০৩. জহির বসে আছে

আমার সামনে জহির বসে আছে। তার গায়ে হালকা কমলা রঙের গেঞ্জি। কী সুন্দর তাকে মানিয়েছে। গেঞ্জির কমলা রঙের আভা তার গালে পড়েছে, খানিকটা পড়েছে তার চোখে— গাল এবং চোখে কমলা রঙ চকচক করছে। আমি বললাম, জহির তোকে সুন্দর লাগছে রে! প্যাকেজ নাটকের নায়কের মতো লাগছে। পার্কে গানের দৃশ্যের শুটিং করার জন্যে নায়ক প্ৰস্তুত। নায়িকা এখনো আসে নি। নায়িকার জন্যে অপেক্ষা।

জহির হাসল। মিচিকা ধরনের হাসি।

আমি বললাম, তুই হাসছিস কেন? মিচিকা টাইপ হাসি?

জহির বলল, পরীক্ষার হলে যাবার কথা বলে এখানে চলে এসেছি। এটা ভেবে কেন জানি মজা লাগছে।

পরীক্ষা দিচ্ছিস না?

না।

পরীক্ষা যে দিচ্ছিস না খালা-খালু কি জানেন?

এতক্ষণে সম্ভবত জেনে গেছেন। আমি এক ওষুধের দোকান থেকে টেলিফোন করে মা-কে বলেছি।

খালা কী বললেন?

কিছু বললেন না। প্রথমে কোঁ করে একটা শব্দ হলো –তারপর ধপাস শব্দ শুনলাম। মনে হয় মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছেন। মা খুব সহজে অজ্ঞান হতে পারেন। একবার কী হয়েছে শোন, খাটের উপর বাবার প্যান্টের কালো বেল্ট পড়েছিল। মা সেই বেল্ট দেখে সাপ সাপ বলে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

এবার অজ্ঞান হয়েছে তোর পরীক্ষার হলে না যাওয়ায়?

মনে হয় হয়েছে। আমি ধপাস শব্দ শুনলাম, আমি যতই হ্যালো হ্যালো করি ওপাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না।

তুই মনে হয়। মজা পাচ্ছিস?

পাচ্ছি। ভাইজান শোন, তোমার কাছে আমি খুব জরুরি একটা কাজে এসেছি।

বল শুনি।

একটু পরে বলি? প্রথমে শোন ফুলফুলিয়ার সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হলো সেই গল্প।

না প্রয়োজন নেই। তবু গল্পটা বলি? খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প। আমি লেখক হলে একটা গল্প লিখে ফেলতাম। হয়েছে কী ভাইজান— বিকাতলা স্টাফ কোয়াটারে আমার এক বন্ধু থাকে। দুপুরবেলা ওর কাছে গিয়েছি। একটা বই নিতে। ও বাসায় ছিল না। চৈত্র মাস, দুপুরে ঝাঝা রোদ। রিকশা পাচ্ছি না। রিকশার খোঁজ করছি–হঠাৎ দেখি একটা মেয়ে দুহাতে দুটা আইসক্রিম নিয়ে আসছে। দামি কোনো আইসক্রিম না। সস্তার জিনিস— ললিপপ। এমন কোনো অদ্ভুত দৃশ্য না যে আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু ঐ দিন আমি হা করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি দাঁড়িয়ে আছি সে এগিয়ে আসছে। আমাকে ক্রস করে চলে গেল— তারপরেও আমি তাকিয়ে রইলাম। তারপর হঠাৎ দেখি মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেছে। আমার দিকে ফিরে আসছে। সে এসে আমার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আইসক্রিম খাবেন? নিন। আইসক্রিম খান।

ভাইজান আমি কোনো কথা না বলে আইসক্রিম নিলাম। পাথরের মূর্তির মতো আইসক্রিম হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা বলল, খান আইসক্রিম খান। আমি সঙ্গে সঙ্গে আইসক্রিমে কামড় দিলাম। যেন জীবনে এই প্ৰথম আইসক্রিম খাচ্ছি। ভাইজান গল্পটা কেমন?

ভালো। মেয়েটা দুটা আইসক্রিম নিয়ে যাচ্ছিল কেন?

সে আর তার বাবা তাদের বাসার দিকে যাচ্ছিল। তারা বাবা আইসক্রিম খেতে চাইল বলেই দুটা আইসক্রিম কেনা হলো। তখন বাবা হঠাৎ কী কারণে মেয়ের ওপর রেগে উল্টো দিকে চলে গেল। মেয়েটা দুটা আইসক্রিম নিয়ে বাসায় ফিরছে। মনে মনে ঠিক করেছে। পথে টোকাই শ্রেণীর কাউকে দেখলে একটা আইসক্রিম দিয়ে দেবে। আমাকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আইসক্রিমটা আমাকে দিয়ে দিল।

তুই কি করলি? আইসক্রিম খেতে খেতে ফুলফুলিয়ার বাসা পর্যন্ত গেলি?

হ্যাঁ ভাইজান। সে আমাকে যেতে বলে নি। হ্যামিলনের বংশীবাদকের পেছনে পেছনে ছেলেপুলেরা যেভাবে গিয়েছে। আমি ঠিক সেইভাবেই গিয়েছি। একসময় মেয়েটা বলল, এই বাড়িতে আমরা থাকি। এখন আপনি বাসায় যান। আমাকে আমার বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ। ঘটনাটা কেমন ভাইজান? ইন্টারেস্টিং না?

হুঁ।

ভাইজান আমি ঠিক করেছি। এই ঘটনা নিয়ে একটা ছোটগল্প লিখব। গল্পের নামসবুজ আইসক্রিম। আমি যে আইসক্রিমটা খেয়েছিলাম সেটার রঙ ছিল সবুজ। গল্পে ছেলেটার নাম থাকবে টগর। মেয়েটার নাম থাকবে বেলী। দুটাই ফুলের নাম।

গল্পের নামটা খারাপ না। তবে পাত্র-পাত্রীর নাম ভালো হয় নি।

গল্পের শেষটা ভেবে রেখেছি। গল্পের শেষে টগর এবং বেলী কাজির অফিসে গিয়ে বিয়ে করবে। বিয়ের পর পরই দুজন দুটা সবুজ আইসক্রিম খেতে খেতে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবে। মিলনাত্মক গল্প।

মিলনাত্মক গল্প না লিখে বিয়োগান্তক লেখা। বাস্তবের সঙ্গে মিলবে। যেমন ধরা এক পর্যায়ে ছেলেটা জানতে পারল যে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। সে খুব মনে কষ্ট পেল। একবার ভাবল সারাজীবন বিয়ে করবে না। সারাজীবন একা থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে করল। তিন বছরের মাথায় তাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো। বেলী বলল, ওগো মেয়েটার সুন্দর একটা নাম রাখো তো। আনকমন নাম। টগর বলল, ওর নাম রাখলাম আইসক্রিম।

জহির বলল, বিয়োগান্তক গল্পটাও খারাপ না। দেখি দুভাবেই লিখব। এখন তোমাকে জরুরি কাজের কথাটা বলেই চলে যাব।

যাবি কোথায়?

এখনো ঠিক করিনি কোথায় যাব। বাড়িতে তো যাওয়াই যাবে না। কোনো এক বন্ধুর বাসায় উঠব। তারপর ডিসিসান নেব। ফুলফুলিয়াকে একবার দেখে আসতে পারলে ভালো হতো। সেটা মনে হয় ঠিক হবে না। তুমি কী বলো? ঠিক হবে?

না।

ওর ছবিগুলি তো ওকে ফেরত দেয়া দরকার। ছোটবেলার ছবি দিয়ে দুটা প্রিন্ট বের করেছি। একটা আইনষ্টাইনের সঙ্গে আরেকটা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার ছবিটা ভালো হয়েছে। ছবি দেখে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ তার নাতনির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।

চা খাবি?

না ভাইজান, চা খাব না। এখন বিদেয় হব। বেশিক্ষণ থাকলে বাবার হাতে ধরা পড়ে যাব। আমি মোটামুটি নব্বই দশমিক পাঁচ ভাগ নিশ্চিত যে বাবা খবর পেয়েই সরাসরি তোমার কাছে চলে আসবে।

আমারও তাই ধারণা।

বাবার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের দুজনকেই পালিয়ে যেতে হবে। আমি কোথায় যাব এটা এই মুহুর্তে ঠিক করে ফেললাম।

কোথায় যাবি?

কোথাও যাব না। শুধু হাঁটব।

শুধুই হাটবি মানে?

ভাইজান, তুমি ফরেস্টগাম্প ছবিটা দেখছ?

না।

ফরেস্টগাম্প ছবিতে অভিনেতা টম হ্যাংকস হাঁটা শুরু করে। দিনের পর দিন কোনো কারণ ছাড়াই হাটে। হাঁটতে হাঁটতেই তার দাড়ি গোঁফ গজিয়ে যায়। আমিও টম হ্যাংকস এর মতোই হাঁটব। তবে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা না। আমি হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করব।

কী চিন্তা করবি?

পৃথিবীতে যে মানুষের মতো ইন্টেলিজেন্ট প্রাণী এসেছে, এরা কেন এসেছে? কেন প্রকৃতি এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি করল? প্রকৃতি মানুষের কাছে কী চাচ্ছে?

হেঁটে হেঁটে এমন জটিল চিন্তা করবি?

হুঁ। ভাইজান আমি হাঁটা শুরু করব তেতুলিয়া থেকে। হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশের শেষ সীমানা টেকনাফের শাহপরীতে যাব। সেখানে সমুদ্রে নেমে গোসল করব। গোসল করে উঠে এসে দাড়ি গোঁফ কমাব। আইডিয়াটা কেমন ভাইজান?

আইডিয়া খারাপ না।

এখন তোমাকে জরুরি কথাটা বলি। জরুরি কথাটা হচ্ছে ফুলফুলিয়াকে তুমি ছবি দুটা দিয়ে আসবে। আমি যাব না। এখন আমার আর যেতে ইচ্ছা করছে না।

খামে ভরে বাইপোস্ট পাঠিয়ে দিলেও তো হয়।

না ভাইজান, তোমাকেই যেতে হবে। আমি তো জানতাম না মেয়েটা বিবাহিতা। গতকাল রাতে মার কাছ থেকে জেনেছি। কিন্তু তার আগেই একটা ভুল করে ফেলেছি। পরশু দুপুরে ফুলফুলিয়াকে একটা চিঠি লিখে পোষ্ট করেছি। বত্ৰিশ পৃষ্ঠার চিঠি। আমি চাই না। এই চিঠিটা সে পড়ুক।

বত্রিশ পৃষ্ঠার চিঠি লিখেছিস কষ্ট করে, আরো কয়েক পৃষ্ঠা লিখলে তো উপন্যাস হয়ে যেত।

আমিও পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লিখব ঠিক করেছিলাম। এ4 সাইজ কাগজ শেষ হয়ে গেল। আমি যে-ধরনের চিঠি লিখেছি সে-ধরনের চিঠি লিখতে কষ্ট হয় না। দুই হাজার তিন হাজার পৃষ্ঠাও লেখা যায়। একটা বাক্যই বারবার লিখি–আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।

আমি বিড়বিড় করে বললাম, পবিত্ৰ গাভী।

জহির বলল, চিঠি তোমাকে ফেরত নিয়ে আসতে হবে ভাইজান।

আমাকে গিয়ে ফুলফুলিয়াকে বলতে হবে যে, তোমার নামে আজ-কালের ভেতর একটা চিঠি আসবে। চিঠিটা তুমি না পড়েই নষ্ট করে ফেলবে।

ঠিক ধরেছ ভাইজান। এই কাজটা তোমাকে করতে হবে।

কোনো মেয়ের পক্ষে চিঠি না পড়ে নষ্ট করে ফেলা তো অসম্ভব ব্যাপার।

এই জন্যেই তো তোমাকে যেতে বলছি। তুমি বললেই অসম্ভব সম্ভব হবে। এই ক্ষমতা তোমার আছে।

আচ্ছা দেখি।

দেখাদেখি না। তুমি আজই যাবে এবং চিঠিটা না পড়ার কথা এমন ভাবে বলবে যেন সে চিঠি না পড়ে। একটা বিবাহিতা মেয়ে যখন দেখবে কেউ তাকে তখন তার ঘেন্না লাগবে। ভাইজান চিঠিটা ফেরত আনতে পারবে না?

চেষ্টা করব।

ভাইজান উঠি?

যা হাঁটা শুরু কর। খালি পায়ে না হেঁটে ভালো কেডস এর জুতা কিনে নে। আমি ঠিক করেছি খালি পায়েই হাঁটব। সঙ্গে টাকা-পয়সা কাপড় চোপড় কিছুই থাকবে না। ক্ষিধে লাগলে মানুষের বাড়ি গিয়ে খাওয়া চাইব। খেতে দিলে খাব। খেতে না দিলে খালি পেটেই হাঁটব। সন্ন্যাসীদের মতো জীবন।

নাগা সন্ন্যাসীদের মতো পুরোপুরি নগ্ন হয়ে তুই যদি হাঁটতে পারিস তাহলে কিন্তু খাওয়ার অভাব হবে না। একজন নগ্নমানুষ কোনো বাড়িতে খেতে চাইছে আপদ বিদেয়। করার জন্যেই তারা তাড়াতাড়ি খাবার দেবে। টাকা-পয়সা চাইলে টাকা-পয়সা দেবে।

নগ্ন হয়ে হাঁটতে পারব না ভাইজান, লজ্জা লাগবে।

লজ্জা লাগলে তো কিছু করার নেই। তোকে বুদ্ধি শিখিয়ে দিলাম। যদি দেখিস মহাবিপদে পড়ে গেছিস, খাওয়া জুটছে না— তখন নাগা সিস্টেম।

জহির উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, শুভ দেশ হন্টন।

 

বিকেল তিনটায় খালু সাহেব চলে এলেন। তাঁর মুখ গভীর। কপালের চামড়া কুঁচকে আছে। চোখ ছোট ছোট। সুপ্ত অগ্নিগিরি টাইপ ভাব ভঙ্গি। বিস্ফোরণের আগে আগ্নেয়গিরি অতিরিক্ত শান্ত থাকে। খালু সাহেবও অতিরিক্ত শান্ত।

কেমন আছ হিমু?

জ্বি ভাল।

তোমাকে পাওয়া যাবে ভাবি নি। তুমি তো ঘরে বসে থাকার লোক না। শুয়ে আছ যে, শরীর খারাপ না-কি?

জ্বি না। শরীর ভালো।

অফিস থেকে বাসায় যাবার পথে ভাবলাম তোমার সঙ্গে বসে এক কাপ চ খেয়ে যাই। জহিরকে নিয়ে কিছু কথা ছিল। কথাও বলি।

আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম— আমি চায়ের কথা বলে আসি।

খালু সাহেব বললেন, চায়ের কথা বলতে হবে না। আমি ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছি। অফিসের পিওনের কাছে ফ্লাস্ক। কাপ আনতে ভুলে গেছি। ওকে দুটা মগ কিনতে পাঠিয়েছি।

আমার কাছে কাপ ছিল।

তোমারটা তোমার কাছে থাকুক। মগ দুটা তোমাকে দিয়ে যাব। অফিস ফেরত মাঝে মধ্যে যদি চা খেতে আসি মাগে করে চা খাওয়া যাবে।

আপনি কি প্রায়ই আসবেন?

খালু সাহেব আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চেয়ারে বসলেন। টেবিলে রাখা ফুলফুলিয়ার ছবি দুটা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।

কার ছবি?

রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের ছবি।

সে তো বুঝতেই পারছি। মেয়েটা কে?

ওর নাম ফুলফুলিয়া।

ফুলফুলিয়া? নামটা পরিচিত লাগছে কেন?

খালার কাছে তার নাম মনে হয় শুনেছেন।

ও আচ্ছা— দ্যাট ফুলি ফুলিয়া? রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের সঙ্গে তার ছবি কীভাবে এলো।

এটা ফটোগ্রাফিক ট্রিক। ফটোশপ নামের একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামে এই কাজটা সহজেই করা যায়।

জহির করেছে?

জ্বি।

পড়াশোনা বাদ দিয়ে সে ট্রিক ফটোগ্রাফ করছে? তুমি নিশ্চয়ই জানো আজ সে পরীক্ষা দিতে যায় নি।

জানি। আমার কাছে এসেছিল।

তোমার কাছে যে আসবে এটা আমি ধরেই নিয়েছি।

খালু সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরালেন। তাঁর কপালের চামড়ায় আরেকটা ভাঁজ পড়ল। চোখ দুটা আরো ছোট হয়ে গেল। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি এখন গা ঝাড়া দিচ্ছে। যে-কোনো সময় লাভা বের হতে শুরু করবে। খালু সাহেবের পিওন দুটা মগ এবং ফ্লাস্ক নিয়ে ঢুকেছে। লোকটা অতি দ্রুত মাগে চা ঢেলে দিল। সে চায়ের সঙ্গে কেকও এনেছে। এক বাক্স টিসু পেপার এনেছে। টিসু পেপার, কেক রেখে অতিদ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মনে হয় তার ওপর এ রকম নির্দেশই ছিল।

হিমু।

জ্বি।

জহিরের পরিকল্পনা কী তা তুমি জানো?

জানি। আমাকে বলে গেছে। আপাতত সে হাঁটবে।

হাঁটবে মানে?

প্ৰথমে যাবে তেতুলিয়া, সেখান থেকে হাঁটা শুরু করবে। হাঁটা বন্ধ হবে শাহপরী দ্বীপে। শাহপরী দ্বীপ হলো বাংলাদেশের শেষ সীমানা। শাহপরী দ্বীপে পৌঁছার পর সে সমুদ্র স্নান করবে। দাড়ি কামাবে।

দাড়ি কামাবে মানে?

এই কদিন সে দাড়ি গোঁফ কামবে না। ছয় মাসে দাড়ি গোঁফ অনেক বড় হয়ে যাবে। কামানো ছাড়া গতি কী?

সে ছয় মাস ধরে হাটবে। এটাই তার পরিকল্পনা?

জ্বি।

সে যে বর্তমানে মানসিক রোগী এটা কি সে জানে?

জ্বি না জানে না। মানসিক রোগী কখনোই বুঝতে পারে না যে সে মানসিক রোগী।

তোমাকে যখন সে তার পরিকল্পনার কথা বলল, তখন তুমি তাকে কী বললে?

আমি তাকে ভালো কেডস জুতা কিনতে বললাম। খাওয়া দাওয়ার সমস্যা যদি হয়। তখন একটা বুদ্ধি বলে দিয়েছি। এই বুদ্ধিমতো কাজ করলে খাওয়া দাওয়ার সমস্যা হবে না। যে-কোনো বাড়িতে খাবার চাইলেই খাবার দেবে।

কী বুদ্ধি?

খালু সাহেব সেটা আপনাকে বলব না। বললে আপনি রাগ করতে পারেন।

রাগ করব না, বলো। আমি হতভম্ব অবস্থায় আছি। হতভম্ব মানুষ রাগ করতে পারে না।

আমি জহিরকে বলেছি। যদি সে দেখে কেউ তাকে খেতে দিচ্ছে না। তাহলে সে যেন নাগা সন্ন্যাসী টাইপ হয়ে যায়। কাপড় চোপড় সব খুলে ফেলে পুরো নগ্ন হয়ে যাওয়া।

শুধু পায়ে থাকবে কেডস জুতা। এই অবস্থায় কোনো বাড়িতে খাবার চাইলে অবশ্যই খাবার দেবে।

খালু সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলছেন না। হাত বাড়িয়ে চায়ের মগ নিয়ে মাগে চুমুক দিলেন। সিগারেট ধরলেন। আমি নিজেই মাগে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, চা-টা খুবই ভালো হয়েছে। খালু সাহেবের ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি দেখা গেল।

হিমু!

জ্বি।

তুমি তাকে নেংটো হয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার ভিক্ষা করে খেতে বলেছ?

তেমন ইমার্জেন্সি যদি হয় তাহলেই এই পথে যেতে বলেছি। তবে সে যাবে না। সে বলেছে তার লজ্জা করে।

তুমি একটা কথা বলবে। আর তা সে করবে না এটা কখনো হবে না। ঠিকই সে নেংটো হয়ে পথে পথে হাঁটবে। হিমু শোন, আমার ধারণা— না ধারণা না আমার দৃঢ় বিশ্বাস পুরো ব্যাপারটার আর্কিটেক্ট হচ্ছে তুমি। কফির দোকান, ফুলফুলিয়া, পরীক্ষা না। দেয়া, নেংটো হয়ে হাঁটাহাঁটি সব কিছুর মূলে আছ তুমি। আমার ছেলে গোল্লায় গেছে যাক–আমি তোমাকে ছাড়ব না। আমি তোমার হিমুগিরি বের করে দেব। তোমার খালা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তোমাকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর তুমি আমার ছেলেকে আমার সামনে হাজির করবে। যদি করতে পার তাহলেই তোমাকে ক্ষমা করব। আর নয়তো না।

খালু সাহেব সময় আরেকটু বাড়ানো যায় না? বাহাত্তর ঘণ্টা করা যায়?

চব্বিশ ঘণ্টা মানে চব্বিশ ঘণ্টা। এখন বাজে দুটা একুশ। আমি আগামীকাল দুটা একুশে তোমার এখানে আসব। তখন যেন জহিরকে দেখতে পাই।

খালু সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।

আমি বললাম, জহির কোথায় আছে আমি জানি না। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। টেলিপ্যাথিক পদ্ধতিতে। একটু সময় তো লাগবেই।

খালু সাহেব আগুন কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এখন ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। রাগ সামলাবার চেষ্টা। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। স্ট্রোক ফোক না। হয়ে যায়। আমি বললাম, চলুন আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসি।

ধন্যবাদ। তোমাকে পৌঁছে দিতে হবে না। I know the way.

খালু সাহেবের রাগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। রাগ এবং টেনশনের সময় তিনি বাংলা ভুলে যান। তাঁকে আর ঘাটানো ঠিক হবে না। আমিও খালু সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, এখন বসে পড়লাম। আমার হাতে চব্বিশ ঘণ্টা সময়। এই চব্বিশ ঘণ্টায় কিছু করা যাবে না। ফুলফুলিয়ার কাছ থেকে অবশ্যি টেলিপ্যাথিক পদ্ধতিতে মানুষকে ডাকার কৌশল শিখে আসা যায়। খালার সঙ্গেও কথা বলা দরকার। খালার বাসায় যাবার প্রশ্নই উঠে না। কথা বলার কাজটা সারতে হবে টেলিফোনে। কোনটা আগে করব বুঝতে পারছি না খালার সঙ্গে কথা বলব, না ফুলফুলিয়ার সঙ্গে দেখা করব? আশ্চর্য ব্যাপার খালু সাহেব এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো কথা বলতে চান। কথা বলাটা ঠিক হবে কিনা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। আমি বললাম, খালু সাহেব কিছু বলবেন?

চব্বিশ ঘণ্টা যাক তারপর যা বলার বলব।

খালু সাহেব দরজার দিকে রওনা হলেন। ফ্লাস্কটা ফেলে যাচ্ছেন। নিয়ে যেতে হবে। বলব কিনা বুঝতে পারছি না। বললে হয়তো আরো রেগে যাবেন। থাকুক ফ্লাস্ক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দামি জিনিস। বরং এক কাজ করা যেতে পারে, ফ্লাঙ্ক ভর্তি চা নিয়ে ফুলফুলিয়ার সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে। ঐ দিন তাঁর গরম রুটিগুলো ভালো ছিল। চা ভালো ছিল না।

 

কলিং বেলে হাত রাখার আগেই দরজা খুলে গেল এবং দরজা পুরোপুরি খোলার আগেই ফুলফুলিয়া বলল, ভাইজান আসুন। চমৎকৃত হবার মতো ঘটনা। দরজায় কোনো পিপ হোল নেই যে ফুলফুলিয়া আগে থেকে দেখবে আমি এসেছি। যেহেতু চমৎকৃত হবার ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই, আমি চমৎকৃত হলাম না। খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, কেমন আছ?

ফুলফুলিয়া বলল, ভালো।

তোমার দুটা ছবি আছে আমার কাছে। ছবি দুটা দিতে এসেছি।

ফুলফুলিয়া বলল, রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে ছবি?

তুমি ব্যাপারটা জানো না-কি?

উনি বলেছেন। উনি আসলে হঠাৎ করে ছবি দেখিয়ে আমাকে বিস্মিত করতে চেয়েছিলেন। পেটে কথা রাখতে পারেন নি। আগেই বলে দিয়েছেন। ভাইজান শুনুন, আমার বাবা বাসায় আছেন। উনার শরীর সামান্য খারাপ। আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে কিছু মনে করবেন না।

উনি কি সব সময় খারাপ ব্যবহার করেন?

কী করলে উনি খুশি হন?

কোনো কিছুতেই খুশি হন না। তবে তার ব্যাঞ্জো বাজনার প্রশংসা করলে তিনি মনে মনে খুশি হন।

কী বাজনা বললে–ব্যাঞ্জো?

জ্বি।

চল, তোমার বাবার কাছে আমাকে নিয়ে চল। উনার নাম কী?

শমসের উদ্দিন।

খাটের ওপর এই গরমের ভেতর কথা গায়ে দিয়ে জবুথবু হয়ে এক বৃদ্ধ বসে। আছে। নেশাগ্ৰস্ত মানুষের লাল চোখ। মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কিছু মানুষ আছে সপ্তাহে একদিন শেভ করেন। উনি মনে হয় সেই দলের। ভদ্রলোকের মুখ ভর্তি দাড় গোঁফের জঙ্গল থাকলেও মাথা চুল শূন্য। টাক মাথা মানুষেরও কিছু চুল থাকে। উনার তাও নেই। তবে তার টাকে বিশেষত্ব আছে। টাকা চকচক করছে না। ম্যাট ফিনিশিং। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন।

আপনে কে?

আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, আমার নাম হিমু।

চান কী?

বসে তারপর বলি। বসতে পারি?

শমসের উদ্দিন লাল চোখে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন। আমার দিকে না। তাঁর মেয়ের দিকে। আমি ফুলফুলিয়াকে বললাম, এই মেয়ে তুমি আমাদের দুজনকে চা দাও। আমি ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে এসেছি। চা খেতে খেতে আমি তোমার বাবার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলি। জরুরি কথা বলার সময় তোমার না থাকাই ভালো।

শমসের উদ্দিন আমার দিকে ফিরলেন। আগের মতোই খ্যাক খ্যাক করে বললেন, মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসছেন? এই এক যন্ত্রণায় পড়েছি। দুই দিন পরে পরে যন্ত্রণা। বাংলাদেশে মনে হয় বিবাহযোগ্য মেয়ে এই একটা। প্ৰস্তাব দেয়ার আগে শুনে রাখেন— আমার মেয়ের দুই বছর আগে বিবাহ হয়েছে। জামাই পোষ্টমাস্টার।

এটা কোনো ব্যাপার না?

কী বললেন, এটা কোনো ব্যাপার না?

জ্বি না। মোঘল ইতিহাস পড়লে দেখবেন মোঘল সম্রাটদের কোনো একটা মেয়েকে পছন্দ হলো। দেখা গেল সেই মেয়ে বিবাহিতা। কোনো অসুবিধা নেই। হাসবেন্ড মেরে ফেলা। নতুন করে বিয়ের ব্যবস্থা কর।

চুপ!

আমাকে চুপ করতে বলছেন?

হ্যাঁ চুপ। আর কোনো কথা না। এখন গেট আউট। এই মুহুর্তে গেট আউট।

আসল কথাটা তো এখনো বলতে পারি নি।

আসল কথা নকল কথা কোনো কথা না। তুমি ভদ্রলোকের ছেলে। মারধোর করব না। মানে মানে বের হয়ে যাও।

আপনার ব্যাঞ্জো বাজনা বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম। আপনার মেয়ের বিবাহের বিষয়ে না। মোঘল সাম্রাজ্যও তো এখন নাই যে স্বামী খুন করে আবার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

ব্যাঞ্জো বিষয়ে তোমার কী কথা?

একটা সিডি কোম্পানি আপনার ব্যাঞ্জো নিয়ে সিডি বের করতে চায়। আমি তাদের এজেন্ট। এই বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।

আমার ব্যাঞ্জো বাজনার সিডি বের করতে চায়?

জ্বি।

তুমি আমার নাম জানো?

নাম কেন জানব না? আপনি হলেন ওস্তাদ শমসের উদ্দিন খাঁ।

খাঁ পেলে কোথায়? নামের শেষে খাঁ নাই।

খাঁ নাই, এখন লাগায়ে দিব। ওস্তাদের নামের শেষে খাঁ না থাকলে মানায় না। আপনি আগ্রহী হলে বলেন। টার্মস এন্ড কন্ডিশন ঠিক করি।

আমার ব্যাঞ্জো বাজনা তুমি শুনেছ?

আমি শুনি নি। শোনার ইচ্ছাও নাই। গান বাজনা আমার পছন্দের জিনিস না। আমি এজেন্ট। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছে, করলাম। বাকি আপনার ইচ্ছ। শুনেছি ব্যাঞ্জো যন্ত্রটা আজকাল বাজানো হয় না। লোকজন এই যন্ত্রটার কথা ভুলেই গেছে। আর আপনি নাকি মোটামুটি বাজাতে পারেন।

মোটামুটি বাজাই? আমি মোটামুটি বাজাই? আমি মোটামুটি বাজালে সিডি কোম্পানি তোমাকে আমার কাছে পাঠাতো সিডি বের করার জন্য? এরা তো তোমার মত ঘাস খায় না।

তাও ঠিক। আপনি কি রাজি?

ফট করে রাজি অরাজি কী? জিনিসটা ভালো মতো বুঝে নেই। চা খাও। কী ধরনের বাজনা এরা চায়? রাগ প্ৰধান?

সেটা আপনার ইচ্ছা। রাগ-প্রধান বাজাতে চাইলে রাগ-প্রধান বাজাবেন। ভালোবাসা-প্রধান বাজাতে চাইলে ভালোবাসা-প্রধান বাজাবেন।

ভালোবাসা-প্রধান কী?

আপনারা সঙ্গীতের লোক। আপনারা জানবেন ভালোবাসা-প্রধান কী?

তুমি তো দেখি গান বাজনা লাইনের কিছুই জানো না।

আগেই তো বলেছি কিছু জানি না। আপনি কী বাজাবেন আপনি ঠিক করুন। আপনার সঙ্গে কি তবলা ফ বলা লাগবে?

ফবলা কী? এইভাবে কথা আমার সঙ্গে বলবে না।

জ্বি আচ্ছা বলব না।

শমসের উদ্দিন সাহেবের চোখ মুখ কোমল হয়ে গেল। তিনি এই প্রথম স্নেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কী?

হিমু।

ভালো নাম কী?

ভালো নাম, খারাপ নোম একটাই— হিমু।

সত্যি সত্যি ব্যাঞ্জোর সিডি বের করবে?

অবশ্যই।

এই উপমহাদেশে আমার চেয়ে ভালো ব্যাঞ্জো কেউ বাজায় না। এটা জানো?

জ্বি না।

তোমাকে তুমি তুমি করে বলছি, মনে কিছু নিও না।

আপনি ওস্তাদ মানুষ আপনি তো তুমি তুমি করে বলবেনই। তাহলে কথাবার্তা ফাইন্যাল?

শমসের উদ্দিন নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন, বত্ৰিশ মাত্রা, সঙ্গে তেহাই— রাগ কাফি যখন ধরব ঝড় তুলে দিব। ব্যাঞ্জোর উপর দিয়ে যখন আঙুল চলবে। আঙুল দেখা যাবে না। যদি আঙুল দেখা যায়–আল্লাহর কীরা আঙুল কেটে তোমাকে দিয়ে দিব।

কাটা আঙুল দিয়ে আমি কী করব?

তুমি আঙুল কেটে কী করবে। সেটা তোমার বিবেচনা। আমার আঙুল কেটে দেয়ার কথা আমি দিলাম।

ধন্যবাদ!

তোমার নামটা যেন কী আরেকবার বলো তো। মিহি? আজকাল মানুষের নাম মনে থাকে না।

আমার নাম হিমু। তবে আপনার যদি মিহি ডাকতে ইচ্ছা হয় ডাকবেন।

রাতে আমার সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করি। আজ বাসায় মাংস রান্না হবে। ঝোল দিয়ে গো মাংস, সঙ্গে চালের আটার রুটি। রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাংসের ঝোলের মধ্যে ফেলবে। রুটি নরম হবে। মুখের মধ্যে ফেলবে। আর গিলে ফেলবে।

কবুল।

কবুল মানে কী?

কবুল মানে আমি রাজি।

খাওয়া দাওয়ার পরে রাগ কাফির একটা বন্দীশ শোনাব। তিন তাল শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

মাথা তো আমার এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। দিন আরো খারাপ করে।

ঠিক করে বলো তো চালের আটার রুটি করবে না পোলাও রাধবে? অনেক দিন পোলাও খাই না। দরিদ্র মানুষ, ইচ্ছা করলেও সম্ভব হয় না।

আপনার কি পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে?

তুমি মেহমান মানুষ এই জন্যে বলছি। আর ফুলফুলিয়া সে-রকম ভালো রাধাতেও পারে না। আমার স্ত্রী পারতেন। আফসোস তার হাতের পোলাও তোমাকে খাওয়াতে পারলাম না।

উনি কোরমা কেমন রাঁধতেন?

কোরমার কথা বলে দিলে তো মনটা খারাপ করে। শহরের লোকজন তো কোরমা রাঁধতেই পারে না। মুরগির রোস্ট, দোপেয়াজা, ঝালফ্রাই। বাঙালি কোরমার কাছে কিছু লাগে? তোমার কি কোরমা খেতে ইচ্ছা করছে?

জ্বি। আপনার কি করছে?

আমার তো মুখে পানি চলে আসছে। বয়স হয়েছে তো, সুখাদ্যের কথা মনে হলে মুখে পানি চলে আসে। সামলাতে পারি না। দেখি ব্যবস্থা করা যায় কি না।

ফুলফুলিয়া এতক্ষণ পরে চা নিয়ে ঢুকেছে। তার দেরির কারণ বোঝা যাচ্ছে। সিঙ্গাড়া ভেজে এনেছে।

শমসের উদ্দিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, পোলাও রাধার ব্যবস্থা কর। পোলাও, মুরগির কোরমা, গরুর ঝাল মাংস। মিহি রাতে খাবে।

ফুলফুলিয়া বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। শমসের উদ্দিন বিরক্ত গলায় মেয়েকে বললেন, হা করে তাকিয়ে থাকিস না তো— রান্নাবান্নার জোগাড় কর। টক দৈ এর ব্যবস্থা রাখিস। গুরু ভোজনের পরে টক দৈ। হজমের সহায়ক।

ফুলফুলিয়া ঘর থেকে বের হতেই শমসের উদ্দিন আমার দিকে ঝুকে এসে গলা নামিয়ে বললেন, মিহি এই যে আমার ব্যাঞ্জোর সিডি বের হচ্ছে। কেন বের হচ্ছে জানো?

আমি বললাম, না।

শমসের উদ্দিন বললেন, গত মাসে সিলেটে গিয়েছিলাম। শাহজালাল সাহেবের দরগায় গিয়ে কান্নাকাটি করেছি। বলেছি আমার বড় শখ আমার বাজনা দেশের মানুষকে শোনাই। আল্লাহপাক, শাহজালাল সাবের উছিলায় তুমি বান্দার মনের বাসনা পূর্ণ করা। আল্লাহপাক যে তখনই মঞ্জুর করে দিয়েছেন বুঝতে পারি নাই। এখন বুঝলাম। ঠিক করেছি। গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়ব। মিহি, তুমি ফুলফুলিয়াকে বলো গোসলের জন্যে গরম পানি করতে। যাও রান্নাঘরে চলে যাও। কোনো অসুবিধা নাই। আমার এই বাড়ি এখন থেকে তুমি নিজের বাড়ি মনে করবে।

আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। ফুলফুলিয়া কুলায় চাল বাছছিল। আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে মোটেই অবাক হলো না। শুধু বলল, সব মানুষকেই কি আপনি মুহুর্তের মধ্যে হাতের মুঠোয় নিতে পারেন? আমাকে পারবেন?

আমি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, গরম পানি করা তো। খাঁ সাহেব গোসল করবেন।

ফুলফুলিয়া বলল, খাঁ সাহেব কে?

তোমার বাবা।

ও আচ্ছা।

আমি হাসিমুখে বললাম, আরেকটা জরুরি কথা। জহির তোমাকে একটা চিঠি লিখেছে। পোষ্ট করেছে। এক দুদিনের মধ্যে চিঠিটা তোমার হাতে চলে আসবে। চিঠি তুলে রাখবে। এখন পড়বে না। যখন আমি তোমাকে পড়তে বলব। তখন পড়বে। ঠিক আছে?

ফুলফুলিয়া বেশ কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর চোখ নামিয়ে শান্ত গলায় বলল, ঠিক আছে।

ব্যাঞ্জোর আসর বসল। রাত বারোটায়। বাড়িওয়ালা না ঘুমানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। দরজা-জানালা বন্ধ করতে হলো যেন শব্দ বাইরে না যায়।

বাজনা শুরু হলো। আমি চমকে উঠলাম— এ-কী? মনে হচ্ছে বাজনার তালে তালে। বাতাস কাঁপতে শুরু করেছে। শুধু বাতাস না, এখন মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি দুলছে। বুকের ভেতরের হৃৎপিণ্ড দুলছে। এ যেন অলৌকিক অপার্থিব সঙ্গীতের ঝড়। আমি ভদ্রলোকের আঙুলের দিকে তাকালাম। আঙুল সত্যি সত্যি দেখা যাচ্ছে না। যে-কোনো মহৎ সঙ্গীত বুকের ভেতরে তীব্ৰ বেদনা তৈরি করে। আমার সে-রকম হচ্ছে। বুক টনটন করছে।

এক সময় বাজনা থামল। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখি আপনার পা-টা একটু এগিয়ে দিন তো। আপনার পায়ের ধুলা কপালে মাখব।

আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই ভদ্রলোক দুহাতে আমার হাত ঝাপ্টে ধরে তাঁর বুকে লাগালেন এবং ব্যাকুল হয়ে শিশুদের মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *