আজও তেমনি দাঁড়াল। কিন্তু আশ্চর্য বেড়ার দরজার সাড়া, জুতোর শব্দ, এই দুটো ঘটনাতেও সামনের ঘর থেকে কোনো সাড়া এল না। অথচ ঘরের মধ্যে মানুষ নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে তা টের পাওয়া গেল। দেখা গেল না কাউকে, তবু কুঞ্জ দাস দাওয়ায় উঠে পড়ে পা ঝুলিয়ে বসল। পিঠটা ঘরের দিকে। গলা তুলে বলল, বাড়ি ঘর আলগা রেখে বাড়ির লোক উধাও! চোর ঢুকল বাড়িতে তা হুশ নেই।
কথার উত্তর এল না, শুধু ভিতরের নড়া-চড়াটা যেন আরও স্পষ্ট হল।
কুঞ্জ দাস সেইভাবেই বলল, মনস্থির করে ফেললাম! ওখানেই মেয়ের বিয়ে দেব।
এবার হঠাৎ ঘরের বাতাস অলক্ষ্যে কথা কয়ে উঠল, ওইখানটা আবার কোনখানটা? চাল-চুলো আছে নাকি?
কুঞ্জ এবার গলাটাকে আরও দরাজ করে, যে চালের নীচে আছে সেইটাই তার চাল, যে চুলোয় খাচ্ছে সেইটাই তার চুলো।
আবার শব্দভেদী বাণ, অধিকারীর সব্বস্বর উত্তরাধি-কারী হবে তো ওই কুড়োনো মেয়েটা। যার জাতের ঠিক-
থাক থাক, আর বাহাদুরীতে কােজ নেই জাত-টাত আমি মানি না!
অলক্ষ্য থেকে—তা হঠাৎ মনস্থির করবার হেতু?
করছিলামই! নতুন করে আবার বাজিয়ে নিলাম। রোমান্টিক পালা নিতে বললাম, বলল, —আমার দ্বারা ওসব প্যান-প্যােনানি হবে না।—ব্যস, করে ফেললাম মনস্থির—
ঘর থেকে অবাক গলা ভেসে আসে, এতে কি হল?
কী হল? কুঞ্জ দাস একটি রহস্যময় হাসি হেসে বলে, বোঝা গেল, সাচ্চা পুরুষ ছেলে। ন্যাকা ভালোবাসাবাসির ধার ধারে না। তবু আরও একটু বাজাব!
ভিতর থেকে এবার একটু স্থির স্বর শোনা যায়। স্থির, ভারী! যে ছেলে ভালোবাসার ধার ধারে না, সেই তাহলে কন্যে সম্প্রদানের পক্ষে সুপাত্ৰ?
আলবত! আর তার কথাবার্তা কী জোরাল! বলে,—বিয়ে বুঝি, ঘর সংসার বুঝি। সেটা হচ্ছে বিজিনেসের মতোন লেন-দেনের ব্যাপার। রোমান্স আবার কি? নেই ওসব এযুগে!
ওঃ! তাহলে আগের যুগে ছিল!
ছিল, সেই রাধাকেষ্টর আমলে ছিল। ব্যস। তারপরে আর না। যা আছে, সবটাই বখামি, আর ন্যাকামি!
ওঃ! ভালো কথা।
আলাপ চলছে। অথচ সেই দূর ভাষণে। একজন দেওয়ালের আড়ালে, আর একজন পিঠ ফিরিয়ে। তবু কথা কাটাকাটিরও কসুর নেই।
একটা গলা বলছে, বিয়ে দেবার আগে মেয়ের ইতিহাসটা বলতে হবে।
আর একটা গলা জোর গলায় জবাব দিচ্ছে, কেন? কী দায় পড়েছে? ওরই বা তিন কুলে কাঁটা গার্জেন আছে?
তবু তো ভদ্দর ঘরের ছেলে!
কুঞ্জ দাসও অভদ্র ঘরের ছেলে নয়!
মেয়েটা তো শুনেছি দাস মশাইয়ের কুড়ানো মেয়ে!
কুড়োনো তো কুড়োনো! অন্নজলের কোনো দাম নেই?
তা বটে! কিন্তু রেলগাড়ির হাতমুখ ধোওয়া হবে, না ধুলো পায়েই বিদায়?
তা সেটা হলেই ভালো হত, নিতান্তই ক্লান্ত, তাই—
অতঃপর এক সময় দেখা যায় কুঞ্জ সেই উঠোনটা পার হয়ে পিছনের এটা দরজা খুলে পুকুরে হাত পা ধুচ্ছে।
এক সময় দেখা যায়, সেই দালানেই একাধারে পাতা আসনে বসে পড়েছে কুঞ্জ, সামনে পরিপাটি করে বাড়া অন্নব্যঞ্জন।
আচ্ছা, লোক তো ত্রিসীমায় নেই, এসব করল কে? ভূতে নাকি?
তা তাই। ভূতই!
কুঞ্জ যখন হাতমুখ ধুয়ে বলল, যাই একবার মিষ্টির দোকানটা ঘুরে আসি, আকাশে তখন ঝিকিমিকি বেলা। অথচ তখন এই ক্ষুদ্রকায় বাড়ির ক্ষুদ্রকায় রান্নাঘরটার মধ্যে দুটো উনুন জ্বলে উঠেছে। শুকনো কাঠ গোছানো ছিল বোধহয়।
মিষ্টি কিনে আরও খানিক এদিক ওদিক ঘুরে কুঞ্জ যখন ফিরল, তখন আসন পাতা, অন্ন প্রস্তুত।
কুঞ্জ আবার পিঠ ফিরিয়ে বসে, আর বলতেই হবে।–ভূতে ভাতের থালা নামিয়ে রেখে যায়।
খাওয়া মেটে, তবু অনেকটা রাত পর্যন্ত এমনি লুকোচুরি খেলা চলে। তারপর একজন বলে, বাড়ি ফিরতে হবে না?
আর একজন বলে, বাড়ি না ঘোড়ার ডিম! সরাইখানা!
তা সেই সেখানেই-
ট্রেন তো সেই ভোরে।
তই আছে চিরকাল।
তার মানে সমস্ত রাত ইস্টিশানের চালার নীচে পড়ে থাকা!
তা মানে তাই দাঁড়ায় বটে।
অগত্যই রাগ-রাগভাবে উঠে পড়ে কুঞ্জ দাস। বলে, আর আসছি না।
ভিতর থেকে ছোট্ট একটু শব্দ, আচ্ছা!
কুঞ্জ গমগমিয়ে বলে, আচ্ছা? হুঁঃ! জানা আছে কিনা আসতেই হবে মুখে কুটো নিয়ো!
কেন? কে আসতে দিব্যি দিয়েছে?
কে দিব্যি দিয়েছে? ওঃ, খুব বোলচাল শেখা হয়েছে। কিছুদিন কলকাতায় বাস করে এই উন্নতিটি হয়েছে।
যাত্রার দল খুলেও সে উন্নতি কম হয়নি।
হুঁ! চোটপাটটি ঠিক আছে। যাক বিদেয় হওয়া যাক! বলে অধিকারী কুঞ্জ দাস গেজে থেকে এক গোছা নোট বার করে সামনের ওই ঘরটার দরজার কাছে নামিয়ে রেখে গলা তুলে বলে, কাগজের টুকরো কখানা তুলে রাখা হোক। ইঁদুরে না কাটে।
এবার ঘর নিঃশব্দ।
কুঞ্জ গলাটা একবার ঝেড়ে নিয়ে বলে, বাগদী মেয়েটা এসে কাজকর্ম ঠিকমতো করে দিয়ে যায়?
যায়।
কুঞ্জ ছাতাটা দাওয়ার পাশ থেকে উঠিয়ে নিয়ে উঠোনে নামে, জুতোটা পায়ে দেয়, বেড়ার দরজাটা খুলে বেরোয়, বাইরে থেকে আবার সেটা আটকে দেয়, তারপর সেই পায়ে চলা পথটা ধরে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে পকেট থেকে টর্চ বার করে আলো ফেলতে ফেলতে।
সারারাত এখন স্টেশনের সেই করোগেটের চালাটার নীচে পড়ে থাকতে হবে, রাত্রি শেষে ট্রেন। অভিজাত স্টেশন নয় যে, ওয়েটিং রুম থাকবে।
তবু মরতে মরতে এখানে আসতে হয় কুঞ্জ দাসকে। মাঝে মাঝেই আসতে হয়। ওই কাগজের টুকরোগুলোর পরমায়ূর কাল আন্দাজ করে করে তো আসতেই হয়। অকারণেও হয়! হঠাৎ মন ভালো হবার যোগ এলে, নাটক জমলে, মেডেল পেলে। এই পায়ে চলা পথটা যেন প্রবল আকর্ষণে টানতে থাকে কুঞ্জকে।
কিন্তু কেন? কিসের দায়ে বাঁধা কুঞ্জ?
তা সে কথা যদি বলতে হয় তো অনেকগুলো বছর আগে পিছিয়ে যেতে হয়। মন দিয়ে শুনতে হয় একটা কুলত্যাগিনী মেয়ের নির্লজ্জ খৃষ্টতার ইতিহাস। সংসারে আর কোথাও কেউ এতখানি ধৃষ্টতা দেখিয়েছে কিনা সন্দেহ।
তবে কুঞ্জ দাসকে দেখতে হয়েছে। কুলত্যাগিনী ওই মেয়েটার দুঃসাহসিক আবদার রাখতেও হয়েছে তাকে।
কুঞ্জ যখন একটা জ্বালার মন আর তার দলবল নিয়ে যেখানে সেখানে চাবুক বসিয়ে বেড়াচ্ছে, তখন একদিন কুঞ্জ একখানা চিঠি পেল। হাতের লেখা দেখে প্রথমে ছিঁড়ে ফেলতে গেল। তারপর আস্তে আস্তে শুধু খামের মুখটা ছিঁড়ল।
দেখল কটা মাত্র লাইন। সম্বোধনবিহীন—
…নির্লজ্জতার সীমা নেই। তা হোক, নির্লজের আর লজ্জা কি? মরতে বসেছি। একবার এসে দাঁড়াতেই হবে। নিচে ঠিকানা দিলাম।
কলকাতার পুব অঞ্চলে একটা গলি-পথের ঠিকানা।
চিঠিখানা নিয়ে সেদিন কুঞ্জ। সারারাত পায়চারি করল, তারপর সকালে একটা কাগজে লিখল, এখনও মুখ দেখাতে সাহস? খামে ভরল, উচিত।মতো স্ট্যাম্প মেরে ফেলে দিল। তারপর মনের জোর করে নাটকের মহিলা দেখতে বসল।
কিন্তু নির্লজ্জতা আর ধৃষ্টতার চরম পরাকাষ্ঠীর নমুনা নিয়ে আবার একছত্র চিঠি এল, তেত্রিশ কোটি দেবতার দিব্যি মুখ দেখাব না। তবু না এলেই নয়।।
অধিকারী কুঞ্জ দাস হঠাৎ মনস্থির করে ফেলল। গায়ে জামা চড়িয়ে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগে একখানা কাপড় গেঞ্জি আর যতগুলো পারল টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
সেখানে গিয়ে দেখে এক বিতিকিচ্ছিরি কােণ্ড। একটা সরু গলির মধ্যে পাকা গাঁথুনির এক বস্তি, তারই একটা ঘরের সামনে একটা মড়া পড়ে। জোয়ান বয়সের পুরুষের মড়া। চেহারা প্রায় সুকান্তি। মরে গেলেও বোঝা যাচ্ছে।
কুঞ্জ গিয়ে পড়তেই একটা সোরগোল উঠল।
অনেকগুলো মেয়ে-পুরুষ এক সঙ্গে কথা কয়ে উঠল। ঘরের মধ্যে একটা মেয়ে-গলা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, ভাসুর বুঝি? তা বিপদের সময় অত ভাসুর ভাদ্দরবৌ মানলে চলে?…তারপর কোন ঘর থেকে একটা বয়স্ক বেটাছেলে বেরিয়ে এসে হেঁড়ে গলায় প্রশ্ন করল, আপনিই বুঝি অমলবাবুর দাদা? তা ভাই মরে গেল। তবে এলেন? প্রতিজ্ঞে ছিল বুঝি মরমুখ দেখবেন? তা তেমন প্ৰতিজ্ঞের উপর্যুক্ত লোকই ছিলেন বটে। শ্ৰীযুক্ত অমলবাবু! মরে গেছেন, আর বলতে কিছু চাই না। তবে চটপট ব্যবস্থা করে ফেলুন মশাই।
করতেই হল ব্যবস্থা। কোথাকার এক মফস্বল শহরের কমল মুখুজ্যের ছেলে অমল মুখুজ্যের লিভার পচে মরা দেহটার সদগতি করতে নিয়ে গেল। কুঞ্জবিহারী দাস। মুখাগ্নিও সেই করল, কারণ তখন সে অমল মুখুজ্যের দাদা।
ভাদ্দরবৌ! সামনে বেরোয় না। কিন্তু কথা না বললে চলছে না। দরজার আড়াল থেকে বলে, আর কিছুদিন আগে এ দয়া হলে দেশের লোকটা বিনি চিকিচ্ছেয় মরত না।
কুঞ্জর চারিদিকে দুডজন করে চোখ কান। কুঞ্জ তবু গলা নামিয়ে বলে, বড়ো দুঃখ হচ্ছে, না?
তা একটা মানুষ বেঘোরে মরলে হয় বৈকি দুঃখ।
আমার একটা বাসনা পূর্ণ হয়েছে! কুঞ্জ চাপা নিষ্ঠুর গলায় বলে, মুখে আগুন ধরাবার বাসনাটা পূর্ণ হল।
আরও একটা মুখ তো বাকি— ঘরের ভিতরটা যেন আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে কথা কয়ে ওঠে, সেটারও কি এ গতি হবার আশা আছে?
কুঞ্জ গম্ভীর গলায় উত্তর দিয়েছিল, গ্যারান্টি দিতে পারছি না।
তা যাক। মুখে আগুন দেওয়াটা ভাগ্যচক্ৰ। যে জন্যে ডেকেছি, বলি—
বলল সেই কথা, সেই দুঃসাহসিক মেয়ে মানুষটা! বছর তিনেকের একটা মেয়ে আছে তার, সেটার ভার নিতে হবে কুঞ্জকে।
ভার নিতে হবে মানে? মানে কিছুই নয়। নিতেই হবে তাই। সেটাই বক্তব্য ওই আদর্শনার। মেয়েটার বাপ মরেছে নানা রোগে, মা মরবো, মানে মরতে বসেছে যক্ষায়, অতএব পরোক্ষে মেয়েটা ডাস্টবিনে যাবে। কুঞ্জ ভার না নিলে নেবে কে? পথের কুকুর বেড়াল ছানার মতো মরবো?
তা মরুক না। কুঞ্জর কী লোকসান তাতে? আমন কত মরছে জগতে।
হ্যাঁ, সেই জবাবই দিয়েছিল কুঞ্জ। চোটপাট বলেছিল, বেড়াল কুকুরের মতো সে অপেক্ষাই বা কিসের? শানে আছাড় দিলেই তো চুকে যায়।
তো, তা হলে তাই দিয়ে যেতে হবে— অন্তরালবর্তিনী বলেছিল, সেটাও একটা উপকার করে যাওয়া হবে। ওর মায়ের তো সেটুকু ক্ষমতাও নেই গায়ে।
হুঁ! তারপর? সেই জননীটির শেষ গতি কি হবে?
তার গতি? একটু হাসি শোনা গিয়েছিল, যক্ষ্মা হাসপাতালের মুদ্দফরাশ নেই!
তা ভালো! উঁচু দরের গতির ব্যবস্থা হয়ে আছে তাহলে! তা হাসপাতালের ব্যবস্থাটা হয়েছে?
হবে! বাড়িওলাই নিজের গরজে টেনে ফেলে দিয়ে আসবে। যাক মেয়েটাকে আছড়ে দেওয়ার কাজটা সেরে যাওয়া হয় যেন।
পাশের ঘরে এধারে ওধারে অনেকগুলো কান ভাসুর ভাদরবৌয়ের আলাপ শোনার আশায় উদগ্র হয়েছিল। তারা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ঘোমটার ভেতর খ্যামটা নাচ!
আরও অনেক কিছুই বলল তারা। এবং অপেক্ষা করতে লাগল, লোকটা বিদেয় হলে আচ্ছা! করে একবার শুনিয়ে ছাড়বে বামুন বৌকে।—বলি এতই যদি কথার বান, মুখ দেখাদেখিতেই যত দোষ? আরও বলবে—ভেতরে ভেতরে এতবড়ো একটি ব্যামো পুষে রেখে এতগুলো লোককে মজাচ্ছ তুমি?
কিন্তু শুনিয়ে দেবার আসাটা আর মিটাল না। তাদের।
লোকটা চলে গেল না।
গেল একেবারে বামুনবৌকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে, আর তার বাচ্চ মেয়েটাকে নতুন জামাজুতো পরিয়ে সঙ্গে নিয়ে।
হাসপাতালের খরচের দায়িত্ব তো অগত্যা কুঞ্জ দাসকেই নিতে হবে। আর রুগীটা যখন মরবেই তখন তার মা-মরা মেয়েটারও যাবজীবনের দায়িত্ব নিয়ে নিতেই হবে। উপায় কি? মানুষ বৈ তো জন্তু জানোয়ার নয় কুঞ্জ?
কিন্তু আশ্চৰ্য্য, রুগীটা মরল না। অখাদ্যের প্রাণ যমের্য অরুচি বলেই হয়তো মরল না, সারল। অতএব হাসপাতালের জায়গা জুড়ে আর থাকা চলল না।
অনেক ঘাটের জল খেয়ে অনেক অবস্থা পার হয়ে, অবশেষে আমতা লাইনের একটা গণ্ডগ্রামের এই আশ্রয়। সাড়ে সাতশো টাকা দিয়ে কেনা হল এই মলাট-ছেড়া বইয়ের মতো বালি-খসা বাড়িটা। আর বাড়িটা নিজের ট্যাকের কড়ি খসিয়ে কিনেছে বলেই হয়তো কুঞ্জ দাসের এটার ওপর এত টান!
বছরের পর বছর করে অনেকগুলো বছরই তো পার হল, টানটা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে না। বোধকরি মুখ না দেখানোর প্রতিজ্ঞাটা বজায় আছে বলে, রংটাও অ-বিবৰ্ণ, উজ্জ্বল।
আগে কখনও কখনও বলত কুঞ্জ, মেয়েটাকে ইচ্ছে করলেই বেড়াতে আনতে পারি।
ঘরের দেওয়াল বলেছে, থাক!
লোকসান কি?
আছে। মিছিমিছি একটা অবোধ শিশুর মনে কৌতূহল জাগিয়ে দেওয়া। পাঁচটা প্রশ্ন তার মনে। তোলা।
কত বড়োটা হল, দেখবার সাধও হতে পারে, তাই ভেবেই বলা।
নাঃ, সে সাধ নেই।
তা, নেই সে সাধ নিশ্চয়। সাধ থাকলে ওই ধৃষ্ট নির্লজ্জ মেয়েমানুষটা নির্ঘাত নিজে থেকেই বলত, কত বড়োটি হল দেখতে সাধ হয়! তা পারত ও বলতে, ওর অসাধ্য যখন নেই।
সাধ নেই দেখবার, তবু কুঞ্জ দাস তার নাটকের সেই ছেলে-সাজা মেয়েটার ফটোগ্রাফ তুলে তুলে মাঝে মাঝে ওই নোটের গোছার সঙ্গে দরজার বাইরে রেখে যায়।
ঘরের ভিতর থেকে তাচ্ছিল্যের স্বর ভেসে আসে। দরকার ছিল না। না দেখে মরছিল না। কেউ।
কুঞ্জ চটে যেত। বলত, কেনই বা মরে না? মরবার তো কথা। গর্ভে ধরলেই তার ওপর মায়ার টান–
সবই কি আর এক নিয়মে চলে? বিতেষ্টাও থাকতে পারে।
হুঁ! অবোধ শিশু, তার ওপর বিতেষ্টা! আর—
শব্দভেদী বাণ বলে, থামা হল কেন? সবটা হয়ে যাক?…আর পাপে বিতেষ্টা ছিল না, অনাচারে বিতেষ্টা ছিল না, এই সব তো?
কুঞ্জ বলত, সোধে সোধে অপমান গায়ে মাখা! কুঞ্জ দাস অত ছোটো কথা কয় না।
আমার ঘাট হয়েছে।
এই তর্কাতর্কি কখনও কখনও বাতাস উত্তপ্ত করে তুলত। কুঞ্জ বলত, আর আসব না।
ঘরের দেওয়াল তখন হেসে উঠত। বলত, টাকাটা তাহলে মনিঅৰ্ডারে আসবে? না কি বন্ধ?
কুঞ্জ রাগ করে বলত, সাধে আর বলেছে বদ মেয়েছেলে!
চলে যেত গটগটিয়ে। আবার আসত। বরং সেবারে আরও তাড়াতাড়ি আসত। ক্রমশ এই আসাটা চন্দ্ৰ সূর্যের মতো নিশ্চিত নিয়ম হয়ে গেছে। আসবেই কুঞ্জ। নতুন মেডেল পেলে সেটা দরজায় ফেলে দিয়ে বলবে, দেশসুদ্ধ লোক পুজো করে বৈ হেনস্তা করে না। মেডেল কেউ আমনি দেয় না।
কোনো বই খুব নাম করলে, এসে ওই উল্টোমুখে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলে, হাজার হাজার লোক দেখছে, আর অহঙ্কারীদের গারবে মাটিতে পা পড়ে না!
ঘরের দেওয়াল বলে, দেখাটা হবে কেমনে করে? আসরের কানাচে হাড়ি বাইরীদের দলে বসে?
সে কথা কেউ বলেছে? কুঞ্জ রেগে ওঠে।
জবাব আসে হাসির সঙ্গে, বলবে কেন? যা ঘটবে সেটাই হচ্ছে কথা।
কুঞ্জ চুপ করে থেকেছে। কুঞ্জ আর কোনো আশ্বাসের কথা খুঁজে পায়নি তখন। তারপর হয়তো কুঞ্জ সহসা বলে উঠেছে, তেত্ৰিশ কোটি দেবতার দিব্যিটা কি জীবনভোর পালতে হবে?
ঘরের মধ্যে একটা অস্ফুট আওয়াজ যেন চমকে উঠেছে। তারপর আস্তে আস্তে যেন ঘুমন্ত মানুষ কথা বলেছে, দেবতার দিব্যি জন্মভোর কেন, জন্ম-জন্মান্তর পালতে হয়।
তেত্ৰিশ কোটি তো আছে ঘেঁচু। মা-কালী এর মধ্যে পড়ে না।
পড়ে? মা-কালীকে অগ্ৰে নিয়ে তেত্ৰিশ কোটি।
দিব্যি দেবার আর বস্তু খুঁজে পেল না! ছ্যাঃ, যেমন বুদ্ধিতে চলল চিরদিন!
আক্ষেপ, রাগ, অসহিষ্ণুতা এই ছিল সমাপ্তি সঙ্গীত। ক্রমশ সেটাও গেছে। এখন শুধু যেন অন্ধ একটা নেশার অভ্যাস। আসে, উল্টোমুখো হয়ে বসে পা দোলাতে দোলাতে বাতাসকে কথা বলে, পুকুরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে, একবেলার ভাতটা খায়, তারপর ছাতাটি নিয়ে স্টেশনে গিয়ে টিনের চালার নীচে সারারাত পড়ে থেকে, সকালের গাড়িতে ফেরে।
রাতে থাকার কথা ওঠে না। নানান জায়গায় থাকা, নানান দেশ থেকে বায়না, কত লাইনের গাড়িতে চড়তে হয়। দলবল নিয়ে, কিন্তু এই আমতা লাইনটায় কখনও ভুল হয় না।
প্রথমবার ভাত পায়নি। কুঞ্জ যা দোকানের মিষ্টি এনে ধরে দেয় একরাশ, তাই থেকেই সাজিয়ে গুছিয়ে ধরে দেওয়া হয়েছিল কুঞ্জর সামনে। কুঞ্জ রেগে উঠে বলেছিল, ভাতের আগে এই এত সব খেতে হবে?
ভাত!
ঘরের মধ্যে থেকে একটা প্ৰেতাত্মার ছায়া কণ্ঠ বলে উঠেছিল, ভাত খাওয়া হবে এখানে?
হবে না তো কি এই পিণ্ডিগুলো গিলে রাত কাটাতে হবে? ভাত ছাড়া রাতে আর কিছু খাই কখনও আমি?
সেই স্বর বলেছিল, এখানে আমি ছাড়া আর কে আছে রাঁধবার?
কুঞ্জ ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, ওঃ, তা শরীর বুঝি ভালো নেই? তবে থাক, তবে থাক। কুঞ্জ ওই কণ্ঠস্বরের মধ্যে বোপাকরি ভয়ানক একটা ক্লান্তির আভাস পেয়েছিল। কিন্তু সে উত্তরটা পেল উল্টো।
শরীর খুব ভালো আছে। হাতে খাওয়া হবে কি না সেই কথাই হচ্ছে।
ওঃ হাতে খাওয়া!
কুঞ্জ একটা বিদ্রাপের হাসি হেসে উঠেছিল, ধৰ্মজ্ঞান! বলি জলটা দিল কে?
জলে আর ভাতে অনেক তফাত।
কিছু না, কিছু না, কোনো তফাত নেই। খাওয়া নিয়ে কথা। বলেই কুঞ্জ আরও হেসে ওঠে, আর সে ধরতে গেলে তো জাতে উঁচু হয়েই যাওয়া হয়েছে। কুলের মুখুটি মুখুজ্যে কুলীন।
ভিতরে স্বর এবার সজীব সতেজ, আরও একটা কথা আছে। কাশির ব্যামো হয়েছিল—
রোগ সারলে আর রুগী কিসের? বেশি কষ্ট না হলে ভাত দুটো চড়ানো হোক। সেই থেকে ওই একবেলা ভাত, আর তার সঙ্গে এক পাহাড় কথা!
কথা, কথা! কথা কইবার জন্যেই যেন ছুটে আসে কুঞ্জ। অথচ একটা অশরীরী আত্মার সঙ্গে কথা। আর নতুন কথা কিছুই নেই। তবে ইদানীং কুঞ্জর ওই পুষ্যি মেয়েটার বিয়ের কথা নিয়ে কথা চালায় কুঞ্জ। তার সঙ্গে নিজের বুদ্ধির বড়াইও।
উঁহু, কাপড়-ফাপড় দিইনি। এখনও। ওই ঘাগরা পরিয়েই ছেড়ে ছেড়ে রেখেছি। বয়েস ধরা যায় না। তা ছাড়া স্বভাবেও একেবারে বাচ্চা! মায়ের তো কাঠ কবুল প্রতিজ্ঞে দেখব না, নইলে মনে হয় নিয়েই চলে আসি। এত বায়না করে! হাত ধরে ঝুলে পড়ে।
অত আহ্লাদেপনা কেন?
আহ্লাদেপনা আবার কি? একটাও স্নেহ মমতার জায়গা তো থাকবে মানুষের?
সম্পর্কটা বেশ ভালোই পেয়েছে। একটু হাসির শব্দও আসে কথার সঙ্গে।
সম্পর্ক! সম্পর্ক নিয়ে কে ধুয়ে জল খাচ্ছে? তবে এই আগে থেকে বলে রাখছি, বিয়ে দিয়ে জামাই মেয়ে এনে দেখাবই। তিন সত্যি!
পরিচয়টা কী দেওয়া হবে?
সে আমি বুঝব।
আবার আসে—
বলে, মনঃস্থির করেছি, তবু এখনও আরও কিছু বাজিয়ে নিতে বাকি। তবে দেরি করব না, ছেলে-বয়স থাকতে থাকতেই দল থেকে সরাতে হবে। অবিশ্যি খুব দুদে আছে মেয়েটা, কাউকে পরোয়া করে না, সব কাঁটার সঙ্গে ঝগড়া। তাই আমার শান্তি।
কুঞ্জর পুষ্যি মেয়েটা দুদে বলে কুঞ্জর শান্তি! আর কুঞ্জ তার পাত্ৰ ঠিক করে ফেলেছে বলে কুঞ্জর শান্তি! তবু পত্রটাকে এখনও বাজিয়ে নিতে বাকি।
সেই বাজানোর পদ্ধতিটাই ধরে কুঞ্জ। লিলিকে ডেকে ডেকে বলে, সারাদিন শুধু হি হি করে বেড়াস কেন? শেলেট পেন্সিলটা নিয়েও বসতে পারসি দুদণ্ড! বাড়িতে একটা লেখা-পড়া জানা ভদ্র ছেলে রয়েছে, তার কাছেও একটু পড়া বুঝে নিলে হয়। তা নয়। কেবল ওই মুখুগুলোর সঙ্গে—
বরুণদা পড়াবে আমাকে? তা হলেই হয়েছে! লিলি ঠোঁট উল্টোয়।
কুঞ্জ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
আবার এক সময় অন্য পথ ধরে কুঞ্জ। বলে, লিলি, যা দিকি—বরুণকে এক পেয়ালা কড়া করে চা দিয়ে আয় দিকি। রাত জেগে বই লেখে! দেখিস যেন আর কাউকে বরাত দিসনি, নিজে করে। দিবি।
লিলি প্রোপ্ৰাইটারের কথা ঠেলতে পারে না। কিন্তু খানিক পরে লিলি রাগ করে ফিরে আসে, আর ককখনো বরুণদাকে চা করে দেব না। এত বকে!
বকে? বাকবে কেন?
কেন? তোমার ভালো ছেলে ভাদর ছেলে যে! চা দিতে গিয়েছি, বলে কি না কে তোকে চা নিয়ে আসতে বলেছে? চা খেতে চেয়েছিলাম আমি? খবরদার যদি আর কখনও শুধু শুধু এ ঘরে আসবি তো দেখাব মজা। যা, ফেলে দিগে যা। লিলি কাঁদো কাঁদো হয় এবার।
কিন্তু কুঞ্জর মুখ হাসি হাসি। কুঞ্জর যেন অঙ্কের ফল মিলে গেছে। কুঞ্জ বলে, তুই বললি না। কেন, প্রোপ্ৰাইটার বলেছে।
বলতে সময় দিয়েছে? দূর দূর, ছেই-ছেই! শেষকালে যখন বললাম, ফেলে দেবে তো— পোপাইটারের সামনে গিয়ে ফেলে দাও গে। যে চা দিতে বলেছে—তখন বলল,—দে, দিয়ে যা।
কুঞ্জ মৃদু হেসে বলে, রাত-দিন চড়া চড়া পালা লেখে তো? মেজাজটা তাই চড়া। তার মুখে প্ৰসন্নতার দীপ্তি–এই ঠিক ছেলে!
মেয়ে মানুষকে দূর দূর করে মানেই, বিয়ে করা পরিবার ছাড়া জীবনে ও আর কারুর দিকে তাকবে না। তা ছাড়া লিলির সঙ্গে গেথে দিতে পারলে চিরকাল আমার কাছে বাঁধা থাকবে লেখক। আর লিলিও কাছে থাকবে।
কুঞ্জ বরুণের ঘরে এসে ঢোকে।—চা দেখে রেগে উঠলে কেন গো নাট্যকার? রাত জেগে লেখো, তাই ভাবলাম একটু কড়া করে চা খেলে—
না না, আমি ওসব পছন্দ করি না—! বরুণ বিরক্ত গলায় বলে, খুব খারাপ লাগে আমার ওই মেয়ে-ফেয়ে ঘরে ঢোকা।
কুঞ্জ উদার গলায় বলে, আরে বাবা, একটা বাচ্চা মেয়ে—
তা হোক! বরুণ রুক্ষ গলায় বলে, বারণ করে দেবেন।
কুঞ্জ হৃদ্যতার গলায় বলে, তা না হয় দিলাম। কিন্তু মেয়েছেলে দেখলেই যদি তোমার এত গা জ্বলে, বে। থ্যা করবে কি করে?
বিয়ে করব, এ কথা আপনাকে বলতে যাইনি।
কুঞ্জ হেসে উঠে বলে, আহা তুমি তো বলতে যাওনি, কিন্তু আমি তো মনে মনে ঠিক করে রেখেছি তোমাকে ঘর সংসারী করে দেব।
বরুণ হঠাৎ ভুরু কুঁচকে বলে, কেন? হঠাৎ আমার প্রতি এমন নেক নজর কেন?
আহা, তুমি রাগ করছ কেন? তোমাকে যে আমার ভারী পছন্দ, তাই!
বিয়ের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক? পছন্দ করেন, করুন।
নাঃ, এখন তোমার মেজাজ ভালো নেই, থাক ও কথা! পালাটার কতদূর হল?
এগোচ্ছে।
শুনতে পাই না একটু?
বরুণ একবার এই লোকটার প্রাথী-প্রাথী মুখের দিকে তাকায়। এটাও আশ্চর্য! দলের আর সকলের ওপর ব্যবহার তো দেখেছে, যেন হাতে মাথা কাটছে। অথচ বরুণের সামনে যেন বেচারী! যেন কৃতাৰ্থস্মন্য অধস্তন! তার মানে বরুণের মধ্যেকার শিল্প-স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা করে ওই গোঁফওয়ালা বেঁটে-খাটো লোকটা। বরুণ হঠাৎ নিজের রূঢ়তার জন্য লজ্জিত হয়। বলে, আচ্ছা, শুনুন খানিকটা—
পড়ে কিছুক্ষণ, তারপর মুখে মুখে বাকিটা শোনায়। একজন ভেজালদার কালোবাজারি ঘিয়ে বিষাক্ত চর্বি ভেজাল দিয়ে কেমন করে নিজের পরিবারের সকলের মৃত্যু ডেকে আনল, আর তারপর ভেজালদারের একমাত্র জীবিত কন্যা পদ্মা উন্মাদিনী হয়ে গিয়ে কীভাবে জ্বলন্ত ভাষায় জগতের সমস্ত লোভী মুনাফাখের আর ভেজালদারদের উদ্দেশে অভিসম্পাত দিয়ে বেড়াতে লাগল, এ তারই কাহিনি।
আধুনিক কোনো একাঙ্কিকা নাটিকার নাট্যকার বিরুণের নাটককে কানাকড়িও মূল্য দেবে কিনা সন্দেহ। বরং হয়তো তার মোটা আদর্শ, আর তার মোটা প্রকাশভঙ্গি দেখে কৌতুকের হাসি হাসবে, তবু বরুণরাও একেবারে অসাৰ্থক নয়। তাদেরও গুণগ্রাহী আছে, তাদেরও শ্রোতা আছে, দর্শক আছে।.সূক্ষ্ম রসের সমজদারই বরং কম। এই মোটা রসের মানুষই তো দেশজুড়ে। দেশ যতই তার সাহিত্য আর শিল্পের উৎকর্ষের বড়াই করুক, আজিও নাটকান্তে নায়িকাকে পাগলিনী করে ছেড়ে দিয়ে তার মুখের অসংলগ্ন ভাষার মধ্যেই নাট্যকারেরও মূল বক্তব্যটি চালিয়ে দেওয়ার যুগ প্রায় অবিচলই আছে।
কাজেই কুঞ্জ অধিকারী বরুণের মুখে নাট্যকাহিনি শুনতে শুনতে রোমাঞ্চিত হয়, আর কল্পিত এক আসরে বসে হাজার হাজার করতালির ধ্বনি শুনতে পায়।
হঠাৎ তাই বরুণের হাতটা চেপে ধরে কুঞ্জ বলে, এইটাই তুমি ভালো করে খাড়া করে ফেল লেখক! কলকাতার পুরনো রাজবাড়ির যাত্রা অপেরা কম্পিটিশনে এটাই নামাব।
বরুণ ওই আসায় উদবেল আগ্রহ-ব্যাকুল মুখের দিকে তাকায়, আর আস্তে আস্তে হাসে। বলে, সবটা করে দেখি কেমন দাঁড়াবে।
তোমার হাতে আবার কেমন দাঁড়াবে! অপূর্বই দাঁড়াবে। কুঞ্জ ওর হাতটা আরও জোরে চেপে ধরে বলে, নাট্যকার, তুমি কখনও আমায় ছেড়ে যেও না।
বরুণের মুখে আসছিল, ম্রোতের শ্যাওলা কি কখনও এক জায়গায় আটকে থাকে? কিন্তু বলতে পারল না। ওই বয়স্ক লোকটার নির্ভরতায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। তারপর লেখা কাগজগুলোয় মন দিল।
একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কুঞ্জ উঠে গেল। কুঞ্জ একা পায়চারি করতে করতে ওই জ্বলন্ত ভাষা আর চারুহাসিনীকে মনে করতে থাকে।
পারবে কি? পারবে বোধহয়! কলকাতার পুরানো রাজবাড়ি থেকে ঘোষণাটা একবার পেলে হয়।
কিন্তু হল একটা ব্যাপার।
কলকাতার ডাক আসবার আগেই মহিষাদল থেকে একটা ডাক আসে। জমিদারি না থাক জমিদার-বাড়ি। এখনও পুরানো ঐতিহ্য রয়ে গেছে। একমাত্র ছেলের পৈতে, সেই উপলক্ষে বিরাট ঘটা আর সেই ঘটনা উপলক্ষে যাত্রা আর কবিগান দেবেন তারা। দুর্গাপুজো মারফত কুঞ্জ অধিকারীর
কুঞ্জ বলে, আমি বলি কি নাট্যকার, তোমার ওই নতুন পালটাই লাগিয়ে দিই।
বরুণ বিস্মিত হয়। বলে, রিহার্সালের সময় কোথা?
হবে, হয়ে যাবে। কুঞ্জ আগ্রহের গলায় বলে, পিটিয়ে পিটিয়ে করে তুলব। মেদনীপুরের লোকের তোমার গিয়ে এই সব চেতনা বেশি। সেখানে তোমার এ পালা নামালে দেখবে কাণ্ড!
বরুণ হাসে, দেখুন!
কুঞ্জ কিন্তু হাসে না। কুঞ্জ সিরিয়াস গলায় বলে, দেখব না, দেখেছি। তুমি যদি আমার সঙ্গে থাক নাট্যকার, কোনো বাধাকেই ভয় করি না।
বলে বটে। অথচ ভাবে বরুণ তার কে? বরুণ তার নাটকের নাট্যকার, এইমাত্র। বলতে গেলে পথে কুড়োনো। আর বলতে গেলে কুঞ্জরই গঠিত বিগ্রহ।—
কোথায় যেন দল নিয়ে চলেছে কুঞ্জ, হঠাৎ রুক্ষুমাথা, ধুলোভর্তি পায়, আধ্যময়লা ধুতি শার্ট পরা ছেলেটা রেলগাড়িতে উঠে পড়ে বলে, পয়সা নেই, বিনাটিকিটে উঠেছি, আমার ভাড়াটা দিয়ে দিন না।
চমৎকৃত কুঞ্জ চমৎকার ভাবটা গোপন করে বলে, তা খামোেকা আমি তোমার রেলভাড়াটা দিয়ে দেব কেন হে বাপু? তুমি আমার কে, বাপের ঠাকুর চোদ্দপুরুষ?
ছেলেটা দমেনি। বলেছিল, এরাই বা আপনার কে? এই যে দলবল নিয়ে যাচ্ছেন?
এরা? এরা তো আমার দল। ভবানী অপেরার নাম শুনেছি? আমি হচ্ছি। তার প্রোপ্ৰাইটার কুঞ্জবিহারী দাস।
ছেলেটা বলেছিল, নাম শুনিনি, এই শুনলাম। তা বেশ তো, আমাকেও দলের লোক করে নিন।
চাইছে, অথচ প্রাথীর ভাব নেই, যেন দাবির সুর। কুঞ্জর ভালো লেগে গেল। হাত কচলানো কৃপাপ্ৰাথী দেখে দেখে অরুচি। আর তা না হল তো তেজে মটমট! এর ভাব আলাদা! কুঞ্জ সকৌতুকে বলল, তা দলে না হয় নিলাম। কিন্তু তোমার কি গুণ আছে শুনি?
ছেলেটা বলল, গুণ কিছু নেই, তবে যাত্ৰা-নাটকের পালা লিখতে পারি কিছু কিছু।
পালা লিখতে পারে! আহা-হা, এই লোকই তো খুঁজে বেড়াচ্ছে কুঞ্জ—যার ক্ষমতা আছে, অথচ আত্মঅহমিকাবোধ নেই। এর নেই, দেখেই বুঝেছে কুঞ্জ। নিজের গুণ সম্পর্কে যেন তাচ্ছিল্য ভাব! ব্যস। সেই রেলগাড়িতেই হয়ে গেল সম্পর্ক স্থাপন।
তারপর-কুঞ্জর উৎসাহ, প্রেরণা আর বিরুণের সহজাত ক্ষমতা। কুঞ্জ অবশ্য বলে, লেখাপড়া জানা ভদ্র। কিন্তু বরুণ নিজে কোনোদিন নিজের পরিচয় দেয়নি। বলে, মায়ে-তাড়ানো বাপেখেদানো রাস্তার ছেলে! ব্যস। এই হচ্ছে আমার পরিচয়।
তবু কোথায় যেন দূরত্ব আছে। আছে অভিজাত্য। কুঞ্জ তাকে বশ করে কেনবার সংকল্প নিয়ে নিজেই বশ্যতা স্বীকার করে বসে আছে। কুঞ্জ তার মহিমায় বিবশ। কুঞ্জ দলের আর সকলের উপর রাজা, বরুণের কাছে প্ৰজা, তাই বরুণ থাকলে সে আর কিছু ভাবে না।
মহিষাদলে যাবার তোড়জোড় চলে, আর চলে জোর মহলা। কয়েকদিনের মধ্যে তৈরি করতে হবে।
হঠাৎ এই মোক্ষম সময়, যখন আর দিনতিনেক দেরি, চারুহাসিনী পড়ল জুরে। রীতিমতো জুর। যে চারুহাসিনীর ভূমিকা উন্মাদিনী নায়িকার।
কুঞ্জ নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকে গুঁড়ো করতে যায়। কুঞ্জ বুকে কিল মারতে যায়। এখন কী করবে। সে? নববালা? বাসমতী? ছি ছি!
হঠাৎ বরুণ বলে বসল, ভাবছেন কেন অত? আপনার লিলিকে নামিয়ে দিন না।
লিলি! কুঞ্জ দাস হকচাকিয়ে বলে, সে কী!
কেন, অবাক হবার কি আছে? বরুণ অবহেলাভরে বলে, রিহার্সাল শুনে শুনে তো ওর মুখস্ত। যখন তখনই তো আওড়ায়। গানও তোলে।
ইদানীং আর অনেকদিন কমবয়সী ছেলের পার্টের দরকার হয়নি। তাই লিলির কথাটা যেন ভুলেই গিয়েছিল প্রোপ্ৰাইটার। লিলি শুধু কোমরে বেল্ট বেঁধে সেই কোমরে হাত দিয়ে দলের ওপর সর্দারি করে বেড়ায়।
কুঞ্জ সে খোঁজ রাখে না, তাই কুঞ্জ অগ্রাহ্যের হাসি হেসে বলে, মুখস্ত হলেই তো হল না হে! মানবে কেন? ওটা হল একটা যুবতী মেয়ের পার্ট।
বরুণ অন্যদিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলে, আপনার লিলিকে তাতে বেমানান হবে না। ঘাগরা
কুঞ্জ তথাপি হাসে, আহা, গড়নটা একটু বাড়ন্ত, তা বলে কি বয়েসের ভাবটা আনতে পারবে?
বরুণ তাচ্ছিল্যাভরে বলে, পারে কি না, আসরে নামিয়ে দিয়ে দেখুন। বয়েস আর ছোটো নেই ওর।
বরুণের মুখে আরও আসছিল—বলে আর ওই নিমাই কোম্পানির দলে ছেড়ে দিয়ে আড়াল থেকে দেখুন।
কিন্তু বলে না। ভাবে, আমার কি দরকার! মেয়েটাকে সে ওই পাকামির জন্যেই দেখতে পারে না। তবে অস্বীকার করতে পারে না, মেয়েটার মুখস্থ করার ক্ষমতোটা।
ওরা যে যার পার্ট রিহার্সাল করে, লিলি শুনে শুনে সবাইয়ের পার্ট মুখস্থ করে ফেলে। ভাবভঙ্গি কিছুই বাদ যায় না। গানও তোলে। তবে কুঞ্জ সম্পর্কে সাবধান থাকে। কুঞ্জ বাড়ি থাকলে গলা তোলে না, পাছে বকে। বকবে, এই ধারণাটাই ছিল লিলির।
বরুণের কাছ থেকে লিলির নাম প্রস্তাবে কুঞ্জ খুব একটা আশান্বিত না হলেও, ঈষৎ কৌতূহলোক্রান্ত হয়েই ডেকে পাঠাল লিলিকে। তারপর বলল, তুই পার্ট মুখস্থ করিস?
লিলি ভয় পেল। বলল, না তো।
না? তবে যে বরুণ বলল! ওকি মিছে কথা বলবার ছেলে?
লিলি ক্রুদ্ধ গলায় বলে, না, মোটেই নয়! আমার নামে তোমার কাছে মিছে মিছে লাগিয়েই তো ও তোমার সুয়ো হয়েছে।
এই দেখো। নিন্দে কোথায়? সুখ্যাতি তো! বলছিল, লিলি ঠিক চারুর মতোন পার্ট বলতে পারে। লিলির গানের গলা আছে।
লিলি সন্দেহের সুরে বলে, তুমি বানাচ্ছি।
এই দেখো! আমার বানাবার দরকার কি? তবে ভাবলাম চারুর তো জুর, কে ওই পদ্মার পার্টটা করবে। বরুণ বলছিল তোর নাকি সব মুখস্থ!
লিলি এবার পুলকিত হয়। অতএব বলে ওঠে, শুনে শুনে মুখস্থ করেছি, বলব?
কুঞ্জ প্রসন্নমুখে বলে, বল।
লিলি মনশ্চক্ষে আসরের মাঝখানে নিজের শাড়িপরা মূর্তিটাকে দেখতে পায়। যে মূর্তি জ্বলন্ত ভাষায় বলছে, পাপা! পাপ! পাপের ভারে জর্জরিত পৃথিবী দুঃহাত তুলে আর্তনাদ করছে.শুনতে পােচ্ছ না তোমরা? ওই পাপ মায়ের বুক থেকে স্নেহ ছিনিয়ে নিচ্ছে, নারীর প্রাণ থেকে ভালোবাসা। আর পুরুষ জাতকে? শয়তানে পরিণত করেছে, নিষ্ঠুর নির্মম লোভী শয়তান! যে শয়তান ধর্ম মানে না, বিবেক মানে না, মানে না লজ্জা ভয়।…এই পাপের একটা পোশাকী নাম আছে, জানো তোমরা? জানোনা? হাঃ হাঃ হাঃ। সে নামটি হচ্ছে সোনা! বুঝলে?…যার পিপাসা রাবণের চিতার মতো শুধু জ্বলছে। নিবৃত্তি নেই।.এত সোনা দিয়ে কি করবে। গো? খাবে? বিছানা পেতে শোবে? হাঃ হাঃ হাঃ। মরণকালে কিসে করে নিয়ে যাবে? লোহার সিন্দুকে? …
পাগলিনীর সুর, পাগলিনীর ভঙ্গি। চোখে-মুখে কায়দা! কুঞ্জও পাগল হয়ে ওঠে। উদভ্ৰান্তের মতোন বলে, শাড়ি নিয়ে আয় একটা, মাটিতে আঁচল দুলিয়ে পর, চুলের দড়ি খুলে ফেল।
তোমার তেত্ৰিশ কোটির দিব্যিটা একদিনের জন্যে বাতিল করবে?
উত্তেজিত কুঞ্জ দাস ঘরের দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলে, এ শুধু হতভাগা কুঞ্জ দাসের মেডেল নয়, তোমার লিলির মেডেল! আসরে নেমেই বাজিমাৎ! ফাস্ট নাইটের মেডেল! বাড়ির কর্তা একটা দিল, আর মহারাজ গৰ্গ বাহাদুর একটা। কী হাততালির ঘটা! আসর ফেটে যায় একেবারে! হাজার হাজার দর্শক লাফিয়ে লাফিয়ে উঠেছিল। তখনি পাশের গায়ে আরও একটা বায়না হয়ে গেল।
ঘর থেকে সাড়া নেই। ঘর নিঃশব্দ! কুঞ্জ দাস গলা চড়ায় কথাগুলো কানে গেল না বুঝি? স্বভাবটি চিরকাল এক রইল। দেমাকীর রাজা! বলি মেডেলটা দেখা হবে? না কি তাতেও অগ্রাহ্যি?. তিন বছরের শিশুটাকে চোখ ছাড়া করে রেখে দিয়েছিলে, সে আজ মেডেল লুটে এনেছে, হাজার হাজার লোকের ধন্যি ধন্যি কুড়িয়েছে, এতেও নিয়ম ভেঙে একবার উঁকি দেওয়া যায় না?
এবার ঘরের মধ্যে থেকে স্বর আসে। শীতল কঠিন।
মেডেলটা লুটেছে তো আসরে নোচে কুঁদে?
হঠাৎ কুঞ্জ দাস যেন মাথায় একটা লাঠির ঘা খায়। লিলির ওই অভাবনীয় সাফল্যে কুঞ্জ যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, কুঞ্জ বুঝি নিজের নীতিও বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। কম বয়েসে বিয়ে দিয়ে যাত্রার দল ছাড়া করে ঘরগেরস্থ করে দেবে লিলিকে, এই সংকল্পটার কথা মনেও ছিল না। আর!
কুঞ্জ আজ কদিন ধরে স্বপ্ন দেখছিল, আলোকোজ্জ্বল আসরে লিলি! আসর ফাটাচ্ছে, হাততালি কুড়োচ্ছে, মেডেল লুঠছে…! বারবার, বহুবার। অজস্র জায়গায়। অজস্র আসরে।
কুঞ্জ স্বপ্ন দেখছে, কলকাতার যাত্রা প্রতিযোগিতায় ফাস্ট হয়েছে কুঞ্জর ভিবানী অপেরা পার্টি থিয়েটারের মালিকরা এসে চুপি চুপি ধরনা দিচ্ছে মেয়েটাকে ভাঙিয়ে নেবার জন্যে।…আর কুঞ্জ সগর্ব হাস্যে বলছে, আজ্ঞে না বাবুমশায়, ও আমার মেয়ে, নিজের মেয়ে। ওকে আমি—
আর কুঞ্জ স্বপ্ন দেখছে, চারুহাসিনীকে আর তোয়াজ করতে হচ্ছে না, বার বার রিহার্সাল দেওয়াতে হচ্ছে না।
কুঞ্জর ঘরের মধ্যে এমন দামি রত্ব ছিল, আর কুঞ্জ তার খবর রাখত না? কুঞ্জ নিজেকে সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ভাবছিল।…আর ভাবছিল, এই ভয়ঙ্কর আহ্লাদের ঢেউতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অন্তরালবর্তিনীর তুচ্ছ প্রতিজ্ঞা।
দুজনে পাশাপাশি বসে দেখবে লিলির মেডেল। সত্যিকারের মা বাপের মতো। কুঞ্জ যে ওর কেউ নয় বলতে গেলে শত্রুপক্ষ, তা তো কুঞ্জর মনে নেই। নিঃসন্তান কুঞ্জর অপত্য স্নেহাটা ওইখানে গিয়েই পড়েছে।
তবু কুঞ্জ যেন ঠিক ভোগ করতে পায় না। সন্তানকে সন্তানের মায়ের সঙ্গে না দেখলে কি সত্যকার আস্বাদ পাওয়া যায়? সেই আস্বাদ পেতে ছুটে এসেছিল কুঞ্জ! আগ্রহের মন নিয়ে। সেই মনে লাঠি খেল।
পাথরের দেওয়াল বলে উঠল, মেডেল তো আসবে নোচে কুঁদে?
কুঞ্জ ওই লাঠির ঘায়ে স্তব্ধ হয়ে গেল, তারপর কুঞ্জর নিজস্ব স্বভাব ফিরে এল। চড়া গলায় বলে উঠল, কুঞ্জ অধিকারী তোমার মেয়েকে বাইজীর নাচে নাচায়নি।
ভিতরের গলা সমান ঠাণ্ডা। মেয়ে আমার নয়, মেয়ে অধিকারীরাই। তবে গোড়া থেকে শুনেছি কি না। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে ঘরগেরস্থিী করে দেওয়া হবে-
কুঞ্জ সক্রোধে বলে, তা সেটা হবে না, কে বলল? নিরুপায়ে পড়ে একদিন নামিয়ে দিলাম, মেয়ের এমন ক্ষ্যামতা যে তাতেই ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল, মেডেল চলে এল, সেই কথাই আহ্বাদ করে বলতে এসেছিলাম। ওকে কি আমি দলে ভর্তি করে ফেলেছি?
আর করতে হবে না, ও নিজেই হবে।
নিজেই হবে!
হবে। বাহবার নেশা মদের নেশার বাড়া। উচ্ছন্ন দিতে সময় নেয় না।
কুঞ্জ উত্তর খুঁজে পায় না। তাই কুঞ্জ হঠাৎ একটা বেআন্দাজী চড়া কথা বলে বসে, কড়া আর চড়া বিদ্রাপের গলায়, তই নাকি? কিন্তু ওর মায়ের তো এত বাহবা। জোটেনি, তবু উচ্ছন্ন যেতেও আটকায়নি। বলে ফেলে কুঞ্জ নিজেই থতোমতো খেয়ে যায়। একথা বলার ইচ্ছে তো তার ছিল না।
কিন্তু কুঞ্জকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ ঘরের মধ্যে এটা হাসি শোনা যায়। সত্যিকার খোলা গলার হাসি। তার সঙ্গে কথা, কে বললে বাহবা জোটেনি? বাহবা না জুটলে উচ্ছন্নে যাবার পথটা পরিষ্কার হল কিসে?
বাহবা! হুঁ! বাহবাটা কিসের?
কেন, রূপের!
রূপের! রূপের! ঝনঝনিয়ে উঠল রক্তকোষগুলো। সে রূপ বহু— বহুকাল দেখেনি কুঞ্জ। যে রূপের প্রতিমাকে হারিয়ে পৃথিবী বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল তার কাছে, আর যে রূপ এই দীর্ঘকাল হতভাগা কুঞ্জ দাসকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সেই রূপের উল্লেখ! সহসা শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় চড়ে ওঠে কুঞ্জর।
কুঞ্জ সহসা চিৎকার করে বলে ওঠে, তা এতই যদি রূপের গরব, সেই রূপ ভাঙিয়ে খেলেই হত! এই গরিব হতভাগাকে বঁদের নাচাবার দরকারটা কি ছিল? কুঞ্জ এবার জিভ কামড়ায়, কুঞ্জ নিজের মুখের উপর নিজে থাবড়া মারে। কিন্তু হাতের ঢ়িল, আর মুখের কথা!
আশ্চর্য, আজই তো সবচেয়ে উৎফুল্ল মন নিয়ে এসেছিল কুঞ্জ। আশাভঙ্গ হল? তা না হয় তাই হয়েছে, তাই বলে কুঞ্জ এমন রূঢ় কথাট, বলবে? তার মানে, ওই মানুষটা ধরে নেবে, এই বিষ মনে পুষে রেখে সরলতার ভান করে নিয়মিত আসা যাওয়া করছে লোকটা, উদারতা দেখিয়ে টাকা দিচ্ছে। কুঞ্জ মরমে মরে যায়।
কিন্তু যাকে ওই বাক্যবাণটি বেঁধা হল, সে মরমে মরেছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেল না। সে দিব্য স্বচ্ছন্দে জবাব দিল, মরতে বসেছিলাম যে! এখন তো সে পথ বন্ধ!
ওঃ! ওঃ! কুঞ্জর আবার সর্বশরীরে আগুনের হালকা ছুঁয়ে যায়। সমস্ত স্থৈর্য হারায়। কুঞ্জর সত্যিই মনে হয়, এই দীর্ঘকাল ধরে সে যেন একটা বদ মেয়েমানুষের হাতের সুতোর তালে বাঁদর নাচ নাচছে। এখন সে হি হি করে বলছে—মরতে বসেছিলাম! উপায় ছিল না …তাই তোমার মতোন বোকা গাধাটার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। না হলে…ভাঙাতাম রূপ! বিধাতার দেওয়া ব্যাঙ্ক নোট!
এরপরও কুঞ্জ স্থৈর্য হারাবে না? কুঞ্জ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ওঃ তাই! তাই—পাখিজুখি খাই না। আমি ধৰ্ম্মে দিয়েছি মন! আর আমি শালা একটা লক্ষ্মীছাড়া বদ মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়ে— আবার ঢং কত! মেয়ে আমার আসরে নেচেছে, বাইজী হয়ে গেছে! ঠিক আছে, ও মেয়ে আর আমি রাখছি না। যার মেয়ে তার কাছে দিয়ে যাব, ব্যস! এই আমার সাফ কথা!
কুঞ্জ দালানের ধার থেকে ছাতাটা তুলে নেয়। ভিতর থেকে ঈষৎ ব্যস্ত গলা শোনা যায়, তা ঝগড়াটা তোলা থাক না এখন, হাতমুখ ধোওয়া হোক!
হাতমুখ ধোওয়া? কুঞ্জ ছিটকে ওঠে, আবার এখানে জলগ্ৰহণ করব আমি?…ভেবেছিলাম অনুতাপে নাকি সব পাপ ধুয়ে যায়। তবে কেন আর.যাক, ভালো শিক্ষাই হল। এই যাচ্ছি, কাল-পরশু এসে মেয়েকে ফেলে দিয়ে যাব, ব্যস!
কুঞ্জ ছাতাটা নিয়ে গঢ় গন্ট্র করে চলে যায়। বৃষ্টি পড়ছিল বির-ঝিরিয়ে, তবু ছাতটা হাতেই থাকে।
আজ আর স্টেশনে পড়ে থাকতে হবে না, এখনও ট্রেন আছে। কুঞ্জ তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠে বসে। আর অবাক হয়ে ভাবে, কী করতে এসেছিলাম। আমি, আর কী করে গেলাম!..আচ্ছা, কী কী বললাম। আমি।…মনে করতে পারল না, শুধু নিজের উপর অপরিসীম ধিক্কারে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রইল। অথচ একটানা অনেকদূর যাবার পথ নয়, দেহটাকে নিয়ে বহু টানা-হেঁচড়া করে তবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে। দল এখনও মহিষাদলে পড়ে। এই টানা-হেঁচড়া করেই এসেছিল, তখন গায়েও লাগেনি, এখন যেন আর দেহ চলছে না।–,
আশ্চর্য এতদিন ধরে কী করেছে কুঞ্জ? কুঞ্জ কি পাগল হয়ে গিয়েছিল? নাকি কুঞ্জকে কেউ মন্ত্র প্রয়োগ করে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল? নইলে কুঞ্জ তার কুলত্যাগিনী স্ত্রীর একটা তু ডাক পেয়ে ছুটে গিয়ে তার বিপদে বুক দিয়ে পড়তে গেল?
বিপদ কি, না তার সেই পাপের সঙ্গীর মৃত্যু! কুঞ্জ তো তখন তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হেসে আঙুল তুলে বলতে পারত, ঠিক হয়েছে! বোঝো—পাপের ফল! পারত, অথচ কুঞ্জ তা করল না।
কুঞ্জ সযত্নে তার সেই পরম শত্রুর শেষকৃত্য করল, কুঞ্জ তার কুলত্যাগিনী স্ত্রীকে মরতে বসা থেকে রক্ষে করল, আর তার একটা অবৈধ দায়িত্ব ঘাড়ে করল।
কুঞ্জ নিজেকে প্রশ্ন করে, কিসের লোভে এসব তুই করেছিলি হতভাগা? কিসের প্রত্যাশায়? কিছু না। তবে? নিশ্চয় ওই মেয়েমানুষটার গুণ-তুকের ফল। নইলে ওই তুচ্ছ একটা মেয়েমানুষকে এত ভয়ই বা কেন তার? তাই কিছুতেই সাহস সংগ্রহ করে একবার ঘরে ঢুকে পড়তে পারে না। বলতে পারে না, দেখি—সত্যিই তুমি সেই উমা কিনা!
আশ্চর্য, আজ পর্যন্ত ওর মুখ দেখল না কুঞ্জ, অথচ মাস মাস মাসোহারা ধরে দিয়ে যাচ্ছে! আর সেও দিব্যি অন্নান বদনে নিয়ে চলেছে। ভালো মেয়ে হলো নিতে লজ্জা হত না? সেই, সেই কথাই ভাবা উচিত ছিল কুঞ্জর। আর ঠাট্টা করা উচিত ছিল, মুখ দেখাতে লজ্জা তোমার, অথচ মুখে হাত তোলার খরচাটি নিতে তো লজ্জা নেই?
কিছু বলতে পারেনি কুঞ্জ। শুধু গাধার মতো গিয়েছে, আর টাকাটি দিয়ে চলে এসেছে। যেন তিনি নিলেই কৃতাৰ্থ! যত ভাবে ততই যেন নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে কুঞ্জর। চৈতন্য হবার যে এত যন্ত্রণা, তা জানত না কুঞ্জ।
কুঞ্জ ওই লিলিকে দিয়ে যাবে, ব্যস!
ভাবনার খেই ছেড়ে কুঞ্জকে গাড়ি বদল করতে হয়। এরপর আবার দুবার বাস বদল করতে হবে কুঞ্জকে।