০৩. টমাস গডউইন

‘গডউইন…? টমাস গডউইন…?’

সিধু জ্যাঠার কপালে ছ’টা খাঁজ পড়ে গেল।

সিধু জ্যাঠাকে আমি বলি বিশ্বকোষ, ফেলুদা বলে শ্রুতিধর। দুটোই ঠিক। একবার যা পড়েন, একবার যা শোনেন—মনে ধরলে ভোলেন না। ফেলুদাকে মাঝে মাঝে ওঁর কাছে আসতেই হয়। যেমন আজকে। ভোরে উঠে হাঁটতে বেরোন সিধু জ্যাঠা লেকের ধারে। মাইল দু-এক হেঁটে বাড়ি ফিরে আসেন সাড়ে ছ’টার মধ্যে। বৃষ্টি হলেও বাদ নেই; ছাতা নিয়ে বেরোবেন। বাড়ি ফিরে সেই যে তক্তপোষের উপর বসেন, এক স্নান-খাওয়া ছাড়া ওঠা নেই। সামনে একটা ডেস্ক, তার উপর বই, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ। লেখেন না। চিঠিও না, ধোপার হিসেবও না, কিচ্ছু না। খালি পড়েন। টেলিফোন নেই। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার হলে চাকর জনার্দনকে দিয়ে বলে পাঠান; দশ মিনিটে সে খবর পৌঁছে যায়। বিয়ে করেননি; বউ-এর বদলে বই নিয়ে ঘর করেন। বলেন, আমার সংসার, আমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবার। আমার ডাক্তার মাস্টার সিস্টার মাদার ফাদার, সবই আমার বই। পুরনো কলকাতা সম্বন্ধে ফেলুদার উৎসাহের জন্য সিধু জ্যাঠাই কতকটা দায়ী। তবে সিধু জ্যাঠা শুধু কলকাতা না। সারা বিশ্বের ইতিহাস জানেন।

দুধ-ছাড়া চায়ে পর পর দুটো চুমুক দিয়ে সিধু জ্যাঠা গডউইন কথাটা আরও দুবার আওড়ালেন। তারপর বললেন, ‘গডউইন নামটা ফস্ করে বললে প্রথমটা শেলির শ্বশুরের কথাই মনে হয়, কিন্তু ভারতবর্ষে এসেছে এমন একটা গডউইনও ছিল বটে; কোন বছরে মারা গেছে বললে?’

‘আঠারো শো আটান্ন।’

‘আর জন্ম?’

‘সতেরো শো আটাশি।’

‘হুঁ, তা হলে এই গডউইন হতে পারে বটে। আটচল্লিশেই বোধ হয়, কিংবা উনপঞ্চাশে, ক্যালকাটা রিভিউতে একটা লেখা বেরিয়েছিল। টমাসের মেয়ে। নাম শার্লি। না না—শার্লট। শার্লট গডউইন। তার বাপ সম্বন্ধে লিখেছিল। হুঁ, মনে পড়েছে।… ওরেব্বাস্! সে তো এক তাজ্জব কাহিনী হে ফেলু!—অবিশ্যি শেষ জীবনের কথা লেখেনি শার্লট। আর সেটা আমি জানিও না; কিন্তু গোড়ায় ভারতবর্ষে এসে তার কীর্তিকলাপ—সে তো একেবারে গল্পের মতো! তুমি তো লখনৌ গেছ?’

ফেলুদা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। বাদশাহী আংটির ব্যাপারে প্রথম তার গোয়েন্দাগিরির তারাবাজি লখনৌতেই দেখিয়েছিল ফেলুদা।

‘সাদত আলির কথা জান তো?’

‘জানি।’

‘সেই সাদত আলি তখন লখনৌ-এর নবাব। দিল্লির পিদিম তখন নিবু-নিবু, যত রোশনাই সব লখনৌ-এ। সাদত ইয়াং বয়সে কলকাতায় ছিল, সাহেবদের সঙ্গে মিশে ইংরিজি ভাষাটা একটু ভাসাভাসা শিখেছিল, আর শিখেছিল ষোল আনা সাহেবিয়ানা। আসাফ-উদ-দৌল্লা মারা যাবার পর ওয়জীর আলি হল নবাব। সাদত আলি তখন কাশীতে। মন খারাপ, কারণ আশা ছিল আসফের পর সেই গদিতে বসবে। এদিকে ওয়জীর ছিল অকর্মার ঢেঁকি। ব্রিটিশরা তাকে বরদাস্ত করতে পারলে না; চার মাসে তার নবাবি দিলে বরবাদ করে। মনে রেখো। অযোধ্যায় তখন কোম্পানির প্রতিপত্তি খুব; নবাবরা কোম্পানির কথায় ওঠে বসে। ওয়জীরকে হটিয়ে তারা সাদতকে সিংহাসনে বসাল। সাদত খুশি হয়ে ব্রিটিশকে অর্ধেক অযোধ্যা দিয়ে দিলে।

‘সে সময়ে লখনৌ-এর অলিতে-গলিতে সাহেব। নবাবের ফৌজে সাহেব অফিসার, সাহেব গোলন্দাজ; তা ছাড়া সাহেব ব্যবসায়ী, সাহেব ডাক্তার, সাহেব পেন্টার, সাহেব নাপিত, সাহেব ইস্কুল মাস্টার; আবার কেউ কেউ আছে যারা এসেছে শুধু টাকার লোভে; নবাবের নেক নজরে পড়ে দু-পয়সা যদি কামাতে পারে। এই শেষ দলের মধ্যে পড়ে টমাস গডউইন। ইংলন্ডের ছোকরা— সাসেক্স না সাফোক না সারি কোথায় তার বাড়ি ঠিক মনে নেই—সে দেশে বসে নবাবির গল্প শুনে এসে হাজির হল লখনৌতে। সুপুরুষ চেহারা, কথাবার্তা ভাল, রেসিডেন্ট চেরি সাহেবের মন ভিজিয়ে তার কাছ থেকে সুপারিশপত্র নিয়ে গিয়ে হাজির হল নবাবের দরবারে। সাদত জিজ্ঞেস করলে, তোমার গুণপনা কী। টমাস শুনেছে নবাব বিলিতি খানা পছন্দ করে— রান্নার হাত ভাল ছিল ছোকরার— বললে আমি ভাল শেফ, তোমাকে রেঁধে খাওয়াতে চাই। নবাব বললে খাওয়াও। ব্যস—গডউইন এমন রান্না রাঁধলে যে সাদত তক্ষুনি তাকে বাবুর্চিখানায় বাহাল করে নিলে। তারপর থেকে নবাব যেখানে যায় সেখানেই মুসলমান বাবুর্চির পাশে পাশে যায় টমাস গডউইন। লাটসাহেব শহরে এলে সাদত তাকে ব্রেকফাস্টে ডাকে—সাহেব খুশি হলে সাদতের মঙ্গল—ভরসা টমাস গডউইন। আর নতুন কোনও ডিশ পছন্দ হলেই আসে বকশিশ। নবাবি বকশিশ জানো তো? দু-দশ টাকা কি দু-চারটে মোহর গুঁজে দেওয়া তো নয়—লখনৌ-এর নবাব! হাত ঝাড়লেই পর্বত। বুঝে দেখো, গডউইনের পকেট কীভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠল। আর তাই যদি না হবে তো সে বাবুর্চিখানায় পড়ে থাকবে কেন? সে রকম লোকই সে নয়।

‘বেরিয়ে এল নবাবের আওতা থেকে। চলে এল আমাদের এই কলকাতায়। এসেই বিয়ে করলে জেন ম্যাডক বলে এক মেমসাহেবকে—কোম্পানির ফৌজের এক ক্যাপ্টেনের মেয়ে। তার তিন মাসের মধ্যে এক রেস্টোরান্ট খুললে খাস চৌরঙ্গিতে। তারপর যা হয় আর কী। সুদিন তো আর কারুর চিরটাকাল থাকে না। গডউইনের ছিল জুয়োর নেশা। লখনৌ থাকতে মুরগির লড়াই আর তিতিরের লড়াইয়ে বাজি ফেলে যেমন কামিয়েছে তেমনি খুইয়েছে। কলকাতায় এসে সে রোগ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।… এর বেশি আর তার মেয়ে কিছু লেখেনি। যদ্দূর মনে হয়, টমাস গডউইন মারা যাবার কয়েক মাস পরেই এ-লেখাটা বেরোয়। সেক্ষেত্রে তার নিজের মেয়ের পক্ষে তার বাপের মন্দ দিকটা কি আর খুব ফলাও করে লেখা চলে? অন্তত সে-যুগে যেত না নিশ্চয়ই। যাই হোক, এশিয়াটিক সোসাইটিতে গিয়ে তুমি লেখাটা পড়ে দেখতে পারো। আমি যা বললাম তার চেয়ে ন্যাচারেলি আরও বেশি ডিটেল পাবে।’

আমার অবিশ্যি মনে হল, সিধু জ্যাঠা পুরো লেখাটাই বাংলা করে বলে ফেলেছেন।

ফেলুদা আর আমি দুজনেই টমাস গডউইনের এই আশ্চর্য কাহিনী শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। আমাদের আগে সিধু জ্যাঠাই আবার মুখ খুললেন।

‘কিন্তু টমাস গডউইনের বিষয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করছ কেন? কী ব্যাপার?’

ফেলুদা বলল, ‘সেটা বলছি। তার আগে আরেকটা জিনিস জানার আছে। নরেন্দ্র বিশ্বাস বলে কারুর নাম শুনেছেন—যিনি পুরনো কলকাতা নিয়ে প্রবন্ধ-টবন্ধ লেখেন?’

‘কীসে লেখেন?’

‘তা জানি না।’

‘কোনও অখ্যাত কাগজে লিখলে সে লেখা আমার চোখে পড়বে না। আজকাল আর ধরাবাঁধা কাগজের বাইরে আর কিছু পড়ি না। কিন্তু এ প্রশ্নই বা কেন?’

ফেলুদা সংক্ষেপে কালকের ঘটনাটা বলে বলল, ‘গাছ পড়ে যদি একটা লোক জখম হয়ে অজ্ঞান হয়, তা হলে তার মানিব্যাগটা দশ হাত দূরে ছিটকে পড়বে কেন, এইখানেই খটকা।’

‘হুম্‌’…

সিধু জ্যাঠা একটু গম্ভীর থেকে বললেন, ‘কাল ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় নব্বুই মাইল। যদি বেরোয় যে ভদ্রলোকের মানিব্যাগ তার শার্ট বা পাঞ্জাবির বুকপকেটে ছিল, তা হলে দৌড়ে পালাতে গিয়ে পকেট থেকে সে ব্যাগ ছিটকে পড়া কিছুই আশ্চর্য নয়। আর দৌড়ানোর অবস্থাতেই তার মাথায় গাছ পড়ে থাকতে পারে। তা হলে আর রহস্য কোথায়?’

‘ভদ্রলোক পড়েছিলেন গডউইনের সমাধির পাশে।’

‘তাতে কী এসে গেল?’

‘সেই সমাধির পাশে খালের মতো গর্ত। মনে হয় কেউ খোঁড়ার কাজ শুরু করেছিল।’

সিধু জ্যাঠার চোখ ছানাবড়া।

‘বল কী হে! গ্রেভ ডিগিং? এ তো ভারী গ্রেভ সংবাদ দিলে হে তুমি। এ তো অবিশ্বাস্য। টাটকা লাশ হলে খুঁড়ে বার করে শব ব্যবচ্ছেদের জন্য বিক্রি করে পয়সা আসে জানি। কিন্তু দুশো বছরের পুরনো লাশের কয়েকটা হাড়গোড় ছাড়া আর কী পাওয়া যাবে বলো! তার না আছে প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্যালু, না আছে রিসেল ভ্যালু। খুঁড়েছে সে ব্যাপারে তুমি শিওর?’

‘পুরোপুরি নয়—কারণ বৃষ্টির জন্য কোদালের কোপের চিহ্ন মুছে গেছে— কিন্তু তবু…’

সিধু জ্যাঠা আবার একটু ভেবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না হে ফেলু, আমার মনে হচ্ছে তুমি বুনো হাঁসের পেছনে ধাওয়া করছ। হাতে কোনও কেস-টেস নেই বুঝি? তাই কল্পনায় একটা রহস্য খাড়া করছ—অ্যাঁ?’

ফেলুদা তার একপেশে হাসিটা হেসে চুপ করে রইল। সিধু জ্যাঠা বললেন, ‘গডউইনের বংশের কেউ যদি এখানে থাকত তা হলে না হয় তাদের জিজ্ঞেস করে কিছু জানা যেত। কিন্তু সেও তো বোধহয় নেই। সব সাহেব পরিবারই তো আর বারওয়েল বা টাইটলার পরিবার নয়—যাদের কেউ না কেউ সেই ক্লাইভের আমল থেকে এই সেদিন অবধি ইন্ডিয়াতে কাটিয়ে গেছে।’

এইবার ফেলুদা তার এতক্ষণের চাপা খবরটা দিয়ে দিল।

‘টমাস গডউইনের তিন পুরুষ পর অবধি তাদের কেউ না কেউ এ-দেশেই মারা গেছে সে খবর আমি জানি।’

‘সে কী?’ সিধু জ্যাঠা অবাক। আসলে আজই সকালে এখানে আসার আগে আমরা লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানটা দেড় ঘণ্টা ধরে দেখে এসেছি। এটা পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানের পরে তৈরি আর এখনও ব্যবহার হয়।

‘শার্লট গডউইনের সমাধি দেখেছি’, বলল ফেলুদা। ‘১৮৮৬ সালে সাতষট্টি বছর বয়সে মারা যান।’

‘গডউইন পদবি দেখলে? তার মানে বিবাহ করেননি। আহা, বড় সুলেখিকা ছিলেন।’

‘শার্লটের পাশে তার বড় ভাই ডেভিডের সমাধি। মৃত্যু ১৮৭৪’—ফেলুদা পকেট থেকে তার খাতাটা বার করে নোট দেখে দেখে বলে চলেছে—‘ইনি খিদিরপুরের কিড কোম্পানির হেড অ্যাসিসট্যান্ট ছিলেন। ডেভিডের পাশে তার ছেলে লেফটেনান্ট কর্নেল অ্যান্ড্রু গডউইন ও তার স্ত্রী এমা গডউইন। অ্যান্ড্রু মারা যান ১৮৮২-তে। অ্যান্ড্রু-এমার পাশে তাদের ছেলে চার্লস। ইনি ডাক্তার ছিলেন, মৃত্যু ১৯২০।’

‘সাবাস! ধন্যি তোমার অনুসন্ধিৎসা আর অধ্যবসায়।’ সিধু জ্যাঠা সত্যিই খুশি হয়েছেন। ‘এখন তোমার জানতে হবে বর্তমানে এঁদের কেউ জীবিত কি না এবং কলকাতায় আছেন কি না। টেলিফোন ডিরেক্টরিতে গডউইন নাম পেলে?’

‘মাত্র একটি। ফোন করেছিলাম। এই পরিবারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।’

‘দেখো খোঁজ করে। হয়তো থাকতে পারে। অবিশ্যি তার হদিস কী করে পাবে তা জানি না। পেলে, আর কিছু না হোক—গ্রেভ ডিগিং-এর ব্যাপারটা আমার কাছে ভুয়ো বলেই মনে হয়—অন্তত টমাস গডউইনের মতো একটা কালারফুল চরিত্র সম্বন্ধে হয়তো আরও কিছু তথ্য জোগাড় করতে পারো। গুড লাক!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *