চা খেয়ে সোমনাথ চুপচাপ বসেছিল। কী করবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। হাত-পা গটিয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া বেকারদের কীই-বা করবার আছে।
কমলা বউদি ওপর থেকে ইংরিজি খবরের কাগজখানা নামিয়ে আনলেন। সোমনাথ দেখলো, বাবা ইতিমধ্যেই কয়েকটা চাকরির বিজ্ঞাপনে লাল পেন্সিলের মাকা দিয়েছেন। বাবার এইটাই প্রাত্যহিক কাজ। খবরের কাগজে প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে বাবা সর্বপ্রথম দ্বিতীয় পাতায় ‘চাকরি খালি’ শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনগুলো পড়ে ফেলেন। প্রয়োজন মতো লাল দাগ মারেন। বিজ্ঞাপনগুলো তখন কাটেন না, কারণ বাড়ির অন্য লোকেরা কাগজ পড়বে। দুপুরে খাবার পর কমলা বউদি আবার খবরের কাগজগুলো বাবার কাছে পৌঁছে দেন। বাবা নিজের হাতে ব্লেড দিয়ে বিজ্ঞাপনগুলো কেটে সোমনাথের কাছে পাঠিয়ে দেন।
কমলা বউদির ইচ্ছে নয় সোমনাথ চুপচাপ বাড়িতে বসে সময় কাটায়। তাই প্রায় জোর করেই একবার ওকে গড়িয়াহাট বাজারে পাঠালেন। বললেন, “তোমার দাদা নেই-শ্রীমান ভজহরির ওপর প্রত্যেকদিন নির্ভর করতে সাহস হয় না। বেশি দাম দিয়ে খারাপ জিনিস নিয়ে আসে। ওর দোষ নয়, গরীব মানুষ দেখলে আজকাল দোকানদাররাও ঠকায়।”
পাজামার ওপর একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে সোমনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। হাতে থলে নিয়ে যে সোমনাথ গড়িয়াহাট বাজার থেকে পুকুরের বাটা মাছ কিনছে তা দেখে কে বলবে বাংলার লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য বেকারদের সে একজন? জিনিসপত্তর কিনতে কিনতে অনেকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অফিস যাবার মতো যথেষ্ট সময় আছে কিনা দেখে নিচ্ছেন। সোমনাথের কীরকম অস্বস্তি লাগছে—ওর যে অফিসে যাবার তাড়া নেই তা লোকে বুঝুক সে মোটেই চায় না।
কলেজে পড়বার সময়ে সোমনাথ কতবার বাজার করেছে। কিন্তু কখনও এই ধরনের অস্বস্তি অনুভব করেনি। পরিচিত কারুর সঙ্গে বাজারে বা রাস্তায় দেখা হলে তার ভালোই লেগেছে। কিন্তু এখন দূর থেকে কাউকে দেখুলেই সে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। কারণ আর কিছু নয়, লোকে বেমালুম জিজ্ঞেস করে বসে, “কী করছো?” যতদিন কলেজের খাতায় নাম ছিল, ততদিন উত্তর দেবার অসুবিধা ছিল না। যত মুশকিল এখনই।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। বাজারের গেটের কাছেই সোমনাথ শুনতে পেলো, “সোমনাথ না? কী ব্যাপার তোমার, অনেকদিন কোনো খবরাখবর নেই!”
সোমনাথ মুখ তুলে দেখলো অরবিন্দ সেন। ওদের সঙ্গেই কলেজে পড়তো। অরবিন্দ নিজেই বললো, “ইউ উইল বি গ্লাড, টু নো বেস্ট-কীন-রিচার্ডসে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হয়েছি। এখন সাতশ’ দিচ্ছে। গড়িয়াহাট মোড় থেকে মিনিবাসে কোম্পানির ফ্যাকটরিতে নিয়ে যায়। এখানে সাড়ে-সাতটার সময় আমাকে রোজ দেখতে পাবে। রাস্তার ওপারে দাঁড়াই-সিগারেট কেনবার জন্যে ভাগ্যিস এইপারে এসেছিলাম তাই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।”
সোমনাথ দেখলো অরবিন্দের হাতে গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট। “খাবে নাকি একটা?” অরবিন্দ প্যাকেট এগিয়ে দিলো।
সোমনাথ সিগারেট নিলো না। অরবিন্দ হেসে ফেললো। “তুমি এখনও সেই ভালো ছেলে রয়ে গেলে? মেয়েদের দিকে তাকালে না, সিগারেট খেলে না, অশ্লীল ম্যাগাজিন পড়ো না।”
অরবিন্দ এবার জিজ্ঞেস করে বসলো, “তুমি কী করছো?”
সোমনাথ অত্যন্ত লজ্জা বোধ করছে। দিতে দিতে চাকরির অ্যাপ্লিকেশন লেখা ছাড় সে যে আর কিছুই করছে না তা জানাতে মাথা কাটা যাচ্ছে সোমনাথের। কোনো রকমে আমতা আমতা করে বলতে যাচ্ছিল, “দেখা যাক, ধীরে সুস্থে কী করা যায়।”
কিন্তু তার আগেই অরবিন্দ বললো, “চেপে রাখবার চেষ্টা করছো কেন ভাই? শুনলাম, ফরেনে যাবার প্রোগ্রাম করে ফেলেছো? তা ভাই, ভালোই করছো। আমরা এই ভোর সাড়ে সাতটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে, পাঁচ বছর কারখানায় তেল-কালি মেখে বেস্ট-কী—রিচার্ডসের জুনিয়র অফিসার হবো। আর তুমি তিন বছর পরে ফরেন থেকে ফিরে এসে হয়তো বেস্ট-কীনেই আমার বস হয়ে বসবে।”
ফরেন যাবার কথাটা যদিও পুরোপুরি মিথ্যে, তবও সোমনাথের মন্দ লাগছে না। “কে বললো তোমাকে?” সোমনাথ প্রশ্ন করলো।
“নাম বলতে পারবো না–তবে তোমারই কোনো ফ্রেন্ড,” অরবিন্দ উত্তর দিলো।
“গার্ল ফ্রেন্ডও হতে পারে,” এই বলে অরবিন্দ এবার রহস্যজনকভাবে হাসলো। “বেশ গোপনে কাজটা সেরে ফেলবার চেষ্টা করছো তুমি,” বললো অরবিন্দ।
দূর থেকে বেস্ট-কীন-রিচার্ডসের ঝকঝকে মিনিবাস আসতে দেখে অরবিন্দ বললো, “তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। দু-একদিনের মধ্যেই তোমার সঙ্গে দেখা করবার প্রয়োজন হবে। সামনের রবিবারে বিকেলটা ফ্রি রেখো। কারণটা যথা সময়ে জানতে পারবে। তোমার বাড়ির নম্বর?”
সোমনাথ বাড়ির নম্বরটা বলে দিলো। অরবিন্দ ততক্ষণে ছুটে গিয়ে মিনিবাস ধরে ফেলেছে।
বাজারের থলিটা বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে বসে সোমনাথ ভাবছিল ফরেন যেতে পারে শুনে অরবিন্দ সেন বেশ খাতির করে কথা বললো। ওর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের বড় অফিসার। ছোট একটা গাড়ি ড্রাইভ করে কলেজে আসতো। সোমনাথের সঙ্গে তেমনভাবে মিশতো না অরবিন্দ। কিন্তু বিদেশে যাবার এই গল্পটা কে বানালো? দু-একজন পরিচিত মহিলার মুখ মনে পড়ে গেলো। কয়েকটা ছবি সরাবার পর হঠাৎ তপতীর মুখটাও চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তপতীই হয়তো অস্বস্তি এড়াবার জন্য রত্নাকে গল্পটা বলেছে। কলেজে রত্নার সঙ্গে তপতীর খুব ভাব ছিল। অরবিন্দ যে রত্নর সঙ্গে জমিয়ে প্রেম করেছে এ-খবর কারুর অজানা নয়।
কিন্তু তপতী জেনেশুনে কেন এইভাবে বন্ধু মহলে সোমনাথকে অপ্রস্তুত করতে যাবে? সোমনাথ আরও কিছু ভাবতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার চিন্তায় বাধা পড়লো। বাইরে ইলেকট্রিক কলিং বেল বাজছে।
কমলা বউদি খবর দিলেন সুকুমার এসেছে। রোগা, কালো, বেশ লম্বা, মিষ্টি স্বভাবের এই ছেলেটি সম্পর্কে কমলা বউদির একটু দুর্বলতা আছে। ও বেচারাও বেকার। ওর উজ্জ্বল অথচ অসহায় চোখ দুটোর দিকে তাকালে মায়া হয় কমলার।
বাইরের ঘরে সোমনাথ ঢুকতেই সুকুমার বললো, “তোর হলো কী? সাড়ে-আটটা বেজে গেছে, এখনও বিছানার মায়া কাটাতে পারিসনি?”
সোমনাথ যে ইতিমধ্যে বাজার-হাট সেরে ফেলেছে তা চেপে গেলো। বললো, “বেকারের কী আর করবার আছে বল?”
“ফের আবার ওই অশ্লীল কথাটা মুখে আনলি। তোকে বলেছি না, ‘বিধবার’ মতো ‘বেকার’ কথাটা আমার খুব খারাপ লাগে। আমরা চাকরি খুঁজছি, সুতরাং আমাদের চাকুরী-প্রার্থী বলতে পারিস।”
“তুই যে আবার প্রথম ভাগের গোপাল হবার পরামর্শ দিচ্ছিস-কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া, যেকারকে বেকার বলিও না,” সোমনাথ মন্তব্য করলো।
সুকুমার বললো, “দাঁড়া মাইরি। কড়া রোদ্দরে যাদবপুর কলোনি থেকে হাঁটতে হাঁটতে এই যোধপুর পার্কে এসেছি। গলা শুকিয়ে গেছে, একটু খাবার জল পেলে মন্দ হতো না।”
কমলা বউদি ঠাণ্ডা জল নিয়ে এলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “চা খাবে তো, সুকুমার?”
সুকুমার খুব খুশী হলো। বললে, “বউদি, যুগ যুগ জিও।”
বউদি চলে যেতে সুকুমার বন্ধুকে বললো, “তুই মাইরি খুব লাকি। যখন তখন চায়ের অর্ডার দেবার সিস্টেম আমাদের বাড়িতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাই অর্ডার অফ দি হোম বোর্ড।” সুকুমারের কিন্তু সেজন্যে কোনো অভিমান নেই। ফিক করে হেসে, বন্ধুকে জানিয়ে দিলো, দাঁড়া, একখানা চাকরি যোগাড় করি। তারপর বাড়িতে আমূল বিপ্লব এনে ছাড়বো। যখন খুশী চায়ের জন্যে একটা ইলেকট্রিক হিটার কিনে ফেলবো। চা চিনি দুধের খরচ পেলে বাড়িতে কেউ আর রাগ করবে না।”
সুকুমারটা সত্যিই অভাগা। ওর জন্যে সোমনাথেরও কষ্ট হয়। শুনেছে, যাদবপরে একটা টালির ছাদের কাঁচা বাড়িতে থাকে। ওর তিনটে আইবুড়ো বোন! টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছে না। গত বছর সুকুমারের বাবার রিটায়ার হবার কথা ছিল। সায়েবের হাতে-পায়ে ধরে ভদ্রলোক এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিন মাস পয়েই চাকরি শেষ হবে। তারপর ওদের কী যে হবে। সুকুমারই বড়। আরও দুটো ভাই ছোট, নীচু ক্লাসে পড়ে। এই ক’মাসে একটা কাজ যোগাড় না হলে কেলেঙ্কারি। বাবার পেনসন নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা ধার নেওয়া আছে। তার ওপর কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে কিছু দেনা আছে বাবার। বড়দির বিয়ে দিতে গিয়ে সেবার ধার না করে উপায় ছিল না। এ-সব বাদ দিয়ে সুকুমারের বাবা হয়তো হাজার ছয়েক টাকা পাবেন। তিনি ভাবছেন তিন ভাগ করে তিন মেয়ের নামে দু’হ্যজার করে লিখে দেবেন। সুকুমারের বাবা অবশ্য জানেন, দু’হাজার টাকায় আজকাল বস্তির ঝিদেরও বিয়ে হয় না। কিন্তু মেয়েরা যেন না ভাবে, বাবা তাদের জন্য কিছুই করেননি।
সুকুমারকে এ-বাড়ির সবাই জানে। সোমনাথের সঙ্গে সে একই কলেজে পড়েছে। সোমনাথের মতোই সেকেন্ড ডিভিসনে পাস করেছিল সুকুমার। তারপর সোমনাথের মতোই সাধারণভাবে বি-এ পাস করেছে। সুকুমার হয়তো আর একটু ভালো করতে পারতো কিন্তু পরীক্ষার ঠিক আগে মায়ের ভীষণ অসুখ করলো। এই যায় এই যায় অবস্থা—ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত দিয়ে, সারারাত জেগে রোগীর সেবা করে সুকুমারকে পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। মেজবোন কণা বকাবকি না করলে সুকুমারের পরীক্ষাই দেওয়া হতো না।
চায়ের কাপ নামিয়ে কমলা বউদি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছো, সুকুমার?”
এক গাল হেসে সুকুমার উত্তর দিলো, “খারাপ নই, বউদি। সামনে অনেকগুলো চাকরির চান্স আসছে।”
কমলা বউদি সস্নেহে বললেন, “চা বোধহয় খুব কড়া হয়নি; তুমি তো আবার পাতলা চা পছন্দ করো না।”
সুকুমার দেখলো চায়ের সঙ্গে বউদি দুখানা বিস্কুটও দিয়েছেন। হাত দুটো দ্রুত ঘষে সুকুমার বললো, “বউদি, ভগবান যদি আপনাকে ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের পার্সোনেল ম্যানেজার করতেন!”
বুঝতে না পেরে সোমনাথ প্রতিবাদ করলো। “কেন রে? বউদি কোন দুঃখে ব্যাঙ্কের চাকর হতে যাবে?”
সরল মনে সুকুমার বললে, “বউদির একটু কষ্ট হতো স্বীকার করছি। কিন্তু তোর এবং আমার একটা হিল্লে হয়ে যেতো। দুজনে বউদির অফিস ঘরে ঢুকে পড়লে বউদি শুধু আদর করে চা খাইয়ে ছাড়তেন না-সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটাও দিয়ে দিতেন।”
সুকুমারের কথা শুনে কমলাও হেসে ফেললো। দুই বেচারার মখের দিকে তাকিয়ে কমলার মনে হলো ওরকম একটা বড় পোস্ট থাকলে মন্দ হতো না। অন্তত এদের মখে একটু হাসি ফোটানো যেতো।
সুকুমার কিন্তু চাকরির আশা এখনও ছাড়ে নি। সব সময় ভাবে, এবারে একটা কিছু, সুযোগ নিশ্চয় এসে যাবে। চা খেতে-খেতে সে সোমনাথকে বললো, “আর ক’টা দিন। তারপর হয়তো দেশে বেকার বলে কিছু থাকবেই না।”
সোমনাথ নিজেও এক সময় এই ধরনের কথা বিশ্বাস করতো। এখন ভরসা কমেছে।
সুকুমার বললো, “একেবারে ভিতরের খবর। রেল এবং পোস্টাপিসে দু’ হাজার নতুন পোস্ট তৈরি হচ্ছে। মাইনেও খুব ভাল–টু হানড্রেড টেন। সেই সঙ্গে হাউস রেন্ট, ডি-এ। তারপর যদি কলকাতায় পোস্টিং করিয়ে নিতে পারি তাহলে তো মার দিয়া কেল্লা। ঘরের খেয়ে পুরো মাইনেটা নিয়ে চলে আসবো অথচ ক্যালকাটা কমপেনসেটরি অ্যালাউন্স পাবো মোটা টাকা।”
সোমনাথ এবার একটু উৎসাহ পেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘কিন্তু এই ক্যালকাটা কমপেনসেটরি’ ব্যাপারটা কী রে?
সুকুমার হেসে ফেললো। “ওরে মূর্খ, তোকে আর কী বোঝাবো? চাকরি করবার জন্যে কলকাতায় থাকতে তো আমাদের কষ্ট হবে—তাই মাইনের ওপর ক্ষতিপূরণ ভাতা পাওয়া যাবে।”
এই ব্যাপারটা সোমনাথের জানা ছিল না। “বারে! চিরকালই তো তুই আর আমি কলকাতায় আছি-এর জন্যে ক্ষতিপূরণ কী?” সোমনাথ বোকার মতো জিজ্ঞেস করে। কাল্পনিক চাকরির সুখ-সুবিধে এবং মাইনে সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করতে ওদের দুজনেরই ভালো লাগে।
সুকুমার বিরক্ত হয়ে বললো, “বেশ বাবা, তোর যখন এতোই আপত্তি, চাকরিতে ঢুকে তুই অ্যালাউন্স নিস না।”
এবার দুজনেই হেসে ফেললো। একসঙ্গে দুজনেই যেন হঠাৎ বুঝতে পারলো ওরা জেগে স্বপ্ন দেখছে, এমনভাবে কথা বলছে যেন চাকরিটা ওদের পকেটে।
সারাদিন টো-টো করে সমস্ত শহর চষে বেড়ায় সুকুমার। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ, রাইটার্স বিল্ডিংস, ক্যালকাটা কর্পোরেশন, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, কারখানা, অফিস কিছুই বাদ দেয় না। তাছাড়া বিভিন্ন দলের বেশ কয়েকজন এম-এল-এ এবং দুজন কর্পোরেশন কাউনসিলর-এর সঙ্গেও সুকুমার ভাব জমিয়ে এসেছে।
সুকুমার বললো, “কদিন আগে বাবা হঠাৎ আমার ওপর রেগে উঠলেন। ওঁর ধারণা আমি চাকরির জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি না। ভাইবোনদের সামনে চীৎকার করে উঠলেন, হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকলে কোলের ওপর চাকরি ঝপাং করে পড়বে না। সেই থেকে এই ‘ঘুরঘুরে’ পলিসি নিয়েছি। দিব্যি কেটেছি, দুপুরবেলায় বাড়িতে বসে থাকবো না।”
সোমনাথ অজানা আশঙ্কায় চুপ করে রইলো। সুকুমারের সংসারের কথা শুনলে ওর কেমন অস্বস্তি লাগে। যে-সুকুমার দঃখ ভোগ করছে, সে কিন্তু মান-অপমান গায়ে মাখছে না। বেশ সহজভাবে সুকুমার বললো, “আমি ভেবেছিলাম মা আমার দুঃখ বুঝবে। কিন্তু মা-ও সাপোর্ট করলো বাবাকে। আমি ভাবলাম, একবার বলি, কলকাতা শহরে ঘোরাঘুরি করতে গেলেও পয়সা লাগে। যাদবপুর থেকে ডালহৌসি স্কোয়ার তো দুবেলা হেঁটে মারা যায় না।”
সুকুমারের কথাবার্তায় কিন্তু কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। অপমান ও দুঃখের বোঝাটা বেশ সহজভাবেই মাথায় তুলে নিয়েছে।
সুকুমারের সান্নিধ্য আজকাল সোমনাথের বেশ ভালো লাগে। কলেজে একসঙ্গে পড়েছে, তখন কিন্তু তেমন আলাপ ছিল না। সুকুমারকে সে তেমন পছন্দ করতো না–নিজের পরিচিত কয়েকজন বন্ধু ও বান্ধবীদের নিয়েই সোমনাথের সময় কেটে যেতো। চাকরি-বাকরির দুঃস্বপ্ন যে এমনভাবে জীবনটাকে গ্রাস করবে তা সোমনাথ তখনও কল্পনা করতে পারে নি।
কিন্তু বি-এ পরীক্ষায় পাসের পর আড়াই বছর আগে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লাইনে দুই সহপাঠীতে দেখা হয়ে গেলো। সাড়ে-পাঁচ ঘণ্টা ধরে দুজনে একই লাইনে দাঁড়িয়েছিল। বাদাম ভাজা কিনে সুকুমার ভাগ দিয়েছিল সোমনাথকে। একটু পরে ভাঁড়ের চা কিনে সোমনাথ বন্ধুকে খাইয়েছিল। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সোমনাথের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। এই ধরনের অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয় নি। সোমনাথের মনের অবস্থা সুকুমার সহজেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সুকুমারের মনে তখন অনেক আশা। বন্ধুকে উৎসাহ দিয়ে সে বলেছিল, “ভাবিস না, সোমনাথ। দেশের এই অবস্থা চিরকাল থাকতে পারে না। চাকরিবাকরি আমাদের একটা হবেই।”
দুজনে ঠিকানা বিনিময় করেছিল। কয়েকদিন পরেই সুকুমার যোধপুর পার্কের বাড়িতে সোমনাথের খোঁজ করতে এসেছিল। সোমনাথের সাজানো-গোছানো বাড়ি দেখে সুকুমার খুব আনন্দ পেয়েছিল। কথায় কথায় সুকুমার একদিন বলেছিল, “আমাদের মাত্র দেড়খানা ঘর। বসতে দেবার একখানা চেয়ারও নেই। চাকরি-বাকরি হলেই ওসব দিকে একটু নজর দিতে হবে। দুটো চেয়ার, একটা টেবিল, জানালার পর্দা—কিনতেই হবে। আমার বোন পর্দার রং পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছে, কোন দোকান থেকে কিনবে তাও ঠিক, শুধু আমার চাকরি হবার অপেক্ষা।”
ওদের বাড়িতে যাবার মতলব করেছে সোমনাথ। কিন্তু সুকুমার উৎসাহ দেয় নি। সোজাসুজি বলেছে, “চাকরিটা হোক, তারপর একদিন তোকে নেমন্তন্ন করে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো। এখন যা বাড়ির মেজাজ, তোকে নিজে থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত দেবে না। ঘরের মধ্যে বসাতে পারবো না, বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলতে হবে।”
সুকুমার বিব্রত হবে ভেবেই সোমনাথ ওদের বাড়িতে যাবার প্রস্তাব তোলে নি। কিন্তু দুই বন্ধুতে প্রায় দেখা হয়েছে। যোধপর পাক থেকে গল্প করতে করতে ওরা কখনও সেলিমপরের মোড়ে চলে গেছে। দুজনে সমব্যথী, সুখ-দুঃখের কত কথা হয় নিজেদের মধ্যে।
আজও সুকুমার বললো, “বাড়িতে বসে থেকে কী করবি? চল, একটু ঘরে আসি।”
বাড়ি থেকে বেরোবার, সুযোগ পেয়ে সোমনাথ রাজী হয়ে গেলো। ট্রাউজারের ওপর একটা বুশ শার্ট গলিয়ে নিয়ে সুকুমারের সঙ্গে সে পথে বেরিয়ে পড়লো।
রাস্তায় সকালের জনপ্রবাহ দেখে সোমনাথ নিজের দুঃখের কথা ভাবে। পৃথিবীটা যে কত নিষ্করুণ তা সে বোধহয় এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। বাড়িতে দাদা বউদি বাবা সবাই এতো ভালোবাসেন—এতে তার প্রতিপত্তি—কিন্তু বাড়ির বাইরে এই জন-অরণ্যে তার কোনো দাম নেই। অন্যের সঙ্গে লড়াই করে একটা সামান্য দশটা-পাঁচটার চাকরি পর্যন্ত সে যোগাড় করতে পারছে না।
সুকুমার জিজ্ঞেস করলো, “কী হলো তোর? গম্ভীর হয়ে গেলি কেন?”
সোমনাথ বললো, “ভাবছি, বাড়ির ভিতরের সঙ্গে বাড়ির বাইরের কত তফাৎ।”
“মারো গুলি! কবিতা ছাড়,” সুকুমার এবার বকুনি লাগালো। “তুই ভাগ্যবান। বেশির ভাগ লোকের ভেতর-বাইরে দুই-ই কেরোসিন। আমার অবস্থা দেখ না। জুলাই মাস থেকে বাবার চাকরি থাকবে না। বাড়ির বড় ছেলে, অথচ সংসারে কোনো প্রেস্টিজ নেই।”
“কেন?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করে।
“চাকরি থাকলে প্রেস্টিজ হতো। এখন বাবা মা ভাই বোন সবাই বলে, গুড ফর নাথিং। অনেক ইয়ংম্যান নাকি এই বাজারেও চাকরি ম্যানেজ করেছে। শুধু আমি পারছি না। বাবা মাঝে মাঝে বলেন, ‘ভস্মে ঘি ঢেলেছি, সুকুমারকে বি-এ পড়িয়ে কী ভুলই যে করেছি।’ বিদ্যে না থাকলে আমি নাকি কারও বাড়িতে চাকর-বাকর হয়ে নিজের পেটটা অন্তত চালাতে পারতাম।”
সোমনাথ কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ গড়িয়াহাটের দিকে হাঁটতে লাগলো। বাঁ হাতের আঙুল মটকিয়ে সুকুমার বললো, “আমিও কী ভুল যে করেছি! মা কালীকে পুজো দিয়ে ইস্কুল ফাইনালে যদি ফার্স্ট ডিভিসন বাগাতে পারতাম, তাহলে এতোদিন চাকরি কাকে বলে দেখিয়ে দিতাম।”
সোমনাথ বললো, “শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছিস কেন? তোর আমার সেকেন্ড ডিভিসন কাঁচিয়ে তো আর ফার্স্ট ডিভিসন করা যাবে না!”
সুকুমার বললে, “বড় দুঃখ লাগছে মাইরি। ব্রেবোর্ন রোডের একটা ব্যাঙ্কে স্কুল ফাইনালে ফার্স্ট ডিভিসন হলে কেরানির চাকরি দিচ্ছে—মিনিমাম ৬৪% নম্বর দেখাতে হবে।”
সোমনাথ আপসোস করলো না। সে আজকাল অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। বললো, “ওটাও এক ধরনের চালাকি।”
সুকুমার বললো, “চালাকি বললেই হলো। ব্যাঙ্কের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দিয়েছে।”
“যে-ছেলে স্কুল ফাইনালে শতকরা ৬৪ নম্বর পেয়েছে, সে কোন দুঃখে লেখাপড়া কুলঙ্গিতে রেখে ব্যাঙ্কে ঢুকতে যাবে?” সোমনাথ বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে জানতে চাইলো।
“এ-পয়েন্টটা আমার মাথায় আসেনি। সাধে কি আর বাবা বলেন, আমার মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছু নেই!” সুকুমারের মুখটা মলিন হয়ে উঠলো।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা গোলপার্কের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সকালবেলার অফিস টাইম। অনেকগুলো প্রাইভেট মোটর গাড়ি হস-হস করে বেরিয়ে গেলো। বাসে, ট্যাক্সিতে, মিনিবাসে তিল ধারণের জায়গা নেই। সুকুমার হাঁ করে ওই ব্যস্ত জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বললো, “না ভাই আর তাকাবো না। শেষ পর্যন্ত কারও চাকরিতে শনির দৃষ্টি লেগে যাবে। মনকে যতই শাসন করবার চেষ্টা করছি, বেটা ততই পরের চাকরিতে নজর দিচ্ছে। লোভের মাল ফেলতে-ফেলতে ভাবছে—এতো লোকের চাকরি আছে অথচ সুকুমার মিত্তির কেন বেকার?”
সোমনাথ বললো, “যত লোককে অফিস যেতে দেখছি, এরা প্রত্যেকে ফার্স্ট ডিভিসনে স্কুল ফাইনাল পাস করেছে বলছিস?” সুকুমার বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলো। মাথা চুলকে বললো, “খুব ডিফিকাল্ট কোশ্চেন করেছিস। তোর বেশ মাথা আছে। হাজার হোক ছোটবেলায় দুধ-ঘি খেয়েছিস। তুই কেন পড়াশোনায় সোনার চাঁদ হলি না, বল তো?”
মন্দ বলেনি সুকুমার। পড়াশোনায় দাদাদের মতো ভালো হলে, সত্যিই সোমনাথের দুঃখের কিছু থাকতো না। নিজের মনের কথা সোমনাথ কিন্তু প্রকাশ করলো না। সুকুমারের যা স্বভাব, হয়তো কমলা বউদিকেই একদিন সব কথা বলে বসবে। সোমনাথ তাই পুরোনো প্রসঙ্গ তুলে বললো, “শক্ত শক্ত কোশ্চেন অনেক মাথায় আসে, কিন্তু উত্তর খুঁজে পাই না।”
সুকুমার মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললো, “তোর কোশ্চেনটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। দাঁড় একটু চিন্তা করে দেখি।”
দরে একটা পাঁচ নম্বর গড়িয়া-হাওড়া বাসে বাদড়-ঝোলা অবস্থায় সুকুমারের বাবাকে মুহূর্তের জন্যে দেখা গেলো। জন পঞ্চাশেক লোক হাঁই-হাঁই করে সেই দিকে ছুটে গেলেও বাস থামলো না, নিপুণভাবে আরও দু’খানা বাসকে পাশ কাটিয়ে মহরতের মধ্যে পালিয়ে গেলো। সুকুমার সেইদিকে তাকিয়ে বললো, “আমার বাবার কথাই ধর না। থার্ড ডিভিসনও নয়। রেড-আপ-টু, ম্যাট্রিক। অফিসে কেরানি হয়েছে তো?”
সোমনাথ বললো, “ও সব ইংরেজ আমলের ব্যাপার। তখন তো আমরা স্বাধীন হইনি।”
সুকুমার ছেলেটা সরল, একটু বোকাও বটে। সংসারের ঘাটে ঘাটে অনেক ধাক্কা খেয়েও একেবারে সিনিক হয়ে ওঠেনি। সে বললো, “তাহলে তো ইংরেজরাই ভালো ছিল। ননম্যাট্রিকও তাদের সময়ে অফিসে চাকরি পেতো—আর এখন হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বাড়িতে বসে রয়েছে।”
“তোর চাকরির জন্যে তাহলে ইংরেজকে ফিরিয়ে আনতে হয়, সোমনাথ টিপ্পনী কাটলো।
“আমি ভাই তোকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি—সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা এসব কিছুই বুঝতে চাই না। যে আমাকে চাকরি দেবে, আমি তার দলে—সে মহম্মদ আলী জিন্নাহ, মাও-সে-তুং হলেও আমার আপত্তি নেই।”
“আস্তে! আস্তে!” সুকুমারকে সাবধান করে দিলো সোমনাথ। “কেউ শুনলে বিপদ হবে। পাকিস্তানের স্পাই বলে চালান করে দেবে।”
বেজায় রেগে উঠলো সুকুমার। “মগের মুলুক নাকি! চালান করলেই হলো? অ্যারেস্ট করলে জেলের মধ্যে বসিয়ে রোজ খিচুড়ি, আলচচ্চড়ি খাওয়াতে হবে। তার থেকে একখানা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে সমস্যা সমাধান করে ফেললা না বাবা! চাকরি পেলে তোমাদের কোনো হাঙ্গামা থাকবে না। তখন জিন্নাহ, নিক্সন, মাও-সে-তুং, রানী এলিজাবেথ কারও নাম মুখে আনবো না—একেবারে সেন্ট পারসেন্ট স্বদেশী বনে যাব। একদম দিল হ্যায় হিন্দস্থানী!”
“সি-আই-ডি কিংবা আই-বি’র লোকেরা যদি এসব শোনে, কোনোদিন তোর সরকারী চাকরি হবে না। জানিস তো, আপয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু করবার আগে পুলিশে খোঁজখবর হয়—দুজন গেজেটেড অফিসারের চরিত্র-সার্টিফিকেট লাগে।” সোমনাথের বকুনিতে সুকুমার এবার ভয় পেয়ে গেলো।
বললো, “যা বলেছিস, মাইরি। হাটের মধ্যে দাঁড়িয়ে রাজনীতির গোবর ঘেটে লাভ নেই। বহু ছেলে তো ওই করে ড়ুবেছে। তারা পলিটিকস করেছে, দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার মেরেছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পার্টি ফান্ডের জন্যে চাঁদা আদায় করেছে, ঝান্ডা তুলেছে, মিছিলে যোগ দিয়েছে, স্লোগান তুলেছে, মনুমেন্টের তলায় নেতাদের বক্তৃতা শুনেছে—ভেবেছে এই সব করলেই সহজে চাকরি পাওয়া যাবে। এখন অনেক বাছাধন ভুল বুঝতে পেরে আঙুল চুষছে।”
সোমনাথ গম্ভীর হয়ে বললো, “এক-এক সময়ে মনে হয়, একেবারে কিছু না করা থেকে যা হয় কিছু করা ভালো। তাতে ভুল হলেও কিছু আসে যায় না।”
সুকুমার তেড়ে উঠলো। “তিন মাস পরে যাদের পেটে ভাত থাকবে না তাদের এসব কথা মানায় না। আমাদের দলে টেনে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কত ছেলেধরা যাদবপরে ঘোরাঘুরি করছে তাদের পকেটে কত রকমের পতাকা। কোনোটা একরঙা, কোনোটা তিনরঙা। তার ওপর আবার কত রকমের ছাপ! আমি ওসব ফাঁদে পা দিই না বলে, ছেলেধরাদের কী রাগ আমার ওপর। আমার সোজা উত্তর, আমার বাবার তিনমাস চাকরি আছে, আমার পাঁচটা নাবালক ভাইবোন। দেশোদ্ধার করবার মতো সময় নেই আমার।”
অফিস টাইমের যাত্রীদের দিকে সুকুমার আবার তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, “যে যা করছে করুক, আমার কী?”
কয়েক মিনিট ধরে সুকুমার নিজের মনে কী সব ভাবলো। তারপর সোমনাথের পিঠে আঙুলের খোঁচা দিয়ে আবার আরম্ভ করলো, “তুই যা বলছিলি—এই যে পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে লোক অফিসের খামে মোড়া টিফিন কৌটো হাতে হাজরি দিতে চলেছে, এরা সবাই তো ইংরেজ আমলে চাকরিতে ঢোকেনি। ওই ছোকরাকে দেখ না—ইংরেজ রাজত্বে তো ওর জন্মই হয়নি। অথচ অফিসে বেরুচ্ছে।”
সুকুমার এবার এক কেলেঙ্কারি করে বসলো। নিখুঁত ইস্ত্রি করা শার্ট ও প্যান্ট পরে এক ছোকরা বাসে উঠছিল, ঠিক সেই সময় ছুটে গিয়ে সুকুমার তাকে জিজ্ঞেস করলো, “দাদা, আপনি ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করেছিলেন?”
অতর্কিত প্রশ্নে ভদ্রলোক চমকে উঠেছিলেন। ব্যাপারটা ঠিকমতো মাথায় ঢোকবার আগেই বাস ছেড়ে দিলো। বিরক্ত ভদ্রলোক চলন্ত গাড়ি থেকে সুকুমারের দিকে অগ্নিদটি বর্ষণ করলেন—তার রসিকতার অর্থ বুঝতে পারলেন না।
সুকুমার বোকার মতো ফুটপাথে ফিরে এলো। বললো, “আমি ভাই রসিকতা করিনি। ওঁর পিছনেও লাগিনি–স্রেফ জানতে চাইতাম কী করে চাকরিটা যোগাড় করলেন।”
সোমনাথ বললো, “ওরকম করিস না সুকুমার। কোন দিন বিপদে পড়ে যাবি। ভদ্রলোক হয়তো পড়াশোনায় আমাদের মতো। তাহলে রেগে যেতে পারতেন।”
সুকুমার ক্ষমা চাইলো। তারপর কী ভেবে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, “সোম, তুই ঠিক বলেছিস। ওইভাবে জ্বালাতন করাটা আমার উচিত হয়নি। ভদ্রলোক যদি আমাদের মতো সেকেন্ড কিংবা থার্ড ডিভিসনের মাল হয়েও চাকরি পেয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয় সিডিউল্ড কাস্ট।”
“ভাতে কী এসে যায়?” বিরক্ত সোমনাথ প্রশ্ন করলো।
“খুবই এসে যায়। সিডিউল্ড কাস্টরাও এখন চাকরি পাচ্ছে না। ভদ্রলোক সিডিউল্ড-ট্রাইব হতে পারেন। চাকরির বিজ্ঞাপনে প্রায়ই লেখে তপসিলীভুক্ত উপজাতি হলে অগ্রাধিকার পাবে। ইন্ডিয়াতে সিডিউল্ড-ট্রাইব গ্রাজুয়েট বোধ হয় কেউ বসে নেই।”
দাঁত দিয়ে ডান হাতের কড়ে আঙুলের নখ কাটলো সুকুমার। তারপর সোমনাথকে বললো, “তোর বাবা তো অনেকদিন আদালতে ছিলেন। একবার খোঁজ করিস তো, কী করে সিডিউল্ড-ট্রাইব হওয়া যায়।”
“আবার পাগলামী করছিস? তুই হচ্ছিস সুকুমার মিত্তির! মিত্তির কখনো সিডিউল্ড-ট্রাইব হতে পারে না। সোমনাথ বন্ধনকে বোঝাবার চেষ্টা করে।
সুকুমার বুঝলো না। বললো, “আমাকে হেল্প করবি না বল। চেষ্টা করে বিশ্বামিত্র যদি ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে প্রমোটেড হতে পারে, তাহলে আমি কায়স্থ থেকে সিডিউল্ড-ট্রাইব হতে পারবো না কেন?’
“ওদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার কথা আমরা জানি না বলেই রসিকতা করতে পারছি। ওদের বড় কষ্ট রে,” সোমনাথ সরল মনে বললো।
সুকুমারও গম্ভীর হয়ে উঠলো। “তুই ভাবছিস আমি জাত তুলে ব্যঙ্গ করছি। চণ্ডালের পায়ের ধূলো জিভে চাটতে পর্যন্ত আমার আপত্তি নেই। কিন্তু জলাই মাসের মধ্যে আমাকে একটা চাকরি যোগাড় করতেই হবে।” বন্ধুর চোখ দুটো যে ছলছল করছে তা সোমনাথ বুঝতে পারলো।
একটু দঃখও হলো সোমনাথের। বন্ধুকে উৎসাহ দেবার জন্যে বললো, “জানিস সুকুমার, চাকরির কথা ভেবে ভেবে আমার মনটাও মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। আধবুড়ো হয়ে গেলাম, এখনও একটা কিছু যোগাড় হলো না। কতদিন তার বাবার হোটেলের অন্ন ধ্বংসাবো? বউদি অত যত্ন করে ভাত বেড়ে দেন, দাদাদের যে-সাইজের মাছ দেন, আমার জন্যে তার থেকেও বড়টা তুলে রাখেন। জিজ্ঞেস করেন, আর কিছু নেবো কিনা। তবু তেতো লাগে।”
এবার রেগে উঠলো সুকুমার। “রাখ রাখ বড় বড় কথা। পাকা রুই মাছের টুকরো পাতে পড়লে বেশ মিষ্টি লাগে। ওই তেতো লাগার ব্যাপারটা তোর মানসিক বিলাসিতা। আমার কিন্তু আজকাল খেতে বসলে সত্যি তেতো লাগে। কাল রাত্রে ডাল পুড়ে গিয়েছিল। একে তো নিরামিষ মেনু তার ওপর ডাল পোড়া হলে কেমন মেজাজ হয় বল তো? মায়ের শরীর ভালো নয়, তাই বোন রাঁধছে ক’দিন। তা বোনকে বকতে গেলাম, বাড়িতে বসে বসে কী করিস? রান্নাটাও দেখতে পারিস না? বোন অমনি ছ্যাড়-ছ্যাড় করে শুনিয়ে দিলো। বলে কিনা, ‘তোমারও তো কাজকম্ম নেই বাড়িতে বসে ভাল রাঁধলেই পারো।’”
“তুই কী উত্তর দিলি?” সোমনাথ জানতে চায়।
“কিছু ্বললাম না, মুখ বুজে দাঁত খিঁচুনি হজম করলাম। তবে, সুকুমার মিত্তির একদিন এর প্রতিশোধ নেবে।”
প্রতিশোধের ব্যাপারটা সোমনাথের ভালো লাগে না। সে নির্বিবাদী মানুষ। বললো, “দূর। আপনজনদের ওপর প্রতিশোধ নিতে নেই।”
সুকুমার তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, “টেবিল-চেয়ারে বসিয়ে বউদি তোকে মণ্ডা-মিঠাই খাওয়াচ্ছে, তাই তোর মাথায় প্রতিশোধের কথা ওঠে না। আমার পলিসি অন্য। যারা আমার সঙ্গে এখন যেরকম ব্যবহার করছে তা আমি নোট করে রাখছি। ভগবান যখন সময় দেবেন, তখন সুদসমেত ফিরিয়ে দেবো।”
“আঃ সুকুমার! হাজার হোক তোর নিজের বোন। তার ওপর আবার প্রতিশোধ কী? সোমনাথ আবার বন্ধুকে বোঝাবার চেষ্টা করলো।
হাসলো সুকুমার। “প্রতিশোধ মানে কি সমর্থ বোনকে ধরে মারবো, না রেগে গিয়ে দোজবরে বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দেবো? বোনের ব্যাপারে আমার প্রতিশোধের পলিসিই আলাদা। সব ঠিক করে রেখেছি এখন থেকে। চাকরিতে ঢুকে প্রথম মাসের মাইনে থেকে কণাকে একটা লাল রংয়ের ঝকঝকে শাড়ি কিনে দেবো। আর শাড়ির মধ্যেই একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা থাকবে—অমুক তারিখের রাত্রিতে যখন আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে বলেছিলি তখনই তোকে এই শাড়িটা দেবার ইচ্ছে হয়েছিল। ইতি–দাদা।”
সোমনাথ একমত হতে পারলো না। বললো, “এখন তোর রাগ রয়েছে, তাই এসব কথা ভাবছিস। যখন প্রথম মাইনে পাবি তখন দেখবি শুধু শাড়িটা দেবার ইচ্ছে হচ্ছে, চিঠির কথা মনেই পড়বে না। হাজার হোক ছোট বোন তো, তার মনে ব্যথা দিতে তোর মায়া হবে।”
সুকুমার কথা বাড়ালো না। বললো, “হয়তো তাই। কিন্তু মাইনে পাবার মতো অবস্থাটা কবে হবে বল তো?’
একটু থেমে সুকুমার বললো, “মাঝে মাঝে তো এম-এল-এ-দের কাছে যাই। রাগের মাথায় ওঁদের যা-তা বলি। আপনাদের জন্যেই তো আমাদের এই অবস্থা। চাকরি দেবার মুরোদ না থাকলে কেন ইংরেজ তাড়িয়েছিলেন, কেন নিজেরা গদি দখল করেছিলেন?”
“ওঁরা কী বলেন?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো।
“মাইরি একটা আশ্চর্য গুণ, কিছুতেই রাগে না এই এম-এল-এ-গুলো। আমাকে ওইভাবে কেউ ফায়ার করলে, স্রেফ ঘাড় ধরে তাকে বাড়ির বাইরে বার করে দিতাম, বলতাম, পরের বারে ব্যাটাচ্ছেলে যাকে খুশী ভোট দিও।”
“যারা পাবলিককে সামলাতে পারে না তারা ভোটে হেরে যাবে” সোমনাথ বললো।
“ঠিক বলেছিস, অশেষ ধৈর্য লোকগুলোর, সুকুমার বিস্ময় প্রকাশ করলো। “অমন চ্যাটাং-চ্যাটাং করে শোনালাম, একটু রাগুলো না। বরং স্বীকার করে নিলো, প্রত্যেকটি ইয়ংম্যানকে চাকরি দেবার দায়িত্ব গভরমেন্টের। যে-সরকার তা পারে না, তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।”
“লজ্জা কিছু দেখলি?” সোমনাথ জানতে চায়।
“অত লক্ষ্য করিনি ভাই। তবে এম-এল-এ-দা ভিতরের খবরের অনেক ছাড়লেন। মাসকয়েকের মধ্যে অনেক চাকরি আসছে। সেলস ট্যাক্স, স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড, হাউসিং ডিপার্টমেন্টের হাজার হাজার চাকরি তৈরি হলো বলে। এতো চাকরি যে সে অনুপাতে গভরমেন্টের চেয়ার নেই। তা আমি বলে দিয়েছি সেজন্য চিন্তার কিছু নেই। চাকরি পেলে আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা চেয়ার চেয়ে নিয়ে যাবো। গভরমেন্টের অসুবিধা করবো না।”
“উনি কী বললেন?” সোমনাথ জানতে চাইলো।
“খুব ইমপ্রেস্ড হলেন। বললেন, সবার কাছ থেকে এ-রকম সহযোগিতা পেলে ওঁরা দেশে সোনা ফলিয়ে দেবেন। ভরসা পেয়ে তোর কথাটাও ওঁর কানে তুলে দিয়েছি। বলেছি, হাজার হাজার লাখ লাখ চাকরি যখন আপনার হাতে আসছে, তখন আমার বন্ধু, সোমনাথ ব্যানার্জির নামটাও মনে রাখবেন। খুব ভালো ছেলে, আমারই মতো চাকরি না পেয়ে বেচারা বড় মনমরা হয়ে আছে। চেয়ারের জন্যে কোনো অসুবিধা হবে না। ওদের বাড়িতে অনেক খালি চেয়ার আছে।”
সোমনাথ হাসলো।
সুকুমার একটু বিরক্ত হয়ে বললো, “এইজন্যে কারুর উপকার করতে নেই। দাঁত বার করে হাসছিস কি? এম-এল-এ-দা বলেছেন, শীগগির একদিন রাইটার্স বিল্ডিংস-এ নিয়ে যাবেন। খোদ মিনিস্টারের সি-এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। সি-এ জানিস তো? মিনিস্টারের গোপন সহকারী কনফিডেনশিয়াল অ্যাসিসট্যান্ট। আজকাল এরা ভীষণ পাওয়ারফুল—আই-সি-এস খোদ সেক্রেটারীরা পর্যন্ত সি-এদের কাছে কেঁচো হয়ে থাকে।”
“তাতে তোর-আমার কী? বড় বড় গরমেন্ট অফিসাররা চিরকালই কারুর কাছে গোখরো সাপ, কারুর কাছে পাঁকাল মাছ।” সোমনাথ আই-এ-এস এবং আই-সি-এস সম্বন্ধে তার বিরক্তি প্রকাশ করলো।
সুকুমার কিন্তু নিরুৎসাহ হলো না। বন্ধুর হাত চেপে বললো, “আসল কথাটা শোন না। সি-এদের পকেটে ছোট একটা নোটবক থাকে। ওই নোটবকে যদি একবার নিজের নাম-ঠিকানা তোলাতে পেরেছিস স্রেফ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সরকারী চাকরি পেয়ে যাবি।”
“তুই চেষ্টা করে দেখ! তদ্বিরের জন্য জুতোর হাফসোল খুইয়ে ফেলে আমার চোখ খুলে গিয়েছে, সোমনাথ বিরক্তির সঙ্গে বললো।
সুকুমার বললো, “আশা ছাড়িস না। ট্রাই ট্রাই অ্যান্ড ট্রাই। একবারে না পারিলে দেখো শতবার।”
“শতবার! শালা সহস্রবারের ওপর হয়ে গেলো, কিছু, ফল হলো না। মাঝখান থেকে রয়াল টাইপ রাইটিং কোম্পানির নবীনবাব বড়লোক হয়ে গেলেন। আমার কাছ থেকে কত বার যে পঞ্চাশ পয়সা করে চিঠি ছাপাবার জন্যে বাগিয়ে নিলেন। আমি মতলব করেছিলুম, কার্বন কাগজ চড়িয়ে অনেকগুলো কপি করে রেখে দেবো, বিভিন্ন নামে ছাড়বো। কিন্তু বাবা এবং বউদি রাজী হলেন না। বললেন, অ্যাপ্লিকেশনটাই নাকি সবচেয়ে ইমপর্টান্ট। ওর থেকেই ক্যান্ডিডেট সম্পর্কে মালিকরা একটা আন্দাজ করে নেয়। কার্বন কপি দেখলে ভাববে লোকটা পাইকিরী হারে অ্যাপ্লিকেশন ছেড়ে যাছে।”
“এটা মাইরি অন্যায়,” সুকুমার এবার বন্ধুর পক্ষ নিলো। “তোমরা একখানা চাকরির জন্যে হাজার হাজার দরখাস্ত নেবে, আর আমরা দশ জায়গায় একই দরখাস্ত ছাড়তে পারবো না?”
সোমনাথ বললো, “আসলে বউদির খেয়াল। টাইপ করার পয়সাও হাতে গুঁজে দিচ্ছেন, বলার কিছু নেই। তবে এখন বুঝতে পারছি সরকার-বেসরকার কেউ আমাদের চাকরি দিয়ে উদ্ধার করবে না?”
“ভগবান জানেন,” সুকুমার রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বললো। অফিসযাত্রীর ভিড় ইতিমধ্যেই অনেকটা পাতলা হয়ে এসেছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোমনাথ একবার বললো, “আমার বউদি কিন্তু মোটেই আশা হাড়েনি। আমার কোঠিতে নাকি আছে যথাসময়ে অনেক টাকা রোজগার করবো।”
“আমার ভাই কোঠি নেই। থাকলে একবার ধনস্থানটা বিচার করিয়ে নেওয়া যেতো।” সুকুমার বললো।
সোমনাথ আবার বউদির কথা তুললো। “সেদিন চুপচাপ বসেছিলাম। বউদি বললেন, ‘মন খারাপ করে কী হবে? ছেলেদের চাকরিটা অনেকটা মেয়েদের বিয়ের মতো। বাবা আমার বিয়ের জন্যে কত ছটফট করেছেন। কত বাড়িতে ঘোরাঘুরি করেছেন। কিছুতেই কিছু হয় না। তারপর যখন ফল ফুটলো, এ-বাড়িতে এক সপ্তাহের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলো।” বউদি বলেছিলেন, “আমার চাকরির ফল হয়তো একদিন হঠাৎ ফুটে উঠবে, লোকে হয়তো ডেকে চাকরি দেবে।”
“তোর বউদির মুখে ফল-চন্দন পড়ুক। জন মাসের মধ্যে যদি আমার ফুল ফোটে তাহলে বড় ভালো হয়, হাতে পুরো একটা মাস থাকে।” সুকুমার নিজের মনেই বললো।
“ফুল তো তোর আমার চাকর নয়। নিজের যখন ইচ্ছে হবে তখন ফুটবে!” সোমনাথ উত্তর দিলো।
সুকুমার এবার মনের কথা বললো। “বড্ড ভয় করে মাইরি। আমাদের কলোনিতে আইবুড়ী দেঁতো পিসী আছে। বিয়ের সম্বন্ধ করতে করতেই পিসী বুড়ী হয়ে গেলো–বর আর জুটলো না। আমাদের যদি ওরকম হয়? চুল-দাড়ি সব পেকে গেলো অথচ চাকরি হলো না!”
এরকম একটা ভয়াবহ সম্ভাবনা যে নেই, তা মোটেই জোর করে বলা যায় না। এই ধরনের কথা শুনতে সোমনাথের তাই মোটেই ভালো লাগে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোমনাথ বললো, “এবার বাড়ি ফেরা যাক। বউদি বেচারা হয়তো জলখাবার নিয়ে বসে আছেন।”
“যা তুই জলখাবার খেতে। আমি এখন বাড়ি ফিরবো না। একবার আপিসপাড়াটা ঘুরে আসবো।”
“আপিসপাড়ায় ঘরে কী তোর লাভ হয়? কে তোকে ডেকে চাকরি দেবে?” সোমনাথ বন্ধুর সমালোচনা করলো।
কিন্তু সুকুমার দমলে না। “সব গোপন ব্যাপার তোকে বলবো কেন? ভাবছিস ফর নাথিং এই সেকেন্ড ক্লাস ট্রামের ভিড় ঠেঙিয়ে আমি আপিসপাড়ায় ভেরেণ্ডা ভাজতে যাচ্ছি? সুকুমার মিত্তিরকে অত বোকা ভাবিস না।”
সোমনাথের এবার কৌতূহল হলো। বন্ধুকে অনুরোধ করলো, “গোপন ব্যাপারটা একটু খুলে বল না ভাই।”
“এবার পথে এসো দাদা! বেকারের কি দেমাক মানায়? বাড়িতে বসে শুধু খবরের কাগজ পড়লেই চাকরির গোপন খবর পাওয়া যায় না, চাঁদ।”
“তাহলে?” সোমনাথ জিজ্ঞেস করে।
সুকুমার বেশ গর্বের সঙ্গে বন্ধুকে খবর দিলো, “অনেক কোম্পানি আজকাল বেকার পঙ্গপালের ভয়ে কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন দেয় না। একটা কোম্পানি তো কেরানির পোস্টের জন্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে যা ফ্যাসাদে পড়েছে না! খবরের কাগজে বক্স নম্বর ছিল। সেখান থেকে তিন লরি অ্যাপ্লিকেশন কোম্পানির হেড আপিসে পাঠিয়েছে। এখনও চিঠি আসছে। তার ওপর আবার কীভাবে খবরের কাগজের আপিস থেকে বক্স নম্বর ফাঁস হয়েছে। কারা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তা কিছু লোক জানতে পেরেছে। প্রতিদিন তিন-চারশ লোক আপিসে ভিড় করছে। কোম্পানির, পার্সোনেল অফিসার তো ঘাবড়ে গিয়ে কলকাতা থেকে কেটেছেন।”
“তাহলে উপায়?” মোমনাথ চিন্তিত হয়ে পড়ে।
“তাদের উপায় তারা বুঝবে, আমাদের কী? তা যা বলছিলাম, এই পঙ্গপালের ভয়ে অনেক কোম্পানি এখন বিজ্ঞাপন না দিয়ে নোটিশ বোর্ডে চাকরির খবর কলিয়ে দিচ্ছে। আমাদের শম্ভু দাস, ছোকরা এইরকমভাবে হাইড রোডের একটা কারখানায় টাইপিস্টের চাকরি বাগিয়েছে। ছোকরার অবশ্য টাইপে পীড ছিল। বেটাকে একদিন দেখেছিলাম মেশিনের ওপর। পাঞ্জাব মেলের মতো আঙুল চলছে। ওর কাছ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আমিও এখন আপিসে-আপিসে ঘুরে বেড়াই। মুখে কিছু বলি না—চাকরির খোঁজে এসেছি জানতে পারলে অনেক আপিসে আজকাল ঢুকতে দেয় না। তাই কোনো কাজের অছিলায় ডাঁটের মাথায় আপিসে ঢুকে পড়তে হয়, তারপর একটু ব্রেন খাটিয়ে স্টাফদের নোটিশ বোর্ডে নজর বুলিয়ে আসি।”
একটু থামলো সুকুমার। তারপর বললো, “ভাবছিস পণ্ডশ্রম হচ্ছে? মোটেই না। চারে মাছ আছে, বুঝলি সোমনাথ? এর মধ্যে তিন-চারখানা অ্যাপ্লিকেশন ছেড়ে এসেছি। কাল যে আপিসে গিয়েছিলাম, সেখানে চাকরি হলে কেলেংকারিয়াস কাণ্ড। প্রত্যেক দিন মাইনে ছাড়াও পচাত্তর পয়সা টিফিন—তাও বাবুদের পছন্দ হচ্ছে না। প্রতিদিন আড়াই টাকা টিফিনের দাবিতে কর্মচারি ইউনিয়ন কোম্পানিকে উকিলের চিঠি দিয়েছে।”
গোলপার্ক থেকে এক বাড়ি ফিরে আসার পথে সুকুমারের কথা ভাবছিল সোমনাথ। ওর উদ্যমকে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে নি সোমনাথ। হয়তো এই পরিশ্রমের ফল সুকুমার একদিন আচমকা পেয়ে যাবে। চাকরির নিয়োগপত্রটা দেখিয়ে, সুকুমার চলে যাবে, কেবল সোমনাথ তখনও বেকার বসে থাকবে। এসব বুঝেও সোমনাথ কিন্তু সুকুমারের মতো হতে পারবে না।
বাবা সরকারী কাজ করতেন, একসময় অনেককে চিনতেন। কিন্তু সোমনাথ কিছুতেই তাঁদের বাড়ি বা অফিসে গিয়ে ধর্না দেবার কথা ভাবতে পারে না। বাবারও আত্মসম্মানজ্ঞান প্রবল—কিছুতেই বন্ধু-বান্ধবদের ধরেন না। দ্বৈপায়নবাবর যে একটা পাস কোর্সে বি-এ পাসকরা বেকার অর্ডিনারি ছেলে আছে সে খবর অনেকেই রাখে না। তাঁরা শুধু দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির দুই হীরের টুকরো ছেলের কথা শুনেছেন—যাদের একজন আই-আই-টি ইনজিনীয়ার এবং আরেকজন বিলাতী কোম্পানির জনিয়ার অ্যাকাউনটেন্ট।
হঠাৎ সোমনাথের রাগ হতে আরম্ভ করছে। সুকুমার বেচারা অত দুঃখী, কিন্তু কারুর ওপর রাগে না। সোমনাথের এই মুহূর্তে রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে। এই যে বিশাল সমাজ তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধই তো সোমনাথ বা তার বন্ধ, সুকুমার করেনি। তারা সাধ্যমতো লেখাপড়া শিখেছে, সমাজের আইন-কানুন মেনে চলেছে। তাদের যা করতে বলা হয়েছে তারা তাই করেছে। তাদের দেহে রোগ নেই, তারা পরিশ্রম করতে রাজী আছে—তবু এই পোড়া দেশে তাদের জন্যে কোনো সুযোগ নেই। এমন নয় যে তারা বড় চাকরি চাইছে—যে-কোনো কাজ তো তারা করতে প্রস্তুত। তবু কেউ ওদের দিকে মুখ তুলে তাকালো—মাঝখান থেকে জীবনের অমূল্য দুটো বছর নষ্ট হয়ে গেলো।
একবার যদি সোমনাথ বুঝতে পারতো এর জন্যে কে দায়ী, তাহলে সত্যিই সে বেপরোয়া একটা কিছু করে বসতো। সুকুমার বেচারা হয়তো তার সঙ্গে যোগ দিতে সাহস করবে না—ওর দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু সোমনাথের পিছ, টান নেই। ওর পক্ষে বেপরোয়া হয়ে বোমার মতো ফেটে পড়া অসম্ভব নয়।
বাড়ি ফিরতেই কমলা বউদি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কারুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি? মুখ অমন লাল হয়ে রয়েছে।”
সোমনাথ সামলে নিলো নিজেকে। বললো, “বোধহয় একটু রোদ লেগেছে।”
বুলবুল অনেক আগেই চেতলায় বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে। ওখানে ভাত খাবে সে। বাবা পুরানো অভ্যাস অনুযায়ী সাড়ে দশটার সময় ভাত খেয়ে নিয়েছেন। শুধু বউদি সোমনাথের জন্যে অপেক্ষা করছেন।
তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিলো সোমনাথ। তারপর দুজনে একসঙ্গে খেতে বসলো। মায়ের মৃত্যুর পর এই এতো বছর ধরে সোমনাথ কতবার কমলা বউদির সঙ্গে খেতে বসেছে। রান্না পছন্দ না হলে বউদিকে বকুনি লাগিয়েছে। বলেছে, “বাবা কিছু বলেন না, তাই বাড়ির রান্না ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
কমলা বউদিও দেওরের সঙ্গে তর্ক করেছেন। বলেছেন, “তেল-ঝাল না থাকলে তোমাদের রান্না ভালো লাগে না। কিন্তু বাবা ওসব সহ্য করতে পারেন না। ডাক্তারবাবু বলে গেছেন, লঙ্কা আর অতিরিক্ত মসলা কারুর শরীরের পক্ষে ভালো নয়।”
কিন্তু এই দু-বছরেই অবস্থাটা ক্রমশ পালটে গেলো। সোমনাথ এখন খেতে বসে কেমন যেন লজ্জা পায়! রান্নার সমালোচনা তো দূরের কথা, বিশেষ কোনো কথাই বলে না। আর কমলা বউদি দঃখ করেন, “তোমার খাওয়া কমে যাচ্ছে কেন, খোকন? হজমের কোনো গোলমাল থাকলে ডাক্তার দেখিয়ে এসো। একটু-আধট, ওষধ খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সোমনাথ প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। ওর কেমন ভয় হয় কমলা বউদির কাছে কিছুই গোপন থাকে না। বউদি ওর মনের সব কথা বোধহয় বুঝতে পারেন।
অপরাহ্নের পরিস্থিতি আরও যন্ত্রণাদায়ক। জন্ম-জন্মান্তর ধরে কত পাপ করলে তবে এই সময় বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকবার শান্তি পায় পুরষ মানুষেরা।
কমলা বউদি সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর এই সময় একটু নিজের ঘরে বিছানায় গড়িয়ে নেন। বিনাশ্রম কারাদণ্ডের এই সময়টা সোমনাথ কীভাবে কাটাবে বুঝতে পারে না। এই সময় ঘুমোলে সারারাত বিছানায় ছটফট করতে হয়। চুপচাপ জেগে থাকলে, মনে নানা কিম্ভূতকিমাকার চিন্তা ভিড় করে। মাঝে-মাঝে বই পড়বার চেষ্টা করেছে সোমনাথ-এখন বই ভালো লাগে না। আগে ট্রানজিস্টর রেডিওতে গান শুনতো—এখন তাও অসহ্য মনে হয়।
অথচ কত লোক এই সময়ে অফিসে, আদালতে, কারখানায়, রেল স্টেশনে, পোস্টাপিসে, বাজারে কাজ করতে করতে গলদঘর্ম হচ্ছে। মা বলেছিলেন, কাউকে হিংসে করবে নাকিন্তু এই মুহূর্তে কাজের লোকেদের হিংসে না করে পারছে না সোমনাথ।