জীবন আমার দুটো শহরে ভাগ হয়ে যায়। ময়মনসিংহে বাড়ি, আত্মীয় স্বজন, চাকরি। ঢাকায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, বন্ধুবান্ধব। ঢাকা আমাকে টানে খুব। হাতে টাকা হলেই বাসে নয়ত ট্রেনে চড়ি। ঢাকা যাওয়ার আরও একটি নতুন কারণ হল সুহৃদ। সুহৃদ এখন ঢাকায়। সুহদকে ঢাকা নিয়ে যাওয়া খুব সহজ ব্যপার ছিল না। ছোটদা এসে ওকে ধরে বেঁধে কাঁদিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন একবার, ঢাকার ইশকুলে ভর্তি করাবেন বলে। মাও বলেছিলেন, তিনি আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এরপর মা নিজেই ঢাকায় গিয়ে ছোটদা আর গীতার হাতে পায়ে ধরে ঘরের ছেলেকে ঘরে নিয়ে এলেন, অবশ্য হাতে পায়ে ধরার দরকার ছিল না, গীতা এমনিতেই ছেলেকে বিদেয় করতে পারলে বাঁচে। ওর আচরণ দেখে গীতা আকাশ থেকে পড়ে। এ ছেলে তার নিজের, এ ছেলেকে সে গর্ভে ধারণ করেছে দীর্ঘ নমাস, তার গর্ভ থেকেই গড়িয়ে নেমেছে ছেলে, নাড়ির বন্ধন যদি থাকে কারও সঙ্গে, তা তার সঙ্গেই আছে, কিন্তু সে ডাকলে ছেলে কাছে আসবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে তার কোলে, তা নয়ত দৌড়ে পালায়। চলে যায় ওর দাদুর কোলে নয়ত ফুপুদের কাছে। এত সাহস এই ছেলে পেল কোত্থেকে, গীতা বুঝে পায় না। রেগে গা আগুন করে বসে থাকে, গা থেকে ধোঁয়া বেরোয়। সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে গীতা চিৎকার করতে থাকে, ‘তোমার গুষ্ঠির মধ্যে পইড়া আমার ছেলে নষ্ট হইয়া গেছে। তাগর যদি এত ছেলে দরকার থাকে, তাইলে তারা বিয়াইয়া লউক একটা। গীতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ছোটদা বলতে থাকেন, গীতা ও গীতা, আমি তোমার ছেলেকে তোমার কাছে যেমনেই হোক আইন্যা দিতাছি।’ এরকম শপথে গীতার মন ভরে না, ছোটদা তার মন ভরানোর জন্য বলেন যে সব দোষ তাঁর, তাঁর দোষেই আজ গীতাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে, তাঁর উচিত ছিল না ছেলেকে জন্মের পর অবকাশে পাঠানো, তাঁর দোষেই আজ গীতার নিজের ছেলে আজ গীতার কাছ ঘেঁসতে চায় না। তাঁকে আরও বলতে হয় যে তাঁর মা আর তাঁর দু বোনের কারণে সুহৃদ নষ্ট হয়ে গেছে, ওকে মানুষ করতে হলে এখন গীতা ছাড়া গতি নেই। গীতা শোনে। চিৎকার আপাতত থামিয়ে সে ওঠে, ঢকঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে সে ছোটদাকে ঘর থেকে বের করে শব্দ করে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে টাকা পয়সা গয়নাগাটি আর শাড়িতে ঠাসা আলমারি খুলে ইস্ত্রি করা সুতির শাড়িগুলোর কিনার দিয়ে হাত ঢুকিয়ে সুহৃদের ছবির অ্যালবাম বের করে অবকাশে আমাাদের সঙ্গে তোলা ওর সব ছবি ছিঁড়ে টুকরো করে, আস্ত রাখে কেবল তার সঙ্গে সুহৃদের ছবিগুলো।
সুহৃদকে নিয়ে অবকাশে আমাদের আবেগ আর উচ্ছঅ!সের শেষ নেই। কদিন পর পরই ওর ছবি তোলা হয়, ইয়াসমিন তার এক বান্ধবীর ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছে, যার স্টুডিওর দোকান আছে, সেই ভাইয়ের ক্যামেরা এনে প্রচুর ছবি তুলে যেদিন নিয়ে এল ছবিগুলো, হুমড়ি খেয়ে একেকজন দেখতে থাকি, গীতা সেদিনই ছোটদাকে নিয়ে আসে ময়মনসিংহ, ছবিগুলো আমাদের মত অত উৎসাহ নিয়ে দেখে না, না দেখলেও উৎসাহ নিয়েই বলে, ছবিগুলো সব যেন তাকে দিয়ে দেওয়া হয়। কারণ আমরা তো সুহৃদকে জলজ্যান্ত পাচ্ছি, সে যেহেতু পাচ্ছে না, ছবি দেখেই তার সাধ মেটাতে হবে। এ কথাটি ঠিক সে বলেও না, আমরাই অনুমান করে নিই। অনুমান করে সুহৃদের যত ছবি যেখানে ছিল, সবই তাকে উদার হস্তে দান করা হয়। এই দানে মার আহা আহা-ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বড়। সেই বিকেলেই ইয়াসমিনের বান্ধবী কৃষ্টি এলে ইয়াসমিন যখন সুহৃদের ছবিগুলো গীতার কাছে চায় কৃষ্টিকে দেখাবে বলে, গীতা মুখের ওপর বলে দেয়, না, ছবি এখন দেওয়া যাবে না, কেন যাবে না? যাবে না। কারণ কি? অসুবিধা আছে। কি অসুবিধা? আছে। কাউকেই ছবি দেখতে দেয়নি। ব্যাগে করে সে ঢাকা নিয়ে এসেছিল। তারপর এই তার ছিঁড়ে ফেলা। নিগেটিভগুলোও কেটে টুকরো করে রান্নাঘরের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে রাখল। এতে তার মন আপাতত শান্ত হয়, কিন্তু হাতগুলো নিশপিশ করতে থাকে, হাতগুলোর ইচ্ছে করে নখের আঁচড়ে আমাকে, ইয়াসমিনকে আর মাকে রক্তাক্ত করতে। কী দোষ আমাদের! নিশ্চয়ই আমাদেরই দোষ, আমরা অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বানিয়ে নিয়েছে, এই দোষ আমাদের। আদরে আহলাদে মানুষ হওয়া সুহৃদ এমনিতেই কারও ডাকে পেছন ফেরে না, মা যে কত ডাকেন সুহৃদ যখন দৌড়ে ছাদে বা মাঠে চলে যেতে থাকে, ভয়ে যে কখন আবার কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়, সুহৃদ ফেরে না। বাতাসের আগে আগে ছোটে সে, যখন ছোটে। কিন্তু গীতার প্রশ্ন সে তার ছেলেকে ডাকলে ছেলে তো শুনতে বাধ্য, কিন্তু ছেলে কেন শোনে না তার ডাক? কেন দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায় না, বসতে বললে বসে না! সুহৃদের অবাধ্য আচরণ দেখে গীতা ভীষণ ক্ষুব্ধ, বিরক্ত। পৃথিবীর আর কেউ ডাকলে সুহৃদ না ফিরুক, কিন্তু গীতা যখন ডাকে, তখন তো ওর জানা উচিত কে ওকে ডাকছে! ও কি জানে না গীতা কে! গীতা বিষম রোষে দাপায়, সুহৃদকে হাতের কাছে পেয়ে হ্যাঁচকা টেনে কাছে এনে চোখ রাঙিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলেছে, ‘আমি যে তোমার মা হই, তা জানো? আমি যে তোমার সবচেয়ে বেশি আপন, তা জানো? আমি ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে আসো না কেন? কারণ কি? এরপর আমি একবার ডাক দিলেই সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে আইসা দাড়াইবা, মনে থাকবে?’ সুহৃদ হতবাক দাঁড়িয়ে মনে থাকবের মাথা নেড়ে দৌড়ে গিয়ে মার আঁচলের তলে নিজেকে লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওর কান্না দেখে বুক ফেটে যায় আমাদের। মা প্রতিদিনই ওকে বলেন, নিজের বাবা মাকে যেন ও ভালবাসে। তবে গীতাকে যখন মা রিমঝিম সুরে বলতে নিচ্ছিলেন, ‘আদর কইরা কইলেই তো ছেলে বুঝে..।’ গীতা বজ্রপাত ঘটায়, ‘আমার ছেলেরে আদর কইরা বলি কি মাইরা বলব, সেইটা আমি বুঝব।’ মা চুপ হয়ে যান। আমরাও চুপ হয়ে বসে থাকি। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মা বলেন, ‘ছেলে এইখানে থাকে বইলা আমাদের চেনে, আমাদের কাছে আসে, আমাদের প্রতি টান তার। তুমি যখন নিয়া যাইবা ওরে, তখন তোমার প্রতিও টান হইব। তখন তো তোমার কাছ থেইকা ও আমাদের কাছেই আসতে চাইব না।’ গীতা দুদিনের জন্য অবকাশে বেড়াতে এসে সুহৃদকে বশংবদ ভৃত্য বানানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকে। গীতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সুহৃদ ছটফট করে। এরপর ছোটদা আর গীতা যখনই সুহৃদকে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে, ও ভয়ে কেঁপে আমাদের আঁকড়ে ধরে কানে কানে বলেছে, ‘আমাকে কোথাও লুকাইয়া রাখো, আমাকে যেন না নিয়া যাইতে পারে।’ আমরা ওকে লুকিয়ে না রাখলে ও নিজেই লুকোনোর জায়গা খুঁজে খুঁজে টিনের ঘরের খাটের নিচে কাগজের বাক্সের মধ্যে নিজেকে সারাদিন লুকিয়ে রেখেছে। গীতা লক্ষ্য করে অবকাশের মানুষগুলোই সুহৃদের আপন এবং ঘনিষ্ঠ, সুহৃদ তাদেরই ভালবাসে, গীতার জন্য ওর কোনও ভালবাসা নেই। গীতা ওর কাছে মূর্তিমান রণচণ্ডী বিভীষিকা ছাড়া, ভয়ংকর ত্রাস ছাড়া কিছু নয়। সুহৃদকে টেনে হিঁচড়ে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে গত কয়েক যাত্রা গীতা বলে আসছে, ‘এই দুনিয়ার কেউ তোর আপন না, আমি ছাড়া।’ সুহৃদ ফ্যালফ্যাল করে গীতার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে পালাতে চায়, গীতা সাঁড়াশির মত ধরে রাখে ওর ঘাড়। কেঁদে ওঠে সুহৃদ, কান্না দেখে গীতার ইচ্ছে হয় বেয়াদব ছেলেটিকে খুন করতে।
সুহৃদকে নিয়ে কম টানা হেঁচড়া হয়নি। মাঠে ও ব্যাডমিন্টন খেলছিল, ছোটদা ঢাকা থেকে এসে কাউকে কিছু না বলে ওকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যান মাঠ থেকে। সুহৃদের আমাকে বাঁচাও আমাকে বাঁচাও আর্তনাদে সারা পাড়া কাঁপছিল। এরপর কদিন পর ছোটদা এসে ওকে অবকাশে ফেরত দিয়ে যান। ধড়ে প্রাণ ফিরে পায় ছেলে। আমরা ওকে নতুন কুঁড়ি ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দিই। ইশকুলে দিয়ে আসি, ইশকুল থেকে নিয়ে আসি। বাড়িতে মা ওকে এ বি সি ডি, ক খ গ ঘ শিখিয়ে, ছবি আঁকা শিখিয়ে, যুক্তাক্ষর শিখিয়ে, সুন্দর সুন্দর ছড়া শিখিয়ে ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র করে তুললেন। আমাদের আদর আর ভালবাসার দোলায় সুহৃদ দুলতে থাকে। এরপর ওকে যে করেই হোক ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যেদিন ছোটদা আবার আসেন, যে করেই হোক নিয়ে তিনি যাবেনই, জগত উল্টো গেলেও নেবেন, সেদিন ইয়াসমিন সুহৃদকে নিয়ে পালায়। ফিরে আসে সন্ধের আগে আগে। ছোটদা সারাদিন অপেক্ষা করে ঢাকা চলে গেছেন। সুহৃদকে নষ্ট বানানোর জন্য আমাদের একশ ভাগ দায়ি করে হুমকি দিয়ে গেছেন, ওকে যদি কালই ঢাকায় না পাঠানো হয়, তবে এ বাড়ির সঙ্গে তার আার কোনও সম্পর্ক থাকবে না।
অবকাশে বৈঠক বসে। বাবার সিদ্ধান্ত, সুহৃদকে তার বাপ মার কাছে এখন দিয়ে দেওয়াই উচিত, ঢাকায় ভাল ইশকুল আছে, ওখানে লেখাপড়া করার সুযোগ ভাল পাবে। এই সিদ্ধান্তটি আমাদের বুক ছিঁড়ে টুকরো করে দেয়, কিন্তু সুহৃদের আলোকিত আগামীর কথা ভেবে টুকরোগুলো শিথিল আঙুলে জড়ো করি। ছোটদা আর গীতার পক্ষে ওকে ঢাকায় নেওয়া সম্ভব নয়, হাত পা মুখ সব চেপে গাড়িতে বসালেও সে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে ঝাঁপ দিতে চায় রাস্তায়। সুতরাং সিদ্ধান্ত হয় সুহৃদকে আমি আর ইয়াসমিন ঢাকায় দিয়ে আসবো। ওর বাবা মার কাছে ওকে সমর্পণ করতে যাচ্ছি, এ কথা শুনলে ও যেহেতু কিছুতেই যেতে চাইবে না, ঢাকায় মেলা দেখতে যাবো, আজই ফিরে আসবো বিকেলে, এই মিথ্যে কথাটি বলে ওকে নিয়ে আমি আর ইয়াসমিন ভোরের ট্রেনে চড়ি। ঢাকায় কমলাপুর ইস্টিশনে নেমে একটি রিক্সা নিই। সুহৃদ চারদিকে তাকিয়ে মেলা খুঁজছে। রিক্সা যখন নয়াপল্টনের রাস্তায় এল, ও চিনে ফেলল রাস্তাা। হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার শুরু করল, আমরা মেলায় যাবো বলেছি, কিন্তু মেলায় না গিয়ে কেন এ রাস্তায় এসেছি! যত বলি যে ছোটদার সঙ্গে একবার দেখা করেই মেলায় যাবো, তত ও গলা ছেড়ে কাঁদে, ও যাবেই না ছোটদার বাড়িতে। নয়াপল্টনে থেমে সুহৃদকে আইসক্রিম খাইয়ে, গলিতে হেঁটে হেঁটে অনেকটা সময় নিয়ে মিথ্যে গল্প শোনাতে হল যে আমাদের হাতে টাকা নেই মেলায় যাওয়ার, ছোটদার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তবে মেলায় যেতে হবে, ময়মনসিংহে ফিরতে হবে। আমাদের আদরে পোষা ছেলে আমাদের কথা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করে ছোটদার বাড়িতে ঢোকে। বাড়িতে ছোটদা ছিলেন না, গীতা ছিল। গীতাকে দেখে সুহৃদ সেঁটে রইল আমাদের গায়ে, সুহৃদের সেঁটে থাকা গীতার সয় না, গীতা ওর মা হওয়ার পরও তার দিকে ও এক পা বাড়াচ্ছে না, এত বড় দুঃসাহস ওর হয় কী করে! সুহৃদকে শক্ত হাতে টেনে নিয়ে গীতা ঘাড় ধাককা দিয়ে মেঝেয় ফেলে দিলে আমরা দৌড়ে গিয়ে ওকে যেই তুলেছি, কেড়ে নিয়ে ওর গালে এক চড় কষিয়ে দিল। ব্যাকুল হয়ে ও আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে গেল, গীতা ওর সার্টের কলার খামচে ধরে পেছনে টেনে নিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, ‘ওইদিকে যাস ক্যা? এইদিকে আয়। আমার অর্ডার ছাড়া এহন থেইকা কিছু করলে খুন কইরা ফালাইয়াম।’
সুহৃদ থরথর করে কাঁপছে ভয়ে। আজ পর্যন্ত অবকাশে কেউ ওকে টোকা পর্যন্ত দেয়নি। চড় কাকে বলে সে জানতো না। ধাককা কাকে বলে জানতো না। এ ধরনের রুক্ষ ভাষা ওর প্রতি কাউকে ব্যবহার করতে কোনওদিন সে শোনেনি।
ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করলে গালে আবারও চড়। পিঠে কিল।
‘মুখ থেইকা একটাও যেন শব্দ বাইর না হয়।’ গীতার অর্ডার।
শব্দহীন আর্তনাদে সুহৃদের শরীর ফুলে ফুলে উঠছিল।
আমরা আড়ালে গিয়ে কাঁদছি। বলতে পারছি না কিছু। ক্ষীণ কণ্ঠে মুদু প্রতিবাদ করলেও গীতা তার শোধ নিচ্ছে সুহৃদকে মেরে। সুহৃদ এখন গীতার গণ্ডির ভেতর, গীতার যা ইচ্ছে, সে তাই করবে। সে যদি চায় তার ছেলেকে কুচি কুচি করে কাটতে, সে কাটবে। যে ছেলে রাজপুত্রের মত ছিল অবকাশে, যার যত্নে মা বাবা ইয়াসমিন আমি ব্যস্ত ছিলাম সারাক্ষণ, যাকে আদর আর ভালবাসার জলে ডুবিয়ে রেখেছি, যাকে মুখে তুলে দিনে আমরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় মুরগির সুপ, ফলের রস, খাঁটি গরুর দুধ, দুধের শর, মাছের কোপ্তা, গাজরের হালুয়া, ডিমের পুডিং ইত্যাদি পুষ্টিকর আর সুস্বাদু খাবার খাইয়েছি, সেই ছেলেকে সারাদিন খেতে দেয়নি গীতা।
আমাদের আর সহ্য হয়নি দৃশ্য দেখতে। আমরা সারা পথ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ময়মনসিংহে ফিরেছি। পথে একটি প্রশ্নই আমার মনে জেগেছে, গীতা কি সত্যি সত্যিই চেয়েছিল সুহৃদ ফিরে যাক ঢাকায়! আমার মনে হতে থাকে গীতা চায়নি সুহৃদ যাক। ও দূরে থাকলেই গীতা সুখে ছিল। ছোটদাকে অপরাধবোধে ভুগিয়ে কেঁচো করে রাখার জন্য গীতার কাছে সুহৃদ ছিল একটি চমৎকার অস্ত্র।
গীতার দুর্ব্যবহারের পরও আমরা নয়াপল্টনে যাই সুহৃদকে দেখতে। সুহৃদ জীবন ফিরে পায় আমাদের দেখলে। কিন্তু আমাদের কাছে আসতে গেলেই গীতা ওকে ডেকে নিয়ে যায় অন্য ঘরে। ওকে অনুমতি দেওয়া হয় না আমাদের কারও কাছে আসার, আমাদের সঙ্গে বসে দুএকটি কথা বলার। ওকে বন্দি করে রাখা হয় অন্য ঘরটিতে, সেই ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে ও দেখে আমাদের। গীতার অনুমতি নিয়ে ও যদি জল খেতে ওঠে বা পেচ্ছ!বখানায় যায়, তখন পলকের জন্য চোখাচোখি হয়, ওই চোখাচোখিতেই আমরা ভালবাসা বিনিময় করি। সুহৃদ ওঠে ওই পলকের দেখাটুকুর জন্যই। গীতার আচরণের প্রতিবাদ করব এমন সাহস আমাদেরও নেই। আমরাও মুখ বুজে থাকি বাঘে দৌড়োনো লুকোনো হরিণের মত।
গীতাকে নানা উপহারের উষ্ণতা দিয়ে গলিয়ে ওকে যদি সামান্য ক্ষণের জন্য দেখার অনুমতি পাই, আমাদের সামনে এসে ওর চোখ চিকচিক করে ওঠে খুশিতে। যে সুহৃদ প্রাণ খুলে হাসত, কাঁদত, যেমন ইচ্ছে তেমন চলতো, দৌড়োতো, কলকল করে কথা বলত —- সেই সুহৃদ এখন হাসতে পারে না, কাঁদতে পারে না, কথা মিনমিন করে বলে, প্রায় শব্দহীন স্বর, শঙ্কিত পদক্ষেপ, নিস্প্রভ, নিরুত্তেজ। একটি কথাই ও দ্রুত বলতে আসে, থাকো, যাইও না। হাতে যদি ট্রেনের টিকিট দেখে চলে যাবার, মুহূর্তে ওর চোখ জলে উপচে পড়ে, টিকিট কেড়ে নিতে চায়। ও বাড়িতে থাকব, ওর সঙ্গে দেখা হবে না, ও ঘরবন্দি থাকবে, তারপরও ওর স্বস্তি হয় যে আছি, বাড়ির কোনও না কোনও ঘরে আছি। সুহৃদের সারা মুখে ভয়, চোখদুটিতে ভয়। গীতার ভয়ে সে পাথর হয়ে থাকে। যে ছেলেটি বেলায় বেলায় খেতো, খেতে না চাইলেও গল্প বলে বলে নানা কৌশলে যাকে খাওয়ানো হত, সেই ছেলে ক্ষিধেয় মরে গেলেও কিছু খেতে পাওয়ার অনুমতি পায় না। টেবিলের ওপর খাবার পড়ে থাকলে আর যারই ছোঁবার অধিকার থাক, সুহৃদের নেই। রেফ্রিজারেটরেও হাত দেবার কোনও অধিকার ওর নেই। গীতা যখন ওকে খেতে দেবে, তখনই ও খেতে পাবে। সেই খাওয়া অতি অখাদ্য খাওয়া। পচা পুরোনো বাসি খাবার। নাদুস নুদুস ছেলে শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গেছে। ছোটদা থাকলে বাড়ির সবাইকে ডেকে নিয়ে খেতে বসেন টেবিলে। তাঁকে দেখিয়ে সুহৃদের পাতে গীতাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও মাংসের টুকরো দিতে হয়। বাইরের লোকের সামনেও গীতা দেখাতে চায় নিজের ছেলেকে সে ভালবাসে, কিন্তু কারও বুঝতে খুব বেশি দেরি হয় না তার সুচতুর চরিত্র। গীতা তার স্বার্থের জন্য নিজের হিংস্র রূপটি যথাসম্ভব ঢেকে রেখে আহ্লাদি গলায় কথা বলে যে কোনও কাউকে গলিয়ে মজিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিতে পারে, এমনই সে পাকা। কিন্তু শেষ অবদি কারও সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব টেকে না দীর্ঘ দিন। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে গীতা হাওয়া।
তারপরও আমরা যাই নয়াপল্টনে। না গিয়ে পারি না। সুহৃদকে একবার চোখের দেখা দেখতে যাই। মা সুহৃদের জন্য ডজন ডজন মুরগি নিয়ে, নানারকম ফলমূল নিয়ে যান ঢাকায়। মার হাত থেকে জিনিসপত্র নিয়ে গীতা গোপনে রেখে দেয়। সুহৃদকে জানতেও দেয় না মা তার জন্য অনেক খাবার এনেছেন। আমি আগে যেমন মাইনে পেলেই সুহৃদকে নিয়ে যেতাম দোকানে, সুহৃদ যত খেলনাই পছন্দ করত, কিনে দিতাম। এখনও হাতে টাকা এলেই সুহৃদের জন্য জামা কাপড় আর তার পছন্দের খেলনা কিনে ঢাকা নিয়ে যাই, গীতা আমার হাত থেকে সব নিয়ে আলমারিতে রেখে দেয়। সুহৃদকে জানানো হয় না, কিছু দেওয়াও হয় না। সব দেওয়া হয় পরমাকে। পরমাকে পরম আদরে মানুষ করছে গীতা। সুহৃদ অবকাশে যে আদর পেত, সেই আদর গীতা পরমাকে দিচ্ছে। পরমা তার বড় ভাইকে গাল দেবার ঘুসি দেবার লাথি দেবার সব রকম অধিকার রাখে, সুহৃদকে পিঠ পেতে কান পেতে সব বরণ করতে হয়। এক বাড়িতে দুই সহোদর ভাই বোন দু রকম ভাবে মানুষ হচ্ছে। যে সুহৃদ নিজে কখনও গোসল করেনি, মা তাকে কুসুম গরম জলে সাবান মেখে তাকে গোসল করিয়ে ঘরে এনে সারা গায়ে জলপাই তেল মেখে চুল আঁচড়ে দিতেন সিঁথি করে, সেই সুহৃদকে এখন একা গোসল করতে হয়, নিজে সে সাবান মাখতে পারে না, শ্যাম্পু করতে পারে না, গায়ে কোনওরকম জল ঢেলে চলে আসে। ২৫ পরমাকে নিজে হাতে গীতা গোসল করিয়ে আনে। পরমার জন্য ভাল জামা কাপড়, ভাল জুতো, ভাল খেলনা। সুহৃদর জন্য যা কিছু সব পুরোনো, সব মলিন। সুহৃদের জন্য একটি শক্ত তোশকের ছোট বিছানা। পরমার জন্য নরম গদির পালংক। পরমার গালে চুমু, সুহৃদের গালে চড়। পরমার গায়ে বেবী লোশন মেখে চুল আঁচড়ে দিতে দিতে গীতা বলছে, কি গো রাজকন্যা, তোমাকে একটু আঙুর দেই।
না।
প্লিজ একটু খাও।
না।
তুমি আমার মা, মা গো, একটু খাও।
পরমা মাথা নাড়ে, সে খেতে রাজি।
পরমা রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, গীতা হাঁক দিল, এই সুহৃদ, পরমারে আঙুর আইন্যা দে।
সুহৃদ দৌড়ে তার মার আদেশ পালন করে।
সুহৃদ আবদার করে, আমিও একটু আঙুর খাই?
গীতা ধমকে ওঠে, না।
পরমা জুতো পরবে। গীতা হাঁক দেয়, সুহৃদ জুতা নিয়া আয়।
সুহৃদ জুতো নিয়ে এল। কিন্তু একটি ধুম শব্দের কিল উপহার পেল।
জুতা মুইছ্যা নিয়া আয়।
ধুলো মুছে নিয়ে এল সুহৃদ।
যা, পরমার পায়ে পরাইয়া দে জুতা।
সুহৃদ জুতো পরাতে পরাতে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলে, ‘আমি কি ওর চাকর?’ গীতা ছুটে এসে নিজের পায়ের জুতো খুলে সেই জুতো দিয়ে সুহৃদের পিঠে সজোরে আঘাত করতে করতে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘হ তুই ওর চাকর। অন্যদিন তো পরাস জুতা, আইজকা মুখ দিয়া কথা বাইর হয় কেন? আইজকা তর সাহস বাড়ল কেমনে? কারে দেইখা সাহস বাড়ছে? মনে করছস কেউ তরে বাঁচাইতে পারবো আমার হাত থেইকা?’
আমার চোখের সামনে ঘটে এগুলো। আমার আর সয় না। বেরিয়ে যাই ঘর থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা কাঁদি। আমরা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। কোনও মা কি পারে এরকম ব্যবহার করতে নিজের সন্তানের সঙ্গে? সৎ মায়ের নির্মমতার অনেক গল্প শুনেছি। সব গল্পই হার মানে গীতার কাছে। মা বলেন, ‘গু ফালায় নাই মুত ফালায় নাই, হাঁটা শিখায় নাই, কথা শিখায় নাই, ছয় বছর পরে একটা তৈরি ছেলে পাইছে, ছেলের জন্য কোনও টান নাই।’ তাই বা কেন হবে, ভাবি। হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে পঁচিশ বছর পর ফিরে পেলেও তো মায়ের আদর মরে যায় না।
বাবাও যান সুহৃদকে দেখতে। বাবার কাছেও গীতা সুহৃদকে ভিড়তে দিতে চায় না। সুহৃদের প্রাণ ফেটে যায় কাছে বাবার কাছে যাবার জন্য। ধমকে কান মলে পিঠে কিল বসিয়ে সুহৃদকে স্থির করে রাখা হয় যেখানে গীতা চায় সে স্থির হোক। বাবা ফিরে আসেন অবকাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে। বলেন, ‘গীতা কি ভুইলা গেছে যে সুহৃদ তার পেটের ছেলে!’
সুহৃদের দুঃসহ অবস্থা দেখে প্রতিবারই আমরা এক বুক দুঃখ আর হতাশা নিয়ে ফিরি। এমনও হয় যে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দরজায়, গীতা দরজা খুলছে না। মা নিজে বাসে চড়ে গরমে ভুগতে ভুগতে ধুলোয় ধোঁয়ায় কালো হতে হতে বাসের গুঁতো ধাককা খেতে খেতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় গিয়ে ছোটদার বাড়ির বারান্দায় তিন চার ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এসেছেন। গীতা ঘরে ছিল, তবুও দরজা খোলেনি। সুহৃদ একদিন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মাকে দেখে গীতাকে ডেকেছে দরজা খোলার জন্য। গীতা ওঠেনি। নিজে সে চেয়ার টেনে এনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলেছে নিজে। এটুকু সাহস করার জন্য সুহৃদের ওপর তাণ্ডব চলে কয়েকদিন। আমিও অনেকদিন বারান্দায় অপেক্ষা করে ফিরে এসেছি। যদি দরজা খোলে তবে বসতে বলে না, যদি নিজে বসিও, তবে খেতে ডাকে না, বাইরে থেকে খেয়ে আসি। শোবার জন্য বিছানা দেয় না। বৈঠক ঘরের সোফায় রাত কাটাই। এরকম যাওয়া কেবল সুহৃদের জন্য। অনেকবার ভেবেছি যাবো না, কিন্তু গেলে সুহৃদের যে ভাল লাগে, সুহৃদ যে জেনে সুখ পায় যে আমরা তাকে দেখতে গিয়েছি, সে কারণে যাই। সুহদকে আমার উপস্থিতির সুখ দেওয়ার জন্য গীতাকে নানা উপঢৌকনে ঢেকে যেন তাকে খুব ভালবাসি, তাকে (ছেলেমেয়েসহ) রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাই, থিয়েটারে নিয়ে যাই, উৎসবে মেলায়, দোকান পাটে, যেখানে গেলে তার ভাল লাগবে যাই, যেন তার মত এত হৃদয়বতী জগতে নেই বলেই তাকে এমন খাতির করছি। আসলে যে সবই সুহৃদের জন্য করি সে কথা গীতাকে বলি না। সুহৃদ যেন আমার সান্নিধ্য পায়, আমার সঙ্গ সুহৃদকে তার শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে খানিকটা প্রাণবায়ু দেয় সে কারণে যে করি, বলি না। গীতা বোঝে ঠিকই, আমিও বুঝি সে বোঝে। কিন্তু গীতা যা বোঝে, তা সে মনে মনেই রাখে, সুহৃদকে বুঝতে দিতে চায় না। অনেক দিন এমন হয়েছে যে টাকা ভর্তি ব্যাগটি সোফায় রেখে পেচ্ছ!বখানায় গেলাম, ফিরে এসে দেখি ব্যাগ পড়ে আছে, ভেতরে একটি টাকাও নেই। সোনার কানের দুল খুলে স্নান করতে গেলাম, ফিরে দেখি দুল নেই। গীতা যদি এসব নিয়ে নিজে খুশি থাকে, তবু সে খুশি হোক। তার মন খুশি থাকলে হয়ত সুহৃদকে কী করে কষ্ট দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা আঁটা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। আমি হারানো জিনিসের জন্য কেবল মনে মনেই দুঃখ করি, অভিযোগ করি না। খাতির পরমাকেও করতে হয়, পরমাকে কোলে তুলে তার অসুন্দর মুখটিকেও আহা কী সুন্দর বলতে হয়, পরমাকে জিনিসপত্র দিলে গীতা খুশি হয় বলে দিতে হয়। গীতা খুশি হলে বসতে বলবে, গীতা বসতে বললে সুহৃদের সঙ্গে আমার দেখা হবে, দেখা না হলেও চোখাচোখি হবে, হয়ত সুহৃদ ফাঁক পেয়ে আমাকে একটু ছুঁয়ে যেতেও পারবে। এই স্পর্শটুকু সুহৃদের জন্য ভীষণ প্রয়োজন। গীতার মা ভাই বোন প্রায়ই যায় ছোটদার বাড়িতে। তাদেরও দেখেছি পরমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে আর সুহৃদকে গালাগাল করতে। গীতাকে খুশি করা গীতার আত্মীয়দের অর্থনৈতিক দায়িত্ব। একবার সুহৃদ পড়ে গিয়ে হাত ভাঙল, গীতা কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না, আমিই সুহৃদকে নিয়ে যাই। ডাক্তার এক্সরে করে দেখলেন হাড় ভেঙেছে। হাত প্লাস্টার করে ব্যাণ্ডেজ করে গলায় ঝুলিয়ে দিলেন নব্বই ডিগ্রি কোণে, হাড় জোড়া লাগতে এক মাস লাগবে বলে দিলেন। সুহৃদ ডাক্তারখানা থেকে বাড়ি ফিরতেই গীতা টেনে সব প্লাস্টার আর ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলেছে। বলেছে, ‘হাতে কিছু হয় নাই। সব ওর শয়তানি।’
গীতার সব দুর্ব্যবহার সহ্য করি আর মনে মনে বলি আমাদের ওপর করুক তার যা ইচ্ছে তাই, তবু সুহৃদের ওপর যেন কোনও অত্যাচার না করে। সুহৃদ বোঝে সব। সুহৃদও গীতার নির্মমতা নিষ্ঠূরতা সহ্য করে, যেন আমাদের সঙ্গে কোনও দুর্ব্যবহার না করে গীতা। ছ বছর বয়স মাত্র সুহৃদের। সুহৃদ তার সমস্ত আবেগ সমস্ত স্বাভাবিক প্রকাশ সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে রেখে কৌশলী হয়ে ওঠে। সে প্রাণপণে তার মাকে খুশি করতে চায়, যেসব কথা বললে তার মা খুশি হবে, সেসব কথা বলে। নিজের মার কিঞ্চিৎ পরিমাণ সহানুভূতি পাবার জন্য এই টুকুন বাচ্চাকে অভিনয় করতে হয়।
বিমানের চাকরিতে বিদেশ ঘুরে ছোটদা সপ্তাহ দু সপ্তাহ পর ফেরেন। ছোটদা ফিরতেই গীতার নালিশ শুরু হয় সুহৃদের বিরুদ্ধে। সুহৃদ খারাপ, সুহৃদ বাজে, ইশকুল থেকে অভিযোগ করেছে, সুহৃদ কথা শোনে না, পরমাকে মেরেছে ইত্যাদি আরও নানা কিছু বানিয়ে বানিয়ে। গীতার সুখ হয় যখন ছোটদা সুহৃদকে ধমকান। ছোটদার কোলে গীতা পরমাকে বসিয়ে দেন, যেন তিনি আদর করেন পরমাকে। পরমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ গীতা। পরমা পড়ায় ভাল, ছড়ায় ভাল, চড়ায় ভাল, নড়ায় ভাল, মন ভরায় ভাল। পরমার এটা লাগবে, ওটা লাগবে। কেবল পরমাকে নিয়েই গীতার সব গল্প। ছোটদা লক্ষ্য করেন সুহৃদের ওপর অনাচার হচ্ছে। লক্ষ্য করেন ঠিকই, কিন্তু গীতার সমালোচনা করার কোনও সাহস তাঁর নেই। তিনি টাকা পয়সা যা কামান তার সবটাই গীতার হাতে তুলে দেন, গীতার প্রতিটি আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই তাঁর কাজ। গীতার ত্রাসের রাজত্যে সুহৃদ তো ভয়ে পাথর হয়ে থাকে, ছোটদাও তটস্থ। গীতা তার বিমান আপিসের ছোটখাটো রিসেপশনিস্টের চাকরিটি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। সম্পূর্ণই সে গৃহবধূ। কিন্তু গৃহবধূর জীবন সে যাপন করে না। জাঁকালো একটি জীবন তার, নিজে গাড়ি চালাচ্ছে, যেখানে খুশি সেখানে যাচ্ছে, টেনিস খেলতে যাচ্ছে, সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে যাচ্ছে। কোনও স্বনির্ভর সম্পন্ন মেয়ে যে স্বাধীনতার স্বপ্নও দেখতে পারে না, গীতা গৃহবধূ হয়েও তা অবাধে ভোগ করে। গীতার নির্ভয়তা, নিঃশঙ্কতা আমাকে বিমুগ্ধ করে, একই সঙ্গে তার অনুদারতা, তার ক্রূরতা, খলতা আমাকে বিচলিত করে।
মা বলেন, ‘সুহৃদের ব্রেইন না আবার খারাপ হইয়া যায়। ছেলেডা স্বাভাবিক ভাবে মানুষ হওয়ার সুযোগ পাইতাছে না।’ মা এও ভাবেন ধীরে ধীরে কাছে থাকতে থাকতেই গীতার হয়ত ওর জন্য ভালবাসা জন্মাবে। আমরাও ভেবেছিলাম, কিন্তু সুহৃদের জন্য তার কোনও ভালবাসা জন্মায় না। সুহৃদের ওপর তার অত্যাচারের কারণ একটিই, সেটি হল ও তাকে ভালবাসে না, ভালবাসে আমাদের। আমাদের কাছ থেকে ওকে দূরে সরিয়েও সে আমাদের জন্য ওর ভালবাসা এতটুকু ম্লান করতে পারেনি, এ কারণেই তার আরও জেদ। তার হিংসে, তার জেদ, তার ক্ষুদ্রতা তার সমস্ত বোধবুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়।
আমরা, এমনও হয়েছে, মাস চলে গেছে যাইনি সুহৃদকে দেখতে, এর একটিই কারণ যেন গীতা আর সুহৃদের সম্পর্ক যেন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সুহৃদকে যেন আর সব শিশুর মত বেড়ে উঠতে দেয় সে। ঈদের সময় ছোটদা যখন বউ বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে আসেন অবকাশে, সুহৃদ ফিরে পায় তার জগত। আগের মত উচ্ছঅল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। খেলে, দৌড়োয়, কথা বলে, হাসে, কাঁদে। আমরা কাছে আছি বলে করে ও, ঠিক আগের মত করে। কিন্তু গীতার সামনে দাঁড়ালে আবার ও পাথর। প্রতি ঈদেই একটি ঘটনা ঘটে, ও কিছুতেই ফিরে যেতে চায় না ঢাকায়। যাওয়ার সময় হলেই ও লুকিয়ে থাকে, ভয়ে কাঁপে। ওকে জোর করে টেনে ধরে মেরে গাড়িতে ওঠাতে হয়। প্রতিবার যাওয়ার সময় ওর আর্তনাদে অবকাশ কাঁপে। সারা পাড়া কাঁপে।
গীতা কোনওদিনই পারে না সুহৃদকে ভালবাসতে। সুহৃদ কোনওদিনই পারে না তার মাকে ভালবাসতে।
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন সুহৃদহীন অবকাশে কোনও প্রাণ থাকে না। প্রেতপুরীর মত লাগে একসময়ের কলরোলে কলতানে মুখর অবকাশটিকে। দীর্ঘ দীর্ঘ দিন দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনি অবকাশের।