তৃতীয় পরিচ্ছেদ
দিন কয়েক পরের কথা।
ভোরবেলা। সূর্য উঠি-উঠি করিতেছে। গোয়াল-বাড়িতে বলদ জোড়াটার কাঁধে হাল চাপাইয়া বাঁধিতে বাঁধিতে মহাতাপ গান ধরিয়া দিয়াছিল।
মালসা মারিয়া কাপড় পরিয়াছে। মাথায় রঙিন গামছা বধিয়াছে। পাশে ওধারে লাঙল নামানো। একটা ধানের বীজের ঝুড়ি। দুইখানা কোদাল। কো-কক্কে। একটা ছোট চটের থলে।
কৃষাণ নোটন সাহায্য করিতেছে।
হাল জোতা হইলে মহাতাপ বার দুই সস্নেহে গরু দুইটার গায়ে হাত বুলাইয়া দিল। তারপর একটা ছোট টুকরিতে কিছু খইল লইয়া একটার মুখের কাছে ধরিল। গান চলিয়াছে। একটার মুখের কাছে খইল ধরিতেই অপরটা গন্ধে চঞ্চল হইয়া উঠিল স্বাভাবিকভাবে। মহাতাপ সমের মাথায় ধমক দিল তাহাকে ধ্যাৎ তেরি!
ইতিমধ্যে বাড়ির ভিতর হইতে বধূ দুইটি, দুইটি ঘড়া কাখে লইয়া কাঁধে গামছা ফেলিয়া স্নানে বাহির হইল।
বড়চাঁপাডাঙার বউ যাইতে যাইতে দাঁড়াইল। হাসিয়া বলিল, ঘরদোর চাষবাস বলে তা হলে মনে পড়ল ছোট মোড়লের এত দিনে? চার দিন গাজননাচন নেচে–পাঁচ দিন ঘুম।
মানদা বলিল, ক ঘটি ভাঙ খেয়েছিল শুধাও।
মহাতাপ বলিল, ফের ব্যাড়ব্যাড় করে। একদিন কেবল ওই কথা, ব্যাড় ব্যাড়—ব্যাড়র ব্যাড়রক ঘটি ভাঙ খেয়েছ? ভাঙ কেউ হিসেব করে খায় নাকি?
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, তা খায় না, কিন্তু ছেলেবেলায় অসুখ করে যার মাথা দুর্বল, সে ভাঙ খায় কেন? কথাটা মনে থাকে না কেন?
মহাতাপ বলিল, এই কান মলছি। বুয়েচ কিনা। সত্যই সে কান মলিয়া বসিল—ওই ঘোঁতনা শুয়ার, আর ওই বেচা শেয়াল, ওই ওরাই—ওরাই যত অনিষ্টের মূল।
কথার উপরে কথা কহিয়া মানদা বলিল, ওরাই যত অনিষ্টের মূল। কচি খোকা। ওরা ঝিনুকে করে খাইয়ে দিয়েছিল।
—দেখ বউদিদি, দেখ। তুমি দেখ। তুমি বল ওকে—এমন করে কেন? কেমন করে দেখ। দেব আষিঢ়ে কিল পিটে বসিয়ে, হাঁক লেগে যাবে।
বলিয়া আগাইয়া গিয়া লাঙলটা কাঁধে তুলিয়া লইল।–চল্ রে চল, নোটন?
নোটন ইতিমধ্যে তামাক সাজিতে গোয়ালের ভিতর ঢুকিয়াছিল। তাহাকে না পাইয়া সে চিৎকার করিয়া ডাকিল, নোটনা। বলি অ—বুড়ো হনু।
বড় বউ বলিল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, মানুর ওপর রাগ করে পালিয়ে গেলে হবে না। আমার একটা কথার জবাব দাও তো। ঘোঁতনাকে ধানটা ছেড়ে দিয়ে এলে, ঘোঁতনার মায়ের কথায় দয়া হল, তা বুঝলাম। কিন্তু একবার জিজ্ঞাসাও তো করে। দাদা রয়েছে। কি কথা বল না যে?
—কি বলব কি? বলতে গেলে, তোমার স্বামীর নিন্দে করতে হবে।
–কার?
–তোমার ইয়ের, বরের। আবার কার!
খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল চাঁপাডাঙার বউ।
মহাতাপ ওদিকে নাকে ঘড়াত শব্দ করিয়া গরু দুটার পিঠে হাত দিয়া তাহাদের চালাইয়া দিল।
বাড়ির বাহিরের দাওয়ায় রাস্তার সামনে সেতাব বসিয়া চেঁড়া ঘুরাইয়া শণের দড়ি পাকাইতেছিল। তাহার সামনে রাস্তার উপর দিয়া মহাতাপ হালগ লইয়া চলিয়া যাইতেছিল। দাওয়ার উপর মানিক একটা মাটির পুতুল লইয়া খেলা করিতেছে। রাখালটা কল্কেতে তামাক সাজিয়া ফুঁ দিতেছে। একটা খুঁটিতে একটা ছাগল বাধা, পাতা খাইতেছে। বাচ্চা দুইটা পাশে ঘুরিতেছে। সেতাব বলিল, কতটা বীজ ফেলবি আজ?
—জোলের দু আড়াতে ফেলাব।
–দু আড়া?
–হাঁ তো কি! তোমার মত মরা খেটে নাকি আমি?
–তা না হয় তু ভীম ভৈরবই হলি! কিন্তু এক দিনে এত ক্যানে?
–বাত চলে যাবে।
–বাত চলে যাবে সে জ্ঞানটা ভাঙ খাবার সময় থাকলে ভাল হত।
–ফ্যাঁচফ্যাঁচ কোরো না বেশি। এই বেটা গরু, চল না ক্যানে। আবার নাকে ঘড়াত শব্দ করিয়া গরু দুইটার পিঠে পাঁচনের টিপ দিল এবং চলিয়া গেল।
সেতাব ডাকিল, মানকে!
–উঁ!
–বাবার মত খবরদার হবারাম হবি নে বেটা। লোককে পাওনা ছেড়ে দিয়ে আসবি না।
–আমি ছিব হব।
–না। হবি না। খবরদার!
–কি হব?
–আমার মত হবি।
–না, তুমি ছাই। রোগা—
–ওরে বেটা, বুদ্ধিতে আমার মত হবি। অঙ্ক শিখবি। কাউকে এক পয়সা ছাড়বি না।
–পয়সা দাও।
–ওরে বেটা, অনেক পয়সা জমিয়েছি তোর জন্যে। সব তোর জন্যে, বুঝলি?
–কাউকে দেব না।
–হ্যাঁ। কেউ আমাকে দেয় নি, কেউ ছাড়ে নি মানকে। বাবা দেনা করেছিল, কেউ ছাড়ে নি। বুঝলি? আর পরিবারের কাছে টাকা নিবি না। তোর বড়মা দেনার সময় গয়না দিয়েছিল দেনা শোধ করতে। তার পাপ আমাকে আজ ভুগতে হচ্ছে। খবরদার মানকে। হাঁ।
রাখালটা হুঁকা-কল্কে সেতাবের হাতে দিল।
সেতাব বলিল, শোন, তু একবার ঘোঁতন ঘোষের বাড়ি যাবি, বুঝলি? বলবি পঞ্চায়েত মোড়লেরা একবার ডেকেছে। বুঝলি?
রাখালটা বলিল—সে আসবে না গো। বড় ত্যাঁদড় নোক ঘোঁতন।
—তা হোক, তু যাবি। আমি বলছি—তু যাবি। আসে না-আসে আমি বুঝব। এই কাগজখানা দিবি।
রাখালটা বলিল, তা হলে এখুনি যাই। নইলে ঘোঁতন মুড়ি খেয়ে বিড়ি টানতে টানতে বেরিয়ে যাবে, আর সেই ভাত খাবার বেলা পর্যন্ত পাব না।
ঘোঁতনের বাড়ি গোপডাঙায়। ঠিক পাশের গ্রামে।
এই গ্রাম ও আধাশহর লক্ষ্মীপুরের মাঝখানে গোপডাঙা–ছোট একখানি গ্রাম। লক্ষ্মীপুরেরই কাছাকাছি বেশি। লক্ষ্মীপুর অনেকদিনের সমৃদ্ধ গ্রাম। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-প্রধান সমাজ। গোপডাঙার টানটা চিরকাল ঐ দিকেই বেশি। ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থ বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোকেরা গোপডাঙার চাষীদের এবং গোপদের উৎপনের পুরনো খরিদ্দার। গোপডাঙার তরিতরকারি এবং দুধ, দুই লক্ষ্মীপুরের অন্নকে পঞ্চাশ না-হোক বেশ কয়েক প্রকার ব্যঞ্জনে সমৃদ্ধ করিয়াছে। এবং গুড় ও দুধ সহযোগে পরমানু না হোক পায়সানে পরিণত করিয়াছে। শুধু তাই নয় এই গ্রামের চাষীরাই। বরাবর ব্রাহ্মণ কায়স্থদের জমিজেরাত ভাগে ঠিকায় করিয়া আসিয়াছে। এবং সেকালে ইহা হইতেই তাহাদের দু-চার জন বছরে নিজের খামারে একটা মরাই-ও বাঁধিয়াছে আবার অজন্মার বছরে ঠিকার ধান শোধ না করিতে পারিয়া খতও লিখিয়াছে। খতের আসল, সুদে বাড়িয়া। তাহাদের পৈতৃক জমি বিক্রয় করিতে বাধ্য করিয়াছে। এ সব পুরনো কথা। তাহার পর মাঝে একটা সময় আসিয়াছিল যখন লক্ষ্মীপুরের ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বাঁড়ুজ্জে মশায়, মুখুজ্জে মশায়, বোস মশায়, ঘোষ মহাশয়ের সকলেই ও-সব উপাধি ছাড়িয়া বাবু মশাই ইলেন; ঘরে ঘরে তক্তপোশ-ফরাসের বদলে চেয়ার-টেবিল হইল, টোল পাঠশালা উঠিয়া গল, ইংরিজি ইস্কুল হইল, বাবুরা শহরে চাকরি ধরিল। উকিল হইল, মোক্তার হইল, ডাক্তার হইল। শরবত ছাড়িয়া চা ধরিল, হুঁকার সঙ্গে সিগারেট ঢুকিল, তখন লক্ষ্মীপুরে খানসাম র চাহিদাটা বাড়িয়া গেল। এই সময় গোপডাঙার অনেকে চাষের মত অভদ্র কাজ ছাড়িয়া এই শৌখিন কাজে ঢাকিল। ছোট বড় করিয়া চুল ইহারাই প্রথম ঘটিল, চাদরের বদলে কামিজ আমদানি করিল। কাছেই বক্রেশ্বর নদী ইহার পর বক্রেশ্বর নদী দিয়া অনেক জল বহিয়া গেল। শুধু বহিয়াই গেল না, বন্যায় চারিপাশ ড়ুবাইয়া দিয়াও গেল। চাষের জমিতে পলিও পড়িল, বালিও চাপিল। সেতাবদের গ্রাম নয়নপুরের চাষীরা বালি-পড়া জমির বালি তুলিল, পলি-পড়া জমিতে সোনা ফলাইল। কিন্তু গোপডাঙার চাষীরা চাষ একেবারে তুলিয়া না দিলেও ওই জীবিকার উপর আস্থা হারাইল। তাহারা চাষের সঙ্গে এটা ওটা ব্যবসায়ে হাত দিল। কেহ নবগ্রামে দোকান করিল। মুদির দোকান, বিড়ির দোকান ইত্যাদি এবং ছেলেদের ইস্কুলে ভর্তি করিয়া দিল। দুই চারটি ছেলে ম্যাট্রিক পাস করিল, একজন এম এ পাস করিল, একজন বি-এল হইল এবং গোপডাঙার বাস উঠাইয়া কর্মস্থল শহরে চলিয়া গেল। ঘোঁতনের বাবা গোপাল ঘোষ নিজে চাষবাসের সঙ্গে পাইকারি অর্থাৎ ধানের দালালির কাজ ধরিয়াছিল। লক্ষ্মীপুরের বণিকদের কাছে টাকা লইয়া গ্রামে গ্রামে ধান কিনিত এবং সেই ধান গাড়ি বোঝাই করিয়া বণিকদের গদিতে পৌঁছাইয়া দিত। কিছু লাভ থাকিত দরের মাথায়, আর কিছু থাকিত ওজনের মাথায়। খরিদ্দারের ঘরে হাতের টিপে যে ওজনটা সে লাভ করিত—সেইটার দাম মিলিত। ইহার উপর আছে কিছু ঢলতা—কিছু আছে। ঈশ্বরের নামে বৃত্তির ভাগ। ঘোঁতনকে ইস্কুলে দিয়াছিল। ঘোঁতন ও সেতাব কয়েক ক্লাস একসঙ্গে পড়িয়াছিল। ঘোঁতন ছেলে মন্দ ছিল না, সেতাবের মত সে এম্কে অ্যাম, একে অ্যান, একে অ্যাল বলিত না। চোস্ত উচ্চারণ ছিল তার। লক্ষ্মীপুরের বাবুদের ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলিত, স্কুলে ডিবেটিং ক্লাবে ডিবেট করিত। ভাল আবৃত্তি করিতে পারি। লক্ষ্মীপুরের থিয়েটার ক্লাবের রিহারস্যালের দিন হইতে অভিনয়ের দিন পর্যন্ত নিয়মিত আড়ালে-আবডালে থাকিয়া শুনিত, শিখিত। ক্লাবের লাইব্রেরি হইতে নাটক নভেল পড়িত। লোকে বলিত ছেলেটির ভবিষ্যৎ আছে। মাস্টাররাও আশা করিতেন, ঘোঁতন অন্তত সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করিবে। মন দিয়া পড়িলে ফার্স্ট ডিভিশনেও যাইতে পারবে।
হয়ত পারিত। কিন্তু গোপাল ঘোষ মরিয়া সব গোলমাল হইয়া গেল। ঘোঁতন বন্ধাশূন্য অশ্বের মত ধাবমান রইল। ফার্স্ট ক্লাসে উঠিয়া সে প্রেমে পড়িয়া গেল। মনে মনে সে বেশ কিছুদিন হইতেই প্রেমে পড়িয়াছিল। স্থানীয় মাইনর গার্লস স্কুলের মাইনর ক্লাসের ছাত্রীদের প্রত্যেকটিকেই কিছুদিনের জন্য প্ৰিয়তমা ভাবিতেছিল। কিন্তু জাতের বাধা বা অন্য বাধা স্মরণ করিয়া সে কথা প্রকাশ করিতে পারি না। নিজের খাতায় তাহাদের নাম লিখিত এবং খুব যত্নের সঙ্গে কাটিত। হঠাৎ প্রকাশ্যে প্রেমে পড়িবার সুযোগ জুটিয়া গেল। স্থানীয় সবরেজেষ্ট্রি আপিসেই তাহাদের স্বজাতি এক কেরানী আসিল—এবং তাহার বড় মেয়েটি মাইনর ক্লাসে ভর্তি হইল। লম্বা ধরনের শ্যামবৰ্ণ মেয়ে, বয়স বোধহয় তের-চৌদ্দ; কিন্তু ঘোতনের প্রেমে পড়িবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। মাইনর ক্লাসে পড়ে; বেণি ঝুলাইয়া ফেরত দিয়া কাপড় পরিয়া স্কুলে যায়—সুতরাং ইহার চেয়ে অধিক আয়োজন আর কী হইতে পারে লক্ষ্মীপুরে। ঘোঁতন প্রেমে পড়িল, মেয়েটির বাপের সহিত আলাপ করিল। তাহাদের বাড়িসুদ্ধ নিমন্ত্ৰণ করিয়া বাড়ি আনিয়া খাওয়াইল। এই সময়েই উমেশ মণ্ডল কাদম্বিনীর বিবাহের জন্য তোক পাঠাইল। ঘোঁতন তাহাকে সোজা না বলিয়া দিয়া বিবাহ ভাঙিয়া দিল। সবরেজেস্ট্রি অফিসের কেরানীবাবুটি ভীরু। কন্যাদায়গ্রস্ত লোক, সেও ঘোঁতনকে পছন্দ করিল। মাস্টাররা বলেন—ছেলে মন্দ নয়। বাহিরে তো খুব চটপটেস্মার্ট। বাড়ি-ঘরদেরও খারাপ নয়। সুতরাং আকারে ইঙ্গিতে সেই ইচ্ছাই প্রকাশ করিল।
ঘোঁতন খুব উৎসাহিত হইয়া পরীক্ষা দিয়া আসিল। শহরে পরীক্ষা দিয়া ফিরিবার সময় সেলুনে চুল ছটিয়া এক টিন গোল্ডেন বার্ডসাই নামক সিগারেট মিকশ্চার কিনিয়া বাড়ি ফিরিল এবং একদা শুভলগ্নে কেরানীবাবুর মাইনর-পড়া চতুর্দশ কন্যা নীহারিকাকে বিবাহ করিয়া ফেলিল। কিন্তু পরীক্ষার ফল বাহির হইলে দেখা গেল যে গেজেটে থার্ড ডিভিশন অবধি কোথাও ঘোঁতনচন্দ্রের নাম নাই।
ঘোঁতন বলিল—শালারা সব!
শ্বশুর বলিল–আবার ভাল করে পড়।
ঘোঁতন বলিল–না, ও গোলামি লেখাপড়া আমি আর করব না।
ঘোঁতন তখন লক্ষ্মীপুরের থিয়েটারে পার্ট পাইয়াছে। সামনে মাসখানেক পরেই অভিনয়। লক্ষ্মীপুরের ক্লাবের নিয়মানুসারে কোনো স্কুলের ছাত্র পার্ট করিতে পায় না। স্কুলে আবার ভর্তি হইতে হইলে পার্ট ছাড়িতে হইবে। সুতরাং ঘোন কিছুতেই রাজি হইল না, উপরন্তু শ্বশুরের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া শ্বশুরের বাসার পথে হাঁটা বন্ধ করিল এবং কিছু জমি বিক্রয় করিয়া লক্ষ্মীপুরের গোলাম দর্জির সঙ্গে বখরায় একটা কাটা কাপড়ের দোকান করিল, এবং ইউনিয়ন কোর্টে পেটি মামলার তদ্বির আরম্ভ করিল। কিছুদিনের মধ্যে কাটা কাপড়ের দোকানের ভাল কাপড়গুলার জামা পরিয়া দোকানটা গোলামকে বেচিয়া দিল বটে কিন্তু মামলার তদ্বিরে তাহার কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠিত হইল। থিয়েটারেও সে সুনাম অর্জন করিল।
শ্বশুর মেয়ের বাপ, তাহার ইচ্ছা যাই থাক, মনের ইচ্ছা মনে চাপিয়া জামাইয়ের কাছে নতি তাহাকে স্বীকার করিতে হইল, সে জামাইকে বলিল—তুমি তা হলে আর একটা কাজ কর। মামলার তদ্বিরের সঙ্গেই চলবে। সবরেজেষ্ট্রি আপিসে আমি রয়েছি, তুমি সবরেজেষ্ট্রি আপিসে টাউটের কাজ কর। শনাক্ত দেওয়া, দলিল লেখার কাজ কর। তা হলে মধ্যে মধ্যে যখন নকলের জন্যে একস্ট্রা হ্যান্ড দরকার হবে সে কাজও বলে-কয়ে করে দিতে পারব।
এ প্রস্তাবে ঘোঁতন রাজি হইল। এবং এ ব্যাপারেও সে কৃতিত্ব প্রদর্শন করিল। কানে কলম গুঁজিয়া বড়তলায় ঘুরিতে লাগিল। কিছুদিন পর লক্ষ্মীপুরের সাহাদের পঞ্চানন সাহার সঙ্গে জুটিয়া একটা যাত্রার দলও খুলিয়া বসিল। পঞ্চানন সাহা লক্ষ্মীপুরের থিয়েটারে দূত-প্রহরী ছাড়া পার্ট পায় না, অথচ তাহার ধারণা ভাল পার্ট পাইলে নিশ্চয়ই নাম করিতে পারে। মধ্যে মধ্যে এ লইয়া ক্লাবে ঝগড়াঝাটিও করিত পঞ্চানন। হঠাৎ এই ঝগড়া একদিন চরমে উঠিয়া গেল এবং পঞ্চানন ক্লাব ছাড়িয়া দিল। কয়েকদিন পর শোনা গেল, পঞ্চানন সাহা যাত্রার দল খুলিতেছে। পঞ্চাননের পয়সা আছে, যথেষ্ট পয়সা, সে হাজার দুয়েক খরচ করিয়া পোশাক, চুল, বাদ্যযন্ত্রপাতি কিনিয়া ঘোঁতনকে ডাকিয়া বলিলবামুন-কায়েতদের সঙ্গ ছাড়া ও বেটারা আমাদিগকে দূত-প্রহরী সাজিয়ে নিজেরা রাজা-উজির সাজে। আমার দলে আয়, রাজা-উজির সব আমরাই সাজব এখানে। ঘোঁতন আনন্দে জুটিয়া গেল।
পঞ্চাননের দল প্রথমেই পালা ধরিল নাগযজ্ঞ এবং নায়ক তক্ষক নাগের পার্ট দিল ঘোঁতনকে। ঘোঁতন তক্ষক নাগের পার্টে এমন ফেঁসফোঁস করিয়া ফেঁসাইল যে লোকে বাহবা দিল খুব। ঘোঁতন নিজেও খুশি হইল, সত্য বলিতে পালাও জমিল।
বছর খানেক পর পঞ্চাননের শখ মিটিল, হাজার খানেক টাকা লোকসান দিয়া দল তুলিয়া দিল। তুলিয়া দিবার সময় ঘোঁতন বলিলপঞ্চানন-দাদা, দল তুলে দেবে? কিন্তু
–কিন্তু কি? আমার শখ মিটেছে।
–তা হলে আমাকে দিয়ে দাও ওগুলো। আমাদের শখ এখনও আছে।
–কিন্তু টাকা যে অনেক লেগেছে ঘোঁতন।
—তা লেগেছে। কিন্তু পঞ্চানন অপেরায় তোমার নামটা তো থাকবে। আমি টাকা কিছু দোব। আড়াইশো।
শেষ পর্যন্ত চারশো টাকায় রফা করিয়া পঞ্চানন সাহাকেই বিঘা দুয়েক জমি সাতশো টাকায় বেচিয়া ঘোঁতন দলের সরঞ্জাম কিনিল এবং বাড়িতে সামনের চাষের সরঞ্জামের ঘরখানার মেঝে বাঁধাইয়া—দেওয়ালে কলি ফিরাইয়া—বাহিরে পঞ্চানন অপেরার সাইনবোর্ড খাটাইয়া দেখিয়া শুনিয়া বলিল–O. K. ঠিক হয়েছে।
প্রথম বছর দুই-তিন জমজমাট আসর চলিয়াছিল ঘোঁতনের। তখন যুদ্ধ মিটিয়াছে কিন্তু বাজারে তখন অঢেল কাগুজে টাকা। তাহার পর মন্দা পড়িয়াছে। ঘোতনের যাত্রার দলে লোকসান। যাইতে শুরু করিল। ওদিকে রেজেষ্ট্রি অফিসে মন্দা পড়িল। ঘোঁতনের স্ত্রী চার-পাঁচ বছরে তিনটি সন্তান প্রসব করিয়া সংসার বৃদ্ধি করিল, নিজে রোগে পড়িল। বোন পুঁটি বড় হইয়া পনের পার হইয়া পড়িল ষোল বছরে। মা মেয়ের বিবাহের জন্য তাগিদ দিলেও ঘোঁতন চঞ্চল হইল না। স্পষ্ট বলিয়া দিল—আমার টাকা নাই। ইহার মধ্যে আরও বিঘা তিনেক জমি নিলাম হইয়া গেছে। ঘোঁতন আপিল করিয়াছে। তাহার উপর পর পর দুবছর অনাবৃষ্টিতে ফসল নাই। ঘোঁতন করিবেই বা কি? গত বছর সেতাবের কাছে ধান লইয়াছিল। ভরসা করিয়াছিল ওই পাগল মহাতাপের। পাগলটাকে যাত্রার দলে। ঢুকাইতে পারিলে পার্টের লোভ দেখাইয়া অন্তত বছরের খোরাকির ধানটার সংস্থান হয়। কিন্তু যাত্রাটাত্রা মহাতাপ বোঝে না। তার চেয়ে সে সঙ ভালবাসে, সংকীর্তন ভালবাসে। বায়া তবলার চেয়ে খোল বাজাইতে তাহার উৎসাহ বেশি। এবার সেইজন্য মহাতাপকে গাজনের সঙে শিব সাজাইয়াছিল। দশ টাকা দাও লইয়াছে। আবার ধান ছাড়িয়া দিলাম বলিয়া লিখিয়াও লইয়াছে।
***
রাখালটা যখন সেখানে গিয়া পৌঁছিল, তখন ঘোঁতনের মা ঘরের দাওয়াটা মাটি দিয়া নিকাইতেছে। ঘোঁতন চায়ের একটা বাটি লইয়া তক্তপোশের উপর বসিয়া আছে। এক হাতে একটা জ্বলন্ত বিড়ি। রুখু চুলগুলা উড়িতেছে। চোখে উদাস দৃষ্টি। সে ভাবিতেছিল পার্টের কথা।
রাখালটা আসিয়া বলিল, ঘোষবাবু মশায়!
—কে? তাহার দিকে ঘোঁতন তাকাইল।সেতাব মোড়লের রাখাল না তুই?
–হ্যাঁ গো। এই কাগজটা দিলে মুনিব। তোমাকে যেতে বলেছে একবার।
কাগজটা দেখিয়া ঘোঁতন দতে দত টিপিয়া ক্রুদ্ধ মুখভঙ্গিসহকারে বলিল, এক কিলে বেটার দাঁত কটা ভেঙে দোব। নোটিশ এনেছে, পঞ্চায়েতের নোটিশ! ভাগ, ভাগ বলছি! ভাগ!
রাখাল বলিল, তা আমি কি করব? ওই! আমাকে পাঠালে–। ওই–
বলিতে বলিতে সে পিছাইতে শুরু করিল।
ঘোঁতন চায়ের বাটি হাতে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, বেটা ছুঁচোর গোলাম চামচিকে ঘোঁতনের মা ত্রস্ত হইয়া বলিল, ও ঘোঁতন, ওরে! কি হল রে?
—কিপটে কঞ্জুস পেকো সেতাবের রাখাল বেটা নোটিশ নিয়ে এসেছে। পঞ্চায়েতের নোটিশ। I don’t care-ওরে বেটা বলে দিবি, ঘোঁতন ঘোষ dont care I mean does not care.
মা আবার বলিল, ঘোঁতন!
ঘোঁতন বলিল, আমি মাছে পোকা পড়িয়ে দেব। হুঁ, হুঁ,–আমি ঘোঁতন ঘোষ। আমি হোৎ-তা-তা লাঙল ঠেলি না। আকাট মুখ্যু নই আমি। সেতাব মোড়লের বাড়ির কীর্তি ফাঁস করে দোব, গুপ্ত বিন্দাবনের পালা লিখে ছড়িয়ে দেব।
মা এবার কঠিন স্বরে বলিল, ঘোঁতন, তোর মুখ খসে যাবে, ও কথা বলিস নে। ঘোঁতন কি বলিতে চাহিতেছে মুখ খুলিবামাত্র সে তাহা বুঝিয়াছে।
ঘোঁতন ভেঙাইয়া বলিল, আ মলো যা। তোর দরদ উথলে উঠল যে?
তুই যা বলছি, তা আমি বুঝেছি। চাঁপাডাঙার বউ সতীলক্ষ্মী। মহাতাপ বোকা হোক, মুখ হোক, তোর মত ফেশানদুরস্ত ভদ্দনোক না সাজুক, বড় ভাল ছেলে। আমি চোখের জল ফেলে। নিজের দুঃখের কথা বললাম তো এক কথায় পাওনা ধান ছেড়ে দিলে—
–দিলে? এই তো সেতাব মোড়ল পঞ্চায়েতের নোটিশ দিয়েছে।
—দিক। সে যখন বলেছে তখন সেতাব কখনও কথা ফেরাবে না। তার উপর কাদু আছে। সে আমার সইয়ের মেয়ে।
–না। ফেরাবে না। একটা আধপাগলা মুখ, একটা উল্লুক, একটা পাঠাতে আর মহাতাপে কোনো তফাত নাই। ঘরে খাবার আছে, সম্পত্তি আছে, তারই জোরে আমাদের চেয়ে তার খাতির। সব কলঙ্ক ঢাকা পড়ছে।
মা এবার মাটি-গোলার হাড়িটা হাতে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বলিল, দেখ ঘোঁতন, অন্যায় কথা বলিস না! তোর যেমন পাপ মন তেমনি কূটবুদ্ধি। তত তোর মনে হিংসে। অমৃতিকে তুই বিষ বলছিস। ছি। ছি।
—যাও, যাও, মেলা ফ্যাঁচফ্যাঁচ কোরো না বলছি। বিড়ি টানিয়া ঘোঁতন খানিকটা ধোঁয়া উড়াইয়া দিল—আমি হাঁড়ি ব্রেক করে দোব বাবা। হুঁ হুঁ।
বলিয়া সে হাঁটু দোলাইতে লাগিল।
মায়ের দাওয়া নিকানো শেষ হইয়াছিল। মাটি-গোলা হাঁড়িটা হাতে লইয়া সে দাওয়া হইতে নামিয়া পাচিলের গায়ে সদর দরজা দিয়া বাড়ির ভিতরে ঢুকিতেছিল, ঘোঁতনের কথা শেষ হইতেই সে ঘুরিয়া দাঁড়াইল। বলিল, তোমার হাঁড়ি যে ভেঙে আটকুচি হয়ে আছে বাবা। চাঁপাডাঙার মেয়ে কাদুর সঙ্গে তোমার বিয়ের সম্বন্ধ ছেলে বয়েস থেকে; তুমি বাবা যাচা লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে দিয়ে বিয়ে করলে নিজে পছন্দ করে। বউমা ভাল, নিন্দে করব না বাবা, কিন্তু সবেরই তো পয় আছে ভাগ্যি আছে; তোমার বউয়ের ভাগ্যি বলতে কিছু নাই। তা ছাড়া ধন্যি বাপের মেয়ে, বাপ সেই যে–আলতানুটি শাকেরকুটি দিয়ে বিয়ে দিয়ে চলে গেল এখান থেকে আর খোঁজ করলে না। আর কাদুর বাপ মরবার সময় মেয়েকে দিয়ে গেল এতগুলি গহনা। আজ কাদুকে দেখে দশখানা গাঁয়ের লোকের চোখ জুড়োয়। বলে মরি মরিকি লালিত্যি! এ রাগের কথা—লোকে না জানুক, আমি জানি। এতে তোমার অকল্যাণ হবে বাবা। আমার সইয়ের মেয়ে সে আমার মেয়ের তুল্য। বিয়ে যখন হয় নাই-তখন তাকে বোন ভাবা উচিত তোমার। কিন্তু তুমি–প্রৌঢ়া আক্ষেপের সঙ্গে ঘাড় নাড়িয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
ঘোঁতন এবার হঠাৎ ক্রুদ্ধ হইয়া হাতের চায়ের বাটিটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল এবং দাওয়া হইতে রাস্তায় নামিয়া হনহন করিয়া চলিয়া গেল। হঠাৎ দাঁড়াইয়া ঘুরিয়া বলিল, চিরকালের ঘরজ্বালানী পরলোনী যে তুমি। কাদু তোমার সইয়ের মেয়ে—সে তোমার পেটের ছেলের চেয়ে। আপন! তার জন্যে আমার উপর রাগ। ফু-ফু! ফু!
রাস্তায় নামিয়া খানিকটা আসিয়াই সে দেখিল, সেতাবের রাখাল ছোঁড়াটা একটা আমগাছের তলায় দাঁড়াইয়া গাছে ঢেলা মারিয়া আম পাড়িতেছিল। ঘোঁতন তাহাকে দেখিয়া ডাকিল, এই ছোঁড়া, শোন্ তো। এই! তাহার মাথার মধ্যে একটা মতলব খেলিয়া গেল।
ছোঁড়াটা ছুটিতে উদ্যত হইতেই ঘোঁতন একটা ঢেলা তুলিয়া বলিল, পালাবি তো ঢেলা মেরে ঠ্যাঙ খোঁড়া করব তোর। শোন্।
ছোঁড়াটা থমকিয়া দাঁড়াইল। ঘোঁতন আগাইয়া আসিয়া বলিল, তার ছোট মনিব কোথা? একবার ডেকে দিতে পারি?
–ছোট মুনিব মাঠে।
–মাঠে?
–হুঁ। বীজ বুনতে গিয়েছে।
ঘোঁতন চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল। কয়েক পা অগ্রসর হইয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বিড়ি খাবি?
–বিড়ি? দেবেন আপুনি? সত্যি?
–এই নে না।
একটা বিড়ি তাহাকে দিয়া নিজে একটা বিড়ি মুখে পুরিয়া দেশলাই জ্বালিয়া ধরাইয়া, নিজের ধরানো বিড়িটা রাখালটার বিড়িতে ঠেকাইয়া দিয়া বলিল, টান।
রাখালটা হুস করিয়া ধোঁয়া ছাড়িয়া দিল।
ঘোঁতন বলিল, হাঁ রে, তোদর ছোট মুনিব আর বড় মুনিবে নাকি ঝগড়া হয়?
–দিন রাত। সেই যে বলে, সাপে নেউলে।
–কেন বল্ তো?
—ছোট মুনিব মানুষটা যে কেমন গো। লোকের কাছে ঠকে আসে। লোককে পাওনা-গোণ্ডা ছেড়ে দেয়। টাকা হাতে পেলেই খরচ করে দেয়। এই বড় মুনিবের রাগ। আর ছোট মুনিবের রাগ, বড় মুনিব কেপন। বড় মুনিব বকে। সবচেয়ে বেশি রাগে, মোল্যানকে বকে বলে।
–হুঁ। বড় মোল্যানের সঙ্গে মহাতাপের খুব মাখামাখি–না রে?
—ওরে বানাস। বড় মোল্যান ছাড়া কথা নাই ছোট মুনিবের। সে যা বলবে তাই বেদবাক্যি।
—তোদের ছোট মোল্যান রাগ করে না?
–করে না আবার? করে, মাঝে মাঝে ফোঁসফোঁস করে। তা ছোট মুনিব বলে—নেহি মাংতা হ্যায়, চলে যা বাপের বাড়ি। বড় মোল্যান আবার বকে ছোট মুনিবকে। ছোট মোল্যানকেও বকে খুব।
–হুঁ। একটু ভাবিয়া লইয়া ঘোঁতন বলিল, ভাল ছেলে তুই—তোকে আমার যাত্রার দলে একটা পার্ট দোব। বুঝলি? করবি?
বার বার সে ঘাড় নাড়িল। মনে মনে মাকে ব্যঙ্গ করিল। চাঁপাডাঙার বউয়ের উপর মায়ের বড় দরদ। অথচ রাখাল ছোঁড়া কি বলিয়া গেল? তাহার মানে কি? নয়ানপুরের যত সব ভেড়ার দল—সেতাব-মহাতাপের অবস্থাকে ভয় করিয়া মুখ খুলিতে সাহস করে না। দেওর-ভাজের মাখামাখিরও একটা সীমা আছে। রাখালটাকে হাত করিয়া ঠিক খবরটা বাহির করিবে সে।
আজকালকার ভাল ভাল উপন্যাসে নরনারী-তত্ত্বের জীবন-রহস্য সে জলের মত বুঝিতে। পারিয়াছে।
ছেলেটা খুশি হইয়া ঘাড় নাড়িল।
ঘোঁতন আবার প্রশ্ন করিল, এখন বল্ তো কোন্ মাঠে বীজ পাড়ছে তোর ঘোট মুনিব?
–ওই তো গো আপনার কাছে কেনাকাড়াজোলের সেই বেঁকী বাকুড়ির মাথায়।
কাঁড়াজোলের মাঠ। এখানে ওখানে লোক হাল বহিতেছে। বৈশাখ মাস বীজ বুনিবার সময়। মহাতাপ লাঙল চালাইতেছিল। তাহার বলিষ্ঠ দেহের সকল শক্তিতে লাঙলের মুঠা চাপিয়া ধরিয়াছে। গরু দুইটা চলিয়াছে মন্থর গমনে।
কৃষাণটা কোদাল কোপাইয়া আলের মুখ কাটিয়া জল-নির্গমের পথ করিয়া দিতেছিল।
এমন সময় আসিয়া দাঁড়াইল ঘোঁতন। ডাকিল, মহাতাপ।
মহাতাপ মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, ভাঙ খাবার দলে আমি নাই, যা!
–একটা বিড়ি খা।
–বকিস না, আমার সময় নাই। দু আড়া বীজ ফেলতে হবে আমাকে।
সঙ্গে সঙ্গে নাকে তালুতে ঘড়াত শব্দ করিয়া গরু দুইটাকে তাড়া দিয়া বলিল, অই-অই, বেকুব বেহুদা গরু কোথাকার। অই-অই, আবার শব্দ। কহিল—ক্যা-কা-ক্যা-ক্যা।
ঘোঁতন বলিল, ওড়ে দাঁড়া, শোন্। কথাটা বেশ ধমকের সুরেই বলিল।
—কি?
–বলি মানুষের কথা কটা রে?
–ক্যানে? কথা একটা। দু কথার মানুষ মহাতাপ নয়।
–তবে?
–কি তবে! মহাতাপ লাঙল ছাড়িয়া দিল এবার।
–তুই যে দাতাকৰ্ণ সেজে মাকে পাওনা ধান ছেড়ে দিয়ে এলি—
–হ্যাঁ হ্যাঁ। তোর মায়ের জন্যে দিয়েছি। তোর জন্যে নয়।
–বুঝলাম। তো তোর দাদা আবার ধান চায় কেন?
–কি?–তোর দাদা, কিপটে সেতাব–
—এক চড়ে তোর উঁত ভেঙে দেব ঘোঁতনা। কিপটে আছে আপন ঘরে আছে, তুই কিপটে বলবি ক্যানে?
—সে ধান চায় ক্যানে? পঞ্চায়েত ডাকে ক্যানে?
–যা যা, ঘর যা। সে আমি বড় বউকে বলে দোব। সে সব ঠিক করে দেবে।
–বড় বউকে বলে ঠিক করে দিবি? ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল ঘোঁতন। ঘাড় নাড়িয়া খুব রসিকের মত হাসিয়াই বলিল, হা হ্যাঁ, তাই দিস। কথার শেষে সে আরও খানিকটা হাসিল।
মহাতাপ তাহার হাসি দেখিয়া ক্ষেপিয়া গেল, বলিল, হাসছিস যে? এই, তুই হাসছিস যে?
ঘোঁতনা বিজ্ঞের মত বলিল, হাসলাম। তা তুই রাগছিস ক্যানে?
—তু হাসবি ক্যানে? মহাতাপ আরও দুই পা আগাইল।
–ওই! ওই! সে পিছাইতে লাগিল।
মহাতাপ খপ করিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিল—ব ব্যাটা ফড়িং, হাসিস ক্যানে? এমন করে হাসলি ক্যানে বল্–
–ছাড়্, ছাড়্ ছাড়্—ওরে বাপ রে।
নোটন ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ছোট মোড়ল, ছাড়, ছাড়, ছোট মোড়ল—
দূর হইতে কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল-ঠাকুরপো!
দূরে একটি গাছতলায় বড় বউ কাদম্বিনী হাতে গামছায় বাঁধা জলখাবার লইয়া দাঁড়াইয়া ছিল; মাথায় বিড়ার উপর জলের ঘটি। মাঠে চাষের কাজের সময় চাষীদের বধূরাও মাঠে স্বামী। পুত্রের জন্য জলখাবার লইয়া যায়। সেতাব ভরা চাষের সময় ছাড়া চাষে খাটে না। হিসাবনিকাশ দেনাপাওনা বীজের ব্যবসা লইয়া তাহার অনেক কাজ। মহাতাপের চাষ লইয়া মাতন।
ছোট বউকে সমাদর করিয়া কাদু মাঠে বাহির হইতে দেয় না। তাহার উপর পাগলকে তো বিশ্বাস নাই; কোথায় মাঠেই ঝগড়া করিয়া বসিবে মানুর সঙ্গে। তাহার যদি মনে হয় গুড় কম কি মুড়ি নরম তাহা হইলে এক কাদু ছাড়া আর কাহারও সাধ্য নাই যে তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া বুঝাইয়া খাওয়াইতে পারে। মহাতাপের জন্য জলখাবার লইয়া আসিয়া গাছতলায় দাঁড়াইয়াই তাহার চোখে পড়িল ঘোঁতন দাঁড়াইয়া আছে, কি কথা বলিতেছে। কথা যে ধানের কথা তাহা বুঝিতে তাহার কষ্ট হইল না। মুহূর্ত পরেই মহাতাপের উচ্চকণ্ঠস্বরে সে চমকিয়া উঠিল। তাহারও মুহূর্ত পরে মহাতাপকে যুদ্ধোদ্যত দেখিয়া তাহাকে চিৎকার করিয়া না ডাকিয়া পারিল না।
মহাতাপ চমকিয়া তাহার দিকে চাহিল।
নোটন বলিল, বড় মুনিব্যান।
দূর হইতে কাদু বলিল, ছেড়ে দাও ঠাকুরপো। ছেড়ে দাও।
মহাতাপ ঘোঁতনকে ছাড়িয়া দিল, যা বেটা আলকাটার কাপ, আজ তোকে ছেড়ে দিলাম। ফের দিন তোকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকা পাকিয়ে দোব।
ঘোঁতন হাতে হাত বুলাইতে বুলাইতে চলিয়া গেল।
মহাতাপ গাছের তলায় গিয়া বসিল, ব্যাটা হাসে। দেখ তো কাণ্ড।
কাদম্বিনী বলিল, কি হল তাতে? হাসি তো ভাল জিনিস।
–ভাল জিনিস? ওই হাসি ভাল জিনিস? ভাল জিনিস তো গা জ্বলে যায় ক্যানে?
–নাও, ভিজে গামছায় গা মুছে ফেল। জ্বালা জুড়িয়ে যাবে। একটু বুদ্ধি কোরো। বুঝলে, সবতাতেই মারমূর্তি ভাল নয়।
—তুমি এই কথা বলছ? তোমার কথায় কখনও রাগি আমি?
বড় বউ জলের ঘটি আগাইয়া দিল–মুখ ধোও। হাত ধোও।
মহাতাপ হাতমুখ ধুইতে লাগিল।
বড় বউ বলিল, আমার কথায় রাগো না সে তো কথা নয়। পরের কথাতেই বা রাগবে কেন? ছিঃ! কি হল কি? ঘোঁতন হাসলেই বা ক্যানে?
–ক্যান! এবার মহাতাপ চেঁচাইয়া উঠিল—ক্যানে! তোমার নাম করে হাসল ক্যানে?
বড় বউ তাহার মুখের দিকে তাকাইল, ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, আমার নাম করে?
–হ্যাঁ। আবার হাসছে যেন মদ খেয়ে আসছে। দাও মুড়ি দাও।
বলিয়া মুড়ির খোরাটা টানিয়া লইল। হস করিয়া জল ঢালিয়া দিল। গুড়ের বাটি হইতে চামচখানেক গুড় লইয়া মিশাইয়া দিল। তারপর বলিল, ব্যাটার হাত ভেঙে দিতাম।
বড় বউ কাদম্বিনী বিচিত্ৰ হাসি হাসিল।তার চেয়ে ওরা হাসুক। হাসতে দাও ওদের। পরের হাত ভেঙে তোমাকে ফ্যাসাদ বাধাতে হবে না।
প্রকাণ্ড হাতে মুড়ির গ্রাস তুলিতে গিয়া মহাতাপ বলিল, এমনি করে হাসবে ঘোঁতনা?
—যাঁর বিচারের ভার তিনিই বিচার করবেন। এতে আমার গায়ে ফোস্কা পড়বে না। কিন্তু ও আবার তোমার কাছে এসেছিল কেন?
ওই দেখ। ভুলে যেতাম এখুনি। তুমি সেই কেপনকে বোলে তো, আমি ঘোঁতনকে যে ধান ছেড়েছি সেটা এবার চাষে ফলিয়ে দোব–দোব–দোব!
বলিয়াই সে বড় বড় গ্রাসে খাইতে লাগিয়া গেল।
চাঁপাডাঙার বউ হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, বড় মোড়ল বুঝি ছাড়বে না বলেছে?
খাইতে খাইতেই মহাতাপ বলিল, পঞ্চায়েত ডেকেছে। আজই সন্ধেবেলা।
চাঁপাডাঙার বউ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না-না-না। সে ঘোঁতনের জন্যে নয়। আজ পঞ্চায়েত বসবে–শিবকেষ্ট রামকেষ্টদের হাঁড়ি আলাদা হবে, বিষয় ভাগ হবে।
–উঁহুঁ, ঘোঁতন বলে গেল। কেপনের সর্দার লোক পাঠিয়েছিল।
চাঁপাডাঙার বউ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া ভাবিয়া লইল।
মহাতাপ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া বলিল, তুমি বোলো যেন!
–বলব। বলব। তুমি খাও।
–বাস। নিশ্চিন্দি তো?
–হ্যাঁ গো, হ্যাঁ।
–এবার এমন চাষ করব–দেখবে।
–কোরো। এখন খেয়ে নাও।
মহাতাপ বড় বড় গ্রাসে মুড়ি খাইতে লাগিল।
চাঁপাডাঙার বউয়ের বুঝিতে বাকি রহিল না ব্যাপারটা। সে মণ্ডলবাড়ির গৃহিণী, সেতাবও বর্ধিষ্ণু ব্যক্তি হিসাবে এখানকার পঞ্চায়েতের একজন মণ্ডল, গ্রামের সকল খবরই তাহাদের পক্ষে জানা স্বাভাবিক। রামকেষ্ট এবং শিবকে দুই ভায়ের মধ্যে বনিবনাও অনেক দিন হইতেই হইতেছে না। কাজেই তাহারা ভিন্ন হইতে চলিয়াছে। সেইজন্য—আজই সন্ধ্যায় পঞ্চায়েত বসিবার কথা। এই সুযোগ লইয়া সেতাব ঘোঁতনের ব্যাপারটাও পঞ্চায়েতের সম্মুখে উপস্থিত করিবার ব্যবস্থা করিয়াছে—কথাটা মুহূর্তে কাদম্বিনী বুঝিয়া লইল। ব্যাপারটা কাদম্বিনীর ভাল লাগিল না। সেতাবের উপর সে বিরক্ত হইল। এ কি? এই স্বভাবটা কি তাহার কোনোদিন যাইবে না? একদিন যখন অবস্থা খারাপ ছিল তখনকার কার্পণ্যের কথা সে বুঝিতে পারে। আজ এত কার্পণ্য কেন? তা ছাড়া মহাতাপ বুদ্ধিহীন হোক, সেও তো বাড়ির অর্ধেকের মালিক। তাহার অপমান হইবে যে! মহাতাপকে সে স্নেহ করে। মহাতাপ সরল, নিৰ্বোধ, মাথাতেও একটু ছিট আছে—তাহার উপর ভাঙ খায়, লোকের সঙ্গে মারামারি করিয়া আসে, জানোয়ারদের সঙ্গে লড়াই করিয়া আসে, সবই সত্যি। কিন্তু মৃত্যুশয্যায় মায়ের কথাটাও কি মনে পড়ে না। সেতাবের? চাঁপাডাঙার বউয়ের তখন পনের-ষোল বৎসর—মহাতাপের চোদ্দ–পনের, মৃত্যুশয্যায় শাশুড়ি বউকে ডাকিয়া বলিয়াছিল—বউমা, ওই পাগলকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম, তুমি ওকে দেখো।
মহাতাপকে ডাকিয়া মা বলিয়াছিল–বড় ভাজ আর মায়ে সমান। চাঁপাডাঙার বউয়ের কথা কখনও অমান্য করবি নে। ও আমার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।
সেতাবকে ডাকিয়া বলিয়াছিল—সবই তোমার ওপর ভার বাবা। বউমার অযত্ন কোরো না, ও-ই হল এ বাড়ির ঘরের লক্ষ্মী। তুমি বউমাকে দেখো; মহাতাপকে দেখো।
চাঁপাডাঙার বউ তাহার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিয়াছে। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা শুধু কর্তব্যপালন নয়, তাহার সঙ্গে তাহার অন্তরের অকৃত্রিম স্নেহের যোগ আছে। বুদ্ধিহীন মহাতাপ আজও সেই ছেলেবেলার মত চাঁপাডাঙার বউকে অ্যাঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে চায়। তাহার ক্রোধ হইলে সে ভয়ঙ্কর হইয়া ওঠে। প্রতিশোধ না লইতে পারিলে সে মেঝের উপর মাথা কোটে। সেসময় তাহার সম্মুখে কেহ দাঁড়ায় না। দাঁড়ায় ওই চাঁপাডাঙার বউ। চাঁপাডাঙার বউ দাঁড়াইলেই মহাতাপের ক্রোধের মাত্রা কমিয়া আসে। সে-ই মুখ তুলিয়া তাহার দিকে তাকায়। চাঁপাডাঙার বউ বলে, ছি! ছি!
মহাতাপ প্রথমটায় প্রতিবাদ করে।
বড় বউ আবার বলে, ছি! ছি! তোমার জন্যে ছি-ছি করে সারা হলাম। চিরকালই কি তুমি ছেলেমানুষ থাকবে?
মহাতাপ এবার নিজের দিকের ন্যায়কে প্রবল করিয়া তুলিতে চেষ্টা করে। বড় বউ বলে, সব বুঝেছি। অন্যায় ওদেরই। কিন্তু সংসারে যে সয়—সেই মহাশয়।
মহাতাপ শান্ত হয়।
মহাতাপের বিবাহও সে-ই দিয়াছে। মানদা তাহারই জ্ঞাতিকন্যা।
মানদা মেয়েটি দেখিতে বড় ভাল। তাহার উপর কাজ কর্মে এমন পারঙ্গম মেয়ে চাষীর বাড়িতেও বিরল। শুধু সেতাবই কি সব ভুলিয়া গেল? দিন দিন পয়সা পয়সা করিয়া সে কি হইতে চলিল।
চাঁপাডাঙার বউয়ের সদাহাস্যময়ী মুখখানি বিষ হইয়া গেল। স্বামীর এই আচরণের সংবাদে মর্মাহত হইল। মহাতাপ এ বাড়ির অর্ধেকের মালিক, তাহার বুদ্ধি নাই কিন্তু তাহার সবল শরীরের পরিশ্রমেই জমির ধানে এ বাড়ির খামার উথলিয়া ওঠে। শুধু তাই নয়—তাহাদের সন্তান নাই, ওই মহাতাপের ছেলে মানিকই এ বংশের উত্তরাধিকারী।
বিষণ্ণ মন লইয়াই সে বাড়ি ফিরিল।
খামার-বাড়িতে কতগুলা কুমড়ার লতা মাচায় উঠি-উঠি করিতেছে, সেতাব একখানা কোদাল লইয়া সেগুলোর গোড়ায় চারা করিয়া দিতেছে। পঁচিলের গোড়ায় হুঁকা-কল্কে ঠেকানো রহিয়াছে।
তাহার অনতিদূরে বসিয়া আছে রামকেষ্ট ও শিবকেষ্টর দুই বিধবা খুড়ী। বয়স চল্লিশবিয়াল্লিশের কাছাকাছি ইন্দাশের বউ ও টিকুরীর বউ। দুই জনেই উবু হইয়া বসিয়া আধঘোমটা দিয়া কথা বলিতেছে, এক জন একটা লাঠি দিয়া মাটিতে দাগ কাটিতেছে।
এক জন বলিতেছে, শিবকেষ্ট রামকেষ্ট ভেন্ন হবে বাবা, তোমরা পঞ্চায়েত মিলে ভাগ করে দিচ্ছ; কিন্তু আমাদের কি হবে, বল?
সেতাব একটু রূঢ়স্বরেই বলিল, সে একা আমাকে বললে কি হবে?
—মোটা মোড়ল তোমাকেই বলতে বললে বাবা। বললে, তোমরা বাপু সেতাবের কাছে। যাও। বয়স ছোট হলেও তার কথাই বিকুবে। তার অবস্থা ভাল। বলতে হেন লোক নাই যে সেতাবের কাছে ধান হোক টাকা হোক ধারে না। শিবকেষ্টদেরও দেনা রয়েছে।
সেতাব কোদালটা রাখিল, বলিল, মিছে কথা বুড়ি, মিছে কথা। দুনিয়া হয়েছে নেমখারামের দুনিয়া। বুঝলে বুড়ি, নেমখারামের দুনিয়া। এই দেখ, ওই ঘোঁতন—সে-ই যাত্রার দলের আলকাটার কাপ, তাকে পঞ্চায়েতে আসতে বলেছিলাম, তা সে বলেছে—নেহি যাঙ্গা।
বউ দুটির এক জন বলিল, শিবকেই রামকে তা বলতে পারবে না বাবা। তোমার ঘরে তমুসুদে বাঁধা। তুমি বললে—তোমার কথা অমান্যি করতে পারবে না।
সেতাব গিয়া হুঁকা-কল্কেটা তুলিয়া লইল, টানিতে টানিতে আসিয়া বলিল, তা তোমরা বলছ কি? কথাটা কি?
চাঁপাডাঙার বউ ইহার মধ্যে কখন আসিয়া ঢুকিয়াছিল। সে আগাইয়া আসিয়া বলিল, কথা আর কি? বিধবা বউ, তাদের খাবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা না করে দিলে হবে ক্যানে? তাহলে তোমরা কিসের পঞ্চায়েত?
এক জন বিধবা বলিল, এই হয়েছে। বউমা এসেছে। বল মা, তুমি বল তো। তুমি বলে দাও সেতাবকে।
সেতাব তাড়াতাড়ি বলিল, আহা, তাই তো বলছি গো! তোমরা কি চাইছ তা বল? বলি আলাদা করে থাকতে চাও, না, ওদের সংসারে থাকতে চাও, তা বলতে হবে তো।
এক জন বিধবা বলিল, আলাদা হলেই তো ভাল বাবা। স্বাধীন মতে থাকতে পাই।
সেতাব উৎসাহের সঙ্গেই বলিল, তাই হবে। আলাদাই থাকবে। দুজনকে খানিকটা করে জমি দিতে হবে দুই ভাইকে।
অন্য বিধবা বলিল, তাতে মোটা মোড়লের মত নাই। বলেছে, সে বলতে পারব না বাপু। তোমরা দুদিন পর কাউকে জমি বিক্রয় কর–
সেতাব বলিয়া উঠিল, করে তো করবে।
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, না। মোটা শ্বশুর ঠিক বলেছে। তাতে সংসার নষ্ট হবে। খুড়ীদিগেও তো ভাবতে হবে-সংসার শ্বশুরের সংসার, স্বামীর সংসার। রামকেষ্ট শিবকেষ্টই তো খুড়ীদের জল দেবে! তোমরা তা কোরো না খুড়ী, তোমাদের অধর্ম হবে।
–কিন্তু হতচ্ছেদ্দা করবে যে বউমা!
—ছেদ্দা কেউ কাউকে আপনা থেকে করে না খুড়ী, ছেদ্দা করাতে হয়। তুমি যার বাড়িতে থাকবে তাকে যদি পেটের ছেলের মত ভালবাস, তার সংসারে নিজের সংসার বলে খাটো তবে ছেদ্দা না করে সে যাবে কোথায়?
সেতাব ইতিমধ্যে কয়েকবার হুঁকায় ব্যর্থ টান দিয়া ধোঁয়া বাহির করিতে না পারিয়া বসিয়া কল্কেটা ঝাড়িয়া ফেলিয়া তামাক সাজিতে বসিয়াছিল। এবং মধ্যে মধ্যে বিরক্তভাবে আপন মনেই হুঁঃ-হুঁঃ করিতেছিল। চাঁপাডাঙার বউয়ের কথাটা শেষ হইতেই সে বলিল, তাই যা হয় হবে খুড়ী, যা হয় পঞ্চজনে করা যাবে। সন্ধেবেলায় এসো বুঝলে? উ তোমরা বললেও হবে না, চাঁপাডাঙার বউ বললেও হবে না। আমরা পঞ্চজনে বুঝেসুঝে যা হয় করব। হ্যাঁ, সে যা হয়। হবে। সন্ধেবেলাতে এসো চণ্ডীমণ্ডপে।
—তাই আসব বাবা।
বিধবা দুই জন চলিয়া গেল। তাহারা চলিয়া যাইতেই সেতাব সেইদিকে তাকাইয়া দেখিয়া আপন মনেই বলিল, এই মেয়েলোকের মুড়লি আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না।
বড় বউ বিধবা দুইটির পিছন পিছন দরজা বন্ধ করিতে গিয়াছিল। দরজা বন্ধ করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তা পারবে কেন? খুড়ীদিগে জমির ভাগ বার করে দিয়ে জমিটা কিনে নেবার মতলবে ঘা পড়ছে বুঝি? সেই মতলব মনে এসেছে? ডি ছি ছি!
সেতাব ধরা পড়িয়া গেল। হঠাৎ সেই মতলবই তাহার মাথায় গজাইয়া উঠিয়াছিল, বোধ করি মতলবের কথাটা নিজের কাছেও ভাল করিয়া পরিষ্কার হয় নাই। ঠিক যেন রোগসংক্রামিত দেহের প্রথম অবস্থার মত! কেহ বলিয়া দিলে বুঝিতে পারে—তাই তো, শরীরটা অসুস্থই তো হইয়াছে। চাঁপাডাঙার বউ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঠিক ধরিয়াছে তাহাকে। সে চমকিয়া উঠিল। সেই চমকানির ধাক্কায় হাতের কঙ্কেটা উল্টাইয়া গেল, কোটা পড়িয়া গেল। সে চাঁপাডাঙার বউয়ের দিকে তাকাইয়া বলিল, তোমার দিব্যি, এই হুঁকো ছুঁয়ে বলছি।
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, আমি মরে গেলেই বা তোমার কি? আর হুঁকো ছুঁয়ে মিথ্যে বললেই বা সংসারে কি হয় শুনি?
সেতাব অপ্রতিভ হইয়া বলিল, হুঁকো ছুঁয়ে বললেই বা কি হয়? তুমি মরে গেলেই বা আমার কি?
–হ্যাঁ গো! বল না কি হয়?
সেতাব আছাড় মারিয়া হ্ৰকাটা ভাঙিয়া ফেলিল, বলিল, হুঁকোর কিছু না বলেছে! এই নে।
—এইবার কোদাল নিয়ে আমার মাথাটা কাটো!
সেতাব চিৎকার করিয়া উঠিল, চাঁপাডাঙার বউ! যা-তা বোলো না বলছি।
চাঁপাডাঙার বউ খুব গম্ভীরভাবে বলিল, পরের ঘর ভাঙতে যেয়ো না। তোমার নিজের ঘর ভেঙে যাবে।
সেতাব এবার হাত জোড় করিয়া বলিল, জোড়হাত করছি চাঁপাডাঙার বউ, তুমি থাম তুমি থাম।
চাঁপাডাঙার বউ সঙ্গে সঙ্গে গড় হইয়া প্ৰণাম করিল, বলিল, তুমি হাতজোড় করলে, আমি। তোমাকে পেনাম করছি। প্রণাম সারিয়া উঠিয়া বলিল, আরও একটা কথা তোমাকে বলি। ঘোঁতন ঘোষের ধান মহাতাপ ছেড়ে দিয়েছে, তুমি তবু লোক পাঠিয়ে পঞ্চায়েতে ঘোঁতনকে ডেকে পাঠিয়েছ। ভাল কর নি। ও-কথা আর তুলো না।
সেতাব চঞ্চল হইয়া উঠিল, বলিল, ইয়েকে বলে, ই তো ভারি ফেসাদ জুড়ে দিলে! পাওনা ধান ছেড়ে দেব?
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, মহাতাপের মানের চেয়ে ধান বড় হল? তার অপমান হবে।
–বোকা পেয়ে তাকে ঠকিয়ে নিলে, তাতে অপমান হয় না আর–
—না, হয় না। যে দান করে সে দাতা। দাতার বোকা বুদ্ধিমান নাই। মহাতাপ দান করেছে। তাকে যদি খাটো করতে চাও, তবে আমি উপোস দেব বলে দিলাম।
বলিয়া সে হনহন করিয়া বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া গেল।
সেতাব নিজের মাথার চুল খামচাইয়া ধরিয়া বসিয়া রহিল। হঠাৎ সে চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, আমি মানি না, মানি না। কারুর কথা আমি মানি না। আমি সেতাব মোড়ল। বলিয়া সেও বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
চাঁপাডাঙার বউকে সে ভয় করে। আবার তাহাকে নহিলে তাহার একদণ্ড চলে না।
চাঁপাডাঙার বউ যেন তাহার বুকের ভিতরটা দেখতে পায়। কোনো কথা তাহার কাছে গোপন থাকে না। তার উপর তার কাটাকাটা কথা। সেতাব থই পায় না। আবার বিচিত্র চাঁপাডাঙার বউ, সে তার বাপের মৃত্যুকালে দেওয়া হাজার টাকা দামের গহনা সেতাবের হাতে দিয়া হাসিয়া বলে টাকার অভাবে তুমি নিলেমে লক্ষ্মীপুরের বাবুদের চরের জমিটা কিনতে পারছ না, জমিটা হাতছাড়া হলে তোমার দুঃখ হবে। কিনে ফেল জমিটা। পরে আমাকে টাকা দিয়ো।
লক্ষ্মীপুরের বাবুদের চরের জমি—সোনা-ফলানোচর। সেখানে এক-একটা তরমুজ হয়। পাঁচ সের ওজনের। সেই জমি কেনার পর মণ্ডলবাড়ি আবার পূর্বের শ্ৰী ফিরিয়া পাইয়াছে। আগের অবস্থাকেও ছাড়াইয়া গিয়াছে। কিন্তু–কিন্তু তাই বলিয়া কি তাহার হুকুমে ওই ঘোঁতনের মত পাষণ্ড উদ্ধত শয়তানকে পাওনা ছাড়িয়া দিতে হইবে। ঘোঁতনকে সে দু-চক্ষে দেখিতে পারে না। সেই স্কুলজীবন হইতে। মহাতাপের অপমান হইবে? মহাতাপ তাহার মায়ের পেটের ভাই। বিষয়-সম্পত্তি, এই ভূতের বেগার খাটা কাহার জন্য? তাহার নিজের জন্য? সে খায় কমুঠা? পরে কি? তাহার নিজের সন্তান আছে? সে খাটে মণ্ডলবাড়ির জন্য। সবই পাইবে মহাতাপের ছেলে মানিক। মানিকের যে ভাইয়েরা ইহার পর আসিবে তাহারা। চাঁপাডাঙার বউ ছাড়া অন্য কেহ হইলে সে এতদিন বংশরক্ষার জন্য আবার বিবাহ করিত। কিন্তু সেতাব তা করে নাই। তুমি সেটা মান না! ঘোঁতনকে পাওনা ছাড়িতে হইবে। রামকেষ্ট শিবকেষ্টদের জমি কিনিতে সে পাইবে না। তোমার কথায়? প্রতাপ মোড়ল মারা গেলে সম্পত্তি নিলামে উঠিয়াছিলরামকেষ্ট শিবকের বাপ হরেক মণ্ডল চাদর গায়ে দিয়া চটি পায়ে দিয়া সদরে গিয়া প্ৰতাপ মোড়লের খিড়কি পুকুরের অংশ কিনিয়াছিল। এখনও তাহারা সে পুকুরের অংশীদার। তোমার কথায় তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইবে! তুমি সেতাবকে ধর্ম-অধৰ্ম শিখাইতে আসিয়াছ! রাগে তাহার চুলগুলা ছিঁড়িয়া ফেলিতে ইচ্ছা হইতেছে।
বাহিরে আসিয়া গোয়াল-বাড়িতে দাঁড়াইল। ডাকিল, গোবিন্দে, গোবিন্দে! ওরে অ-গোবিন্দে! গোবিন্দে।
গোয়ালঘর হইতে গোবিন্দ বাহির হইয়া আসিল—কি বলছেন গো?
সে চোখ কচলাইতে লাগিল।
–ঘুমুচ্ছিলি?
–ঘুমুই নাই। বসে বসে ঢুলছিলাম।
–ঢুলছিলি?
–কি করব? বড় মনিব্যান না এলে তো দুধ দোয়ানো হবে না।
–তু এক কাজ কর। ছুটে যাবি রামকেষ্টদের বাড়ি, বুঝলি?
ঘাড় নাড়িয়া গোবিন্দ বলিল, হ্যাঁ।
–রামকেষ্টদের দুই কাকীকে জানিস তো?
–এই তো খানিক আগে এয়েছিল, তারাই?
–হ্যাঁ। তাদের যাকে পাবি ডাকবি, আড়ালে ডাকবি, বলবি—কেউ যেন না শোনে, বুঝলি?
–হ্যাঁ, চুপিচুপি বলব।
–হ্যাঁ। বলবি–বড় মুনিব বলে দিলে, তোমরা জমি চাইবে। বাস, বলে চলে আসবি।
বলিয়াই আপন মনে বলিল, তারপর আমি দেখছি। আমি কারুর কথা শুনি না। কাউকে গেরাহ্য করি না। বড় সব বড় বেড়ে গিয়েছে।
বলিতে বলিতে গোয়ালবাড়ি হইতেও বাহির হইয়া গেল।
চণ্ডীমণ্ডপের পঞ্চায়েত মজলিসে সেতাব আসিল সকলের শেষে। মজলিসের সকলে তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছিল। প্রায় দশ-বার জন লোক বসিয়া আছে। পঞ্চায়েতের প্রধান মোটা মোড়ল বিপিন মণ্ডল স্থূলকায় মানুষ, গলায় তুলসীর মালা, কপালে তিলক। শান্তদর্শন লোকটি। তাহার আশপাশে বাকি লোক বসিয়া আছে। রামকেষ্ট ও শিবকেষ্ট দুই ভাই দুই বিপরীত দিকে বসিয়াছে। একটু দূরে বসিয়া আছে তাহাদের দুই বিধবা খুড়ী। মাঝখানে একটা হারিকেন জ্বলিতেছে।
চণ্ডীমণ্ডপের সামনে পথের উপরে জন চার-পাঁচ ছোকরা অন্ধকারের মধ্যে বিড়ি টানিতেছে। একজন বলিতেছিল, জমি তো মোট তিরিশ বিঘে। তাতে খুড়ীদিকে জমি দিতে গেলে ওদের থাকবে কি? অন্য একজন বলিল, ওরা ধরেছে, জমিই ওরা নেবে। সংসারে থাকা মানে অধীন হয়ে থাকা। সে ওরা থাকবে না।
–তা বললে চলবে কেন? ওদের দু ভায়ের কথা ভাবতে হবে তো?
–পঞ্চায়েত কি বলছে?
—মোটা মোড়ল না বলেছে। আর সবাই চুপ করেই আছে। সেতাব পাকু না এলে মুখ খুলবে না।
ঠিক এই সময়েই পিছনে শোনা গেল গলাঝাড়ার শব্দ। একজন বলিল, কে?
পথের বাঁক হইতে লণ্ঠন হাতে বাহির হইয়া আসিল সেতাব।
সকলে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল। একজন বলিল, সেতাবাদা!
সেতাব বলিল, আর সেতাবাদাঁতে কাজ নাই। পথ ছাড়।
একজন হাসিয়া বলিল, কি হল, মেজাজ এত খারাপ কেন?
সেতাব তাহাদিগকে অতিক্ৰম করিয়া চণ্ডীমণ্ডপের তালগাছের টুকরা দিয়া গড়া সিঁড়িতে পা দিয়া বলিল, সেতাব কারু কথা গেরাহ্য করে না, বুঝেছ? সে পেকো চামদড়ি কৃপণ—যা বল। ন্যায্য কথা সেতাব বলবেই, আর ন্যায্য দাবি পাওনা সে কড়াক্রান্তি কাউকে ছাড়বে না।
সে গটগট করিয়া উপরে উঠিয়া গেল। মেজাজটা সত্যই তাহার খারাপ হইয়া আছে।
মহাতাপ সন্ধ্যার সময় কাঁধে খোল লইয়া সংকীর্তনের দলে যোগ দিতে যাইবার পথে বাড়ির দুয়ারে প্রকাণ্ড একটা গোখুরা সাপ মারিয়াছে। বৈশাখ মাস, গোখুরা সাপকে পিতিপুরুষে ব্রাহ্মণ বলিত, তাহার উপর অনেক সাপ বাড়ির লক্ষ্মীর প্রহরী। সাপটা বাহির দরজার পাশ দিয়া যাইতেছিল। মহাতাপ একে মহাতাপ, তাহার উপর বৈকালে ভাঙ খাইয়াছে। সাপটাকে দেখিবামাত্র খোল নামাইয়া খামারের একটা বাঁশ লইয়া দুমদাম শব্দে দুই-তিনটা আঘাতেই শেষ। করিয়াছে। তিরস্কার করিলে বলিয়াছে, সাপ যদি লক্ষ্মীর পাহারা হয় তো মহাতাপও দিগ্গজ পণ্ডিত!
তারপর দুই হাতের বুড়া আঙুল নাড়িয়া বলিয়াছেকচু জান তুমি! এ বাড়ির লক্ষ্মীর পাহারা সাপ নেহি হ্যায়, মহাতাপ হ্যায়। এ বাড়ির লক্ষ্মী হল বড়াবউ, আর মহাতাপ মণ্ডল পাহারাদার!
সাপটাকে দেখাইয়া বলিয়াছে, ও বেটা লক্ষ্মীকে ডংশাতে এসেছিল। এখুনি বড় বউ আসত সন্ধ্যেতে বারদোরে জল দিতে। বাস্! ফেঁসা না-না করে লাগাত ছোবল!
বলিয়াই খোল লইয়া বাহির হইয়া গিয়াছে।
তাহার উপর পঞ্চায়েত আসরে আসিবার জন্য লণ্ঠনটি হাতে লইয়া পা-টি সবে বাড়াইয়াছে। অমনি আদরিণী বড় বউ টুক করিয়া পিছু ডাক দিয়াছে। সে ডাকার কত ঢং!
পিছু ডাকছি না। কিন্তু মনে করিয়ে দিচ্ছি আমার মাথার দিব্যি রইল!
সেতাব চমকিয়া উঠিয়াছিল। ভুরু কুঁচকাইয়া বলিয়াছিল–মানে?
হাসিয়া কাদু বলিয়াছিল—ওর আবার মানে থাকে নাকি? মাথার দিব্যি মানে মাথার দিব্যি।
–তা তো বুঝলাম। কিন্তু কিসের জন্যে?
কাদু উত্তর দিয়াছে—সত্যি যদি আমাকে ভালবাসতো কিসের জন্যে তা পঞ্চায়েতের আসরে যেতে যেতে ঠিক মনে পড়বে।
সেতাব চটিয়া উঠিয়াছিল—হেঁয়ালি সে ভালও বাসে না, বুঝিতেও পারে না। অথচ এই কাদুর অভ্যাস। কাদুর স্পৰ্ধা একেবারে আকাশে ঠেকিয়াছে। গায়ের অনেক মেয়ে আড়ালে আড়ালে বলে—মোড়লবাড়ির চাঁপাডাঙার বউ অহঙ্কারে যেন মটমট করছে। হেসে ঠেকার দিয়ে কথা কয় যেন বিন্দাবনের রাধা। সেতাবের মনে হইয়াছিল তাহারা মিথ্যা বলে না। সে উত্তরে বলিয়াছে—ভাল আমি কাউকে বাসি না; হ্যাঁ।
শুনিয়া কাদুর সে কি হাসি।—বেশ আর একবার বল—তিন সত্যি হোক।
–ক্যানে, মিছেমিছি তিন সত্যি করব ক্যানে? কি দায় পড়েছে!
সারাটা পথ সেতাব আপন মনে গজগজ করিতে করিতে আসিতেছে।
মজলিসের প্রান্তে গিয়া লণ্ঠন রাখিয়া প্ৰণাম করিল। তারপর মজলিসে গিয়া বসিল। বিপিন। তাহাকে দেখিয়াই বলিল, এস বাবা। তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি। নাও, তামাক খাও। কোটা সে আর একজনকে দিল। সে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তি। সে সেতাবের দিকে আগাইয়া দিল। সেতাব হুঁকোটা লইয়া মজলিস হইতে সরিয়া গিয়া পিছন ফিরিয়া টানিতে বসিল। টানিতে টানিতে বলিল, তারপর? কি ঠিক হল সব?
বিপিন বলিল, এ দিকে তো গোল কিছু নাই! জমি মাপজোক, হিসেবকিতেব সে সব তো হয়েই আছে একরকম। রামকেষ্ট শিবকেষ্ট, আপন আপন পছন্দ করেও নিয়েছে। বাসনকোসন ভাগ কাল সকালে হবে। এখন দুই খুড়ী বলছে—আমাদের খাবার মত জমি বার করে দাও।
শিবকেষ্ট বলিল, খেতে দিতে আমরা নারাজ নই। কিন্তু জমি দিতে গেলে আমাদের থাকবে কি?
এক খুড়ী বলিল, তা বাবা, তোমাদের সঙ্গে কি বউদের সঙ্গে আমাদের যদি না বনে?
বিপিন বলিল, ও কথা অনেক হল বউমা। আর থা। আমার বাপু জমি দেবার মত নাই।
যে মাতব্বর কাটা লইয়া সেতাবকে দিয়াছিল সে বলিল, আমি বলি কি, একটা ধান বরাদ্দ করে দেওয়া হোক, দুজনে দুই খুড়ীকে দেবে। আর দুই খুড়ীর থাকবার মত দুখানা ঘর, রান্নাঘর।
বিপিন বলিল, তা মন্দ কথা নয়। সেতাব, বল বাবা, কি বলছ?
সেতাব হুঁকাটা লইয়া মজলিসের মধ্যে ফিরিয়া বলিল, লেন, খান। বিপিন হুঁকাটা লইল। সেতাব বলিল, আপনাদের উপর আমার কথা বলা ঠিক নয় জেঠা। তবু না বললেও নয়।
একজন বিধবা বলিল, বল বাবা, তুমি হক কথা বল।
–হক কথাই বলব, যেন রাগ-টাগ কেউ করবেন না। ধান ঘর এসব আমার মত নাই। দেখুন, দু বছর পর যদি ধান বন্ধ করে, কি কোনো বছর যদি ভাল ফসল না হয়? দিতে না পারে?
বিধবা টিকুরীর খুড়ী বলিল, এই। বুদ্ধিগুণেই হা-ভাত, বুদ্ধিগুণেই খা-ভাত। পঞ্চায়েত বুঝে দেখুক।
ইন্দাশের খুড়ী সঙ্গে সঙ্গে সুর ধরিল, তার চেয়ে আমাদের দু জাকে পাঁচ বিঘে করে দশ বিঘে জমি আলাদা করে দাও বাবা, আমরাও নিশ্চিন্দি তোমরাও নিশ্চিন্দি। সাতখানা খাটের দড়িতে থাকব না।
—উঁহুঁ-উঁহুঁ। সেতাব ঘাড় নাড়িল। সাতখানা খাটের দুড়িতে থাকব না বললে কি হয়। খুড়ী? তোমাদের মুখে আগুন দেবে ওরা, তোমাদের মুখে জল দেবে, শ্রাদ্ধ করবে ওরা। বুড়ো বয়সে অসুখ করলে ওদেরই তোমাদের সেবা করতে হবে। তোমাদের শ্বশুর-স্বামীর বংশ। ভাসুরের ছেলে, স্বামীর ভাইপো। তোমাদের গর্ভের সন্তান নাই; ওরাই তোমাদের সন্তান। আমি বলি, জমি দেওয়াও নয়, ধান দেওয়াও নয়, দুই খুড়ী দুই ভাসুরপোর ঘরে মায়ের মতন থাকবে, তেমনি যত্ন-আত্যি করবে, নাতিনাতনী নিয়ে ঘর করবে, এরা সেবা করবে, ছেদ্ধা-ভক্তি করবে, বাস।
বিপিন বলিয়া উঠিল, ভাল ভাল ভাল। এর চেয়ে আর ভাল কথা হতে পারে না। গোবিন্দ। গোবিন্দ! হরিবোল হরিবোল।
সেতাব বলিল, পৃথক হলেই পৃথক। মা বেটায় পৃথক হলে মা বেটা পর হয়। আবার পুরকে আপন করলে পরই আপন হয়। শিবকেষ্ট রামকেষ্ট পৃথক হচ্ছে, কেন হচ্ছে জানি না। তা হচ্ছে। হোক। কিন্তু তোমরা খুড়ীরা দু ভাগকে চার ভাগ করে সংসারটার সর্বনাশ করে দিয়ো না।
অন্য একজন বলিল, বা বাস্। এর ওপর আর কথা নাই। হরিবোল হরিবোল।
আর একজন বলিয়া উঠিল, তাই বটে। হরিবোল হরিবোল!
মজলিসের মধ্যে গুঞ্জন উঠিল।
ওদিকে ঠিক এই সময়ে বাহিরের রাস্তা হইতে কোন একজনের চিৎকার শোনা গেল–বিচার করুক পঞ্চায়েত, এর বিচার করুক। গরিব বলে আমার মান-ইজ্জত নাই? পঞ্চায়েত–
বলিতে বলিতেই গায়ের চাদরখানা কোমরে জড়াইতে জড়াইতে আসিয়া উপস্থিত হইল রাখাল পাল। বিশ্বামিত্রের মত ক্রোধী শীর্ণকায় রাখাল আসিয়া বসিয়াই মাটিতে একটা চাপড় মারিয়া বলিল, পঞ্চায়েত এর বিচার করুক। মজলিসটা স্তব্ধ হইয়া গেল।
সেতাব বলিল, কিসের বিচার রে বাপু? হঠাৎ যে একেবারে গগন ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলি!
রাখাল বলিল, চেঁচাবে না? আলবৎ চেঁচাবে। পঞ্চায়েত বিচার করবে কি না বলুক!
বিপিন মোড়ল এবার বলিল, কি হল তাই বল?
—আমাকে মারলে। ঠাস করে এক চড়! এই গালটা দেখ, পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ বসেছে। সে লণ্ঠনটা তুলিয়া লইয়া নিজের গালের পাশে ধরিল।
—আঃ, তাই তো রে; কে মারলে—
—ওই ওরই ভাই। সে আঙুল দিয়া সেতাবকে দেখাইয়া দিল।
–মহাতাপ? সেতাব প্রশ্ন করিল।
–হ্যাঁ—হ্যাঁ—হ্যাঁ।
সেতাব মাথা হেঁট করিয়া বলিল, কি বিপদ হয়েছে যে আমার!
বিপিন প্রশ্ন করিল, এমনি মারলে তোকে মহাতাপ? মহাতাপ রাগী বটে, খানিকটা অবোধও বটে, কিন্তু এমনি কেন তোকে মারবে রাখাল?
–নাম সংকেত্তনের দলে আমি বাজাচ্ছিলাম। রাখাল পালের সঙ্গে খেলে কে হাত দিতে পারে বলুক পঞ্চায়েত। আমি হক মেরে বলছি, পাঁচখানা গায়ে কে আছে তা বলুক।
–নাই। তাই হল। সে কথা থাক। কি হল তাই বল।
রাখাল বলিল, তাই হল লয়। ডাক কে আছে? ডাক। একটু চুপ করিয়া রহিল। বোধ করি, কেহ তাহার এই আত্মশ্লাঘার উত্তরে সাড়া দেয় কি না দেখিবার জন্যই চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর বলিল, আমাকে বলে, তাল কাটছে। নিজে ভাঙ খেয়ে তাল কাটছে। তার ঠিক নাই। আমি বললাম, তোর কাটছে। তা গায়ের জোরে বলে, না, তোর। আমি বললাম, মহাতাপ, ক্ষ্যাপামি করিস তোর বউয়ের কাছে বউদির কাছে, এখানে করি না। এই আমার গালে বসিয়ে দিলে এক চড়।
বিপিন বলিল, তুই বউ বউদির কথা তুললি কেন?
—কি, হয়েছে কি? বলি তাতে কি হয়েছে কি? তোমরা বিচার করবে কি না বল?
সেতাব বলিল, হবে, বিচার হবে। নিশ্চয় হবে। বস্ তুই। আগে এই কাজ শেষ হোক। তারপর হবে।
—তারপর হবে?
–হ্যাঁ। বস্ তুই।
–বসব? বসতে হবে?
–হ্যাঁ রে, তামাক খা।
–নেহি মাংতা হ্যায়। চাই না বিচার আমি চাই না।
বলিয়া রাখাল হনহন করিয়া চলিয়া গেল। বাহির হইতে বলিল, বড়লোক কিনা? নিজের ভাই কিনা? বেমক্কা চড় খেয়ে যদি মরে যেতাম আমি?
বিপিন বলিল, গাঁজা খেয়ে খেয়ে রাখালের মেজাজে আগুন ধরেই আছে। মহাতাপকে সাবধান কোরো সেতাব। ভাঙ খেতে ওকে দিয়ো না।
সেতাব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আমার হয়েছে মরণ। বুঝলেন? আমার কথা কি শোনে?
–চাঁপাডাঙার বউমাকে বোলো, তাকে খুব মানে শুনেছি।
হঠাৎ সেতাব বলিয়া উঠিল, আমি যাই, হতভাগাকে একবার দেখি–
—বোসো, বোসো। মাথা খারাপ কোরো না। এদের কাজটা সেরে দাও বাবা।
সেতাব আবার বসিল। বলিল, এর আর সারাসারি কি বলুন? দুই খুড়ী দুই ভায়ের ভাগ। কে কাকে নেবে বলুক। খুড়ীরাও বলুক।
যে ব্যক্তি সেতাবকে কা দিয়াছিল সে বলিল, ছোট খুড়ী ইন্দেশের বউ তো ছোট ভাই রামকেষ্টর সম্পর্কে শাশুড়ি হয়। রামকেষ্টর বউ তো ভাইঝি হয়!
রামকেষ্ট বলিল, তা হোক। ছোট খুড়ীর টান দাদার ছেলেদের ওপর। ভাইঝিকে দশটা কড়া কথা না বলে জল খায় না।
ইন্দেশের বউ বলিয়া উঠিল, আর তোমার বউ মুখে ময়দা লেপে চুপ করে শোনে, না? একেবারে ভাল মানুষের পিতিমে। আমাকে বলে না? বলে কি বাবা সকল—তবে ভাইঝির কথা বলি শোন। লুকিয়ে চাল ধান বেচে পয়সা করে। আমি বলি, সাজার সংসারে চুরি করিস না। ভাগী ভঁড়িয়ে খেতে নাই। তাই রাগ বাবা। সেদিন নিজের ছেলেকে একটা বশি কিনে দিলে। তা শিবকেষ্টর ছোট ছেলেটা কাঁদতে লাগল। আমি বললাম, একেও একটা কিনে দে। পয়সা তো সাজার সংসারের পয়সা, মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। আমি বাবা তাকে একটা বাঁশি কিনে দিয়েছি।
হ্যাঁ, তা দিয়েছি। ছেলেটি আমার কাছে থাকতে ভালবাসে। এই রাগ।
সেতাব বলিল, বেশ বেশ। তা হলে খুড়ী শিবকেষ্টর সংসারেই থাকবে।
—তাই থাকব। সেই ভাল।
–আর মেজ খুড়ী টিকুরীর বউ রামকেষ্টর সংসারে থাকবে। বুঝলে গা খুড়ীরা?
টিকুরীর খুড়ী বলিল, বুঝলাম বাবা, খুব বুঝলাম। এমন বোঝা আর বুঝি নাই কখনও। আঃ, মরি মরি মরি।
—তার মানে?
–মানে? তুমি বাবা দুমুখো সাপ। এক মুখে কামড়াও এক মুখে ঝাড়। তাই হল। তোমরা পঞ্চায়েত, যা বলবে তাই হল।
বলিয়া সে উঠিয়া চলিয়া গেল।
সেতাব ডাকিল, খুড়ী! অ খুড়ী।
বিপিন বলিল, উই উঁহুঁ! ডেকো না। যাক। ভাগ করতে গিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করা যায় না। বাবা। থাক। এখন শিবকেষ্ট, রামকেষ্ট, ইন্দেশের বউমা, এই যা হল—তাতে তোমরা মোটামুটি খুশি তো?
শিবকে বলিল, আমার আপত্তি নাই।
–রামকেষ্ট?
–আমি মশায় যা করে দেবেন তাতেই রাজি।
ইন্দেশের বউ বলিল, আমি মেনে নিয়েছি বাবা, আমি মেনে নিয়েছি।
সেতাব উঠিল। আমি তা হলে উঠলাম জেঠা।
বিপিন বলিল, তা তোমার সেটা কি করে হবে? ঘোঁতনের সেইটা। ঘোঁতন তো আসে নাই।
সেতাব বলিল, সেসে আমি ছেড়ে দিলাম। বুঝেছেন? সে ছেড়ে দিয়েছি। মহাতাপ যখন ছেড়ে দিয়েছে, তখন ও-কথা থাক। তবে বলতে চেয়েছিলাম, ঘোঁতন আমাকে আঙ্গুল দেখাবে ক্যানে? বুঝেছেন? আর পাগলকে শিব সাজাবার লোভ দেখিয়ে দশ টাকা চাঁদাই বা নিয়েছে। ক্যানে? তারই জন্যে। বলুন না দশজনে এ জোচ্চুরি কি না! আচ্ছা, আমি চললাম জেঠা।
সে বাহিরে আসিয়া আবার একটি প্রণাম করিয়া লণ্ঠনটি হাতে করিয়া বাহির হইয়া গেল।
সেতাব বাড়ির দরজায় আসিয়াই চাঁপাডাঙার বউয়ের উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইল। বাড়ির ভিতরে চাঁপাডাঙার বউ কাহাকে তিরস্কার করিতেছে।
তোমাদের দু ভায়ের জ্বালায় হাড়ে কালি পড়ে গেল। নিন্দে শুনে কান পচে গেল।
সেতাব দরজা খুলিয়া গোয়াল-বাড়িতে প্রবেশ করিল, তাহার পর খামার-বাড়িতে ঢুকিল। এবার মহাতাপের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে বলিল, আমি তোমাকে জ্বালাব? আমি তোমার হাড়ে কালি পড়ালাম?
–পড়াও না?
–কক্ষনও না। সে পড়ায় তোমার স্বামী কুচুটে পাকাটি চামদড়ি কেপন—
–ছি ছি মহাতাপ।
–আর ওই ছোট বউ। ওই কুঁদুলী, ওই ঘ্যানঘেনানী, ওই দুটু সরস্বতী।
মানদার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ও মা গ—অ! বলে সেই দরবারে হেরে বউকে মারে ধরে। আমাকে নিয়ে পড়লে কেন?
সেতাব বাড়ি ঢুকিয়াই আলোটি কমাইয়া দিয়া খামার-বাড়িতে চুপ করিয়া বসিল।
বাড়ির ভিতরে তখন মানদা ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, খবরদার বলছি, আমাকে নিয়ে কথা বলবে না বলছি।
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, মানু, তুই চুপ কর।
—কেন? চুপ করব কেন? আমাকে নিয়ে পড়ল কেন?
মহাতাপ বলিল, পড়বে না? তুই তো আজ আমাকে ভাঙ খাওয়ালি। তুই কিনে আনিয়ে বেটে শরবত করে রাখিস নি, বললি নি? বলুক বড়গিনি; সারাদিন ভূতের মত খাটো, বরাবরের অভ্যেস না খেলে বাঁচবে কেন? ভাঙ খেলে আমার চড়াত করে রাগ হয়ে যায়। দিলাম চড়িয়ে রাখালের গালে।
—এখন রাখালের বউ গাল পাড়ছে শোন গিয়ে। যত শাপশাপান্ত একরত্তি মানিকের ওপর। কেন তুমি এমন করে মেরে আসবে?
–নিজে তাল কেটে আমাকে তালকানা বলবে কেন? আমি তালকানা? ও আমাকে বললে। আমি ছাড়ি না কাটি?
–হ্যাঁ, তুমিই তালকানা, তোমার তাল কেটেছিল, আমি বলছি। নাও, মার আমাকে দেখি।
–বড় বউ! ভাল হবে না বলছি!
–নাও, মার না।
—তুমি ছোট বউ হলে সে দিতাম এতক্ষণ।
মানদা ফোঁস করিয়া উঠিল, কই, মার না দেখি।
—দেখবি?
বড় বউ দাওয়া হইতে উঠানে নামিল,—কাল সকালে আমি চলে যাব তোমাদের বাড়ি থেকে। তোমাদের দুই ভায়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। তারও হবে। মহাতাপের দিকে চাহিয়া বলিল—তোমারও হবে। দুই ভাইয়ে যা খুশি করবে। এই রাতদুপুরে দুদিক থেকে দুই ভায়ের ওপর গাল পড়ছে। ওদিকে রামকেষ্টদের বাড়ি থেকে, এদিকে রাখালের বউ। আমি আর পারব। না, আমি আর পারব না।
বলিয়া চাঁপাডাঙার বউ ঘরে ঢুকিয়া গেল।
মানদা বলিল, নাও, হল তো। গোসাঘরে খিল পড়ল তো। আর খাবেও না, সাড়াও দেবে না, কাঠ হয়ে পড়ে থাকবে।
সেতাব এবার আসিয়া ঘরে ঢুকিল; সে আর থাকিতে পারে নাই। সে বলিতে বলিতেই ঢুকিল, একে বলে, এতো বড় ফেসাদ। একে বলে, ঘোরালে লাঠি, ফেরালে কোতকা সেই বিত্তান্ত! আরে বাপু, আমার অন্যায়টা কি হল? তুমি যা বললে, তাই করে এলাম। জমি ধান সব দেওয়া বাতিল করে দুই বউকে দুই ভায়ের ভাগে ভাগ করে দিলাম। তাতেই গাল দিচ্ছে টিকুরীর খুড়ী। রামকেষ্ট নয়। তা আমি কি করব? ঘোঁতনার ওপর নালিশ তুলে নিলাম
মহাতাপ উঠানে ভাম হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, তোমার মনোবাঞ্ছাই পূৰ্ণ হোক–চললাম আমি।
সেতাব ব্যস্ত হইয়া বলিল, অই—অই–ওরে, চললি কোথা? ওরে। অঃ, এ গোয়ারগোবিন্দকে নিয়ে কি করি বল তো? ওরে। সেতাবও বাহির হইয়া গেল।
বাহির হইতে মহাতাপ বলিল, সেই রাখলার কাছে চললাম। তার পায়ে ধরে নাকে খত দিয়ে নাকের চামড়া তুলে দিয়ে আসছি।
মানদা ব্যস্ত হইয়া ডাকিল, দিদি! দিদি! শুনছ?
বড় বউ আবার বাহির হইয়া আসিল।
মানু বলিল, ওই আবার গেল, বারণ কর।
–না। যাক। রাখাল প্রবীণ মানুষ, গাঁজা খায়, কিন্তু কখনও কারুর মত করে না। ধার্মিক লোক। তার কাছে মাপ চেয়ে আসুক। রাখালের বউয়ের শাপশাপান্ত আর শুনতে পারছি না।
মানদা ফোঁস করিয়া উঠিল—আর টিকুরীর খুড়ীর শাপশাপান্ত? বড় মোড়লকে পাঠাও পায়ে ধরতে।
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, বড় মোড়ল ন্যায়বিচার করে এসেংহ মানু। অন্যায় তো করে নি। টিকুরীর খুড়ীই অন্যায় করে শান্ত করছে। সে শাপান্ত আমাদিগকে লাগবে না। আর সে গাল তো দিচ্ছে বড় মোড়লকে আমাকে। তা দিক, মানিকের অকল্যাণ না হলেই হল।
শিবকেষ্ট রামকেষ্ট পালদের বাড়ির একাংশে পথের ধারে দাওয়ার উপর বসিয়া টিকুরীর বউ উচ্চকণ্ঠে গাল দিতেছিল। কিছুদূরে শিবকেষ্ট রামকে দাঁড়াইয়া আছে। আর কয়েকজন জুটিয়াছে। তাহাদের মধ্যে ঘোঁতন রহিয়াছে। দাঁড়াইয়া জটলা করিয়া বিড়ি টানিতেছে।
পল্লীগ্রামে সেই ছড়ার মত বাঁধা গালিগালাজ-অভিসম্পাত। তাহার বাধুনি বিচিত্র, সুর বিচিত্র।
টিকুরীর বউ বলিতেছিল, সব্বস্বান্ত হবে, পথে দাঁড়াবে, ফকির হবে, জমিদার মহাজনে ড়ুগড়ুগি বাজিয়ে যথাসৰ্বস্ব নিলেম করে নেবে। টিনের চাল ঝড়ে উড়ে যাবে, পাকা মেঝে ফেটে চৌচির হবে। সাপখোপের আড়ত হবে। অকালে মরবেন, বিনা রোগে ধড়ফড়িয়ে যাবেন-ওই আদুরী গিদেরী পরিবার চাঁপাডাঙার বউয়ের দশা আমার মত হবেন।
ওপাশ থেকে ঘোঁতন বলিয়া উঠিল, তা হবে না খুড়ী, তা হবে না। ও শাপ দিও না। ফলবে না, ফলবে না।
টিকুরীর বউ ফোঁস করিয়া উঠিল—কে রে, বলি তুই কে রে মুখপোড়া ভঁ্যাদড়? তুই কে?
ঘোঁতন হাসিতে হাসিতে আসিয়া দাঁড়াইল।—মুখখানা আমার কালো বটে খুড়ী, কিন্তু পোড়ে নাই; মেচেতা পড়েছে। আমি ঘোঁতন।
—ও। ইংরেজি-পড়া বাবু, যাত্রার দলের কাপ। তা তুই তো বলবিই রে? তোকে ধান। ছেড়ে দিয়েছে, নালিশ তুলে নিলে।
–নিলে সাধে! আমি ঘোঁতন ঘোষ। হোৎ-তা-তা লাঙল-ঠেঙানো বুদ্ধি নয় আমার। আমি কলকাঠি টিপতে জানি। পাকাল মাছের পেটে কেঁচোর বাসার খবর জানি আমি। বুঝেছ! আমার নামে নালিশ করবে?
—তুই আমার হয়ে একটা নালিশ ঠুকে দিতে পারিস? পাপরের দরখাস্ত না কি বলে। টাকাকড়ি লাগে না, অনাথ গরিব বলে।
–বললেই পারি। ঘোঁতন কাউকে ডরায় না।
–তা হলে বোস্। আমি গালটা দিয়ে নিই। মনের ঝালটা মিটিয়ে নিই।
—তা লাও। ওদিকে রাখালের বউও খুব জুড়েছে-ওলাউঠো হবে, না হয়ত রাজকাশ হবে। লোহার গতর ভেঙে যাবে। ছেলে মরবে। বউ ভিক্ষে করবে
সুর ধরিয়া সঙ্গে সঙ্গে টিকুরীর বউ শুরু করিল, করবে, ভিক্ষে করবে, দোরে দোরে হরিবোল বলে ওই চাঁপাডাঙার বউ
হঠাৎ চমকিয়া টিকুরীর বউ বলিল, কে র্যা?
অন্ধকার পথে একটা দুনী মাথায় করিয়া যাইতেছিল নোটন।
–আমি গো, নোটন।
–নোটনা। তা মাথায় কি? দুনী নাকি? এত রেতে দুনী নিয়ে কি করবি?
–হ্যাঁ গো। আকের জমিতে হেঁচন দিতে হবে।
শিবকেষ্ট বলিল—চুপ কর খুড়ী। সেতাবদের কৃষেণ নোটন-ও সব শুনে গেল। বলবে তে গিয়ে সব মুনিব-বাড়িতে।
দুই হাতের বুড়া আঙুল নাড়িয়া বুড়ি বলিল-বয়েই গেল—বয়েই গেল। আমার বেগুন বাড়ি ভেসে গেল! শুনবে! শোনবার জন্যেই তো বলছি! আমি কি ভয় করি নাকি কাউকে?
তখন সেতাবের বাড়িতে দাওয়ার উপর পিঁড়িতে বসিয়া রাখাল ভাত খাইতেছে। সঙ্গে বসিয়াছে—মহাতা ও সেতাব। পরিবেশন করিতেছে চাঁপাডাঙার বউ। সে অম্বল পরিবেশন করিতেছিল। সকলেই তালুতে টোকা মারিয়া খাইতেছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে বলিতেছিল, আঃ!
রাখাল বলিল, আর একটু দাও, বউমা, আর একটু! বেড়ে বেঁধেছ! খাসা হয়েছে!
সেতাব বলিল, তা হলে কি হবে! কাঁচা তেলের গন্ধ উঠেছে। এত করে নাকি তেল দেয়! হুঃ?
মহাতাপ বলিল, তেল বেশি হয়েছে, তেল বেশি হয়েছে! তেল নইলে রান্না হয় নাকি?
রাখাল বলিল, আরে, ওই তেলেই তো অম্বলের সৈরভ…সুবাস! নেশার মুখে যা লাগছে, সে কি বলব, অম্রেত যেন। আর তেমনি কি রান্নার তাক। বেঁচে থাক মা সুখে থাক, সংসারের কল্যাণ হোক। খেয়ে মুখটা জুড়ল। পোড়া আর ধরা আসেদ্ধ আর নুনচড়া খেয়ে জিভে যেন চটা ধরেছিল!
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, সব আমাদের ছোট বউয়ের রান্না।
–বা-বা-বা! বলিহারি বলিহারি! তা হবে না কেনে? মহাতাপ যে ছোকরা বড় ভাল, বড় ভাল ছোকরা! আমাকে বড় মেরেছে ভাঙের নেশার মুখে। তা মারুক! ভুল করেছে। আবার গিয়ে তো বললে রাখালদাদা, দোষ হয়েছে। তা আমিও বললাম, বাস্ বাস্; ঠিক আছে। ভাগ্যে পঞ্চায়েতে নালিশ করি নাই! বুয়েচ, হাতের তীর ছাড়তে নাই। ছাড়লেই বাস, ভ্যাক করে বিঁধে যাবে। তাই তো আমার পরিবারকে তখন থেকে বলছি—এমন করে গাল দিস না, দিস না। তা বুয়েচ, আমাকে মানুষ বলেই গণ্যি নাই। তোমরা কিছু মনে কোরো না-ওর কথায় কিছু হয় না। বুয়েচ? তা সেও ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। মহাতাপ বললে, খেতে হবে, আজই রেতে। তা আমি দোনোমনো করছিলাম, কিন্তু সে-ই বললে—সে কি, ডাকছে হাত ধরে, যাবে না কি? বুয়েচ। তা পেট খুব ভরল। খুব।
মানদা আসিয়া দুধের বাটি নামাইয়া দিল।
—আবার কি?
–দুধ।
এমন সময় বাহিরে ধম করিয়া একটা শব্দ উঠিল। সকলেই চকিত হইয়া উঠিল। মহাতাপ খাবার ছাড়িয়া উঠিয়া লাফাইয়া নামিল।
—কে?
ওপাশ হইতে সাড়া আসিল, আমি গো ছোট মুনিব।
মহাতাপ বাহির হইয়া গেল।
খামার-বাড়িতে নোটন দুনীটা সশব্দে ফেলিয়াছে, শব্দটা তাহারই।
মহাতাপ বলিল–দুনী আনলি?
–না আনলে? তোমার মন তো বিন্দাবন, যদি বাঁশি বাজে তো রেতেই বলবেচ যাব, লাগাব দুনী! তোমার কিলকে বড় ভয়!
—দাঁড়া রে বাবা, খোল কুটে রেখেছে কি না দেখি!
–সে বড় মোল্যান ঠিক রেখেছে। কাজে তার ভুল হবে না।
আর খোল তো এসেছে কাল বিকেলে। আজ কুটলে কখন? বড় বউ–অ বড় বউ?
ফিরিয়া আসিয়া বাড়িতে ঢুকিল। তখন সেতাব-রাখালের খাওয়া হইয়া গিয়াছে। তাহারা হাত মুছিতেছে।
রাখাল বলিতেছে, তা তুমি পালদের বাড়িটা ভাগ করে ভাল করেছ সেতাব। ঠিক করেছ। বউ দুজনকে ভাগ করে দুজনার ঘরে দিয়েছ, ন্যায্য করেছ। হু! তা নইলে জমি দিলে বেচেঘুচে পালাত। বেশ করেছ। তা হলে আমি যাই। বুয়েচ? আর ওই আমার পরিবারের গালের জন্যে কিছু মনে কোরো না। আমি ঠাণ্ডা, সেও ঠাণ্ডা। বুয়েচ? আমি চললাম। সে আসবে, কাল মহাতাপের বউ-ছেলেকে আশীর্বাদ করতে আসবে। বুয়েচ! বলিয়া পুলকিত হাস্যে স্মিতানন হইয়া উঠিল।
সে চলিয়া গেল। ওদিক হইতে আসিয়া মহাতাপ ঘরে ঢুকিল।
মহাতাপ হাঁকিয়া বলিল, বলি কানমে কেতনা ভরি সোনা পিধা হ্যায় বড় মোল্যান? বলি, আকের গোড়ায় দেবার খোল কোটা হয়েছে?
মানদা বলিয়া উঠিল, বিত্যেব দেখ! ষাড়ের মত চেঁচানি দেখ?
কথাটা অবশ্য সে চাপা গলাতেই বলিল, কারণ ভাসুর রহিয়াছে। কিন্তু কথাগুলা কাহারও কান এড়াইল না। এড়াইবার জন্য বলেও নাই সে।
মহাতাপ ফাটিয়া পড়িল, অ্যাও! কিল মেরে দাঁত ভেঙে দোব। সে আগাইয়াও গেল।
বড় বউ বাহিরে ছিল না। সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া মহাতাপের সামনে দাঁড়াইয়া বলিল, কি হচ্ছে, হচ্ছে কি?
মহাতাপ থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল। বড় বউ বলিল—মারবে। কেন মারবে শুনি?
মহাতাপ বলিল, তোমাকে নয়। ওই দুটু সরস্বতীকে।
মানদা বলিয়া উঠিল, বটে! আমি বুঝি বানে ভেসে এসেছি?
আরে তুই আমাকে ষাড় বলি কেনে?
বড় বউ বলিল, তুমি ওকে দুষ্টু সরস্বতী বলবে কেন? আর বাঁড় তো ভাল কথা। বাবা শিবের বাহন। মা দুৰ্গার সিংহ তার কাছে পারে না।
—আমাকে বোকা বোঝাচ্ছ তুমি!
–না। তাই পারি? বোসো, ঠাণ্ডা হয়ে বোসো। এখন কি বলছিলে বল? কানে কত ভরি সোনা পরেছি, নাকি?
মানদা বলিয়া উঠিল, শুধাও না, কত ভরি দিয়েছে?
মহাতাপ বলিল, সে ওই কেপনকে বলবে। কেবল ধান বেচেছে, গুড় বেচেছে আর টাকা করেছে।
সেতাব আর পারিল না। বলিল, তুমি দাতাকৰ্ণ হয়ে লোককে পাওনাগণ্ডা ছেড়ে দিয়ে আসছ! এমনি করলে, খাবে—দু হাতের বদলে চার হাতে খাবে।
মহাতাপ উত্তর না পাইয়া হঠাৎ মাটিতে চাপড় মারিয়া চেঁচাইয়া উঠিল, আমার খোল কোটা হয় নাই কেনে? আমার আকের জমিতে হেঁচন দিতে হবে। তার আগে খোল না দিলে, আবার সেই এক মাস পর ভিন্ন হবে না। কেনে খোল কোটা হয় নাই?
সেতাব বলিল, হবে রে হবে। ব্যস্ত হোস না! দু-তিন দিন দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
কাদম্বিনী বলিল, কাল পরশু দুদিনে আমি কুটিয়ে দোব। তুমি ক্ষেপো না। আর ঘেঁচন দেবার জন্যে তাড়াতাড়ি কোরো না। জল নামবে। দু-তিন দিনের মধ্যেই নামবে।
–নামবে। তোমার হুকুমে নামবে। আকাশ খাঁখাঁ করছে। জ্বলে গেল সব।
–নামবে। গরম দেখছ না? তারপর ওই দেখ। লণ্ঠনটা হাতে লইয়া সে দেওয়ালের গায়ে আলো ফেলিয়া অন্য হাতের আঙুল দিয়া দেখাইল—মেঝে থেকে পিঁপড়েরা ডিম মুখে করে ওপরে উঠে যাচ্ছে।
দেখা গেল, সারি বাঁধিয়া লক্ষ পিঁপড়া উপরে উঠিয়া চলিয়াছে।
বড় বউ বলিল, শুধু এক জায়গায় না, আজ আমি পাঁচ-সাত জায়গায় দেখেছি।
–আ—ত তেরি তোম তেরে না। বলিয়া মহাতাপ একটা লাফ দিয়া উঠিল; তারপর বলিল, দাদা, বোসস বোসো। তামুক সাজি।
বলে কলকে লইয়া তামাক সাজিতে বসিল।
বড় বউ ডাকিল, মানু আয় খেয়ে নিবি।
বড় বউয়ের দেখায় ভুল হয় নাই। রাত্রে সত্য সত্যই জল নামিল। গুরু গুরু শব্দে মেঘগৰ্জনে মহাতাপের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল।
মানু তখন উঠিয়া পড়িয়াছে। সে ঘরের জানালা বন্ধ করিতে ব্যস্ত।
মহাতাপ সদ্য-ঘুম-ভাঙা চোখে বিহ্বলের মত চাহিয়া বলিল, জল? মেঘ ডাকছে?
মানু বলিল, ছাটে সব ভিজে গেল।
মহাতাপ বলিল, যাক যাক। বন্ধ করিস না মানু, বন্ধ করি না।
–বন্ধ করব না?
–না। আহা-হ্যাঁ, কেমন জল নেমেছে দেখ দেখি!
উঠিয়া গিয়া মানুর হাত ধরিল। বলিল, বোস এইখানে। বসে বসে জল দেখি।
মানু ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিল, জল দেখব?
–হ্যাঁ। আমার কোলে মাথা রেখে শো। আমি জল দেখি আর তোকে দেখি। হঠাৎ এই বর্ষার আমেজে তাহার আবেগ উথলিয়া উঠিল। সে দুই হাতে মানুর মুখখানি ধরিয়া বলিল, পাগলি পাগলি পাগলি! তোকে আমি খুব ভালবাসি।
–ছাই বাস। দিনরাত মারব, মারব আর অকথা কুকথা!
–আরে! সে কথা তোকে না মানু, তোকে না। তোর ক্যাঁটকেঁটে কথাকে–
–হুঁ। বড় মোল্যানের কথাগুলা তো মিষ্টি লাগে! তার বেলা?
আরে বাপ রে! দুই হাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া মহাতাপ বলিল, আরে বাপ রে, বড়কী বহু, উ তো ঘরকে লছমী হ্যায়।
মহাতাপ মানদাকে সজোরে বুকে চাপিয়া যেন পিষিয়া ফেলিল।
ওদিকে চাঁপাডাঙার বউয়ের ঘরে চাঁপাডাঙার বউ আপন ঘরের জানালায় একা বসিয়া বাহিরের বর্ষণের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে।
সেতাব মুড়িসুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে। দুর্বলদেহ সেতাবের অল্পেই শীত লাগে। গ্রীষ্মকালেও সে একখানা চাদর পায়ের তলায় রাখিয়া তবে ঘুমায়। চাঁপাডাঙার বউ স্বামীর জড়োসড়ো ভাব দেখিয়া একটু হাসিয়া চাদরখানা তাহার গায়ে চাপাইয়া দিল। ও ঘরে মানিক কাঁদিয়া উঠিল। চাঁপাডাঙার বউ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।