তপনের অভ্যর্থনার জন্য শিখা পরিপাটি আয়োজন করিয়া রাখিয়াছে। কয়েক মিনিটের দেখা তপনের কথা শিখা আজ সারাদিন ভাবিয়াছে। আশ্চর্য ঐ মানুষটি। মুহূর্তে যে এমন করিয়া আপন করিয়া লইতে পারে, তপতী তাহার সম্বন্ধে কেন ওরূপ কথা বলিল! শিখা সমস্ত দিন ভাবিতেছে ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু রহস্য আছে। তপতীর বিবাহের গোলযোগের কথা ভাগলপুরে থাকিতেই সে শুনিয়াছিল তার মার চিঠিতে। আজ তপতীর সেই বরকে দেখিয়া সে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছে। শিখারা দুই বোন, দাদা বা ছোট ভাই নাই,তপন যদি শিখার দাদা হয়,—শি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল,–হ্যাঁ, হইয়াছেনই তো।
তপতীরসহিত ফিরিবার সময় দেখাৰাকরিয়া আসাটা ভালো হয় নাই।কিন্তু উনি যেবারণ করিলেন।ওঁরকথায় অবাধ্য তো হওয়া যায়না।তপতীরাগকরেকরুক—তাহার ভাবকরিতে বেশী দেরী হইবে না। ব্যাপারটা তো শোনা যাক দাদার মুখ হইতে।
তপন আসিয়া পৌঁছিল। পরনে অফিসের পোশাক, হ্যাট-কোট-প্যান্ট। শিখা আগাইয়া যাইতে হাসিমুখে বলিল, চিনতে পাচ্ছিস ভাই, দিদি?
-চিনিবার তো কথা নয় যা ভোল বদলেছোবদলেছেন।
–থাক, আর ছেন জুড়তে হবে না। দুজনেই হাসিয়া উঠিল। শিখা আবেগজড়িত কণ্ঠে বলিল,–কখন যে মনের মধ্যে দাদার আসনখানি জুড়ে বসেছো, টেরই পাইনি। নিজের অজ্ঞাতসারেই তুমি বলে ফেললাম।
তোর কাছে এমনটাই আশা করছিলাম ভাই। চল, বাবা মাকে প্রণাম করি গিয়ে।
উচছুসিত আনন্দে শিখা তপনকে ভিতরে আনিয়া তাহার মা-বাবার সহিত পরিচয় কাইয়া দিল। তপন হেঁট হইয়া তাহাদের প্রণাম করিয়া উঠিয়াই বলিল,–আমি নিজে নিমন্ত্রণ নিয়েছি কাকীমা, আপনার দুষ্টু মেয়ে নিমন্ত্রণ করেনি।
হ্যাঁ, করেনি–নিমন্ত্রণ করবার সুযোগ দিয়েছিলে? যাওয়া মাত্র তাড়িয়ে ছাড়ল মা। এত্তো দুষ্টু!
জাস্টিশ মুখার্জি অত্যন্ত নিরীহ এবং গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাহার গাম্ভীর্য টুটাইয়া তিনি কহিলেন,—শঙ্কর বলছিল যে জামাই তাঁর খুব ভালো হয়েছে, তা এতো ভালো হয়েছে
কে জানতো! খুব ভালো ছেলে!
-তোমার খুব ভালো লেগেছে,–নয় বাবা? এত কথা বলে ফেল্লে যে!শিখা কৌতুক হাস্যে চাহিল তার বাবার পানে।
শিখার মা দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলেন, বলিলেন,–তোমার আর একটা জোড় নেই বাবা? দুটোকেই বাঁধতুম!
শিখা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল,—ওকি গরু নাকি মা, বাঁধতে চাইছো?
–তোর বন্ধু সেদিন স্যার রমেনের বাড়ীর পার্টিতে বলছিল, তার বর নাকি হয়েছে একটা গরু। তাই তোর জন্যেও একটা এমনি গরু আমরা খুঁজছি।
-না মা, গরুটরু বলো না, আমার দাদা যে ও। শিখা মৃদু হাসিয়া বলিল।
–নিশ্চয় আপনি বলবেন কাকীমা। আমার মা আমার শেষ দিন পর্যন্ত গরু আর গাধা বলতেন। তারপর থেকে আর কেউ বলেনি। আপনি বলুন তো, আপনার কণ্ঠে আমার মার কণ্ঠস্বর শুনে নিই আর একবার!–তপনের দুটি চক্ষু ছল ছল করিয়া উঠিল। শিখার মাতা বিহ্বল হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, তুমি যদি গরু হও বাবা, তাহলে মানুষ কে, তাই ভাবছি। কিন্তু বাবা, অফিস থেকে আসছো তো? এসো, হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে গল্প করবেখন।
খাইতে বসিয়া তপন বলিল,–শিখার বিয়ে দিতে চান কাকীমা! আপনার কিছু ঠিক করা নেই তো?
–না বাবা, ঠিক কিছু নেই। মেয়েকে আর বড় করতে ভরসা করিনে বাবা; চারিদিকে দেখছো তো, ধিঙ্গি মেয়েরা সব মোটরে চড়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে। বয়স বাড়ছে বিয়ে হচ্ছে না। সমাজে কত মেয়ে যে আইবুড়ো রয়েছে তার ঠিক নেই।
—আপনাদের সমাজের তো এই রকমই গতি কাকীমা। কিন্তু সমাজের উপর আপনি চটলেন কেন?
–না বাবা, আমাদের সেকানের সমাজই ভালো ছিল। বিয়ে করবে না, ধিঙ্গিপনা কবে বেড়াবে, তারপর বয়েস বাড়লে আর বিয়েই হবে না। এই তো হচ্ছে আকছার।
–আশায় আশায় থাকে কাকীমা, মনে করে, আরো ভালো বর জুটবে, তারপর আরো ভালো, এমনি করেই বয়েস বেড়ে যায়। আর আমাদের সমাজের মতো আপনারা তো কচি মেয়ের জোর করে বিয়ে দেন না; জোর করে বিয়ে দেবার অবশ্য আমিও পক্ষপাতী নই, তবে যোল থেকে কুড়ি একুশের মধ্যেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত।
শিখা এতক্ষণ নতমুখে তপনের চা তৈরী করিতেছিল, বাগ পাইয়া বলিয়া উঠিল,–ওপির বয়স এখনো কুড়িও পেরোনি, অতএব মাভৈঃ দাদা!
–তুই থাম—গুরুজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাগড়া দিস নে!
শিখা অনাবিল আনন্দে তপনের মুখের দিকে চাইল। শিখার দাদার অধিকারটি তপন অতি সহজে গ্রহণ করিয়াছে। এমন করিয়া কেহ কোনদিন তাহাকে ধমক দেয় নাই, এমন মিষ্ট, এমন আন্তরিকতাপূর্ণ। হাসি মুখে সে চা আগাইয়া দিয়া বলিল,–আচ্ছা, গুরুজনদের সঙ্গে কথা শেষ হলে ডেকো আমায়।
শিখা চলিয়া যাইতেছে, মা বলিলেন,—যাচ্ছিস কেন?
শিখা দুই পা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ভাবছো কৈন মা? ও তোমার আধুনিক যুগের চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি, মুখার্জি, ঘোষ, বোস, মিত্তির নয়। শিখা না থাকলেও ওর চলবে, বরং ভালোই চলবে। আমি কিছু বেল ফুল তুলে নিয়ে আসি।
শিখা চলিয়া গেল। তপন মধুর হাসিয়া বলিল,কাকীমা, এই আধাবিলেতি সহরের বুকের ওপর মেয়েকে আপনারা কি করে এমন শুদ্ধাচারিণী রেখেছেন?
-আমি ওকে খুব কড়া নজরে রাখি বাবা। চারিদিকে তো দেখছি। আমি ছিলুম ভটচাজ্যি বামুনের মেয়ে, একেবারে সনাতনপন্থী; এখানকার সব দেখে মনে হয় ভালো আমাদের সমাজে অনেকেই ছিল, মন্দ যে না ছিল তা নয়, কিন্তু মন্দটা বেছে না ফেলে আমরা ভালোমন্দ সবই বিসর্জন দিয়েছি অথচ যাদের অনুকরণ করতে চাইছি, তাদের ভালোগুলো ছেড়ে মন্দগুলোই নিচ্ছি।
তপন হাসিমুখে শুনছিল, তারপর ধীরে ধীরে বলিল,–আমি দেখেই বুঝেছিলাম কাকীমা, আপনার সতী-শশাণিত ওর প্রতি শিরায় বইছে। আচ্ছা কাকীমা আপনি আমার উপর নির্ভর যদি করেন তো ওর যোগ্য এবং আপনার মনের মতো ছেলে আমি ওর জন্যে এনে দেবো। কিন্তু আমি যে আপনার বাড়ী এসেছি বা মাঝে মাঝে আসবো একথা যেন কোনরূপে আমার শ্বশুরবাড়ীতে প্রকাশ না পায়। কারণ শিখার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক হওয়া উচিত বলে ওঁরা মনে করেছেন, শিখা তার থেকে আমার ঢের বেশী আপনার।
-তুমি ওঁদের বলে আসনি বুঝি।
-না,–এবং কোনদিন বলে আসবোনা। কারণ ওদের জামাই সম্পর্কে তো আর আমি আপনার বাড়ীতে আসছি না, আসছি আপন বোনটিকে দেখতে। আমি কায়-মন এক করে কথা বলি কাকীমা, শিখার সঙ্গে আমার সহোদর বোনের আর কিছু তফাৎ নাই। আমি তো আজকালকার দা জাতীয় জীবনই—যাকে তাকে আমি দাদা বলতে অনুমতি দিই না।
-বেশ বাবা, তুমি শিখার দাদা, এ তার গৌরব। তোমার কটি ভাই-বোন?
—আমার কেউ নেই কাকীমা, একটা খুড়তুতো বোন আছে। এই সারা বিশ্ব-সংসারে আজ সকাল পর্যন্ত সেই একমাত্র মেয়ে ছিল যার সঙ্গে আমি যখন তখন কথা বলি, দুষ্টুমি করি। আজ থেকে হলো আমার দুটি বোন শিখা আর সে!
শিখা আসিয়া পড়িল একটা রূপার রেকাবিতে কতকগুলি ফুটন্ত বেল ফুল লইয়া। বলিল,–পা দুটি বাড়াও তো! তোমার পায়ে শ্বেতপুষ্প ছাড়া আর কিছুই দেওয়া যায় না।
মা বলিলেন,–তোমরা গল্প করে বাবা, আমি ঘরের কাজ দেখি। তিনি চলিয়া গেলেন। তপন বলিল,লক্ষ্মী বোনটি একটা কথা তোকে জিজ্ঞাসা করবো, সত্যি উত্তর দিস।
–তোমার কাছে মিথ্যে বলব না দাদা, যদিও মিথ্যে অনেক সময়ই বলি আমি। তপন তাহার বিবাহ হওয়ার পর হইতে এই দুই মাসের ঘটনা শিখাকে বলিয়া গেল। তারপর জিজ্ঞাসা করিল,—ওর মতবল কি শিখা, ও কি কাউকে ভালোবাসে?
–তাতো জানিনে দাদা, সেরকম কিছুতো দেখিনি! দাদা, তোমায় ও ভুল বুঝেছে। আমি কালই ওকে বুঝিয়ে দেবো।
-না! তপনের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত দৃঢ়-না শিখা, তাহলে তোকে আর ভগ্নীস্নেহ দিতে পারবো না। সে আমায় ভালো যদি বাসে, এমনিই বাসবে, কারো প্ররোচনায় নয়। আমি যেমন, যেমনটি সে আমায় দেখেছে, তেমনি ভাবেই আমি তার হৃদয় জয় করতে চাই। যদি না পারি, জানবো সে আমার নয়।
কয়েক মিনিট নীরবে কাটিয়া গেল। তপন পুনরায় আরম্ভ করিল—আমি তো আধুনিক কোনককেট মেয়েকে বিয়ে করতে আসিনি শিখা, আমি ভেবেছিলুম বিয়েকরছিস্বর্গীয় মহাত্মা শ্যামসুন্দর চ্যাটুজ্যের নানীকে।যুক্তকর ললাটে ঠেকাইয়াতপন সেই স্বর্গীয় মহাত্মারউদ্দেশে নতি জানাইল। তারপর বলিল,–আর শুনলাম, আমার বাবা নাকি মিঃ চ্যাটার্জিকে কথা দিয়েছিলেন, তাই পিতৃসত্য পালন আর বিপন্ন মিঃচ্যাটার্জিকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম আর ভেবেছিলাম, আমার অনন্ত জীবনের সাথীকে হয়ত ঐ বাড়ীতেই খুঁজে পাবো।
ব্যথায় বেদনায় তপনের কণ্ঠ মলিন শুনাইতেছে। শিখা অভিভূতের মতো তপনের দিকে চাহিয়া রহিল, চোখ তাহার জলে ঝাপসা হইয়া আসিতেছে। এই অপরূপ সুন্দর হৃদয়বান মানুষটিকে তপতী গ্রহণ করে নাই—আশ্চর্য!
-তুমি আমায় অনুমতি করো দাদা, আমি কালই তোমার সাথীকে এনে দেবব—সে তোমায় চেনেনি!
-না, শিখা তা হয় না। আমার স্বরূপ উদঘাটিত করে তার ভালোবাসা পাওয়া এখন আর আমার আকাঙক্ষার বস্তু নয়। আমি জানি প্রত্যেক মেয়েই চায়, তার স্বামী রূপবান, জ্ঞানবান, ধনবান হোক, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যদি তা কারো না হয়, তবে সে কি এমন করে স্বামীর অন্তর চূর্ণ করে দেবে? হিন্দু নারী সে, পবিত্র বৈদিক-মন্ত্রে তার বিয়ে হয়েছে যে বিয়ের জের জন্ম হতে জন্মান্তরে চলে বলেইনা শাস্ত্রের বিশ্বাস—সেই ধর্মের মেয়ে হয়ে সে স্বামীকে একটা সুযোগ পর্যন্ত দিল না নিজেকে প্রকাশ করবার! আমি বুঝেছি শিখা, এই অহঙ্কারের মূলে দুটো জিনিস থাকতে পারে। এক, সে অন্য কাউকে ভালোবেসে, যাকে পেল না বলে গভীর ক্ষুব্ধ হয়েছে; নয় ত, সে আজো অন্যাসক্তা, পবিত্র আছে, কাউকেই ভালোবাসে না। যদি শেষের কারণ সত্যি হয়, তবে আমি তাকে এমনি থেকেই ফিরে পাব, আর যদি প্রথম কারণটা সত্যি হয়, তাহলে সে আমায় হাজার ভালোবাসলেও আমি তাকে গ্রহণ করবো না। আমার জীবনে অন্যাক্তা নারীর ঠাঁই নেই।
শিখা শিহরিয়া উঠিল। তপতী এ কি করিয়া বসিয়াছে। যে অদ্ভুত চরিত্রবান স্বামী সে লাভ করিয়াছে, তাহাতে তপতীকে অন্যাক্তা ভাবিয়া ত্যাগ করা তপনের পক্ষে কিছুই বিচিত্র নহে।…গভীর স্তব্ধতার মধ্যে শিখা ভাবিতে লাগিল।
-বোনটি, আমার মায়ের পেটের বোনের সঙ্গে তোের আজ কিছু তফাৎ নেই। আমার কথা রাখবি তো?
–নিশ্চয় দাদা, তোমার কথার অবাধ্য হবো যেদিন সেদিন তোমায় দাদা বলবার মোগ্যতা হারাবো যে।
তপতীর পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে। আজ সে আসিয়া বসিবে বন্ধুদের আসরে। উপরে প্রসাধনে সে ব্যস্ত। বন্ধুগণ আসরটা জমাইয়া তুলিতেছেন।
রেবা দেবী বলিলেন,–এবার কিন্তু তপতী বরের সঙ্গে মিশবার বিস্তর সময় পাবে বুঝেছে, এতকাল তো বৃথাই কাটালে সব। এখনো সে দেখেনি, কিন্তু একবার দেখলে আর রক্ষে নাই।
সমস্বরে ব্যানার্জি-চ্যাটার্জি-ঘোষ প্রশ্ন করিলেন কেন?
—কারণ ছেলেটা যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি সুন্দর কথা; তপতী আবার কাব্যপ্রিয়, ওর একটা কথাতেই মুগ্ধ হয়ে যাবে।
–বলো কী! সে তো একটা বোকারাম, মূর্খ।
—মোটই না! আমি মাত্র একদিন গিয়েছিলাম তার কাছে। আমায় দেখে কি বল্পে জানোত।
—কি বল্লে!
-বল্লে, আসুন। আপনি কোন্ দেশীয়া? নমস্কার না করমর্দন করবো! আমি বল্লাম একদম স্বদেশী,নাম শ্রীমতী রেবা দেবী! তা বম্নে কি জাননা? বম্নে রেবা তো উপল-বিষমে বিশীর্ণা। কিন্তু আপনি তো দেখছি শীর্ণা নন!
—উত্তরে তুমি কি বল্লে?–মিঃ ব্যানার্জি প্রশ্ন করিলেন।
–বল্লাম, আমি মোটা হলে তো কিছু যায় আসে না, তপতী খুব স্লিম্।
—ও কথা তুমি বলতে গেলে কেন? তপতীর রূপ ওর না দেখাই তো দরকার।
—শোনই-না কথাটা। তপতী স্লিম শুনে বলে, বড্ড খুসী হলাম শুনে; ওর তন্বী দেহ তরবারী দিয়ে অনেককে জবাই করতে পারবে, কি বলেন? আমি তো অবাক! বম, হাঁ আমাদেরগুলো একদম ভোঁতা।
—তাতে কি বল্পেঃ মিঃ ব্যানার্জি শুধাইলেন।
-বল্লে, শান দিয়ে নিন। এত রুপাউডার লিপষ্টিক রয়েছে কি জন্যে। শুনে আমি চুপ করে গেলুম। ও মুখ ফিরিয়ে হরু-ঠাকুরের পাঁচালী পড়তে লাগলো। পরদিন তপতীর মা বারণ করলেন ওখানে যেতে। নইলে ওর জবাব আমি দিতাম।
–বারণ করলেন কেন?
—তা জানি না, বোধহয়, ও বিরক্ত হয়।
–বিরক্ত নয়, ভয় করে, ওর বিদ্যে প্রকাশ হয়ে পড়বে।
–ওর বিদ্যে প্রকাশ হলে তোমাদের বিশেষ সুবিধে হবে না। কারণ ও সত্যি বিদ্বান—তোমাদের মতো শ্যালো নয়।
ইতিমধ্যে মিঃ অধিকারী আসিয়া পৌঁছিলেন। এই মিঃ অধিকারীকে এখন আর ইহারা সুনজরে দেখিতেছেন না। কারণ তপতী তাহার কাছ হইতে আংটি লইয়াছে। অধিকারীই তাহা হইলে তপতীর মন আকর্ষণ করিয়াছে সর্বাপেক্ষা অধিক।
রেবা তাহাকে দেখিয়া বলিল,–আসুন—মিঃ অধিকারী এবার আমাদের মেঘদূতের আপনিই তো যক্ষ!
মিঃ অধিকারী আত্মপ্রসাদের হাস্য করিলেন। ওদিকে তিন-চারটি যুবক তাহার দিকে জনান্তিকে ক্রুদ্ধ ত্রুর কটাক্ষপাত করিতেছে। বিনয়ের সহিত অধিকারী কহিলেন,–বেশ, আমি সম্মত।
—কিন্তু সম্মতি যার কাছ থেকে পাওয়া চাই, তিনি টয়লেটে ব্যস্ত; ঐ এসে পড়েছে। তপতী তর তর বেগে সিড়ি দিয়া নামিয়া আসিল। সুদীর্ঘ বেণী সর্পাকারে দুলিতেছে,
তাহার অর্ধেকটা আচ্ছন্ন করিয়া ধূপছায়া রঙেব অঞ্চলপ্রান্ত পিঠের উপর দিয়া কোমরের কাছে পড়িয়াছে। সমস্ত তনুলতা ঘিরিয়া একটা স্নিগ্ধ সুরভি। সকলে তাহাকে সহাস্যে
অভিবাদন করিল। একজন প্রশ্ন করিল,—পরীক্ষা নিশ্চয় ভালো দিলেন!
–হ্যাঁ, আজকার প্রোগ্রাম কি! অকাজে বসে থাকা?
-না, নিশ্চয় না। আজই আমরা ঠিক করবে আগামী মেঘদূত উৎসবে কে কি রোলে নামবেন। প্রথমে দুএকটা গান হোক একটু নাচও যদি হয় আপনার।
হাসির বিদ্যুৎ ছড়াইয়া তপতী কহিল–নাচ আজ নয়, বড় ক্লান্ত। পরশু বরং চলুন স্টিমার ভাড়া করে খানিকটা বেড়িয়ে আসি।
সকলে সমস্বয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল,–হুর্রে! এইতো চাই। থি চীয়ার্স ফর মিস চ্যাটার্জি।
তপতী আত্মপ্রসাদ লাভ করিবার অবকাশ পাইবার পূর্বেই মিঃ ব্যানার্জি শুধাইলেন—সেই ভদ্রলোকটির খবর কি, দ্যাট গুড, ওল্ড ম্যান?
মধুর হাসিয়া তপতী বলিল,–থাক, তার কথায় কি দরকার! ওর ওপর জেলাস হবার কোন দরকার নাই, ও আমাদের ছায়াও মাড়াবে না।
—গুড্। না মাড়ালেই আমরা খুশি থাকব।
তপতী এবং আরো অনেকের গান গাওয়ার পর আগামী উৎসবের কর্মসূচী প্রস্তুত হইল এবং আগামী কল্যকারও একটা খসড়া তৈরী হইল। রাত্রি অনেক হইয়াছে সকলে চলিয়া গেলে তপতী উপরে আসিয়া দেখিল, তপন খাইতে বসিয়াছে। মা সম্মুখে বসিয়া খাওয়াইতেছে। তপতীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া মা ডাকিলেন,—আয় খুকী খেয়ে নে। তপন ওদিকে মুখখানা এতই নীচু করিয়া দিয়াছে যে প্রায় দেখা যায় না। মা দেখিয়া বলিলেন,–খাও বাবা এত লজ্জা কেন।
তপতীর দিকে তপন পিছন ফিরিয়াই ছিল, সেই ভাবেই উত্তর দিল,লজ্জা না মা অনভ্যাস। খাওয়া হয়ে গেছে, উঠলাম।
—দুধ খাও নি বাবা এখনো।
—আজ আর দুধ খাব না মা, বড ঘুম পাচ্ছে। তপন মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গেল। মিসেস চ্যাটার্জি তপতীকে বলিলেন, খাওয়ার পর তুই আজ ওর ঘরে গিয়ে শুবি খুকী।
তপতী অত্যন্ত বিরক্ত এবং কুদ্ধ হইযা বলিল,–তুমিও সেকেলে হয়ে যাচ্ছ মা। কোন ঘরে শুতে হবে, না হবে, আমি খুব ভালো জানি। আমি আর কচি খুকীটি নই।
মিসেচ্যাটার্জি অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া বলিলেন—সে কি খুকী, তোর মতলব কি তাহলে।
ব্যাপারটা অত্যন্ত বিশ্রী হইয়া উঠিতেছে বুঝিতে পারিয়া তপতী সাবধান হইয়া গেল। বলিল,–তুমি মিছেমিছি অত ভাব কেন। দিন পালিয়ে গেল নাকি? বলিয়া তপতী হাসিয়া উঠিল।
মা ভীতভাবেই বলিলেন,—কিন্তু আজই বা গেলি?
–না মা না, ভালো একটা দিনক্ষণ ঠিক করো। তোমার ঐ গোঁড়া বামুন জামাইয়ের কাছে কৃষ্ণপক্ষের দিনে নাই বা গেলাম।
মা খানিকটা প্রসন্না হইলেন। তাহারা দিনক্ষণ না-মানিলে কি হইবে তপন তো মানে! হ্যাঁ, সেই ভালো হইবে। একটা ভালো দিন তিনি ঠিক করিবেন।
তপতী আহার সারিয়া আপন কক্ষে গিয়া হাসিতে লুটাইয়া পড়িল। মাকে কত সহজে কঁকি দেওয়া যায়। কিন্তু পাঁজিতে ভালো দিনের অভাব নাই এবং মা কালই বাহির করিবেন। আচ্ছা তখন অন্য মতলব খাটানো যাইবে। তপতী নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া পড়িল।
একখানা প্রকাণ্ড গাড়ি আসিয়া থামিল, নামিল তপন আর শিখা-বিনায়ক অভ্যর্থনা করিতে আসিয়া থামিয়া গেল; কর্মিগণ বিব্রত হইয়া উঠিল। মীরা ব্যতীত নারী অতিথি এখানে কখনো কেহ আসে নাই। বিনায়ক কোনরূপে নিজেকে সামলাইয়া একটা নমস্কার করিল। অন্যান্য সকলেই তাহার অনুসরণ করিল কোন প্রকারে। কিন্তু শিখা সহজ হাসিতে সকলকে চকিত করিয়া দিয়া বলিল–সব কিন্তু খুঁটিয়ে দেখাবেন বিনায়কবাবু, চলুন আগে অফিস দেখি আপনার।
কে এ? তপন যাহাকে বিবাহ করিয়াছে, সে নয় নিশ্চয়ই। তপনটা কি ফন্দিবাজ। কাহাকে লইয়া আসিতেছে কিছুমাত্র জানায় নাই। তপন বলিল–তুই ওর সঙ্গে ঘুরে সব দেখ ভাই শিখা, আমি ততক্ষণ একটা নতুন খেলনার নক্সা করি—কেমন? তপন গদীতে আসিয়া বসিল।
—আচ্ছা,—আসুন বিনায়কবাবু।
নিরুপায় বিনায়ক শিখাকে লইয়া কারখানা দেখাইতে গেল। ছোট ছোট যন্ত্রগুলি হাতেই চলে। একটা মাত্র বিদ্যুৎ পরিচালিত কল রহিয়াছে। যতদূর সম্ভব শিখা বুঝিতে চেষ্টা করিল। বিনায়ক ধীরে ধীরে বলিয়া গেল এই কারখানা প্রতিষ্ঠার করুণ ইতিহাস, তাহার দরিদ্র জীবনের কাহিনী। লাজুক বিনায়ক নত মুখেই কথা কহিতেছে; বড় সুন্দর লাগিল শিখার। কোনরূপ ঔদ্ধত্য নাই, সহজ অনাড়ম্বর লোকটি। বন্ধুবাৎসল্যে চোখ দুইটি ছলছল করিতেছে। বিনায়ক বলিয়া চলিল,—তপনকে যদি না পেতাম শিখা দেবী, তা হলে হয়ত বিনায়কের অস্তিত্বও মুছে যেতো। কিন্তু তপনের কিছুই করতে পারলাম না।
–করতে পারলাম না কেন! চেষ্টা করেছেন?
—কি চেষ্টা করবো? তপন তো হাত পা বেঁধে দিয়েছে?
শিখাও নীরব হইয়া গেল। তপনকে সে এই কয়দিনে ভালো রকমই চিনিয়াছে।
খানিক পরে বিনায়ক জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি চেনেন তাকে, কিসের অত অহঙ্কার তার।
–শুধু চিনি নয় সে আমার বিশেষ বন্ধু। আপনার মতো আমারও হাত-পা দাদা বেঁধে দিয়েছেন।
বিনায়ক শুধু বলিল,–হুঁ।
শিখা বলিল,–কিন্তু আপনি ভাববেন না কিয়বাবু, যতদূর জানি তপতী এখনও নিষ্কলঙ্ক আছে। সে নিশ্চয়ই নিজের ভুল বুঝতে পারবে। বিনায়ক আবার একটা ই দিল। একটি কিশোর কর্মী আসিয়া বলিল,–বড়দাদাবাবু, ছোট-দা ডাকছেন আপনাদের।
–যাচ্ছি। বলিয়া উভয়ে উঠিল। চলিতে চলিতে শিখা বলিল,আপনারা বুঝি এদের বড়দা আর ছোটদা।
হ্যাঁ, এখানে চাকর কেউ নেই। সবাই ভাই ভাই, সবাই অংশীদার।
—সব নিয়মই বুঝি আপনাদের দুজনের মস্তিষ্কপ্রসূত?
—সবই ঐ তপনের সৃষ্টি দেবী। মাথা আমার খোলে না। ও যা বলে, তাই আমি করে যাই।
আশ্চর্য। এই লোকটির মতো বন্ধুর উপর এমন অগাধ স্নেহ আর শ্রদ্ধা একযোগে পোষণ করিতে শিখা আর কাহাকেও দেখে নাই। নিজে তিনি কেমন, তাহা বুঝাইবার চেষ্টা মাত্র করিলেন না। বিনায়কের দিকে একটা সশ্রদ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া শিখা হাসিয়া বলিল,–সবইত ওঁর বলছেন, আপনার নিজের কি কিছুই নাই?
—আছে, আমার নিজের অতুল সম্পদ আছে। ঐ বন্ধু, আমার তপন। শিখা অভিভূত হইয়া গেল। দুজনে অফিস ঘরে আসিয়া পৌঁছিল। অফিস দেখিয়া শিখার চোখ জুড়াইয়া যাইতেছে। দেওয়ালে টাঙানো শিবমূর্তিগুলি যেন জীবন্ত। মেঝের আলপনাগুলি কোন অতীত যুগের সহিত যেন বর্তমানের যোগ স্থাপন করিতেছে। ঘরে ধুপসুরভীত বাতাস মন্থরমদির। চতুর্দিকে শান্তির আবহাওয়া। একটাও চেয়ার বা টেবিল নাই; থাকিলেও যেন এ ঘরে মানাইত না।
শিখা দ্বিধাহীন মনে ঠিক তপনের ছোট বোনটির মতই পলাশপাতাটা টানিয়া লইয়া খাইতে বসিল। খাইতে খাইতে বলিল—তোমাদের এখানে তো ভাই রোজ পিকনিক—আমার কিন্তু যেদিন খুসি ভাগ রইল এতে।
বিনায়ক বলিল,–খুসিটা যেন আপনার রোজই হয়।
শিখা বলিল,—আপনার ভাগে তাহলে কম পড়ে যাবে। দুই ভাইবোনে জুটলে আপনি পাবেন না।
হাসিতে হাসিতে বিনায়ক কহিল—না হয় হেরেই জিতবো।
—অর্থাৎ। শিখা তাকাইল।
তাহার চোখের দিকে চাহিয়া বিনায়ক বলিল,—অর্থাৎ এত বেশী হারবো যে হারের দিক দিয়ে আমিই হব ফাস্ট।
তিনজনেই হাসিয়া উঠিল।
তপতী আসিয়া অনুযোগ করিল,—সকাল থেকে তিনবার ফোন করলাম মা, শিখা কিছুতেই আসছে না—আমাদের পার্টিতে যাবে না বলছে।
-কেন? কি হল তার? যাবে না কেন? মা নিরীহের মতো প্রশ্ন করিলেন।
—কে জানে! তোমার জামাই কিছু বলেছে নাকি? সেই যে সেদিন ওর সঙ্গে দেখা করতে গেল তারপর থেকে আর শিখা আসেনি।
-জামাই কি বলবে খুকী। ওর নামে মিছেমিছি কেন বদনাম দিচ্ছিস?
মা বিরক্ত হইতেছে, কিন্তু তপতী ঝঙ্কার দিয়া কহিল, খুব বলতে পারে। যা অসভ্য। ভদ্র মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অভদ্রতা করা কিছু বিচিত্র নয়।
—ও কথাই বলেনা তো বেশী, ভদ্র কি আর অভদ্রই কি। তোদর পার্টিতে ওকে নিয়ে যাচ্ছিস তো আজ-দেখে নি আমার কথা ঠিক কি না।
—ওকেনাই-বা নিয়ে গেলুম মা, বিস্তর বড় বড় লোক যাবে সেখানে যদি কিছু অসভ্যতা করে বসে, গঙ্গার জলে সে লজ্জা ধোয়া যাবে না।
–সে কি খুকী, ওকে না নিয়ে গেলে ভাববে কি। লোকেইবা বলবে কি? নিরুপায় তপতী রাজি হইল, নতুবা মা হয়ত একটা সীন ক্ৰীয়েট করিয়া বসিবেন! বলিল,–আচ্ছা, তাহলে এই জিনিস কটা কিনে নিয়ে যেতে বলল। তপতী একটা লিস্ট দিল।
বন্ধুবর্গের সহিত তপতী পূর্বেই যাত্রা করিল। তপনকে মা যেমনটি আদেশ করিয়াছিলেন, সে তেমনি ভাবেই গিয়া স্টিমারে উঠিল এবং জিনিসগুলি চাকরের হাতে দোতলায় তপতীর নিকট পাঠাঁইয়া দিয়া নীচেই বসিয়া রহিল। যথাসময়ে স্টিমার ছাড়িয়া গেল।
উপর হইতে সঙ্গীতের মধুর সুরলহরী ভাসিয়া আসিতেছে। তপন অত্যন্ত সঙ্গীত প্রিয়। কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল, আর ভাবিতে লাগিল—ঐ সভায় গিয়া একখানি গান গাহিলেই সে তপতীকে আকর্ষণ করিতে পারে কিন্তু যে নারী অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তা, তাহাকে তপনের আর কোন প্রয়োজন নাই। তপনের জীবনসঙ্গিনীর স্থানে সে বসিতে পাইবে না।
তপতীর পরিচিতের সংখ্যা শতাধিক। প্রায় সকলেই আসিয়াছে। অতবড় স্টিমারখানা জুড়িয়া নানাভাবে নানা কথাবার্তা চলিতেছে। পরিচিত হিসাবে মিঃ ঘোষাল, যাঁহার সহিত তপতীর বিবাহ হইবার কথা ছিল, তিনিও আসিয়াছেন। তাহাকে দেখিবামাত্রই তপতীরলিয়া উঠিল,—আসুন, বাপের লক্ষ্মী ছেলে—আছেন কেমন?—এই বিদ্রূপ সকলেই উপভোগ করিল কিন্তু মিঃ ঘোষালের বুকের ভিতর কোথায় যেন একটা আনন্দের শিহরণ জাগিতেছে। বাপের ডাকে বিবাহ-সভা হইতে উঠিয়া যাওয়া তাহার চরম নির্বুদ্ধিতা, কিন্তু তাহার উদ্দেশ্য তো তাহা ছিল না। তপতীর বাবাই তো যত গোল বাধাইলেন। টাকাটা ফেলিয়া দিলেই চুকিয়া যাইত। মিঃ ঘোষালের জীবনে এই ব্যর্থতার ক্ষতি কোনদিন পূরণ হইবে না তথাপি আজ তিনি আনন্দিত হইলেন এই ভাবিয়া যে, তপতীর অনুযোগের অভ্যন্তরে ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে তাহার প্রতি ভালোবাসার ইঙ্গিত। তপতী সেদিন তাহাকে চাহিয়াছিল, আজো তাহাকে না পাওয়ার দুঃখ অনুভব করে। প্রীতিকণ্ঠে তিনি বলেন,–বরাতে সইলোনা তপতী দেবী, আমার দোষ কি বলুন?নইলে বাবার কথাকে মান্য আমি জীবনে ঐ একবারই করেছি, আর ঐবারই শেষ বার। কিন্তু এখন তো…
-হ্যাঁ, এখনো লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপ করে থাকুন।
যে তাহার মুখের গ্রাস কাড়িযা লইয়াছে তাহাকে দেখিবার ইচ্ছা হওয়া মিঃ ঘোষালের পক্ষে স্বাভাবিক কিন্তু যাহাদের তিনি দেখিতেছেন, সকলেই প্রায় পরিচিত, স্বল্পপরিচিত। প্রশ্ন করিলেন,–তিনি কি আসেননি—আপনার স্বামী?
স্বামী কথাটা উচ্চারিত হইতে শুনিয়াই তপতীর মুখ লজ্জার হইয়া গেল।
–কি জানি, আছে কোথায় ওদিকে। বলিয়াই সে অর্গান লইয়া বসিল। চাকরটাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সকলে জানিল, জামাইবাবুনীচে একাই বসিয়া আছেন। চপলা তরুণীর দল তৎক্ষণাৎ নামিয়া আসিল এবং তপনকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া গেল। অতিথি বর্গ দেখিল, তাহার চোখে, একটা ঘন সবুজ রংএর ঠুলি, কপালে ও গণ্ডে চন্দনপঙ্ক। এদিকে পরনে কোট প্যান্ট এবং মাথায় হ্যাট। এই অদ্ভুত বেশ দেখিয়া সকলেই বিস্মিত, বিরক্ত হইল এবং একটা বিজয়ের উল্লাসও অনেকেই অনুভব করিল। তপতীর অহঙ্কার চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। তপতী কোন দিন স্বামীর দিকে চাহে নাই, আজো চাহিল না। তরুণীর দল তপনকে লইয়া এক জায়গায় বসাইয়া দিল, বলিল,–স্বদেশী আর বিদেশীতে মেলাচ্ছেন বুঝি। কিন্তু টুপিটা খুলুন টিকি আর কাটবো না—অভয় দিচ্ছি।
তপন শান্ত করে বলিল,–ভরসা পাচ্ছিনে টিকির বদলে মাথাই যদি..
হাসিতে হাসিতে একজন বলিল,—মাথা তাহলে আছে আপনার? আমরা ভেবেছিলাম, তপতী সেটা ঘুরিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই।
তপন নিতান্ত গোবেচারার মতো বলিল,–টিকি না থাকায় ওঁর ঘোরাতে অসুবিধা হচ্ছে।
রেবা দেবী আসিয়া বলিল,–আমি কেটেছিলাম টিকি, আমি শ্ৰীমতী রেবা…
—আপনি আমার বড় উপকার করেছেন রেবা দেবী টিকির উপর দিয়েই ফাড়াটা উতরে গেল! মাথাটা বাঁচতেও পারে।
–বাঁচবে না, ওটাকে আজ তপির পায়ে সমর্পণ করাবো।
অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে তপন কহিল,—ওঁর পা থেতলে না যায়।
তপতী ওদিক হইতে ক্রুদ্ধস্বরে ডাকিল,—কি করছিস তোরা? এদিকে আয়না সব!
-তোর বর যে যাচ্ছে না। বলিয়াই তাহারা তপনকেও ধরিয়া আনিয়া একটা টিপয়ের কাছে বসাইয়া দিল। তাহার অদ্ভুত বেশ প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে।মৃদুগুঞ্জন বিদ্রূপ শুরু হইয়া গিয়াছে। তপতীর কানেও দুই চারিটা কথা ভাসিয়া আসিল কিন্তু এখানে সে নিরুপায়। অত্যন্ত বিরক্তির সহিত সে একবার তপনের দিকে আঁখিপাত করিল। চোখের ইলি এবং চন্দনে মুখখানা আচ্ছন্ন। লোকটা কালো কি ফর্সা তাও বোঝা যায় না। মাথায় টুপি থাকার জন্য চুলও দেখা যাইতেছে না। গঙ্গাবক্ষে এই অপরূপ মূর্তি দেখিয়া হাসিই পাওয়া উচিত কিন্তু হাসিতে গিয়াই মনে পড়িয়া গেল, ঐ কিম্ভুত কিমাকার লোকটা তাহার স্বামী! তপতীর কান্না পাইতে লাগিল। আত্মসম্বরণ করিবার জন্য সে রেলিং-এর ধারে আসিয়া দাঁড়াইল।
নীরবে চা-টুকু শেষ করিয়া উঠিয়া তপন বলিল,–নমস্কার, আমি নীচেই বসছি গিয়ে।
তাহার রূপ, আচার, ব্যবহার দেখিয়া সকলেই বুঝিয়াছিল, এখানে বসিবার সে যোগ্য নয়। কেহই বিশেষ কিছু বলিল না। তপতী হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। কিন্তু তপন চলিয়া যাইবামাত্র মিঃ ঘোষাল কহিলেন—ওই লোকটা আপনার বর? আশ্চর্য। আপনার বাবার বুদ্ধির প্রশংসা করতে পারলাম না।
অত্যন্ত উম্মার সহিত তপতী জবাব দিল,–থাক, আমার বাবা আপনার বুদ্ধি ধার করতে যাবেন না নিশ্চয়ই।
তপতীর মনের অবস্থা বুঝিয়া সকলেই এ আলোচনা বন্ধ করিয়া দিল! তপতী কিন্তু আর কোন কথাই কহিল না। অপমানে তাহার সারা অন্তর জ্বলিতেছে। স্টিমার জেঠিতে ফিরিবামাত্র সে চার পাঁচজন অন্তরঙ্গ বন্ধু লইয়া নিজে গাড়ী চালাইয়া বাড়ী চলিয়া গেল।
তপন একধারে দাঁড়াইয়া দেখিল। আপন মনে হাসিল। উহাদের সেনিষ্ঠুর ভাবে ঠকাইয়া দিয়াছে। ধীরে ধীরে আসিয়া সে ট্রামে উঠিল।
তপতী গৃহে ফিরিয়া শয্যায় লুটাইয়া অনেকক্ষণকাদিল। আজ তাহার ঠাকুরদারকথাগুলি মনে পড়িতেছে। তিনি বলিতেন—তোর যা বর হবে দিদি, তার আর জোড়া মিলবে না—তার সেই ভবিষ্যদ্ববাণী নিয়তির এমন নিষ্ঠুর বিদ্রূপ হইয়া দেখা দিবে—কে জানিত! তপতী স্থির করিয়া ফেলিল—অপমান করিয়া ঐ বর্বরকে বাড়ী হইতে তাড়াইয়া দিবে। সারা জীবন তপতী একা থাকিবে, সেও ভালোতপতীর উহার সহিত এক গৃহে বাস অসম্ভব।
দুঃস্বপ্নের মধ্যেই তপতীর রাত্রি কাটিয়া গেল। প্রভাতে তাহার গা-হাত পা ব্যথা করিতেছে, উঠিল না। মা আসিয়া ডাকিলেন,শরীর খারাপ খুকী! উঠছিস না কেন?
মায়ের উপর এক চোট ঝাল ঝাড়িয়া লইতে গিয়া তপতী থামিয়া গেল। বেচারী মা, উহার কি দোষ? জামাইকে স্নেহ মমতা করা শাশুড়ীর কর্তব্য।
তপতী উঠিয়া পড়িল। স্নান সারিয়া চা খাইতে আসিয়া দেখিল, রবিবার বলিয়া তপন বাহিরে যায় নাই, চা খাইতেছে।তপতীর গলার স্বর শুনিয়াই সে মুখ নীচু করিল, যেন তপতী তাহাকে দেখিতে না পায়।
তপতী আসিয়া তপনকে দেখিয়াই জ্বলিয়া উঠিল। রুক্ষ স্বরে বলিল,–বৈরাগী আগে চা খেয়ে যাক, তারপর আমি খাবো।
মা রাগিয়া বলিলেন,—ছিঃ খুকী, কি সব বলছিস?
তপন হাসিয়া কহিল,—ভালোই তো বলেছে মা। বৈরাগী যেন আমি হতে পারি। অনেক তপস্যায় মানুষ বৈরাগী হয় মা। বৈরাগ্য সাধনার ধন।
রোষ ভরে তপতী বলিয়া চলিল,–যথেষ্ট হয়েছে আর দরকার নাই! তপতী চলিয়া গেল।
মা বলিলেন—কিসব তোমাদের ব্যাপার বাবা, ঝগড়া করেছে নাকি?
—কিছু না মা, ঝগড়া আমি করি নে। আমার চন্দন তিলক ওর পছন্দ নয়; তা কি করা যায় বলুন। কারো রুচির খাতিরে চন্দন মাখা আমি ছাড়তে পারবো না।
তপনের মুখের হাসি দেখিয়া মা আশ্বস্ত হইলেন। ছোটখাটো কিছু একটা উহাদের হইয়া থাকিবে। দম্পতীর কলহ, ভাবনারও কিছুই কারণ নাই।
তপন চা খাইয়া উঠিয়া গেলে তপতী আসিল। মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। মা হাসিয়া বলিলেন,–ঝগড়া টগড়া করিস নে খুকী-ছেলেটা বড় ভালো।
—অত ভালো ভালো নয় বুঝলে মা। অত ভালো হতে ওকে বারণ করে দিও।
—তুই বারণ করিস, আমার কি দায়?
তপতী রুখিয়া উঠিল। বলিল—-ঐ ইডিয়টটাকে শাঁখ বাজিয়ে ঘরে তুলতে তো দায় পড়েছিল তখন—যত সব।
কিন্তু তপতী সামলাইয়া লইল। মা বিরক্ত হইয়া বলিলেন, চুপ কর খুকী, স্বামীকে ওসব বলতে নেই।
তপতীর ইচ্ছা হইতেছিল, মাকে আচ্ছা করিয়া কয়েকটা কথা শুনাইয়া দেয়। বলে যে তোমরা যাহাকে আনিয়াছ, সে আমার পদ-সেবার যোগ্য নহে। তাহাকে আমি লইব না। তোমরা তাহাকে লইয়া যাহা খুশি করিতে পার। কিন্তু ব্যাপারটা বিশ্রী হইবে, বাবা শুনিবেন, এখনি একটা কেলেঙ্কারী ঘটিয়া যাইবে, অতএব সে থামিয়া গেল।
মা বলিলেন—দিন ঠিক করেছি, পয়লা বোশেখ তোদের আবার ফুলশয্যা হবে।
—আচ্ছা, পয়লা বোশেখ সে কথা ভাবা যাবে। বলিয়া তপতী চলিয়া আসিল। শিখা কেন আসিল না কাল? তাহাকে যে তপতীর কি ভীষণ দরকার। তপতী আবার ফোন্ করিল।
শিখা ফোনে আসিয়া বলল,—কি বলছিস তপু?
—আমার বিপদে তুই চিরকাল সাহায্য করেছিস; আজ আমার এই ঘোর দুর্দিনে কেন তুই লুকোচ্ছিস বল ত?
শিখা ভরা গলায় বলিল,–লুকোইনি তপু! আমি একজন সন্ন্যাসী দাদা পেয়েছি, তার কাছেই এ কয়দিন কাটলো। এখনি আবার আসবেন তিনি।
–বেশ তো তাকেও নিয়ে আয়।
–যাবেন না। আলাপ-পরিচয় না হলে যাবেন কেন?
—তা হলে কি আমি যাবো তোদর বাড়ী?
–আসতে পারিস, তবে দাদার সঙ্গে দেখা হবে না।
–কারণ?
—দাদা চট করে কারো সঙ্গে আলাপ করেন না। তারপরে তুই আর্যনারী হয়ে স্বামীকে গ্রহণ করিসনি শুনলে চটে যাবেন।
মুহূর্তে তপতীর অন্তর রোষরক্তিম হইয়া গেল, বলিল—থাক ভাই, সেই আর্যপুত্রের সঙ্গে আলাপ করবার আমার দরকার নাই। তাহলে আসবি নে?
–না ভাই, মাফ করিস?
–আচ্ছা, আর ডাকবো না তোকে।
তপতী ফোন ছাড়িয়া দিল। ওদিকে ফোন হাতে করিয়া শিখা বেদনায় মুহ্যমান হইয়া পড়িতেছে।
সকালরেলায় শীতল হাওয়া বহিয়া যাইতেছে। একটা চাপাগাছের তলায় তিনখানা বেতের চেয়ার পাতিয়া শিখা অপেক্ষা করিতেছিল। মাত্র মাসখানেক হইল তপনের সহিত তাহার পরিচয়, কিন্তু ইহারই মধ্যে তাহার কি অভাবনীয় পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। ঐ স্পর্শমণির পরশে শিখার অন্তর যেন সোনা হইয়া গেল। কিন্তু ঐ মণিটি যাহার সে উহাকে পাথর ভাবিয়া দূরে ফেলিয়া দিয়াছে। তার মতো দুর্ভাগিনী আর কেহ আছে কি না, শিখা জানে না। তপতীর জন্যে শিখার অন্তর করুণায় দ্রব হইয়া উঠিল।
তপন ও বিনায়ক আসিয়া পৌঁছিল। শিখা প্রণাম সরিয়া বলিল,–একটা কথা শোন দাদা-একটা প্রার্থনা।
-কি বল্। তোর প্রার্থনা পুরানো তো দাদার গৌরব।
-জানি। অনুচিত কিছু চাইবো না দাদা। তুমি তপতীর সঙ্গে বা তার কাছে এমন দুচারটে কথা বল, যাতে সে তোমাকে চিনবার সুযোগ পায়, অন্তত উৎসুক হয়।
—তাতে লাভ কি শিখা?
–আছে লাভ আমার বিশ্বাস, তপতী আজো তোমার অযোগ্য হয়ে যায়নি। ওর প্রথম জীবন অত্যন্ত সুন্দর ঠাকুমা-ঠাকুরদার হাতে গড়া। ও এই সোসাইটির চার্মে পড়ে নষ্ট হতে বসেছে, কিন্তু এখনো নষ্ট সে হয়নি। তুমি ওকে বাঁচাও দাদা।
–মরণ-বাঁচনের অধিকার আমার হাতে নেই শিখা। তবে যদি সে আজো অন্যপরায়ণা থাকে, যদি সে সতী থাকে, তাহলে তাকে পাব। তার জন্য আয়োজনের কিছু তো প্রকার নেই। তবুও তোর কথা রাবো যতটা সম্ভব।
শিখা নীরবে নত নেত্রে স্বহস্তে প্রস্তুত খাবারগুলি সাজাইতে লাগিল! বিনায়ক ফুটন্ত চাঁপা ফুলের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে। ফুলটা ফুটিয়াছে অনেক উঁচুতে নাগাল পাওয়া যায় না। বিনায়ক একটা লাফ দিল।
শিখার করুণ মুখশ্রী হাসিতে রঞ্জিত হইয়া উঠিল। বলিল, শুধু কারখানার হিসাবই দেখেন না, ফুলের খবরও রাখেন দেখি।
হাসিমুখে বিনায়ক বলিল, রাখি, কিন্তু নিজের জন্য নয়, মীরাটা বড্ড ফুল ভালোবাসে।
—আমার জন্যও একটা পাড়বেন।
বিনায়ক ত্বরিতে জবাব দিল, কেন, আপনার তো দাদা রয়েছে, দিক না পেড়ে।
ঠোঁট ফুলাইয়া শিখা কহিল, দাদা তো আছেই, আপনি বুঝি কেউ নন? কথাটা বলিয়াই শিখার অত্যন্ত লজ্জা বোধ হইতে লাগিল। চাহিয়া দেখিল তপন কিঞ্চিৎ দূরে একটা কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়াইয়া আছে। নিজেকে প্রচ্ছন্ন করিবার জন্য ডাকিল, দাদা খাবে এসো।
বিনায়ক কিন্তু কথাটার জের ছাড়ে নাই, কহিল,আমার সঙ্গে তাহলে একটা সম্পর্ক আপনার হওয়া দরকার। কী সম্পর্ক বাঞ্ছনীয় আপনার?
—আপাতত বন্ধু। শিখা জবাব দিয়া সরবৎ তৈরী করিতে লাগিল।
ঐ আপাতত কথাটির মধ্যে রহিয়াছে যে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত তাহাই ভাবিতে গিয়া শিখার হাস্যমধুর মুখের পানে চাহিয়া বিনায়ক বুঝিল, শিখাকে পাওয়া তাহার পক্ষে খুব কঠিন না-ও হইতে পারে। কিন্তু তাহার ভয় করিতেছে। তপনের দারুণ ভাগ্য-বিপর্যয়ের কথা তাহাকে আতঙ্কিত করিয়াছে। এই সোসাইটিতে দরিদ্র বিনায়ক আবার ঢুকিবে। শিখা তাহার আকাঙক্ষাব ধন, শিখাকে পাইলে ধন্য হইয়া যাইবে বিনায়ক কিন্তু শিখাকে সে রাখিবে কোথায়?
–কি ভাবছিস্ বিনু। বলিয়া তপন ফিরিয়া আসিল।
–ভাবছেন, আমার সঙ্গে উনি কি সম্পর্ক পাবেন। বলিয়া শিখা গ্লাসের সরবৎ আরো বেগে নাড়িতে লাগিল। মুখে তাহার হাসি মাখানো।
তপন শিখার গায়ে একটা কৃষ্ণচূড়ার ঝরা ফুল ছুঁড়িয়া দিয়া কহিল,দুষ্টু আমার বন্ধুকে বিব্রত করে তুলেছিস্?
কি করা যায় দাদা, তোমার বন্ধু যদি নিঃসম্পৰ্কীয় কাউকে ফুল তুলে না দেন, তাহলে, সম্পর্ক একটা পাতানো ভালো নয় কি? মীরাটা কিন্তু বড্ড দেরী করছে।
–থাম—তার স্বামী, শাশুড়ী, শ্বশুর। সকালবেলা বিস্তর কাজ। ঐ তো এসেছে…
প্রকাণ্ড একটা গাড়ী গেটে ঢুকিতেই শিখা ছুটিয়া গিয়া মীরাকে জড়াইয়া ধরিল—আয় দুষ্টু, এত্তো দেরী করলি যে…?
-চুপ চুপ বিনুদা এক্ষুণি মার লাগাবে! ওর কারখানার পাংচুযালিটি বড় কড়া। কিন্তু বিনুদার মুখটা যেন,—কি হয়েছে বিনুদা? মীরা বিনায়কের মাথার চুলে হাতের আঙুলগুলি বাইয়া নড়িতে লাগিল।
—না বোনটি, কিছু হয়নি; আয়, তোর জন্য এই ফুলটা পেড়ে রেখেছি।
মীরা ফুলটা লইয়া খোঁপায় পরিতে পরিতে বলিল,–তোর কই শিখা?
শিখা করুণ কণ্ঠে কহিল,–আমার দাদাও দিল না, তোর বিনুদাও না।
–বা-রে! বিনুদা, ফুল পেড়ে দাও, আমার হুকুম, ওঠো।
বিনায়ক উঠিতে যা শিখা ব্যাকুলভাবে বলিয়া উঠিল,–না, না, আগে খেয়ে নিন–।
মীরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছে, এমনি ভঙ্গি করিয়া বলিল,–বটে। আমার চেয়ে তোর দরদ ওর উপর বেশি? আচ্ছা। তোমাকে ওর হাতে দিয়ে দিলুম বিনুদা, বুঝে কাজ কর এবার থেকে।
মীরা সটান তপনের পায়ের কাছে বসিয়া হাঁটুতে চিবুক রাখিয়া বলিল, কাল কি হলো দাদা, কেঁদেছিলে সারারাত?
–না বোনটি কাঁদবো কেন? তোর দাদা কি এত দুর্বল।
কথাটা বলিয়াই তপন মীরার খোঁপা হইতে চাঁপা ফুলটা তুলিয়া লইয়া হাসিয়া বলিল—আমারে ফুটিতে হোল বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাসে—আমি চম্পা।
ব্যাপারটা বেশ সরস হইয়া উঠিতেছিল, কিন্তু মীরার প্রতি উচ্চারিত তপনের শেষের কথাটি এই ক্ষুদ্র সভাটিকে সচকিত করিয়া দিল। এইখানে এমন একজন আছে, অতলান্ত সাগরের মতো যাহার বেদনা পারহীন, কূলহীন। তাহার কথা শিখা বা বিনয়ক ভুলিয়া না গেলেও খুব তীক্ষ্ম ভাবে মনে রাখে নাই।
তপনের কথায় শিখার নারী হৃদয়ের কোমলতা যেন উদ্বেল হইয়া উঠিল, তিরস্কারের স্বরে সেবলিল,–তুমি হয়তো খুব কঠিন দাদা, কিন্তু তুমি এমন করে কথা বলো যে পাষাণও কেঁদে ওঠে—শিখার দুই চোখ কারুণ্যে কোমল হইয়া উঠিল।
মীরা শিখার কানে আসিয়া স্নেহের মাধুর্যে কহিল,দাদা আমার আকাশের তপনের মতই নিজেকে ক্ষয় করে পৃথিবীকে আলোক দেবে। এই তার সাধনা শিখা।
তোর ভাই বোন দুজনেই সমান মীরা! তোদের হাসিভরা কথা শুনে জনহীন প্রান্তর কেঁদে ওঠে।
মীরা এবং তপন অপ্রস্তুতের মতো চুপ করিয়া গেল। বিনায়ক অবস্থাটাকে একটু হালকা করিবার জন্য বলিল,–কান্না মানুষের প্রথম অভিব্যক্তি।
রুখিয়া শিখা জবাব দিল,—তাই অমনি বন্ধু জুটিয়েছেন, প্রতি কথায় কাঁদবো।
বিনায়ক বলিল,–রোদনের মধ্যে দিয়েই আমরা শ্রেয়ঃ লাভ করি, শিখা দেবী।
–রাখুন আপনার ফিলজফি। শ্রেয়ঃ সম্বন্ধে আমার ধারণা আপনার সমান নাও হতে পারে।
না হতে পারে, কিন্তু হতেও তো পারে। তপন টপ্পনি দিল।
–রাগিও না দাদা, ভালো লাগছে না। তোমার বন্ধুর শ্রেয়ঃ যদি দিনরাত কান্না দিয়ে পাওয়া যায়, তাহলে আমার তা চাইনে।
—আমরা কে কি চাই তা আমরা নিজেরাই জানিনে শিখা দেবী। বিনায়ক বলিল।
–রাখুন, রাখুন, এটা কলেজের ক্লাশরুম নয়। আমি কি চাই, তা আমি খুব ভালো করেই জানি।
মীরা খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল,–জানিস তো চেয়ে নে-না ভাই।
রোষরক্ত নয়নে শিখা ডাকিল—মীরা ভালো হচ্ছে না।
হাসি বিকশিত মুখে মীরা বলিল,–খুব ভালোহচ্ছে শিখা।
দোতলার বারান্দা হইতে শিখার মা ডাকিয়া বলিলেন—রোদটা কড়া হয়ে উঠলো তপন, ঘরে চলে এসো বাবা তোমরা।
তপন ও মীরা তৎক্ষণাৎ উঠিয়া চলিয়া গেল। এ যাওয়ার উদ্দেশ্য এতই স্পষ্ট যে শিখা লজ্জানতমুখে খাবারের বাসনগুলি গুছাইতে লাগিল। বিনায়ক একটা ফুল পাড়িয়া শিখার হাতে দিয়া বলিল,–বেশ তাহলে বন্ধই হলেন—কেমন, রাজি।
–রাজি। শিখা নতমুখে বলিল কথাটা।
ইচ্ছা থাকিলেও বেশীক্ষণ বিনায়কের কাছে একলা থাকিতে শিখার লজ্জা করিতেছিল। উভয়ে চলিয়া আসিল ছায়াঢাকা বারান্দায়।