টেবিল-বাতি জ্বালিয়ে একটা বই নিয়ে বসে। পড়া হয় না। বাতিটা। আবার বন্ধ করে দেয়। কালো অক্ষরগুলো মুছে গিয়ে একটা শব্দ জেগে থাকে। বিয়ে। রুবা ভাবি বিয়ে করেছে এবং প্রতিবছর বিয়ের মাসুল ওঠাচ্ছে। নাসিমা আপা বিয়ে করেনি। বিয়ে না করেও বিবাহিত জীবনযাপন করছে। তাহলে বিয়ের অর্থ? কেমন করে এ শব্দ জীবনের সব সত্যকে উদ্ঘাটন করে? সালমা টেবিলের ওপর পা উঠিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। ঘুরেফিরে রুবা ভাবির কথা মনে হয়। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ওরা। হাসিখুশিতে ভরা মেয়ে রুবা ভাবি। শিহাব ভাইও ভালো। বিয়ের পাঁচ বছরে চারটে সন্তানের বাবা হয়েছে। চিন্তা নেই। সালমা হাসতে হাসতে বলেছিল, এবার ক্ষান্ত দাও রুবা ভাবি।
পাগল। পেটে বাচ্চা না থাকলে আমার ভালো লাগে না রে। যেদিন বুঝব আর পারি না সেদিন থামব।
সালমা অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়েছিল। গা-টা কেমন ঘিনঘিন করছিল। মন হয়েছিল, রুবা ভাবির সারা গায়ে পোকা কিলবিল করছিল। তখুনি সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া একটি মুখ। সেই সাঁওতাল-মা। কালো কুচকুচে পেটানো শরীর। বাচ্চা বাঁচত না তার। মনে মনে বলেছিল, তুমিও যদি অমনি হতে রুবা ভাবি তাহলে কেমন হতো? পরে রুবা ভাবিকে বলেছিল, তুমি আমায় অবাক করলে রুবা ভাবি। বিয়ের দায় কি এমনি করে ওঠাতে হয়?
কেন? কেন?
তোমার যদি এতই শখ তাহলে তুমি কুমারী অবস্থায় মা হতে পারনি কেন?
তুই একদম নষ্ট হয়ে যাচ্ছিস সালমা।
ঠিক আছে, না হয় তাই হলাম। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
জানি না।
তখন তোমার পেট খালি লাগেনি?
আঃ, সালমা!
জানি তো উত্তর দিতে পারবে না।
এসব কথা বলতে নেই সালমা।
না, আর বলব না।
সালমার এ ধরনের বেয়াড়া প্রশ্ন সহ্য করেও রুবা ভাবি ওকে আদর করে। সালমা গেলে কী করবে বুঝতে পারে না। কত কী যে খাওয়ায় তার ঠিক নেই। অথচ রুবা ভাবির বাচ্চাদের সালমা একদম সহ্য করতে পারে না। একটাকে থামালে আরেকটা শুরু করে। মারামারি, হৈচৈ, কান্নাকাটি সে এক বিশ্রী ব্যাপার। সালমা চোখ বুজে সেই কান্না যেন শুনতে পেল। হাসল আপন মনে। তবু রুবা ভাবি বেশ আছে। কোনো চাঞ্চল্য নেই। কিন্তু রুবা ভাবি যা পারে, সালমা তা পারে না। ওইসব চিন্তা করলে শরীর শিরশির করে।
আপামণি। হরলিকস।
আনুর মা এক গ্লাস হরলিকস টেবিলে রাখে।
বাবা কী করছে আনুর মা?
পড়ছেন।
মা?
রান্নাঘরে।
রাতের রান্না কী?
মাংসের ভুনা, ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজি, বেগুন ভাজা।
মন্দ না। তুমি বসো ওইখানে।
সালমার আদেশে আনুর মা মেঝের ওপর বসে পড়ে। আনুর মাকে জানার খুব ইচ্ছে ওর, কিন্তু ও তেমন করে কোনো উত্তর দিতে পারে না। আসলে হয়তো গভীর কিছু ভাবে না।
আচ্ছা আনুর মা, আমাদের সঙ্গে থাকতে তোমার কেমন লাগে?
কেমন-টেমন বুঝি না। পেটের দায়ে থাকি।
তোমার স্বামী নেই, মেয়েটাও কাছে নেই, তোমার খারাপ লাগে না?
সারাদিন কাজে থাকি। রাতে শুলেই ঘুম আসে। আর কিছু জানি। ওই আম্মা ডাকে। আনুর মা একরকম দৌড়ে চলে যায়। সালমার রাগ হয়। কোনো কাজের না। নিজেকে নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। বেশি কিছু বোঝেও না। সালমা হরলিকস খায়। টেবিল-বাতিটা আবার জ্বালে। পড়তে বসে। আস্তে আস্তে মনোযোগ বাড়ে। কালো কালো অক্ষরগুলো মনে হয় খুব পরিচিত। ওরাই তো দিনরাত সালমার অন্তরের কাছে বসে কথা বলে।
রাতের খাবার টেবিলে বাবা খুব গম্ভীর হয়ে যায়। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলে না। কথা বেশি বলে সাকিব আর। সালমা আড়চোখে বাবার মুখের দিকে তাকায়। ওর ওপর অসন্তুষ্ট হলো কি না বুঝতে পারে না। অল্প একটু খেয়ে উঠে পড়ে।
কী, হয়ে গেল তোমার?
বাবার গম্ভীর কণ্ঠ। সালমা থতমত খেয়ে যায়।
এই মাংসটুকু খাও।
খেতে ইচ্ছে করে না।
খেতে হবে।
সালমা আর কোনো প্রতিবাদ না করে বসে পড়ে। মাংস খেয়ে উঠে যায়। বাবা আর কিছু বলে না। খাওয়া-দাওয়ার পর সাকিব বারান্দায় গিটার নিয়ে বসে। সালমা দরজা-জানালার পর্দা খুলে দিয়ে শুয়ে থাকে। ক্রস ভেন্টিলেশনের দরুন ফুরফুরে বাতাস আসছে। এক ঝাপটা করে ফুলের গন্ধও আসে কখনো। বাইরে আমগাছের মাথায় অন্ধকারের মৃন্ময়ী ইচ্ছেগুলো আড়ি আড়ি খেলে। পাতায় পাতায় অশরীরী স্পর্শ। চোখ বুজে থাকতে কী ভীষণ আরাম লাগছে! গিটারের বাজনা ছন্দ তুলে ভাসছে। কখনো মৃদু। কখনো তীব্র। সালমার মনে হয়, ও আস্তে আস্তে এক বিরাট আঙর ক্ষেতে ঢুকে যাচ্ছে। থােকা থােকা রসাল ফলের মতো মাতাল আবেগ ওর অনুভূতিকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। ও হাঁটছে। কেবলই হাঁটছে। চারদিকে রসাল ফল। সবুজ পাতা। আর কিছু নেই। ওর মনে হয় কিছুর দরকার নেই। এমনি করে ও অনন্তকাল কাটাতে পারে। সালমা তলিয়ে যাচ্ছে।
তলিয়ে যেতে যেতেও ভুস করে ভেসে ওঠে এক এবং একাধিক শব্দ। ফুরফুরে বাতাস-সাকিবের বাজনা-মৃন্ময়ী অন্ধকার ইত্যাদি সালমাকে নাগরদোলার মতো দোলায়। দোলাতে দোলাতে ঘুম পাড়ায়। দুসপ্তাহ একনাগাড়ে ক্লাস করতে করতে আবার হাঁপিয়ে ওঠে সালমা। ক্লান্তিকর। বাবার লেকচার, ড. হায়দারের লেকচার, মমতাজ আপার লেকচার কিছুই ভালো লাগে না। পুরনো গৎ বাঁধা পড়া। মোটেই সুবিধে নয়। যেসব বই ঘেঁটে ওরা পড়ায় সেইসব বই সালমা বাসায় কয়েকবার পড়েছে। ওরা কেউ নতুন কথা বলে না। কোনো নতুন দর্শনের কথা বলে সবাইকে চমক দিতে পারে না। ছাত্রছাত্রীর চিন্তাশক্তি আলোড়িত করে না। কপচানো বুলির নোট লিখে, আবার সেগুলো মুখস্থ করে উগরে দিতে হবে। এই করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি জুটবে। ভাবতে বিশ্রী লাগে ওর। আবার সেই নসিয়া। মনে হয় বাবা সেই ধরনের পণ্ডিত হোক যে একটা তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবে নাড়িয়ে দিক বিশ্বকে।
বাবা কিছু পারে না। কেননা বাবার মধ্যে ক্ষমতার লোভ, বিদ্যাবুদ্ধির অহংকার, সভ্যতার মেকি নিষ্প্রাণ আদবকায়দা, অর্থের চিন্তা, নানাবিধ ক্রিয়া সমানভাবে কাজ করে। বাবা নিজেকে জয় করে শক্তিমান হতে পারেনি। মাঝে মাঝে সালমার ভীষণ ইচ্ছে করে একজন শক্তিমান পুরুষের মুখোমুখি হতে, সে শক্তিমানের পায়ে নিজেকে লুটিয়ে দিতে। অন্যেরা যত কথাই বলুক আসলে বাবা বিদ্বান, কিন্তু জ্ঞানী হতে পারেনি। যে নিজেকে জানে না সে জ্ঞানী হয় কী করে? অন্যকে জেনে বিদ্বান হওয়া যায়, কিন্তু নিজেকে না জানার অক্ষমতায় সব জ্ঞান চাপা পড়ে। সালমা মনে মনে আবার সেই নিজস্ব প্রার্থনা করে, তুমি জাহিদ চৌধুরীই থাক, আমার বাবা হতে এসো না। তোমার মতো বাবা আমার জীবনে না থাকলেও চলে। আমার মতো মেয়েও তোমার হয়তো খুব একটা দরকার নেই। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পার না। তোমার অক্ষমতা আমার লজ্জার কারণ। তোমার মধ্যে সেই শক্তিমান মানুষ খুঁজে পাই না বলে আমার নসিয়ার মতো লাগে। কী যে বিশ্রী ব্যাপার বাবা, সে তুমি বুঝবে না। যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে একটি আশ্চর্য অনুভূতিও দানা বাঁধে। নিজের সঙ্গে নিজের এক অবিরাম যুদ্ধ করতে হয়। এ যুদ্ধের কোনো পরিণতি নেই।
সেদিন বিকেলে বাবা-মা দুজনে বাইরে গেল। মা কী ভীষণ সেজেছে! অত উৎকট সাজের প্রয়োজন ছিল কি? এজন্যে মার ওপর রাগ হয় সালমার। রুচিসম্মতভাবে সাজতে জানে না। যা তাকে মানায় না তাই তার করা চাই। বাবাও কিছু বলে না। বলবেই কী? বাবা ভাবে যে-কোনো উপায়ে নিজেকে প্রদর্শনীর সামগ্রী করে তোলাটাই আর্ট। বাবা এর বেশি কিছু ভাবতে পারে না। মাকে নিজের চিন্তার মধ্যে আনতে পারে না সালমা। মার কড়া কমলা রঙের শাড়িতে চোখ ধাধিয়ে যায়।
আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি লিমা। ফিরতে রাত হবে।
সালমা ঘাড় কাত করে। বসার ঘরে সাকিব মিতালির সঙ্গে গল্প করছে। মিতালি যে এসেছে বাবা-মা কেউ টের পায়নি। সালমা এখন একা একা কী করবে ভেবে পেল না। মনে হলো সুখ-দুঃখের কথা। জলিল মিয়া বাগানে পানি দিচ্ছে। গরুম হওয়া বইছে চারদিকে। সূর্যের তেজ কমেনি। সালমা বাড়ির পেছনদিকে ওর নির্জন পৃথিবীতে এলো। সুখ-দুঃখের বাক্স খুলে বের করে দিলো। ওরা লাফাতে লাফাতে বাগানের ঘাসের আড়ালে অদৃশ্য হলো। পাতা ঝরার পালা শেষ। আমের বোল এসেছে। চমৎকার গন্ধ ভাসছে। আর সব গাছে নতুন পাতা। কচি পেলব। হাত দিয়ে ধরলে মাখনের মতো লাগে। ঝরা পাতার মৌসুম নেই বলে চারদিক ছিমছাম লাগছে। বাগানটাকে মনে হয় অনেক হালকা। কোনো বোঝায় ভারাক্রান্ত নয়। সালমার নিজেরও ফুরফুরে লাগে। আমের বোল ঝরে পড়ে পাতার ওপর। খরগোশ দুটো পায়ের কাছে এসে মুখ ঘষে। আবার দৌড়ে চলে যায় অন্যদিকে। ওরা বেশ খেলায় মেতেছে। অনেক দিন পর আজ ছাড়া পেয়েছে। জলিল মিয়া খরগোশ দুটোর যত্ন করে, কিন্তু সালমা বাগানে না এলে ওদের ছেড়ে দেবার নিয়ম নেই। সালমার ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থির লাগে। ওই খরগোশ দুটোর মতো ছুটোছুটি করতে ইচ্ছে করে। ঘাসের বুকে, পাতার আড়ালে লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। নিজের সঙ্গেই নিজের খেলতে সাধ হয়। সালমা আতা গাছটার ছোট কাণ্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। দোতলা থেকে হিন্দি গানের সুর ভেসে আসছে। মনে পড়ে, নাসিমা ওকে যেতে বলেছিল। নাসিমা কেন ডেকেছে কে জানে। হয়তো কোনো নতুন রেকর্ড কিনেছে, সেটা শোনার জন্য। এখুনি একবার গেলে মন্দ হয় না। বিকেলটা ভালোই কাটানো যাবে।
সালমা ফিরে আসে। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে সাকিব নেই। ওর ঘর থেকে দুজনের কথা শোনা যাচ্ছে। বাবা-মা নেই বলে সাকিব মিতালিকে শোবার ঘরে নিয়ে গেছে। সালমার হাসি পেল। ওদের বিরক্ত
করে সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ উঠে গেল। বাইরের দরজা খোলা। ভেতরের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ বলে ঘরের মধ্যে আঁধার আঁধার ভাব। নাসিমা ডিভানের ওপর কাত হয়ে শুয়ে আছে। পিঠের ওপর কুচকুচে কালো চুলের গোছা ছড়ানো। মুখে কেমন একটা হাসি।
সালমার অন্যরকম লাগে। চেঞ্জারে বেহালা বাজছে।
আয় সালমা, বোস।
সালমা একধারের সোফায় বসে।
এই মিউজিকের রংটা খুব সুন্দর না?
মিউজিকের রং?
হ্যাঁ, তুই দেখতে পাচ্ছিস না? ওই দেখ কেমন বেগুনি রং পরাগ হয়ে ছড়িয়ে গেছে সারাঘরে।
কী যে বলো নাসিমা’পা।
ঠিকই বলি। তুই একটা হাঁদা মেয়ে।
নাসিমা কথা বলে বাহুতে মাথা চেপে রাখে। সালমা অসহায় বোধ করে। উঠবে না বসবে বুঝতে পারছে না। বেহালা শেষ হয়ে গেছে। বাঁশির একটা রেকর্ড বাজছে এখন। নাসিমা মাথা তোলে।
দেখছিস সালমা, কেমন ধূসর রঙে ভরে গেছে সব দিক।
সালমা হা না কিছু বলল না। কথা বলা বৃথা। শোবারঘরে থেকে সাব্বির ভাই এলো টলতে টলতে। সালমাকে দেখে হাসল। হেই করে শব্দ করল। ফ্রিজ খুলে দুই বোতল পানি খেল। তারপর আবার চলে গেল। এতক্ষণে সালমার অস্বস্তি লাগা শুরু হয়েছে। বুঝল দুজনেই নেশাগ্রস্ত। কিন্তু কী খেলে মিউজিকে রং দেখা যায়? ভীষণ উত্তেজনা বোধ করে। এ জিনিস খেতেই হবে। নাসিমা আবার নিজের মধ্যে তলিয়ে গেছে। কুচকুচে কালো চুলের ঝরনা নেমেছে ডিভানের গা বেয়ে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় সাদা পিঠ দেখা যাচ্ছে। ব্লাউজের অর্ধেক বোতাম খোলা। হাত দুটো শিথিল। ঝুলছে। সালমা তাকিয়ে আছে; কিন্তু কোনো কিছুই দেখছে না। মাথার মধ্যে ঘুরছে একটি শব্দ। মিউজিকের রং? এ বোধ ওকে পেতেই হবে। মিউজিকে রং না দেখলে সালমা আর টিকতে পারছে না। হাতের ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেলে মেঝের ওপর। চুপচাপ পা ফেলে বেরিয়ে আসে। সাকিবকে জিজ্ঞেস করা যায়। ও কি জানে কী খেলে মিউজিকে রং দেখা যায়!
সাকিবের ঘরের সামনে এসে থমকে যায় সালমা। দরজা বন্ধ। সাদা ধবধবে পর্দা বাতাসে দুলছে। সাকিবের নিস্পাপ চেহারার মতো ভেতর থেকে হাসির শব্দ আসছে। সালমার রাগ হয়। চনচনিয়ে ওঠে সাদা রাগ। দরজার গায়ে লাথি মারে।
কে?
ভীষণ মোটা গলা সাকিবের! এমন করে তো ও কখনো কথা বলে। আজ কেন বলছে? তবে কি ও মিতালির গা থেকে সুগন্ধি বের করে নেশা করছে? সালমা একদম চুপসে যায়। মন খারাপ হয়ে যায় ওর। সাকিব নেশাগ্রস্ত। এখন কিছুতেই দরজা খুলবে না। সালমা বোেকার মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা এখন মিউজিকে রং দেখতে পাচ্ছে। সালমার বিষণ্ণ মুখটা কালো হয়ে আসে। সাকিব দরজা খোলে না। ওই একটা শব্দ মোটা গলায় উচ্চারণ করে চুপ করে যায়। ওর কোনো গরজ নেই, যেহেতু দরজার গায়েও আর কোনো শব্দ নেই। যে পর্দাটাকে সাকিবের চেহারার মতো নিস্পাপ মনে হয়েছিল তার রং বদলে যায়। বারান্দায় এমাথা-ওমাথা জুড়ে পায়চারি করে।
সালমা একসময় সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায়। জলিল মিয়া এখনো বাগানে কাজ করছে। বিরাম নেই লোকটার। করতোয়া পাড়ের ছেলে। গায়ের মধ্যে নদীর মতো শক্তি। ফুলে ফুলে উঠে বান ডাকিয়ে দেয়। গেট দিয়ে হাফিজ ঢোকে। এ বাসায় প্রায়ই আসে ছেলেটা। সোজাসুজি সামনে এসে দাঁড়ায়। শরীরজুড়ে একটা দীন ভঙ্গি। ওকে দেখলে রাগ হয় সালমার।
স্যার নেই?
না।
কোথায় গেছেন?
ফাংশনে।
কখন ফিরবেন?
রাত হবে।
ও তাহলে যাই।
ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেটি। বিনীত ভঙ্গিটা সালমার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। অসহ্য! ছেলেটা চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সালমা ডাকে।
শুনুন।
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ। বাবার কাছে আপনার কী দরকার?
স্যার বলেছিলেন আমাকে একটা চাকরি দেখে দেবেন। একটা চাকরি আমার খুব দরকার।
বেশ তো ভালো কথা। চোখা ছেলের মতো চোখেমুখে কথা ফোঁটাতে পারেন না? অমন জবুথবু হয়ে থাকেন কেন?
মানে–কী বলছেন?
এমএ পাস করেছেন?
হ্যাঁ, গত বছর। স্যার আমাকে খুব ভালো জানেন। আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম।
ও সেই কাগুজে ডিগ্রি। এজন্যে রোজ রোজ স্যারের পায়ে ধরতে আসেন।
কী বললেন?
বাবা আপনাকে কোনোদিন চাকরি করে দেবে না।
উনি কথা দিয়েছেন।
তাতে কী? ওরকম কথা উনি অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে দেন। দেখেন না, বাবা বক্তৃতায় এ কথা বলে, কাজে আর এক কথা করে।
হাফিজ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না। স্যারের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন?
আপনারা এমনি পাশ কাটিয়ে যান বলে আর কিছু ভাবতে পারেন। আপনাদের মতো ছেলেদের মাথা ভাঙিয়ে বাবা খায়। আপনি না অনেকদিন বাবার বক্তৃতা লিখে দিয়েছেন, প্রবন্ধ লেখাতে সাহায্য করেছেন? বিনিময়ে কী পেয়েছেন? আপনাদের মতো ছেলেদের মাথাগুলো হলো সিঁড়ি। তার ওপর পা রেখে আমার বাবা ওপরে ওঠে। যতদিন আপনাকে প্রয়োজন ছিল ব্যবহার করেছে। এখন নেই। এজন্যে বাবা আপনার দিকে ঘুরেও তাকায় না। বাবার পিছে পিছে ঘুরে এবার নিজে নিজে একটা চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা করুন।
সালমা হাফিজকে উপেক্ষা করে বাগানে চলে যায়। একটুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে গেট খুলে বেরিয়ে যায় হাফিজ। গেটটা খোলাই থাকে। হতাশ মর্বিড টাইপের ছেলেদের মোটেই পছন্দ হয় না সালমার। ওরা বেপরোয়া না হয়ে অনবরত নত হতে থাকে। বাবার কাছে কেবল আসে আর যায়। একদিনও বাবার সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারল না। জোর দিয়ে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। বাবা যা বলে তা শুনে চলে যায়।
কামিনী ফুলগাছটার নিচে জলিল মিয়া বিশ্রাম নিচ্ছে। বাগানের কাজ আজকের মতো শেষ। সালমা রক্তকরবী গাছটার নিচে দাঁড়ায়। পেছনের আমড়া ডালে একটা চমৎকার ঘুঘু বসে আছে। সালমা আগ্রহ নিয়ে দেখে। পাখিটার ঘাড়ের চারপাশে কলার আছে এবং তার ওপরে নিচে দুটো সাদা ডোেরা আছে। গায়ের রং হালকা বাদামি। মাথায় ধূসর রঙের ওপর কিছুটা জলপাই রঙের ছাপ আছে। সালমা মনে মনে ভাবে, ঘুঘুটা ডাকে না কেন? ডাকলে বেশ হতো। মিশন হাসপাতালে উদাসী দুপুরগুলো ফিরে পেত যেন। ফিরে পেত কৈশোরের কতকগুলো টুকরো টুকরো স্মৃতি। আশ্চর্য, শুধু একটি শব্দ দিয়ে বিস্মৃত অতীতকে কেমন অনায়াসে ফিরে পাওয়া যায়। গোটা ছবিটা এক ঝলকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় সেই কৈশোরটা ডেকে উঠেছে ঘুঘু-ঘু-ঘুঘু।
কী দেখছ আপামণি?
পাখি।
পাখি? এটা তো পরী ঘুঘু। খুব সুন্দর না?
তুমি অনেক পাখি চেনো, না জলিল ভাই?
পাড়াগেঁয়ে মানুষ, পাখি চিনব না? ছোটবেলায় বাটুল দিয়ে কত ঘুঘু মেরেছি। বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কেবলই তো পাখি খুঁজতাম।
ইস, আমার যদি তোমার মতো একটি ছোটবেলা থাকত!
জলিল মিয়া হাসে। সে হাসিতে সালমার বুকটা শূন্য হয়ে যায়। কী যেন পাওয়া হয়নি জীবনে অনেক কিছু দেখাও হয়নি। শুধু চোখের দেখা নয়। নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আপন করে দেখা। ওই ঘুঘুর গাজুড়ে যেমন সাদা ফোঁটা, তেমনি ফোঁটার মতো শূন্যতা থৈথৈ করছে অন্তরজুড়ে।
আবার কী ভাবো আপামণি?
তোমার গল্প বলো জলিল ভাই।
আমার আবার কী গল্প!
কেন তোমার তো কত কথা আছে। খেয়া বাইতে, মাছ মারতে, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাত্রা শুনতে, বরদার সঙ্গে প্রেম করতে
এসব আবার একটা কথা নাকি?
আচ্ছা জলিল ভাই, ছোটবেলায় তুমি খুব ডানপিটে ছিলে না?
খুব। কারো কথা শুনতাম না। যা খুশি তাই করতাম। এই খামখেয়ালি মনটার জন্য আমি জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে গেছি আপামণি।
জলিল মিয়া বিড়ি ধরায়। সালমার মনে হয় জলিল মিয়ার চুল যেন আরো পেকেছে। সাদার ভাগই বেশি। খামখেয়ালি মন নিয়ে কেবল কি জ্বলে-পুড়েই মরে মানুষ? জলিল মিয়া কি বৃদ্ধ বয়সে অনুতাপ করছে? সালমা বুঝতে পারে না কিছু।
জলিল ভাই বরদা এখন কী করে?
কী আর করবে। ভাইয়ের সংসারে আছে। কচুর শাক, কলমিলতা বিক্রি করে দিন চালায়। জানো আপামণি, বরদা আমাকে খুব ভালোবাসত। কতদিন আমার বুকে মাথা রেখে কেবলই কেঁদেছে। শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই হেরে গেল ও। কিছুতেই পারল না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বলেছিলাম গাঁয়ে থাকব না, অন্য কোথাও চলে যাব। তাও রাজি হলো না।
আমড়া ডালে ঘুঘুটা তখনো বসে আছে। জলিল মিয়া সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বিড়িটা শেষ হয়ে এসেছে। কোনো একটা মেয়ে জলিল মিয়াকে ভালোবেসে পরে বিয়ে করেনি। এজন্যে তার মনে অনেক দুঃখ থাকতে পারে, সালমার তাতে কিছু এসে যায় না। জলিল মিয়ার ছেলেবেলাটাই বেশি ভালো লাগে। বর্ষার করতোয়ায় জাল ফেরে মাছ ধরার দৃশ্য কল্পনা করতে করতে শিউরে ওঠে ও। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মধ্যে কাদাপানি ভেঙে মামার বাড়ি চলে যাওয়াটা আশ্চর্য লাগে। এমন দিন সালমার জীবনে একটাও আসেন্Pি পাখি খুঁজতে খুঁজতে গভীর বনে। হারিয়ে যায়নি ও। সাতসকালে গোসাইবাড়ির বিছানো বকুল ফুল পাগলের মতো দুহাতে তুলে কেঁচড় ভরেনি। মনে হয় অনেক কিছু বাকি রয়ে গেল। এই না করতে পারার বেদনা শূন্যতা হয়ে কষ্ট দেয়।
ওই লোকটা একটা বিরাট ফাঁকিতে পড়েছিল বলে এখন অনুতাপ করে। কিন্তু কেন? ওর মতো বৈচিত্র্যময় জীবনই বা কয়জনের হয়? সালমা ভাবল, আসলে কোনোকিছু নিয়েই অনুতাপ করা ঠিক নয়। প্রত্যেক ঘটনাকে যদি নিজের কাজের অঙ্গীভূত করে না নেওয়া যায় তাহলে দুঃখ বাড়ে। বুক ভেঙে আসতে চায়। যে যা করে তা তার নিজ দায়িত্বে করে। তার জন্য আবার অনুতাপ কিসের? সেটা নিজের দুর্বলতার লক্ষণ। সালমার মোটেই পছন্দ নয়। শ্বেতকরবী গাছের ডালে একজোড়া বুলবুলি লাফাচ্ছে। সাদা ফুলগুলো বুক চিতিয়ে হাঁ করে আছে। সালমা সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, তুমি অনেকদিন গ্রামে যাওনি জলিল ভাই?
যতদিন বরদা বেঁচে থাকবে, ততদিন গ্রামে যাব না।
কোনো মানে হয় এসব সেন্টিমেন্টের!
কী বললে?
বললাম তুমি একটা কাপুরুষ। কী এমন অন্যায় করেছ যে পালিয়ে বেড়াতে হবে?
না, পালানো নয় আপামণি। ওর জন্য যাব না। গতবার যখন গেলাম তখন খুব কেঁদেছে। আমি গ্রামে গেলে দশজনে ওকে দশ কথা বলে। অপবাদ দেয়।
তাতে তোমার কী? আর একটু সাহসী হলে তো ওই অপবাদ ওর জন্য আশীর্বাদ হতো।
ওইসব কথা থাক আপামণি।
আমি একবার তোমার সঙ্গে গ্রামে যাব। দেখব তোমার। ছেলেবেলাটা খুঁজে পাই কি না।
জলিল মিয়া হো হো করে হাসে। সালমা চুপ করে থাকে। আনমনে তাকায়। কখন যেন আমড়ার ডাল থেকে ঘুঘুটা উড়ে চলে গেছে। বিকেল নাচছে কৃষ্ণচূড়র পাতায়। গোলাপি চেরিফুলের গাছটা যৌবনে ফেটে পড়ছে। ডালগুলো নুয়ে গেছে। জলিলের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হয়ে যায় সালমা। ওই হাসি কোনোদিন দেখেনি। আস্তে আস্তে বলে, সত্যি বলছি জলিল ভাই, আমি তোমার সঙ্গে একবার গ্রামে যাব। একটু মিথ্যে নয়।
যেয়ো, আপামণি যেয়ো।
জলিল মিয়া অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। করতোয়া পাড়ের গ্রামে তখন শেষ বিকেলের আলো। বাঁশঝাড়, কদবেল গাছ, বনবরির ঝোপ এড়িয়ে চিকন রাস্তা গিয়ে নেমেছে নদীর পাড়ে। পায়ে পায়ে বাজে ঝরাপাতার শব্দের নূপুর। চারদিকে গাছগাছালি ঘাস-লতাপাতা-ফুল মাথা নাড়িয়ে চলেছে। সালমার কানে নদীর শব্দ স্পষ্ট হয়ে। ওঠে। ভরাট নদী। চিকচিকে বালি। এবড়ো-থেবড়ো পাড়। সুরভি মাখানো বাতাসের আস্বাদ পায় সালমা। ছটফট করে ওঠে মন। উঠে হটতে থাকে। বারান্দায় উঠে আসে। বাবা-মার ঘরে টেলিফোন বাজছে। অনেকক্ষণ বাজার পর সালমা এসে টেলিফোন ধরে।
হ্যালো।
কে বলছেন?
আমি সালমা। আপনি কাকে চান?
আপনাকেই।
আমাকে?
হুঁ।
আপনি কে?
চিনবেন না।
আমাকে কিছু বলবেন?
দেখুন, আমার খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
সালমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এতক্ষণ দম আটকে আসছিল।
আপনি কী করছিলেন?
বাগানে বসেছিলাম।
জানেন টেলিফোন নাম্বার ঘোরাতে ঘোরাতে আমার মনে হয়েছিল যে একটি মেয়ে পাব, যে এক সেকেন্ডে আমার মুহূর্তগুলো ভরে দিতে পারে।
কত জায়গায় চেষ্টা করেছেন?
অনেক। কোথাও শুনতে পাই বাঁজখাই কণ্ঠ, কোথাও চাকরের গলা, কোথাও বাচ্চা ছেলে। বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দেব ভাবছিলাম। এমন সময় আপনাকে পেলাম।
বেশ মজা।
শব্দ করে হাসে সালমা। ওর মনে হয় ওর ভেতরকার সেই বিষণ্ণ ভাবটা অনবরত বেরিয়ে যাচ্ছে। বুকটা ঝরঝরে লাগছে।
তোমার খারাপ লাগছে না রে সালমা?
না। তোমার?
সালমা দুঃসাহসী হয়ে নিজেও তুমি বলে। দেখা যাক না খেলাটা কতটুকু জমে ওঠে।
অদৃশ্য লোকটা যদি বিনা দ্বিধায় ওকে তুমি বলতে পারে, তবে ও পারবে না কেন?
আমার–আমার যে কেমন লাগছে তা আমি তোমাকে বোেঝাতে পারব না সালমা। আমি আবার কমার্সের লোক কি না, যোগ-বিয়োগের হিসাবটা বেশি বুঝি। নিজের নিঃসঙ্গতা রঙিন করে ভরিয়ে তোলার মতো ভাষা আমার জানা নেই।
সবসময় ভাষা দিয়ে কি কাজ হয়?
তা হয় না। তবু টেলিফোন যখন, তখন ভাষাটাই অবলম্বন করতে হয় বৈকি।
তুমি বেশ লোক।
কেন?
বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পার।
অপর প্রান্ত থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসে। চমৎকার ভরাট গলা। ভঙ্গিটা নিভাঁজ। সালমা মনে মনে সেই অদৃশ্য ব্যক্তির চেহারার একটা ছক কাটে। নাক, চোখ, মুখ, ভুরু, চিবুক, চুল, হ্যাঁ ঠিক এরকম হতে পারে। রংটা শ্যামলা। দীঘল চোখে অনেক ভাষা। নিঃসঙ্গতা যাকে যাতনা দেয় তার মধ্যে নির্ঘাত একটা ভাবুক মন আছে। সে মন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এক গ্রহ থেকে আর এক গ্রহে। সে ফেরারি মনের কি ঠিকানা আছে?
সালমা।
ধক করে ওঠে সালমার বুক। কে যেন খুব কাছে থেকে প্রিয় নামে ডাকল। উষ্ণ সান্নিধ্যে ভরা সেই কণ্ঠ। একটু থেমে সালমা উত্তর দেয়।
বলো।
চুপ করে গেলে কেন?
তুমিও তো কিছু বলছ না। ও হ্যাঁ, শোনো, তুমি কিন্তু বেশ আমার নামটা জেনে নিয়েছ। এবার তোমার নামটা বলল।
না-ইবা জানলে। থাক না।
মন্দ বলোনি। না জানার মধ্যে মাধুর্য বেশি।
আবার হাসি। হাসির শব্দ মাতিয়ে তোলে সালমাকে।
তুমি খুব লক্ষ্মী মেয়ে।
মোটেই না।
কেন? কেন?
বাঃ, তুমি দেখছি একরেই সব জানতে চাও।
ও তাই তো, আস্তে আস্তে সব জানা উচিত। তুমি কী করো সালমা?
পড়ি।
কী পড়?
অনার্স থার্ড ইয়ার।
কোন বিষয়ে?
দর্শন। তুমি কী করো?
চাকরি।
কী চাকরি?
ধরো ছোটখাটো একটা কিছু।
তার মানে তুমি বলবে না।
আবার হাসি শোনা যায়।
সালমা আমার নিঃসঙ্গতা কেটে যাচ্ছে। মনে হয় তোমার সঙ্গে থাকলে আমি কোনোদিন নিঃসঙ্গ হব না।
যাঃ বাজে কথা! সব মানুষই ব্যাসিকালি নিঃসঙ্গ। তাকে ভরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। আমার মোহ যখন কাটবে তখন তুমি আবার নিঃসঙ্গ হবে। ক্লান্তিতে পেয়ে বসবে তোমাকে।
তুমি তো অনেক বোঝ দেখছি। তুমি বলে দাও সালমা, আমার এ অনন্ত শূন্যতা কী দিয়ে ভরাব?
জানি না।
তুমি জানো।
জানি না।
সালমা–প্লিজ।
আমি জানি না, জানি না, জানি না।
সালমা?
শূন্য কণ্ঠ ভেসে আসে ওপার থেকে। মনে হয় এই মুহূর্তে সবকিছু হারিয়ে লোকটা নিঃস্ব হয়ে গেল। আর কোনো কথা বলতে পারছে না।
চুপ করে গেলে কেন?
এবার তুমি কিছু বলো।
কী খেলে মিউজিকের রং দেখা যায় তুমি জানো?
জানি।
বলো?
মারিজুয়ানা।
তুমি খেয়েছ কখনো?
নিয়মিত খাই।
লাইনটা কেটে যায়। সালমা আর যোগাযোগ করতে পারে না। যন্ত্রটার ওপর রাগ হয়। কেন যে কেটে গেল লাইনটা! অনেকক্ষণ বসে থাকে। ভাবে হয়তো আবার ফোনটা বাজতে পারে। কথায় কথায় নাম্বারটা রাখা হয়নি। রাখলে ও নিজেই যোগাযোগ করতে পারত। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। মারিজুয়ানা? মারিজুয়ানার কথা আর জানা হলো না। দশ-পনেরো মিনিট বসে থাকার পরও টেলিফোন এলো না। দেয়ালে টাঙানো বাবা-মায়ের বড় আকারের বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে সালমা। মনে হয় ওর চোখের সামনে ওই ছবিটার রং ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। সাদা এবং কালো ছবিটা রঙিন হয়ে গেছে। বাবার মুখটা প্রকাণ্ড তিমির মতো দেখাচ্ছে। মা হয়ে গেছে ছোট্ট একটা সোনালি মাছ। পেছনের দেয়ালটা সাদা সমুদ্র যেন। সালমা অপলক তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। টেলিফোন বাজে। সালমার বুকটা ধক করে ওঠে। সেই অদৃশ্য বন্ধু যদি হয়?
হ্যালো?
জাহিদ চৌধুরী আছেন?
না, বাইরে গেছেন।
কখন ফিরবেন?
রাত দশটার দিকে।
আপনি ওনার কে হন?
কেউ না।
একটা খবর ছিল বলতে পারবেন?
না।
সালমা টেলিফোন রেখে দেয়, বিরক্ত লাগে। এই কণ্ঠ তো শুনতে চায়নি। যাকগে। কিন্তু লোকটাকে ও মিথ্যে কথা বলল কেন? সত্যি কি জাহিদ চৌধুরী ওর কেউ হয় না, সালমা বুকের ওপর হাত রাখে। হৃৎপিণ্ড এক তালে ধুকধুক করছে। জাহিদ চৌধুরী কেউ না হলে এ শব্দ পেল কোথা থেকে? তবু শরীর ঝাকিয়ে ও অস্বীকার করল সত্য। জাহিদ চৌধুরী ওর কেউ না, কেউ না। ওই নামটা একটা পোকার মতো লাগে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও। বারান্দার বাতিটা বন্ধ করে দেয়। আলো ভালো লাগছে না। এখন চাই অন্ধকার-মূন্ময়ী অন্ধকারের সখী খেলা। সাকিবের ঘরে আলো নেই একটু পরে খুট করে দরজা খুলে ওরা বেরিয়ে আসে। বারান্দায় ওকে দেখে দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
অন্ধকারে কী করছিস দিদিভাই?
এমনি হাঁটছি।
মিতালি তোর সঙ্গে গল্প করতে চাইছিল—
হ্যাঁ সালমা আপা, আপনি যেন কোথায় উধাও হলেন। ওর কথার মধ্যে ছেলেমানুষি ভঙ্গি আছে। সাকিবের সঙ্গে বেশ মানায়। সালমা হাসে। ওর কথার উত্তর দেয় না। জানে বড় বোনের মান রাখতে ও কথা বলেছে সাকিব। ওইটুকু তো ভদ্রতা। নইলে আর কী। মুখে অমায়িক হাসি টেনে বলে, তুমি একলা কী করে যাবে মিতালি?
আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে আসব। কাছেই তো।
সাকিব চটপটে উত্তর দেয়।
আসি সালমা আপা।
সালমা হেসে মাথা নাড়ে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে ওদের। বিদায় দেয়। ওরা চলে যেতে যেতে কী যেন কথা বলে আর হাসে। ওদের আচরণে ছেলেমানুষি চপলতা। সালমার বেশ লাগে। পাতলা ছিপছিপে মিতালি প্রায় সাকিবের সমান সমান লম্বা। মাথায় ববকাট চুল। শ্যাম্পু করা। কেমন মসৃণ ওর চুলের গোছা। মিতালি নির্জন দ্বীপের গানের পাখির মতো। ও দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারে। সালমা মনে মনে সাকিবের প্রশংসা করল। চমৎকার পছন্দ ওর। সঙ্গী হিসেবে এমন একজন পছন্দ করেছে, যে সামনে এসে দাঁড়ালে বেদনা কমে যায়। অহেতুক গান আসে মনে। মিতালি অবলীলায় সাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। হয়তো ওদের বিয়ে হবে। হয়তো হবে না। তাতে কী এসে যায়! যৌবনের গন্ধ কখনো ফুরায় না। সে গন্ধের বৃত্ত ছন্দ রচনা করে। অন্যত্র সুখ খোঁজে। পথে টেনে নিয়ে আসে। ভরিয়ে তোলে নতুন পেয়ালা। ভাবতে ভাবতে সালমার নেশা ধরে। বুক চেপে আসে। মনে হয়, ঠিক এ মুহূর্তে, এখন কাউকে চাই। নইলে ব্যর্থ হয়ে যায় লগ্নের খেলা। আঃ, কী কষ্ট! সালমা মনে মনে উচ্চারণ করে। অস্থির লাগে। চিৎকার করে কাউকে ডেকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। রকিবের কথা মনে হয় ওর। কখনো রকিবের দুচোখ জ্বলে ওঠে, কখনো সালমার হাত ধরে অনুনয় করে। সেই আর্তিটা আজ স্পষ্ট কানে বাজে। সালমার মনে হয় কে যেন দরজার গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। খুব মৃদু সে ধ্বনি। যেন কিসের মঙ্গলবার্তা বলে যাচ্ছে, ঘণ্টা হাতে লোকটা এগিয়ে আসছে। সালমা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। নিভে। যায় একশ পাওয়ারের বাল্ব। অন্ধকারে ফিসফিস করে সে বলে, আমি এসেছি।
নিবিড় অন্ধকারে মমতাময়ী হয়ে সালমাকে ঘিরে রাখে। এক টুকরো আলো শুধু একটা মুখের ওপর ঝুলে আছে। হাতে তার ঘণ্টা। একটানা বেজে চলে।
সালমা হাত বাড়ায়। সমুদ্রের ওপর থেকে স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে যায়। অদ্ভুত ঠান্ডা। কোথাও আলো নেই। এখন অন্ধকারই আপন। আর কিছু চাই না। আর কিছু না।
সালমা উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। বাইরে জানালার ধারে ওর নির্জন দ্বীপ। সে দ্বীপ ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। অজস্র অসংখ্য ফুলে ছেয়ে যায়। এত ফুল একসঙ্গে সালমা কোনোদিন দেখেনি। এত বিচিত্র রঙের সমাবেশ আর কখনো চোখে পড়েনি। সালমার মনে হয় ফুল ছাড়া আর কিছু সত্য নয়। ফুল আনন্দ। ফুল বেদনা। হাসি-কান্না সব। আস্তে আস্তে কোমল প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। কোথাও বেদনা নেই। জ্বালা নেই। ছড়ানো ফুলের মতো অনুভূতির সব রং মিলেমিশে এক হয়ে আছে। ভিন্ন রঙে তার কোনো প্রতিভাস নেই।
সালমা বালিশে মুখ গুঁজে দেয়।
সকালে ছিমছাম করে নিজেকে সাজায় সালমা। আজ মনটা বেশ আছে। ভয়ানক হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে। কপালে লাল টিপ দিতে দিতে মনে হয় লাল টিপ রকিবের খুব পছন্দ। আজ ওরা দুজনে অনেক দূরে যাবে। রকিব কিছু বলেনি। শুধু বলেছে যাবার জন্য। সালমার একঘেয়ে লাগছে। কোথাও যেতে পারলে ভালো লাগত। দশটায় রকিব বলাকার সামনে আসবে। ওখান থেকে দুজনে যাবে। সালমা গান গাইতে গাইতে চুল বাঁধে। মা এসে সামনে দাঁড়ায়।
বেরোচ্ছিস নাকি?
হ্যাঁ।
তোর সঙ্গে কথা ছিল।
বলো।
সালমা ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে।
বলছিলাম কী জহিরকে তোর কেমন লাগে?
কেন?
না মানে তোর বাবার খুব পছন্দ কি না।
যা বলবে খোলাখুলি বল–
জহিরকে তোর জন্য পছন্দ করেছে তোর বাবা। এখন তোর মতামত পেলে আমরা কাজে এগোতে পারি। ছেলেটি কিন্তু খুব ভালো। তোর বাবার ভক্ত।
তাহলেই হয়েছে।
কী?
ওই যে ঘুরেফিরে এক কথা। ভালোর সংজ্ঞা মানে অধ্যাপক জাহিদ চৌধুরী।
কী বলছিস লিমা?
ঠিকই বলেছি। তোমরা অন্ধ, তাই ভালো-মন্দ বুঝতে পার না। বাবার মতো ছেলে আমার কোনোদিনই পছন্দ না।
নিজের বাবা সম্পর্কে–
তুমি আমাকে বেশি কিছু বলার সুযোগ দিয়ো না মা।
তোর মতটা বল?
মত নেই।
ও।
মা কেমন অপমানিত বোধ করে। মুখটা লাল হয়ে যায়। তবু কিছু বলতে পারে না। সালমাকে বড় ভয়। মাঝে মাঝে মা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অবাক লাগে। সালমাকে চেনে বলে মনে পড়ে না। কোনোদিন ওকে দেখেছে বলেও মনে হয় না। সালমা মার মুখের দিকে তাকায়। মা উঠে যেতেই সালমা বলে, শোনো মা, আর কোনোদিন আমাকে এসব কথা বলতে এসো না।
মা আর কোনো কথা না বলে চলে যায়। সেই বেদনাক্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়েও সালমার মায়া হয় না। সম্পর্কের অধিকারের সুতোটা বড় জঘন্য। ওটা গলায় পরাতে চাইলেই ও নির্মম হয়ে ওঠে। মা বেরিয়ে যাবার পরও সালমা গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। জাহিদ চৌধুরী নামটা ভাবলেই সালমার মনে হয় একটি ফাঁকির পাহাড়। লোভের রক্তপিণ্ড। খ্যাতির পঙ্কে ড়ুবে যাওয়ার বাসনা-পোকা। এছাড়া জাহিদ চৌধুরী আর কী? মৌলিক কিছু করার ক্ষমতা তো নেই তার। কেবল চর্বিত চর্বণের বাহাদুরি দেখিয়ে দুহাতে হাততালি লুটছে। আসলে নিজের সম্পর্কে যার কোনো বিবেচনা নেই, অহেতুক বাহাদুরি নিতে যার ঘৃণা নেই, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক স্বীকার করতে সালমার ঘৃণা। সালমার মাথাটা ঝাঁকিয়ে ওঠে। বেড়াতে যাবার আনন্দটা বুঝি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার সেই ধূসর বিষণ্ণতা পেয়ে বসে সালমাকে। খরগোশের লোমশ শরীরের মতো ধূসর বিষণ্ণতা বাড়তে থাকে। যন্ত্রচালিতের মতো ও উঠে চুল বাঁধে। শাড়ি পরে। স্যান্ডেলে পা ঢোকায়। এবং একসময় ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। চারদিকের লোকজন গাড়ি, রিকশা–সবকিছুর মধ্যে ধূসর বিষণতা অনবরত জমতে থাকে। সালমার আর কিছু ভালো লাগে না।
রকিব ওকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, কিরে এত দেরি কেন?
সালমা বলে, তোর মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে রকিব।
রকিব অবাক হয়, কেমন?
ঠিক তিমি মাছের পিঠের মতো।
সালমা শব্দ করে হাসে। রকিব ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সালমাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। ও মাঝে মাঝে এমনি খেয়ালি হয়। তখন ওকে অসুস্থ দেখায়। অসুখী মনে হয়। উদাসীন সালমার কোনোকিছুতে ভ্রুক্ষেপ থাকে না। আজো ঠিক তেমনি দেখাচ্ছে ওকে।
কোথায় যাব আমরা?
শহর থেকে অনেক দূরে।
চল।
স্কুটার ঠিক করা ছিল। দুজনে উঠে বসে। বাতাসে চুল ওড়ে সালমার। শাড়ির আঁচল রকিবের মুখে এসে লাগে। পেরিয়ে যায় শহরের কোলাহল। গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় কমে আসে। চারদিকে সবুজ। যতদূর চোখ যায় বিচ্ছিন্ন সবুজ অংশ নির্জন দ্বীপের মতো প্রতিভাত হয়। বদলে যায় সালমার মন। দখিনা বাতাসের মতো চমৎকার এক ভালো লাগা শরীরের ফোকর গলিয়ে সবখানে ঢুকে পড়ে। মাতিয়ে তোলে ওকে। সেই ধূসর বিষণ্ণতা সবুজ দৃশ্যাবলির সামনে তলিয়ে যায়। জেগে ওঠে নীলাভ সমুদ্র।
সালমা রকিবের হাত ধরে, আমার খুব ভালো লাগছে রকিব।
সত্যি?
হুঁ।
রকিব ওর পিঠের ওপর হাত দিয়ে কাছে টানে।
আমরা দুজন আর কখনো এমন করে বেরিয়ে পড়িনি।
না। রকিব আলতো চাপ দেয়।
আমরা অনেক আনন্দ মুহূর্ত নষ্ট করেছি।
হয়তো তাই।
স্কুটার এসে থামে ডাকবাংলার সামনে। বাগানের চারদিকে রক্তজবার সমারোহ। মাধবীলতার ঝড় উঠেছে গেটের দুপাশে। মৌসুমি ফুলে ছেয়ে আছে চারদিক। সালমা কী করবে ভেবে পায় না। দুজন বারান্দায় উঠে আসে। দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। রকিব ওর হাত। ধরে।
ভালো না জায়গাটা!
চমৎকার জায়গা। তুই কেমন করে খোঁজ পেলি?
এক বন্ধুর কাছে। সারাদিন আমরা এখানে থাকব সালমা।
ঠিক। জানিস রকিব, মনে মনে আমি এমন একটি জায়গাই খোঁজ করছিলাম। যেখানে পাথরের গা বেয়ে ঝরনা বয়ে যায়। হরিণ আসে দৌড়ে। শকুন্তলার সেই আশ্রমের মতো। এখানে তো সেসব কিছু নেই। কেবল আম-কাঁঠালের বন।
না থাক। আমি মনে মনে সব খুঁজে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি ধুলা-ওড়া রাস্তার দুপাশে ইউক্যালিপটাসের সারি। লম্বা লম্বা গাছের মাথায় বাবুই পাখির বাসার মতো ঝোপ। সেদিকে তাকালে মনে হয় আমি কী যেন ফিরে পেয়েছি। আমার আর কিছু চাই না।
তুই একটা বোকা মেয়ে সালমা। চল, ওই পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে আসি।
রকিব সালমার হাত ধরে হাঁটে। এমন নির্জন সঙ্গ ওর জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। সালমাকে এত কাছের মনে হয়নি কখনো। এত প্রাণখোলাও না। ওকে আজ অন্যরকম লাগছে। গজিয়ে ওঠা কচুপাতার মতো সতেজ আর পেলব। মোহনীয় বটে। আদতে সালমা একটা দুঃখী মেয়ে। সুখ ও বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে ফেলে। আর অনবরত হারায় বলে কোথাও সালমার স্বস্তি নেই।
জল টলটল পুকুরের চেহারা। লালপদ্ম ভাসছে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নামে ওরা। নামে… নামে… নামে। বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি। নিচে জল। সালমা স্যান্ডেল খুলে পা ড়ুবিয়ে বসে। পানিতে ড়ুবে থাকা সিঁড়ির গায়ে শেওলার আস্তর পড়েছে। পায়ের তলা পিছল লাগে।
সঙ্গে কাপড় থাকলে গোসল করতাম।
কাপড় জোগাড় করা যাবে।
কোথা থেকে?
ওই দেখ না দারোয়ানের বাসা। ওর বউয়ের একটা শাড়ি নিয়ে আসব।
না বাবা, দরকার নেই। ওই তেল চিটচিটে ময়লা শাড়ি আমি পরতে পারব না।
তাহলে আর কি?
রকিব হাত উল্টে মুখভঙ্গি করে। তুই বোস। দারোয়ানকে কিছু খাবার ব্যবস্থা করতে বলি। রকিব লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে চলে যায়। সালমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। রকিব অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে হয় ও বুঝি কোনো এক পাতালে নেমেছে। ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলো শেষ হয় না। নিচের দিকে। নামতে নামতে সিঁড়ি যেখানে শেষ হয় সেখানে জল টলটল করে। একটু দূরে লাল পদ্ম। হাত বাড়িয়ে তুলে আনতে হয়। সালমার নসিয়ার মতো লাগে। চিৎকার করে ওঠে, রকিব আমি নামতে চাই না। উঠতে চাই। উঠতে চাই।
কিন্তু কেউ কোথাও নেই। সালমার ক্ষীণ কণ্ঠ বাতাসে এপাশ-ওপাশ দোলে। দারোয়ানের হাঁসগুলো জলে ভাসে। সালমা কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চায়। পারে না। সিঁড়ির পাশের দেয়ালের সঙ্গে মাথা হেলিয়ে দেয়। সাদা হাঁসগুলো পরি হয়ে এসে সালমার হাত ধরে। সালমা যেন পাতালপুরীর রাজকন্যে। ওরা ওর চারদিকে পাখা ছড়িয়ে নাচছে।
কিরে, তোর মুখটা এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?
রকিবকে সামনে পেয়ে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সালমা।
রকিব, আমি নামতে চাই না।
ভয় কি, আমি তো আছি।
রকিব ওর গালে চুমু দেয়। কেউ টের পায় না। আম-কাঁঠালের ছায়ায় দুজনে ঘুরে বেড়ায়। এত কথা যে ওদের জমা ছিল তা ওরা জানত না। কখনো লুকোচুরি খেলে, কখনো অকারণ দৌড়াদৌড়ি করে, গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চুমু খেয়ে সালমা আবার নিজেকে ফিরে পায়। ফিরে পায় সুখের লোমশ শরীর। ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে পাখিগুলো কিচকিচ করে। দূরের মাঠে হরিয়ালের ঝাঁক এসে বসে। শুকনো পাতা খয়েরি। পাকা পাতা হলুদ। সজীব পাতাগুলো সবুজ। নিজেকে অমন পাতার মতো মনে হয় সালমার। জীবনটা এমনি। সবুজ, হলুদ আর খয়েরি। এর বাইরে আর সব রং বুঝি বেমানান। সবুজ থেকে হলুদ হয়। হলুদ থেকে খয়েরি। হঠাৎ করে দৃষ্টি আটকে যায় একটা পাখির গায়ে।
ওটা কী পাখি দেখ তো রকিব? নীলের ওপর সাদা বড় বড় ফোঁটা। ঠোঁটটা কত বড় দেখ? আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে।
পাখিটার নাম ঠিক মনে পড়ছে না। তবে শুনেছি, ওটা নাকি যেখানে ডাকে সেখানে কেউ না কেউ মারা যায়।
যাহ্! বাজে কথা।
হ্যাঁ, সত্যি। লোকে বলে।
সালমার গাটা শিরশির করে ওঠে ওই পাখিটা যদি এখন ডেকে ওঠে তাহলে কে মরবে, ও, না রকিৰ আশপাশে তো আর কেউ নেই। সমস্ত পরিবেশ সালমার সামনে প্রথমে হলুদ তারপর খয়েরি হয়ে যায়। মৃত্যুর রং খয়েরি। পায়ের তলে পড়া শুকনো পাতার মতো মৃত্যুর পর মচমচিয়ে ভেঙে যায় শরীর। আর কিছু বাকি থাকে না। মিশে যায় মাটিতে। কেমন যেন লাগে সালমার। আবার সেই নসিয়া। মাথা ঘুরে ওঠে।
ওই পাখিটা যদি এখন ডাকে রকিব।
কী হবে, হয়তো আমি মরে যাব।
তুই কেন? আমি মরব।
কাউকে মরতে হবে না। ওই দেখ পাখিটা উড়ে চলে যাচ্ছে।
কোনদিকে যাবে?
কী জানি। চল, দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। দুজনে আবার হাঁটতে থাকে। কাঁঠাল-আমের ছায়া নরম মিনতিতে পায়ের কাছে লুটোপুটি খায়। কোথাও সবুজ ঘাস। কোথাও লাল মাটি। দূরে চষা ক্ষেত। কোনো গাছ নেই। কেবল মাটির ঢেলা ওলটপালট হয়ে আছে। সালমার বুকটা কেমন করে। মাঠপারের অসীম শূন্যতা পেয়ে বসে। ডাকবাংলার কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ে দারোয়ানের বউ নিজের ঘরের দরজার সামনে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে উৎসুক দৃষ্টি। মুখে বয়সের ছাপ জোয়ারের জলের মতো বিছিয়ে যাচ্ছে। ছেলেমেয়ে নেই। হয়নি। ওদের দেখে বউটি আড়ালে চলে যায়। সালমার মনে হয় একবার গিয়ে ওর সঙ্গে আলাপ করে আসা উচিত ছিল। এমন নিঃসঙ্গে কেমন করে ওর দিন কাটে? নাকি ও গ্রামের ছোট্ট মেয়ের মতো এখনো আম-কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় ঘুরে বেড়ায়? প্রজাপতি ফড়িং জোনাকি ধরে? পুকুরের জলে সাঁতার কেটে পদ্ম তোলে? ওর অখণ্ড অবসর ও কেমন করে ভরিয়ে তোলে? সালমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
ওরা ফিরে আসার একটু পরেই দারোয়ান খাবার দিয়ে যায়। আলাদা স্বাদের রান্না। মৌরির মতো লাগে ওর। আলগা সুগন্ধি পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সমস্ত খাবারে। অনেক যত্নে তৈরি। বউটির নির্জন দ্বীপে সালমা এক নতুন অতিথি। ভাবতে গিয়ে পুলক অনুভব করে। রকিব কোথায় হারিয়ে যায়। অন্তর হাতড়ে রকিবকে খুঁজে পায় না সালমা। কেবল অনুভব করে কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা কেউ যেন দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে জোয়ারের জলের রেখা।
তুই খাচ্ছিস না কেন সালমা?
খাচ্ছি তো।
হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, ওকে খাওয়া বলে না।
বেশি দেখলে আমি কী করব।
সালমা উঠে পড়ে। খুব বেশি ও কোনোকালে খেতে পারে না।
জানিস সালমা, মনে হচ্ছে অনেকদিন পর একটা কিছু খাচ্ছি।
সত্যি? আমারও তাই মনে হয়েছে।
সালমা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে। বালিশ টেনে নেয় কোলের ওপর। বাইরে আম-কাঁঠালের মাথার ওপর নির্জন দুপুর আঁকিয়ে বসেছে। জানালা দিয়ে দূরের আকাশে দৃষ্টি ফেললে দু-একটা ভুবন চিল উড়তে দেখা যায়। সালমার শরীর ঝিম ধরে আসে। অলস ঝিমুনিতে পেয়ে বসে। রকিব তখনো খেয়ে চলে।
সব শেষ না করে উঠবি না দেখছি?
আঃ, কথা বলিস না।
রকিব তৃপ্তির ভেঁকুর তোলে।
ঠিক আছে, ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে নিই।
সালমা টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। রকিব আড়চোখে ওকে দেখে। সালমা নির্বিকার। চোখ বুজে আছে। বাইরে শিরীষ গাছের মাথায় বসে একটা যমকুলি মিষ্টি স্বরে ডেকে যায়। টকটকে লাল ডানা আর চকচকে পালকে মোড়ানো সুন্দর পাখি। নির্জন দুপুরে মিষ্টি গানে তন্দ্রার মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সালমা। মনে হয়, অনেককাল আগে কোথায় যেন ও একটা স্বচ্ছ জল টলটল সরোবর ফেলে এসেছে। সাদা-বুক মাছরাঙা সেই সরোবরে ডোবে আর ওঠে। সে পুলকের যেন শেষ নেই। সালমার মনে হয় সে-রকম একটা পুলক ওর ঘাড়ের কাছে থেকে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আবার পায়ের তলা থেকে উঠে আসছে। আবার নামছে। আবার উঠছে। মনে হয় সাদা-বুক মাছরাঙা যেমন অনবরত ডোবে আর ওঠে ঠিক তেমনি একটা খেলা জমে উঠেছে। সালমার ভালোই লাগে। আরামে চোখ বোজে।
তবু স্বস্তি নেই। নাকের কাছে লাল পদ্মর ঘ্রাণ পায়। টকটকে লাল পদ্ম টলটলে জলে ভাসে। সালমার ড়ুবে যেতে ইচ্ছে করে সেই অতলে। আজ কেমন যেন লাগছে। একদম গা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। সব ইচ্ছেগুলো আম-কাঁঠালের বনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে পাখি হয়ে চলে যেতে বাসনা হয়। অন্য কোথাও। অনেক দূরে। সেই রকম একটা নির্জন দ্বীপ বুকের ভেতর জেগে ওঠে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কেউ আর কোথাও নেই। কে যেন সলিমার সব অনুভূতি অবশ করে ফেলেছে। কই, কাউকে তো ডাকেনি ও! কে এলো চুপিসারে! ঘুম ঘুম লাগে। ঘুম আসে না। অথচ নিবেদনে মন চায়।
কানের কাছে অস্পষ্ট, ডাক শোনে সালমা। নির্জন দ্বীপে ও মাত্র একজন লোক খুঁজে পেয়েছে।
সালমা।
কথা বলিস না।
সালমা।
আঃ, কথা বলতে চাই না।
এখন কী করব সালমা?
সিঁড়ি দিয়ে তো নামছি।
তারপর?
সামনে জল টলটলে পুকুরে লাল পদ্ম ভাসে।
তারপর?
আমরা পদ্ম ছিঁড়তে জলে নামব।
আমরা পদ্ম বুকে নিয়ে জলে ভাসব।
আমরা পাতালপুরীতে চলে যাব। আবার সব এলোমেলো হয়ে যায় সালমার। সাদা মসৃণ মাখনের মতো ফিকে হলুদ গায়ের রঙের ওপর প্রজাপতি দেখতে পায়। প্রজাপতি ওড়ে সালমার শরীরে। সালমার মনে হয় অনেকদিন আগে ওর ঘরে রোজ প্রজাপতি আসত। এক-একদিন এক-একটা। কখনো সাদা দেয়ালে পেইন্টিংয়ের মতো বসে থাকত। পল গঁগার ছবি যেন। কখনো স্বচ্ছন্দে উড়ে বেড়াত। একটুও ভয় পেত না। সালমা কোনোদিন ওগুলো ধরার চেষ্টা করেনি। কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। আজ প্রজাপতি খুব কাছে। হাত বাড়ালেই ধরা যায়। ধরতে ইচ্ছে করে। ধরে বুকের আঁচায় ভরে রাখব নিশ্চিন্তে।
সালমার মনে হয় ও অনেকদূর পথ চলে এসেছে। অনেক রাস্তা পেছনে ফেলে ও তরতরিয়ে চলে এসেছে। একটুও কষ্ট হয়নি। বেদনা না, দুঃখ না, বিষণ্ণতা না, কেবল সুখের মতো ধানের শীষ সালমার বুকের মাঠে মাথা উঁচিয়ে আছে। আর কোথাও কিছু নেই। লোকালয় ছেড়ে চলে এসেছে বাইরে। সব পেছনে ফেলে। সব ছেড়েছুঁড়ে। তখনই মনে হয়, নগ্ন হয়ে গেছে ও। নগ্নতার লজ্জা পেয়ে বসে ওকে। আবিরের মতো রং ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় ও। তখন কিছু মনে থাকে না। ভেসে আসে পাখির মিষ্টি গান আর তখনই ঘুম পায় সালমার। ঘুম। ঘুম। হরিয়ালের ঝাঁকের মতো ঘুম এসে নামে দুচোখে।
শেষ বিকেলে রকিবের বুকে মুখ গুজে থাকা মাথাটা টেনে উঠিয়ে লাল হয়ে যায় সালমা। মিটমিটিয়ে হাসে রকিব। ওর ঘুম অনেক আগে ভেঙেছে। চুপচাপ শুয়ে ছিল। রকিবের মুখে হাসি দেখে সালমা মাথাটা বালিশে গুজে দেয় আবার।
তোর হাসি দেখলে গা জ্বলে।
রকিব হো হো করে হাসে।
উঃ, থামবি!
না, থামব না।
বেশ তাহলে আমি চলে যাই।
সালমা উঠে বসে। রকিব ওকে বুকের ওপর টেনে নেয়।
যেতে চাইলেই কি হয়?
সালমা কথা বলে না।
অ্যাই সালমা—
কী?
আবাল খেলা—
যা!
সালমা উঠে বাথরুমে যায়। হাত-মুখ ধুয়ে মাথা আঁচড়ে নেয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবার দেখতে পায় সেই বউটি। পরনে জংলি ছাপা শাড়ি। চোখে ঔৎসুক্য। বুকের মাঝে একটা লাল মোরগ। ওকে দেখে চট করে ঘরে ঢুকে যায়। সালমা যাবে কি যাবে না ভেবে পায় না।
দারোয়ান চা নিয়ে আসে।
তোমার বউয়ের সঙ্গে আলাপ করা হলো না হামিদ?
কী আলাপ করবেন আপা, ও তো বোবা!
বোবা?
সালমার কণ্ঠে বিস্ময় উপচে পড়ে। অবাক হয়ে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, ওর বুকে সাগর আছে। সেই সাগরের তল নেই। অথচ সে ঠিকানা সালমার জানতে হবে। দারোয়ান দুটো চেয়ার বারান্দায় টেনে এনে দেয়। টেবিলে চায়ের ট্রে রাখে।
তুমি বোবা মেয়ে বিয়ে করলে কেন হামিদ?
মধ্যবয়সী দারোয়ানের মুখে হাসি। অপাঙ্গে চুলকানো সে হাসি নিয়ে নিজের ঘরের দিকে তাকায়।
বড় ভালো মেয়ে ও। ছোটবেলা থেকেই বাপ-মা কেউ নেই। চাচার কাছে ছিল। আমিও ওই বাড়িতে কাজ করতাম। চাচার বাড়িতে সুখ ছিল না ওর জন্য। ছিল কষ্ট। মুখ বুজে সব সইত। একদিন আমাকে ধরে অনেক কাঁদল। কিছু তো বলতে পারে না, কেবল কাঁদে। আমি বুঝলাম সবই। তারপর আমি ওকে বিয়ে করলাম। তখন ওর চাচা আমাকে এই চাকরিটা জোগাড় করে দিলো।
কথা যে বলতে পারে না, তোমার খারাপ লাগে না?
না। কথা দিয়ে কী হবে আপা। আমরা তো সুখেই আছি। এই আপনাদের মতো অনেকে আসে, তাদের সঙ্গে কথা বলি।
সালমা চুপচাপ শোনে। বউটিকে আবার দরজায় দেখা যায়। দারোয়ান উঠে চলে যায়। ইশারায় ওদের কী কথা হয়েছে কে বুঝবে। সালমারও যেতে ইচ্ছে করে। পারে না। কী বলবে ওখানে গিয়ে! দারোয়ানের কথার দরকার হয় না। ও চোখে চোখে কথা বলে।
ভালোবাসা বুঝি এমনি? ভালোবাসতে পারলে শুধু অনুভবে বুঝে নেওয়া যায়, শরীরের সব ইন্দ্রিয় কথার কাজ করে। আর কী। আর কী লাগে। ভালোবাসা না থাকলে দরকার হয় কথার। তখন চমক লাগাতে হয়। কথা তৈরি করে মন ভরাতে হয়। ইত্যাদি। ইত্যাদি। ঘুরেফিরে সেই কথাটা মনে হয় সালমার, কথা দিয়ে কী হবে আপা, আমরা তো সুখেই আছি।
দারোয়ান এক প্লেট আমের আচার নিয়ে আসে।
আমার বউ আপনার জন্য দিলো আপা—
ইস, তোমার বউ খুব কাজের তো–
সালমা আচার উঠিয়ে নেয়। মধ্যবয়সী লোকটা পরিতৃপ্তির হাসি হাসে। জিভ দিয়ে আমের টুকরো চাটতে চাটতে সালমা দারোয়ানকে দেখে। লোকটা সিঁড়ির ওপর গিয়ে বসেছে। মধ্যবসয়ী লোকটার বুকের সাগর সুখের মুক্তোয় টইটম্বুর। ওরা বেশ ভালোই আছে। সালমার হৃদয় কাঁপে। কেন যে কে জানে! মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। সূর্য ডোবার পথে। বাড়ি ফিরতে হবে। রকিব কি আবার ঘুমিয়ে পড়ল? নাকি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে? ফিরতে হবে ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সালমা ওর যৌবনের কতকগুলো মুহূর্ত এখানে ফেলে যাচ্ছে। জীবনের এ লগ্নের এমনতর উপচার আর কোনোদিন দিতে হয়নি। কিন্তু কই, তার জন্য তো ওর কোনো খারাপ লাগছে না। কোথাও কোনো বেদনার রেখা নেই। ওই বোবা বউটির চোখের ভাষার উৎসুক হাসি সালমার যৌবনের রাজসাক্ষী। যমকুলির মিষ্টি গান সানাইয়ের সুরের মতো বেজেছে। সালমার বারবার মনে হয় ও ওর তেইশ বছরের যৌবনের সঙ্গে ওই মধ্যবয়সী লোকটার বয়স যোগ করে নিয়ে যাচ্ছে। এই নির্জন ডাকবাংলাতে ও হয়তো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু সঙ্গী হিসেবে যা পেল তার কোনো বিনিময় মূল্য নেই।