৩. জড়ের প্রকৃতি
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা সম্মত হয়েছি (যদিও প্রয়োগভিত্তিক যুক্তি ছাড়াই) যে এটি বিশ্বাস করা যুক্তিসম্মত যে আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত-যেমন, সেই বিষয়গুলো যা আমরা আমার টেবিলের সঙ্গে যুক্ত করেছিলাম হল বিষয়ের অস্তিত্বের প্রতীক যা আমাদের প্রত্যক্ষ থেকে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল, অর্থাৎ বর্ণ, কাঠিন্য, শব্দ ইত্যাদির সংবেদন ছাড়াও যা টেবিলটিকে আমার কাছে দৃশ্যমান করে তোলে, আমি মনে করি যে আরও কিছু একটা আছে যার মধ্যে এই বিষয়গুলো দৃশ্যমান হয়। যখনই আমি চোখ বন্ধ করি তখনই বর্ণ অন্তর্হিত হয়, যখনই আমি আমার হাত টেবিল থেকে সরিয়ে নিই তখনই কাঠিন্যের সংবেদন অনহিত হয়, আমি শব্দ করা বন্ধ করলেই টেবিলের আওয়াজও বন্ধ হয়। কিন্তু আমি এটা বিশ্বাস করি না যে যখন সবকিছুই অন্তর্হিত হয় তখন টেবিলও অন্তর্হিত হয়। বরং আমি বিশ্বাস করি টেবিলটি সর্বক্ষণ অস্তিত্বশীল বলেই যখনই আমি চোখ খুলবো, আমার হাত রাখবো এবং আবার শব্দ করা আরম্ভ করবো, তখনই সমস্ত ইন্দ্রিয়-উপাত্ত আবার ফিরে আসবে। এই অধ্যায়ে যে প্রশ্নটি আমরা বিবেচনা করবো তা হলো-এই প্রকৃত টেবিলের প্রকৃতি কি, যা আমার প্রত্যেক ছাড়াই স্বাধীনভাবে আছে? পদার্থবিজ্ঞান এই প্রশ্নের এক অসম্পূর্ণ ও কিছুটা অনুমানমূলক উত্তর দিয়েছে, তথাপি তা যথেষ্ঠ শ্রদ্ধার রাখে দাবি। পদার্থবিজ্ঞান অনেকটা না জেনেই এই মতে উপনীত হয়েছে যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনাবলিকে গতিতে পরিণত করা উচিত। আলো, তাপ ও শব্দ সমস্তই তরঙ্গ-গতির ফল, যা বস্তুর থেকে নির্গত হয়ে সেই ব্যক্তির দিকে যায় যে সেই আলো দেখে বা উষ্ণাতা অনুভব করে বা শব্দ শোনে। যার এই তরঙ্গ-গতি রয়েছে তা হয় ইথার অথবা স্থল জড় পদার্থ, কিন্তু এই দুটি ক্ষেত্রেই দার্শনিক এর নাম দেবে জড়। বিজ্ঞান যে একমাত্র গুণাবলি এতে আরোপ করবে তা হল স্থান এবং গতিসূত্র অনুসারে গতিশক্তি। বিজ্ঞান এর অন্যান্য গুণাবলিকে অস্বীকার করছে না, কিন্তু যদি তাই হয়, এই সমস্ত গুণাবলি বৈজ্ঞানিকের কাছে প্রয়োজনীয় নয় এবং এগুলো ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করতে তাঁকে সাহায্য করে না।
অনেকে বলেন আলো হল তরঙ্গ-গতি রূপ, কিন্তু এটি ভ্রান্ত, কেননা যে আলো আমরা তাৎক্ষণিকভাবে দেখি, যা আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সরাসরি জানি, তা তরঙ্গ-গতির রূপের নয়। এ হল সম্পূর্ণ আলাদা এমন কিছু যা আমরা, দৃষ্টিহীন না হলে, সবাই জানি, যদিও আমরা তার বর্ণনা করতে পারবো না এবং আমাদের এই জ্ঞান একজন দৃষ্টিহীনকে দিতে পারবো না। অপরপক্ষে, একটি তরঙ্গ গতির একজন দৃষ্টিহীনের কাছে বর্ণনা করা যায়, কেননা সে তার স্পর্শের সাহায্যে স্থানের জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং সমুদ্রে ভ্রমণের মাধ্যমে এই তরঙ্গ গতির ব্যাপারে আমাদের মতই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। কিন্তু একজন দৃষ্টিহীন ব্যক্তি এর সহায্যে যা জানে তাকে আমরা আরো বলে বুঝি না। আমরা আলো বলে বুঝি তাকেই যা একজন দৃষ্টিহীন ব্যক্তি কখনই বুঝতে পারবে না। এবং যাকে আমরা কোনদিনই তার কাছে বর্ণনা করতে পারবো না।
এখন এই এমন কিছু, যাকে একমাত্র দৃষ্টিহীনরা ছাড়া সকলেই জানে, তাকে বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী বাইরের জগতে পাওয়া যাবে না। এটি হল এমন কিছু যা দ্রষ্টা ব্যাক্তির চোখ, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের উপরে নির্দিষ্ট কিছু তরঙ্গের ক্রিয়ার ফল। যখন বলা হয় যে আলো হল তরঙ্গরাশি,তখন আসলে বোঝানো হয় যে তরঙ্গরশ্মিগুলো হল আমাদের আলোর সংবেদনের বাহ্য কারণ। কিন্তু যার মাধ্যমে সাধারণ ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এবং দৃষ্টিহীনরা করে না, সেই আলোকে বিজ্ঞান জগতের কোন অংশ বলে মনে করে না, যা আমাদের এবং আমাদের ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ (স্বাধীন)। এই একই কথা অন্যান্য সংবেদনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিজ্ঞানের জগতে শুধুমাত্র বর্ণ, শব্দ ইতাদিই যে জড়ের মধ্যে নেই তা-ই নয়, স্থানেরও ঠাই নেই সেখানে, যাকে আমরা দেখা বা স্পর্শের মাধ্যমে অনুভব করি। বিজ্ঞানের কাছে প্রয়োজনীয় হল যে জড় কোন স্থান অধিকার করে থাববে, কিন্তু যে স্থানে এই জড় রয়েছে তা কিন্তু সেই স্থান নয় যা আমরা দেখি বা অনুভব করি। সূচনাপর্বে বলা যায়, যে স্থানকে আমরা দেখি তা সেই স্থান নয় যাকে আমরা স্পর্শের দ্বারা পাই। শৈশবের অভিজ্ঞতার সাহায্যে আমরা শিখি যা দেখছি তাকে কিভাবে ধরতে হয়, বা কিভাবে সেই দ্রব্যগুলো দেখা যায় যা আমরা স্পর্শ দিয়ে অনুভব করছি। কিন্তু বিজ্ঞানের মতে স্থান হচ্ছে স্পর্শ এবং দেখার মধ্যে নিরপেক্ষ, কাজেই এটি স্পর্শস্থানও নয় বা দৃষ্টিস্থানও নয়।
আবার, বিভিন্ন লোকেরা একই বস্তুকে তাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী বিভিন্ন আকারের দেখে। যেমন একটি গোল মুদ্রা। এটিকে আমাদের সর্বদা গোল বলাই উচিত হলেও মুদ্রাটির দিকে সোজাসুজি না তাকালে সেটিকে ডিম্বাকার দেখতে পারে। এটিকে গোল বলে বিচার করার সময়, আমরা বিচার করি যে এর একটি প্রকৃত আকার আছে যা এর দৃশ্যগত আকার নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত স্বভাব যা দৃশ্যগত আকারের থেকে আলাদা। কিন্তু এই প্রকৃত আকার যা বিজ্ঞানের বিচার্য বিষয় তাকে অবশ্যই প্রকৃত স্থানে থাকতে হবে, যে-কোন ব্যক্তির আপাত স্থানে থাকলে চলবে না। প্রকৃত স্থান হল সর্বজনগ্রাহ্য, আপাত স্থান প্রত্যক্ষকর্তার ব্যক্তিগত। বিভিন্ন ব্যক্তির স্থানে একই বস্তুকে বিভিন্ন আকারে মনে হতে পারে। এভাবে প্রকৃত স্থান, যাতে প্রকৃত আকার রয়েছে, তা ব্যক্তিগত স্থানের থেকে আলাদা।
সুতরাং বিজ্ঞান যে স্থান নিয়ে আলোচনা করে তা আমরা যে-স্থান দেখি এবং অনুভব করি তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হলেও এক নয় এবং এই সম্পর্ক আলোচনার অবকাশ রাখে। আমরা সম্মত হয়েছিলাম যে বাহ্য বস্তু আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে এক হতে পারে না, কিন্তু আমাদের সংবেদনের কারণ হতে পারে। এসব বাহ্য বস্তুগুলো বিজ্ঞানের স্থানে রয়েছে, যাদেরকে আমরা বাহ্যিক স্থান বলতে পারি। এটি গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের সংবেদনগুলো যদি বাহ্য বস্তু দ্বারা ঘটে থাকে তাহলে অবশ্যই বাহ্য স্থান থাকবে যেখানে এসব বস্তু, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো, স্নায়ু এবং মস্তিষ্ক রয়েছে। আমরা কোন একটি বস্তুর স্পর্শ সংবেদন তখনই পাই যখন আমরা তার সংযোগে আসি। অর্থাৎ যখন আমাদের দেহের কোন অংশ বাহ্য স্থানে থাকে সেই স্থানের কাছে যেখানে বস্তু জায়গা নিয়ে রয়েছে। আমরা একটি বস্তুকে দেখি যখন কোন অস্বচ্ছ বস্তু আমাদের চোখ ও কর মাঝখানে বাহ্য স্থানে থাকে না। একইভাবে আমরা শুধু শুনি বা ঘ্রাণ নিই বা বস্তুর স্বাদ আস্বাদন করি যখন আমরা তার খুব কাছাকাছি থাকি বা যখন সেটি জিহ্বাকে স্পর্শ করে বা বাহ্যস্থানের এমন কোন আদর্শ জায়গায় থাকে যা আমাদের দেহের কাছাকাছি। আমরা বলতে পারি না, একটি বস্তু থেকে আমরা বিভিন্ন অবস্থায় কি কি সংবেদন পেতে পারি, যতক্ষণ না আমরা বস্তুটি এবং আমাদের দেহ একই বাহ্য স্থানে আছে বলে মনে করি, কেননা প্রধানত বস্তু এবং আমাদের দেহের আপেক্ষিক অবস্থানই ঠিক করে কি ধরনের সংবেদন আমরা বস্তুটির থেকে পাবো।
এখন আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্তগুলো আমাদের ব্যক্তিগত স্থানে রয়েছে, হয় দেখার স্থান বা স্পর্শ স্থান বা অন্যান্য অস্পষ্ট স্থান যা আমাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো দিতে পারে। যদি, বিজ্ঞান এবং সাধারণ বোধবুদ্ধি অনুযায়ী, শুধুমাত্র এক সর্বজনগ্রাহ্য বাহ্য স্থান থেকে থাকে, তাহলে অবশ্যই কোন না কোনভাবে ইন্দ্রিয়-উপাত্তের আপেক্ষিক অবস্থানের সঙ্গে আমাদের ব্যাক্তিগত স্থানের মিল থাকবে। ঘটনাটি এরকম মনে করার কোন অসুবিধা নেই : যদি আমরা রাস্তার উপরে একটি বাড়িকে আর-একটি বাড়ি থেকে কাছে দেখি, তাহলে আমাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয় এই ঘটনার সাক্ষী থাকবে যে এটি কাছের, উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা রাস্তা ধরে হেঁটে যাই তাহলে এটিতে তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে। অন্যান্য ব্যক্তিরাও এই মতে সম্মত হবেন যে বাড়িটি কাছে দেখাচ্ছে তা কাছে রয়েছে। সামরিক মানচিত্রও এই একই মত পোষণ করবে এবং এভাবে সমস্ত কিছুই বাড়িটি এবং তার ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের স্থানগত সম্পর্ক তৈরি করবে যা আমরা পাবো যখনই আমরা বাড়িটির দিকে দেখবো। এভাবে আমরা মনে করতে পারি যে বাহ্য স্থান সেখানেই আছে যেখানে বাহ্য বস্তুর স্থানগত সম্পর্ক রয়েছে এবং সে সবের সঙ্গে মিল রেখে যেখানে ব্যক্তিগত স্থানে তার অনুরূপ ইন্দ্রিয়-উপাত্ত রয়েছে। এই হল সেই বাহ্যস্থান যা জ্যামিতির আলোচ্যবস্তু এবং পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যাও যাকে গ্রহণ করে।
মনে করা যাক, বাহ্য স্থান রয়েছে এবং ব্যক্তিগত স্থানের সঙ্গে তার মিল রয়েছে, এর থেকে আমরা কি জানতে পারি? আমরা শুধু সেটাই জানি যা মিল দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থাৎ আমরা এর স্বরূপ সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু আমরা জানতে পারি বাহ্য বস্তুর সেই ধরনের ব্যবস্থাগুলো যা স্থানগত সম্পর্কের ফল। যেমন, আমরা জানতে পারি কোন গ্রহণের সময় পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সমান্তরাল রেখায় আসে-যদিও আমরা বাহ্য সমান্তরাল রেখার স্বরূপ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারি না, যেভাবে আমরা দৃশ্যগত স্থানের সমান্তরাল রেখার সম্পর্কে জানি। এভাবে আমরা দূরত্বগুলোর স্বরূপের থেকে বাহ্য স্থানের দূরত্বের সম্পর্ক সম্পন্ধে অনেক বেশি জানতে পারি। আমরা জানতে পারি একটি দূরত্ব আর-একটির থেকে বেশি, বা এটি অন্যটির মতো এই সমান্তরাল রেখায় রয়েছে; কিন্তু আমাদের বাহ্য দূরত্বের তাৎক্ষণিক জ্ঞান হয় না যা আমাদের ব্যক্তিগত স্থানের দূরত্ব সম্পর্কে হয়, অথবা রঙ, শব্দ বা অন্য ইন্দ্রিয়-উপাত্ত সম্পর্কে হয়। আমরা বাহ্য স্থান সম্পর্কে এই সমস্ত বিষয় জানতে পারি, একজন জন্মান্ধ মানুষ এই দৃশ্য স্থান বিষয়ে যা অন্যদের কাছ থেকে জানে। কিন্তু একজন জন্মান্ধ মানুষ যেরকম দৃশ্য স্থান সম্পর্কে কিছু জানতে পারে না, আমরাও সেরকম বাহ্য স্থান সম্পর্কে কিছু জানি না। আমরা জানতে পারি গুণের সম্পর্কের কথা যা ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে মিল রাখার জন্য প্রয়োজন, কিন্তু আমরা জানতে পারি না সেই সবের প্রকৃতি সম্পর্কে যার উপর এই সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
সময়ের ক্ষেত্রে, আমাদের স্থিতিকালের অনুভূতি বা সময় যাওয়ার অনুভূতি ঘড়ির সময় যাওয়ার তুলনায় নিতান্তই অসহযোগী পথপ্রদর্শক। আমাদের অবসন্ন বোধ করা বা কষ্ট পাওয়ার সময়টা যখন আমরা অপেক্ষাকৃত ব্যস্ত থাকি সেই সময়ের তুলনায় অত্যন্ত ধীরে যায় এবং যখন আমরা ঘুমোই তখন মনে হয় সময়ের অস্তিত্বই নেই। এভাবে সময় স্থিতিকাল দ্বারা গঠিত বলে সর্বসাধারণের ও ব্যক্তিগত সময়ের মধ্যে পার্থক্য করা প্রয়োজন, যেরকম স্থানের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। কিন্তু যেহেতু সময় পূর্ব এবং পর এই ধারায় তৈরি, তাই এই ধরনের পার্থক্য করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। সময়ের ধারা যা ঘটনার মধ্যে রয়েছে, যতদূর আমরা দেখতে পাই, তা হচ্ছে একই সময়ের ধারা যা তাদের মধ্যে রয়েছে। কোনভাবেই কোন কারণ দেখনো যাবে না যে এই দুই সময়ক্রম এক নয়। এ একই কথা সাধারণত স্থান সম্পর্কেও সত্য। একটি রাস্তা দিয়ে একদল মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে গেলে দলটির আকার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদা দেখাবে, কিন্তু সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষরা একই ধরনের বিন্যাস দেখবে। এ কারণে আমরা বাহ্য স্থানের ক্ষেত্রেও এই বিন্যাসটিকে সত্য বলে জানবো, অপরপক্ষে এর আকারটি বাহ্য স্থানের সঙ্গে ততক্ষণ মিল রেখে চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিন্যাসের ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখা প্রয়োজন।
এ থেকে যে ঘটনার যে সময়ক্রম রয়েছে বলে মনে হয় তা প্রকৃত সময়ক্রমের সঙ্গে এই, এটি প্রয়োজনীয় একটি সম্ভাব্য ভুল বোঝা থেকে সতর্ক হওয়া। একথা মনে করা উচিত নয় যে বিভিন্ন বাহ্য বস্তুর বিভিন্ন অবস্থার ইন্দ্রিয় উপাত্তগুলোর মত একই সময়ক্রম রয়েছে, যা এসব বস্তুকে দেখতে সাহায্য করে। বজ্র এবং বিদ্যুৎ বাহ্য বস্তু হিসেবে একই সময়ে ঘটে, অর্থাৎ বিদ্যুৎ বাতাসের বাধাদানের সঙ্গে একই সময়ে ঘটে, যেখানে বিপত্তিটা শুরু হয় অর্থাৎ যেখানে বিদ্যুৎ থাকে। কিন্তু যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে আমরা বজ্রপাতের আওয়াজ বলে মনে করি তা ততক্ষণ পর্যন্ত ঘটেনা যতক্ষণ না বাতাসের বাধাদান আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়। একইভাবে সূর্যের আলো আমাদের কাছে পৌঁছাতে আট মিনিট লাগে, অর্থাৎ যখন আমরা সূর্যকে দেখি তখন আমরা আট মিনিট আগের সূর্যকে দেখি। ইন্দ্রিয়-উপাত্ত যে-বাহ্য বস্তুর প্রমাণ দেয় তা হল আট মিনিট পূর্বের বাহ্য সূর্যের প্রমাণ। বাহ্য সূর্য ওই শেষের আট মিনিটে অন্তর্হিত হয়ে গেলেও যে ইন্দ্রিয়-উপাত্তকে আমরা সূর্য দেখা বলছি তার কোন পরিবর্তন হবে না। এটি ইন্দ্রিয়-উপাত্ত এবং বাহ্য বস্তুর মধ্যেকার পার্থক্য দেখানোর প্রয়োজনীয়তাকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে।
স্থান সম্বন্ধে আমরা যা দেখলাম তা ইন্দ্রিয়-উপাত্ত এবং তার বাহ্য প্রতিরূপের সম্বন্ধ সম্পর্কেও প্রযোজ্য। যদি একটি বস্তুকে নীল এবং অপরটিকে লাল দেখায়, তাহলে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই অনুমান করতে পারি যে এই দুই বাহ্য বস্তুর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। আবার দুটি বস্তুকে নীল দেখলে আমরা তাদের মধ্যে মিল রয়েছে বলে মনে করতে পারি। কিন্তু আমরা বাহ্য বস্তুর সেই গুণের সঙ্গে সরাসরি সংযোজিত হওয়ার আশা করতে পারি না যার জন্য এগুলো নীল বা লাল দেখায়। বিজ্ঞান আমাদের জানায়, এই গুণ হল এক ধরনের গতি-তরঙ্গ; এবং এটি জানা বলে মনে হয়, কেননা আমরা যে স্থান দেখি তাতে গতি-তরঙ্গের কথাই চিন্তা করি, কিন্তু এই গতি-তরঙ্গগুলোকে অবশ্যই প্রকৃত স্থানে থাকতে হবে যার সঙ্গে আমাদের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। এভাবে প্রকৃত গতি তরঙ্গগুলোর সেই পরিচিতি নেই যা আমরা তাদের আছে বলে ভেবেছিলাম এবং যা বর্ণ সম্পর্কে প্রযোজ্য তার সঙ্গে অন্যান্য ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মিল রয়েছে। এবাবে আমরা দেখি যে যদিও বাহ্য বস্তুর সম্বন্ধের বিভিন্ন জ্ঞাত গুণাবলি রয়েছে যা ইন্দ্রিয়-উপাত্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রহণ করা হয়েছে, তথাপি বাহ্য বস্তুরা তাদের অন্তর্নিহিত স্বভাবের ক্ষেত্রে অজানাই থেকে যাচ্ছে, যতদূর ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জানা যায়। এই প্রশ্নটি থেকেই যায় যে বাহ্য বস্তুর অন্তর্নিহিত স্বভাব আবিষ্কার করার অন্য আর কোন উপায় আছে কিনা।
ইন্দ্রয়-উপাত্ত সম্পর্কে সব থেকে স্বাভাবিক প্রকল্প, যদিও শেষ পর্যন্ত সমর্থনযোগ্য নয়, হচ্ছে প্রথমত এটি বাহ্য বস্তু কখনই ইন্দ্রিয়-উপাত্তের মতো হতে পারে না, কিন্তু তারা অনেকটা একই রকম হতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এই মত অনুযায়ী বাহ্য বস্তুর প্রকৃত রঙ থাকতে পারে এবং সৌভাগ্যবশত আমরা বস্তুর প্রকৃত রঙকে জানতে পারি। কোন একটি বিশেষ মুহূর্তে একটি বস্তুর রঙ সাধারণভাবে একই রকমের হতে পারে, যদিও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তা হুবহু এক নয়। এভাবে আমরা মনে করতে পারি যে প্রকৃত রঙ হল এক ধরনের মধ্যবর্তী রঙ, যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা বিভিন্ন ছায়ার (Shade) মধ্যবর্তী।
এ ধরনের মতবাদকে হয়তো সুনির্দিষ্টভাবে খন্ডন কর যায় না, কিন্তু এটকে ভিত্তিহীন বলে দেখানো যেতে পারে। এটা পরিষ্কার যে, যে রঙ আমরা দেখছি তা নির্ভর করে আলোর তরঙ্গের উপর যা আমাদের চোখে আঘাত করছে এবং সেই মাধ্যম দ্বারা পরিবর্তিত যা আমাদের এবং বাহ্যবস্তুর মধ্যে বাধাদান করছে; একই সঙ্গে চোখের দিক থেকে আলোর প্রতিফলনের দ্বারাও পরিবর্তিত হচ্ছে, মধ্যবর্তী বায়ু বর্ণকে পরিবর্তিত করছে যদি না তা পুরোপুরি স্বচ্ছ হয় এবং যে কোন তীব্র প্রতিফলন একে পুরোপুরি পরিবর্তিত করতে পারে। সুতরাং যে রঙ আমরা দেখি তা হলো চোখে পৌঁছানোর পর রশ্মির ফল এবং এটি সেই বস্তুর ধর্ম নয় যার থেকে রশ্মিটি আসবে। এভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে চোখে কিছু তরঙ্গ পৌঁছানোর জন্যই আমরা কোন বিশেষ বর্ণ দেখি, যে বস্তুটি থেকে তরঙ্গটি শুরু হয়েছিলো তার কোন বর্ণ থাক বা না-ই থাক। সুতরাং এক্ষেত্রে আসলে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে বাহ্য বস্তুর কোন বর্ণ আছে, অতএব এই ধরনের মতের স্বপক্ষে কোন সমর্থনযোগ্যতা নেই। অন্যান্য ইন্দ্রিয়-উপাত্তের ক্ষেত্রেও একই ধরনের যুক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ওঠে–এরকম কোন সাধারণ দার্শনিক যুক্তি আছে কিনা যার দ্বারা আমরা বলতে পারি যে যদি জড় সত্য হয় তাহলে তা অবশ্যই এই-এই ধরনের স্বভাব থাকবে। উপরিউক্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রায় সমস্ত দার্শনিকরা, সম্ভবত সকলেই, এই মত পোষণ করেন যে যা কিছু সত্য তা কিছু অর্থে মানসিক অথবা আমরা যা কিছু জানি তা কোন না কোন অর্থে মানসিক। এই ধরনের দার্শনিকদের ভাববাদী বলা হয়। ভাববাদীরা আমাদের বলেন যে জড় বলে যা প্রতিভাত হয় তা আসলে মানসিক : হয় (যেমন লাইবোনিজ বলেন) কোন না। কোন অর্থে স্থূল মন, অথবা (যেমন বার্কলে বলেন) মনের ধারণা, যা আমরা। সাধারণভাবে বলি, যা জড়কে দেখে। এভাবে ভাববাদীরা জড়ের অস্তিত্ব যে মনের থেকে অন্তর্নিহিতভাবে আলাদা তা অস্বীকার করেন। কিন্তু তারা একথা অস্বীকার করেন না যে আমাদের ইন্দ্রিয়-উপাত্ত হল এমন কিছুর প্রতীক, আমাদের ব্যক্তিগত সংবেদনের থেকে যার স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সেই কারণগুলো আলোচনা করবো যা আমার মতে ভুল–যেগুলো ভাববাদীরা তাঁদের মতের স্বপক্ষে পেশ করে থাকেন।