০৩. ছুটির দিনে খোকন

ছুটির দিনে খোকন সাধারণত খুব ভোরে ওঠে। বই নিয়ে পড়তে হবে না এই আনন্দেই ঘুম ভেঙে যায় সকাল সকাল। এখন সবদিনই ছুটি। অনেকদিন ধরে স্কুল হচ্ছে না। তবু এ বাড়ির নিয়মে ছুটি মাত্র একদিন–শুক্রবার। সেদিন ঘুম থেকে ওঠার  জন্যে কেউ ডাকডাকি করবে না। কেউ যদি সারা দিন ঘুমাতে চায় তাহলে তাও পারবে। ছোটরা বাড়ির ভেতর চিৎকার চেঁচামেচি করলেও তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। টিভির সামনে রাত এগারোটা পর্যন্ত বসে থাকলেও কেউ বলবে না-যাও, ঘুমুতে যাও। সেদিন হচ্ছে স্বাধীনতার দিন।

আজ শুক্রবার। খোকন জেগে উঠেছে খুব ভোরে। তার ইচ্ছে হলো কিছুক্ষণ চেঁচিয়ে কাঁদতে। এরকম সুন্দর একটি ঝকঝকে দিনে তাকে ঘরে বসে থাকতে হবে। তাছাড়া আজ দুপুরে স্কুলের বারান্দায় ভয়াল-ছয়ের একটি গোপন জরুরি মিটিং বসবে। সে মিটিং-এ সবাই থাকবে, শুধু সে থাকবে না। সবাই হয়তো ভাববে সে আর ভয়াল ছয়ে নেই। তাকে বাদ দিয়েই আজ নিশ্চয়ই সব ঠিকঠাক হবে। খোকন হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রতনের মা এসে একবার জিজ্ঞেস করল–নাশতা ঘরে দিয়ে যাবে কি না। খোকন বলল, সে আজ নাশতা খাবে না, তার খিদে নেই। রতনের মা দ্বিতীয়বার কিছু বলল না। শুক্রবার খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করা নিষিদ্ধ। কেউ খেতে চাইলে খাবে না। রতনের মা দুমিনিট পরেই আবার এসে হাজির।

দাদাভাই, আপনেরে ডাকে।

কে ডাকে?

আপনের আম্মা।

খোকনের মার শরীর মনে হয় আজ অন্যদিনের চেয়েও খারাপ। মাথার নিচে তিন চারটা বালিশ দিয়ে তাকে শোয়ানো হয়েছে। মুখ রক্তশূন্য। ঘরের বড় বড় জানালায় ভারী পর্দা ঝুলছে। চারদিক অন্ধকার। খোকন ঘরে ঢুকতেই তিনি নিচুগলায় বললেন, কাল বিকেলে তোকে খুঁজছিলাম, কোথায় ছিলি?

মায়ের সামনে খোকন মিথ্যা বলতে পারে না। সে মৃদুস্বরে বলল, বাইরে ছিলাম।

মিছিল-টিছিলে যাস নাই তো?

না।

ঝামেলার মধ্যে যাবি না, কেমন?

আচ্ছা।

বস্ এখানে। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তুই তো আমার ঘরে আসাই বন্ধ করে দিয়েছিস।

খোকন বসল। খোকনের মা বললেন, একটা কমলা খাবি?

না।

না কেন, খা একটা।

তিনি একটি কমলা বের করে দিলেন।

আমার কাছে দে, আমি ছিলে দিচ্ছি।

আমি ছিলতে পারব।

দে আমার কাছে।

খোকনের মা কমলা ছিলতে লাগলেন। কিন্তু দেখে মনে হলো এটুকু কাজ করতেই তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। তিনি টেনে টেনে বললেন, মিস গ্রিফিন বলছিল গণ্ডগোল নাকি প্রায় মিটমাটের দিকে। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নাকি শেখ মুজিবের মিটমাট হয়ে গেছে। এখন নাকি শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবে।

খোকন কিছু বলল না।

মিটমাট হয়ে গেলেই হয়। মনে একটা শান্তি পাওয়া যায়। তাই না খোকন।

হ্যাঁ।

কিন্তু তোর বাবা বলছিল, এত সহজে নাকি কিছু হবে না। পাকিস্তানিরা নাকি চায় না শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হয়। আমি এখন কার কথা বিশ্বাস করি?

খোকন উঠে দাঁড়াল।

মা এখন যাই।

বোস না আরেকটু, বোস।

পরে আসব।

আচ্ছা আসিস। মিছিল-টিছিলে যাস না কিন্তু, লক্ষ্মী বাবা।

বললাম তো আমি যাই না।

ওইসব বাচ্চাছেলেদের জন্যে না।

খোকন নিজের ঘরে এসে মুণ্ডুহীন লাশ পড়তে বসল। মঞ্জুর কাছ থেকে বহু সাধ্য সাধনা করে আনা হয়েছে। কিন্তু পড়তে ভালো লাগছে না। খোকন বই বন্ধ করে জানালার পাশে বসে রইল। জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে টুনুকে। তার জন্যেই ঘুর ঘুর ব্ৰছে বোধহয়। যারা সাধারণ গরিব ঘরের ছেলে তাদের মতো সুখী বোধহয় আর কেউ নেই। কেউ তাদের আটকে রাখে না। যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। এই যে সাজ্জাদ, মিছিল দেখলেই ঢুকে পড়ে। কেউ তাকে কিছু বলে না। একদিন একা একা গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে এল।

খোকন জানালা বন্ধ করে দিল। বাইরে তাকিয়ে থাকতেও খারাপ লাগছে। দোতলার সিড়িতে অনজু আর বিলু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। খোকন কড়াগলায় ধমক দিল, গোলমাল করিস না। ওরা গোলমাল করতেই লাগল। করবে জানা কথা। আজ ছুটির দিন। ওরা কোনো কথা শুনবে না। খোকন ভাবল, ছাদে গিয়ে বসে থাকবে। চুপচাপ।

ছাদে যাবার পথে বাবার সঙ্গে দেখা। বাবা থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার কি অসুখ করেছে?

জি-না।

কাল অনেক রাত পর্যন্ত তোমার ঘরে বাতি জ্বলছিল, কী করছিলে?

কিছু করছিলাম না।

জেগে ছিলে নাকি?

জি।

জেগে ছিলে অথচ কিছুই করছিলে না?

বাবা খুবই অবাক হলেন। বোকনের বাবা রকিব সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন টিচার। ইতিহাস পড়ান। তিনি খুব সহজে অবাক হতে পারেন। তাঁর বেশ কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। যেমন, প্রায়ই খোকনের সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে কথা বলেন। সেসময় তাকে তুমি তুমি করে বলেন। অন্যসময় তুই করে।

খোকন ঠিক করে বললো তো তোমার শরীর খারাপ করেনি তো?

জি-না।

দেখি এদিকে এসো, জ্বর আছে কি না দেখি।

তিনি খোকনের কপালে হাত রাখলেন।

না, জ্বর নেই তো।

রকিব সাহেব আবার অবাক হলেন। যেন জ্বর না থাকাটাও অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার।

কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলে, কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলে নাকি?

হ্যাঁ।

আমাকে বলতে চাও? বলতে চাইলে বলতে পারো।

খোকন ইতস্তত করতে লাগল। বাবা বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। মাঝে মাঝে খোকনের প্রতি তার আগ্রহ খুব বেড়ে যায়। খুব খোঁজখবর করেন। তারপর আবার আগ্রহ কমে যায়। বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিছুই আর মনে থাকে না।

আমরা ছয়জন বন্ধু মিলে একটা দল করেছি। দলের নাম ভয়াল-ছয়।

বলো কী! খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। দলের কাজ কী?

আমার ভূ-পর্যটন করব।

ভূ-পর্যটন করবে?

হ্যাঁ। প্রথমে যাব আফ্রিকা।

বাহ, বেশ মজার তো।

বাবা এবার আর অবাক হলেন না। হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ছোটবেলায় আমিও একটা দল করেছিলাম। আমাদের দলের কাজ ছিল গুপ্তধন খুঁজে বের করা। কোনো গুপ্তধন আমরা খুঁজে পাইনি। তখন আমার বয়স ছিল বারো কি তেরো। তোমার এখন কত বয়স?

তেরো বছর তিন মাস।

এই বয়সটাই হচ্ছে দল করবার বয়স।

বাবা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।

কবে যাচ্ছ আফ্রিকায়?

এখনো ঠিক হয়নি।

তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলা দরকার। আমরা সবসময় শুধু পরিকল্পনা করি। কাজ আর করা হয় না। তোমরা যদি একদিন সত্যি সত্যি হাঁটতে শুরু করো, তাহলে ভালোই হবে। মাইল দশেক যেতে পারলেও অনেক কিছু শিখবে।

বাবা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। খোকন বুঝতে পারল না এখন তার কী করা উচিত। চলে যাওয়া উচিত না দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। কারণ বাবার অন্যমনস্কতা খুব বিখ্যাত। একবার শুরু হলে দীর্ঘ সময় থাকে। তখন কাউকে চিনতে পারেন না।

খোকন।

জি।

ছুটির দিনে তুমি তোমার দলের সঙ্গে না থেকে ঘরে বসে আছ কেন?

বড়চাচা বলেছেন আজ কোথাও বেরুতে পারব না।

ও আচ্ছ। কারণটা কী?

খোকন কারণ বলল। রকিব সাহেব বললেন, শাস্তিটা একটু মনে হয় বেশি হয়ে গেছে। তোমার কী মনে হয়?

খোকন কিছু বলল না।

তোমার বড়চাচা হয়তো ভেবেছেন তুমি মিছিল-টিছিলে গিয়েছ, সেজন্যেই এমন শাস্তি। তুমি গিয়েছিলে নাকি?

না।

কখনো যাওনি?

খোকন চুপ করে রইল।

কয়েকবার গিয়েছ, তাই না?

হ্যাঁ।

আমার কী মনে হয় জানো? আমার মনে হয়, মিছিল করবে যুবকরা। মিছিল হচ্ছে প্রতিবাদের ভাষা। এ কাজটি যুবকদের জন্যে। শিশুরা শিখবে, যুবকরা কাজ করবে, বৃদ্ধরা ভাববে। ঠিক না?

হ্যাঁ।

রকিব সাহেব হঠাৎ করে খানিকটা গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমার কি ধারণা শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হবেন?

আমি জানি না। এ নিয়ে কখনো ভেবেছ?

না।

আমি অবশ্যি অনেক ভেবেছি। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করা ছাড়া ওদের উপায় নেই। ইলেকশনে জিতেছেন। কিন্তু ওরা করতে চাহে না। ওদের অজুহাত বের করতে হবে। কী অজুহাত দেবে সেটাও একটা সমস্যা। সমস্যা নয়?

হ্যাঁ।

এদিকে ভুট্টো সাহেব বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আমার দল সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। তার মানে কী বলতে পারো?

না।

ভুট্টো সাহেবই পাকিস্তানকে দুটি অংশ হিসেবে ভাবছেন। অথচ তারা দোষ  আমাদের। ভাবখানা এরকম যেন আমরাই পকিস্তানকে দুভাগে ভাগ করতে চাচ্ছি।

আমরা চাচ্ছি না?

ওরা যা শুরু করেছে তাতে চাওয়াই উচিত। আমি অন্তত চাই। তবে যারা একসময় পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছেন, দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন, তারা নিশ্চয়ই চান না। যেমন তোমার বড়চাচা।

বড়চাচা চান না?

মনে হয় না। তবে আমার ভুলও হতে পারে।

শেষপর্যন্ত কী হবে? পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাবে?

নির্ভর করছে ওদের ওপর। ওরা যদি আমাদের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করে তাহলে হয়তোবা ওদের সঙ্গে থাকা যাবে। কিন্তু ওরা আমাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। পরিস্থিতি ভালো না।

বাবা কথা শেষ না করেই চটি ফটফট করে তার ঘরে ঢুকে গেলেন। খোকন চলে গেল ছাদে। এ বাড়ির ছাদটা প্রকাও। রোজ বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলে অনজু আর বিলু। চুন দিয়ে ঘর আঁকা আছে।

খোকন বেশ খানিকক্ষণ একা একা ঘুরে বেড়াল। ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছিল না। আবার নিচে যেতেও ইচ্ছা করছিল না। একসময় রতনের মা এসে বলল, এখন নাশতা দেই?

বললাম তো কিছু খাব না।

এক গ্লাস দুধ আইন্যা দিমু।

না।

আপনেরে আম্মা ডাকে।

একটু আগেই গেলাম। আবার?

হ্যাঁ। আসেন আমার সাথে।

খোকন দেখল তার মা হাঁপাচ্ছেন। অসুখ বোধহয় খুব বেড়েছে। খোকন বলল, মা ডেকেছ?

হ্যাঁ, তুই নাকি কিছু খাস নাই? কেনরে ব্যাটা, কারও উপর রাগ করেছিস?

না।

আমি তো কোনো খোঁজখবর করতে পারি না। কী খাস না-খাস কে জানে!

আমি ঠিকই খাই।

মা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, রতনের মা, যাও তো খোকনের খাবার নিয়ে এসো। আমার সামনে বসে সে খাবে। খোকনের একবার ইচ্ছা হলো বলে, ছুটির দিনে খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি করা যাবে না। বডচাচার নিষেধ আছে। কিন্তু সে কিছু বলল না। মাকে কষ্ট দিতে তার কখনো ইচ্ছা করে না। মা এত ভালো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *