেনি। মহিলা বৃদ্ধের পাশে গিয়ে ঝুঁকে শরীরে হাত ছোঁয়ালেন, একবার নাড়ি দেখলেন, তারপর পায়ের কাছে পড়ে থাকা চাদরটা টেনে মুখ অবধি ঢেকে জুতোয় শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন।
আচমকা একটা মানুষকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়ায় অনিমেষের শরীর কেঁপে উঠল। চোখের সামনে জুড়ে থাকা ওই সাদা কাপড়টা যেন নিষ্ঠুর হাতে জীবনকে সরিয়ে দেয়। ওর মনে পড়ল বৃদ্ধ বলেছিলেন যে স্বাভাবিকভাবে শুয়ে থাকলে ওঁর সর্বাঙ্গে হাড় ফোটে। তাই এক উদ্ভট ভঙ্গিতে বসে থাকতেন, সেইভাবেই ঘুমুতেন, আরাম তৈরি করে নিয়েছিলেন মনের মতো। অথচ এখন কী নিশ্চিন্তে সর্বাঙ্গ বিছিয়ে শুয়ে আছেন। মানুষটা যে কখন নিঃশব্দে চলে গেল সে টের পায়নি দু’হাত দূরে শুয়ে থেকেও। হঠাৎ সে লক্ষ করল নার্স চলে যাওয়ার পর এই ঘরে আর কোনও শব্দ হচ্ছে না। সবকটা বেডের মানুষ এই দিকে চুপচাপ তাকিয়ে। এঁরা প্রত্যেকেই জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহে হোঁচট খেয়ে হাসপাতালে এসেছেন মেরামতের জন্য। কিন্তু মুশকিল হল মৃত্যুর দরজাটা এখান থেকে এত কাছে, বড় কাছে! হঠাৎ কেউ শ্লেষ্মা-জড়ানো গলায় ‘হরি হে নারায়ণ’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনিমেষের মনে হল বৃদ্ধের শরীর থেকে নির্গত আত্মা এখনও এই ঘরে পাক খাচ্ছে আর তাকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই ওই তিনটি শব্দ অঞ্জলির মতো ছুড়ে দেওয়া হল। এই বৃদ্ধের কোনও আত্মীয়কে সে দু’দিনে দেখেনি। পৃথিবীতে জন্মে এত বয়স ভোগ করে চুপচাপ চলে যাওয়ায় পৃথিবীর কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হল না। এত কষ্ট পাওয়া অথবা কাউকে কষ্ট দেওয়ার কী দরকার ছিল ওই বৃদ্ধের যদি চুপচাপ মৃত্যুর কাছে এভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়! সেদিন সেই অন্ধকার গলিতে পুলিশের বুলেট যদি আরও কয়েক ইঞ্চি ওপরে ছুটে আসত তা হলে অনিমেষেরও ওই একই হাল হত। খুব বিরক্তিতে মাথা নাড়ল অনিমেষ, না, এইরকম চুপচাপ সে মৃত হয়ে যাবে না।
এদিন আর-একটা ঘটনা ঘটল। এগারোটা নাগাদ অনিমেষ দেখল ওর বেডের দিকে একটি ছেলে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ চোখ পড়ায় চমকে উঠেছিল সে, সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল, মনে হয়েছিল সুনীলদা এগিয়ে আসছে। যে মানুষটাকে ওরা মাথায় করে নিয়ে গিয়ে জলপাইগুড়ির শ্মশানে দাহ করে এল সে কী করে এখানে আসবে? সে দেখল পঁচিশের নীচে বয়স, পাজামা আর হ্যান্ডলুমের গেরুয়া পাঞ্জাবি পরনে ছেলেটি ঘরে ঢুকে অন্য বেডগুলো একবার দেখে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
কলকাতা শহরের কোনও ছেলেকে অনিমেষ চেনে না। ছেলেটি ওর বেডের পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল খানিক, তারপর বলল, ‘এখন তো আপনি সুস্থ মানে কথা বললে অসুবিধে হচ্ছে না, তাই তো?’
অনিমেষ নিঃশব্দে মাথা নাড়ল, সে কিছুই বুঝতে পারছিল না।
‘আপনি একটু সুস্থ না-হলে আসতে পারছিলাম না। ওদের বুলেটটা নিচু হয়ে এসেছিল এটুকুই যা সান্ত্বনা। আপনার সব খবর আমি জানি, দু’দিন জ্ঞান ফেরেনি, প্রচুর ব্লিডিং হয়েছিল।’ সামান্য জড়তা নেই কথায়, অপরিচিত শব্দটা কথা বলার ভঙ্গিতে নেই।
‘আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।’ সরাসরি বলে ফেলল অনিমেষ।
‘কী করে চিনবেন? তখন তো আপনার হুঁশই ছিল না। শুধু মা মা বলে গোঙাচ্ছিলেন।’ হাসল ছেলেটি, ‘যাক, আপনার জ্ঞান না-ফিরলে আসতে পারছিলাম না। তারপর শুনলাম পুলিশ নাকি এমন মগজ ধোলাই করেছে যে আবার অজ্ঞান হয়ে গেছেন।’
বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছিল অনিমেষের। ও কি সেই ছেলেগুলোর একজন যারা ট্রাম পুড়িয়েছিল? এই মুহূর্তে যদি সম্ভব হত অনিমেষ উঠে বসত। ওর চোখ-মুখে এক ধরনের উত্তেজনা ফুটে উঠল, ‘আপনারা আন্দোলন করছিলেন?’
ওর এই হঠাৎ উত্তেজিত ভাবটা লক্ষ করেও ছেলেটি খুব সহজ গলায় বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘পুলিশ আপনাদের ধরতে পারেনি?’
‘না!’ বলেই হেসে উঠল ছেলেটি, ‘তা হলে এখানে এলাম কী করে? আপনার সঙ্গে পরিচিত হই, আমার নাম সুবাস সেন। চাকরিবাকরি পাইনি এখনও, টিউশনি করি কয়েকটা। আপনার নাম তো অনিমেষ, এবারে স্কুল ফাইনাল পাশ করে কলেজে ভরতি হতে এসেছ?’
আর-একবার অবাক হল অনিমেষ। এসব কথা সুবাস জানল কী করে? সে লক্ষ করল সুবাস বাক্যটা আরম্ভ করেছিল আপনি বলে, শেষ করল তুমিতে।
টুলটা নিয়ে এসে সুবাস বলল, ‘তোমার সুটকেস খুলে এসব জানতে পারলাম। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি আমাদেরই দলের লোক। যাক, বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে এখান থেকে?’
বিহ্বল অনিমেষ সময় নিল কথা বলতে, ‘হ্যাঁ, বাবার এক বন্ধু দিয়েছেন, পুলিশও দিতে পারে।’ তারপরই সে প্রশ্নটা ছুড়ল, ‘আপনাদের আন্দোলন এখনও চলছে?’
সুবাস প্রশ্নটা শুনে অনিমেষকে ভ্রূ কুঁচকে দেখল। কী বুঝল অনিমেষ জানে না। তবে সন্দেহ ছিল ওর চোখে, ‘যতক্ষণ আন্দোলনটা আমাদের সবাইকার না-হবে ততক্ষণ তার জীবন কয়েক ঘণ্টা কিংবা দিনের। আমরা শুধু সরকারকে খুঁচিয়ে একটু বিরক্ত করতে পারি কিন্তু সেটাকে বৃহৎ ব্যাপারে নিয়ে যেতে পারি না। তাই সেদিন গুলি চলল, ট্রাম পুড়ল, কাগজে হেডিং হল কিন্তু মানুষের অবস্থা একই রয়ে গেল। তুমি রাস্তায় বেরুলে দেখবে জীবন একদম স্বাভাবিক, সে দিনের কথা কারও খেয়ালে নেই।’
অনিমেষ মন দিয়ে কথাগুলো শুনল। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সেদিন কী ধরনের আন্দোলন তার বিস্তৃত বিবরণ সুবাসের মুখে শোনে। কিন্তু সংকোচ হল এবার, কী মনে করবে বলা যায় না। তাই যে প্রশ্নটা নিজের কাছে অস্পষ্ট সেটাই ও জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কীসের জন্য আন্দোলন করছেন?’
সুবাস ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবল, তারপর বলল, ‘জলপাইগুড়িতে তুমি কি বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলে?’ অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না।
‘আজ থাক। পরে একদিন আলোচনা হবে। তোমার জন্য দুঃখিত, কলকাতায় পড়তে এসে কী হয়ে গেল! কত দিনে সারবে বলছে?’
‘এখনও বলেনি তবে বাবার বন্ধু বলছেন বেশি দিন লাগবে না।’ ওকে উঠতে দেখে অনিমেষের খারাপ লাগছিল। সুবাসের সঙ্গে কথা বলতে ওর ভাল লাগছে।
সুবাস বলল, ‘তোমার সুটকেস আর বেডিং নীচের এনকোয়ারিতে জমা দিয়েছি আজ। মনে হয় ওরা কিছু সরাবে না, দেখে নিয়ো সব ঠিক আছে কিনা!’
যেন ঝিনুক খুলেই মুক্তো পেল অনিমেষ। হারানো জিনিস দুটো সুবাস জমা দিয়ে গেছে জেনে ও বিহ্বল হয়ে পড়ল। কলকাতা শহরের কোনও মানুষ একটা দায়িত্ব নিজে থেকে নেবে সে কল্পনা করতে পারেনি। এখানকার মানুষের হৃদয় নেই, বিশ্বাস শব্দটা এই শহরে খুঁজে পাওয়া যাবে না— এ সবই শুনে এসেছে এতকাল। অথচ ওর আহত শরীরটাকেই ওরা শুধু তুলে আনেনি, গলির ভেতর ছিটকে পড়ে থাকা জিনিসপত্র কুড়িয়ে এনে হাসপাতালে জমা করে দিয়ে গেছে— অনিমেষের বুক ভরে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি আবার আসবেন তো?’
‘তোমাকে এরা কবে ছাড়বে কিছু বলেছে?’
‘না।’
‘যদি উপায় থাকে তবে হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়াই ভাল। ভারতবর্ষের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে মর্গের কোনও পার্থক্য নেই। বিকেলে আমার সময় হবে না, এলে এই সময় আসব।’
‘এই সময় ওরা আসতে দেয়?’
‘এসেছি তো। আমি সব জায়গায় যেতে পারি, ব্রিটিশ আমল হলে লাটসাহেবের শোওয়ার ঘরেও ঢুকে যেতে পারতাম। চলি।’ কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে এল সুবাস, ‘একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। কাগজে বেরিয়েছে প্রথম সারির একজন নেতাকে পুলিশ নাকি আহত অবস্থায় ধরেছে বলে দাবি করেছে। কিছু না-পেয়ে ওরা পুতুলকে মানুষ বলে চালাচ্ছে। ওরা যদি আবার প্রশ্ন করে জবাব দিয়ো না।’
অনিমেষ সরল মনে জানাল, ‘পুলিশ তো অভিযোগ তুলে নিয়েছে, ওরা আমার কাছে সে দিনের পর আর আসেনি। বাবার বন্ধু দেবব্রতবাবু এটা ম্যানেজ করেছেন।’
একটু অবাক চোখে অনিমেষকে দেখল সুবাস, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘দেবব্রতবাবু কী করেন?’ কথাটার মধ্যে একটুও স্বাভাবিকতা নেই, অনিমেষের অস্বস্তি হল, ‘জানি না, তবে এখানকার পুলিশের সঙ্গে ওঁর খুব জানাশোনা আছে।’
‘ও। তবে আর চিন্তা কী!’ কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল সুবাস।
মন খারাপ হয়ে গেল অনিমেষের। যে উপমাটা এইমাত্র সুবাস দিয়ে গেল সেটা মনের সব আনন্দ নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যেহেতু সে কোনও সক্রিয় আন্দোলনে যোগ দেয়নি তাই পুতুল হয়ে গেল? আর দেবব্রতবাবুর কল্যাণে পুলিশ যে হাত গুটিয়ে নিয়েছে এতে তার অপরাধ কোথায়? কিন্তু সুবাসের মুখের ভাব স্পষ্ট বলে দিল কথাটা শুনে সে একটুও খুশি হয়নি। ও পাশের জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। এখন কড়া রোদ। সুবাস নিজে থেকে না-এলে তার দেখা পাওয়া আর সম্ভব নয়। পাশের বেডে এখনও সেই বৃদ্ধ চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছেন। সুবাস কি একটা মৃতদেহের অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছিল?
দুপুরবেলায় ঘুম এল না। আজকাল অবশ্য এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশের বিছানা এখন ফাঁকা। এমনকী বেডকভার না-থাকায় ময়লা তোশকটা বিশ্রী দাঁত বের করে হাসছে। ওদিকে চোখ রাখা যায় না। সুবাসের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর অনিমেষের মন কেমন ভার হয়ে আছে। সুবাস ওর চেয়ে বয়সে খুব একটা বড় নয় অথচ ওর সঙ্গে কথা বললে নিজেকে ছেলেমানুষ বলে মনে হয়। অনিমেষ জোর করে ভাবনাটাকে অন্য দিকে ঘোরাতে চাইল। দেবব্রতবাবু বলেছিলেন যে স্কটিশচার্চে ওঁর এক বন্ধু নাকি অধ্যাপনা করেন। অনিমেষ সেখানে ভরতি হয়ে বাড়িতেই পড়াশুনা করতে পারে। ফার্স্ট ইয়ারে কাউকেই বেশি পড়তে হয় না। অ্যাটেন্ডেন্সের গড় ঠিক থাকলেই প্রমোশন পাওয়া যায়— তা সেটাও নাকি ম্যানেজ হয়ে যাবে। এটা শুনে অনিমেষ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছে কিন্তু যতক্ষণ ব্যবস্থাটা পাকা না-হচ্ছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই। ফার্স্ট ইয়ারটা শুয়ে শুয়েই কাটাতে হবে?
বিকেলবেলায় মহীতোষ এলেন। সঙ্গে দেবব্রতবাবু, আজ নীলা আসেনি। দূর থেকে বাবাকে দেখতে পেয়ে খানিকটা সংকোচ আর কেন জানা নেই অপরাধবোধ এল অনিমেষের। মহীতোষ সোজা মানুষ, চা-বাগানের নির্জনতায় থেকে সরল কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। অনিমেষ জানে বাবা তাকে ঘিরে অনেক আশা করেন। ওকে ডাক্তার হতে হবে, অনেক পসার হবে— প্রচুর টাকা আসবে, এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে যে ফর্মুলা তার বাইরে তিনি ছেলেকে কিছুতেই দেখতে চান না। অথচ কলকাতায় সে পড়তে আসুক এ ব্যাপারে তাঁর কোথায় যেন দ্বিধা ছিল। হয়তো ভেবেছিলেন জলপাইগুড়ি থেকে আই. এসসি. পাশ করে কলকাতায় পড়তে গেলে ওর আরও দায়িত্ববোধ এবং বয়স বাড়বে সুতরাং চিন্তার কিছু থাকবে না। সেই ছেলে কলকাতায় পৌঁছে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে খবর পেয়ে পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন তিনি। খবরটা এল লোকাল থানা থেকে। সাব-ইনসপেক্টর ছেলে সম্পর্কে জেরা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। যেন অনিমেষ কলকাতায় খুব বড় ডাকাতি করতে গিয়ে আহত হয়েছে। একটা কথা তাঁর মাথায় ঢুকছিল না, একদম আনাড়ি ছেলে কলকাতায় গিয়ে কী করতে পারে যার জন্য পুলিশ গুলি করবে? কাগজে তিনি পোড়া ট্রাম-বাস আন্দোলনের ছবি দেখেছেন। মহীতোষের সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল নিজের ছেলেকে তিনি কখনওই চিনতে পারেননি। ট্রেনে গেলে অনেক সময়। পড়ি কি মরি করে তেলিপাড়া থেকে যে বেসরকারি মালের প্লেন ছাড়ে তাতেই জায়গা করে নিলেন। অনিমেষের এই খবরটা জলপাইগুড়িতে সরিৎশেখরকে জানাবার সময় পেলেন না আর। শেষ দুপুরে দমদমে নেমে সোজা দেবব্রতবাবুর কাছে চলে এসেছেন তিনি। জীবনে প্রথম প্লেনে চড়ার উত্তেজনা একটু টের পেলেন না মহীতোষ। দমদম থেকে হরেন মল্লিক লেনে আসতে যে কলকাতা পড়ল তা শান্ত, কোথাও কোনও বিক্ষোভ নেই। কল্পনাই করা যাচ্ছে না এখানে এসে অনিমেষ কী কারণে গুলি খেতে পারে। দেবব্রতবাবু বাড়িতে ছিলেন, দীর্ঘকাল বাদে দেখা হওয়ামাত্র মহীতোষ হাসপাতালে যেতে চাইলেন। কিন্তু তখন দুপুর, যেতে চাইলেই সম্ভব নয়। দেবব্রতবাবু মহীতোষকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সমস্ত ঘটনাটা শোনালেন। এর কিছুটা অনিমেষের কাছে দেবব্রতবাবু জেনেছেন, কিছুটা পুলিশের সূত্রে, বাকিটা অনুমান।
অনিমেষ এখন মোটামুটি ভাল, জীবনের কোনও আশঙ্কা নেই জানতে পেরে মহীতোষ কিছুটা শান্ত হলেন। সকালে পাওয়া উত্তেজনাটা হঠাৎ নিভে এলে নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হল। দেবব্রতবাবু ওঁকে বোঝালেন এখন কিছুই করার নেই, শুধু সময়ের অপেক্ষা। থাই-এর হাড়ে গুলি লেগে সেখানে ফ্র্যাকচার হয়েছিল, অপারেশন হয়েছে, ডাক্তার বলছে মাস ছয়েক বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকলে অনিমেষ হাঁটতে পারবে। দুর্ঘটনা তো ঘটেই কিন্তু মুশকিল হল সেটা ঘটবার আগে কিছুতেই জানা যায় না। মহীতোষ বললেন, ‘আসলে আমার ভাগ্যটাই এইরকম। ওর মা চলে গেল একটা সামান্য দুর্ঘটনায়, কোনও কারণ ছিল না। ছেলেটা এতকাল দাদুর কাছে মানুষ হয়েছে, আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। স্কুল ফাইনালে ও যখন ফার্স্ট ডিভিশন পেল আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পড়াশুনায় ভাল কিন্তু বড্ড জেদি আর অবাধ্য মনে হত। তা রেজাল্ট ভাল হতে ওকে ঘিরে একগাদা কল্পনা করে ফেললাম। অথচ দেখুন, সঙ্গে সঙ্গে আবার দুর্ঘটনা।’
দেবব্রতবাবু বললেন, ‘আপনার ছেলেকে অবাধ্য বলে মনে হয় না কিন্তু।’
মহীতোষ হাসলেন, ‘ওটা ঠিক বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। ও যেটা ভাল মনে করে সেটা করবেই। এককালে কংগ্রেসের কাজকর্ম করত আমার অপছন্দ সত্ত্বেও।’
দেবব্রতবাবু অবাক হলেন, ‘অনিমেষ কংগ্রেস করত?’
‘আমি ঠিক জানি না, তবে সেরকমই শুনেছিলাম, নেহাতই কাঁচা ব্যাপার, চাপল্য তো ওই বয়সেই আসে।’ মহীতোষ নিজেই উড়িয়ে দিলেন কথাটা।
‘ঠিক আছে, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না, ওর কলেজে ভরতির সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। স্কটিশে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়ে রাখছি, সুস্থ হলে ক্লাস করবে।’
‘স্কটিশে কেন, প্রেসিডেন্সিতে জায়গা পাবে না?’
‘না— মানে, ধরাধরির ব্যাপার তো। ক্লাস না-করলে প্রেসিডেন্সি খাতায় নাম রাখবে না। খুব কম্পিটিশন ওখানে।’
‘স্কটিশ কি আর আগের মতো আছে?’ দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল মহীতোষকে, ‘তার ওপর কো-এডুকেশন কলেজ—।’
‘দূর মশাই, ওসব নিয়ে ভাববেন না। প্রেসিডেন্সিতেও মেয়েরা পড়ছে। পড়াশুনাই হল আসল কথা। স্কটিশের আর্টস ডিপার্টমেন্টটা ভাল।’
‘আর্টস?’ মহীতোষ যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘অনিমেষ কি আর্টসে ঢুকতে চায়?’
‘হ্যাঁ, তাই তো বলল। তা ছাড়া সায়েন্স নিয়ে পড়লে ক্লাস না-করলে চলবে না। প্র্যাক্টিক্যালগুলো তো বাড়িতে বসে করা যাবে না।’
মুখ-চোখ শক্ত হয়ে গেল মহীতোষের, নীরবে মাথা নাড়লেন। সেটা লক্ষ করে দেবব্রতবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি অন্য কিছু ভাবছেন?’
চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন মহীতোষ, ‘ডাক্তাররা যদি বলে থাকেন ছয় মাসের মধ্যে ও উঠতে পারবে না তা হলে আর এখানে রেখে লাভ কী! আর তার পরেও তো হাঁটাচলা সড়গড় হতে সময় লাগবে। আমি ওকে নিয়ে যেতে চাই, সামনের বছর দেখা যাবে।’
‘নিয়ে যাবেন মানে?’ হেসে ফেললেন দেবব্রতবাবু, ‘আপনি তো এখনও ওকে চোখে দেখেননি, সামান্য নড়াচড়া ওর পক্ষে ক্ষতিকর আর আপনি সেই জলপাইগুড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন?’ তারপর ব্যাপারটা ধরতে পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি চাইছেন না অনিমেষ আর্টসে ভরতি হোক?’
মহীতোষ ঘাড় নাড়লেন, ‘না, ওর জীবন লক্ষ্যহীন হোক সেটা চাই না। ওর মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হবে, আমারও তাই ইচ্ছে।’
কথাটা শুনে দেবব্রতবাবু হাসলেন, ‘তাই বলুন। তা হলে অবশ্য এ বছরটা নষ্ট করতেই হবে। যাক, হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করুন। চারটের একটু আগেই বেরোব আমরা।’
মহীতোষ উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখলেন, ‘আমি বরং হোটেল থেকে ঘুরে আসি।’
‘হোটেল? আপনি হোটেলে থাকবেন নাকি?’
‘কত দিন থাকতে হবে জানি না তো, আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তা ছাড়া প্যারাডাইস হোটেলটা কাছেই, আমাদের জলপাইগুড়ির হোটেল বলতে পারেন— এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।’
দেবব্রতবাবুর ঘোর আপত্তি মহীতোষ শুনলেন না। প্রয়োজনে পুত্রকে তিনি বন্ধুর কাছে সাময়িকভাবে থাকতে পাঠাতে পারেন কিন্তু নিজের থাকার কোনও কারণ পান না।
ক’দিনের যাওয়া আসায় দেবব্রতবাবু এর মধ্যেই হাসপাতালে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এনকোয়ারি কাউন্টার থেকে এক ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে ওঁকে ডাকলেন, ‘আপনি তো জেনারেল বেডের একশো আটত্রিশ নম্বরের কাছে আসেন?’
দেবব্রতবাবু ঘাড় নাড়লেন, ‘কেমন আছে ও?’
‘খারাপ কিছু রিপোর্ট নেই। আপনার পেশেন্টের নাম অনিমেষ, তাই তো?’
‘হ্যাঁ। কী হয়েছে?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ সকালে একজন আপনার পেশেন্টের নাম করে দুটো লাগেজ দিয়ে গেছে। ওকে দেখিয়ে তো কোনও লাভ নেই, আপনারা যদি চান তো নিয়ে যেতে পারেন।’
দেবব্রতবাবু অবাক হয়ে মহীতোষের দিকে তাকালেন। মহীতোষ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি একটু দেখতে পারি?’
দেবব্রতবাবু পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইনি পেশেন্টের বাবা।’
চিনতে পারলেন মহীতোষ। বেডিংটা তো বটেই, সুটকেসটাও সঙ্গে এনেছিল অনিমেষ। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে কেউ হয়তো দিয়ে গেছে কিন্তু এতদিন বাদে চিনে চিনে এগুলো এখানে কী করে পৌঁছাল সেটাই বোধগম্য হচ্ছিল না ওঁদের। জিনিসপত্র মিলিয়ে দেখার কোনও মানে হয় না। প্রথমত ওতে কী কী ছিল তাই মহীতোষ জানেন না আর যদি কিছু হারিয়ে থাকে তা কখনওই পাওয়া যাবে না। এগুলো কেউ দিয়ে গেছে তাই যথেষ্ট।
কলকাতার হাসপাতাল সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না মহীতোষের। খাটের অভাবে যাতায়াতের পথের পাশেই রুগিদের শুয়ে থাকতে দেখে যে চিন্তা মাথায় এসেছিল সেটা দূর হল ঘরে এসে। একদম দেওয়াল-ঘেঁষা বিছানায় ছেলে শুয়ে আছে। কোমর অবধি একটা চাদরে ঢাকা, মুখ শুকনো, ভীষণ রোগা দেখাচ্ছে। এক পলকে চেহারাটা দেখেই মহীতোষ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। যে ছেলের জন্য এতটা পথ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে এলেন তারই জন্য মন তিক্ত হল। তাঁর মনে পড়ল এই ছেলে চিরকাল অবাধ্য এবং একসময় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই জেদ প্রকাশ করেছে। নিজের গোঁয়ারতুমির জন্য ওর এই অবস্থা, যেমন বীরত্ব দেখাতে গিয়েছিল তার উচিত শিক্ষা হয়েছে। নইলে এত বড় কলকাতা শহরের কোনও মানুষের গায়ে গুলি লাগল না আর উনি ট্রেন থেকে নামতেই গুলি খেয়ে গেলেন! আসলে এটা মহীতোষকে জ্বালানোর একটা রাস্তা যেটায় ওর মা মরে গিয়েও হেঁটে যাচ্ছে।
অনিমেষ মুখ নামিয়ে নিল। চট করে বাবার দিকে চাইতে সাহস হল না। দেবব্রতবাবুর গলা শুনতে পেল সে, ‘যাক, আর কোনও চিন্তা নেই, তোমার বাবা এসে গেছেন।’
অনিমেষ চেষ্টা করছিল মুখটা স্বাভাবিক রাখতে। তার যে খুব কষ্ট হচ্ছে এটা সে কিছুতেই মহীতোষকে বুঝতে দেবে না। দেবব্রতবাবু টুলটাকে খাটের তলা থেকে টেনে এনে মহীতোষকে বললেন, ‘বসুন।’
মহীতোষ বসলেন না। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলের শরীরের দিকে তাকালেন। ওর একটা পা সামান্য উঁচুতে, খাটের পায়ার দিকটার তুলনায় মাথার দিকটা একটু বেশি ঢালু। চাদরে ঢাকা থাকলেও বোঝা যাচ্ছে উঁচু পায়েই গুলি লেগেছে। কিছু কথা বলা উচিত কিন্তু কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না মহীতোষ।
দেবব্রতবাবু বললেন, ‘তোমার বাবাকে কত করে অনুরোধ করলাম আমার বাড়িতে থাকার জন্য তা উনি শুনলেন না। বোধহয় প্যারাডাইস হোটেলের রান্না খুব ভাল। তা আমরা যদি কখনও জলপাইগুড়িতে যাই তা হলে দেখো ঠিক হোটেলে গিয়ে উঠব।’ কথা শেষ করে সামান্য হেসে মহীতোষের দিকে তাকালেন দেবব্রতবাবু।
‘জলপাইগুড়িতে হোটেল কোথায়!’ কিছু একটা বলতে পেরে মহীতোষ সহজ হলেন। তারপর হলঘরটার ওপর নজর বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একটা ঘরে এতগুলো লোক রয়েছে, এখানে আলাদা ঘর পাওয়া যাবে না?’
‘আলাদা মানে কেবিনের কথা বলছেন? চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যাবে কিন্তু তার কী দরকার? কেবিনে থাকলে মানুষের মুখ দেখতে পাবে না, দু’দিনেই হাঁপিয়ে উঠবে। আর চিকিৎসার কথা যদি বলেন সেটা সর্বত্রই সমান।’ দেবব্রতবাবু মুখ ঘুরিয়ে অনিমেষকে প্রশ্ন করলেন, ‘আজ পায়খানা হয়েছে তো?’
নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ। গতকালও এই প্রশ্ন করেছিলেন উনি এবং সেটা মেয়ের সামনেই। কোনও পুরুষমানুষের এইসব প্রাকৃতিক ব্যাপার নিয়ে মেয়েদের সামনে কথা বলা যে লজ্জাজনক সেটা ভদ্রলোকের মাথায় আসে না। দেবব্রতবাবু বললেন, ‘গুড। আসলে ওটা ক্লিয়ার হয়ে গেলে আমাদের অর্ধেক রোগই সেরে যায়। যদিও তোমার ওই পজিশনে ওটা খুব ডিফিকাল্ট।’
ভাঙা পা জোড়া লাগার সঙ্গে পায়খানা পরিষ্কারের কী সম্পর্ক অনিমেষ বুঝতে পারল না।
মহীতোষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে খাবার টাবার কেমন দেয়?’
প্রশ্নটা ঠিক কাউকে নির্দিষ্ট করে নয়, দেবব্রতবাবু অনিমেষের দিকে তাকালেন। এখন অবধি কোনও শক্ত খাবার অনিমেষ খায়নি। কাল থেকে তাকে ভাত দেওয়া হতে পারে বলে দুপুরের নার্স বলে গেছে। উত্তরটা দেবব্রতবাবুই দিলেন, ‘হাসপাতালে কি আর রাজভোগ খাওয়াবে? ডাক্তার যদি রাজি হয় তা হলে ওকে বাড়িতে নিয়ে যাই, কী বলেন? অনেক আরামে থাকবে। এখানে কথা বলার লোকই পাওয়া যায় না।’
এমন সময় পাশের বেডে দু’জন লোক একটি ছেলেকে ধরাধরি করে শুইয়ে দিয়ে গেল তোশকের ওপরেই। এখনও চাদর পাতার সুযোগ হয়নি। ছেলেটা বিছানায় শুয়ে উঃ আঃ করতে লাগল সমানে। ওর সঙ্গীরা যে সেবাযত্ন করছে তাতে সুরাহা হচ্ছে না কিছুই।
দেবব্রতবাবু সে-দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে একজন বুড়ো ছিল না?’
অনিমেষ আস্তে উত্তর দিল, ‘উনি মারা গেছেন।’
‘সে কী! কালই তো দেখে গেলাম।’ হতভম্ব দেবব্রতবাবুর মুখটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ বলল, ‘আজ সকালে টের পাওয়া গেল।’
এবার মহীতোষ কথা বললেন, ‘টের পাওয়া গেল মানে? একটা লোক কখন মরে গেছে তা কেউ খবর রাখল না? অদ্ভুত ব্যাপার তো! তুই দেখলি?’ এই প্রথম ছেলেকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন মহীতোষ।
অনিমেষ বাবার দিকে তাকাল। খুব বিচলিত দেখাচ্ছে ওঁকে। বাবাকে দেখার পরই যে সংকোচটা এসেছিল এখন সেটা অনেক কম। বরং বাবার অদ্ভুত ব্যবহারে সে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিল। ওর আহত হবার পর যিনি জলপাইগুড়ি থেকে ছুটে এলেন তিনি এসে অবধি একটাও কথা বলেননি, কী করে ঘটনাটা ঘটল জিজ্ঞাসাও করেননি। গম্ভীর মুখে অনিমেষ মহীতোষের প্রশ্নটার উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ’।
মহীতোষ বললেন, ‘খুব খারাপ ব্যাপার। আচ্ছা, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা যাবে এখন?’
দেবব্রতবাবু বললেন, ‘চলুন দেখি। তবে আপনি যা চাইছেন তা হবে না।’
অন্যমনস্ক মহীতোষ বললেন, ‘মানে’?
‘ওই যে তখন বলছিলেন না, ছেলেকে নিয়ে ফিরে যাবেন, সেটা অসম্ভব। দেখেই বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। তার ওপর আপনাদের বিখ্যাত মণিহারীঘাট পার হয়ে যাওয়া— কিছু হয়ে গেলে সারাজীবন আফশোস করতে হবে।’
‘কিন্তু এখানে রাখা মানে আপনার ওপর অত্যাচার করা। তা ছাড়া, এ বছর যখন নষ্ট হচ্ছেই, চলুন, আগে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দেখি—।’ অনিমেষকে কিছু না-বলে ওঁরা বেরিয়ে গেলেন।
কথাগুলো শোনামাত্র অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। মহীতোষ এসেছেন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে? এটা ঠিক, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে ভাল লাগছে না। কিন্তু জলপাইগুড়িতে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই এখানকার কলেজে আর ভরতি হওয়া যাবে না। মহীতোষ তো স্পষ্ট বললেন, এ বছরটা নষ্ট হচ্ছে। তার পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে সে এখন কলেজে ভরতি হচ্ছে না। একটা বছর চুপচাপ বৃথায় চলে যাবে এবং উনি সেটা মেনে নিয়েছেন। অনিমেষের মনে হচ্ছিল সে যদি একবার এখান থেকে জলপাইগুড়ি ফিরে যায় তা হলে আর কখনও কলকাতার কলেজে পড়া হবে না। কিন্তু সে এখন তো কিছুই করতে পারে না। যার বিছানা থেকে এক ইঞ্চি উঠে বসার সামর্থ্য নেই তার কথা কেউ শুনবে কেন? যদি দাদু থাকতেন কাছে, অনিমেষ সরিৎশেখরের অভাব ভীষণভাবে অনুভব করল। দাদুর কথায় বাবা না বলতে পারতেন না আর দাদুকে রাজি করানো নিজেকে রাজি করানোর মতোই সহজ। এখনও সে ভালভাবে কলকাতার রাস্তায় হাঁটেনি, কলকাতার কিছুই দেখেনি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ট্রামের চাকার ঘরঘর শব্দ ছাড়া কলকাতা ওর কাছে অচেনা, তবু অনিমেষের মনে হচ্ছিল, কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে তার সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।
অনিমেষ চোখ বন্ধ করে ছিল। হঠাৎ সে অনুভব করল কেউ যেন খাটের পাশের টুলটায় এসে বসেছে। সে চোখ খুলল না। খানিক বাদে সে মহীতোষের গলা শুনতে পেল। গলা অদ্ভুত বিষণ্ণ এবং কেমন ভাঙা ভাঙা। এরকম গলায় বাবাকে কখনও কথা বলতে শোনেনি সে। মহীতোষ বললেন, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, খোকা?’
চোখ খুলল না অনিমেষ। এতক্ষণ কোথায় ছিল জানা নেই, অভিমানের সুতোটা টানটান হয়ে যেতে লাগল। ওর মনে হল, চোখ খুললেই সে কেঁদে ফেলবে। কিছুক্ষণ কোনও কথা নেই, তারপর খুব আলতোভাবে পায়ের ওপর স্পর্শ পেল অনিমেষ। ওর অপারেশনের জায়গায় হাত রেখে মহীতোষ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খোকা, খুব ব্যথা করছে রে?’
সামান্য স্পর্শ কিন্তু অনিমেষের মনে হল, কেউ করাত দিয়ে ওর পা কাটছে। অন্য সময় হলে আর্তনাদ করত কিন্তু এখন শারীরিক যন্ত্রণাটাকে দাঁতে চাপল সে। প্রাণপণে, স্বাভাবিক গলায় সে বলার চেষ্টা করল, ‘না বাবা।’