০৩. চা খাচ্ছি

আমি এবং মেজোভাই একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছি। নীতু এসে ডাকল, ভাইয়া। আমরা দুজন একসঙ্গে বললাম, কী?

নীতু আমাদের দুজনকেই ভাইয়া ডাকে। আমরা দুজন এক সঙ্গে থাকলে খুব মুশকিল হয়। ভাইয়া ডাকলে একসঙ্গে বলি, কী। নীতু হেসে গড়িয়ে পড়ে। আজ হাসল না। মুখ কালো করে বলল— বাবা যেন কী রকম করছেন। আমরা ছুটে গেলাম। বাবা দিব্যি ভালো মানুষের মতো দোতলার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। চশমার কাচ পঙ্কিার করছেন। আমাদের হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে বললেন, কী ব্যাপার?

আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

মেজোভাই বললেন, আপনার শরীর কেমন?

আমরা সবাই বাবাকে তুমি করে বলি। মেজোভাইও বলেন। তবে তিনি কেন জানি মাঝে মাঝে আপনি বলেন।

বাবা বললেন, আমি তো ভালোই আছি। দাঁতের ব্যথা এখন আর নেই।

মেজোভাই বললেন, এখানে বসে কী করছেন?

বসে থেকে কী আর করা যায়! চশমার কাচ পরিষ্কার করছি। কেন বল তো?

না, এমনি জিজ্ঞেস করছি।

ইস্তিয়াক, তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?

মোজোভাই বললেন, ভালো হচ্ছে।

পরীক্ষা কবে?

এখনো দেরি আছে।

কত দেরি?

ধর মাসখানিক ৷

মাসখানিক আর দেরি কোথায়? ত্ৰিশদিন। মাত্ৰ সাত শী বিশ ঘণ্টা। আর সময় নষ্ট করবি না। এখন খানিকটা কষ্ট করলে বাকি জীবন তার ফল ভোগ করবি।

নিতান্তই সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তা। বাবারা যেসব কথা ছেলেদের বলেন–সেসব কথা। আমরা দুজন নিচে নেমে নীতুকে খুঁজে বের করলাম। মেজোভাই বিরক্তমুখে বললেন, সব সময় ফাজলামি করিস কেন?

নীতু মুখ কালো করে বলল, ফাজলামি করব কেন? আমি ঘর পরিষ্কার করছি, বাবা আমাকে ডেকে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে। মইনুদিন বসার ঘরে বসে আছে। আমি কোন লজ্জায় তার সামনে পড়ব বল? তুই তোর মাকে নিয়ে যা। বল যে আমরা এই বাড়ি ছেড়ে দেব। টাকা-পয়সা যা নিয়েছি। সব তো আর একসঙ্গে দিতে পারব না, বাই ইন্সটলমেন্ট দিয়ে দেব। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি আমি বাসায় নেই। বলবি আমি দেশের বাড়ি গিয়েছি। যা, তাড়াতাড়ি যা। তোর মাকে সঙ্গে করি নিয়ে যা।

মেজোভাই বলেন, তুই এসব বসে বসে বানিয়েছিস। বাবা কখনো এরকম কিছু বলে নি।

নীতু রেগে গিয়ে বলল, আমি শুধু আজেবাজে কথা বানাতে যাব কেন? বাবাকে পাগল বানিয়ে আমার লাভ কী?

লাভ-ক্ষতি জানি না। তুই কথা একটু বেশি বলিস। কথা। দয়া করে কম বলবি।

কথা তুমিও বেশি বল। তুমিও দয়া করে কথা কম বলবে।

আমি কথা বেশি বলি?

হ্যাঁ, বেশি বল। বড়। আপাকে কী নাকি বলেছি–বড়। আপা আজ চলে যাচ্ছে। বাচ্চাদের নিয়ে একা এক ফ্ল্যাটে থাকবে।

আমি তো কিছুই বলি নি।

অবশ্যই বলেছ।

কী বলেছি?

বলেছ, বসতবাড়ি মুসলিম আইনে মেয়েরা পায় না। পায় ছেলেরা। কাজেই এই বাড়ি তোমরা তিন ভাই পাবে। একটা লিমিটেড কোম্পানি হবে। সেই কোম্পানি সদস্য হবে শুধু ছেলেরা। একজনের কাছে থাকবে পাওয়ার অব এটর্নি, সেই কোম্পানি দেখাশোনা করবে। বল নি এসব কথা?

হ্যাঁ, বলেছি। তাতে অন্যায়টা কী হয়েছে? আইনে যা আছে তাই বলেছি।

এই আইন তোমকে কে শিখিয়েছে? কোথেকে শিখলে এই আইন?

তুই চেঁচাচ্ছিস কেন? তুমি যা শুরু করেছ না চেঁচিয়ে করব কী? একজন ভিক্ষা দিয়েছে সেই ভিক্ষা নিয়ে লাফালাফি শুরু করেছি। ভিক্ষা নিতে লজ্জা লাগে না?

চুপ করতো!

না, চুপ করব না। তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করছি। তোমার বাড়াবাড়ি ঘুচিয়ে দেব।

আমার বাড়াবাড়ি ঘুচিয়ে দিবি?

হ্যাঁ, দেব। এই বাড়ি আমি ফেরত দেয়াব। ঐ মেয়েকে দেয়াব। আর যদি ঐ মেয়ে নিতে না চায়–তাহলে কোনো একটা এতিমখানাকে কিংবা এইরকম কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার ব্যবস্থা করব। বাবাকে বললেই বাবা করবেন।

বাবা করে ফেলবেন?

হ্যাঁ করবেন।

বাবার উপর তোর এত কনট্রোল আছে তা তো জানতাম না।

যখন খাঁচা থেকে পাখি উড়ে যাবে তখন জানবে। তার আগে জানবে না। আর তুমি কি ভেবেছ বাবাকে আমি বলি নি? বলেছি। বাবা কী বলেছেন জানতে চাও?

মোজোভাই চুপ করে রইলেন।

নীতু সাপের মতো ফোস-ফোঁস করতে করতে বলল, বাবা আমাকে বলেছেন, তিনি তাই করবেন।

মোজোভাই নীতুর কথা ঠিক বিশ্বাস করলেন না, আবার পুরোপুরি উড়িয়ে দিতেও পারলেন না। নীতু লোকজনকে ধাঁধায় ফেলার জন্যে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলে এটা যেমন সত্যি, আবার কঠিন সত্য কথা অবলীলায় বলে এটাও সত্যি।

নীতু বলল, ভাইয়া, তোমার লোভ খুব বেশি। এত লোভ ভালো না। লোভ কমাও। নয়তো কষ্ট পাবে। এই বাড়িতে যখন এতিমখানা হবে কিংবা ফিরিয়ে দেয়া হবে তানিয়াকে, তখন বুনোভাইয়ের কিছুই হবে না। সে এখন যেমন আছে তখনো তেমনি থাকবে। কারণ তাঁর এই বাড়ির উপর কোনো লোভ নেই। মনের কষ্টে মারা যাবে তুমি। কারণ লোভে তোমার সর্বাঙ্গ জড় জড়।

নীতু মেজোভাইকে স্তম্ভিত করে দোতলায় উঠে গেল। মেজোভাইকে দেখাচ্ছে বাজ-পড়া তালগাছের মতো। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে বললেন, নীতু কি পাগল হয়ে গেল নাকি? এসব কী বলছে? আমার তো মনে হয় ওর ব্ৰেইন পুরোপুরি ডাউন। ও পাগল হয়ে গেছে।

বুঝতে পারছি না। হয়তো হয়েছে।

বড় আপার কাণ্ডটা দেখ তো। ঠাট্টা করে কী না কী বলেছি, ওমনি। আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে রওনা হয়ে পড়েছে। এমন তো না যে তার টাকা পয়সা নেই।–-প্রচুর টাকা। চৌদ্দ লাখ টাকায় দুলাভাই ফ্ল্যাট কিনলেন। এছাড়াও দুলাভাইয়ের পৈত্রিক বাড়িও আছে। তাঁকে বাদ দিয়ে লিমিটেড কোম্পানি খুলতে তাঁর এত আপত্তি কেন?

ভাইয়া, ঐ প্রসঙ্গ থাক।

মোজোভাই ইতস্তত করে বললেন, তুই যা তো— দেখ আপাকে বুঝিয়ে–সুঝিয়ে শান্ত করা যায়। কিনা। আর নীতুকে ঠাণ্ডা করতে হবে। আমাদের বোনগুলোর এমন মাথা গরম হল কেন বল তো? আমার ধারণা মাথা গরম ভাবটা এরা মার কাছ থেকে পেয়েছে।

হতে পারে।

ভাগ্যিস মা ঘরে নেই। মা থাকলে হইচই বাঁধিয়ে বিশ্ৰী কাণ্ড করত।

তা ঠিক।

মা কোথায় জানিস?

কই। জিতু মিয়াকে নিয়ে যখন গেছে তখন মনে হয় কাঁচা বাজারে।

মা আসার আগেই ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলা যায় কিনা একটু দেখ তো।

দেখছি।

বড় আপনাকে সামলোনো খুব কঠিন হবে না। এর আগেও তিনি রাগ করে বাড়ি ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে। সুটকেসে কাপড় ভরেছেন, তারপর আবার রাগ পড়ে গেছে। বেশির ভাগ সময়ই আপনাআপনি তার রাগ পড়ে যায়। আজ তা হবে কিনা কে জানে। নির্ভর করছে মেজোভাই তাকে কতটা রাগিয়েছে তার উপর। আমি বড় আপার ঘরের দিকে রওনা হলাম।

আপা আসব?

বড় আপার চোখ ভেজা। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, না।

আমি ঘরে ঢুকলাম।

বড় আপা সুটকেসে কাপড় গুছাচ্ছেন।

রিমি এবং পলি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। তাদের চোখও ভেজা। সম্ভবত মার খেয়েছে। চুপচাপ থাকলে মেয়ে দুটিকে পুতুলের মতো লাগে। আদর করতে ইচ্ছা হয়। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সঙ্গে সঙ্গে ওরা জিভ বের করে আমাকে ভেংচি দিল। কেউ কাউকে শিখিয়ে দিল না। দুজনেই করল এক সঙ্গে। আশ্চর্য কো-অর্ডিনেশন।

বড় আপা বলল, কী বলবি বলে চলে যা। বিরক্ত করিস না।

আমি খাটের উপর বসলাম। বড় আপনাকে খুশি করার বেশ কয়েকটি পদ্ধতি আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে মুখ কাচুমাচু করে তার কাছে টাকা ধার চাওয়া। কেউ টাকা ধার চাইলে তিনি অত্যন্ত খুশি হন। মুখে অবশ্যি চূড়ান্ত অখুশির ভাব নিয়ে আসেন। একগাদা কথা বলেন–তোরা আমাকে কী ভাবিস? আমি টাকার গাছ? আমাকে বাকি দিলেই হুড়হুড় করে টাকা পড়বে? ও আমাকে কোনো হাতখরচ দেয়? একটা পয়সা দেয় না। বাজার খরচ বাঁচিয়ে দুএকটা জমাই। তাও তোরা ধারের কথা বলে নিয়ে যাস। টাকার দরকার হলেই বড় আপার কথা মনে হয়। অন্য সময় তো মনে হয় না।

একগাদা কথা বলেন ঠিকই, বলতে বলতেই তার মন ভালো হয়ে যাবে। খুশি খুশি মুখে টাকা বের করবেন।

আমি এই পদ্ধতি কাজে লাগাব বলে ঠিক করলাম। ইতস্তত করে বললাম, বড় আপা, একটা কথা বলতে চাচ্ছি সাহসে কুলোচ্ছে না। তুমি রাগই কর কিনা। আজকাল তুমি আবার অল্পতেই রেগে যাও।

আমার আবার রাগ। আমার রাগে কার কী যায় আসে? আমি একটা মানুষ নাকি? কী ব্যাপার?

এলিফ্যান্ট রোডে একটা শার্ট দেখে এসেছি। আমার খুব পছন্দ হয়েছে আপা। মেরুন কালার।

পছন্দ হলে কিনে ফেলি।

তুমি টাকা না দিলে কিনব কোথেকে? আমার কাছে কি টাকা-পয়সা আছে?

তোরা আমাকে ভাবিস কী? টাকার বস্তা?

হ্যাঁ।

বড় আপা খুশি হয়ে গেলেন। তাঁর মুখ উজ্জ্বল। অনেক চেষ্টা করে তিনি মুখে বেজার ভাব নিয়ে এলেন।

তোদের এই ধার চাওয়ার অভ্যাসটা গেল না। আমার কাছে কিছু হবেটবে না। যা, বিরক্ত করিস না।

আপা, দিতেই হবে।

ধার, ধার আর ধার। কোনোদিন একটা পয়সা ফেরত দিয়েছিস?

এবারেরটা দেব। অনেষ্ট। আপা অন্য গড। অবশ্যই ফেরত দেব।

আর দিবি! তোদের আমি চিনি না? হাড়ে হাড়ে চিনি। কত দাম শার্টের?

তিনশ।

মিথ্যা কথা বলছিস। ঠিক করে বল কত?

আড়াই শ!

আশ্চর্য তোদের স্বভাব। এর মধ্যেও ট্রিকস করে পঞ্চশ টাকা হাতিয়ে নেবার মতলব?

তিনশ চাচ্ছে আড়াই শতে দেবে।

বড় আপা সুটকেস খুলে তিনটা একশ টাকার নোট বের করে গম্ভীর গলায় বললেন, এক্ষুণি পঞ্চাশ ফেরত দিয়ে যাবি। আমি কিন্তু বসে থাকব।

সুটকেস গুছাচ্ছিলে, ব্যাপার কী?

ভাবছিলাম ফ্ল্যাটে চলে যাব।

কেন?

ইস্তিয়াকের গায়ে চর্বি বেশি হয়েছে। আমাকে আইন দেখায়। মুসলিম আইনে বসতবাড়ি ভাগ হয় না। কে চায় তোর বসতবাড়ি? আমাকে এসব বলার অর্থ কী? আমি কি গাছ। তলায় আছি? চৌদ্দ লাখ টাকা নগদ গুনে ফ্ল্যাট কিনেছি। ব্যাংক থেকে একটা পয়সা নেই নি।

তা তো ঠিকই।

আমাকে অপমান করে আইন দেখায়। ভালো করে বল যে, আপা, এই বাড়িটা আমাদের তিন ভাইয়ের থাকুক। তোমার তো বাড়ি আছেই। তা না, ফারাজী আইন। আইনজ্ঞ এসেছেন।

ঠাশ করে গালে একটা চড় লাগালে না কেন?

বড় আপা আরো খুশি হয়ে গেলেন। আমি বললাম, সত্যি সত্যি যদি লিমিটেড কোম্পানি হয় সবাইকে নিয়েই হবে, পাওয়ার অব এটর্নি থাকবে তোমার কাছে। কারণ তুমি সবার বড়।

এই সাধারণ কথা গাধাটার মাথায় ঢুকলে তো কাজই হত।

বড় আপা মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, তোরা এখানে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

আমরা যাচ্ছি না মা?

না?

মেয়ে দুটি এক সঙ্গে এমন প্ৰচণ্ড চিৎকার দিল যে ঘরের জানালা পর্যন্ত কেঁপে গেল। এরকম দুটি মেয়েকে বড় করতে আপার জীবন পানি হয়ে যাচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাই আপা।

যা। টাকাটা দিয়ে যাস কিন্তু।

দুই-একদিন পরে দেই আপা?

বড় আপার খুশিখুশি ভাব আরো প্রবল হল। যদিও বিরক্ত গলায় বললেন, একবার তোর হাতে টলকা চলে গেছে, এই টাকা কি ফেরত আসবে? অভ্যাসটা বদলা। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে যার-তার কাছে টাকা চাইবি। টাকা ধার চাওয়া আর ভিক্ষা চাওয়া একই।

তোমার কাছে ভিক্ষা চাওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই।

বড় আপার মনের সব গ্রানি ধুয়ে-মুছে গেল। তিনি সুটকেস থেকে কাপড় নামিয়ে রাখছেন। আমি বললাম, তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। এটা আবার কাউকে বলবে না।

আচ্ছা যা, বলব না।

আমার শেষ কথাটাও তাকে খুশি করার জন্যে বলা। আপাকে কিছু গোপন করতে বললেও তিনি খুব খুশি হন। এবং কথাটা জনে জনে বলে বেড়ান। আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের পরিবারের সব সদস্যই জানবে যে, তিনি আমাকে শার্ট কেনার জন্যে তিনশ টাকা দিয়েছেন। আসল দাম আড়াই শ। ফাঁকি দিয়ে পঞ্চাশ বেশি নিয়েছি। পুরো ঘটনা বলার পর বলবেন, থাক, ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। বেচারা লজ্জা পাবে। আমাকে বলেছে কাউকে না জানাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *