০৩. দু-আঙুলে আস্ত সিগারেট

দু-আঙুলে আস্ত সিগারেটটা ধরে কিছুক্ষণ ঘোরাতেই ভেতরের তামাক খসে পড়ে যেতে লাগল। প্রায় সবটা খালি হয়ে আসবার পর অনিন্দ্য তার বাঁ-হাতের চেটোতে রাখা গাঁজার মশলা সেটার মধ্যে ভরতে শুরু করল। অবিলম্বেই সেটা আবার একটা অসমান চেহারার সিগারেটে পরিণত হল।

অনিন্দ্য সেটা ধরিয়ে খুব লম্বা একটা টান দিল, ধোঁয়া চেপে রাখল বুকের মধ্যে। তারপর সিগারেটটা সুব্রতর দিকে বাড়িয়ে চোখের ইশারায় বললে, নে।

সুব্রত বলল, না, আমার দরকার নেই।

অনিন্দ্য এবার দম-চাপা গলায় এক ধমক নিয়ে বলল, নে, না শালা।

মেঝেতে বসে পোস্টার লিখছিল অরবিন্দ, সে বলল, আমায় একটু দিয়ে গুরু!

সুব্রত সিগারেটটা নিয়ে দুর্বলভাবে টানতে লাগল। ধোঁয়া ভেতরে নিচ্ছে না। দু-বার টেনেই সেটা নীচে অরবিন্দর দিকে এগিয়ে দিল। অনিন্দ্য চোখ বুজে ধ্যানী-সন্ন্যাসীর মতন বসে আছে।

সিগারেটটা এ-রকম দু-তিনবার হাত ঘুরতে লাগল। অনিন্দ্য এরই মধ্যে আরও খানিকটা গাঁজার পাতা হাতের তালুতে নিয়ে গুঁড়ো করছে।

একবার একটু ধোঁয়া ভেতরে চলে যেতেই সুব্রত কেশে উঠল। ঘা লেগেছে ব্রহ্মতালুতে, কাশি আর থামেই না। অনিন্দ্য তার মাথায় আস্তে আস্তে চাপড়া মারতে মারতে বলল, সুব্রতটা একেবারে মেয়েছেলের হদ্দ।

অরবিন্দ বলল, ও-কথা বোললা না। ও-কথা বোললা না। মেয়েরাও আজকাল ফাটাচ্ছে! শিখাকে দেখেছ তো? একটানে ফাঁক করে দেয়। তুমিও হেরে যাবে গুরু।

অনিন্দ্য মুখটা বেঁকিয়ে বলল, রাখ তোর শিখার কথা! তুই ঝেড়েছিস?

না, মাইরি।

চান্স পাসনি? অনেকেই তো…

তুমি? সত্যি করে বলো তো…

আমার দরকার নেই। আমি ভাবছি সুব্রতকেই…

অনিন্দ্য সুব্রতর কাঁধে হাত দিয়ে তাকে কাছে টানার চেষ্টা করতেই সুব্রত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এই কী হচ্ছে কী?

অরবিন্দ হাসতে লাগল আলজিভ দিয়ে। তারপর চেঁচিয়ে উঠল, যাঃ! দিলি তো। সবটা নষ্ট করে দিলি তো!

সুব্রতর পায়ের ধাক্কা লেগে রঙের কাপটা উলটে গেছে। সুব্রত সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হয়ে পড়ল। সবসময়েই সে এ-রকম একটা কিছু গোলমাল করে ফেলে। অরবিন্দ বলল, যাক গে, লেখা আমার প্রায় ফিনিশ।

অনিন্দ্যর মুখ লালচে হয়ে গেছে। চোখে একটা ঝিমঝিম ভাব। তৃতীয় সিগারেটটা নিয়ে সে পরম সুখে টানছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, শিখা নাকি অশ্রুবিন্দুর সঙ্গে দিঘা গিয়েছিল?

অরবিন্দ উদগ্রীব হয়ে বলল, তাই নাকি? কে বলল?

সুব্রত বলল, তোরা কী যে সব আজেবাজে বানিয়ে বানিয়ে বলিস! শিখা মেয়েটা ভালো, স্মার্ট, কারুকে বিশেষ পাত্তা দেয় না, সেইজন্যই তোরা…

অপর দু-জন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, কী রে পিরিত আছে নাকি তোর? চিঠিফিটি লিখেছিস?

অনিন্দ্য বলল, খুলে বল না। অন্যের মালের দিকে আমরা নজর দিই না।

যাঃ, সেসব কিছু নয়। আমি জানি শিখা মেয়েটা ভালো।

আমরাও তো বলছি মালটা ভালো।

তোরা সব মেয়েকেই বুঝি ওইরকম ভাবিস?

অরবিন্দ হঠাৎ রেগে উঠে বলল, আরে ওসব ঝান্ডু পার্টি আমার অনেক চেনা আছে। পরপর চার বার দিলে চোট খেয়েছি। এখন স্রেফ বুঝে গেছি, ধর তক্তা, মার পেরেক। অনেক হাই হাই টক শুনেছি, সেইসব ফোতো কাপ্তেনকে একবার ধুবুড়িয়াবাগানে সাইডিং করে দেখ তো কীরকম খিচে রড দেয়—

বাইরে দরজায় খট খট শব্দ হল। অরবিন্দ চেঁচিয়ে উঠল, কে?

আমি। খোল না।

অনিন্দ্য খাট থেকে তড়াক করে নেমে বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, আগে খুলিস না।

ঘরের দেওয়ালে একজোড়া ইলেকট্রিকের তার ঝুলছিল। জ্যান্ত তার। অনিন্দ্য সেই তারজোড়া টেনে এনে সামনের খোলা মুখটা দরজার লোহার হাতলের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিল। তারপর বলল, কাম ইন!

ও দিক থেকে সুখময় দরজার হাতল ছুঁতেই শক খেল এবং চেঁচিয়ে উঠল, উরেঃ বাবারে!

ঘরের মধ্যে তিনজন বেদম হাসছে। অনিন্দ্য দরজা খুলে বলল, কীরকম চুপকি দিলাম! সুখময় হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, এসি না ডিসি? ওফ!

এসি হলে খোপড়ি উড়ে যেত।

এ-রকম বাজে ইয়ার্কি করিস কেন বল তো! অনিন্দ্যটা…

নিশ্বাসে ঘরের হাওয়ার গন্ধটা নিয়ে সুখময় বলল, গাঁজা টানছিলি নিশ্চয়ই? তোদের নিয়ে আর পারি না। হাতে এত কাজ রয়েছে এখন…

অরবিন্দ জিজ্ঞেস করল, কাল তাহলে পরীক্ষা হচ্ছে না তো?

সুখময় গম্ভীর হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে চোখ বুলিয়ে নিল একবার। অনিন্দ্যর সারা ঘরে বইপত্র ছড়ানো। কোর্সের বই ছাড়াও নানা ধরনের বই পড়ে সে। বারট্রাণ্ড রাসেলের আত্মজীবনী, চীন বিষয়ে এডগার স্নো, এমনকী প্লে বয় ম্যাগাজিন পর্যন্ত। সুখময় একটা ভোলা বই বন্ধ করে দিয়ে ভারী গলায় জানালো না! আমরা আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছি। ৮ জুলাইয়ের আগে পরীক্ষা হবে না। পোস্টারগুলো লিখেছিস তো?

সব ফিনিশ।

আজ রাত্তিরেই পোস্টারগুলো মেরে দিয়ে আসবি, না কাল সকালে? তা

রপর সুখময় আর অরবিন্দ গভীর গুরুত্বের সঙ্গে পরীক্ষা বন্ধ করার পরিকল্পনা আঁটতে লাগল। কারা কারা দলে আছে, কারা কারা নেই। দু-একটা রাঙালুমার্কা ভালো ছেলে পরীক্ষা দেবেই বলছে, কিন্তু তাদের ঠাণ্ডা করতে অসুবিধে হবে না। দু-চারবার ধড়কান দিলেই ভয়ে পালাবে। পরীক্ষার আগে ইলেকশানটা করে যেতেই হবে।

অনিন্দ্য আলোচনায় অংশ না নিয়ে চুপ করে বসে আছে। সুব্রত পোস্টারগুলো গুছিয়ে তুলছে। পরীক্ষাটা একটু পিছোননা খুবই দরকার।

সুখময় বলল, অনিন্দ্য তুই-ও দু-একটা পোস্টার লাগাবি তো?

অনিন্দ্য বলল, ছিঁড়ে ফেল।

বাকি তিনজনের কেউ ওর কথার মানে বুঝতে পারল না।

অনিন্দ্য নিজেই ওদের বুঝিয়ে দিল, পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেল, দরকার হবে না। কাল পরীক্ষা হবে।

তার মানে?

অরবিন্দ বলল, গাঁজার ঝোঁকে কী যা তা বলছ গুরু। কাল পরীক্ষা হবে, বললেই হল? এ কী, ও ঘুড়ি তোর বিয়ে?

অনিন্দ্য হুংকার দিয়ে বলল, আলবত হবে। কালই পরীক্ষা হবে।

সুখময় বলল, জল খা, এক গেলাস জল খা। নেশা তোর মাথায় চড়ে গেছে।

নেশা-ফেশার কথা হচ্ছে না। আমি কাল পরীক্ষা দেব।

নিজে আমাদের উসকে দিয়ে এখন পেছন থেকে ল্যাং মারছিস?

ইউনিয়নের ইলেকশানের আগে পরীক্ষা হলেই হল? নেক্সট ইয়ারে তাহলে আমাদের পজিশানটা কী হবে?

পরীক্ষা হয়ে গেলে নেক্সট ইয়ারে তো আমরা থাকছিই না।

তা বলে ইউনিয়নটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে?

সে অন্য ছেলেরা বুঝবে! আমাদের কি চিরকাল থেকে যেতে হবে নাকি?

অরবিন্দ কাঁচুমাচু গলায় বলল, ইলেভনথ আওয়ারে এ-রকম মত বদলাবার কোনো মানে হয়? কী করে পরীক্ষা দেব, কোনো প্রিপারেশান নেই—তোমার মতন ব্রিলিয়ান্ট ছেলের তো কোনো অসুবিধে নেই…

হাসাসনি অরবিন্দ, হাসাসনি। পাশ করার জন্য আবার প্রিপারেশান লাগে নাকি? আমি তো ফার্স্ট ক্লাস পাবই। অসুবিধে হবে এই সুব্রতদের মতন মিডিয়োকারদের। ও খেটেখুটে পড়াশুনো করে যা রেজাল্ট করবে, তোরা টুকেও তাই করবি।

সুখময় কঠোরভাবে বলল, ওসব মাকড়াবাজি ছাড়। কাল পরীক্ষা হবে না, বলে দিয়েছি, হবে না।

অনিন্দ্য বলল, আমি কাল পরীক্ষায় বসব। দেখি কোন শালা আমায় আটকায়।

আমরা আটকাব।

আরে যা যা। তোদের মতো ভুক্কার পার্টি আমার অনেক দেখা আছে।

অনিন্দ্য মাথাগরম করিস না মাইরি, তোকে এখনও বলছি…

ভাগ এখান থেকে। মেলা বকবক করিস না, মাথা ধরে যাচ্ছে।

অনিন্দ্য!

আমি কালা নই। চেঁচাবার দরকার নেই।

সুখময় সদর্পে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আচ্ছা, দেখব কাল তোর মুরোদ। চল অরবিন্দ।

অরবিন্দ সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, আয়!

অনিন্দ্য সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, না তুই থাক।

সুব্রত দোটানায় পড়ে গেল। সে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছে।

সুখময় জাদুকরের মতন দৃষ্টি দিয়ে সুব্রতকে আবার জিজ্ঞেস করল, কী রে, তুই আসবি না?

অনিন্দ্য ধমক দিয়ে বলল, তোরা যা-না, সুব্রত এখন এখানে থাকবে।

সুখময় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কীরে সুব্রত, তুই যে মাগের অধম হয়ে গেলি। ভয় খাচ্ছিস? আসবি না আমাদের সঙ্গে? ঠিক আছে, এমন হুড়ো দেব, বুঝবি পরে–

সুব্রত কোনো কথা না বলে মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সুখময়রা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অনিন্দ্য খাটের তোশকটার এককোণ তুলে আর একটা কাগজের পুরিয়া বার করল। আবার একটা গাঁজা সিগারেট সাজতে লাগল।

সুব্রত চেয়ারে বসে পড়ে বলল, সত্যিই তুই কাল পরীক্ষায় বসতে চাস?

হ্যাঁ, কেন, তুই পরীক্ষা দিবি না?

চার-পাঁচ দিন ধরে তো কিছুই পড়লাম না। তারা সবাই মিলে বললি—

যা আগে পড়েছিস তাতেই হবে।

তোর কথা আলাদা, তুই ভালো ছেলে।

অনিন্দ্য হা-হা করে হাসল। তার হাসিতে সবসময় একটা বিদ্রুপের ভাব থাকে। যেন গোটা বিশ্বসংসারের সবাই নির্বোধ, সে একা দূর থেকে সব কিছু দেখছে।

কাল ওরা গেটে পিকেটিং করবে।

করুক। দেখবি বেশিরভাগ ছেলেই পরীক্ষা দিতে চায়। হুড়মুড় করে ঢুকে গেলে কেউ আটকাতে পারবে না।

আমিও তো পরীক্ষা দিতেই চেয়েছিলাম। কত কষ্ট করে বাড়ি থেকে আমার পড়ার খরচ জোগাচ্ছে, এরপরেও যদি একটা বছর নষ্ট হয়।

অনিন্দ্যর অবশ্য এ সমস্যা নেই। তার বাড়ি বেশ অবস্থাপন্ন। টাকাপয়সার প্রসঙ্গ সে পছন্দ করে না।

সিগারেটটায় শেষটান দিয়ে সে হঠাৎ খাট থেকে নেমে পড়ে বলল, চল।

কোথায়?

শিখার বাড়িতে।

এখন? রাত নটা বাজে।

তাতে কী হয়েছে?

না, আমি এখন বাড়ি যাব।

মেয়েমি করিস না তো! তোর কি বাড়ি ফেরার সময়ের ডেডলাইন আছে নাকি?

কাল পরীক্ষা দিলে আজ একটু পড়তে হবে না?

লাস্ট মোমেন্টে পড়াশুনো করে কেউ দিগগজ হয় না।

তারপরই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে সুব্রতর থুতনি ধরে আদর করে বলল, মানতু সোনা! তুই মেয়ে হলি না কেন মাইরি?

লজ্জারুণ মুখে সুব্রত বলল, যাঃ এ-রকম করিস না। আমার ভালো লাগে না।

শিখাদের বাড়ি যোধপুর পার্কে। সারাবাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। কে জানে কোন ঘরে শিখা থাকে। শিখাদের বাড়ির ছাদের ওপর যে-আকাশ সেখানে অনেক বেশি তারা। বাড়ির দু-পাশে দু-টি নারকোল গাছ তাদের পাতা নেড়ে নেড়ে বাড়িটিকে হাওয়া দিচ্ছে।

বসবার ঘরে দু-জন প্রৌঢ় বসেছিলেন। একজন শিখার কাকা, অপর জন তাঁর বন্ধু। শিখার কাকা দরজা খুলে দিলেন।

সুব্রত একটু লাজুক চোর চোর ভাব করেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। অনিন্দ্য এগিয়ে এসে বলল, শিখা আছে?

একটু থেমে, শিখার কাকার অব্যক্ত কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যই সে আবার বলল, আমরা ওর ক্লাসফ্রেণ্ড।

ডেকে দিচ্ছি, ভেতরে এসে বোসো।

শিখার কাকা ভেতরে ডাকতে গেলেন। অপর ভদ্রলোকটি বসে বসে হাঁটু দোলাচ্ছেন। অনিন্দ্য তাঁর দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল। বন্ধুরা সবাই জানে, বুড়ো খচাতে অনিন্দ্য দারুণ ওস্তাদ।

অনিন্দ্য সবসময় তাঁর চোখে চোখ ফেলে রাখায় ভদ্রালোক একসময় অস্বস্তিতে উঠে চলে গেলেন বাইরে। অনিন্দ্য আবার সেই বিদ্রুপ মিশিয়ে হাসল।

শিখার চুলগুলো একবেণি করে বাঁধা। একটা আটপৌরে শাড়ি পরা, মুখে ঘাম। সে বেশ লম্বা, কাটালো নাক ও থুতনি, স্পষ্টচোখ মেলে তাকাতে জানে। ঘরে ঢুকে সে ঝপাং করে একটা সোফায় বসে পড়ে ঈষৎ ঝাঁঝালো গলায় বলল, কী ব্যাপার? তোমরা এখন?

অনিন্দ্যর চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু হয়ে এসেছিল। সে বলল, পড়ছিলি?

পড়ব না তো কী করব?

যদি কাল পরীক্ষা শুরু না হয়!

তোমরা বুঝি সেই ঘোঁট পাকাতে এসেছ?

সুব্রত তাড়াতাড়ি বলল, না, না, আমরা জানাতে এসেছি কাল পরীক্ষা হবেই।

শিখা বলল, সে-কথা বুঝি টেলিফোনে জানানো যেত না?

অনিন্দ্য বলল, তবু ইচ্ছে হল, তোমাকে একবার দেখে যাই।

শিখা চঞ্চলভাবে শরীর মুচড়ে বলল, ঠিক আছে, দেখা তো হয়েছে, এবার কেটে পড়ো। আমার অনেক পড়া বাকি আছে।

যতই পড়ো, আমাকে বিট করতে পারবে না!

বুঝেছি! সেইজন্যই বুঝি তোরা আমার পড়া নষ্ট করতে এসেছিস?

সুব্রত বলল, না, না, আমরা এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। আমরা শুধু বলতে এলাম, কালকে সুখময়রা পরীক্ষা ভণ্ডুল করার চেষ্টা করতে পারে–কিন্তু আমরা পরীক্ষা দেবই।

সে তোরা না বললেও আমি পরীক্ষা দিতামই। এবার তো পুলিশ গার্ড থাকবে।

অনিন্দ্য জড়ানো গলায় বলল, সেই কথাই তো বলছি, সবাইকে খবর দিতে হবে, সবাইকে তৈরি হয়ে আসতে হবে।

তৈরি হওয়া মানে কী? বোমা-টোমা নিয়ে যাবে নাকি? তাহলেই সেরেছে।

না, না, সে-কথা বলছি না, অন্তত কলম তো নিয়ে যাবে। পরীক্ষা দিতে যাবে, অথচ সঙ্গে যদি কলমটাও না থাকে।

শিখা হেসে বলল, বুঝেছি। এবার ওঠো।

তাড়াচ্ছিস কেন? এক কাপ চা খাওয়াবি?

চা, এতরাত্রে?

কেন, চা খায় না লোকে? মাল তো খেতে চাইনি।

তোদের এইসব কথা শুনে আমার বিচ্ছিরি লাগে।

সুব্রত খুব অস্বস্তি বোধ করল। শিখার সামনে এলেই তার বুকের মধ্যে একটু একটু কাঁপে। শিখাকে তার কত কথা বলার আছে। কিন্তু কিছুই বলা হয় না। শিখা তাকে একদিন কলেজ স্ট্রিট থেকে একটা বই কিনে আনতে বলেছিল, তাতেই সে ধন্য হয়ে গেছে। সে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইল শিখার দিকে। শিখার ব্রা-র স্ট্র্যাপটা ব্লাউজের বাইরে বেরিয়ে এসেছে, সেটা হাত দিয়ে ভেতরে সরিয়ে দিয়ে শিখা সুব্রতকে বলল, তোমাকে তো আমি ভালো ছেলে বলে জানতাম। তুমিও এইসব খাচ্ছ নাকি? তোমার বন্ধুকে এবার নিয়ে যাও।

সুব্রত বলল, এই অনিন্দ্য, ওঠ।

অনিন্দ্য আর কথা বলতে পারল না। চোখ বুজে চেয়ার থেকে ঢলে পড়ল।

মাটিতেই পড়ত। সুব্রত তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল তাকে। শিখাও ধড়ফড় করে উঠে এল। অনিন্দ্যর রক্তবর্ণ চোখ দেখে সে ব্যাপারটা বুঝে ফেলে আন্তরিক দুঃখিত গলায় বলল, কাল পরীক্ষা আর আজও তুই নেশা করেছিস? ছিঃ, তোদের লজ্জা করে না?

কোনোক্রমে সিধে হয়ে বসার চেষ্টা করে অনিন্দ্য বলল, লজ্জা করবে কেন? লজ্জা তো নারীর ভূষণ। তোরই যখন সেই ভূষণ নেই–এই বলে সে শিখার আঁচল খসে-পড়া বুকের দিকে তাকালো। শিখা কঠোরভাবে সুব্রতকে বলল, একে বাড়ি নিয়ে যাও।

তৎক্ষণাৎ অনিন্দ্য, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে মানুষের মতো সোজা হয়ে বলল, যাচ্ছি। কাল দেখা হবে, রণক্ষেত্রে।

অনিন্দ্যকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে সুব্রত বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। তাদের বাড়ি এরমধ্যেই নিঝুম হয়ে পড়ে। শুধু দোতলার খাবার ঘরে মা একা জেগে বসে বসে একটা মাসিক পত্রিকা পড়ছেন।

খুব মৃদুগলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? সুব্রতও খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে উত্তর দিল, অনিন্দ্যর সঙ্গে পড়াশুনো করছিলাম।

কাল তোদের পরীক্ষা আরম্ভ না?

হ্যাঁ। সেইজন্যই তো, অনিন্দ্যর কাছে অনেক নোটস আছে, দু-জনে একসঙ্গে না পড়লে—

পরীক্ষায় কোনো গোলমাল হবে না তো?

না, কিছু না।

ভালো করে পরীক্ষা দিস, পাশটা করলে..একটা মানুষ এত খাটছে, কতদিন আর টানবে এত বড়ো সংসারটা…

সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, তুমি চিন্তা কোরো না।

সুব্রত নিঃশব্দে রুটি-তরকারি খেয়ে যেতে লাগল। একবারমাত্র মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কোনো চিঠি আসেনি?

মা বললেন, না।

হাত ধুয়ে সুব্রত ওপরে উঠে গেল। তিনতলায় একটিমাত্র ঘর। এই ঘরটা তার একার। আগে এই ঘরটা তার দাদার ছিল, এখন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে।

ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই নিয়ে সে চলে এল ছাদে। সারাদিনে সে তিন-চারটের বেশি সিগারেট খায় না।

রাত্তিরের এই সিগারেটটাই তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। ছাদে পায়চারি করতে করতে সে একা একা কথা বলে।

সুব্রত খেলাধুলো কোনোটাই ভালো পারে না, রাজনীতিতে পিছু হঠে আসা ছেলে, পড়াশুনোয় মাঝারি। বন্ধুরাও যখন-তখন তার মাথায় হাত বুলোয়।

আকাশের দিকে তাকালে নিজেকে আরও ছোটো মনে হয়।

ছাদে পায়চারি করে করে সুব্রত শরীরটাকে চাঙ্গা করে তুলল। আজ সে সারারাত পড়বে। সব বইগুলোতে একবার অন্তত চোখ না বুলেলে চলবে না। পাশটা করতেই হবে। শিখা নিশ্চয়ই এখনও পড়ছে। অনিন্দ্যটা কখন যে পড়ে কেউ জানতে পারে না। লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিক কাজ সেরে নেয়।

সিগারেটের শেষ টুকরোটা সে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে চলে এল। ল্যাস্কির বইটা খুলে সবেমাত্র লাল দাগ দেওয়া জায়গাগুলো খুঁজতে শুরু করেছে, এমন সময় আলো নিবে গেল। বিদ্যুৎ বন্ধ।

বইটা টেবিলের ওপর ছুড়ে দিয়ে সুব্রত বলল, ধুর শালা!

এখন আবার মোমবাতি খুঁজতে হবে। মোম খোঁজার বদলে সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল চেয়ারে। তারপর হঠাৎ ক্রুদ্ধভাবে প্যান্টের বোতামগুলো খুলে চেপে ধরল নিজের পুরুষাঙ্গ। এবং যাবতীয় মোহময়ী চিত্রতারকাদের কথা চিন্তা করতে লাগল খুব মন দিয়ে। একটু বাদেই তাদের সকলেরই মুখ হয়ে গেল শিখার মতন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *