থার্ড পিরিয়ডে অংক আপা ক্লাসে ঢুকেই বললেন, বিলু ক্লাস শেষে আজি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। অংক আপা আজেবাজে প্রশ্ন করবেন। কয়েকদিন আগে হাফ টাইমের সময় অংক আপার সঙ্গে দেখা। আপা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার মা শুনলাম ঐ লোকটার সঙ্গে ইন্ডিয়া চলে গেছে, সত্যি নাকি?
না সত্যি না।
কোথায় আছে তাহলে?
আমি চুপ করে রইলাম।
আপা গলা নিচু করে বললেন, বলতে পার না, না?
সিরাজগঞ্জে আছেন।
ও বাচ্চাকাঁচা হয়েছে নাকি?
আমি জানি না আপা?
আমাকে কে যেন বলল একটা ছেলে হয়েছে।
আমার নিজের ধারণা মেয়েদের মতো হৃদয়হীন পুরুষরা হতে পারে না। ছেলেরা কেউ এখনো আমাকে আমার মা প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অথচ চেনাজানা মেয়েদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে কিছু জানতে চায়নি।
ক্লাসের বন্ধুদের কথা বাদই দিই, বন্ধুদের মা-খালাদের পর্যন্ত কৌতূহলের সীমা নেই। কোনো না কোনো ভাবে টেনেন্টুনে ঐ প্রসঙ্গ আনবেই।
বিলু তোমরা আগে কিছু টের পাওনি? আগেই তো টের পাওয়া উচিত।
তোমার মা নাকি যাবার আগে বহু টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে?
মা গিয়েছেন প্রায় দুবছর আগে। এখনো কেউ সেটা ভুলতে পারে না কেন কে জানে?
অংক ক্লাসটা আমার খুব খারাপভাবে কাটল। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র গেলাম। আপার কাছে। আপার নিজের কোনো ঘর নেই। কমন রুমে একগাদা টিচারের সঙ্গে বসে আছেন। তিনি আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমাদের বাড়িতে বয়স্ক মহিলা কেউ নেই?
কাজের একটি মেয়ে আছে। আকবরের মা।
সে ছাড়া কেউ নেই?
জি না আপা। কেন?
তোমরা তো বড় হচ্ছে এখন, কিছু কিছু জিনিস তোমাদেব বলা দরকার, কেউ বলছে না। তাই তোমাকে ডাকলাম।
আমি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, বিলু তোমার এবং নীলুর দুজনেরই এখন ব্ৰা পরা উচিত।
আমি চোখ-মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তোমার বাবাকে বলবে কিনে দিতে। বাবাকে বলাব মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। আর যদি লজ্জা লাগে তাকে আমি একটি চিঠি লিখে দিতে পারি।
দিন, একটা চিঠি লিখে দিন।
ঠিক আছে, ক্লাস ছুটির পর চিঠি নিয়ে যেও। আরেকটি কথা, নীলু। মোটেই পড়াশোনা করছে না। তোমার বাবাকে বলবে কোনো প্রাইভেট টিচার রেখে দিতে। অংকে সে খুব কাঁচা। অংক জানে না বললেই হয়।
আপা আমি বলব।
আছে তুমি যাও এখন। এই সব বললাম দেখে কিছু মনে করনি তো?
জি না।
মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। রাগ করার কিছু নেই বিলু। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। এত ঝামেলার মধ্যেও যে মেয়ে প্রতি বিষয়ে সবচে বেশি নাম্বার পায় তার প্রশংসা তো করতেই হয়।
অংক আপা একটু হাসলেন।
বিলু?
জি।
কখনো কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবে।
ঠিক আছে আপা বলব।
শোন আরেকটা কথা। ইয়ে কি যেন বলে তোমার বাবা-নাকি আবার বিয়ে করছেন?
জি না।
তুমি বোধহয় জানো না। বাবার বিয়ের কথা তো মেয়েদের জানার কথা নয়।
বাবার বিয়ের কথা কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। দিনাজপুর থেকে বড় মামা এসেছিলেন। তিনি পর্যন্ত নিলুকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন, দুলাভাই নাকি বিয়ে করছেন? নিলু তার স্বভাবমত হেসে ভেঙে পড়েছে।
হাসছিস কেন?
হাসির কথা বললে হাসব না মামা?
আমি কি হাসির কথা বললাম নাকি? বিয়ে করলে তোদের অবস্থাটা কি হবে ভেবেছিস?
কি আর হবে। আমার তো মনে হয়। ভালই হবে। কথা বলার একজন লোক পাওয়া যাবে।
কথা বলার লোকের তোর অভাব?
হ্যাঁ মামা। বিলুর সঙ্গে কি আর কথা সব বলা যায়? মা জাতীয় একজন কেউ লাগে। বাবা বিয়ে করলে ভাল হয় মামা।
করছেন নাকি?
জানি না মামা। তবে দোতলার নজমুল চাচা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা এখন একটা বিয়ে করলে মনে হয় সংসার স্বাভাবিক হয়।
তুই কি বললি?
আমি বললাম, তা তো ঠিকই।
মামা গম্ভীর হয়ে পড়লেন। নীলু বলল, তারপর একদিন এক বুড়োমত ভদ্রলোক এসে বাড়িটাড়ি ঘুরেটুরে দেখলেন। মার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক কি রকম ছিল জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করলেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ মামা, বিয়ে বোধহয় লেগে যাচ্ছে।
নীলু খিলখিল করে উঠল। আমি নিজেও অবাক হলাম। এসব কিছুই আমি জানি না। নীলু আজকাল অনেক কথাই আমাকে বলে না। প্রায়ই সে তার বান্ধবীর বাড়ি যাচ্ছে হঠাৎ করে তার সঙ্গে এত খাতির হল কেন–জিজ্ঞেস করাতে সে গা এলিয়ে হোসেছে। এ বাড়ির সবাই বদলে যাচ্ছে। বাবা বদলেছেন সবচেয়ে বেশি। আমাদের জন্মদিন গেল। জুন মাসের দশ তারিখ। বাবা কোনো কবিতা লিখলেন না। কয়েকদিন আগে দেখলাম সেতারাকে কি জন্যে যেন ধমকাচ্ছেন। সেতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার এরকম আচরণ তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। বাড়িও ফিরছেন। আজকাল অনেক রাতে। গতকাল বাড়ি ফিরলেন সাড়ে এগারোটার দিকে। আমি জেগে বসে ছিলাম। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে আছ কেন? আর থাকবে না। দশটা বাজতেই ঘুমাতে যাবে।
আমি শান্ত স্বরে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন?
রেগে রেগে কথা বলছি নাকি?
আমি উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবা খাওয়া-দাওয়ার পর আমার ঘরে পাশের জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, এই বিলু, বিলু। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। বাবা বেশ খানিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।
বাবা এরকম ছিলেন না, বাবা বদলে যাচ্ছেন। নীলু। তো বদলে গেছে। আমি নিজেও বোধহয় বদলাচ্ছি। একা একা থাকতে ইচ্ছে করে। সেদিন খুব ঝগড়া করলাম নীলুর সঙ্গে। আমি মাঝে মাঝে অচেনা সব মানুষদের মন গড়া চিঠি লিখি, নীলু। সেটা জানে। তবু সে একটা চিঠি হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, প্রেমপত্র নাকি রে? তারপর মুখ বাঁকা করে পড়তে শুরু করল–আপনাকে একটি কথা বলা হয়নি। এখন শ্রাবণ মাস তো, তাই খুব বৃষ্টি হচ্ছে। রাতদিন ঝমঝম বৃষ্টিশ নীলু। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, শ্রাবণ মাস কোথায় রে, এটা তো আশ্বিন মাস। তোর মাথাটা খারাপ। হি-হি-হি। আমি চিঠি কেড়ে নিয়ে নীলুর গালে একটা চড় কষিয়ে দিলাম। নীলু দারুণ অবাক হয়ে গেল। আমি এরকম ছিলাম না।
বাবা বিয়ে করলে সংসার স্বাভাবিক হলে তো ভালই হয়। নীলু ঠিকই বলেছে, সব বাড়িতে মা জাতীয় একজন কেউ দরকার। সে সময়মত মেয়েদের ব্ৰা কিনে দেবে।
কিন্তু আমার বড় মামা সেদিকটা দেখছেন না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু-একটা হতে যাচ্ছে। মামা বললেন, খোঁজখবর না রাখায় এটা হচ্ছে। নানান ধান্ধায় থাকি। খোঁজখবর নেই তা ঠিক। মামার বাড়ির সঙ্গে এখন সম্পর্ক নেই বললেই হয়। মামারা অনেকদিন ধরে আসেন না। আগে ঘনঘন আসতেন এবং যতবার আসতেন ততবারই জিদ করতেন। আমাদের দিনাজপুরে নেবার জন্যে। বাবা ব্যবসাপাতির ঝামেলা তুলে এড়িয়ে যেতেন। মা স্পষ্ট বলতেন, তোমাদের বৌদের সঙ্গে আমার বনে না। বাবা মা মারা গেলে বাপের বাড়ি থাকে না। সেখানে যাওয়া যায় না।
বাবা আবার বিয়ে করবেন কি-না এই প্রসঙ্গে বড় মামার এরকম কৌতূহলের কারণ কি আমি ধরতে পারি না। মামাদের সঙ্গে আমার বাবার তেমন আন্তরিকতা নেই। এইসব নিয়েও মার সঙ্গে তার ঝগড়া হত। মা বলতেন, আমার ভাইদের তুমি সহ্য করতে পার না, এর কারণ কি আমাকে বল তো?
সহ্য করতে না পারার কি আছে?
কথা বল না, চুপচাপ থাক।
একেক জনের একেক রকম স্বভাব। আমার স্বভাবই হচ্ছে কথা কম বলা।
দোতলার নজমুল হুঁদা সাহেরের সঙ্গে তো খুব বকবক কর।
আমি বকবক করি না। উনি করেন। আমি শুনি।
আমার ভাইদের সঙ্গে তো তাও কর না।
ওনার বকবকানি শোনা যায়। তোমার ভাইদেরটা শোনা যায় না।
ও–তাই বুঝি?
বাবা চুপ। মা কাটা কাটা গলায় বললেন, বেশ তো আমি ওদের বলব যেন আর না আসে।
মামাদের আসা বন্ধ হয়নি। আমার ধারণা বাবার কাছ থেকে তারা টাকা-পয়সা নিতেন। আমার সব মামারাই ব্যবসা করতেন। টাকার দরকার তাদের লেগেই থাকত। এটা অবশ্যি আমাদের অনুমান। কারণ মামারা হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেই মা গম্ভীর মুখে বলতেন, দরকার ছাড়া তো তোদের আসা হয় না, আবার দরকার হয়েছে বুঝি? মামারা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসতেন।
এবারো যখন এলেন সম্ভবত টাকার জন্যেই এলেন। বাবার ব্যবসা পাতির অবস্থা সম্পর্কে খুব ব্যস্ত হয়ে খোঁজখবর শুরু করলেন। আমার ঘরে ঢুকে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, দুলাভাইয়ের ব্যবসা কেমন চলছে রে?
ভালই বোধহয়। আমি তো এইসব ঠিক জানি না।
না জানলে হবে কেন? খোঁজখবর রাখতে হয়। দুলাভাইয়ের ছেলে নেই। তোদেরই তো খোঁজ করতে হবে। ঠিক না?
আমি চুপ করে থাকি। বড় মামা সিগারেট ধরান একটা। নিচু গলায় বললেন, মনে হল দুলাভাইয়ের ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। তোদের গান-বাজনা শেখাচ্ছেন, এসব তো দারুণ খবচান্ত ব্যাপার। হাতি পোষার মতো, লাভ হয় না কিছু।
লাভ হবে না কেন?
আরে দূর, দুই-একদিন সারেগামা করলেই যদি গান হত তাহলে কি আর কথা ছিল নাকি? আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বড় মামা হঠাৎ করে বললেন, তোদের এখন শাড়ি পরা উচিত, বুঝলি? তোর আর নীলুর। বড় হয়ে গেছিস।
কথাটা এমন অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলা যে আমি হকচাকিয়ে পেলাম। বড় হয়ে যাচ্ছি। বড় হওয়াটা খুব-একটা কি বাজে ব্যাপার?
রাস্তাঘাটে একা একা চলাফেরা করবি না। ঐদিন দেখলাম সন্ধ্যার পব নীলু বাড়ি আসল।
বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। জন্মদিন।
জন্মদিন-ফন্মদিন যাই হোক একা একা যেন না যায়। সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম যন্ত্রণা।
আমরা সুন্দরী বুঝি?
হুঁ, ইয়ে সুন্দরী তো বটেই। আয়না দিয়ে নিজেদের দেখিস না?
আমি হঠাৎ বলে বসলাম, কে বেশি সুন্দর মামা? আমি না নীলু?
মামা জবাব দিলেন না। তাঁকে খুব বেশি চিন্তিত মনে হতে লাগল।
ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষাতে নীলু অংক এবং ইংরেজিতে পাস করতে পারল না। অংকে পেল। তেইশ আর ইংরেজিতে একত্রিশ। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। হাসিমুখে বলল, দূর–আমি আর পড়াশুনা করব না।
করবি না তো কি কারবি?
বিয়ে করব।
বিয়ে করবি মানে? কাকে বিয়ে করবি?
বিয়ে করার লোকের অভাব আছে নাকি? আমি হ্যাঁ বললে এক্ষুণি দুতিনটা ছেলে চলে আসবে।
তাই নাকি?
হুঁ, তুই কী ভাবিস আমাকে?
আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, বাবা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে রাগ করবেন।
রাগ করবার কী আছে? সবাই একরকম হয়? কেউ ভাল করে, কেউ করে না।
বাবা রাগ করলেন না। প্রগ্রেস রিপোটটা দেখলেন অবাক হয়ে।
এ রকম হয়েছে কেন নীলু?
পড়াশুনা করতে আমার ভাল লাগে না বাবা।
আগে তো লাগত।
আগেও লাগত না। জোর করে পড়ড়াম।
ভাল না লাগলেও অনেক কিছু করতে হয় নীলু। তোমাদের জন্যে একজন টিচার রেখে দিলে কেমন হয়?
নীলু কথা বলে না। বাবা বললেন, তোমার কী মনে হয় বিলু মা?
ভালই হবে।
নীলু হালকা স্বরে বলল, এখন থেকে আমি একা একটা ঘরে থাকতে চাই বাবা।
পশ্চিমের ঐ ঘরটা পরিষ্কার করে দিলেই হবে। আমি রমজান ভাইকে বলব।
একা থাকার দরকার কী? তোমার তো আবার ভূতের ভয়।
এখন আমার ভূতের ভয় নেই বাবা।
আমার মনে হয় না। এটা ভাল হবে।
ভালই হবে বাবা।
ঠিক আছে। সেতারা কার সঙ্গে থাকবে?
তোমার সঙ্গে কিংবা বিলুর সঙ্গে।
উঠি চলে গেল। বাবা গন্ধীর হয়ে বললেন, তোর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে?
জি না।
নীলু সারা দুপুর জিনিসপত্র সরিয়ে পশ্চিমের ঘরটা গোছাল। আমি কয়েকবার বললাম, এই–রাত্ৰিবেলা ভয় পাবি। নীলু। কোনো উত্তর দিল না। বিকেলের মধ্যে দেখলাম ঘর তৈরি হয়ে গেছে। একটা খাট। পড়ার টেবিল। আলনা। মায়ের ড্রেসিং টেবিল দিয়ে চমৎকার সাজিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এক ফাঁকে আমাদের ঘর থেকে মায়ের ছবিটাও নিয়ে গেছে।
সেতারা পড়েছে খুব মুশকিলে। সে রাতে কার সঙ্গে ঘুমোবে বুঝতে পাছে না। আমাকে সে ঠিক পছন্দ করে না। বাবার সঙ্গেও থাকতে চায় না। কিন্তু নীলু বলে দিয়েছে সে একা একা ঘুমোবে। আমি সেতারাকে বললাম, ওর যা ভূতের ভয়, দেখবি রাত আটটা বাজিলেই এই ঘরে চলে আসবে কিংবা তোকে নিয়ে যাবে।
সেতারা খুব-একটা ভরসা পাচ্ছে না। সে মুখ কালো করে দুপুর থেকেই আমার পেছনে ঘুরছে।
ছুটির দিন বিকালে সাধারণত নজমুল চাচা আমাদের সঙ্গে এসে চা খান। আজ তিনি খবর পাঠালেন তার ঘরে গিয়ে যেন আজকের চাটা খাওয়া হয়। তিনি মুক্তাগাছার মণ্ডা আনিয়েছেন। নীলু বলল, দূর–আমি যাব না।
যাবি না কেন?
আমার মাথা ধরেছে।
দুটো এসপিরিন খা।
বললাম তো ভাল লাগছে না।
নীলু তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
নজমুল চাচার শরীর ভাল ছিল না। চাদর মুড়ি দিয়ে বসে ছিলেন। নজমুল চাচা, সাধারণত চা খেতে খেতে মজার মজার গল্পগুজব করেন। আজ সে সব কিছুই হল না। নজমুল চাচা বিরসমুখে বললেন, তোর বাবার একটা বিয়ের কথা হচ্ছে। মেয়েটির হাসবেন্ড মারা গেছে একাত্তুরের যুদ্ধে। একটি ছেলে আছে। ন’বছর বয়স। ছেলেটা তার নানার কাছে থাকে।
আমি কিছু বললাম না। নজমুল চাচা বললেন, মেয়েটা খুব ভাল। আমি চিনি। প্রাইমারি স্কুলের টিচার। একদিন নিয়ে আসব। এখানে। তোরা কথাবার্তা বলিস।
জি আচ্ছা।
সৎ মায়ের অত্যাচার-টত্যাচার সম্পর্কে যা শোনা যায় সে সব ঠিক না। তাছাড়া তোরা তো যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এত বড় বড় মেয়েরা তো সাধারণত বন্ধুর মতো হয়। ঠিক না?
জানি না, হয়ত হয়।
তোর বাবার অবস্থাটা দেখতে হবে না? রাত-বিরাতে বাড়ি ফেরার বাজে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
নীলু আসেনি যে?
ওরা নাকি মাথা ধরেছে।
ও নাকি পরীক্ষা খুব খারাপ করেছে?
জি।
সংসারে বিশৃঙ্খলা আসার জন্যে এটা হয়েছে। বুঝতে পারছিস তো?
চাচা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রমজান ভাই এসে বলল, ইউনিভার্সিটির একজন মাস্টার নাকি নিচে বসে আছে।
চাচা অবাক হয়ে বললেন, কিসের মাস্টাের? মাস্টার এখানে কী জন্যে? বিলু তুই উপরে আমার কাছে পাঠিয়ে দে তো।
বসার ঘরে গম্ভীর চেহারার একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু অন্য রকমের একটি ভারিক্কি ভাব আছে। ভদ্রলোক আমাকে দেখেই বললেন, একটু দেরি করে ফেললাম, না?
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমি আগেই আসতাম। ভাবলাম জন্যদিনে খালি হাতে আসা ঠিক না। কিন্তু তোমাদের এখানে তো কিছু পাওয়া যায় না। আমি ঘণ্টাখানিক ঘোরাঘুরি করেছি। কবিতার বই পাওয়া যায়। কবিতা তো তুমি পড় না, নাকি পড়?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি বোধহয় নীলুর কাছে এসেছেন। আমি ওর ছোট বোন বিলু। আমরা যমজ বোন। ভদ্রলোক দীর্ঘ সময় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।
নীলু আমাকে বলেনি। তার যমজ বোন আছে। লোকজন কী সব চলে গেছে নাকি?
কিসের লোকজন?
আজি নীলুর জন্মদিন না?
না তো।
ও আমাকে বলেছিল আসতে। সম্ভবত ঠাট্টা। আমি বুঝতে পারিনি। আমি ঠাট্টা বুঝতে পারি না।
ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা খুলে কাঁচ মুছতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনি বসুন, আমি নীলুকে ডেকে নিয়ে আসি।
তোমাদের চেহারায় অদ্ভুত মিল। যমজ বোনদের মধ্যেও কিছু ডিফারেন্স থাকে। একজন মোটা হয়। অন্যজন রোগা কিন্তু…।
ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন।
আপনি বসুন আমি এক্ষুণি ডেকে আনছি।
নীলুকে ভদ্রলোকের কথা বলতে সে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
এইসব কী রে নীলু? ভদ্রলোক কে?
মুন্নিকে তো চিনিস? মুন্নির দূর-সম্পর্কের ভাই।
তাকে আসতে বলেছিলি?
হুঁ।
কেন?
এমনি বলেছি।
আয় তাহলে। কী যে কাণ্ড।
আমি যেতে পারব না। আমার মাথা ধরেছে।
নীলুর মাথা ধরেছে এবং গায়ে বেশ জ্বর শুনে ভদ্রলোক অল্প হাসলেন।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তাহলে যাই। ওর জন্যে দুটো বই এনেছিলাম— দিয়ে দিও।
আপনি বসুন, চা খেয়ে যান।
তোমার বাবা আছেন?
জি না। উনি রাত করে ফেরেন।
তোমার বাবা যখন থাকবেন তখন একদিন আসব।
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, আমি আসব। এটা বোধহয় নীলু ভাবেনি। এসে পড়েছি দেখে হকচাকিয়ে গেছে।
আপনি বসুন না, চা খেয়ে যান। উপরে নজমুল হুদা চাচা আছেন, তাঁর কাছেও বসতে পারেন।
না না, ঠিক আছে।
আমি ভদ্রলোককে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, বেশ একটা অস্বস্তিকর অবস্থা হয়ে গেল। তাই না? আমার প্রবলেম হচ্ছে আমি ঠাট্টা-তামাশা ঠিক ধরতে পারি না। মনে হয় আমার বুদ্ধিশুদ্ধি নিচু স্তরের।
বলেই ভদ্রলোক উঁচু গলায় হেসে উঠলেন। একজন ভারিক্কি ধরনের গম্ভীর চেহারার ভদ্রলোক এমন ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠবেন আমি কল্পনাও করিনি।